প্রিয় পৌষমাস পর্ব-১৭+১৮

0
146

#প্রিয়_পৌষমাস ১৭.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর, দুপুরের খাবার শেষে বিমর্ষ বসে আছে পুকুর পাড়ে। সময় গড়িয়েছে বেশ। তাতে অবশ্যই হেলদোল নেই পৌষীর। দগ্ধ অন্তঃকরণ, অশ্রুশূন্য চোখ তার। কিন্তু দৃষ্টি পুকুরের স্বচ্ছ জলে নিবদ্ধ। মনটাকে সেই তখন থেকে শাসিয়ে যাচ্ছে, এমনটায় তো হবার ছিল। তবে কেন মেনে নিতে পারছো না?

দুপুরে খাবার টেবিলে বসে দেখেছিল আরাভকে করা জামাই আতিথেয়তার দৃশ্য। সে তখন খাবারটা মুখে তুলেছিল কোনো ভাবে। আরাভ, আকসা দু’জনকে পাশাপাশি বসানো হল। সে তাদের থেকে কিছুটা দূরত্বে। হবু জামাই, শ্বশুর বাড়িতে প্রথম আগমনে তার জন্য করা হল আস্ত মোরগ থেকে শুরু করে বাহারী রকমের খাবারের আয়োজন। নতুন জামাইকে দেখতে আত্নীয়-স্বজনদের ভীড় ছিল সকাল থেকে। খাওয়া-দাওয়া শেষে বসার ঘরে চলল বিয়ে নিয়েও পরিকল্পনা। কীভাবে বিয়ের আয়োজন করা হবে? এদের মধ্যমণি ছিল আরাভ। সবার কথার সাথে হু হাতেই জবাব দিচ্ছিলি সে শুধু। পৌষী পাশের রুম থেকে শুনে যাচ্ছিল এসব। কিন্তু যখন শুনল বিয়ে আগামী দু’দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। কাল হলুদের অনুষ্ঠান, পরশু বিয়ে। তবে বিয়ের পরবর্তী অনুষ্ঠান ফেনীতে হবে।

এইটুকু শুনে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। অবশেষে তার প্রিয় মানুষটার বিয়ে। নতুন জীবনের জন্য অবশ্যই তাকে অভিবাদন জানানো উচিৎ। সকালে বিয়ের জন্য কেনাকাটাও করতে দেখেছে। এত আনন্দঘন মুহুর্তের ভীড়েও সে আরাভের নির্লিপ্ততা দেখেছে। কেমন যেন দায়সারা ভাব। তবে আকসার মুখে ছিল প্রাণবন্ত হাসি। পরিবার হিসেবে আকসার পরিবার দশে দশ। মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে কানাডায় পাঠিয়েছে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে এসেছে। কিন্তু বিয়ের জন্য মেয়ের পছন্দকেই সম্পূর্ণ সমর্থন করে যাচ্ছে। কোনো প্রকার অভিযোগ নেই। আরাভকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ তাদের। এমন পরিবার খুব ভাগ্য করেই পাওয়া যায়। সে হাসল আনমনে। তার আরাভ ভাই খুব ভাগ্যবান এমন একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী পেয়ে।

অজান্তেই চোখের কোণে জল জমল। গড়িয়ে পড়ার আগ মুহুর্তেই মুখ আকাশপানে তুলে নিল। দূর দিগন্তের মাঝে নিজের শূন্য অভিব্যক্তি ব্যক্ত করল। নীরবে মন কত কিছুই বলে যাচ্ছে। সে শুধু নিজেকে শান্ত রাখার আহবান জানাচ্ছে।
‘কোন এক অদৃশ্য বাঁধন ছিল।
কিন্তু বিশ্বাসের মত ছোট্ট শব্দের কোন বাঁধন ছিল না আমাদের মাঝে। তাই তো, তুমি আমার হয়েও আমার নও। ভালো থেকো প্রিয়।’

