প্রিয় পৌষমাস পর্ব-১৫+১৬

0
4

#প্রিয়_পৌষমাস ১৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ঘরের ভেতরে হাসির ঝংকার শুনেই বুঝে গেছে অতিথি কারা এসেছে। পৌষী অবাক হয়নি আর। প্রবেশ করে দেখতে পেল নিজের ফুফি-মামাকে। এক পাশে তার নানুও আছে। দাদু-নানু বেশ গল্পে মজেছে। তাকে দেখা মাত্রই মারিয়া ছুটে এল। জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমার বইন এত শুকিয়ে গেছে কীভাবে?’

পৌষী নানুর উপর কপট রাগ দেখালো। এই বাক্য ছাড়া আর কিছু জানে না তার নানু। নতুন কিছুও তো বলতে পারে। মুখের কোণে ঈষৎ হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘তোমার চিন্তায় নানু, রাতে ঘুম আসে না।’
মারিয়া হাসল। গাল টেনে বলল,
‘আমার চিন্তা কর, না জামাইয়ের চিন্তা কর। নানুর জন্য চিন্তা হইলে কল দিয়ে খোঁজ নিতা।’
পৌষী নিজের ফাঁদেই নিজেই পড়ল। তাই বলে উঠল, ‘আরে দূর, নানু কি যে বল না, তোমার চিন্তায় করি।’

মারিয়ার মুখে প্রাণবন্ত হাসি। হঠাৎই চোখ পড়ল আরাভের দিকে। পৌষীর ঠিক পেছনে দাঁড়ানো। দেখে চেনার উপায় নেই এই ছেলেকে। অজান্তেই বলে উঠল, মাশ’আল্লাহ। দেখতে পুরো ইংরেজদের মত, বেশ লম্বা চওড়া একটা ছেলে। আরাভকে ডেকে বলল,
‘কেমন আছো নানু ভাই?’

আরাভ মারিয়াকে সালাম দিল। মারিয়ার সাথে সাথে পাশে বসা নিজের ফুফুকেও সালাম দিল। মারিয়া সালাম নিয়ে ভালোমন্দ কুশল বিনিময় করল। শোভা এত সময় ছটপট করছিল, কখন তার ভাইপো আসবে। আর তাকে জড়িয়ে ধরবে। আরাভকে দেখা মাত্রই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠল। ভেজানো গলায় বলল,
‘কতদিন পর আমাদের কলিজাকে দেখছি। এত নিষ্ঠুর কিভাবে হলি আরাভ। পাঁচ বছরে একটাবার এই ফুফুর কথা মনে পড়েনি। একটাবার খোঁজ নিলি না। কেন বাপ?’

আরাভ কিভাবে শান্ত করবে বুঝতে পারল না। সে ভালোই বুঝতে পেরেছে তার ফুফুরও অভিমান জমেছে তার উপর। নিজের ফুফুর মাথায় হাত বুলালো। মলিন গলায় বলল,
‘সর‍্যিই ফুফি, এমন ভুল আর হবে না।’
শোভা চোখ মুছলো। আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আর ফিরে যাস না, নিজের দেশেই থাক। তোদের ছাড়া ভালো লাগে না বাপ।’

আরাভ নিজের ফুফির এমন সরল সোজা আবদারে হাসল। জবাবে হ্যাঁ বলে মাথা নাড়িয়ে এপাশ ওপাশ করল শুধু।

পৌষী নিজের ফুফুর সাথে কুশল বিনিময় শেষে রুমে ফিরে এল। কিন্তু এসে যা দেখল তার চক্ষু চড়কগাছ। তার রুম আর তার নেই। দুই বিচ্ছু পুরো রুমে তান্ডব চালিয়েছে। তার একমাত্র মামার দুইটা মাত্র ছয় বছরের জমজ ছেলে, যুবাব আর যাবির। জমজ হলেও চেহারায় কোনো মিল নেই তার পাপাহদের মত। কিন্তু এই দু’জন এত পরিমাণ বিচ্ছু। খোদ শয়তানও এদের দেখে ভয়ে পালিয়ে যাবে। এজন্য তার মামী দুই বিচ্ছুকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায় না। এরা তার বিছানার দফারফা বানিয়ে দিয়েছে। বালিশ মেঝেতে রেখে তার উপর বসেছে। ড্রেসিরুমের অর্ধেক জিনিস মেঝেতে। একজন মুখে পাউডার মেখেছে, অন্যজন কসমেটিকসের জিনিস খেলনা বানিয়ে খেলছে। বাথরুমের দরজা খোলা। তার জুতা দিয়ে গাড়ি বানিয়েছে। ভাগ্য ভালো তার বইয়ে হাত দেয়নি। নয়তো দু’টোকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিত এখন।

