প্রিয় পৌষমাস পর্ব-৩৩+৩৪

0
157

#প্রিয়_পৌষমাস ৩৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। অথচ এখানে সন্ধ্যা আর সকাল দুটোই এক মনে হয়। ঘড়ির কাটায় বিকেল ৫টা ছুঁই ছুঁই। আচমকাই পৌষীর ঘুম ভাঙলো। বাইরের ঠান্ডা হিমেল বাতাসের শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে। তুষার ঝড়ের সাথে বাতাসের বেগ প্রচন্ড বেড়েছে। পৌষীর মাথা ব্যথা করছে। এক’হাত কপালে রেখে ককিয়ে উঠল। তার মৃদুস্বরের আর্তনাদে আরাভেরও ঘুম ভাঙলো। সে মাথা উঠিয়ে নিজের মুখ পৌষীর সম্মুখে রেখে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

পৌষীর ধরা গলা। ‘মাথা ব্যথা করছে।’

আরাভ আড়মোড়া ভেঙে উঠল। রুমের হিটারের তাপমাত্রা আবার কিঞ্চিৎ বাড়াল। পৌষীর কপালে হাত রেখে চিন্তায় পড়ে গেল সে। হতাশার সুরে বলল,
‘সর‍্যিই! তোমাকে এত শীতের মাঝে এখানে নিয়ে আসা একদম উচিত হইনি। পরিবেশ পরিবর্তন তোমার শরীর নিতে পারবে না। এখানে তাপমাত্রা সবসময় মাইনাসের নীচে থাকে। রাতে আরও বেশি ঠান্ডা পড়বে। তোমার শরীর গরম হয়ে আছে এখন। জ্বর আসবে বোধহয়।’

স্বামীর এহেন কথায় শুকনো ওষ্ঠদ্বয় এলিয়ে হেসে উঠল পৌষী। কপালের হাত সরিয়ে বলল, ‘তুমি অহেতুক চিন্তা করছো আরাভ ভাই? আমার কিচ্ছু হবে না।’

‘কি বললে,, ভাই?’

পৌষী জিহ্বা কামড় দিল। বিড়বিড় করল নিজে নিজে, তাহলে কি ডাকবে সে? ওগো, শুনছো, ময়নার বাপ। কিন্তু তাদের তো বাচ্চা নেই। ভাবতে গিয়ে নিজেই শুকনো ওষ্ঠদ্বয় টিপে হাসল। আরাভ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে পৌষীর দিকে। মুখ টিপে হাসিটা নজরে এল তার। দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করল। পৌষীর কপালে আলতো করে চুমু খেল সে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘ভাই ডাকো আর যায় কর, আমার বাচ্চাদের মামা বানাতে যেও না কিন্তু।’
তারপর আরাভ আলগোছে উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। ফের বলল, ‘আমি আসছি। ততক্ষণ শুয়ে থাকো।’

পৌষী কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আরাভের ছোঁয়ার কেমন যেন জাদু মেশানো। তার ব্যথা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ইচ্ছে করছে ফের আবদার করতে, আরেকটা চুমু খাও তো ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। তোমার বউয়ের ওষুধ তো তুমি। কিন্তু সেই কথা মুখেই রয়ে গেল। আরাভ ততক্ষণে রুম ছেড়ে পগারপার।

আরাভ নীচে নামতেই আরিবাকে দেখে থমকে গেল। কেমন উদভ্রান্তের মত সে ঘরে ডুকেছে। চোখমুখ আতঙ্কিত। সে মনের কথা না চেপেই জিজ্ঞেস করল,
‘কি ব্যাপার! এমন পাগলের মত ছুটে এলি কেন?’

আরিবা ভয়ে চোখ গোল গোল করে তাকাল। এভাবে ভাইয়ের সাথে দেখা হবে ভাবিনি সে। আমতা আমতা করে বলল,
‘ফেন্ডের সাথে মজা করতে করতে কখন সন্ধ্যে হয়ে গেল টেরই পাইনি। বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল।’

‘একটু নয়, অনেকটাই দেরি করেছিস।’

ভাইয়ের জবাব না দিয়ে আরিবা হাই তুলল। বলল, ‘ভাইয়া ভাবী কোথায়?’

