প্রিয় পৌষমাস পর্ব-২১+২২

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ২১.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

এখনো তব্দা খেয়ে আছে পৌষী। সাথে লজ্জায় মরমর অবস্থা। এমন অপ্রত্যাশিত কিছু স্বপ্নেও চিন্তা করেনি। চোখ দুটো নামিয়ে রেখেছে সেই কখন থেকে। আচমকা ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে এক পলকের চেয়েও কম সময়ের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেল আরাভের সাথে। এমন উদভ্রান্তের মত আরাভকে সে আর কখনো দেখেনি। কত গোছানো পরিপাটি সুদর্শন যুবক ছিল সে। অথচ আজ ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। তার অদ্ভুত চাউনি, মোহমায়ায় আচ্ছন্ন সে দু’চোখ। এ যেন অবর্ণনীয় এক অন্যরকম অনুভূতি। এমন অদ্ভুত আচরণ এই প্রথম করল বোধহয়। কোনো মৌখিক বাক্য বিনিময় ছাড়া হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরল। বুকটা ধুকপুক করছে সেই থেকে। নিশ্বাসটাও নিচ্ছে বেশ মেপে মেপে। অথচ আরাভ নিজের বাহুবন্ধনে পৌষীকে এখনো শক্ত করে ধরে আছে। কিছু মুহুর্ত পার হতেই হুট করে তার মতিভ্রম হল, সে পৌষীকে আলগোছে ছেড়ে দিল। তারপর পাশ কাটিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,

‘আমি কি তোমার বিছানায় বসতে পারি, পৌষমাস?’

কথাটা বলেও জবাবের অপেক্ষা করেনি আরাভ। তার আগেই দপ করে বিছানায় বসে পড়েছে। এমন বিক্ষিপ্ত আচরণে ফের আশ্চর্য হল পৌষী। খাটের অন্যপাশে দাঁড়ানো সে। নীচু মাথা তুলে তীক্ষ্ণনজর দিল সামনে থাকা আরাভের দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টি তার স্থায়ী হল মাত্র কয়েক পলকের জন্য। চোখে চোখ রাখা বেশ কষ্টসাধ্য হল আজ। ঐ দু’চোখ ইন্দ্রজাল জানে বোধহয়। কেমন অদৃশ্য টানে তাকে কাছে ডাকছে। সে ফের দৃষ্টি এপাশ ওপাশ করে অন্যদিকে ঘুরালো। দৃষ্টির সাথে সাথে তার গলার স্বরও আবদ্ধ হয়ে আছে। হাজার চেষ্টা করে একটা শব্দও বের হল না মুখ থেকে। এ কেমন সর্বনাশ হল তার! তবে কি আরাভ তাকে বশ করেছে? শুকনো ঢোক গিলল আরাভের দৃষ্টির অগোচরে।

এক মুহুর্তে আরাভ পুরো রুম জুড়ে চোখ বুলালো। না চাইতেই অযাচিত কিছু চোখে পড়ল। তার পৌষমাস বড্ড অগোছালো হয়ে গেছে। গায়ের পোশাক সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে বিছানায়। হয়ত স্বামী শোকে দুঃখবিলাস করতে গিয়ে আর গোছানো হয়ে উঠেনি। সে নিভৃতেই হাসল। কিছুটা এলোমেলো থাকা ভালো। মুখের কোণে অদৃশ্যমান দুষ্টু হাসি ফুটল। বলল,

‘তুমি আগের থেকে অনেক মোটা হয়ে গেছো পৌষমাস। তবে, বডি ফিটনেসের বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি। ভালোই!’

