প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-২০+৩০

0
366

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৯

নাদিয়ার আত্মসম্মানে আ ঘা ত লাগলো প্রচুর। রাগও লাগছে। ওকে কখনো কেউ এভাবে বকেনি। বাবাকে সে শ্রদ্ধা করে। একমাত্র বাবাই তাকে মাঝেমাঝে এভাবে বকে। তাও শুধু রেজাল্ট খারাপ হলে বকে। কোথাকার কোন লোক! ভালোই তো বেসেছে নাদিয়া। কোনো অপরাধ তো করেনি। ওঁর সাহস হয় কি করে নাদিয়াকে ধমকানোর! এর প্রতিশোধ তো নাদিয়া অবশ্যই নিবে। চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে তার। কাঁদতে কাঁদতে মুখ একেবারে লালবর্ণ। নাদিয়া বিছানায় শুয়েছিলো। সেখান থেকে উঠে বাবা-মায়ের ঘরে গেলো। বদরুজ্জামান সাহেব চা পান করছিলেন। নাজমা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। বাবার কাছে গিয়ে কোলে মাথা রাখে নাদিয়া। বদরুজ্জামান সাহেব মেয়ের চোখমুখ দেখে বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হইছে, মা?”
“বাবা, বাবা…

বলেই উচ্চ সুরে কেঁদে উঠে নাদিয়া। নাজমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের কাছে এলেন। বদরুজ্জামান সাহেবকেও বেশ চিন্তিত দেখালো। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবাকে বলো মা। কেউ বকেছে? বীথি ঝগড়া করেছে?”

কান্নার কারণে কথাই বলতে পারছেনা নাদিয়া। নাজমা মেয়ের শিয়রের কাছে বসলেন। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ক্ষান্ত হয় নাদিয়া। নিজ থেকেই বলতে শুরু করে,
“বাবা, আমি তোমাকে একটা অভিযোগ করবো। তুমি কথা দাও এর বিচার করবা?”

বদরুজ্জামান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“কি কথা মা?”
“বাবা, তোমার কথাতেই আমি শাহবাজ স্যারের কাছে পড়া শুরু করি। উনি খুব খারাপ বাবা। উনি আমার শরীরে বাজেভাবে স্পর্শ করেছে কয়েকবার। আজকেও করেছে।”

বদরুজ্জামান সাহেব মেয়ের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তার জানা মতে শাহবাজ খুবই ভালো ছেলে। যদিও তার বাবার চরিত্র খারাপ ছিলো। কিন্তু..
নাজমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,
“আমি আগেই বলেছিলাম। যে ছেলের বাবা তিন বিয়ে করছে সেই ছেলের চরিত্র আর কেমন হবে! না, আপনি জন দরদী সাজছেন। এখন এর বিহিত করেন।”

নাদিয়া কখনো বাবাকে মিথ্যা বলেনা। এটা পরিবারের সবার জানা। মেয়েকে তাই অবিশ্বাসও করা যাচ্ছেনা। তবুও তিনি মেয়েকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“নাদিয়া, মা। তুমি কি সত্যি বলছো?”
“আমি তোমাকে কখনো মিথ্যা বলেছি বাবা!”

নাদিয়ার কান্নার বেগ বাড়ে। নাজমা রেগে যান। ক্রুদ্ধ সুরে স্বামীকে বলেন,
“এত বড় একটা ঘটনার পরও মনে হচ্ছে মেয়ে মিথ্যা বলছে! মেয়ের প্রতি এই বিশ্বাস?”

ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে এর তো অবশ্যই একটা বিহিত হওয়া জরুরি। শাহবাজ তো এখানে কৃতঘ্নের পরিচয় দিলো। সত্যি বলতে স্ত্রীকে অনেক বলে শাহবাজদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। অনুরোধ করেছিলেন যেন তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার না করে। নাজমা তার কথা রেখেছেন। তারা সবাই উপরে এলেন। ঘরের দরজা লাগানো। সেসময় শাহবাজ ঘরে ফিরেই প্রিয়াঞ্জনাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তার মনে হচ্ছিল এত চিন্তা করলে সে মা রা যাবে। তার ঘুম প্রয়োজন। প্রিয়াঞ্জনাও কোনো প্রশ্ন করেনি। দরজায় হালকা করে টোকা দিলেন বদরুজ্জামান। শাহ্, প্রিয়া তখন গভীর ঘুমে। নাজমা জোরে জোরে দরজায় আ ঘাত করা শুরু করলেন। হাসিমুখে আপ্যায়ন করলেও তিনি শুরু থেকেই স্বামীর বিরুদ্ধে ছিলেন। যা করতেন তা অনেকটা মুখে মুখেই ছিলো তার। শাহদাত চৌধুরীর চরিত্র নিয়ে তিনি বহু কথা শুনেছেন। এটা ঠিক তার স্বামীকে সাহায্য করেছিলো। তবে চরিত্র তো খারাপ। সেই লোকের সন্তানকে তিনি বাড়িতে কি করে স্থান দিবেন! দুইজন অবিবাহিত কন্যা তার ঘরে। তারউপর এই ছেলের উপরেও প্রতারণা, টাকা মে রে দেওয়ার অভিযোগ আছে। শাহ্ এর ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করেছিলো এ কথা তিনি অস্বীকার করেন না। মেয়েকে এই ছেলের কাছে পড়তে দেওয়ার ইচ্ছাও তার ছিলোনা। স্বামীর কথায় দিয়েছেন কেবল।
“কি করছো নাজমা!”
“ভয় পেয়েই দরজা খুলছেনা।”

বদরুজ্জামান ভ্রু কুঁচকালেন। মেয়েকে তিনি বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনোটাই করতে পারছেন না।
এমন সময় দরজা খুললো প্রিয়াঞ্জনা। গভীর ঘুম তার চোখে। চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে চাচি?”
“তোমার স্বামীকে ডাকো।”
“উনি তো ঘুমাচ্ছেন।”
“নোংরা কাজ করে আবার ঘুম আসে কেমনে?”

নাজমার কথায় অবাক হলো প্রিয়াঞ্জনা। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”

নাদিয়া কান্না করে যাচ্ছে। বিথী ওকে সামলাচ্ছে। প্রিয়াঞ্জনাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন নাজমা। বদরুজ্জামান চেয়েও থামাতে পারলেন না। সবাই ঘরে ঢুকলো। চেঁচামেচিতে শাহবাজ উঠে বসেছে বিছানায়। নাজমা বললেন,
“এই ছেলে। তুমি আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত দিয়েছো কেন? ল ম্পট।”

শাহবাজ অবাক হয়ে নাদিয়ার পানে চাইলো। নাদিয়া মাথা নিচু করে কাঁদছে। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, চাচি।”

বদরুজ্জামান ভূঁইয়া সাহেব মুখ খুললেন এবার। ব্যথিত কন্ঠে বললেন,
“আপনাকে আমি বড় ভরসা করেছিলাম শাহবাজ। আপনি এই কাজটা করতে পারলেন?”
“কি করেছি আমি চাচা?”

নাজমা বললেন,
“এমন সাজছে যেন ভাজা মাছ উল্টায় খেতে জানেনা। আমার মেয়ে কখনো মিথ্যা বলেনা। বাবার কাছে তো নাই। সেই মেয়ে চোখ, মুখ ফুলিয়ে ফেলছে কান্না করে। কিছু না হলেই এমন করার মেয়ে আমার নাদিয়া না। তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত দেওয়ার! ছিঃ! বাপের মতনই চরিত্র পাইছো। মেয়েবাজ কোথাকার!”

শাহাবাজের রাগের মাত্রা আকাশ ছুঁয়েছে এবার। কি মিথ্যাবাদী মেয়েটা! সে হিং স্র বাঘের মতো তেড়ে গেলো নাদিয়ার দিকে। কেউ কিছু বোঝার আগেই
চ ড় বসিয়ে দিলো তার গালে। চিৎকার করে বললো,
“আমি কখনো তোমার গাঁয়ে হাত দিয়েছি। এই মেয়ে আল্লাহর কসম করে বলো কখনো এমন কিছু করেছি?”