‘রুমেই আছে।’

ফের আরিবা বলে উঠল, ‘তুই কিচেনে যাচ্ছিস? আমার জন্য একটা কফি নিয়ে আসিস তো।’

আরাভ বোনের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। ফের জবাব দিতে গিয়ে দেখল তার বোন নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার মন খচখচ করছে। এত দেরি করে আসার কারণটা কি? কিন্তু তা নিয়ে আর বেশি ঘাটালো না। কিন্তু বলে উঠল,
‘যদি পারিস একবার পৌষীকে দেখে আসবি। ওর বোধহয় জ্বর আসবে।’

আরিবা চমকে উঠল। ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে টিপ্পনী মারল সে,
‘জ্বর না উঠে কই যাবে। জামাই পাগলা একটা বউ। দেশে তো নিজের যত্ন নেয়নি। এখন জামাইকে কাছে পেয়ে জ্বর হুড়মুড় করে চলে এসেছে, বুচ্ছো ভাইয়া।’

আরাভ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। দু’চোখে লজ্জা আনাগোনা করছে তার। বোন তার বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আরিবা ভাইয়ের দিকে একপলক তাকাল। আরাভ ইতস্তঃবোধ করছিল। ইতিউতি করি অন্য দিকে মুখ ঘুরাল তখন। আরিবা ভাইয়ের এমন লজ্জা মাখা মুখ দেখে নিজেই মুখ টিপে হাসল।
___

নিশুতি রজনী। পৌষীর জ্বর ক্রমে বেড়েই চলেছে। আরাভ মাথায় পানি দিয়েছে, কপালে জলপট্টি দিয়েছে। ডাক্তারকে কল করে ওষুধও আনিয়েছে। কিন্তু এত কিছু করেও তার জ্বর কমানো গেল না। রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরের ঘোরে মেয়েটা আবোলতাবোল বকতে লাগল। আরাভকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে উঠল,
‘আরাভ ভাই, তুমি আমাকে ভালোবাসো না কেন? ও আরাভ ভাই, আমার চেয়ে তিতলি বেশি সুন্দরী? তুমি সবসময় ঐ তিতলির প্রশংসা কর কেন?’

আরাভ পৌষীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, ‘আমি তোমাকেই ভালোবাসি। আর কাউকে ভালোবাসি না তো।’
পৌষী বিশ্বাস করল না। দু’ঠোঁট উলঠে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নার শব্দ তুলল। বলল,
‘তুমি আকসাকে কেন বিয়ে করবে বলেছো? তোমাকে আমি খু,ন করবো আরাভ ভাই। তুমি খুব খারাপ ছেলে।’

‘আমি বিয়ে করব কখন বলেছি? তুমিই তো আমার একমাত্র বউ।’
‘তাহলে আমাকে ছেড়ে কেন চলে এসেছিল? আমি কিন্তু খুব দুঃখ পেয়েছি তখন।’
নিজের বুকের বামপাশে হাত রেখে বলল, দেখ এখানে খুব কষ্ট হত। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না।’

আরাভ পৌষীকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরল। মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমার বুকেও তোমার জন্য কষ্ট হত। বিশ্বাস কর, তুমি ছাড়া আর কাউকে নিয়ে কখনো ভাবিনি। তোমাতেই শুরু, তোমাতেই শেষ।’

বুকে গুজে থাকা পৌষী বার বার নাক টানল। বলল, ‘তুমি পারফিউম ব্যবহার কর না কেন? তোমার পারফিউমের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে তো।’
আরাভ তাজ্জব বনে গেল। নিজের দু’হাত দিয়ে পৌষীর থুতনি আঁকড়ে ধরে বলল, ‘কিন্তু তুমি যে বলেছিল তখন, তোমার পছন্দ নয়। গন্ধে বমি আসে।’

পৌষী কিঞ্চিৎ শব্দ করে হেসে দিল। বলল, ‘আমি তো মজা করেছি তোমার সাথে। কিন্তু তুমি সবকিছুতে এত সিরিয়াস হয়ে যাও কেন?’