বিস্ময়ে পৌষীর চোখ গোল গোল হয়ে গেল মুহুর্তে। সে কি সত্যিই মোটা হয়ে গেছে। তার ওজন তো মাত্র ছেচল্লিশ। এটা কি সত্যিই বেশি হয়ে গেছে? কিন্তু হুট করে তার চোখ পড়ল বিছানায় অগোছালো কাপড়ের উপর। সেই কাপড়ে দৃশ্যমান একটা সংখ্যা জ্বলজ্বল করছে বেশ। নিশ্চিত এই লোক সেটা দেখেছে। লজ্জায় যেন আরও গুটিয়ে গেল সে। দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রায়। এই লোককে তাড়াতে হবে জলদি। সে হুট করে বলে উঠল,

‘আরাভ ভাই, তোমার রুমে যাও। আমি ঘুমাব।’

আরাভ দায়সারা জবাব দিল,
‘তো, ঘুমাও। আমি কি ধরে রেখেছি তোমাকে। কবেই ছেড়ে দিয়েছি। তবে তুমি চাইলেই আমাকে ধরতে পার? আই ডোন্ট মাইন্ড।’

পৌষী ভেবে পেল না এই লোকের আচমকা কি হয়েছে? তার সাথে এমন নরম সুরে কথা বলছে কেন? কালকেও তো তাকে কটাক্ষ করল। কেমন রূঢ়ভাষায় কথা বলল। অথচ একদিনের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন। কি করে সম্ভব? আক্ষেপের সুর তুলল মুখে। বলল,

‘আরাভ ভাই,,,

বাকি কথা শেষ করতে দেয়নি আরাভ। বলে উঠল, ‘দাঁড়িয়ে না থেকে বিছানায় বস। যা বলার পাশে বসে বলতে পারো। দূর থেকে বললে আমি আবার শুনতে পাই না।’

অনেক কষ্টে নিজের লজ্জাকে সংযত করল পৌষী। বলে উঠল,
‘এই রুমে কি চায় তোমার?’

আরাভ জবাব দিল না। চুপচাপ বসে আছে। কিছু মুহুর্ত পার হতেই বলল,
‘তুমি কিছু বললে পৌষমাস? আগেই বলেছি আমি দূরের শব্দ শুনতে পাই না। পাশে এসে বস। তারপর কি জানতে চাও বল।’

পৌষী এবার বিরক্তিবোধ করল। অসহ্য লাগছে তার কাছে। চোখমুখে দৃশ্যমান তার বিরক্তিবোধ। পা দু’কদম এগিয়ে আরাভের সামনে দাঁড়াল। রুক্ষ ভাষায় বলল,

‘তুমি এক্ষুনি আমার রুম থেকে বের হবে। সহ্য হচ্ছে না তোমার এসব বেহায়াপনা। এসব বেহায়াপনা তোমার হবু বউয়ের সাথে কর গিয়ে।’

পৌষী ভেবেছিল তার দৃঢ় কথায় আরাভ ফুঁসে উঠবে। তার গালে কষে এক থাপ্পড় মেরে হনহনিয়ে বের হয়ে যাবে রুম থেকে। কিন্তু ঘটল তার উল্টো কিছু। যা হওয়ার ছিল না তাই হল। জানালার পর্দাগুলো টেনে দিল আরাভ। বিকেলের রোদ আসা বন্ধ হয়ে গেল তখন। ঘর কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। পৌষী হতভম্বের মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আরাভ তাকে ছোঁ মেরে বিছানায় নিয়ে শুয়ে পড়ল। পৌষী তখনও হতবিহ্বল। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকাতে চাইল। কিন্তু আরাভের বলিষ্ঠ হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে বাঁচাতে বরাবরই ব্যর্থ হল। তার দু’হাত আরাভের বুকের মাঝে লেপ্টে আছে। তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ স্পষ্টত শুনতে পাচ্ছে সে। নিশ্বাসের নির্গত বায়ুও তার মুখে আছড়ে পড়ছে। কেমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আছে সে। দু’চোখ মেলে রাখা। অথচ তাকাতে অস্বস্তিতে ডুবছে। ঈষৎ আলোয় বেশ বুঝতে পারছে, আরাভের তীর্যক দৃষ্টি তার উপর। শেষে ধস্তাধস্তি করে ক্ষান্ত হল সে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘তুমি এত অসভ্য কবে হলে আরাভ ভাই? নির্লজ্জের মত এমন করছো কেন?’