মনটা যখন বিক্ষিপ্ত, তখন কোন এক বজ্রকণ্ঠের ক্ষুব্ধ স্বর ভেসে এল তার কর্ণদ্বয়ে। পৌষী সেই দিকেই চোখ তুলে তাকাল। তার সামনে দাঁড়িয়ে অগ্নিবর্ষণ করছে আরাভ। দু’চোয়াল শক্ত, চোখের কোণেও জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডলী। এমন মুখাবয়বের হেতু তার জানা নেই। এভাবে তাকে দেখার বিশেষ কোন কারণও নেই আরাভের কাছে, তাও কেন এভাবে তাকিয়ে আছে জানতেও ইচ্ছে করল না তার। কিন্তু সে নির্লিপ্ত চাউনি ফেলল তার দিকে। অথচ ক্রোধানলের আগুনে জ্বলছে আরাভ। সে নিজের দূরত্ব কমিয়ে পৌষীর আরও নিকটবর্তী হল। চোখে চোখ রেখে ছুঁড়ল তার অনাকাঙ্ক্ষিত এক তীর্যক বাক্য।

‘তোর কয়টা পুরুষ লাগে?’

পৌষী বাকরুদ্ধ এমন প্রশ্নে। আরাভের মুখে এত জঘন্য প্রশ্ন বোধহয় আজই শুনল। জবাব কি দেয়া উচিৎ তার জানা নেই। অপ্রত্যাশিত আসা প্রশ্নের জবাবও দিল অপ্রত্যাশিতভাবে।
‘মানে?’
‘আমি না হয় তোর পছন্দের তালিকায় ছিলাম না। কিন্তু সাফওয়ান তো ছিল। তাকে কার জন্য ছেড়ে দিলি? না-কি তোর পছন্দের তালিকাও বেশ চাহিদা সম্পন্ন পৌষী।’

আরাভের এমন হীন বাক্যেই পৌষী যেন নিজের সত্তায় হারিয়ে বসেছে। বুকের ভেতর এক তীক্ষ্ণ তীরের আঘাত হেনেছে যেন। চোখের দৃষ্টি তার সম্পূর্ণ আরাভের চোখের উপর। এই প্রথম তীক্ষ্ণদৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে তাদের দু’জনের মধ্যে। আরাভের চোখে ক্রোধানল হলেও পৌষীর চোখে অবিশ্বাস্য। তার আরাভ ভাই কি তবে এই সাফওয়ানের জন্যই তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। এই জন্যই তার চোখে এত ঘৃণা তার জন্য? কিন্তু তার হিসেব মেলাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। একটা বার তো তাকে জিজ্ঞেস করতে পারত। অন্তত সত্যতা যাচাই করতে পারত। কিন্তু তা করেনি আরাভ। বরং তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ফিরেছে নিজের হবু বউ নিয়ে। কই সে’তো একবারও বলেনি আরাভ ভাই তুমি আমাকে রেখে কেন অন্য এক মেয়েতে মজেছো? তাকে কেন বিয়ে করছো? তাহলে তাকে নিয়ে কেন এত মাথা ব্যথা তার। কিছু সময় তীক্ষ্ণদৃষ্টি বিনিময় শেষে পৌষী নিজেই দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে। শীতল গলায় বলে উঠল,

‘আমি কাকে ছাড়ব, কাকে রাখব এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিষয়, নান অফ ইউর বিসনেস।’

মুহুর্তেই পৌষীর বাম গাল জ্বলে উঠল আরাভের বলিষ্ঠ হাতের চড় খেয়ে। সে অবাক হল না। এমনটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর দাবানলের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে সে। অথচ বাইরে থেকে বেশ শান্ত। মন বলছে, অনেক হয়েছে। সহ্য যা করার সে করেছে। কিন্তু আর নয়। যা ভাবার সে ভেবে ফেলেছে। তার চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। বলে উঠল,

‘কি সমস্যা? এতই পুরুষত্ব প্রমাণ করার শখ তাহলে নিজের হবু বউয়ের সাথে দেখাও। কিন্তু একজন বাইরের মেয়ের গায়ে হাত তুলে নিজেকে কি প্রমাণ করতে চাইছো? আর একবার গায়ে হাত তুললে এখানে রণক্ষেত্র হয়ে যাবে কিন্তু আরাভ ভাই।’

আরাভ বলল, ‘অন্তত পুরুষত্ব প্রমাণ করতে আমার কোন নারীর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আফসোস, আমি ভাবতেও পারছিনা তুই এতটা নীচে নেমে গিয়েছিস?’