‘কখন সিরিয়াস হয়েছি?’

‘মনে নেই কখন সিরিয়াস হয়েছো? সাফওয়ানের সাথে আমাকে দেখে তুমি ভেবে নিয়েছো ওকে আমি ভালোবাসি। তিতলি যে তোমাকে চিঠি দিয়েছে আমি তখন জানতাম না। কিন্তু যখন শুনি হতবাক হয়ে যাই। এজন্য তোমার জন্মদিনে আমার ব্যাগে রাখা উপহার আমি ভেবেছি তুমি তিতলিকে দিয়েছো। কারণ এর আগে মাঝেমধ্যে তুমি তিতলির প্রশংসা করতে। আবার তিতলির চিঠিও পড়েছো। এজন্য ধরে নিয়েছিলাম এসব তিতলির। কিন্তু উপহারগুলো আমি খুলে দেখিনি তখন। স্কুলে তিতলিকে বলি খুলে দেখার জন্য। কিন্তু তখন আমার মনে তোমার জন্য অদ্ভুত অনুভূতি হয়। কেন জানি না, সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়। তিতলিকে দেয়া উপহারগুলো দেখে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। এজন্য সেদিন বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। জানো, সেদিন আমি ফেনী রেলওয়ে জংশনে নিরিবিলি বসে দীর্ঘসময় ধরে কেঁদেছি। সেদিন খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, আরাভ ভাই তুমি আমাকে ভালোবাসোনি কেন? আমি কি দেখতে খুব খারাপ, ঐ তিতলির থেকেও খারাপ। তার ঘন্টা দুয়েক পরে সাফওয়ান আমাকে দেখে ছুটে আসে। আমার মন খারাপ দেখে রেষ্টুরেন্টে জোর করে খেতে নিয়ে যায়। কিন্তু আমি কিছুই খেতে পারিনি সেদিন। সে আমাকে আবার বাইকে করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়। পড়ে যাওয়ার ভয়ে তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখেছিলাম। বিশ্বাস কর, আমি তাকে একটুও শক্ত করে ধরিনি। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমাকে একটুও বিশ্বাস কর না। ভাবছ, সব মিথ্যে বলছি।’

আরাভ পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ ভাবে দৃঢ়বন্ধনে বেঁধে নিল পৌষীকে। চোখেমুখে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিল তার। বলল,
‘কে বলেছে? তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। আমি শুধু রাগানোর জন্য বলেছি এসব। আমিও তোমাকে সব সত্যি বলতে মুখিয়েই ছিলাম। কিন্তু সেদিনের পর থেকে তুমি দূরত্ব বাড়িয়ে ছিলে আমার থেকে। যা প্রতিনিয়ত আমাকে কষ্ট দিত। তাই তো কানাডায় ফিরে এসেছি। শুধু তোমার অনূভুতি প্রকাশিত হওয়ার জন্য। যদিও রোজ ভয় পেতাম, তুমি আমার থাকবে তো। না অন্য কারো হয়ে যাবে?’

পৌষী হিচকি তুলল কাঁদতে কাঁদতে।
‘তুমি পাঁচ বছরে একটা খোঁজও নাওনি, আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি।’

‘দাদুকে জিজ্ঞেস কর, আমি প্রতিদিনই আমার বউয়ের খোঁজ নিতাম। কিন্তু আমার বউ তার জামাইর খোঁজ নেয়নি কখনো।’

পৌষীর প্রতিত্তোর করতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। কারণ ততক্ষণে তার কান্নার বেগ বেড়েছে। ভেজানো গলায় অস্পষ্ট সুরে বলল,
‘আমি ভেবেছি তুমি আমাকে ঘৃণা কর ভীষণ। তাই আর তোমার মুখোমুখি হতে চাইনি।’

