প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-৩১+৩২

0
401

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-৩১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

হাজতে রাখা হয়েছে শাহবাজকে। অনেক টাকা পয়সা আর প্রভাবশালী মানুষজন থাকলে হয়তো তাকে থানা থেকে ছাড়ানো যেতো। সেই দুটো জিনিসই বর্তমানে শাহবাজের নেই। প্রিয়াঞ্জনাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। আজ যেহেতু বৃহস্পতিবার আগামী শুক্র, শনি সব বন্ধ থাকবে। তাই এই দুদিন শাহবাজকে জেলে থাকতে হবে। তারপর রবিবারে কোর্টে চালান দেওয়া হবে। আকরাম চাইলেই সময় বাড়াতে পারতো। সে এসব করছে পূর্ব শত্রুতার সূত্র ধরে। শাহবাজকে বিপদে ফেলে সে একরকম পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। দুয়েকটা চড়,ঘু ষিও দেওয়া হয়েছে। আকরামের মানসিক একটা সমস্যা আছে। যাকে সে আপন করে নেয় তাকে নিজের সবকিছু পারলে দিয়ে দেয়। আর যাকে একবার ঘৃ ণা করে তার সর্বোচ্চ ক্ষতিটা করে সে শান্ত হয়। সে অনেকদিন ধরেই চাচ্ছিলো শাহবাজকে একটা মা ই র দিবে। কিন্তু গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সালিশে বসে সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। তাই আর পারেনি। তিনি অবাক হচ্ছিলেন এটা ভেবে যে এত বড় ঝামেলা হলো অথচ কেউ কোনো মামলা দেয়নি। এর তো আরো বড় শা স্তি হওয়া দরকার ছিল।

প্রায় মাঝরাতেই রিমনের বাড়িতে থানা থেকে ফেরত আসে প্রিয়াঞ্জনা। একজন ভালো উকিল ধরলে কয়েকদিনের মধ্যেই জামিন পাওয়া সম্ভব শাহবাজের। সুফিয়া বললো,
“হাত-মুখ ধুঁয়ে ভাত খেয়ে নেও।”
“কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা, আপু।”

সুফিয়া জোর করেই প্রিয়াঞ্জনাকে খাবার বেড়ে দিলো।
“রিমন ভাই, কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
“একজন ভালো উকিলের কাছে যেতে হবে।”
“আপনার পরিচিত আছে কেউ?”
“আমার নেই। আমার দোকান মালিকের পরিচিত থাকতে পারে। দেখি সকালে কথা বলে। ভাবী, আপনি একটা কাজ করেন। কিছুদিন আমাদের এখানে থাকেন। কোর্ট আর উকিলের কাছে যাওয়া সহজ হবে।”
“জ্বি, ভাই।”

শিক্ষা চত্বরে নিজ বাসাতেই চেম্বারে বসেন এডভোকেট আমিনুল ইসলাম। রিমন নিজের দোকান মালিকের কাছ থেকে উনার নাম্বার জোগাড় করেছে। সিনিয়র উকিল। কথা বলে যা বোঝা গেলো প্রাথমিক অবস্থাতেই তিনি পঞ্চাশ হাজার দাবি করে বসে আছেন। প্রিয়াঞ্জনা অনুনয় করে বলেছে,
“টাকাটা একটু কমানো যায় না স্যার। আমরা খুবই বিপদে আছি।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না। এখানে অনেক প্রসেসিং এর ব্যাপার আছে। প্রশাসনকে টাকা খাওয়াতে হবে, জজকে একটা এমাউন্ট দিতে হবে। আপাতত জামিন পঞ্চাশের নিচে সম্ভব না।”

প্রিয়াঞ্জনার কানে স্বর্ণের দুল, হাতে চুড়ি, গলায় চেন আর আঙুলে খুবই দামী ডায়মন্ডের আংটি আছে। আংটি টা শাহবাজ দুবাই থেকে এনেছিলো। তাদের মধ্যে প্রথমবার যেদিন গভীর ভালোবাসা হয় এর পরদিন সকালে প্রিয়াঞ্জনা হাতের আঙুলে পরিয়ে বলেছিলো,’এটা আমাদের প্রথম কাছে আসার স্মৃতি হিসেবে থাকুক প্রিয়াঞ্জনা।’