চোখের মণি স্থির হয়ে আছে পৌষীর। আরাভের চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় জবাব দিল, ‘কারণ আমি খুবই নীচ, জঘন্য। তাই নেমে গেছি। নেক্স,,’

আরাভ কথা বাড়ালো না আর। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল পৌষীর সামনে থেকে। অথচ তার মুঠোফোন তখনও টুংটাং শব্দ তুলে নতুন মেসেজের আগমন দিচ্ছে। আধঘন্টা আগে সে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে ছিল। সেই মুহুর্তে ঘটেছে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। তার কাছে ভার্সিটির এক বন্ধু মেসেজ দিয়ে জানালো সাফওয়ান বিয়ে করেছে গতকাল। সে সাফওয়ানের সদ্য বিয়ের একটা ছবিও তাকে পাঠাল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে নির্বাক, হতরুদ্ধ সে। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তার সেই বন্ধু হঠাৎই বলল,

‘জানিস দোস্ত, তোর কাজিন সাফওয়ানকে ঠকিয়েছে কিন্তু। বেশ কিছুদিন ডেটও করেছে দেখলাম। শেষে কি’না সাফওয়ানকে ছেড়ে দিল। সাফওয়ান কিন্তু তোর কাজিনকে অনেক ভালোবাসত। অথচ তোর কাজিন তাকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে। আসলে দোস্ত, রাগ করিস না। তোর কাজিনও বাকি মেয়েদের মতই। কীভাবে একটা ছেলের জীবন নিয়ে খেলল, প্রতারক একটা।’

আরাভ সাফাই গাইতে পারেনি পৌষীর হয়ে। তবে তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলবে সে এটা সহ্য করতে পারবে না। তাই তো কথার পৃষ্ঠে কথার তুমুল ঝগড়া করেছে সেই বন্ধুর সাথে। সাফওয়ানের নাম্বার নিয়ে কল দিয়েছে সাথে সাথে। পৌষীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দুষল খোদ সাফওয়ানকে। সাফওয়ান শুনে বাকরুদ্ধ। নিজের সাফাই গাইতে বলল,

‘প্রথমত আমি পৌষীকে ঠকায়নি, না তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বরং দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরও অপেক্ষা করেছি। কিন্তু পৌষীর মন গলাতে পারেনি। প্রথম প্রথম আমার সাথে ভালো ব্যবহার, সুন্দর হাসি-খুশি চললেও পরে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কারণ, ততদিনে না’কি পৌষীর জীবনে অন্য কেউ প্রবেশ করেছে। তাই সে আর আমাকে মেনে নিতে পারবে না। কেমন মেয়ে ভাবতে পারছিস? তোর চাচাতো বোন আসলেই চরিত্রহীন, বুঝেছিস? তার একজনে হয় না, চৌদ্দজন লাগে।’

এতটুকু বলেই সে থামল। নিজেকে বাঁচাতে আরাভের কাছে চরম সত্যি কথাটা লুকিয়ে গেছে বেশ কায়দা করে। বলতে গিয়েও বলা হয়নি পৌষী তাকে কখনই পছন্দ করেনি, না কখনও ভালোবেসেছে। উল্টো তাকে শাসিয়ে গেছে দিনের পর দিন। তবে একবার অকপটে স্বীকার করেছিল তার কাছে, সে বিবাহিত। তার স্বামী আছে। সে স্বামী না’কি খোদ আরাভই। সাফওয়ান একটা জিনিস তখনই ভালোই বুঝেছিল, এই আরাভের জন্যই পৌষী তার হয়নি। তাই তো আরাভকে হিংসে হত তার। কিন্তু এই চরম সত্যিটা সে লুকিয়ে গেছে তার পরিচিত বন্ধুদের কাছেও। ঈর্ষান্বিত হয়ে ইচ্ছেকৃত একটা মিথ্যে রটিয়েছে। পৌষী তাকে চিট করেছে। এতে যে সে তৃপ্তি পায় তা কিন্তু নয়। বরং রাগ হয়, ঘৃণা হয়। পৌষী কেন তার হয়নি। সে কেন আরাভ হতে পারেনি। তাহলে হয়ত পৌষী আজ তার হত। কত কিছুই সে ভেবেছে। কিন্তু আরাভকে বিপরীত কিছু বলে কেন যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল মনে মনে। তবে সত্যিই তার কষ্ট হয় পৌষীর জন্য।