কিন্তু বাকি রুমের এমন বেহাল দশা দেখে তার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল হুট করে, ‘এই তোদের কি সমস্যা বল তো? রুমের এই অবস্থা কি জন্য করেছিস?’
যুবাব, যাবির পৌষীকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল। এক ছুটে ঘর থেকে বেরুতে চাইলে সে দু’জনকে শক্ত করে ধরল। তারপর চেঁচিয়ে তার মামাকে ডাকল। প্রত্যুষ হন্তদন্ত হয়ে রুমে এল। যা ভেবেছে তাই হল। তার দুই বিচ্ছু আকাম করে রেখেছে। সে থাপ্পড় দেয়ার জন্য হাত তুলতেই পৌষী ইশারায় থামাল। মামাকে বলল চুপ করে দেখ আমি কি করি। সে দুজনের হাত ছেড়ে দিল। যুবাব, যাবির তখন চোরা চোখে চেয়ে আছে পৌষীর দিকে। সে দুজনকে আদেশ করল,

‘পুরো রুম তোরা এলোমেলো করেছিস, এখন তোরাই আবার গোছাবি। নয়তো একটাকেও বাড়ি যেতে দেব না আমি। সোজা বাথরুমে বেঁধে রাখব।’

পৌষীর ধমকে রুম গোছানোর কাজে লেগে পড়ল দু’জন। ছোট্ট হাতের কারণে আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল বার বার। কিন্তু পৌষী হার মানার পাত্র নয়। দু’ভাইকে দিয়ে ঠিকই সব গুছিয়ে নিচ্ছে। প্রত্যুষ দাঁড়িয়ে নিজের ছেলে আর ভাগ্নীর কান্ড দেখে যাচ্ছে শুধু। তার পেছনে আরও একজন সটান হয়ে দাঁড়ানো। আরাভের চোখেমুখে যেন ঘোর বিস্ময়। কিন্তু ঠোঁটের কোণে ঝুলছে সুপ্ত হাসি। যাক তার ভবিষ্যৎ তাহলে বেশ উজ্জ্বল।

দুপুর আড়াইটা। পৌষী ফ্রেশ হয়ে এল খাবার টেবিলে। কিন্তু এসে দেখল আরাভ খাবার সামনে রেখে বসে আছে। সে কিছুটা অবাক হল। ভেবেছিল আরাভ খেয়ে নিয়েছে এতক্ষণে। তাকে দেখে আরাভ বলল, জলদি বস, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
পৌষী আরও একবার অবাকের চরম শিখরে। আরাভের আচরণ তাকে বেশ ভাবাচ্ছে, বেশ অন্যরকম আজ। সে একপলক তাকালো আরাভের দিকে। জবাবে বলল,
‘আমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলে?’
আরাভ খাবার মুখে দিতে দিতে বলল,
‘সবাই তো খেয়ে নিয়েছে। শুধু আমরা দু’জনই বাকি। তোমার একা খেতে ভালো লাগবে না, তাই আর কি।’

পৌষী বলার মত দ্বিতীয় বাক্যে খুঁজে পেল না আর। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আবারও তাকালো আরাভের মুখপানে। কিন্তু আরাভ নিজের কাজে ব্যস্ত। রোস্টের বাটি থেকে রানের অংশটা পৌষীর পাতে তুলে দিল। সাথে দিল সালাদ আর গরুর ভুনা মাংস। পৌষী চমকে উঠল। বলল,
‘মুরগীর রান তো তোমার প্রিয়, আমাকে দিলে যে।’
আরাভ আলগোছে হাসল। পৌষীর দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল,
‘ভাগাভাগী করা শিখে নিচ্ছি। যাতে পরে টানাটানি করতে না হয়।’
পৌষী ভ্যাবাচ্যাকা খেল। কি এক অদ্ভুত উত্তর দিল। সে আর জবাব দিল না। নিশ্চুপ খাবারে মনোযোগ দিল।