আরাভ মৃদু হাসল। কিঞ্চিৎ দূরত্ব তাদের মাঝে তখনও। সেই দূরত্ব রেখেই বলল, ‘তুমিই তো বললে বেহায়াপনা করতে।’

‘আমি তোমার হবু বউয়ের কথা বলেছি।’
‘দেখ, হবু বউ কাছে নেই। কিন্তু বউ তো কাছে আছে।’

বউ সম্মোধনে পৌষীর বক্ষস্থল কেঁপে উঠল হঠাৎই। এ শব্দটাতে যেন কিছু ছিল। কি এক শিহরণ জাগানো শব্দ। ভাবতেই যেন লজ্জায় আরও মিইয়ে গেল। গলা থেকে উঠে আসা শব্দগুচ্ছ যেন আবার ফেরত গেল। অনেক কঠিন ভাষা বলতে গিয়েও থেমে যেতে হচ্ছে তাকে। কি এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। সে চুপ হয়ে আছে, আরাভও নিশ্চুপ। পিনপতন নীরবতা দু’জনের মাঝে। অথচ দু’জনই একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনছে প্রকটভাবে। নীরবতা ভেঙে আরাভ বলল,

‘লজ্জা পাচ্ছো পৌষমাস? লজ্জা পেলে তোমাকে একদম বউ বউ লাগে।’

আরাভ আরও কিছু বলতে গিয়েও হঠাৎই থেমে গেল। তার এমন রোমান্টিক মুহুর্তে দরজায় বেশ সজোরে করাঘাতের শব্দ করল কেউ। কিঞ্চিৎ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো সে। এ সময় আবার কে দরজায় কড়া নাড়ে? আরাভের এমন আদুরে আলাপ পৌষীর ঠিক হজম হচ্ছে না। সে ছাড়া পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল আবার। কিন্তু আরাভ ছাড়ার পাত্র নয়, হাতের বাঁধন দৃঢ় করল আরও। তারপর ফিসফিস করে বলল,

‘ইলফিসের মত এত নড়ছো কেন? চুপ থাকো না, পৌষমাস। আমাকে কথা বলতে দাও।’

পৌষী বুঝল না তার কি করা উচিৎ। উত্তপ্ত কিছু গালি ছুঁড়বে না’কি নিজেকে বের করবে এর বাহুবন্ধন থেকে। কিন্তু দু’টোর একটাও তাকে দিয়ে হচ্ছে না। তবু মিনমিন করে বলল,

‘আরাভ ভাই এসব কি হচ্ছে? ছাড়ো বলছি।’

আরাভ জবাব দেয়ার আগেই দরজার পাশ থেকে সৌরভের ক্রোধান্বিত বাক্য ভেসে এল।

‘আমি জানি, আরাভ তুমি এখানেই আছো। বাইরে এসো, তোমার সাথে আমার দরকারী কিছু কথা আছে।’

আরাভ দায়সারা জবাব দিল,
‘ছোট পাপাহ, তুমি কেমন শ্বশুর বল তো। মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের রোমান্সে বাধা দিতে আসছো। এখন যাও। সময় হলে আমি নিজেই আসব।’

সৌরভ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মুহুর্তে। ফের দরজায় করাঘাত করতে গিয়েও লজ্জায় তার হাত থেমে গেল। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, এটা আরাভের জবাব ছিল। ছেলেটা এত নির্লজ্জ কবে থেকে হল, ভেবে কূল পেল না। সে পৌষীর রুমের চৌকাঠ থেকে প্রস্থান করল অতিদ্রুত। বসার ঘরে বসে অদ্ভুতভাবে পায়চারি করছে। সত্যিই আরাভ তো এই ছেলে?এমন বাক্যে কি সেই ছুঁড়েছে। ছেলেটা এমন নির্লজ্জ হয়ে গেল ভাবতেই তার চক্ষু কোটর থেকে বের হবার উপক্রম। প্রিয়া নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল সৌরভকে খুঁজতে। কিন্তু এসে দেখল, তার স্বামী কেমন বিক্ষিপ্ত আচরণ করছে। সে বেশ অবাক হল। সোফায় গিয়ে বসল সে। বলল,

‘কি হয়েছে তোমার? এমন ভাবে পায়চারি করছো কেন?’