মস্তিষ্ক টগবগ করছে জলন্ত লাভার মত। এমন অপবাদ সহ্য হল না আরাভের। যদি সম্ভব হত তবে সে মোবাইলের ভেতর প্রবেশ করে সাফওয়ানের কন্ঠস্বর চেপে ধরত। কিন্তু আফসোস, তা সম্ভব নয়। তবে হাল ছাড়েনি। কথার পৃষ্ঠে সেও জবাব দিয়েছে বেশ শক্ত গলায়।

‘চরিত্রহীন বলেই সে তোর মত রাতারাতি প্রেমিক বদলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করেনি। কখনো হাতেনাতে অন্য পুরুষের সাথে কট খায়নি। তোর কারণেই তোকে ছেড়ে দিয়েছে সে। তুই রাত কাটাস এক মেয়ের সাথে আর বিয়ে করিস অন্য মেয়েকে। নর্দমার নোংরা জলে পতিত হওয়া ফুলেল চরিত্রের সুপুরুষ তুই, যে অন্যের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে আসিস। পারলে নিজের বউকে পোশাকের মত প্রেমিকা বদলানোর গল্পটা বলিস। চরিত্রের কেমন সার্টিফিকেট দেয় তোর বউ, তখন দেখিস।’

সাফওয়ানের ফিরতি জবাবের অপেক্ষা সে আর করেনি। কল কেঁটে দিয়েছে মুহুর্তে। আরাভের সমস্ত শরীর ক্ষোভে ফুঁসছে। তার পৌষমাস এতটাও নির্লজ্জ নয়। কিন্তু তাদের সম্পর্কের ভাঙ্গনের কারণ তার অজানা। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এই সাফওয়ান তার পৌষমাসকে একদমই সুখে রাখতে পারত না। এমন চরিত্রের পুরুষ খুব ভয়ংকর হয়। কিন্তু তার পৌষমাস কি সত্যি সাফওয়ানকে ভুলে গেছে? তার জীবনে কি আর কেউ এসেছে এখন। মুখের কোণে তার বিদ্রুপের হাসি। নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করল। তোমার পৌষমাস যাকে ভালোবাসুক, তাতে তোমার কি? তোমাকে তো আর ভাসে না।

চলবে,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ১৮.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে ধরণীবুকে। চাঁদের আলোয় রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের সমাপ্তি ঘটেছে। উজ্জ্বল আলো দৃশ্যমান। তবে এত জ্বলজ্বল আলোর মাঝেও চৌচালা টিনের ঘরে যেন আঁধার নেমেছে। সবার চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকন্ঠার ছাপ। সবার চিন্তার বড় কারণ আরাভ ঘরে নেই। সেই দুপুর থেকেই গায়েব। মুঠোফোনও বন্ধ সেই তখন থেকেই। যোগাযোগের অন্য উপায় নেই। এই অচেনা গ্রামের তার কিছুই জানা নেই। যেকোন বিপদ উৎপেতে আছে। যদি বড় কোন বিপদে পড়ে থাকে ছেলেটা। ঘরের মধ্যে সবাই জড়ো হয়ে বসে আছে। কিন্তু গৌরব বসে নেই। সে খুঁজতে বেরিয়েছে বহু আগেই। সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বের হয়েছে, সে অবশ্যই আরাভকে নিয়েই ফিরবে। চিন্তার কোন কারণ নেই।