কথার মাঝে আরাভ পৌষীর অধর মাঝে নিজের শাহাদাৎ আঙ্গুল চেপে ধরল। হিসহিসিয়ে বলল,
‘আর কথা নয়। এবার শুধু ভালোবাসা। আমার বুকে চুপটি হয়ে ঘুমাও তো।’

পৌষী চুপচাপ বিড়ালছানার মত বুকে মুখ গুজে আছে। ফিসফিস করে বলল,
‘আমি তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ডাকলে রাগ করবে?’
আরাভ তার বোকা বোকা কথায় হাসল। জবাব দিল বেশ কিছুক্ষণ পরে। বলল,
‘যা খুশি ডাকো। শুধু ভাই ডেকো না আর।’

পৌষী বলে উঠল, ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।’
আরাভ ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুম।’

চলবে,,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ৩৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

জ্বরের ঘোরে পুরো তিনদিন বিছানার সাথে লেপ্টে ছিল পৌষী। হুঁশহীন অচেতন জীর্ণশীর্ণ শরীরে ছিল প্রায়। কখন আঁধার ঘনিয়ে রাত নামত, আবার কখন ক্ষণিকের জন্য সূর্য দেখা দিত। তা অজানায় ছিল তার। অবশ্য এতদিন আরাভ নিজের বউয়ের সেবা শুশ্রূষা করতে বিন্দুমাত্রও কাপর্ণ্যতা করেনি। কিন্তু আজ সুস্থ হতেই সারাঘর টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। তার সে কি আনন্দ! আরাভের কাছেও আবদার করেছে, সে পুরো অন্টারিও শহর ঘুরে বেড়াবে। বিনিময়ে আরাভ হেসেছে শুধু। বউ তার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে তার সাথে। আগের সেই চঞ্চলতাবতী পৌষী রূপেই ফিরছে। সে তো এটাই চায় তো এতদিন।

পৌষী পুরো ঘর ঘুরঘুর করা শেষ করে আবার আরাভের কাছে ফিরে এসেছে। তার কোলে বসে দু’গাল টেনে আবদারের সুর তুলে বলল,

‘আপনার বউ তুষারে ঢাকা শহর দেখবে। সেই বরফ দিয়ে ফুটবল খেলবে। পুতুল বানাবে। তারপর সুন্দর দেখে পুতুলের একটা নামও দেবে। তাকে কখন নিয়ে যাবে, বলুন না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।’

আরাভ বিনিময়ে আবারও হাসল। বলল, ‘তোমার শরীর ভালো হোক, পুরোপুরি সুস্থ হও। তারপর তোমায় নিয়ে পুরো শহর দাপিয়ে বেড়াব।’
পৌষী কপট রাগ দেখাল। দু’ঠোঁট উলঠে বলল, ‘তুমি বউকে একটুও ভালোবাসো না, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।’

‘তাহলে কাকে ভালোবাসি?’
‘আমি কি জানি?’

আরিবা নীচে এসে তার ভাই-ভাবীর এমন ভালোবাসাময় দৃশ্য দেখে বেশ আপ্লূত হল। মন তার ভীষণ খুশি। কিন্তু যখনই নিজের কথা ভাবে, দু’চোখে পানি জমে অজান্তেই। কি থেকে কি হল তার জীবনে। এমনটা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি কখনও? আক্ষেপের শ্বাস বেরিয়ে এল বক্ষপট থেকে। পৌষী আরাভ থেকে নিজেকে ছুটালো। মনে মনে পণ করল, সে আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাছে একদমই ঘেঁষবে না। লোকটা একদম খারাপ। তার কোনো আবদারই রাখে না। কিন্তু সিঁড়ির কাছে আসতেই আরিবার মুখোমুখি হল সে। আরিবাকে তার বড্ড অচেনা লাগে আজকাল। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কেমন থম মেরে থাকে। কথার মাঝেও জড়টা। সঠিক কোনো জবাব দিতে পারে না। সে মুখের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটালো। বলল,

কি ব্যাপার ননদিনী! লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের প্রেম দেখা হচ্ছে বুঝি?’