সৌরভও সোফায় গা এলিয়ে বসেছে। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেলল হুট করে। বলে উঠল,
‘প্রিয়ারানী আমি ভাবতেও পারছি না এটা আমাদের আরাভ।’

প্রিয়া অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’

‘আরাভ আমাকে নির্লজ্জ শ্বশুর বলল। মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের রোমান্সে যেন বাধা না দেই। তার সময় হলে সে নিজেই আসবে। ভাবতে পারছো কিছু?’
প্রিয়া মুখ টিপে হাসল। জবাবে বলল, ‘তাই তো! সব জামাই’রাই বুঝি এমন নির্লজ্জ হয়, তাই না প্রফেসর সাহেব।’

‘খোঁচা মারলে, প্রিয়ারানী?’
‘না’তো, একদমই না।’
প্রিয়া শব্দ করে হেসে উঠল। সৌরভ বউয়ের দিকে তাকাল। মুগ্ধ হয়ে গেল বউয়ের সেই হাসি দেখে। কে বলবে এই নারীর চল্লিশ বছর বয়স। এখনও সুদর্শনা তার প্রিয়ারানী। কত প্রাণোবন্ত তার সেই হাসিমুখ। দেখলেই তার অস্থিরতা মুহুর্তে গায়েব হয়ে যায়। এই যে তার ক্রোধ দমন হয়ে গেছে এখন। সে চুপচাপ বউয়ের মুখপানে তাকিয়ে আছে। প্রিয়া হঠাৎই হাসি থামাল। সৌরভের এমন চাউনি দেখে ভড়কালো। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘কি ব্যাপার! প্রফেসর সাহেব, এভাবে থাকিয়ে আছো কেন?’
‘প্রিয়ারানী, তোমাকে দেখি।’
‘অচল পুরোনো মানুষ, আমাকে দেখার কি আছে বল তো।’
সৌরভ মৃদু হাসল। বলল, ‘প্রিয় মানুষ কখনো অচল পুরোনো হয় না প্রিয়ারানী। সময়ের সাথে সাথে সে আরও প্রিয় হয়ে উঠে।’
___

লজ্জায় ক্ষোভে রীতিমতো ফুঁসছে পৌষী। সে এখন তার বাবার সামনে কীভাবে যাবে? এতটা নির্লজ্জ কীভাবে হল আরাভ? সে ভাবতেই লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছে আরাভের বলিষ্ঠ বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে, কিন্তু ছাড়া না পেয়ে শেষে বহুল চর্চিত একটা কাজ করে বসল। সে আরাভের ঘাড়ে একটা কামড় বসিয়ে দিল। আর তাতেই সফল হল সে। আরাভ ছেড়ে দিল চটজলদি। পৌষী বিছানা থেকে দৌড়ে দরজার দিকে ছুটল। কিন্তু দরজার কাছে যেতে অসফল হল শেষ পর্যন্ত। কারণ ততক্ষণে আরাভও তার ফিরতি জবাব দিয়ে দিয়েছে। ঠিক তার মত করে ঘাড়ে বসালো আরাভের দন্তপাটির নিখুঁত কামড়। পৌষী হতভম্বের মত হাত চেপে সেই জায়গা ধরে বসে আছে। অথচ আরাভ ভাবলেশহীন। বলে উঠল,

‘হিসাব বরাবর, পৌষমাস।’

চলবে,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ২২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

গায়ে নতুন টিশার্ট আর টাউজার জড়ানো। সদ্য গোসল সেরে আসায় চুল এখনো ভেজা তার। পা দু’খানা মেলে তার সামনে বসে আছে। চোখমুখে আগের সেই উৎকন্ঠা নেই। কেমন আমোদিত মুখাবয়ব। সৌরভ এক পলক দেখেই অবাক হল। এই ছেলে চটজলদি এত পরিবর্তন হয়ে গেল কীভাবে? তবে কি তার মেয়ের সাথে ভাব বিনিময় হয়ে গেল? এত জলদি? কপালে চিন্তার ভাঁজ তার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরাভকে দেখল বেশ সময় ধরে। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও কন্ঠরোধ হয়ে আছে তার। আরাভই নীরবতা ভাঙল। বলল,