আলিশবা ছেলের শোকে পাথর হয়ে আছে। বড্ড ভয় হচ্ছে তার। তার ছেলেটার হুট করে কি হল? তিন বছর আগেও তার ছেলে এমন সব কাজ করত। হুটহাট গায়েব হয়ে যেত। খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে তার বাবা ঘরে ফিরত তখন। শেষে আরাভকে নদীর তীরে, লেকের ধারে ঘুমন্ত পাওয়া যেত। আবার মাঝেমধ্যে হাতের মাঝে জলন্ত নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে দেখত নির্জন নদীর তীরে। কিন্তু তার বাবাকে দেখলে নদীতে ফেলে দিত সঙ্গে সঙ্গে। তার বাবা এসব দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত তখন। ছেলের শোকে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরত। কত রাত ঘুমায়নি সে। ছেলের জন্য আফসোসে মরত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলত, আমার ছেলেকে মানুষ করতে পারেনি আরাভের মা। ছেলেটা দিন দিন নেশাখোর হয়ে যাচ্ছে। দিনের চব্বিশ ঘন্টার মাঝে বিশ ঘন্টায় নিকোটিন উড়াতে দেখি। হঠাৎ করে আমার এত শান্ত-গম্ভীর ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেল কেন? কি পাপ করেছি আমি আরাভের মা, বলতে পারবে?

আলিশবা তখন নিশ্চুপ চোখের জল ফেলত। স্বামীকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা তারও জানা নেই। আজও মনটা কু গাইছে। তার ছেলে আবারও সেই আরাভ হয়ে যাবে, না’কি কোন বিপদে পড়ল? নীরবে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়ালো তার। উৎকন্ঠা আর অস্থিরতায় বিমূঢ় হয়ে আছে।

রুমের দরজা বন্ধ করে চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে আরিবা। তার মায়ের এমন অস্থিরতা দেখে বিরক্ত হল কিছুটা। সামান্য দূরত্ব রেখে মায়ের সামনে মুখ ফসকে বলল,

‘আম্মু এমন করে কেঁদো না’তো। তুমি জানো, তোমার ছেলে এমনই। কাউকে কিছু না বলে হুটহাট গায়েব হয়ে যাওয়া তার স্বভাবগত অভ্যাসের মধ্যে একটা। পুরাই খচ্চর একটা।’

আলিশবা চোখ তুলে তাকাল মেয়ের দিকে। কড়া করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শুধু। মনে মনে ছেলের জন্য প্রার্থনায় করছে এখন। আরিবা সুযোগ পেয়ে ফের বলে উঠল,

‘শোন আম্মু, অতিরিক্ত আদরের নমুনা হচ্ছে তোমার ছেলে। আমি হইলে পিটিয়ে পিঠের ছাল উঠাই নিতাম। আফসোস আমারে দুনিয়ায় নিয়ে আসছো তার পরে। নয়ত বড় বোন হওয়ার সুযোগে ওরে আমি প্রতি ঘন্টায় উত্তম মাধ্যম দিতাম।’

মুহুর্তে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আলিশবার। ধমক দিয়ে বলল,
‘এসব কেমন কথাবার্তা? বড় ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় তার জন্য দোয়া করবে তা না। বসে বসে তার নামে মন্দ কথা বলছো। এগুলো ভালো না কিন্তু।’

আরিবা কিছুসময়ের জন্য চুপ করে বসল। কিন্তু পরক্ষনে বলে উঠল,
‘তোমার ছেলের মনে কি চলছে, সেটা তো সেই ভালো জানে। কাউকে যদি না বলে বুঝব কীভাবে তার মনের কথা? এভাবে নিরুদ্দেশ না হয়ে বলতে তো পারত? কিন্তু না, সেটা তো তোমার ছেলে করবে না।’

‘এমন ও তো হতে পারে, আরাভের সত্যিই কোন বিপদ হয়েছে? তাই কাউকে জানাতে পারেনি।’

আরিবা কিছুটা বিচলিত হল। বিপদ হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে এই মুহুর্তে তার ভাই ফিরে আসুক জলদি এটাই চায় সে।