আরিবা মৃদু হাসল। মাথা নাড়িয়ে না জবাব দিল। পৌষী ফের খোঁচা মারল,
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে। তুমিও এমন করে কাউকে নিয়ে ভাবছো, তাই না?’
আরিবা চমকে উঠল হঠাৎই। নিজের অসহায়ত্ব মুখ লুকাতে ব্যস্ত হল। বলল, ‘আরে না ভাবী। এমন কিছু নয়।’
পৌষী তার অদূরদর্শী দৃষ্টি ফেলল। চট করে বলল, ‘তুমি কিছু লুকাচ্ছো বোধহয়। কানাডায় আসার জন্য যতটা এক্সসাইটেড ছিলে, আসার পর ততটাই মৌনতা তোমার চোখমুখে। যেন আনন্দ জিনিসটাই তুমি চেনো না। কি হয়েছে বল তো?’

আরিবা অকূল পাথারে পড়ল বোধহয়। আমতা আমতা করল ফের, ‘কি সব হাবিজাবি বল ভাবী? এমন কিছুই না।’
কথাটুকু শেষ করল হাঁটতে হাঁটতে। তড়িঘড়ি পায়ের কদম চালিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করল। পৌষী থ হয়ে গেল। তার মন বলছে আরিবা কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু কি সেটা?
________

দিন দুয়েক পর আরাভ নিজের কথা রাখল। আরিবা পৌষী দু’জনকে নিয়ে বের হল ঘোরার জন্য। প্রথমে তারা অন্টারিও লেক দেখবে। সেখানে অন্টারিওর মিউনিসিপ্যাল পার্কে থাকবে একদিন। এই পার্ক কানাডার কিংস্টনে অন্টারিও লেকের পাশে অবস্থিত। পাশে কাতারাকি উপসাগর। এই লেক দেখা শেষ হলে সোজা যাবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখার জন্য। কিন্তু পৌষী অন্টারিও লেক দেখেই ফিদাহ। এই লেক এত সুন্দর! সে একবার ন্যাশনাল জিওগ্র‍্যাফিতে দেখেছিল। স্বচ্ছ নীল জল একদম সমুদ্রের ন্যায়। পাশে সাদা বালির বীচ। আশেপাশে ম্যাপল গাছসহ অন্যান্য ঝাউগাছও আছে। আরও আছে নাম না জানা অসংখ্য গাছ। ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ এ লেকের সৌন্দর্য যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

পৌষী আরাভকে ডাকল লেকের পাশে দাঁড়াতে। সে কয়েকটা ছবি তুলবে। ছবি তোলা শেষ হলে তার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপল। সে তুষারের গোলা বানিয়ে আরাভের গায়ে ছুঁড়ল। আরাভ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে তখনও। বউয়ের কার্যকলাপ আজকাল তাকে বেশ ভাবায়। অবশ্য সেও একটু ভাবল। বউকে দুষ্টুমি করতে সময় দিল। কিছু সময় পেরুতেই সেও তুষারের গোলা বানিয়ে বউয়ের গায়ে ছুঁড়ল। পৌষীর গায়ে সেটা না পড়ে অন্যদিকে গিয়ে পড়েছে। এতেই পৌষী হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। আর এই দৃশ্যগুলো আরিবা ক্যামেরা বন্ধি করছে দূর থেকেই। পৌষী আরাভ প্রায় ঘন্টাখানেক নিজেদের মধ্যে গোলা মারামারি করল। শেষে দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে তুষারের মাঝে গিয়ে বসল। কিন্তু পৌষী থেমে নেই। সে তুষারের উপর তুষারের স্তুপ করে একটা পুতুল বানাল। আর সেই পুতুলের নাম দিল পৌরা। আরাভ শব্দ করে হেসে দিল নাম শুনে। বলল,

‘ও তোমার বোন, নাম পৌরা দিলে যে?’

পৌষী কর্ণপাত করেনি আরাভের কথায়। সে ভাবলেশহীন। তার গলার সুরে বেশ আহ্লাদীপনা। বলল,
‘সে একটা পুতুল, তবে বোন হতে চাইলেও সমস্যা কোথায় জনাব?’

