প্রিয় পৌষমাস পর্ব-২৭+২৮

0
163

#প্রিয়_পৌষমাস ২৭.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

সাত তলার ভবন জুড়ে কৃত্রিম আলোর প্রজ্জলন। মাত্র তিন ঘন্টার অনুপস্থিতিতে এত কিছু। কিন্তু অতিথির আগমন দেখে আরও একটু চমকালো পৌষী। বাসায় পা রাখতেই হঠাৎই সেই চেনা সুর, আরে আমার আম্মাজান, আমার বৌমা এসেছে। চোখমুখে উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে যেন, ঠোঁটের কোণেও প্রশান্তির হাসি গৌরবের। পৌষী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল তাকে দেখে। সালাম দিয়ে বলল, ভালো আছো বড় পাপাহ?
গৌরবের মুখে চওড়া হাসি বিদ্যমান। বলল,
আম্মাজান, মন খারাপ কেন? পৌষী লাজুকলতায় নুয়ে গেল। বলল, না’তো।
পেছনে থাকা আরাভকে দেখল একপলক। জবাব দিল, আপনার শ্বশুর থাকতে আপনার কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।

আরাভ নিজের বাবাকে দেখেও না দেখার ভান করল। কিন্তু গৌরবের নিজের ছেলেকে দেখে তার মুখাবয়ব বদল হল হুট করে। ছেলের উপর তার চাপাক্ষোভ আছে। তারই প্রতিফলন ঘটল মুহুর্তে। পৌষী গৌরবের চোখমুখের আকস্মিক পরিবর্তনে চমকালো ভীষণ। বলল,
‘কি হয়েছে বড় পাপাহ?’
গৌরব চোখমুখ কুঁচকে বলল, একটা কঠিন পদার্থ জন্ম দিয়েছি আমি। তাই তো আমার আম্মাকে এত কষ্ট দেয়।
আরাভ বাপের এমন উপহাস হজম করে নিল চুপচাপ। জবাব না দিয়ে নিজের রুমে হনহনিয়ে প্রবেশ করল। পৌষী উত্তরের আশায় গৌরবকে আরও কিছু বলতে গিয়েও থামল। আচমকা কারো মুখে ভাবী ডাক শুনে। হম্বিতম্বি করে ছুটে এসে আরিবা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মুখে তার বার বার উচ্চারিত হচ্ছে, ভাবী সেই তিনঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি, কখন আসবে তুমি? এত সময় লাগল কেন তোমার।

পৌষী থমকে আছে যেন। কি এক অদ্ভুত অনুভূতিতে সিক্ত হচ্ছে সে। মৃদু হেসে জবাব দিল, কখন এলে তোমরা? বাকী কথা বলার সুযোগ হয়নি আর। আরিবার সাথে কিয়াশা মিলে তাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। তাকে নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড। আলিশবাও এসে তাকে দেখে গেল। মুখের সামনে বলল, মাশ’আল্লাহ! আমার বৌমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে। পৌষী লাজুর লতার ন্যায় নেতিয়ে গেল যেন। বড্ড হাসফাস লাগছে তার কাছে। দুপুরের মধ্যে দেখতে দেখতে অতিথিতে গমগম করছে তাদের পুরো ঘর। ছাদের কোণে বর-কনের জন্য স্টেজ বানানো হয়েছে। রাতে হলুদের আয়োজন। পরেরদিন রিসিপশন অনুষ্ঠান। এত কিছু শুনে পৌষী থ হয়ে আছে। সে কিছুই জানে না এসবের। মাত্রই দেখছে।