রান্নাঘরে আলিশবা প্রিয়াকে কাজে সাহায্য করছে। কাজের ফাঁকে আলিশবা কিঞ্চিৎ নজর বুলালো পৌষী আর আরাভের উপর। আচম্বিত প্রিয়াকে ডেকে বলল,
‘দেখেছো দু’জনকে। একে অপরের প্রতি এখনও কিন্তু সুপ্তটান আছে। কিন্তু ছেলেটা পৌষীকে বিয়ে করার জন্য কেন রাজি হল না, তা আজও জানা হয়নি।’
প্রিয়া নিশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘বাদ দাও না আপু। ওদের নিজেদের মধ্যে হয়ত এমন কিছু কখনোই ছিল না। যা ছিল মজা-মাস্তি শুধু, অন্যকিছু নয়। আমরাই ভুল ভেবেছি তাদের নিয়ে।’

আলিশবা মর্মাহত হল। তার মন মানতে চাইছে না। যা দেখছে, তা হয়ত ভুলও হতে পারে। সে তার ছেলেকে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি।

পূর্ণীর রুমে তার সমবয়সী ও অসমবয়সীদের মিলনমেলা বসেছে। আরিবা, কিয়াস, আকসা আর পূর্ণী মিলে লুডু খেলছে। সাথে কিয়াসের তেরো বছর বয়সী ছোট বোন কিয়াশাও আছে তাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য। কিয়াস আরিবার একমাসের ছোট। কিন্তু দু’জনের মাঝে বেশ প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। কিয়াসের একটা গোপন তথ্য আরিবার বেশ জানা। তাই ইচ্ছে করেই লুডুখেলার মধ্যে কিয়াসকে পূর্ণীর পার্টনার বানিয়ে দিয়েছে। কিয়াস প্রথমে ভয় পেয়েছিল। পরে আরিবা ইশারায় বলল, ভয় পাস না, মে হু না। কিয়াস বড্ড অসহায় এই মুহুর্তে। এটাই তো তার আসল ভয়। কোন ফাঁকে কি করে বসে আরিবা। খেলা চলল প্রায় ঘন্টাখানেক। এরপর আকসা বলল,

‘যাও তৈরি হও সবাই। বিকেল চারটা হতে চলল। আমাদের পাঁচটার ট্রেনে উঠতে হবে। তাহলে রাত এগারোটার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো কিন্তু।’

আকসা এসে পৌষীকে ঘুম থেকে উঠালো তড়িঘড়ি। বলে উঠল, ‘জলদি তৈরি হও।’
পৌষী নিভু নিভু চোখে জবাব দিল,
‘কেন আপু?’

‘বলেছিলাম না সকালে, সারপ্রাইজ আছে। এখন জলদি তৈরি হও। আমরা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।’
‘তো যাও না গ্রামের বাড়ি, আমাকে কেন টানছো?’
‘আরে বোন নেত্রকোনা যাব, আমাদের গ্রামের বাড়িতে। তোমাদের পুরো পরিবার যাচ্ছে, সাথে তুমিও যাচ্ছো।’

পৌষী চমকে উঠল। বলল আমি কেন যাব? আকসা জবাব না দিয়ে তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করালো। তারপর টেলেটুলে বাথরুমে পাঠালো জলদি। নিজেও তৈরি হতে লাগল। কতদিন পর নিজের দেশে এসেছে। আর নিজের গ্রামে যাবে না, তা কি করে হয়। তার পুরো পরিবার এখন নেত্রকোণায় আছে। আজ আরাভের পুরো পরিবার যাবে তার সাথে। সে সবাইকে তাগাদা দিলো দ্রুত তৈরি হতে। নাজমা এতদূর ভ্রমণ করতে পারবে না। শরীর তার বড্ড নড়বড়ে। সে না যাওয়ার বাহানা খুঁজল। কিন্তু আকসা নাছোড়বান্দা। বলল, ট্রেনে যেতে কোনো সমস্যা নেই। তারা ফার্স্ট ক্লাস বগি নিয়েছে। ঘুমাতে, বসতে কোনো সমস্যা হবে না কারো। অগত্যা নাজমাও প্রস্তুতি নিল যাওয়ার জন্য। অথচ ঘরের বাকি সদস্যরা আগেই প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে।