গলার চেন, কানের দুল আর হাতের চুড়ি স্বর্ণকারের দোকানে খুলে দিলেও হাতের আংটিটা সে দিতে পারেনি। খুব কষ্ট হচ্ছিল প্রিয়াঞ্জনার। বিক্রি করে দিলো সবকিছু। এত বিপদ গেছে তাদের, শাহবাজ কখনো তার গাঁয়ের গহনাগুলো নেয়নি। কখনো এগুলো বিক্রি করবে সে প্রসঙ্গও তুলেনি। বিয়ের অন্য গহনা অবশ্য প্রিয়াঞ্জনা তার হাতে তুলে দিয়েছিলো। সেগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলো শাহবাজ। বড়বাজার থেকে অটো করে আবার রিমন, প্রিয়াঞ্জনা উকিলের বাসায় আসে। আমিনুলের হাতে তুলে দেয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমিনুল সাহেব আশ্বাস দিলেন সোম,মঙ্গলবারের মধ্যেই জামিন হয়ে যাবে। বাকিটা উনি দেখবেন। তবে হাজিরা দিতে হবে শুনানির তারিখ অনুযায়ী। আদালত হলো বর্তমানে টাকার খেলা। একজন সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত, নিঃস্ব করে ছাড়ে।
শাহবাজকে জেলে নেওয়া হয়েছে। তাকে কিছু
মা র ধোর করা হয়েছিলো। অসুস্থ হয়ে পড়েছে শাহবাজ। শরীরে যা আ ঘা ত লাগার লেগেছে। সেটা নাহয় পুষিয়ে যাবে। তবে মনের আঘাত! বারবার চোখের সামনে ভাসছে প্রিয়াঞ্জনার ক্রন্দনরত মুখটা। তার অর্ধাঙ্গী পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলো আকরামের। না চাইতেও তুলনা চলে আসে। মায়ের প্রতি অভিযোগ বাড়ে। মা বিদেশে স্বামী নিয়ে থাকেন। কোনোদিন শাহবাজের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন নি। বাবার দুর্দিনে বড়লোক এক বন্ধুর সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শাহবাজ মেয়েদের তেমন ভরসা করতো না। মনে হতো এরা তো সব স্বার্থপর, লোভী। আল্লাহ তার কপালে এমন একজনকে জুটিয়ে দিলেন! বুঝিয়ে দিলেন এই পৃথিবীর সব নারী সমান নয়। এক রুমের ভিতরে প্রায় চল্লিশজন আসামী। কেউই স্থায়ী নয়। কয়েকদিনের ভিতরেই জামিন হবে। এত আসামিদের ভিড় থাকার কারণও আছে। বিরোধী দলের ছেলেপেলে এরা। মিছিলে নেমেছিলো, ভাংচুর করেছে। তাই পুলিশ বেশিরভাগই আটক করে জেলে চালান করে দিয়েছে। তাদের নেতাকেও ধরেছে। শরীফ জামান হলেন গাজীপুরের ব্যবসায়ী। একসময় মাধবধীতে ছিলেন। কিন্তু দলীয় ঝামেলায় জড়িয়ে আর সেখানে ব্যবসা করা হয়নি। কিছু বছর আগেই পাড়ি জমিয়েছেন গাজীপুর। চৌরাস্তায় কাপড়ের বড় পাইকারি দোকান দিয়েছেন তিনি। বেশ রমরমা ব্যবসা। জাত স্বভাব তার যায়নি। বারবার নরসিংদীতে ছুটে আসেন। মিটিং, মিছিল করে ঝামেলায় জড়ান। আবার টাকা, লোকের বলে বেরিয়ে যান। একলা মানুষ। বউ মা রা গেছে প্রায় বছর পনেরো আগে। বউকে ভিষণ ভালোবাসতেন। তাই আর বিয়ে করেন নি। একটা মেয়ে আছে। তাকেও বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কানাডায় থাকে স্বামীর সাথে। তিনি পান খেয়ে ঘুরে বেড়ান, মাঝেমাঝে দোকানে বসেন। আর রাজনীতি করেন। ছেলেটাকে অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছিলেন তিনি। ঠোঁটে একটু র ক্তের দাগ। চুপচাপ এককোনায় বসে আছে। চেনা চেনাও লাগছে। কোথায় যেন দেখেছেন। তিনি নিজের সিট থেকে উঠে এসে বসলেন শাহবাজের পাশে। শাহবাজ ফ্লোরে বসেছিলো।
“তোমাকে আমার অনেক চেনা চেনা লাগছে। তুমি কি আমাদের দলের কেউ?”

