প্রিয় পৌষমাস পর্ব-১৯+২০

0
154

#প্রিয়_পৌষমাস ১৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

কয়েক বিঘা জমি জুড়ে আকসাদের সুবিশাল বাড়ি। তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে গ্রামের অন্যান্য বাড়িগুলো। একপাশে তাদের ফলের বাগান, অন্যপাশে বিশাল পুকুর। বাগান পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। রাত হলে এখানে নীরবতা যেন জেঁকে বসে থাকে। তখন অদ্ভুত এক ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তবে এখন চাঁদের আলোতে সেই অনূভুতি কিছুটা লাগব হয়েছে। চারদিকে চাঁদের উজ্জ্বল আলো, পুকুরের স্বচ্ছ জলেও সে আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। সেই দৃশ্য নজর কাড়ছে আরাভের। তনুমন পুলকিত হল বেশ। হুট করে ভাবল অনেক কিছুই, এমন রাতে সে তার পৌষমাসকে নিয়ে পুকুর পাড়ে বসবে। কাঁধে মাথা রেখে দু’জনে চন্দ্রবিলাশ করবে। একে অপরের মনের সব অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করবে। ভাবতেই অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তার।

ঘড়ির কাটায় রাত এগারো ছুঁই ছুঁই। রাত বাড়ার সাথে সাথে শীতের প্রকোপও বেড়ে চলেছে। ঠান্ডায় কিছুটা কাঁপছে তার শরীর, তার উপর গা ছমছমে ভাব। আরাভ এসব কিছুর তোয়াক্কা না করেই বাড়িতে প্রবেশ করল। ভেবেছিল, অনেক রাত হয়েছে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশব্দে পা রাখল ঘরের ভেতর। দরজায় করাঘাত করতেই মুহুর্তে হাট করে দরজা খুলে গেল। বসার ঘরে তখন সবাই উপস্থিত। আরাভ পুরাই অবাক। সবার চোখেমুখে কেমন আতঙ্কের ছাপ। অথচ তার দিকে শান্ত দৃষ্টি ফেলছে সবাই। আকসা পর্দার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্টই। এত কিছুর ভীড়েও তার মন পৌষমাসকে খুঁজে যাচ্ছে। সবাই উপস্থিত হলেও তার ছোট পাপাহ আর ছোট আম্মু নেই এখানে। পৌষীও গায়েব। মেয়েটা বড্ড রাগ করেছে তার উপর। নিশ্চয় তার রুমে শুয়ে আছে। অবশ্য তার উপর রাগ করা ফরজ। সে একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করেছে তার উপর। এমনটা না করলেও পারত সে। নিশব্দে বক্ষস্থল থেকে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল।

আলিশবা ছেলেকে দেখে দ্রুতই বসা থেকে উঠে এল। হাউমাউ করে কেঁদে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। আরাভ মায়ের মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিল, ‘কেঁদোনা আম্মু। আমি ভালো আছি তো। শুধু শুধু এত দুঃচিন্তা কেন কর তুমি।’

আলিশবা কান্না ভেজানো গলায় বলল, ‘এমন করো কেন বাবা? এভাবে কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছিলে। মায়ের কি দুশ্চিন্তা হয় না।’

আরাভ জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। হুট করে দরজার চৌকাঠ থেকে গৌরবের দৃঢ় গলার জবাব এল,
‘তোমার ছেলে হাওরে ঘুরতে গিয়েছে। কিন্তু তার ফোনে চার্জ নেই এটা তার মাথায় ছিল না। কাউকে বলারও প্রয়োজন মনে করেনি। কতটা কেয়ারলেস তোমার ছেলে ভাবো, আলিশবা।’

আলিশবা এবার ছেলেকে ভালো করে পরখ করল। সে জানে গৌরব তাকে মিথ্যা বলছে। তার ছেলের কিছু তো অবশ্য হয়েছে। কিন্তু ঘরভর্তি এত মানুষের সামনে নিজের ছেলেকে কীভাবে জিজ্ঞেস করবে। তাই শান্ত হয়ে গেল মুহুর্তে। ভেজানো গলায় বলে উঠল,
‘আর কখনো এমন করো না বাবা, বিপদ সব সময় উৎপেতেই থাকে। কখন কীভাবে বিপদ আসবে টেরই পাবে না তখন। এত কেয়ারলেস হলে কীভাবে চলবে, বল?’