পড়ন্ত বিকেল। পাঁচটা বাজতে আর বিশ মিনিট বাকি। সবাই গাড়িতে উঠল দ্রুতই। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহুর্তে পার্থ এসে হাজির। সে পৌষীর সাথে দেখা করার অজুহাতে আরিবাকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু সবার এত তাড়াহুড়ো আর হুলুস্থুল দেখে সে ভীষণ লজ্জিত হল। চলে যেতেই মনঃস্থির করল তখন। আচমকা সৌরভ তাকে নিজের কাছে ডাকল। নিজের বন্ধু পরশ আর প্রিয়ার বান্ধুবী রাহীর ছেলে পার্থ। তাই নিঃসংকোচে বলে উঠল,
‘আমাদের সাথে গাড়িতে উঠো।’

পার্থ’র চোখেমুখে বিস্ময় তখন। সে তাদের পারিবারিক ভ্রমণে কেন যাবে? জবাবে বলল,
‘না আঙ্কেল, আমি কেন?’
সৌরভ ধমক দিল।
‘জলদি উঠ। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি পরশকে কল দিয়ে বলব, তুমি আমাদের সাথে আছ।’
পার্থ’র মনে তখন লাড্ডু ফুটল। কিন্তু লজ্জায় চুপসে আছে। পৌষী মুখ টিপে হাসল। সে জানে পার্থ এখানে কেন এসেছে? অথচ আরিবার হুঁশ নেই। সে আছে দুনিয়ার হাবিজাবি গল্প নিয়ে। আচমকা চোখ পড়ল আরাভের দিকে। পার্থ’র অবস্থা তখন আরও শোচনীয়। যদি একবার তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। নির্ঘাত মেরে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দেবে আরিবার ভাই। কিয়াসের পাশে বসেছে পার্থ। কিয়াস হুট করে বলে উঠল,

‘কি হয়েছে পার্থ ভাই? এত ঘামছো কেন?’

পার্থ জবাব দেয়ার আগে আচমকাই আরিবা বলে উঠল,
‘পার্থ ভাইয়া, ভালো আছো?’

ব্যস, আরিবার ভাই ডাক শুনে পার্থ’র যা একটু আশা ছিল তাও ফুড়ুৎ। অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকালো। পৌষী অতর্কিত খিলখিল করে হেসে উঠল। আরাভ এতক্ষণ বিরক্ত হচ্ছিল। এত হৈ-হুল্লোড়ে তার মাথা ধরে গিয়েছে। তাও চুপটি করে সহ্য করছে। কিন্তু পৌষীর হাসিতে তার বিরক্তিকর মুখে মুহুর্তে শীতলতার শিহরণ বয়ে গেল। সে বিমোহিত হল। নজর তার সম্পূর্ণ স্থির হয়ে আছে তখন। চোখের পলকও পড়ল না। শুধু বিড়বিড় করল আপনমনে,
‘হোক না মধুরও প্রলয়,
কাটুক নীরবতা,
বিমোহিত কর বারে বার,
প্রিয় সুস্মিতা।’

ট্রেনের দু’টো বগির প্রথমটাতে বাড়ির ছেলে-মেয়েরা, অন্য বগিতে মুরুব্বিদের অবস্থান হল। নিজেদের সিট অনুযায়ী সবাই বসে পড়েছে। দূরগামী ট্রেন চলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। ঘড়িতে তখন পাঁচটা দশ। শীতের বিকেল। তাই সন্ধ্যা নেমেছে বহুক্ষণ আগে। জানালা খুলতেই শীতল বাতাসে সবাই কাবু হয়ে গেল। দ্রুত জানালা বন্ধ করে দিল আবার। শাল-সোয়াটার গায়ে জড়িয়ে যে যার মত ঝিমাচ্ছে। এতক্ষণ হৈ-হুল্লোড় থাকলেও ধীরে ধীরে সবাই শান্ত হয়ে গেল।

বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দেওয়া যাচ্ছে না। পৌষী বিরক্ত হল। সে বসেছে আরাভের মুখোমুখি সিটে। না চাইতেও বার বার চোখাচোখি হচ্ছে। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। আরাভের দু’চোখে আজ অন্য কিছু দেখছে। কেমন করে তার দিকে চেয়ে আছে। অথচ আকসা তার পাশে। কিন্তু তার দিকে তাকালো না একবারও। সে যারপরনাই অবাক। নিজের হবু বউকে না দেখে তাকে দেখার কারণটা তার বোধগম্য নয়। বরং আজব ও ভীষণ অস্বস্তির ব্যাপার মনে হচ্ছে। আরাভ যেন পৌষীর অস্বস্তি চট করে ধরে ফেলল। বলে উঠল,

‘কোন সমস্যা?’