রাতে সাজানো স্টেজে প্রথমে নিয়ে আসা হল আরাভকে। তাকে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো। পূর্ণী এসে বলল, দুলাভাই। আরাভ চমকে উঠল বোধহয়। সে এটা আশা করেনি পূর্ণী তাকে দুলাভাই ডাকবে। তার সাথে কিয়াম, কিয়াশাও দুলাভাই ডাকল। আরিবাও এসে বলল, দুলাভাই। বোনের মুখে দুলাভাই শুনে স্তব্ধ পুরো। শেষে কি’না নিজের বোনও দুলাভাই ডাকছে। কি কপাল তার! কিন্তু আরিবা মুখ টিপে হাসছে। এর কিছু সময় বাদে আগমন ঘটল পৌষীর। আরাভ অবাক হয়ে দেখছে সে দিকেই। গায়ের জামা হালকা সবুজ রঙা আর নিচের লেহেঙা ও ওড়না হলুদ রঙা। হাতে-কানে, গলা-মাথায় বেলীফুলের গহনা পরিহিত। মনে হচ্ছে কোন এক হলুদ পরী আকাশ থেকে টুপ করে নেমে এসেছে ধরণী মাঝে। তার গায়ে সবুজ রঙা পাঞ্জাবী। পৌষীকে ঘিরে রেখেছে মেয়ে’রা। শেষে আরিবা গিয়ে উদ্ধার করল তাকে। সবার উদ্দেশ্য বলল, আমার ভাবীর কাছ থেকে সরো সবাই। পৌষীকে নিয়ে বসানো হল আরাভের সাথে। কিয়াম, কিয়াশা মিলে তাকেও ভাবী ডাকল। পৌষীর তো দমবন্ধকর অবস্থা। সবাই মিলে তাকে ভাবী ডাকছে। কি দুষ্টরে বাবা!

শোভাসহ প্রিয়া অবাক হল ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখে। এরা তো গিরগিটির মতই রঙ বদলায় মুহুর্তে। আরাভ মুখ টিপে হাসছে। তার কাছে অবশ্য খারাপ লাগছে না। কাজিন বিয়ে করলে এমনই তো হওয়ার কথা। কিন্তু পরক্ষনেই একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার বাচ্চারাও তাকে বাপ না ডেকে মামা ডাকছে? ভাবতেই চোখমুখ কুঁচকে তাকাল পৌষীর দিকে। বিড়বিড় করল, নো নেভার এভার।

পাশে থাকা পৌষী হকচকিয়ে উঠল আরাভের কান্ডে। ফিসফিস করে বলল, ‘কি হয়েছে আরাভ ভাই?’
আরাভ গর্জে উঠল, ‘থাপ্পড় মেরে দু’গাল লাল করে দেব বেয়াদব। আরেকবার ভাই ডাকলে।’

পৌষীর মুখে তখন দুষ্ট হাসি। বলল,
‘কেন আরাভ ভাই? আমি কি করেছি আরাভ ভাই? এমন করছো কেন আরাভ ভাই? ও আরাভ ভাই।’
আরাভের চোখ কপালে। তাদের দিকে সজাগ দৃষ্টি সব অতিথির। ফিসফিস করে বললেও আশেপাশের বাকিরা ঠিকই শুনবে এসব। সে চোখ পাকালো। ভরা মজলিসে তার মান সম্মান সব খেয়ে নিবে এই পৌষমাস। কিন্তু ক্ষুব্ধ হওয়ার পরিবর্তে শান্ত গলায় জবাব দিল,

‘আহারে এমন বইন কই পাওয়া যায়। আসো বইন বুকে আসো। তোমাকে কয়েকটা চুমু খাই।’

মুহুর্তেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল পৌষীর। ভ্যাবাচ্যাকা খেল ভীষণ। আরাভের মুখে তখন বক্র হাসি। দু’ঠোঁট গোল করে নিজের এক চোখ বন্ধ রেখে আলগোছে উড়ন্ত চুমু খেল পৌষীকে। সে তো পুরাই বাকরুদ্ধ। কি বেহায়া পুরুষ। আশেপাশে চোখ বুলাতেই নজর পড়ল তার কাজিন গুষ্টি তাদের দিকেই হা হয়ে আছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হল আরেকবার।