কিছুটা থেমে ছেলেকে পুনরায় বলে উঠল, ‘যাও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো। খেয়ে কিন্তু জলদি শুয়ে পড়বে। অনেক রাত হয়ে গেছে।’

আরাভ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। তবে তার দু’চোখ এদিক ওদিক বুলালো। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। সবার দৃষ্টি তার উপর তখনও। আকসার বাবা-মা কেমন সন্দিগ্ধ দৃষ্টি বুলাচ্ছে তার উপর। কিন্তু লজ্জায় হয়ত কিছু জিজ্ঞেস করছে না। বেশ দোটানায় ভুগছে তারা। আকসা বাবা-মায়ের এমন অভিব্যক্তি বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু তার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ নেই, শুধু হতাশায় দগ্ধ সে। তার অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেছে। কাল সকালে আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে হয়ত।

খাবার টেবিলে বসেও উশখুশ করছে আরাভ। মা’কে মিনমিন করে বলল,
‘আম্মু, ছোট পাপাহ, ছোট আম্মুকে দেখলাম না, তারা কোথায়?’
আলিশবা দম ফেলল নিশব্দে। বলল, ‘আছে, ঘুমাচ্ছে হয়ত।’

আরাভ ভীষণ অস্থিরতায় ভুগল। নিজের খাবারটা কোনোভাবে সাবাড় করে নিল। হাত ধুতে ধুতে মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আম্মু শুয়ে পড়। আমার জন্য আর দুশ্চিন্তা কর না। আমি ভালো আছি কিন্তু।’
তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল খাবার টেবিল ছেড়ে। আলিশবা চেয়ে আছে অপলক। তার ছেলে আকসার রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। এত রাতে কি প্রয়োজন সেটা তার বোধগম্য নয়।

আরাভ রুমের দরজায় করাঘাত করল। আকসা মাত্রই শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দরজা খুলতেই সে কিছুটা অবাক হল। ভেবেছিল, হয়ত তাকে কিছু বলবে। কিন্তু আরাভ অকপটে বলে উঠল, আমি ভেতরে যাব। আকসার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল মুহুর্তে। হঠাৎ করে তার রুমে কি জন্য প্রবেশ করবে। তাকে জরুরী কিছু বলার আছে না’কি? সে কিছু বলার আগেই আরাভ দরজা ঢেলে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে এসে সারারুমে চোখ বুলিয়ে পৌষীকে খুঁজল। না পেয়ে বলে উঠল,

‘পৌষী কোথায় আকসা?’

আকসা এবার তাজ্জব বনে গেল। তার রুমে এসে তার হবু বর অন্যকে খোঁজে। চোখমুখে তীব্র কৌতূহল তার। তবু শান্ত গলায় বলল,
‘যদি ভুল না হই, তোমার প্রিয় মানুষ আর পৌষমাস ঐ একজনই তাই না, আরাভ।’

‘হুমম, একজনই। এখন সে কোথায়? একটু ডেকে দাও। তার সাথে কথা আছে আমার।’

‘কি কথা আরাভ, আমাকে বলা যাবে?’
আরাভ বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকালো। বলল,
‘প্লিজ, পৌষীকে ডাকো। বিষয়টা তাকে নিয়েই।’

আকসা শান্ত হয়ে বিছানায় বসল। তারপর আরাভের দিকে স্থিরদৃষ্টি রেখে বলল,
‘নেই, চলে গেছে।’
‘চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে?’
‘তোমাদের বাড়িতে, ফেনী চলে গেছে।’
‘কখন গেছে?’
‘যখন তুমি গায়েব ছিলে? বিকেল ছয়টার ট্রেনে উঠেছে তারা।’