মাঝবয়েসী একজন লোকের কথা শুনে তার দিকে ফিরে তাকায় শাহবাজ। তারপর আবার চোখ নামিয়ে বলে,
“আমি কোনো দল করিনা।”
“তাহলে জেলে আসলে কি করে?”
“টাকা আত্মসাৎ, জালিয়াতি।”

সুদর্শন, কথা-বার্তায় গাম্ভীর্যের ছাপ এমন ছেলের মুখে শরীফ সাহেব এসব কথা শুনে বেশ অবাকই হলেন।
“তোমাকে দেখে মনে হয় না।”
শাহবাজ জবাব দিলো না। এখন তার কোনো কিছুই ভালোলাগছে না।
“তোমার চেহারা আমার পরিচিত এক ভাইয়ের সাথে মিলে। উনি অবশ্য মা রা গেছেন। একটা ছেলে আছে শুনেছি। মাধবধীতে বেশি একটা যাওয়া হয় না তাই তেমন যোগাযোগও নেই। শাহাদাত চৌধুরীর নাম শুনেছো?”
“জ্বি, আমার বাবা হোন।”

মাথা নিচু করেই উত্তর দিলো শাহবাজ।
“তোমার নাম কি বাবা?”
“শাহবাজ চৌধুরী”

শাহাদাত চৌধুরী ছিলেন শরীফ জামানের বন্ধু মানুষ। দলীয় ঝামেলায় মাধবধীতে প্রবেশ করতে পারেন না তিনি। মিটিং, মিছিল সবই করেন নরসিংদী মেইন কেন্দ্রে। বহু বছর বন্ধুর সাথে যোগাযোগ ছিলো না। ছেলেটা শুনেছিলেন ঢাকা থাকে। ছোটবেলায় দেখেছিলেন। ব্যবসা জীবনে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। শাহাদাত চৌধুরীর মৃ ত্যুর খবরও তিনি পেয়েছিলেন বেশ কিছুদিন পরে। ছেলেটার অনেক প্রশংসা শুনেছিলেন। কখনো সচক্ষে দেখা হয়নি। আজ এমন বিব্রত অবস্থায় তাদের দেখা! মনে মনে কষ্ট অনুভব করলেন তিনি। হাত রাখলেন শাহবাজের মাথায়। হাত বুলিয়ে দিলেন। এতিম ছেলেটার জন্য বড় মায়া হচ্ছে তার। আকস্মিক এমন কান্ডে শাহবাজ অবাক হলেও কেন যেন বাবার কথা মনে পড়ছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার।
“কিভাবে এমন ঝামেলায় জড়ালে বাবা? আমি অনেকদিন বাবুর হাটে যাই না। এসব খবরও কানে আসেনা। কি হয়েছে শাহবাজ? তুমি কি সত্যিই এসব করেছো?”

শাহবাজ বিগত কয়েকমাসের সব ঘটনা খুলে বললো। অজান্তে গলাও ভিজে গেলো তার। কি করে তার চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা তাকে পথের ফকির বানালো সবই বললো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শরিফ।
“তোমার চাচারা হইলো কু ত্তার জাত। এক নাম্বারের নিমক হা রা ম। তোমার বাপেরেই সাবধান করছিলাম এ ব্যাপারে। শাহাদাত চৌধুরী শক্ত মানুষ। তারসাথে এসব পারে নাই। তোমাকে নরম পেয়ে এসব করছে। আকরামে এই কাজটা কেমনে করতে পারলো। আমি বের হয়েই অফিসে ডাকাবো।”
“থাক, চাচা। ঝামেলা আর ভালোলাগেনা।”
“কত টাকা লাগবে তোমার? আমি দিবো। আমার গাজীপুরে ব্যবসা আছে। একজন ভালো মানুষ খুঁজতেছিলাম। যে সব দায়িত্ব নিবে। আমি ভবঘুরে মানুষ। রাজনীতি করি, ঘুরে বেড়াই। এই সুযোগে
চা মচাগুলো অনেক টাকা সরায় ফেলে। আমি বুঝি কিন্তু কিছু বলিনা। তুমি বসবা আমার দোকানে? শাহাদাত আমার অনেক ভালো বন্ধু ছিলো। তার ছেলে এমন বিপদে পড়ছে জানলে আগেই পাশে দাঁড়াতাম।”