‘ছোট পাপাহ, তোমার দরকারী কিছু কথা ছিল না আমার সাথে। এখন বলতে পারো।’

‘তুমি নিজেই ছোটবেলার বিয়েটা প্রত্যাখ্যান করেছো। তাহলে এভাবে আমার মেয়ের কাছে আসা কি উচিৎ হয়েছে তোমার?’

‘প্রত্যাখান তো অবশ্য করার কথা, কেন করব না? ঐ বিয়ে দিয়ে কি সংসার করা যাবে? দু’জনই তো নাবালক ছিলাম। একটা পাঁচবছরের বাচ্চা মেয়ের সাথে আটবছরের বাচ্চা ছেলের বিয়ে দিয়েছো। তোমার মেয়ে তো তখন বিয়ের অর্থই জানতো না। আমিই বা আর কত বড় ছিলাম? তাছাড়া এখনো আইনিভাবে আমাদের বিয়ে স্বীকৃতি পাইনি। বিয়ে তো আবারও করতে হবে তোমার মেয়েকে। কি কপাল আমার, এক বউকে দু’বার বিয়ে করতে হচ্ছে। তবে আমি তোমাকে বিয়ের আয়োজন করতে বলেছিলাম কিন্তু ছোট পাপাহ? মনে করে দেখ। আর হ্যাঁ, যদি পারো চটজলদি বিয়ের আয়োজন শুরু করে দাও তো। আমার হাতে আবার সময় কম। আর মাত্র পাঁচদিন আছি দেশে। তোমার মেয়েকে পটাইতে পটাইতে আমার আটদিন খেয়ে নিয়েছে। এমন কঠিন মেয়ে পয়দা করছো, পেটের নাড়িভুঁড়ি পঁচে যাবে তাও মুখ ফুটে কথা বের হবে না। কথায় বলে না, ভাঙবে তবু মচকাবে না।’

হতবিহ্বল সৌরভ নিশ্চুপ শুনল সব কথা। আবারও নিজমনে বিড়বিড় করল, এই ছেলে আরাভ নয়। তার জামাই বাবাজী এত নির্লজ্জ কখনো ছিল না। না এমন অকপটে কথা বলত। বেশ গম্ভীর শান্তশিষ্ট ছিল। কিন্তু এখন? সন্দিগ্ধ নজরে সে আরও একবার চোখ বুলালো আরাভের মুখাবয়বে। কিন্তু দৃষ্টিতে তখন অন্যকিছু নজরে এল। হঠাৎই এমন কিছু দেখল, লজ্জায় আর অস্বস্তিতে শুকনো ঢোক গিলল সে। আরাভের ঘাড়ে কামড়ের দাগ দৃশ্যমান। এমন কিছু তার নজরে আসতে হল। ছিঃ! কি লজ্জায় না লাগছে তার। কিন্তু আরাভকে কীভাবে বলবে, এই দাগটা ঢেকে রাখতে। আরাভ সৌরভের অস্থিরতা দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হল। বলে উঠল,

‘কি হয়েছে ছোট পাপাহ? শরীর খারাপ লাগছে না’কি অন্যকিছু?’

সৌরভ যে কথা বলতে ডেকে ছিল, তাই আর বলা হল না। উল্টো বলে উঠল,
‘তোমার জ্যাকেট কোথায়? আজ বোধহয় ঠান্ডা বেশি পড়বে, তাই না। কানে, গলায় ঠান্ডা লাগতে পারে, কানটুপি পরে থাকবে কিন্তু।’

হঠাৎই প্রসঙ্গ বদল দেখে আরাভ তাজ্জব বনে গেল। বলল,
‘এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এর চেয়েও বেশি ঠান্ডা আমি সহ্য করতে পারি।’