নির্বাক-ধূসর দৃষ্টিতে তাকাল আকসার দিকে। মুহুর্তে কি হল কে জানে, আরাভ রুম থেকে বেরিয়ে গেল হুট করে। আকসা পিছু ডাকল। কিন্তু আরাভ তার সেই ডাকে কর্ণপাত করেনি। আকসা উপায় না পেয়ে গৌরবকে ডাকল। কিন্তু ততক্ষণে আরাভ বাড়ির উঠোন বেরিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যাচ্ছে। গৌরব বেরুলো কিছু সময় বাদে। নিজের পায়ের গতি আরও বাড়াল। শীতের তীব্রতা ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। আরাভ এসব নিয়ে না ভেবেই ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যই। গাড়ি বিহীন বেশিদূর পা চালাতে পারল না। গৌরব খপ করে পেছন থেকে ধরে নিল। আরাভ কিছু বলার আগেই কষে একটা চড় বসালো তার বাম গালে।

আরাভ অবাক হল কিছুটা। গৌরব ধমক দিয়ে উঠল তাকে,
‘কোথায় যাচ্ছ এত রাতে? ঘড়িতে সময় দেখেছো? এটা কানাডা নয়, তুমি চাইলে যখন তখন যেদিকে খুশি চলে যেতে পারবে।’

আরাভ ছোট্ট করে বলল, ‘পাপাহ আমাকে যেতে দাও, প্লিজ।’

গৌরব বলে উঠল, ‘এখন মধ্যরাত আরাভ, তুমি ট্রেন পাবে না, আর না কোন দূরপাল্লার গাড়ি পাবে। ভোর পাঁচটার ট্রেন আছে, আমি নিজেই তোমাকে পৌঁছে দেব। পাগলামি না করে এখন বাসায় চল।’

আরাভ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। গৌরবের মেজাজ চটল কিঞ্চিৎ। কোপিত কন্ঠে বলল,
‘এই কাজটা যদি আগে করতে তাহলে আজকে এই দিন দেখতে হত না। আমাদেরও মাথা নীচু করে রাখার প্রয়োজন ছিল না। ওয়াদা ভঙ্গ করার মত কষ্ট বোধহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টিও নেই। সে যাই হোক, হাতে চার ঘন্টা সময় আছে এখনো। তুমি ঘুমিয়ে নাও। আমি নিজে গিয়ে তোমাকে পৌঁছে দেব কিন্তু, প্রমিজ করছি।’

আরাভ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার সাথে বাড়িতে ফিরল। আকসা তখন বারান্দায় দাঁড়ানো। চুপচাপ দেখে যাচ্ছে শুধু আরাভের জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড। আলিশবা মুখে কাপড় গুজে কাঁদছে। রাত-বিরেতে তার ছেলের এমন পাগলামি বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। আরাভ রুমে ফিরে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। কখন ভোর হবে। সে ফেনীর উদ্দেশ্য রওনা দিবে। তার যে অনেক কথা জমে আছে।
___

ঘুমন্ত শহর, মাঝে মধ্যে দু’একটা গাড়ি চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে শুধু। কিছু সময়ের মাঝে সৌরভদের ট্রেন ফেনীতে প্রবেশ করবে। চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখছে সে। প্রিয়ার ঘুম ভাঙ্গতেই সৌরভের দিকে নজর পড়ল তার। সৌরভ নিজের সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েকে দেখছে অপলক। পৌষী উপরের সিটে ঘুমে চৈতন্যহীন। প্রিয়ার চোখমুখে ঘুমের রেশ কাটেনি তখনও। সৌরভ গা এলিয়ে তার পাশে এসে বসতে বসতে বলল,