নাদিয়া গালে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। নাজমা এক ধাক্কা দিয়ে শাহবাজকে সরিয়ে দিলেন। মেয়েদের ব্যাপারে তিনি পৃথিবীর কাউকেই ছাড় দেন না। নিজের খালাতো ভাইকেই পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন।
“এই কু ত্তার বাচ্চা। কোন সাহসে আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত তুলিস তুই।”

বদরুজ্জামানও বেশ রেগে গেলেন। তবে স্ত্রীকে আটকে ধরে সামলাচ্ছেন। সেই সাথে বললেন,
“এই কাজটা কিন্তু আপনি ঠিক করেন নাই। আমার সামনে আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত কি করে তুললেন আপনি।”

শাহবাজও সমান তালে বলে যাচ্ছে। বড় কোনো
মা রা মা রি হতে পারে। প্রিয়াঞ্জনা তাই শাহবাজকে থামানোর চেষ্টা করলো। নাজমা প্রায় ছুটে এসেই শাহবাজের গালে চ ড় বসিয়ে দিলেন। হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠলো শাহবাজ। রাগ এত পরিমাণে বেড়েছে তার। সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা।
“আপনি কোন সাহসে আমার গাঁয়ে হাত দিলেন। এই মহিলা! নিজের মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে আপনার? পায়ে পায়ে খোঁচা দেয়। বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক করতে চায়। বে * পয়দা করছেন একটা।”

অবস্থা বেগতিক হচ্ছে। শাহবাজের মাথায় র ক্ত উঠে গেছে। প্রিয়াঞ্জনা এক পর্যায়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো শাহবাজকে। বদরুজ্জামান সাহেবকে বললো,
“চাচা, আমরা কালকে এই ব্যাপারে কথা বলি? আপনারা এখন যান।”

নাজমা চিৎকার করে বললেন,
“কোনো কথা নাই। দুইদিনের মধ্যে ঘর খালি চাই।”

একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে নাজমাকে নিচে নিয়ে এলেন বদরুজ্জামান। প্রিয়াঞ্জনা বিস্মিত হয়ে ভাবলো,
‘মানুষ কত সহজে রূপ বদলায়!’ সে কখনো কল্পনাও করেনি এই মহিলা এমন! প্রথমদিন উনাকে দেখে মায়ের কথা মনে পড়েছিলো তার। মনে হয়েছিলো কত মমতাময়ী মহিলাটি! দরজা খোলা। শো শো বাতাস আসছে ঘরে। প্রিয়াঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে শাহবাজ। সকল রাগ, ক্ষোভ অশ্রু হয়ে ঝরে প্রিয়াঞ্জনার কাঁধে। কখনো নিজের শাহ্ কে এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি প্রিয়াঞ্জনা।
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো প্রিয়াঞ্জনা?”
“নিজের চাইতেও বেশি।”

শাহবাজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা। তার শাহ্কে আ ঘা ত করেছে মহিলা। তার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যিখানে। আর যে সহ্য হয়না। এত এত বিপদ! জীবনটা এমন কেন? যখনই তারা ভাসতে ভাসতে তরী খুঁজে পায় তখনোই আবার ডুবে যায়। এর শেষ কোথায়?

(চলবে)….