সাদা বাতির আলোতে ঔজ্জ্বল্যময় সারাঘর। কোথাও অন্ধকারের ছিঁটেফোঁটা নেই। তবু যেন গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত তার রুম। চোখমুখে তীব্র বিষাদ আর নীলচে বেদনায় আহত বক্ষপাজর। সব আছে, তবুও যেন কিছুই নেই। আকসা বারান্দায় বসে আছে সেই সন্ধ্যা থেকে। শীতের তীব্রতাও আজ তাকে কাবু করছে না। সে ছন্নছাড়ার মত বসে আছে আনমনে। আকাশের বুকে শুভ্র চন্দ্রিমা। তার আলোতেও আজ কোনো আকর্ষণ খুঁজে পেল না। সে আছে নিজের মর্মদহনের তিক্ত বেদনা নিয়ে। কি হবে তার? এটাই কি চূড়ান্ত সমাপ্তি? সে কি হেরে গেল। তার বিদায় ঘন্টা কি বেজে গেছে তবে। কত প্রশ্নই তো ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্ক জুড়ে।

তার পরিবারের এখনো অজানা আরাভ কেন চলে গেছে? কিন্তু সে জানে, হয়ত এটাই অন্তিম অধ্যায় তার জীবনে। আরাভ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর ফিরবে না।
__

নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলা। আশেপাশে দোকানপাট, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পার্কগুলোও দেখা হয়েছে। কিন্তু কোথাও খোঁজ পায়নি এখনো, আরাভের মুঠোফোন বন্ধ। এভাবে কাউকে খোঁজ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে এসবের মাঝে গৌরব এখনও সন্দিহান। হুট করে তার ছেলের গায়েব হয়ে যাওয়াটা মানতে পারছে না। কি এমন কারণ হতে পারে? মস্তিষ্ক জুড়ে নানান প্রশ্ন ছুঁড়ল সে। ঘুরে ঘুরে মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওরে এল। এত সুবিশাল হাওর, এখানে নিজের ছেলেকে আদৌও খুঁজে পাবে কি’না সন্দেহ। তবু্ না চাইতেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল। হাওরের আশেপাশে খুঁজল। এখানে পর্যটকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। তাই শুরুতেই গেল সেই স্থানগুলোতেই। ঘুরতে ঘুরতে চোখ পড়ল এক অযাচিত স্থানে। নিজের পায়ের গতি বাড়িয়ে ছুটল সেখানে। যা দেখল, তাতে অবশ্যই চমকায়নি সে।

হাওরের পাড়ে বেঞ্চে আধা-শোয়া বসে আছে আরাভ। হাতের আঙ্গুলের মাঝে ধোঁয়ায় উড়াতে থাকা নিকোটিন। এক টান মেরে তা আবার আকাশে ছেড়ে দিচ্ছে। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি তার আকাশপানে। যেন কিছু একটার জন্য অভিযোগ জানাচ্ছে। গৌরব গলা খাঁকারি দিয়ে ছেলের পাশে বসল। আরাভ নিজের বাবাকে দেখে বিচলিত হল বেশ। দ্রুতই জ্বলতে থাকা নিকোটিন ছুঁড়ে ফেলল নিচে। চোখেমুখে তীব্র হতাশার ছাপ। গৌরব অবাক হয়নি। এমনটা আগেও দেখেছে। তবে কারণটা আজও জানা হয়নি। কিন্তু আজ কি তার ছেলে একবার তাকে জানাবে? ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘তিন বছর আগেও নিজেকে এভাবে নিকোটিনে ডুবিয়ে রাখতে। আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি তার কারণ, কিন্তু তুমি মুখ ফুটে কিচ্ছু বলনি। তবে আজকে আমি জানতে চাইব না তার কারণ। শুধু বলব, কেন নিজেকে এত পোঁড়াচ্ছো?’