‘প্রিয়ারানী আমার পৌষীটা কত্ত বড় হয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি এতদিন।’

প্রিয়া চুপচাপ স্বামীর কথা শুনল। সৌরভ পুনরায় বলে উঠল,
‘জানো প্রিয়ারানী, আজ আমার মেয়েটা একটা আবদার করেছে। আমি বাবা হিসেবে সেই আবদার ফেলতে পারিনি। তাই তো বেরিয়ে এসেছি আমার মেয়ের এক কথায়।’

প্রিয়া চমকালো বেশ। হঠাৎ করে এমন প্রলাপ বাক্য শুনে কৌতুহলী হল ভীষণ। সে জানে ফেনীতে বিয়ের পরবর্তী অনুষ্ঠান হবে। এজন্য তারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ফিরেছে। কাল বাদে পরশু বিয়ে। বউ নিয়ে সোজা ফেনীতে রওনা দিবে আরাভ। এসব বলেই তো সৌরভ হুলুস্থুল করে সেই বাড়ি থেকে বের হল তখন। কিন্তু এখন এসব কি বলছে সে? সে হা হয়ে আছে। বাকি কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে।

সৌরভ পুনরায় বলে উঠল, ‘বিকেল বেলায় হুট করে আমার মেয়ে আমার পায়ের কাছে বসে বলল, কিছুদিন আগে আসা আমার জন্য সেই ডাক্তার পাত্রকে আমি বিয়ে করতে রাজি পাপাহ। আগে আমি দ্বিমত করেছিলাম। কিন্তু এখন আর দ্বিমত করব না পাপাহ। তবে আমার একটা শর্ত আছে, আজ এবং এক্ষুনি ফেনীতে ফিরতে হবে কিন্তু আমাদের। পাপাহ, এইটুকু আবদার রাখবে আমার।’

সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শব্দ করে। ফের বলল, আমার চঞ্চল মেয়েটা বড্ড শান্ত হয়ে গেছে। কখনো আমার কাছে কোন আবদার করেনি, কিন্তু আজ একটা আবদার করেছে। তাই সেই আবদার অপূর্ণ রাখতে চাইনি, প্রিয়ারানী।’

প্রিয়ার শান্ত মস্তিষ্ক হুট করে জ্বলন্ত লাভায় পরিণত হল। তাকে একটা বার জানানোর বা বলার কি দরকার ছিল না। সব সময় মনমর্জি হলে কি হবে? সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। সৌরভের উপর সে আপাতত ক্ষুব্ধ। কথা বলার ইচ্ছে নেই। তাই জবাব দিল না কিছুই।

চলবে,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ২০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

মধ্যাহ্নের দ্বিপ্রহর। ঘড়ির কাটা দুপুর দেড়টার মাঝামাঝি। শীতের দুপুরেও রোদের আলো উষ্ণতা ছড়াচ্ছে বেশ। গোসল সেরে টিভিতে খবর দেখছে সৌরভ। প্রিয়া রান্নাঘরে টুকটাক কাজে ব্যস্ত তখনও। খিদেয় পেট ছোঁ ছোঁ করছে তার। পরক্ষণেই নিজের বউকে ডাক দিল, প্রিয়ারানী কাজ শেষ হলে খাবার দাও। খিদে পেয়েছে কিন্তু। প্রিয়া আচ্ছা বলে ফিরতি জবাবও ছুঁড়ল। দু’জন ছাড়া এ ঘরে আর কেউ নেই। পূর্ণী নেত্রকোণায় রয়ে গেছে। পৌষী তার ঘরে। ঘর জুড়ে নিরবতা বিরাজমান। সহসাই কলিংবেলের কর্কশ শব্দ হল। কিঞ্চিৎ অবাক হল সে। এ ভরদুপুরে কে এল আবার? কিন্তু দরজা খুলে যা দেখল তার চক্ষু চড়কগাছ। অবিশ্বাস্য নজর দিল সেই দিকে। উষ্কখুষ্ক চুল আর ফোলা দু’চোখ। গায়ে শীতের জ্যাকেট এখনো জড়ানো। উদ্বাস্তুর মত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাভ। কত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। অথচ ক্লান্তিহীন দু’চোখে তার বড্ড অসহায়ত্ব। আকুলতা যেন তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। এত মায়াময় দু’চোখ দেখেও না দেখার অদৃশ্য ভান করল সে। বলে উঠল,

‘তুমি এই সময়?’