শাহবাজ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আসলে জীবনে কোন মুহূর্তে কখন কি হবে আমরা কেউই জানিনা। শাহবাজ কি কখনো কল্পনা করেছিলো আজ এরকম একজন মানুষের সাথে তার দেখা হবে! তাও জেলে!
“আকরামকে কত টাকা দিতে হবে?”
“পঁচিশ লাখ, চাচা।”
“আপাতত কিছু দিলে মানবেনা।”
“বলতে পারছিনা।”
“উকিল ধরেছো?”
“আমার ওয়াইফের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। ও কি উকিলের কাছে গেছে কিনা আমার জানা নেই।”

শাহবাজকে একটি কল করার ব্যবস্থা করে দিলেন শরীফ। প্রিয়াঞ্জনার সাথে দু মিনিটের মতো কথা বলতে পারলো শাহবাজ। পুরোটা সময় প্রিয়াঞ্জনা কেঁদেছে। উকিলের সাথে কথা বলেছে তাও জানিয়েছে।

শরীফ সাহেবের জামিন হয়ে গেলো। এর তিনদিন পরেই জামিন হলো শাহবাজের। আকরামকে অফিসে ডেকে শাহবাজের হয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন শরীফ জামান। কিন্তু আকরাম তা নেয়নি। উল্টো রাগ দেখিয়ে গেছে। বলেছে এর শেষ দেখে ছাড়বে। ছলিমুদ্দীন সাহেব শাহবাজকে সময় দিয়েছেন। শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা দুদিন রিমনের বাসায় থেকেছে। আজ তারা ফিরে যাচ্ছে শিবপুর। সেখান থেকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে তারা যাবে গাজীপুর। শাহবাজ হলো স্ফুলিঙ্গের মতো। তার ব্যবসায়িক জ্ঞান প্রখর। একটা সুযোগেই সে জ্বলে উঠতে পারবে। জামান সাহেব তাকে ভরসা করেছেন। শাহবাজের এখনো বিশ্বাস হয়না। সবকিছু মনে হয় স্বপ্নের মতো৷ এমন বড়মাপের একজন ব্যক্তিকে নিজের পাশে পাবে সত্যিই অবাক করা বিষয়। জীবনকে আমরা রূপকথা বলিনা। তবে অনেক সময় রূপকথার মতোই ঘটনা ঘটে যায়। শরীফ জামান সাহেব যেহেতু শাহবাজের মাথায় হাত রেখেছেন। কেউ তাকে কিছু বললেও ভেবে বলবে। দুঃখের অবসান হচ্ছে কি তবে?

(চলবে)….

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-৩২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

চন্দ্রবিলাস ঘরটি এই কয়েকমাসেই বড্ড আপন হয়ে গিয়েছিলো। সবকিছু যখন গুছিয়ে নিচ্ছিলো তখন ভিষণ কষ্ট হচ্ছিলো প্রিয়াঞ্জনার। আজ রাতেই তারা গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। শাহবাজ যেহেতু একেবারে চলে যাবে তাই প্রথমে অধ্যক্ষ মোশতাকের সাথে দেখা করে সে। কথা হয় বেশ অনেকক্ষণ। মোশতাক সাহেব মন ভরে দোয়া করেছেন শাহবাজের জন্য। ছেলেটা মেধাবী, পরিশ্রমী। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সহজ-সরল। ছেলেটা যেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তিনি অন্তর থেকে দোয়া করেছেন। তারপর শাহবাজ আসে তার একজন শিক্ষার্থীর বাসায়। গতমাসের বেতন দেয়নি তারা। ছাত্রের মাকে শাহবাজ বললো,
“আন্টি, আমার বেতনটা যদি দিয়ে দিতেন তাহলে ভালো হতো।”
“স্যার, কয়েকদিন পরে নেন। বিপদে আছি।”
“আমি শিবপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আন্টি। আর কখনো আসতে পারবো কিনা জানিনা।”

ভদ্রমহিলা যথেষ্ট ধনবান। স্বামী পল্লী বিদুৎ অফিসে চাকুরি করেন। কিন্তু মহিলার স্বভাবই এমন। গৃহশিক্ষকদের টাকা দিতে চান না। তিনি বললেন,
“তাহলে পরে শিবপুর আসলে নিয়েন।”
“অন্তত কিছু টাকাও যদি দিতেন তাহলে উপকার হতো আন্টি।”

মহিলা ধমকে বলে উঠলেন,
“এত টাকা টাকা করছেন কেন, স্যার? হাভাতে আপনি?”