পৌষী দ্রুতই না বলে মাথা নাড়ালো।

আরাভ নিজের মুখ কিছুটা পৌষীর সামনে নিয়ে এল। অন্যেরা যাতে না শুনে তাই ক্ষীনস্বরে বলে উঠল,
‘তাহলে ড্যাব ড্যাব করে এত কি দেখ? আজ কি আমাকে একটু বেশিই হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে?’

পৌষী মুহুর্তে তাজ্জব বনে গেল। জবাব দিতে গিয়ে দেখল, আরাভ সটান হয়ে বসে পরেছে। যেন সে কিছুই জানে না। অথচ মুখের কোণে দুষ্ট হাসি তার।

চলবে,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ১৬.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ছুটন্ত রেলগাড়ীর ঝনঝন শব্দ আর হিম করা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। তবে গিজগিজ করা কেবিনের মাঝে শীতলতা কম থাকলেও আছে হাস্যরসের যোগান। সবার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু আরিবা। সে তার কানাডিয়ান জীবনের গল্প বলছে। তার খিলখিল শব্দ ভেসে আসছে হুটহাট। সেই শব্দে হৃদয়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বয়ে যায় পার্থ’র। লুকিয়ে এদিক ওদিক করে তখন দেখে আরিবাকে। সরাসরি তাকানোতে তার বড্ড ভয়। পাছে তার বড় ভাই যদি বুঝে যায়। তাহলে প্রেম শুরু হওয়ার আগে সমাপ্তি ঘটবে অচিরেই।

কিয়াস, আরিবা ও পূর্ণী যেন গল্পের সমাহার নিয়ে বসেছে। আরিবার সাথে গলায় গলা মিলিয়ে কিয়াসও নিজের জীবনের গল্প বলে যাচ্ছে। আরিবা হুট করে ক্ষেপানোর জন্য বলে উঠল, তোর বাথরুমওয়ালীর কি খবর কিয়াস?
কিয়াস লজ্জায় কাচুমাচু করল। এই মেয়ে তার মহা সর্বনাশ করে ছাড়বে এখন। আমতা আমতা করল, দূর এসব কি বলিস তুই?
পূর্ণী জিজ্ঞেস করে উঠল,
‘কিয়াস ভাইয়া, তোমাকে একটা মেয়ে প্রপোজ করার পর তুমি না’কি লজ্জায় বাথরুমে চলে গিয়েছিলে? এটাই কি সেই বাথরুমওয়ালী?’

কিয়াস আহত চোখে তাকাল। সামান্য একটা কথাও আরিবার পেটে হজম হয় না। একদিন মজারচ্ছলে এই কথা শেয়ার করেছিল তার সাথে। আর সে পুরোগুষ্টি শুদ্ধ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। মুখের কোণে কিঞ্চিৎ অসহায়ত্ব তার। পূর্ণীর জবাবে বলল,

‘তবে কথাটা পুরোপুরি সত্যি না, আংশিক সত্য। একবছর আগের ঘটনা। ভার্সিটির প্রথমদিন। সেদিন আমার টয়লেটে যাওয়ার ভীষণ তাড়া ছিল। তাই আশেপাশে কে আছে তা না দেখেই আমি টয়লেটে ছুটে যাচ্ছিলাম। এরপর ঘটে এক অঘটন। বের হয়ে আসার পর আমাকে হিরো বলে ডাক দেয় কিছু ছেলে। তারা হাত মেলায়। বলে উঠে, তুমি ভাই আসলেই লয়্যাল। সুন্দরী মেয়েদেরও পাত্তা দাও না দেখছি। প্রপোজ করায় তুমি উল্টো বাথরুমে ঢুকে গেলে লজ্জায়। তখন আমি বেকুব বনে গেলাম। কি বলে এসব? তাই বলে উঠলাম, মানে? তারপর একজন বলে উঠল, বাজী ধরেছিলাম তোমাকে নিয়ে সুন্দরী একজন মেয়ের সাথে। মেয়েটা বলেছিল, তোমাকে পটিয়ে দেখাবে, তাও মাত্র একঘন্টার মধ্যে। উল্টো মেয়েটাই এখন বাজীতে হেরে গেছে।