আরাভ ঘাবড়ালো না। অকপটে বলল, ‘ভেতরে আসতে বলবে না।’
সৌরভ বলল, ‘আসো।’

আরাভ ভেতরে প্রবেশ করেই সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘পৌষী কোথায় ছোট পাপাহ?
সৌরভ চাপা কষ্টে জর্জরিত। অথচ চোখমুখ ভীষণ শান্ত দেখাল তার। বলল,
‘কেন?
‘ওকে ভীষণ প্রয়োজন, ওর সাথেই আমার কথা আছে।’

সৌরভ যেন কিছুটা বিরক্ত হল। রুষ্ট হয়ে জবাব দিল, ‘তাকে আবার তোমার কি প্রয়োজন?,,
আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। দেখল আরাভ ততক্ষণে পৌষীর রুমের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। তার কথার পৃষ্ঠে জবাব দেয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। আরাভের এমন বিরূপ আচরণে ভাবনায় পড়ে গেল সে। পিছু ডাকল, তুমি ঐদিকে কোথায় যাচ্ছো?’
‘পৌষীর রুমে যাই ছোট পাপাহ।’
আরাভের সোজাসাপটা জবাব এল।

সৌরভ যেন কানে কম শুনল। আরাভের আকস্মিক আগমন, আবার রহস্যময় আচরণ। কেমন সন্দেহ ঠেকল তার কাছে। সে আরাভের পিছু নিতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল। সেও চায় কারণ উন্মোচন হোক, আরাভের উদ্দেশ্য তার জানা দরকার।

দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল আরাভ। পৌষীর রুম জনশূন্য, তার অস্তিত্বও নেই এখানে। পুরোদস্তুর অবাক হল। এই ভরদুপুরে কোথায় গেল আবার? ওয়াশরুমের দরজা আগে থেকেই বন্ধ। অগত্যা বারান্দা দেখল, সেখানে তন্নতন্ন করে খুঁজল। খাটের তলায়ও চোখ বুলালো। কোথাও তার ছায়াও খুঁজে পেল না। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে ভাবল। শেষে ছুটল অন্য ঘরগুলো দেখার জন্য। সবগুলো ঘর খালি পড়ে আছে। না কোথাও নেই তার পৌষমাস। হঠাৎ করে কোথায় লুকালো মেয়েটা?

আরাভের এত ছোটাছুটি দেখে প্রিয়া যেন অবাকের শীর্ষে। দম ফেলারও সময় নিচ্ছে না। এত কি খুঁজে ছেলেটা। এভাবে হুট করে নেত্রকোনা থেকে কেন ফিরে এসেছে? সে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবাজী, কি খুঁচ্ছো এত?
সব রুম খুঁজেও পৌষীকে না পেয়ে প্রিয়ার কাছে গেল আরাভ। বলে উঠল,
‘ছোট আম্মু, পৌষী কোথায়?’
প্রিয়া আরও অবাক হল। মেয়েটা তো তার রুমেই ছিল। আরাভ কি তবে পৌষীকেই খুঁজে যাচ্ছে এতক্ষণ। কিন্তু কেন? ফিরতি জবাব দিল,
‘পৌষী তার রুমে নেই?’
‘না, ছোট আম্মু।’
‘কিন্তু, সে’তো রুমেই ছিল। ভালো করে খুঁজে দেখ।’

আরাভ ফের একবার পৌষীর রুমে চোখ বুলালো। কিন্তু মেয়েটা কোথাও নেই। হতশ্রী মুখ নিয়ে প্রিয়ার সামনে আবারও হাজির হল। প্রিয়া তখন টেবিলে খাবার পরিবেশন করছিল। আকুতি নিয়ে বলে উঠল,
‘ছোট আম্মু, বল না পৌষী কোথায়?’
‘তাকে কেন খুঁজে যাচ্ছো এত?’
‘ছোট আম্মু, প্লিজ কারণটা পরে বলছি। আগে বল তোমার মেয়ে কোথায়?’