শাহাবাজ লজ্জা পেলো। বেরিয়ে এলো তাদের বাড়ি থেকে। এমন চার হাজার টাকা এক সময় শাহবাজের একদিনের রেস্টুরেন্টের বিল ছিলো। আজ এই টাকার জন্য কথা শুনতে হয়েছে তাকে। ভাগ্য সত্যিই অদ্ভুত!
নাদিয়া ছাদে গোলাপ দেখছে সাথে গুণগুণ করে গান গাইছে। প্রিয়াঞ্জনা পাশে এসে দাঁড়ায়। তার আকস্মিক আগমনে চমকে যায় নাদিয়া। আজ আকাশ মেঘলা। হালকা হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। প্রিয়াঞ্জনা মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি যে কাজটা করেছো একদম ভালো করো নি নাদিয়া।”
“কি করলাম আমি?”
“নাটক করো না। আমার সামনে নাটকের প্রয়োজন নেই।”
“আপনার সাথে নাটক করার কিংবা কথা বলার ইচ্ছেও আমার নেই।”
“আমার শাহ্কে আমি চিনি, নাদিয়া। সে কেমন আমি জানি। নিষ্পাপ, এতিম মানুষটাকে তুমি কষ্ট দিয়েছো। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রেখেছি। তিনি তোমার বিচার করবেন।”
“আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারেন না। গজ ব আল্লাহ আপনাদের উপরেই ফেলছে। বড় বড় কথা বলেন।”

নাদিয়াও কম না মুখে মুখে তর্ক করছে।
“ঠিক আছে। দেখা যাবে সামনে কি হয়। আমি কখনো মানুষকে অভিশাপ দেইনা। কিন্তু তোমরা আমার শাহ্ কে বিনা কারণে আ ঘা ত করেছো। আমার শাহ্ অসহায়। এতিমের উপর অন্যায় আল্লাহ ও সহ্য করেন না।”
“হইছে, রাখেন। আপনার আজাইরা কথা শোনার সময় নাই। আপনার জামাই একেবারে ধোঁয়া তুলসি পাতা।”

ভেংচি কেটে নাদিয়া নিচে চলে গেলো। রাতেই শিবপুর ছাড়ে শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা। ভেলানগর বাসস্ট্যান্ডে রিমন এবং সুফিয়ার সাথে দেখা করে পাড়ি জমায় গাজীপুর। বাসে উঠে বসার পর প্রিয়াঞ্জনা অনুভব করলো প্রথমদিনের মতো লাগছে। সেদিনের মতো বৃষ্টিও হচ্ছে আজ। শরীফ জামান সাহেবের সাথে প্রিয়াঞ্জনার কথা হয়েছে। এত অমায়িক মানুষ সে খুবই কম দেখেছে। ভালো মানুষের চোখ দেখলেই চেনা যায়। জামান সাহেব সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো মানুষ।