সেদিনের পর থেকে আমাকে লয়্যাল হিরো বলে ডাকা হয় ভার্সিটিতে। ব্যস এটাই আসল কাহিনী।’

পূর্ণী হতাশার সুর তুলল মুখে। বলল,
‘দূর, মজা পাইলাম না। ভাবছিলাম, মেয়ের তাড়া খেয়ে বাথরুমে ঢুকছিলে।’
কিয়াস অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল। তাকে নিয়ে এমন সব ভাবে মেয়েটা। সে মুখে হাত রেখে বলল,
আসতাগফিরুল্লাহ, এসব কি কইলি?

আরাভ আচমকাই হেসে উঠল। কিয়াসের কাঁধে চপাড় দিয়ে বলল, এ না হলে আমার ভাই। এগিয়ে যা, দোয়া করি।
__

নাজমা ভয়ে আর অস্থিরতায় বার বার বাথরুমে আসা-যাওয়া করছে। সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এতবার সিট থেকে উঠা নামায়। আবার ঠান্ডায় শরীরও কাঁপছে তার। বুড়ো শরীর এত ধকল নিতে পারছে না। সৌরভ মায়ের জন্য গরম চা ঢেলে নিল। যদি শরীর তার কিছুটা উষ্ণতা পায়। নাজমা ধীরে ধীরে পান করল। গা এলিয়ে বসলেন তিনি। মায়ের অস্থিরতা কমতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। শেষে আরাভকে কল দিল। বলল সবার জন্য চা নিয়ে যাওয়ার জন্য। চা পান করলে শরীরে ঠান্ডা কম অনুভব হবে।

আরাভ সৌরভের কথা শুনে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। কেবিনে তখন পৌষী নেই। সে বাইরে এসে এদিক ওদিক খুঁজল, যদি মেয়েটাকে খুঁজে পায়। কিন্তু খুঁজে পেল না। কিছুসময় পর দেখল একটা কেবিনের পেছনে অন্ধকারের মাঝে দাঁড়ানো আছে পৌষী। আরাভ আৎকে উঠল। মেয়েটা পাগল না’কি। এভাবে কেবিনের বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে জঘন্য কিছুও তো হতে পারে? সে এগিয়ে এসে পৌষীর পিছনে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিল তার মনোযোগের উদ্দেশ্য। পৌষী অতর্কিত পেছনে মাথা ঘুরিয়ে নিল। আরাভকে দেখে কিঞ্চিৎ বিচলিত হলেও আগের মত সটান দাঁড়িয়ে থাকল। আরাভ আরও একটু এগিয়ে গেল। কিঞ্চিৎ দূরত্ব তাদের মাঝে তখন। বলল,

‘মন খারাপ?’

নীরবতায় আচ্ছন্ন পৌষী মাথা নাঁড়িয়ে না বুঝাল। আরাভ ফের জিজ্ঞাসা করল,
‘তাহলে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘এমনিই, ভেতরে অনেক শোরগোল, তাই বাইরে বেরিয়ে এলাম।’
‘ভয় করছে না, এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে?’

পৌষী আবারও নিজের মাথা নাঁড়ালো। মৃদু আলোয় বুঝা গেল না পৌষীর মুখের অভিব্যক্তি। তবে কোনো কারণে মেয়েটা বড্ড ব্যতীত। আরাভ কিছুটা গা ঘেঁষে দাঁড়ালো তার। শান্ত স্বরে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘কিন্তু আগে তো ভয় পেতে। সামান্য বাতাসেও ভয় পেতে। জানালার কিঞ্চিৎ শব্দেও হাউমাউ করে চিৎকার জুঁড়ে দিতে। নিজের ছায়াকেও ভয় পেতে। তবে সবচেয়ে বেশি নীরবতাকে ভয় পেতে। এখন শোরগোল ভালো লাগে না তোমার? আশ্চর্য লাগল শুনে।’