সকালের আলো ফুটতেই বেশ হম্বিতম্বি ব্যাপার সবার মাঝে। হলে যেতে হবে, তাই দ্রুত তৈরি হতে আদেশ করল সবাইকে। ঘড়ির কাটায় সকাল এগারোটা ছুঁইছুঁই। পৌষীকে তার রুমে সাজানো হচ্ছে। আরাভ একপলক দেখতে চাইল। কিন্তু তার বোনসহ কাজিন গুষ্টি দেখতে দিল না তাকে। উল্টো তাকে হলে পাঠিয়ে দিল। আরাভ একা একা হল যাচ্ছে। সাথে কিয়াম আর পার্থ, সারিফও এসেছে। পৌষীর বন্ধু তারা। দোটানার মাঝে সে হলে উপস্থিত হল। সৌরভ প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে ছিল। আরাভকে দেখেও সে নিশ্চুপ। আরাভ দ্বিধায় ভুগল কিছু সময়। সৌরভের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ছোট পাপাহ, তুমি এখনো আমার উপর রেগে আছ?

সৌরভের চোখমুখে তীব্র অসন্তোষ। কিন্তু প্রকাশ করল না কিছুই। মলিনমুখে বলল, না।

আরাভ হাপিত্যেশ করল আপনমনে। বলল, আমি জানি, তুমি আমাকে ক্ষমা করনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, তোমাকে আমি সব সত্যি বলতে পারব না কখনই। কারণ, পৌষী তোমার মেয়ে হলেও সে আমার স্ত্রী। তার কিছু ভুল বা অন্যায় আমি চাইলেই সবার কাছে প্রকাশ করতে পারি না। এটা একান্তই আমাদের ব্যাপার। তবে তোমার মেয়েকে আমি ছেড়ে যাইনি, শুধু সময় দিয়েছিলাম। সে যেন বুঝতে পারে আমাকে। এর বাইরে আর কিছু নয়। প্লিজ, বোঝার চেষ্টা কর।’

সৌরভের উদগ্রীব দৃষ্টি। বলল, ‘পৌষী কি ভুল করেছে আমাকে বল?’

‘দুঃখিত! ছোট পাপাহ, এটা আমি বলতে পারব না।’
‘তাহলে তুমি বিয়েটাকে অস্বীকার করেছিল কেন?’

‘আসলে আমি তখন হুঁশে ছিলাম না। ভেবেছিলাম তোমার মেয়ে আমাকে কখনই ভালোবাসবে না। তাই এ বিয়েটাকে খারিজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পরে বুঝতে পেরেছি ছোট পাপাহ, যেটা আমার নিজের একান্তই ব্যক্তিগত। সেটাকে কখনো এভাবে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া উচিৎ নয়। আমারও কিছু ভুল ছিল। পৌষীকে নিজের মনের কথা জানানো। অন্তত একটা ইতিবাচক কিছু ইঙ্গিত দেওয়ার দরকার ছিল। হয়ত, আজ এত দূরত্ব সৃষ্টি হত না আমাদের মাঝে। বড্ড বেশি ভুল করেছি ছোট পাপাহ, সর‍্যিই। এবারের মত মাফ করে দাও।’

সৌরভের চোখ ছলছল। দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন না ছুঁড়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরল আরাভকে। ভেজানো গলায় বলে উঠল,
‘আজ সত্যিই আমার জামাই বাবাজী বড় হয়ে গেছে। আমি ভুল করিনি একদমই। আমার মেয়ের যোগ্য বর চিনতে একটুও ভুল করিনি।’

আরাভও হাসল। কিন্তু আপনমনে বিড়বিড় করল, কিন্তু তোমার মেয়ের শাস্তি এখনো বাকি ছোট পাপাহ। তার যে ক্ষমা নেই।