‘তাহলে সে আমার শালীকা?’
‘ভাবতে পারেন, কিন্তু আমার বাবার মেয়ে নই কিন্তু।’

আরাভ বউয়ের কান্ডে হাসল। জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার পর থেকে মেয়েটা বেশ দুষ্ট আর চঞ্চল হয়ে গেছে।

পুরো একদিন অন্টারিও লেক ঘোরাঘুরি শেষে তারা পৌঁছাল নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখার জন্য। এটি বোধহয় পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের মধ্যে একটি। এর আশেপাশে অজস্র হোটেল রেষ্টুরেন্ট অবস্থিত। বিয়ে করার জন্য অন্যতম বেষ্ট জায়গা হিসেবে এটাকে বেছে নেয় কানাডিয়ান’রা। তাই প্রচুর কাপল আসে রোজ এখানে। আরাভ পৌষীকে সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাল। দেখতে যতটা মুগ্ধতা মেশানো, ঠিক ততটাই ভয়ংকর এই জলপ্রপাত। তাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তারা এর প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করছে। পুরো একদিন নায়াগ্রা জলপ্রপাতে কাটালো তারা। দিন পাঁচেক তারা শহরের বিভিন্ন পর্যটন এলাকাগুলোও ঘুরে আসল।

ঘোরাঘুরি শেষে শরীর-মন দুটোই সতেজ থাকে। ক্লান্তিগুলো যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় নিজের শরীর থেকে। কিন্তু আরাভ কিছুটা বিচলিত। পরের দিন তাকে চিরাচরিত সেই অফিসে যেতে হবে। পৌষীকেও নিয়ে ভার্সিটি যেতে হবে। তাকে ভর্তি করানোর জন্য ভর্তির আবেদন জমা করে এসেছে সে।
___

আরিবার দিন যাচ্ছে কোনোরকম। নিজের মাঝে নিজেকেই খুঁজে পায় না ইদানিং। কিন্তু ভাইয়ের অবাধ্য হতে পারবে না সে। তাই ভাই-ভাবীর সাথে নিজের ভার্সিটিতে পা রেখেছে প্রায় একমাস পর। চেনা ভার্সিটিও আজ বড্ড অচেনা ঠেকছে তার কাছে। সে ক্লাসের বাইরে বসে আছে। আরাভ পৌষী টিচাররুমে প্রফেসরদের সাথে কথা বলছে। হঠাৎই পরিচিত এক মুখ দেখে সে ঘাবড়ে গেল। এ লোককে দেখলেই তার বমি আসে এখন। সে দ্রুতই টিচাররুমে প্রবেশ করে ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। পৌষী আরিবার এহেন আচরণে বেশ অবাক। কিন্তু জিজ্ঞেস করার জন্য এটি মোক্ষম সময় নয় বিধায় বলা হয়ে উঠেনি তার। টিচাররুম থেকে আরাভ বের হতেই আরিবা বলে উঠল,

‘ভাইয়া ভাবীকে এখানে ভর্তি না করালে হয় না। দেশে সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী কিন্তু।’

আরাভ থমকে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
আরিবা কিঞ্চিৎ ভয় পেল। আমতা আমতা করল তখন। বলল,
‘দেশের স্নাতক শেষ হলে ভাবী স্নাতকোত্তরটা না হয় এখানে পড়বে। তাই বলছিলাম আর কি।’

আরাভ আরও বেশি অবাক হল। তার বোন এর আগে পৌষীকে কানাডা নিয়ে আসার জন্য সবার আগে সেই সমর্থন জানিয়ে ছিল। কিন্তু আজ তার কথার বদল দেখে তার মনেও কিঞ্চিৎ সন্দেহের উৎপত্তি হল। কিন্তু সে প্রকাশ করল না। চুপ মেরে গেল নিভৃতেই। বলল,

‘কানাডায় স্নাতক পর্যায়ে পড়লে স্নাতকোত্তর পড়ার দরকার নেই। এদেশের পড়ার সাথে নিজের দেশের পড়ার আকাশ পাতাল পার্থক্য কিন্তু। এখানে পড়া শেষে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার আছে। কিন্তু দেশে এর কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাই কানাডায় পড়াটাই উত্তম।’