পৌষীর মুখে তাচ্ছিল্যে মাখা সুপ্ত হাসি। সামান্য আলোয় আরাভের দেখা হল না সেই হাসি। পৌষী বলে উঠল,
‘বয়স হয়েছে, দিন বদলেছে। সময়ের সাথে সাথে তো বদল আসে। আর এটাতো সামান্য বাচ্চাকালের ভয়। সেটাও এখন কেটে গেছে।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন তুমি পূর্ণ যুবতী।’

পৌষী তড়াক করে আরাভের দিকে তাকাল। কি মীন করে বলল তা বুঝল না। কিন্তু তীব্র অস্বস্তিতে ডুবল সে। আমতা আমতা করল,
‘কেবিনে ফিরে যাই।’
আরাভ সায় জানাল, ওকে।

রাত বাড়ল, সাথে বাড়ল সময়ের গতি। শীতল হাওয়ায় চলল কেবিনের ভেতর হাস্যরসের আলাপন। ঘড়ির কাটায় রাত দশটা ত্রিশে পৌঁছাতেই গন্তব্য এসে থামল তাদের ট্রেন। সবার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। নেত্রকোনায় প্রথম আসা তাদের। আকসার পরিবার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন থেকে বেরুতেই শীতের প্রকোপ ভালোই টের পেল সবাই। কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে গিয়ে উঠল। রাত এগারোটার মাঝে আকসার বাড়িতে অবস্থান হল তাদের।

টিনের তৈরি বিশাল বড় ঘর। ঘরের চালও টিন দিয়ে তৈরি। রাতে ভালোভাবে বুঝা না গেলেও দেখল, বাড়ির আশপাশ গাছগাছালিতে ভরপুর। তবে বাড়ির পরিবেশ কেমন তা বোঝা গেল না তখন। কিন্তু আকসার পরিবার বেশ আতিথেয়তা সম্পন্ন পরিবার। তাদের জন্য দ্রুত খাবারের আয়োজন শুরু করে দিল। কোনো রকম কুশল বিনিময় শেষে শুরু হল খাবারের পর্ব। প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে চলল এই খাওয়ার পর্ব। খাবার শেষে ঘুমে ঢুলুমুলু সবাই।

আকসার ছোট চাচা পুরুষদের নিয়ে গেলেন কামরা দেখানোর জন্য। তাদের দেওয়া হল একটা কামরা। পাশে রুমে আবার ছেলেদের কামরা। মহিলাদের আলাদা করে, মেয়েদেরও আলাদা কামরা দিলেন। পার্থ, আরাভ আর কিয়াসদের এক কামরায় থাকার ব্যবস্থা হল। অন্যদিকে আকসা আর পৌষী ছিল এক কামরায়, বাকিরা সব আলাদা।

ঘুমে অচেতন পুরো বাড়ি। অথচ পৌষীর চোখে ঘুম নেই। চোখ জুড়ে অস্থিরতা বিরাজমান। রাত পোহালে নতুন দিনের শুরু। অথচ তার জীবনে মহাকালের শুরু। আরাভ নতুন জীবনে পা রাখবে দ্রুতই। তাই তো সূদুর ফেনী থেকে তারা নেত্রকোণায় এসেছে। চোখ থেকে নোনাজল গড়ালো অজান্তেই। নিশব্দে ফুঁফিয়ে উঠল। কান্নার শব্দ যাতে আকসার কানে না যায় তাই মুখে কাপড় গুজে দিল।

ভোরের আলো ফুটতেই পাখির কলরোলে মুখরিত হল আকসাদের বাড়ি। ছেলে মেয়েরা এক এক করে উঠতে শুরু করেছে। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল আটটা। আরিবা ঘুম থেকে উঠে মুগ্ধ হয়ে গেল। বিশাল টিনের ঘর। ঘরের চারপাশে বারান্দা। ঘরের মেঝে পাকা করা, পুরো ঘর আবার পাকা সিঁড়ি দিয়ে ঘেরাও করা। তাদের নিজস্ব পুকুর, পাশে আবার ফল বাগান। কিন্তু তখন পুকুরপাড় ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। শীতের হিমেল হাওয়া এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার। অথচ সে ভ্রুক্ষেপহীন। গাছে হরেক রকম পাখি দেখে তার হুঁশ নেই। তাদের কিচিরমিচির শব্দ শুনে মুগ্ধতায় ডুবে গেল। তাদের ঘুম থেকে উঠতে কিছুটা দেরি হলেও বাড়ির মানুষদের উঠতে দেরি হয়নি। তারা রান্নাঘরে বেশ ব্যস্ত। সে দেখল, উঠানের এককোণে মাটির উনুন বানানো হয়েছে। সেখানে রান্নায় ব্যস্ত রাধুনি’রা।