আরাভ মাথা নিচু করে বসে আছে। গলার স্বর কাঁপছে তার। ভেতর থেকে শব্দগুচ্ছ বের হতে চাইছে না। হা করে নিঃশ্বাস ছাড়ল শেষে। বলে উঠল,
‘পাপাহ, আমি তাকে ছাড়তে পারব না।’

গৌরব চট করে জবাব দিল,
‘একটা গল্প শুনবে। আমার নিজের গল্প। জানো, আমি প্রথম যখন তোমার মা’কে প্রপোজ করি, তোমার মা সঙ্গে সঙ্গে রিজেক্ট করেছিল। তোমার মায়ের জন্য ভার্সিটির অজস্র ছেলে পাগল ছিল। ভাবছো, তোমার মা সুন্দরী বলে হয়ত তাকে পছন্দ করত সবাই? কিন্তু বিষয়টা আসলে তা নয়, তোমার মা সুন্দরীর সাথে সাথে বেশ পর্দাশীলও ছিল। খুব সহজলভ্য ছিল না তার মুখ দেখা। সবসময় নিজেকে বোরকায় আবৃত রাখত। একদিন পানি খাওয়ার ছলে তোমার মায়ের মুখ দেখেছিলাম। কিন্তু মুখ দেখার আগে থেকেই আমি তাকে পছন্দ করতাম। হয়ত ছায়ার মতই অনুসরণ করতাম বলে আমি সফল ছিলাম মুখ দেখার জন্য। তবে তোমার মা আমাকে বহুবার রিজেক্ট করেছে। কিন্তু আমি কখনো দমে যায়নি। সে আমাকে ভালোবাসে না জেনেও তাকে আমি সবকিছু থেকে আগলে রাখতাম। কেউ তার দিকে তাকালেই আমি সেই ছেলেকে মেরে আসতাম। কত অভিযোগ আসত রোজ আমার নামে। শেষে এক প্রকার আমাকে ভার্সিটি থেকে বের করার নোটিশও আসে। কিন্তু সেদিন তোমার মা এসে আমাকে বাঁচিয়ে নেয়।

প্রায় দু’বছর পর তোমার মা আমার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তবে শর্ত ছিল তাকে আগে বিয়ে করতে হবে। কারণ সে হারাম সম্পর্কে বিশ্বাস করে না। তারপর সেই থেকে আমাদের বৈবাহিক জীবনের এই আটাশ বছর পার করে ফেলেছি। শুধু ভালোবাসলে হয় না আরাভ, ভালোবাসার মানুষকে রক্ষাও করতে হয়। তার কাছে ভালোবাসাও প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু তুমি তাকে না ভালোবাসার কথা বলেছো, না তাকে রক্ষা করেছো। উল্টো তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো?’

আরাভ ফোঁস বলে উঠল,
‘কিন্তু সে তো আমাকে ভালোবাসেনি।’

‘কিন্তু তুমি বলেছো, তুমি ভালোবাসো তাকে? এখনো সময় আছে আরাভ, ভেবে দেখ। তুমি কিন্তু ভুল করেনি, অন্যায় করেছো তার সাথে। সবচেয়ে বড় কথা, তুমি কার কাছে রেখে গিয়েছিলে তাকে? একজন ব্যক্তিত্ববান পুরুষ কখনো নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষের কাছে রেখে যায় না। বরং নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করে পরপুরুষের নজর থেকে।’

আরাভ চমকে উঠল নিজের বাবার কথা শুনে। তবে কি তার পৌষমাসকে নিজের কাছে রাখা উচিত ছিল। তাকে বলা উচিত ছিল সে তাকে ভালোবাসে। তার পৌষমাস কি তাকে মেনে নিত তখন। সে আর ভাবতে পারল না। উঠে দাঁড়াল কিছু না বলে। বাবাকে এক পলক দেখে হনহনিয়ে বের হতে উদ্বত হল সে।

গৌরব জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

আরাভ পিছু না ঘুরে জবাব দিল, ‘বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে যাই পাপাহ, দোয়া কর।’

গৌরব বিড়বিড় করল, বড্ড দেরি করে ফেলেছো বাপ। তবে দোয়া করি সফল হও।

চলবে,,,,