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-৩০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

কোথায় যাবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা শাহবাজ। চাকরিটাও বোধহয় আর থাকবেনা। রিমনের কাছে যাবে কি! তাদেরই তো কত ঝামেলা। চিন্তার কারণে গলা দিয়ে একটা দানাও নামছেনা তার। প্রিয়াঞ্জনাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। বদরুজ্জামান সাহেবের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু তিনি কোনো কথাই শুনেন নি। যা বোঝা গেলো বাড়িটা ছাড়তেই হবে।

হেমন্ত এসেছে নিরবে। হেমন্তে নাকি মানুষের মন বিষণ্ণ থাকে। ভিষণ সত্য কথা। দিন ছোট হয়ে আসছে। আসরের আজান দিতে দিতেই সন্ধ্যে হয়ে আসে। আজকের মধ্যাহ্ন এক বিষাদপূর্ণ মধ্যাহ্ন। প্রিয়াঞ্জনাকে ঘুম পাড়িয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাজ। পুকুরের পাশটায় খেসারি কলাইয়ের ক্ষেত লাগানো হয়েছে। গাছগুলো উঁকি দিচ্ছে সবে। এমন সময় নাদিয়াকে নিচে উঠানে দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয় শাহবাজ। মানুষ এত বাজেও হয়? এত নোংরা!
টাকা দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে আজ দুদিন। ওরা যেকোনো সময় চলে আসবে। এই বাড়িতেই আসবে। শাহবাজই ঠিকানা দিয়েছে। দিতে বাধ্য হয়েছে। মেইন গেটে কারা যেন টোকা দিচ্ছে। নাদিয়া উঠানে বসেছিলো। সাথে তার একজন বান্ধবী। ঐদিন শাহবাজকে কেস খাওয়ানোর গল্পই করছিলো নাদিয়া। সে সাথে হাসাহাসি। নাদিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়া! এবার মোকাবিলা করুক। খুব তো ভাব নিচ্ছিলো। এসব খেলা নাদিয়া ভালোই পারে। গেটের শব্দ ক্রমশ বাড়তেই নাদিয়া উঠে গিয়ে মেইন গেট খুলে দিলো। নাদিয়াকে অবাক করে দিয়ে কয়েকজন পুলিশ আর ব্যবসায়ী আকরাম প্রবেশ করলেন বাড়ির ভিতরে। শাহবাজ যা বোঝার বুঝে গেলো। যা যা নি কৃ ষ্ট হওয়ার ছিলো সবই হয়েছে তার সাথে। এখন শুধু এটারই বাকি ছিলো। সে ঘরে প্রবেশ করে। প্রিয়াঞ্জনা নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। গত কয়েক রাত চিন্তায় চিন্তায় সেও ঘুমায় না। তার সাথে প্রিয়াঞ্জনাও জেগে থাকে। ডাকতে ইচ্ছে করেনা। তবুও ডাকে,
“প্রিয়াঞ্জনা, উঠো। তাড়াতাড়ি উঠো।”

হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে প্রিয়াঞ্জনা।
“কি হয়েছে শাহ্?”
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে উঠে সে। শাহবাজ মাথা ঠান্ডা রাখে। এমন পরিস্থিতিতে উত্তেজিত হওয়া যাবেনা। ধীর কন্ঠে বলে,
“পুলিশ এসেছে প্রিয়াঞ্জনা। আমাকে মনে হচ্ছে থানায় ধরে নিয়ে যাবে।”

ঠাটা পরা মানুষের মতন স্তব্ধ হয়ে গেলো প্রিয়াঞ্জনা। এসব ব্যাপারে সে খুব ভয় পায়। সে কি বলবে? কোনো কথাই তার মুখে আসছেনা। প্রিয়াঞ্জনার কপালে চুমু খায় শাহবাজ। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“এখানে পাঁচ হাজার টাকা আছে। রাখো। আমি রিমনকে কল করছি…

কল করার সুযোগ আর হলোনা। বদরুজ্জামান সাহেব সহ পুলিশের লোকজন এবং আকরাম উপরে চলে এলো। পুলিশ কর্মকর্তা হাসান বললেন,
“আপনাকে আমাদের সাথে পুলিশ স্টেশন যেতে হবে। আপনার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি এবং টাকা আত্মসাৎ এর কেস করা হয়েছে।”

বদরুজ্জামান সাহেব হয়তো সাহায্য করতেন। নিজের মেয়ের চাইতে বড় তো আর অপরের ছেলে না। শাহবাজ থমথমে সুরে বলে,
“আমাকে একটি কল করার সুযোগ দিন।”