প্রিয়া হতাশার সুর তুলল মুখে। বলল, ‘ও সত্যিই রুমে ছিল। আবার খুঁজে দেখ।’
আরাভ দু’হাত কোমরে রেখে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করে আকুলতার সুর তার গলায় ভেসে এল,
‘ছোট আম্মু, বল না তোমার মেয়ে কোথায়? ওর সাথে আমার অনেক কথা জমে আছে। অনেক কিছু বলার আছে। প্লিজ বল না।’

‘আমি তো ওকে রুমেই দেখেছি। এখন কোথায় গেছে? আমি সত্যি জানি না। তুমি বস, খাবার খেয়ে নাও। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সকাল থেকেই অভুক্ত আছো।’
‘কিন্তু আমার খিদে নেই, ছোট আম্মু।’

প্রিয়ার ডাকে সাড়া না দিয়ে আরাভ ফের পৌষীর রুমে প্রবেশ করল। প্রিয়া হতবাক। কিন্তু পুনরায় জিজ্ঞেস করল না আর। সৌরভ চেয়ার টেনে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। প্রিয়া আরাভের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু সৌরভ শুনতে নারাজ। প্রিয়াকে থামিয়ে দিল তার আগেই।

আধ-ঘন্টা পেরুলো, পৌষীর রুমে বসে আছে আরাভ। অথচ যার জন্য অপেক্ষা করছে সেই ব্যক্তি উধাও। কোথায় আছে তাও সে জানে না। পুনরায় প্রিয়ার কাছে ফিরে এল। কিন্তু প্রিয়া আগের মতই একই জবাব দিল। শেষে অগত্যা সৌরভের কাছে আকুতি মিনতি করল পৌষী কোথায় জানার জন্য। সৌরভ তার কথায় কর্ণপাত করল না, না জবাব দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করল। সে নিজের কাজেই ব্যস্ত। আরাভ হার মানার পাত্র নয়। সে সৌরভের কাছে ফের মিনতি করল। সৌরভ এবার কিঞ্চিৎ বিরক্তিবোধ প্রকাশ করল। বলল,

‘ফিরে যাও আরাভ, আজ বাদে কাল বিয়ে তোমার। এখন এসব পাগলামি মানায় না তোমাকে।’

‘বিবাহিত লোকের আবার কিসের বিয়ে ছোট পাপাহ?’
সৌরভ বাক্যহীন, জবাব দিল না আর। কিন্তু আরাভ থেমে নেই। বলল,