‘সাবধান থাকা ভালো, তাই বললাম। কানটুপিটা পরে থেকো। আর যদি পারো, ঘর থেকো বাইরে যাওয়ার দরকার নেই এই সময়।’

সৌরভ কথা বাড়ালো না আর। বাক্যেটুকু শেষ হতেই পড়িমরি করে ছুটল নিজের রুমের উদ্দেশ্য। সে বাপ হয়ে এসব কিছু কেন তার নজরে এল। হায়রে! এই লজ্জা সে এখন কোথায় রাখবে? হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে ঢুকল সে।

প্রিয়া নাস্তা বানানোতে ব্যস্ত। অতর্কিত তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পৌষী। মাথায় গোল করে ঘোমটা টানানো। চোখমুখে কেমন তীব্র অস্বস্তি। প্রিয়া একপলক মেয়ের দিকে নজর বুলালো। নিভৃতেই হাসল। তার মেয়েটা হয়ত লজ্জায় গুটিয়ে আছে এখন। তাই সে কিছু বলে ঘাটালো না আর। পৌষীকে বলল, চা তৈরি করতে। সে শীতের বিকেলের নাস্তা হিসেবে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে। সাথে আছে খেজুর রস। আর শরীর চাঙ্গা রাখতে আছে আদা চা। পৌষী চা বানাচ্ছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। আচমকাই ঘোমটা সরে গেল তার মাথা থেকে। প্রিয়া না চাইতেই ঘাড় ঘুরাতে গিয়ে চোখে পড়ল অযাচিত কিছু। সে দেখেও না দেখার ভান করল। কিন্তু ভাবল, সৌরভের কথা। বাবা হয়ে মেয়ের এমন কিছু দেখা বড্ড অস্বস্তির বিষয়। সে পৌষীকে বলল, তুই রুমে যা এখন। আরাভের কিছু লাগবে কি’না জিজ্ঞেস কর?

পৌষী অথৈজলে পড়ল। সেই অসভ্যটার জন্যই তো এখানে এসেছে। এখন রুমে গেলে তার সাথে আবার কোন অঘটন ঘটে কে জানে? সে মায়ের বিরোধিতা করল।
‘আরাভ ভাইয়ের কিছু লাগবে না। আমি তোমার সাথে কাজ করি না এখন। তুমি একা একা কত কাজ করছো?’

‘আরাভ ভাই কি? কেউ নিজের স্বামীকে ভাই ডাকে?’

‘আমিও তো তোমার মেয়েকে এই কথায় বোঝাচ্ছিলাম। ভাই ডেকে আমার মান-সম্মানের দফারফা বানিয়ে ছাড়ছে। শেষে আমার বাচ্চাগুলোও না জানি আমাকেই মামা ডেকে বসে থাকে।’

সহসাই পেছন থেকে আরাভের টিপ্পনী ভেসে এল। পৌষী আরও একবার অস্বস্তিতে ডুবল। না মাথা তুলল, না একবার পেছনে তাকাল। প্রিয়া আরাভের কথায় আলতো করে হাসছে। সান্ত্বনা দিল নিজের মত করে,

‘চিন্তা করো না, সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘তাই যেন হয় ছোট আম্মু।’

প্রিয়া একপলক আরাভের দিকে তাকাল। কিন্তু নজর বুলাতে গিয়ে দৃষ্টি পড়ল আবারও অন্য কিছুতে। সে ভেবে পেল না, দু’জনেরই একই অবস্থা। নিশ্চিত দু’জনেই ঝগড়া করেছে। সে কিছু একটা ভাবল। পৌষীকে বলল,
‘যা তো রুমে যা। আরাভকে নিয়ে যা তোর সাথে। আমি নাস্তা হলে পাঠিয়ে দেব।’

‘কিন্তু আমি থাকলে কি সমস্যা?’