কেটে গেলো সাতমাস। গাজীপুরে আসার পর অভাবনীয় ভাবে বদলে গেলো শাহবাজ এবং প্রিয়াঞ্জনার জীবন। ব্যবসায় প্রবেশ করা মাত্রই একের পর এক সাফল্য। সোনার কাঠি, রূপার কাঠি ছুঁয়ালে যেমন রূপকথার জগতে দুঃখ দূর করা যায়; ঠিক তেমন করে একটা সুযোগ বদলে দিয়েছে শাহবাজের জীবন। জামান সাহেবের দোকানের পাশে নিজের দোকান দিয়েছে সে। আকরামের সকল টাকা পরিশোধ করেছে। আস্তে আস্তে অন্যদের ঋণও দিচ্ছে। কাপড়ের ব্যবসায় একবার যদি উপরে উঠা যায় তাহলে আর পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনা। শাহবাজের চৌকস বুদ্ধি, পরিশ্রম তাকে সফল করেছে। একজন ব্যবসায়ী নিজের দুটি কাপড় তৈরির কারখানা বিক্রি করে দিবেন। লসেই দিয়ে দিচ্ছেন। পনেরো লাখ টাকা দিয়ে সে কারখানা ক্রয় করে শাহবাজ। এই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সে পাইকারি কাপড় নিতো। তিনি অনেক লস করেছেন ব্যবসায়। তাই নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিলেন সব মেশিন। কারিগরসহ শ্রমিক আছেন প্রায় একশত জনের মতো। কারখানা দুটো কোনা বাড়ির পাশেই। শাহবাজের কাপড় তৈরির ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। ম্যাজিকের মতো এই ব্যবসায়ও সে সফল। এইবার আর কাপড়ের ব্যবসায় সীমাবদ্ধ থাকেনি শাহবাজ। বাস কিনেছে চারটা। বাসের ব্যবসায় অনেক টাকা। একটু বুদ্ধি খাটালেই চলে। সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতেও বিনিয়োগ করার ইচ্ছে আছে তার। এত দ্রুত আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে কখনো কল্পনাও করেনি শাহবাজ।

গাজীপুরের এক আবাসিক এলাকার বহুতল ভবনে ডুপ্লেক্স বাসায় থাকতেন জামান সাহেব। শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা এখানেই উঠেছিলো প্রথমদিন। আজও তারা এখানেই থাকে। প্রিয়াঞ্জনার কখনো মনে হয়নি জামান সাহেব তাদের অল্পদিনের পরিচিত। শাহবাজ এবং তার মাথায় সবসময় ছায়ার মতন থাকেন। ঠিক একজন বাবার মতন। সবকিছুতে গাইড করেন শাহবাজকে।
আর কিছুদিন বাদেই প্রিয়াঞ্জনার ডেলিভারি ডেট। জান্নাতের টুকরা আসবে তার ঘরে। মেয়েটা পেটে আসার পর থেকে সবকিছুতেই বরকত হচ্ছে। প্রিয়াঞ্জনাকে খাইয়ে দিচ্ছিল শাহবাজ। আপেল, কমলা, আনার এক বাটি ভরে এনেছে। কিছুক্ষণ আগেই প্রিয়াঞ্জনা বমি করে শাহবাজের শরীর ভাসিয়েছিলো। বিন্দুমাত্র বিরক্ত শাহবাজের চোখে ছিলোনা। বরং পরম যত্নে তাকে পরিষ্কার করে দিয়েছে। এখন ফল খাইয়ে দিচ্ছে। আজকাল প্রিয়াঞ্জনার মন ভালো থাকেনা। বারবার মনে হয় সবকিছু তো ঠিক হয়ে গিয়েছে। কোনো অভাব, দুঃখ তাদের নেই। শাহবাজ, অনাগত সন্তান এবং সে খুব সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে। কিন্তু যদি সে
মা রা যায়! মৃ ত্যু ভয় হয়। আলতো করে শাহবাজকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনা। গভীর আবেগে বলে,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি শাহ্।”
“আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি, প্রিয়াঞ্জনা।”

প্রিয়াঞ্জনার উঁচু হয়ে আসা পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে সেখানে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় শাহবাজ। হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করে নিজের অংশকে। কি সুন্দর! এ জগতের নিয়ম। একজন পুরুষের অংশ বেড়ে উঠে তার আপনার চেয়ে আপন অর্ধাঙ্গীর গর্ভে। এ অনুভূতি স্বর্গীয়। অত্যন্ত স্নিগ্ধ। মানুষের জীবন বহমান। ঠিক নদীর মতন। কখনো স্থির, কখনো উত্তাল। জীবনসঙ্গীর খারাপ সময়ে যারা নিজের সুখের জন্য ছেড়ে যায় তারা স্বার্থপর। তারা কখনো ভালোবাসতে জানেনা। জীবনে কোনো না কোনো সময় অনুভব করে তারা অসুখী। অপরপ্রান্তে প্রিয় মানুষটার দুঃসময়ে পাশে থেকে ভরসা দিলে, বিশ্বাস করলে একসময় দুঃসময় কেটে যায়। বন্ধন মজবুত হয়। প্রকৃত সুখ অর্জন করা যায়।

(চলবে)…