‘তুমি পৌষীকে লুকিয়ে রেখেছো, তাই না ছোট পাপাহ। কিন্তু কতদিন লুকাবে আমার থেকে। আমি তাকে ঠিক খুঁজে বের করব। হয়ত আমার অনেক ভুল ছিল, অন্যায় করেছি। কিন্তু তুমিও তো কম অন্যায় করনি আমার সাথে। শৈশব থেকে কৈশোর, কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে দাওনি, তাদের আশেপাশেও ঘেঁষতে দাওনি। তীক্ষ্ণ নজরে রেখেছিলে আমাকে। কারণ তুমি চাওনি দ্বিতীয় কেউ আসুক আমার জীবনে। তোমার মেয়েকেই যেন নিজের মস্তিষ্কে রেখে দেই সারাজীবন। কিন্তু, যৌবনে পা রাখতেই আমার উপর রেস্ট্রিকশন জারি করলে। তোমার মেয়ের কাছাকাছি যাওয়া যাবে না, তাকে এড়িয়ে যেতে হবে। কোন প্রেম-নিবেদন করা যাবে না। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও আমি অসহায়। তুমি চাওনি আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক গড়ে উঠুক। আমি তোমার কথা রেখেছিলাম ছোট পাপাহ। কিন্তু ছোট পাপাহ, তুমি কি রেখেছিলে তোমার কথা? একবারও কি পৌষীকে আমাদের বিয়ের কথা জানিয়ে ছিলে। তাকেও কি আমার মত রেস্ট্রিকশন জারি করেছিলে। কোন ছেলের সাথে কথা বলা যাবে না। বন্ধুত্ব করা যাবে না, তুমি অলরেডি বিবাহিত। বল ছোট পাপাহ? তাহলে আজ কেন আমাকেই শাস্তি পেতে হচ্ছে? কেন সব কৈফিয়ত আমাকেই দিতে হচ্ছে।
ছোট পাপাহ, আমি তোমার মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছিলাম কিন্তু মুক্তি নই। আমার থেকে তার কোন মুক্তি নেই।’

রাগে ক্ষোভে মনের মাঝে যা ছিল, সব উগড়ে দিল আরাভ। সৌরভ প্লেটে ভাত মেখে মুখে তুলছে গ্রোগাসে। আরাভের সকল অভিযোগ শ্রবণ করল চুপচাপ। তার কথা শেষ হতেই দ্বিরুক্তি প্রকাশ করল নিজের অবস্থান থেকে। বলল,
‘আমি তোমার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম তোমাদের দু’জনের ভালোর জন্য। তোমরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলে। তখন তোমাদের মাঝে কোনরূপ বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক, আমি চাই নি। এতে পড়াশোনায় মনোযোগ হারাতে দু’জনেই। কিন্তু তার বদলে তুমি কি করেছো? পাঁচ বছর লাপাত্তা, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল বিদেশের মাটিতে। আবার ফিরে এলে অন্য এক নারী নিয়ে।’

আরাভ তাচ্ছিল্যের সুর তুলল মুখে। বলল,
‘এই বিষয়ে আমি তোমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই। আমার অনেক কিছু জানার আছে তার কাছ থেকেই। তাকেও অনেক কিছু জানানোর আছে আমার।’

‘কিন্তু তুমি বড্ড দেরি করে ফেলেছো আরাভ?’
‘বাহ! ছোট পাপাহ, আজকাল তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকো তাহলে। আগেই জামাই বাবাজী ছাড়া ডাকতেই না। বেশ উন্নতি হয়েছে তোমার।’

সৌরভ খাবারে মনোযোগ দিল। আপাতত আরাভকে নিয়ে ভাবছেন না। সন্ধ্যায় পাত্র আসবে পৌষীকে দেখতে। কথাবার্তা জমলে আজকেই আকদ করে রাখবেন। নয়ত আরাভ নতুন করে ঝামেলা পাকাবে? প্রিয়া নিজের স্বামীকে দেখে যাচ্ছে বিরতিহীন। একটা মানুষ এত দ্রুত কীভাবে পরিবর্তন হতে পারে? কোলে পিঠে মানুষ করা তার সবচেয়ে প্রিয় সেই ছোট্ট আরাভকে এত জলদি কীভাবে ভুলতে পারে? ছেলেটার কোনো কথায় সে কর্ণপাত করছে না। একটা বার খাবার খেতেও বলল না। এত নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারে? সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। কন্ঠরোধ হয়ে আসছে। আরাভকে বলল,

‘খেতে বস বাবাজী। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বস না, খেয়ে নাও।’
‘তোমার মেয়েকে খুঁজে বের করি, তারপর শান্তিতে খাবার খাব, তার আগে নয়।’