ফুলেল মঞ্চে বসানো হল আরাভ পৌষীকে। সোনালী রঙা শেরওয়ানিতে আরাভ বর সেজে বসেছে। পৌষীকে পরানো হয়েছে সোনালী বর্ণের গাউন। সাথে সোনালী বর্ণের বড় ওড়না দিয়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টানানো। পৌষীর মুখ ঢাকা সেই লম্বা ঘোমটার আড়ালে। আপ্যায়ন শেষে বর-বউ দেখতে এসে পুরাই হতাশ সব অতিথি’রা। আরাভ সবাইকে কড়া নিষেধ করে দিয়েছে তার বউকে দেখানো যাবে না। মাত্র ত্রিশমিনিট বসতেই সে ফুলেল মঞ্চ থেকে পৌষীকে রুমে নিয়ে যেতে বলল। সৌরভ প্রিয়া অবাক হল, তবে অসন্তুষ্ট নয়। এমন জামাই দরকার তাদের। অনেক পুরুষ এসে ফিরে যাচ্ছে। বর দেখলেও বউ দেখা হয়নি তাদের।

পৌষীকে একা রুমে বসানো হয়েছে। সেখানে পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু কয়েকজন মহিলা ঘুরেফিরে তাকে দেখছে। ছবি তোলাও নিষেধ করেছে আরাভ। তার বউকে অন্যেরা কেন দেখবে। তার ছবিও কেন অন্যের মুঠোফোনে থাকবে। তার নিষেধাজ্ঞায় পৌষী কেমন ভীত হয়ে আছে। তার জন্য আর কি কি নিষেধাজ্ঞা জারি করবে কে জানে?

আরিবা মেজেন্ডা কালারের লেহেঙ্গা পরিহিত। মাথায় টিকলি, সাথে আছে পাথরের ভারী গহনাদি। তার এমন রূপে মোহিত হল পার্থ। যেন ঐ রুপের অনলে দগ্ধ হচ্ছে সে। বার বার আড়চোখে দেখতে গিয়ে আরিবার সাথে চোখাচোখি হচ্ছে তার। আরিবা নিভৃতেই হাসল। মানুষের ছয়টা ইন্দ্রিয় হলেও মেয়েদের সাতটা ইন্দ্রিয় হয়। সে বুঝতে পারে পার্থ তাকে পছন্দ করে। সে মুখে হাসি ঝুলিয়ে পার্থের সামনা সামনি দাঁড়াল।
গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘পার্থ ভাইয়া তুমি কি আমাকে পছন্দ কর?’

পার্থ স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন পুরো। গলা শুকিয়ে কাঠ। আমতা আমতা করে উঠল, ‘আ,,,আ, না,, না,, মানে।

‘তুমি আমতা আমতা করছো কেন পার্থ ভাই? আমাকে তোমার পছন্দ নয়। তাহলে বাঁচলাম। আসলে তোমার কষ্ট দেখে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে এখন।’

‘কিসের কষ্ট?’

‘এই যে এভাবে আমাকে চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছো। এটা কষ্ট নয়।’

পার্থ ধরা পড়ে চোরের মত হয়ে গেছে। পোক্ত জবাব দিতে অক্ষম সে। মাথা নীচু করে বলল,
‘সর‍্যিই,, আসলে আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন করব না।’

‘তোমার ভালা লাগা শেষ পার্থ ভাইয়া?’

পার্থ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। কি জবাব দিবে এখন। তার এমন নিশ্চুপতায় আরিবা বিরক্ত হল বেশ। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
‘ঠিক আছে এভাবে হ্যাংলার মত আমাকে দেখবে না আর। আমার শখের পুরুষ আছে কিন্তু অলরেডি, বুঝেছো।’

পার্থ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আরিবা হনহনিয়ে চলে যেতেই সে নিজের বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরল। বিরহের অনলে পুড়ছে যে হিয়া। কিন্তু নেভানোর জল বুঝি নেই কোথাও। ভারাক্রান্ত মন তার, নিশ্চুপ দেখল তার নিগূঢ় যতনে রাখা প্রেয়সীর প্রস্থান। সে হাসল, সেই হাসিতে তৃপ্ততা নেই। ছিল, না পাওয়ার অপূর্ণতা।

চলবে,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ২৮.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

(( শুধুমাত্র১৯+ দের জন্য প্রযোজ্য। ১৮+ রা দূরে থাকুন।))