পুলিশের সামনেই আকরাম মোবাইলটা শাহবাজের হাত থেকে নিয়ে নেন। গমগমে কন্ঠে বলেন,
“এসব রাখো মিয়া।”
তারপর হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হাসান, একে যা জিজ্ঞেস করার থানায় নিয়ে করবা।”

হাসান সাহেব হলেন আকরামের বন্ধু মানুষ। কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলেন শাহবাজকে এরেস্ট করতে। প্রিয়াঞ্জনা কান্না করছিলো এতক্ষণ। শাহবাজকে যখন হাতকড়া পরানো হলো তখন আঁতকে উঠলো প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ নিষ্প্রাণ। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রিয়াঞ্জনাও পিছন পিছন যাচ্ছে। মুখে বার বার বলছে,
“কোথাও নিবেন না। দয়া করেন, স্যার। ওকে ছেড়ে দেন।”

উঠানে ততক্ষণে অনেক লোক জমা হয়েছে। একপর্যায়ে আকরামের পা জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনা কেঁদে উঠে।
“ভাই। আমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে বলেন। আপনার টাকা দিয়ে দিবো। কিছুদিন সময় দেন ভাই।”

উঠানে কোনো মানুষই এগিয়ে আসছেনা। শাহবাজের আর সহ্য হলোনা। আকরাম কিছুই বলছেনা। মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। শাহবাজ ধমকে উঠলো প্রিয়াঞ্জনাকে। মেইন গেট পেরিয়ে শাহবাজকে পুলিশের গাড়িতে উঠানো হলো। প্রিয়াঞ্জনা মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে। অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে শাহবাজ। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে।
মাটিতে বসে কতক্ষণ কান্নার পর প্রিয়াঞ্জনার হুঁশ ফিরলো। বুঝে গেলো তার শাহ্ এর তো কেউ নেই। ভেঙে পড়লে হবেনা। তামাশা সবাই দেখেছে কেউ সাহায্য করেনি। আরো বদরুজ্জামান সাহেবকে নানা রকম কথা শুনিয়ে গেছে। কি করে তিনি একজন অপরাধীকে বাসা ভাড়া দিলেন।
উঠে দাঁড়ায় প্রিয়াঞ্জনা। অনেকক্ষণ কান্নার ফলে মাথা ব্যথা করছে প্রচন্ড। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশে। মাথাটা ধরে কোনো মতে উঠানে প্রবেশ করে সে। নাজমা, বিথী, নাদিয়া বসেছিলো উঠানে। প্রিয়াঞ্জনাকে দেখামাত্র মুখ ফিরিয়ে নিলো তারা। কোনো কিছু না বলেই উপরে চলে এলো প্রিয়াঞ্জনা। হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। তারপর বসলো খাটে। মানুষের জীবনে ঝড় যখন আসে তখন চতুর্দিক থেকেই আসে। কোনো উপন্যাস কিংবা সিনেমার মতন তুড়ি বাজালেই সব ঠিক হয় না। লড়াই করতে হয়, ধৈর্য্য ধরতে হয়। সময় বয়ে যায়। নানারকম আ ঘা ত, প্রতি ঘা ত মোকাবেলা করতে হয়। রূপকথার মতো সোনার কাঠি, রূপার কাঠি ঘুরালেই বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়া যায় না। গলা ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে ভেঙে গেছে। প্রিয়াঞ্জনা ফোন করে রিমনকে। রিং হয়। রিসিভ হয় সাথে সাথেই।
“আসসালামু আলাইকুম, শাহ্।”
“রিমন ভাই। আমি প্রিয়াঞ্জনা।”
“কি হইছে ভাবী?”
“পুলিশ শাহ্কে ধরে নিয়ে গেছে রিমন ভাই…
বলেই কান্না করে দেয় প্রিয়াঞ্জনা।
” কাঁদবেন না ভাবী। আমরা আসতেছি।”
“আপনি জেলখানার মোড়ে আসেন, ভাই। আমি আসতেছি। থানায় যেতে হবে। মনে হচ্ছে থানায় নিয়ে গেছে।”
“নরসিংদী থানা নাকি মাধবধী থানা সেটা জানেন?”
“কিছু জানিনা ভাই। কিছু জানিনা। আপনারা থাকেন আমি আসতেছি।”
“এত রাতে একা আসতে পারবেন, ভাবী।”
“পারবো ভাই। স্বামীর জন্য সব পারতে হয়।”