আরাভ কথা শেষ করে ঘাড় ঘুরাতেই চমকে উঠল। ঢিপঢিপ শব্দে অস্থিরভাবে কাঁপছে তার বক্ষপিঞ্জর। নিশ্বাসের গতিবেগও বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। এতক্ষণ এই মেয়েটাকে সে খুঁজে চলেছে। অথচ সে চুপচাপ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। অবশেষে তার দগ্ধ হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির আগমন হল তার পৌষমাসকে দেখে। ঠোঁটের কোণে ফুটল এক চিলতে হাসি। কিন্তু পৌষীর বিভ্রম দৃষ্টি। হয়ত এভাবে তাকে দেখবে প্রত্যাশা করেনি। সেও কিছু বলে ঘাটালো না আর। নিজেকে স্থির করল অতি দ্রুতই, নিভৃতেই দু’জনে কথা বলবে একে অপরের সাথে। তাই জিজ্ঞেস করা হল না এতক্ষণ কোথায় ছিল সে। উল্টো বলে উঠল,

‘এস একসাথে বসি। আমি এতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’

পৌষী ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এখন তার কি বলা উচিৎ। এই লোকটার বিরহে এতক্ষণ অভুক্ত থেকে ছাদে শোক বিলাস করে এসেছে। অথচ ঘরে এসে দেখছে এই লোক না’কি তার জন্য অপেক্ষা করছে। অদ্ভুত তো! উড়োজাহাজে করে এসেছে না’কি? এত দ্রুত ফেনীতে আসল কীভাবে? না’কি সে নিছকই স্বপ্ন দেখছে? স্বপ্ন ভেবে আলতো করে হেসে উঠল। আরাভ কিঞ্চিৎ অবাক হল। ভ্রু কুঞ্চন করে বলে উঠল,

‘হাসছো কেন? আমি হাসির কি বললাম?’

পৌষী পিটপিট করে তাকাল। তার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য ঠেকছে। আচমকাই বলে উঠল, ‘আরাভ ভাই তুমি কখন এলে?’
আরাভ ফের অবাক হল। বলল, ‘বইন, তুমি যখন গায়েব ছিলে তখন।’
পৌষী বেশ লজ্জা পেল। সে একবার নিজের বাবা-মায়ের উপর চোখ বুলালো। তার বাবা একটু আগে উঠে গেছে খাবার টেবিল থেকে। কিন্তু তার মা এখনো বসা। আরাভের হুট করে বইন সম্মোধন তার কেমন যেন লাগল। অবশ্য এ আর এমন কি? দু’দিন পর তো এমনিতেই সে বইন হয়ে যাবে। সহসাই মর্মদহনে পুড়ল। চেয়ার টেনে বসতেই আরাভও বসল তার পাশাপাশি। পৌষী অজান্তেই কত কিছু ভেবে চলেছে। অথচ আরাভ ভাবনাহীন। খাওয়ার মাঝে তার পূর্ণদৃষ্টি পৌষীর উপর। চুপচাপ কোনরূপ বাক্য বিনিময় ছাড়াই খাবার শেষ করে উঠল দু’জন। পৌষী চটজলদি নিজের রুমে এল। দরজা টেলে ভেতরে পা রাখতেই দেখল তার পিছু পিছু আরাভও এসে পড়েছে। অবাকের চরম শিখরে সে, তার রুমে আসছে কেন এই লোক? জড়তা নিয়ে বলে উঠল,

‘আরাভ ভাই তু,,তুমি এখানে?’

আরাভ মুখে জবাব না দিয়ে অপ্রত্যাশিত এক কাজ করে বসল। পৌষীর দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেল মুহুর্তে। নিশ্বাস নেওয়াও বন্ধ করে দিল সে। আরাভ হাসল কিঞ্চিৎ শব্দ করে। অথচ দু’চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে অনবরত। হাতের বাঁধন আর দৃঢ় করল। পৌষীর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘চোখ খোলো পৌষমাস, নিশ্বাস নাও বলছি। তাকিয়ে দেখ, আমি কিচ্ছু করেনি কিন্তু।’

চলবে,,,,,,