দরজার চৌকাঠে সারিবদ্ধ কাজিনদের ঝাঁক। আরিবার হাতে কাঁচি, কিয়াশার হাতে ফুলেল থালা এবং পূর্ণী ও কিয়াম মিলে ফিতা ধরে রেখেছে। যুবাব, যাবিরের হাতে আবার ফুলের থালা। তারা দু’ভাই মিলে ফুল বর্ষণ করবে তাদেরকে। আরাভ অবাক হল না। এটা তো হবারই ছিল। তার মুষ্টিতে আবদ্ধ আছে পৌষীর হাত। ঘোমটা এখনও তোলা হয়নি। তারা দু’জন দাঁড়াতে কিয়াশা নিজের ফুলেল থালা এগিয়ে দিল। আরাভকে বলে উঠে, দুলাভাই এখান থেকে একটা চিরকুট উঠান তো। আরাভ নিঃসংকোচে একটা চিরকুট উঠাল। তাতে লিখা পঞ্চাশ হাজার পাঁচশ পঞ্চাশ। সে ভ্রু কুঁচকালো। বলে উঠল, পঞ্চাশ হাজার বুঝলাম, কিন্তু আবার পাঁচশ পঞ্চাশ কেন?

পূর্ণী চেঁচিয়ে উঠল, আরে দুলাভাই এত কৈফিয়ত চাইছো কেন? জলদি টাকা দিয়ে বিদেয় কর আমাদের। অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘুমাতে হবে আমাদের।’

আরাভ আপনমনে বিড়বিড় করল, মনে হচ্ছে তার থেকে এদের তাড়া বেশি। নিজের পকেট হাতড়ে দেখে এত টাকা তার পকেটে নেই। হতাশ হল সে। চোখমুখে তীব্র অস্বস্তি। বলল,
‘পকেটে এত টাকা তো এখন নেই, সকালে দিলে হবে?’

আরিবা প্রতিবাদ করে উঠল, অসম্ভব! টাকা দিয়ে তারপর বউ নিয়ে যাবে। নয়ত বউ পাবে না।

আরাভ বোনের আচরণে যারপরনাই অবাক। এজন্যই লোকে বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। সে মুঠোফোন চেপে গৌরবকে কল দিল। বলল, পাপাহ কিছু টাকা দার দাও তো। তোমার মেয়ে আমার বউ নিয়ে টানাটানি করছে। টাকা না দিলে বউ দেবে না বলেছে। গৌরব বেশ মজাই পেল। হেসে উঠল মুখ টিপে। তবে হাসির শব্দ আরাভের কানে পৌঁছালো না। কিছুসময় বাদে গৌরব টাকা পাঠালো একজন বাচ্চা ছেলের কাছে। ফুলেল থালায় টাকা রাখতেই আরিবা ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে নিল। বাকিদের বলল, বর-বউকে ফুল বর্ষণ কর সবাই। তারপর ভাইয়ের হাতে কাঁচি দিয়ে বলল, এবার ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করুন তো দুলাভাই।

দু’চোখে বিস্ময় আরাভের। নিজের বোনই তাকে দুলাভাই ডাকছে ভাবা যায়। সে পৌষীকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। কিন্তু ভেতরে এসে তার চক্ষু ছানাবড়া। চারপাশে চোখ বুলাতে নজরে এল শুধু ফুল আর ফুল। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে তার রুম। বোনের প্রতি সদ্য জন্ম নেওয়া আক্রোশ মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেল ফুল দিয়ে রুমের এত সাজসজ্জা দেখে। আসলেই তার বোন জিনিয়াস। মনে মনে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু মুখ ফুটে বলা হয়নি তার। আরিবা রুমে এসে পৌষীর ঘোমটার ভেতরে মুখ রেখে বলল,
ভাবী শুভ রাত্রী। জলদি আমাদের জন্য একটা দুষ্ট মিষ্টি বাবু আনো তো। আর ওয়েট করতে পারছি না।