বোরকা পরে এই ঘন আন্ধার রাতেই বেরিয়ে পড়ে প্রিয়াঞ্জনা। আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করছে।
‘আমার শাহ্কে তুমি হেফাজতে রেখো, আল্লাহ।’

এই পৃথিবীতে এমনও নারী আছেন যারা স্বামীর দুঃসময়ে ছেড়ে যায় আবার এমন নারীও আছেন যারা স্বামীর ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়াঞ্জনা তার শাহ্ এর নিকট আহ্লাদী, বোকাসোকা। প্রিয়াঞ্জনার প্রাণভোমরা তার শাহ্। মানুষটাকে সে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। মানুষটার জন্য সে যেকোনো লড়াইয়ে নামতে প্রস্তুত।

“আপনি এমন করেন কেন প্রীতম। মেয়েটাকে একটু কোলে নিলেও তো পারেন। রাতের পর রাত জেগে মেয়েকে আমি সামলাই। আপনার পরিবারের একটা মানুষও আমাকে সাহায্য করেনা। কেন এমন করছেন আপনারা? আমার মেয়ে কালো বলে?”

চিৎকার করে বলে উঠে স্বর্ণা। প্রীতম বিরক্ত হয়। এমনিতেই তার কোনোকিছু ভালোলাগছে না। এতগুলো দিন হয়ে গেলো ফাহিম তাকে কোনো আশ্বাসই দিচ্ছে না। এখন তো কলও ধরেনা।
“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”

আবারও চিৎকার করে উঠে স্বর্ণা। প্রীতমের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। প্রীতম ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিরক্তিকর! স্বর্ণাকে এখন তার কাছে বিরক্তিকরই লাগে।

প্রাপ্তির বমি হয়েছে কয়েকবার। শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো না। ফাহিমের সাথে তার তেমন যোগাযোগ হয়না। মাঝেমধ্যে কল করে কেবল। প্রাপ্তি বেঁচে আছে নিজের যন্ত্রণাকে আঁকড়ে ধরে। প্রীতিকে কয়েকবার কথাটা বলতে গিয়েও সে বলেনি। কি হবে বলে? ফাহিম তো আর শাস্তি পাবেনা। উল্টো এ ব্যাপারে জানতে পারলে তার ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। তার মা জোহরা বেগম এখন নতুন পায়তারা করছেন। প্রাপ্তি, প্রীতি আর প্রিয়াঞ্জনা তারা তিনবোনই বেশ সুন্দরী। জোহরা একসময় চাইতেন উনার ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। তবে প্রিয়াঞ্জনা আর প্রীতম এতটা কষ্ট দিয়েছে তাকে এখন আর প্রাপ্তি, প্রীতির প্রতিও কোনো আশা নেই তার। প্রাপ্তিকে পাড় করেছেন। প্রীতির জন্য বিসিএস ক্যাডার একজনের সম্বন্ধ এসেছে। মনে হচ্ছে এসএসসির আগেই প্রীতিকেও তিনি বিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হবেন। তার মনে ভয় ঢুকেছে। যদি প্রিয়াঞ্জনা কিংবা প্রীতমের মতো তারাও এসব করে ফেলে! প্রিয়াঞ্জনাকে এখন মন থেকে তীব্র
ঘৃ ণা করে প্রাপ্তি। আজ তার যে অবস্থা হয়েছে সবকিছুর জন্য দায়ী বড় আপা।

(চলবে)…..