সে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। পুকুর পাড় ঘুরে এসে ঘরের সামনের পাকা সিঁড়িতে গিয়ে বসল। এর কিছুসময় পর পূর্ণীর আগমন হল। সে হাই তুলতে তুলতে আরিবার কাছে এল। কিঞ্চিৎ রাগের বহিঃপ্রকাশ তার চোখেমুখে। তাকে ঘুম থেকে আরিবা ডেকে তুলেনি কেন? সেজন্যই। আরিবা মুখে জবাব না দিয়ে বিনিময়ে তাকে পুকুরপাড়ে ঘুরতে নিয়ে গেল। পূর্ণীর রাগ যেন মুহুর্তে ফুড়ুৎ। এত সুন্দর দৃশ্য বোধহয় সে খুব কমই দেখেছে। তারা দুজন পুকুরের এককোণে বানানো বাঁশের তৈরি মাচায় গিয়ে বসল। শীতের সকালের মনোরম দৃশ্য দেখে দুজনেই উচ্ছ্বসিত। গায়ের শাল কোনোরকম টেনেটুনে পরেছে। ঠান্ডা অনুভূত হলেও সকালটা তাদের কাছে বেশ মিষ্টিই লাগছে। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে টুপটুপ করে শিশির বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। তাদের দুজনকে এভাবে বসতে দেখে কিয়াস আর পার্থও এগিয়ে এল। চারজন মিলে গল্প জুড়ে দিল রাতের মত।

সবার ঘুম ভাঙলেও পৌষী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তখনও। আকসা কয়েকবার ঘুরে গেল পৌষীর রুম থেকে। সে কিছুটা আশাহত হল। ভাবল, হয়ত মেয়েটা লম্বা জার্নির ধকল নিতে পারেনি। তাই আর ঘুম থেকে উঠানোর জন্য তাড়া দেয়নি। কিন্তু প্রিয়া কিছুটা ক্ষুব্ধ হল মেয়ের উপর। বেড়াতে এসে এমন কান্ডহীন আচরণ সে মানতে নারাজ। ঘড়ির কাটায় তখন নয়’টার ঘরে। সে পৌষীকে ডাকার জন্য ছুটে এল। ঠিক তখনি, পৌষী বিছানা ছেড়ে মাত্রই উঠেছে। চোখমুখ কেমন ফুলে আছে। সে মেয়েকে দু’চারটা কথা শুনিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। তার মাথায় আসে না, মেয়েটা এত দায়িত্বহীন কেন হল?

পৌষী রুম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আকসার মা তাকে দেখে বলল, ভালো আছো আম্মু? সে হ্যাঁ বলে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল। তাকে খাওয়ার টেবিলে বসতে বলল। সে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছিল। সবাই খেয়ে বসে আছে। আর সে মাত্র ঘুম থেকে উঠল। লজ্জা আর জড়টায় যেন তাকে গিলে গাচ্ছিল সেই মুহুর্তে। তৎক্ষনাৎ হুট করে উপস্থিত হল তাকে বাঁচানোর জন্য এক মানব দূত। চট করে তার পাশের টেবিলে বসে পড়ল। তার মুখের কোণে জ্বল জ্বল করছে উজ্জ্বল হাসি। আশেপাশে কি হচ্ছে সেসবের কিঞ্চিৎ পরোয়া নেই তার মাঝে। পৌষী তাজ্জব বনে গেল। এ লোক এত বেলা না খেয়ে কেন বসে আছে? সে জিজ্ঞেস করার আগেই আরাভ বলে উঠল,

‘তুমিও খাওনি। আমিও খাইনি। বাহ কি দারুণ মিল আমাদের। তাই না পৌষমাস!’

চলবে,,,,,