পৌষী ভ্যাবাচ্যাকা খেল মুহুর্তেই। তার শাশুড়ীও তখন জনসম্মুখে তার কাছে এই আবদার করেছে, আমাদের খেলার সাথী চাই। বৌমা শাশুড়ীর এই আবদার পূরণ করবে কিন্তু। সে হাসফাস করল। কি আজব জ্বালা! ঘোমটার আড়ালে থাকায় আরাভের মুখ দেখা হয়নি ভাগ্যিস। নয়ত এখন চোখ মেলাতো কিভাবে? আরিবা বজ্রবেগে এসে আবার বজ্রবেগে ছুটে চলে গেল। পৌষী এখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে কি করবে কিছু ভেবে পেল না। আরাভ গিয়ে দরজা বন্ধ করল। তার বোন আর কাজিনগুষ্টি সব আজ মিলেমিশে একাকার। কখন ঘাপটি মেরে বসে থাকে কে জানে? তাই দ্রুত দরজা বন্ধ করল।

পৌষীকে হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। ঘোমটা না তুলে নিজেই ঘোমটার ভেতরে মুখ রাখল। দেখল, লজ্জায় লাল হওয়া তার লাল টুকটকে বউকে। সে হাসল। পৌষীর নাকের ডগায় আলতো করে চুমু খেল। তখন আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল পৌষী। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল তার তনুমনে। কি এক মধুর যাতনা। আরাভ পৌষীর ঘোমটায় ঢাকা মুখটা উন্মুক্ত করে দিল। লজ্জায় মাথা নীচু করে রেখেছে সে। আরাভ আরও নিকটবর্তী হল তার। সে তখন দু’হাত কচলানোতে ব্যস্ত। সহসাই তার কর্ণকুহর হল আরাভের নেশাক্ত বুলি,

‘অপূর্ব এই রমণীকে স্বাগতম আরাভের জীবনে আসার জন্য। একবার চোখ তুলে তাকাবেন আমার দিকে। আপনার চোখের মায়ায় অবগাহন করব। সেখানে আজকের রাতের জন্য বিশেষ কি রেখেছেন তা দেখতে চাই।’

পৌষী চোখ তুলল না, না মুখ থেকে কোন জবাব এল তার। আরাভ অদ্ভুত এক কাজ করল তখন। তার গায়ের গহনা খুলে দিয়ে বলল, যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, সময় কিন্তু দশমিনিট মাত্র।

সে যেন আবারও অবাকের চরম সীমায়। এত কম সময়? এত তাড়া কিসের এই লোকের। সে বুঝে পায় না। ওয়াশরুম গিয়ে পাক্কা ত্রিশ মিনিট ব্যয় করেছে সে। আরাভ কিছুই বলল না। শান্তস্বরে বলল, এসেছো তাহলে। তারপর নিজে ফ্রেশ হতে গেল। পৌষী চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে। বিছানার দিকে তাকাতেই অস্থির লাগছে। পায়ের পাতাও অদ্ভুতভাবে কাঁপছে তার। বুকের মাঝে ধুকপুক করা যেন থামছেই না। দাঁত দিয়ে নিজের হাতের আঙ্গুল কামড়ে আছে। হাসফাস করতে করতে সে শেষ। অথচ মাত্র পাঁচ মিনিট বাদে আরাভ বের হয়ে এল ওয়াশরুম থেকে। পৌষীর অস্থিরতা আরও দ্বিগুণ বাড়ল। এত জলদি আরাভ চলে এসেছে দেখে।

আরাভ পৌষীর অস্থিরতা দেখেও না দেখার ভান করল। বলল, চল ঘুমাব, অনেক রাত হয়ে গেছে। পৌষী চটজলদি বলল, ঘুমাবো না। চল না আরাভ ভাই আমরা গল্প করি। আরাভ নিভৃতেই হাসল বোধহয়। মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল, ওকে চল। কিন্তু গল্প কোথায় করবে?