আরিবা চুপ হয়ে গেল। কিন্তু তার মন বলছে, এই দেশ যতই উন্নত হোক কিন্তু এদেশের বিরূপ সংস্কৃতি তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। তার চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ। কীভাবে বলবে সে এসব কথা।
___

শীতের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। ম্যাপল পাতার দেশে মার্চ এলে বসন্তের আগমন হয়। তখন গাছে গাছে বাংলাদেশের মত কোকিলের ডাক শোনা না গেলেও বিচিত্র রকমের পাখির আনাগোনা বেড়ে যায়। ম্যাপল গাছের পাতারা নিজেদের সৌন্দর্য বিলিয়ে বেড়ায় এই সময়। রাস্তার ধারে, বাড়ির আশেপাশে কমলা রঙের ম্যাপল পাতা ঝরে পড়ে থাকে। এমন দৃশ্য কানাডার জন্য খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এমনই একদিন বিকেলের ঝলমলে রোদের মাঝে আরাভ হন্তদন্ত হয়ে বাসায় আসল। হাতের মাঝে রাখা কিছু কাগজ, ফাইল ছুঁড়ে মারল বিছানায়। শার্টের কলারে আঁটোসাটো টাই’টাও ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। আরিবা ভাইয়ের এমন হনহনিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশের দৃশ্য দেখেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সময় সুযোগ কিছুই পায়নি সে।

পৌষী ওয়াশরুমে ছিল, বের হয়ে চমকে উঠল আরাভের এমন বিরূপ আচরণ দেখে। জিজ্ঞেস করতে সে প্রথমে ভয় পাচ্ছিল। পরে সাহস সঞ্চার করে বলল, ‘কি হয়েছে তোমার?’

আরাভ পৌষীকে আলগোছে বুকের মাঝে চেপে ধরল। গলার স্বর ভীষণ কাঁপছে তার। কাঁপা স্বরে বলল,
‘বিয়ের ইনভিটেশন কার্ড পেয়েছি আমার কলিগের। পৌষী বিষয়টা বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে ভীষণ। বিয়ে কার সাথে হবে জানো?’

আরাভের দু’ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। পৌষী গুজে থাকা মাথা আরাভের বুক থেকে বের করল। চট করে বলল, জানি না’তো! কার সাথে বিয়ে হচ্ছে? তুমি তো বলনি আমাকে।’

আরাভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুখ কুঁচকে জবাব দিল পৌষীর। বলল,
‘খুবই বিচ্ছিরি ব্যাপার। বলতেও মুখে বাঁধছে আমার। এই দেশে সমকামিতা এত বেশি হয়, কি বলব আর?’
পৌষী চমকালো। বলল, ‘দু’জনই কি ছেলে?’

আরাভ মাথা নাড়াল। বলল, ‘না ছেলে নয়, দু’জনেই মেয়ে।’

পৌষী চুপ হয়ে গেল। বলার ভাষা নেই তার। সে অপেক্ষা করছে আরাভ কি বলবে এখন তা শোনার জন্য। আরাভ মৌনতা পালন করছে চুপচাপ। কিছুসময় পর নিজের মৌনতা ভেঙে বলল,

‘সর‍্যিই বউ! আমি নিজেকে সেইফ রাখতে পারব, তোমাকেও হয়ত সেইফ রাখতে পারব। কিন্তু আমার বাচ্চাদের সেইফ রাখতে পারব না। এদেশ উন্নত হলেও এদেশের এসব কালচার আমাদের জন্য উপযুক্ত নয়। ভাবছি দু’বছর পর একবারের জন্য নিজের দেশে ফিরে যাব। এদেশ আমার বাচ্চার জন্য একদমই নিরাপদ নয়।’

পৌষী হাসল। তার কোন আপত্তি নেই। আরাভও খুশি হল বউয়ের সম্মতি পেয়ে।

চলবে,,,,,,