প্রিয়া ধমক দিল, ‘যা তো। আমাকে কাজ করতে দেয়।’

পৌষী নিজের রুমে না গিয়ে বসার রুমে গিয়ে বসল। আরাভ তখন ড্রাইনিং এ বসে শাশুড়ীর সাথে খেজুরে আলাপে ব্যস্ত। পৌষী বেশ বিরক্ত হল। নিজের রুমে প্রবেশ করাও এখন তার জন্য বিপদজনক। এই লোককে একদমই বিশ্বাস করছে না সে। কেমন যেন বেহায়া পুরুষ মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। নিজের হবু বউ রেখে তার কাছে কি? এই কথাটা ঠিকমত হজম হচ্ছে না তার। আবার পরিষ্কার করে কিছু বলছেও না তাকে। কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে এখানে? কি চাই তার?
___

সন্ধ্যো গড়িয়েছে বহু আগে। আরাভ ঘরে নেই অনেকটা সময় ধরে। কোথায় গেছে জানে না কেউ। শুধু প্রিয়াকে বলেছে, ছোট আম্মু আমি একটু আসছি। পৌষী নিজের রুম একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয়বার আরাভ আসলে যাতে আর অগোছালো না থাকে। গোছানো শেষে বারান্দার এক কোণে বসে আছে নিভৃতেই। চুপচাপ নিজের জীবনের হিসাব কষে যাচ্ছে। আচমকাই তার দরজায় মৃদু শব্দ হল। অভিমানে দগ্ধ হলেও মুখের কোণে হাসি ফুটল। ভাবল, আরাভ এসেছে আবার। এবার কি কান্ড ঘটাবে তার সাথে। সেটা ভাবতেই ভয়ে আৎকে উঠল। কিন্তু এবার সে ছাড়ার পাত্র নয়, একদম নাক বরাবর ঘুষি মেরে দেবে। কুটিল হাসল। কিন্তু লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে দরজা খুলতে গিয়ে। তার আকাশকুসুম ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিল সৌরভ। বাইরে থেকে বলে উঠল,

‘দরজা খোলো পৌষী।’

নিজের বাবার গলার স্বর পেয়ে হতচকিত পুরো। এই সময় তার বাবা কেন? দ্রুত দরজা খুলল সে। সৌরভকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পৌষী জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে পাপাহ?’

সৌরভ ধীর কদমে পৌষীর রুমে এসে ঢুকল। দপ করে বিছানায় বসে গেল। শুকনো ঠোঁট ভেজালো নিজের জিহ্বা দিয়ে। মেয়েকে কাছে ডেকে বলল, ‘বস এখানে, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’
পৌষী নিজের বাবার কথায় চটজলদি পাশে গিয়ে বসল। তার দিকে উদগ্রীব দৃষ্টি দিয়ে বলল, ‘কি পাপাহ?’

‘দেখ, গতকাল তুমি নিজের মুখে স্বীকার করেছো। তুমি সেই ডাক্তার ছেলেটাকে বিয়ে করতে রাজি। আমি যেন তাদের আসতে বলি। তুমি দ্বিমত করবে না আর। এখন তুমিই বল, সত্যিই সেই ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করবে কি’না? তোমার মতামতের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। পাত্রপক্ষ অলরেডি আমাদের বাড়ির নীচে চলে এসেছে। তাদের আসতে না বললে আমাদের সম্মান মাটিতে গিয়ে মিশবে এখন। কারণ আমরাই তাদের ডেকেছি। ভেবে দেখ, জবাব যেন নড়চড় না হয় তোমার।’

পৌষী তো ভুলেই বসে আছে এই কথা। বক্ষস্থলটা কেঁপে উঠল বোধহয়। চোখের কোণেও জল জমল মুহুর্তেই। কি হচ্ছে তার সাথে এসব? কি করবে সে। অসাড় মস্তিষ্ক, ভাবনার জগৎ বন্ধ। কোন সদুত্তর খুঁজে পেল না সে আর।
সৌরভ ফের জিজ্ঞেস করল,
‘জবাব দাও পৌষী। তুমি এখন যথেষ্ট ম্যাচিউর কিন্তু। তাই ভেবেচিন্তে উত্তর দাও। তবে সময় আমাদের হাতে একদমই কম।’