পৌষী জবাব দিল দ্রুতই, বারান্দায়।
আরাভ বারান্দায় গিয়ে ঝুলন্ত দোলনায় গিয়ে বসল। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে এখন। কিন্তু প্রকৃতি তার শীতলতা কমায়নি একটুও। সে বসতেই পৌষীও তার পাশে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে বসল। কি গল্প করবে তাই ভাবছে। গায়ে তার শীতের মোটা চাদর জড়ানো। আরাভ ফের হাসল। কিন্তু সেই হাসি পৌষীর নজরে এল না। সে পৌষীকে কাছে টেনে নিজের দু’পায়ের খালি জায়গায় বসালো। তার গায়ের চাদর খুলে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল সে। হুট করে এমন হওয়ায় পুরো হতভম্ব পৌষী। তবু নিজেকে সান্ত্বনা দিল, এই আর এমন কি? কিন্তু কিছু মুহুর্ত যেতেই বুঝল, আরাভের আসল উদ্দেশ্য কি। জোঁকের মত নিজের গায়ের সাথে লেপ্টে রেখেছে। বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া যেন গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হচ্ছে তার বদন জুড়ে। সাথে ওষ্ঠদ্বয়ের প্রগাঢ় ছোঁয়া তার গ্রীবাদেশে একক রাজত্ব করে যাচ্ছে ক্রমাগত।

আরাভের গভীর ছোঁয়ার সে যেন পুরো স্তব্ধ, নিথর। মুখের শব্দও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কাঁপছে সারা শরীর। আরাভ বুঝল সবই। তাই ফিসফিস করে উঠল তার কানের কাছে, ‘তুমি না গল্প করবে? কই কিছু বলছ না কেন?’

পৌষীর প্রাণপাখি যায় যায় অবস্থা। এখান থেকে পালাতে পারলে বোধহয় বাঁচতো সে। অথচ বেহায়া লোক বলছে গল্প বলতে। সে কোন দুঃখে বলেছিল গল্প করবে। তার থেকে বিছানায় শুয়ে গেলেই পারত। গলা দিয়ে কথা বেরুলো না তার। অনেক কষ্টে মিনমিনে বলল, ‘ছা,,ছা,ছাড়ুন না, এভাবে গল্প কীভাবে করব?’

‘তুমি গল্প কর, আমি আমার কাজ করি।’
পৌষী আমতা আমতা করল, ‘কিন্তু,,, ‘

ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফের বেরিয়ে এল আরাভের শান্ত স্বরে নেশাক্ত সুর,
‘পাঁচবছর দু’মাস দশদিন অপেক্ষা করেছি। এরপরও অপেক্ষা করাতে চাও কেন? এত অপেক্ষা কিন্তু দূরত্ব বাড়ায় পৌষমাস। তুমি কি এতটাই অবুঝ? জানো, আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল। তুমি বিয়ে কি না বুঝলেও আমি বুঝতাম, বিয়ে মানে বউ। আর বউকে আদর করতে হয়। কিন্তু আদর বলতে আমি শুধু চুমুই বুঝতাম। এজন্য যখনই সুযোগ পেতাম তোমাকে চুমু খেতাম। তাও যেন তেন চুমু নয়, একদম ঠোঁটে ঠোঁট রেখে। ব্যস, তখন তো তুমি রেগে আগুন। তোমার ঠোঁটে চুমু খাওয়া একদমই পছন্দ ছিল না। এজন্য আমাকে খামছি দিতে নয়ত কামড় বসাতে। আর বাড়ির সবাই ভাবত, তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না। তুমি বড্ড হিংসুটে আর ঝগড়ুটে। কিন্তু আসল কারণ তো আর কেউ জানে না। শুধু তোমাকে চুমু খাওয়ার জন্য তুমি আমাকে কামড় বসাতে।’

পৌষী চমকালো ভীষণ। হঠাৎ করে লজ্জার পারদ উড়ে গিয়ে রাগ ভর করল তার মস্তিষ্কে। কি বেহায়া লোক! তেজীস্বরে বলে উঠল,
‘তুমি ছোট থেকেই এমন বেহায়া ছিলে? আর আমি ভাবতাম তুমি কত ভদ্র? কোন মেয়ের দিকে তাকাও না।’

ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি। আবারও সেই নেশালো সুর তার, ‘ভদ্র! আমি মোটেও ভদ্র নই পৌষমাস। হ্যাঁ, অন্যেদের কাছে ছিলাম। কিন্তু তোমার কাছে তো একদমই নই। অন্তত তোমাকে কখনো ভদ্র নজরে দেখিনি।’

‘তাহলে কি নজরে দেখতে?’
‘বউ নজরে। যতটা গভীরভাবে অনুভব করা যায়, ঠিক সেভাবেই দেখতাম।’

পৌষীর শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল আরাভের কথায়। বিড়বিড় করল আপনমনে, ছিঃ! কি নির্লজ্জ লোক। তার ভাবতেই মাথা ভনভন করে ঘুরছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার। বলল,
‘তাহলে আমি বুঝিনি কেন? তুমি এমন লুচুভাবে আমাকে দেখতে?’

‘কারণ তুমি মাথামোটা ছিলে?’
‘মানে কি?’

‘মনে আছে একবার বাড়িতে কেউ ছিল না, দাদুর ভাই মারা গিয়েছিল সেদিনকার কথা।’

‘হুম, মনে আছে। কিন্তু কেন?’

আরাভ ফের হাসল। পৌষী এবারও দ্বিধায় ভুগল। অস্থির হয়ে আছে সে জানার জন্য। তাই আমতা আমতা করল, ‘কি হয়েছিল সেদিন?’

‘এই যে তুমি মাথামোটা, তাই বুঝনি আমি কি করেছি।’
‘কি করেছিল সেদিন?’

‘তোমার ঘুমন্ত মুখে চুমু খেয়েছি অনেকগুলো। তারপর আর কি করেছি বলা যাবে না।’

পৌষীর কাঁদোকাঁদো অবস্থা প্রায়। নিজেকে কেমন রোবট মনে হচ্ছে। কেউ তার ঘুমানোর সুযোগ নিল, অথচ সে টেরই পেল না। সে কি মরার মত ঘুমায় তাহলে? চৈতন্যহীন শরীরে হুট করে হুঁশ ফিরল তখন। আরাভের মাথার চুল টেনে ধরল শক্ত করে। গলার স্বরে তেজ এনে বলল,
‘সত্যি করে বল আরাভ ভাই, কি কি করেছো আমার সাথে।’

আরাভ মৃদু শব্দ তুলে চিৎকার করল, ‘আরে তুমি বউ না’কি রাক্ষুসি রানী কটকটি। এভাবে কেউ জামাইর চুল টেনে ধরে? বইন আমি কিচ্ছু করিনি, বিশ্বাস কর।’

‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। বল জলদি, তা না হলে তোমার মাথা থাকবে, কিন্তু চুল থাকবে না।’

‘ঐ আর কি, শুধু চোখ বুলিয়ে তোমাকে দেখিছি। আর কিছু করিনি।’

পৌষীর মাথা রাগে টগবগ করছে। ছিঃ! কি অসভ্য লোক। লজ্জা আর রাগ দুটোই একাকার। ইচ্ছে করছে এই লোকের মাথা ফাটিয়ে দিতে। চুল ছাড়লেও রাগ দমন হল না। সে আরাভের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। একদমই ছুঁবে না আমাকে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আরাভ মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে অনবরত। বউকে চেতাইতে তার বেশ মজা লাগে। সেও পিছু পিছু গিয়ে পৌষীর পাশে শুয়ে পড়ল। নিজের দু’হাত বাড়াল পৌষীর দিকে। আলগোজে টেনে নিজের বক্ষপাঁজরে বেঁধে নিল। কানের কাছে আবারও মৃদুস্বর তুলল,

‘এই রাত শেষ হলে খুঁজে পাবে না।
আজ মধুরাত আমাদের ফুলসজ্জা।’

চলবে,,,,,