সৌরভ উঠে দাঁড়াল আবার। পাত্রপক্ষ এল বলেই। অথচ পৌষী বিমূঢ়তায় আচ্ছন্ন যেন, থমকে আছে তার সমস্ত কায়া। আরাভ এলে কি জবাব দেবে সে। কিন্তু তার বাবাকে দেওয়া কথাও রাখতে হবে? সে আলমিরা খুলে একটা শাড়ি বের করে নিল। নিজের থেকেও তার বাবার সম্মানটা আগে। নিজের হাতে শাড়ি পরে নিল। অপেক্ষা করছে বাবার ফিরতি ডাকের জন্য।

সৌরভ বসার ঘরে নতুন অতিথিদের বসালেন। মাত্র পাঁচজন মানুষ এলেন। পাত্র, পাত্রের বাবা-মা আর পাত্রের মামা ও বন্ধু। প্রিয়া সৌরভের এহেন কাজে বেশ অসন্তুষ্ট হল। বিবাহিত মেয়েকে আবার বিয়ে দিবে না’কি? কেমন রসিকতা তার! সৌরভকে বেশ কটুবাক্য শোনাল এর জন্য। তার উপর আরাভ যদি দেখে এসব। তখন কি হবে? সৌরভ পাত্তা দিল না কোন কথায়। সে তার মনমর্জি চলছে। প্রিয়া নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে অতিথিদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। তবে খুব বেশি আয়োজন করেননি। বসার ঘরেও সৌরভের অনুরোধে অতিথিদের সাথে কথা বলতে আসেন। কুশলাদি বিনিময় করে বেরিয়ে গেলেন আগের মতই। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার সময় সৌরভ প্রিয়াকে থামালো। বলল,

‘পৌষীকে নিয়ে এস, জলদি।’

প্রিয়া দু’চোখ রাঙালো। দৃষ্টিতে তার অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে। না বলতে গিয়েও থেমে গেল হঠাৎ পৌষীর আগমনে। তার মেয়েটাও কি পাগল হল। বাপের সাথে সাথে এই মেয়ের মাথাও গেছে। সে পৌষীকে নিষেধ করল পাত্রের সামনে না যাওয়ার জন্য। অথচ পৌষী যেন নির্লিপ্ত। সালাম দিয়ে সে চুপচাপ গিয়ে বসল বসার ঘরে সোফার মাঝে। সামনা-সামনি পাত্র বসেছে। টুকটাক কথা চলছে সবার মাঝে। পৌষীকে যা জিজ্ঞেস করছে তার জবাব দিচ্ছে সে। পাত্র আঁড়চোখে পৌষীকে দেখছে। তার মনটা বড্ড আকুপাকু করছে। পৌষীর সাথে নিরিবিলি একাকী কিছু কথা বলার জন্য। এভাবে সবার সামনে তো আর মনের কথা বলা যায় না। সে অনেক আগে থেকেই মেয়েটাকে দেখে এসেছে। কতদিন ধরে তাদের প্রস্তাব ঝুলিয়ে রেখেছে। প্রায় এক বছর হতে চলল বোধহয়। কিন্তু শেষে তাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য বড্ড কৃতজ্ঞ সে। তাই যা করার চটজলদি করতে হবে। তার তো তর সইছে না আর। পাত্রের বাবা সৌরভকে বলল,

‘আপনার মেয়েকে আমাদের অনেক আগে থেকেই পছন্দ। যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমরা চাইছি, আজ রাতেই ওদের দু’জনের আকদ করে নিতে। কি বলেন বেয়াইসাব?’

‘কি হচ্ছে এখানে?’
আচমকাই কারো বজ্রকন্ঠ প্রতিধ্বনিত হল বসার ঘরে। সবার উদগ্রীব দৃষ্টি তখন ভেসে আসা সেই ব্যক্তির উপর। এক বলিষ্ঠ গড়নের সুদর্শন যুবক। কি অপূর্ব! পাত্র নিজেই মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখছে তাকে। পুরুষ মানুষও এত সুন্দর হয়?

চলবে,,,,