প্রিয় পৌষমাস পর্ব-৯+১০

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

পূর্ণী ক্লাস শেষ হতে ফটকের সামনে দাঁড়াল। দেখল কিছু ছেলের জটলা বেঁধেছে বাইরে। তাদের পাশ কাটিয়ে সে রাস্তায় উঠল। ছেলেগুলোর মাঝে একজন তাকে ক্ষেপালো,
‘এই যে বাঁশের কঞ্চি।

পূর্ণীর মেজাজ চটে গেল। মুখে যা আসল তাই বলল, ‘তুই কঞ্চি, তোর বাপ কঞ্চি, তোর চৌদ্দগুষ্টি কঞ্চি।’
ছেলেগুলো হেসে দিয়ে বলল,
‘দাঁড়া কে কঞ্চি দেখাচ্ছি।’

পূর্ণী আর দাঁড়াল না। দ্রুত কদমে বাড়ির দিকে ছুটল। কিন্তু আচমকাই এক মোটরবাইকের সাথে ধাক্কা খেল। ভাগ্যবশত এই যাত্রায় বেঁচে গেল। তেমন কিছুই হয়নি। মোটরবাইকার চটজলদি তার বাইক থামিয়ে ফেলেছে। পূর্ণী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইকার তাকে জিজ্ঞেস করল,
‘এত দ্রুত ছুটছিলে কেন?’
পূর্ণী আমতা আমতা করল,
‘আসলে ওরা আমাকে রোজ ক্ষেপায়। বলে আমি না’কি বাঁশের কঞ্চি।’
সাফওয়ান বাইক ছেড়ে নামল। বলল,
‘চল তো দেখি ওরা কারা? কেন ক্ষেপায় শুনে আসি?’

পূর্ণী সাফওয়ানকে নিয়ে ছেলেগুলোর সামনে গেল। তখন ছেলেগুলো তাকে দেখে অবাক হল। কিন্তু পাশে সাফওয়ানকে দেখে আরও বেশি অবাক হল। বলল,
‘ভাই তুমি এখানে?’
সাফওয়ান তাদের কথার জবাব না দিয়ে সোজাসাপটা বলে উঠল,
‘তোরা ওকে বাঁশের কঞ্চি কেন বলিস?’
ছেলেগুলো মূহুর্তে হেসে গড়াগড়ি খেল। বলে উঠল, ‘ভাই আমরা ওর সাথে মজা করেছি শুধু।’
সাফওয়ান তেতে উঠল। তেজী গলায় বলল,
‘মেয়েটা তোদের পরিচিত।’
ছেলেগুলো বলল, না।

‘তাহলে একটা অপরিচিত বাচ্চা মেয়ের সাথে তোদের কিসের মজা? আজ তোদের জন্যই বড় একটা দুর্ঘটনা হতে পারত। তাই কড়াভাবে হুঁশিয়ারী দিচ্ছি। এরপর আর কারো সাথে এমন মজা করবি না। মনে থাকে যেন।’

ছেলেগুলোকে সাফওয়ান সাবধান করে চলে এল। পূর্ণীকে জিজ্ঞেস করল বাসা কোথায়? চল বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। পূর্ণী দ্বিরুক্তি না করে সাফওয়ানের সাথে বাসায় ফিরল। ফটকের সামনে আরাভ দাঁড়ানো ছিল। সাফওয়ানের সাথে পূর্ণীকে দেখে ভীষণ অবাক হল। বলে উঠল,
‘তুই পূর্ণীকে কোথায় পেলি? ওর কিছু হয়েছে? পূর্ণী তো স্কুলের গাড়িতে আসে।’

সাফওয়ানও অবাক হল। বলল, ‘পূর্ণী তোর কি হয়?’
‘আমার কাজিন।’
সাফওয়ান ফের বিস্মিত হল। তড়িৎ জবাব দিল, ‘কে, পৌষীর বোন?’

আরাভ মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, হুম।
সাফওয়ান শুনে বেশ খুশিই হল। শেষমেষ কি’না সে পৌষীর বোনকেও পেয়ে গেল। কি আজব কপাল তার। হেসে উঠল। আরাভ তাকে বাসায় ডাকল। সাফওয়ান দ্বিরুক্তি করতে চাইলেও পূর্ণীও তাকে যেতে বলল। আরাভের পিছু পিছু উপরে উঠে এল সে। পূর্ণী সাফওয়ানকে বসার ঘরে বসতে বলল। ঘরের সবাইকে ডাকল আরাভ। সাফওয়ান লজ্জা পাচ্ছে। এ এক অন্যরকম লজ্জা। পৌষী বাসায় নেই, এখনো স্কুলে। তাই তাকে দেখা হল না তার। সামান্য নাস্তা করে বেরিয়ে গেল দ্রুতই।

বিকেল গড়াতেই পৌষী স্কুল থেকে বাসায় এল। খাবার খেয়ে রেষ্ট নিয়ে আবার পড়তে বসতে হবে। এক যন্ত্রণা তার। শুধু পড়ালেখা আর পড়ালেখা। কি হবে এত পড়ে? সেই তো একদিন মরেই যাবে। আফসোসে পুড়ল কিছু সময়। আচমকাই নজর পড়ল তার রুমের চৌকাঠে। আরাভ প্রবেশ করছে তখন। কিন্তু আজকে আরাভকে অন্যরকম লাগছে। পরনে নতুন টিশার্ট, চুল স্টেট করে আঁচড়ানো। গায়ে তীব্র গন্ধযুক্ত পারফিউম। পুরো রুম তার গায়ের গন্ধে মৌ মৌ করছে।

পৌষী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই এমন সাজ কেন তার? আরাভ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
‘কি ব্যাপার! মনে হয় আজ প্রথম দেখছিস? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’
পৌষী ভাবনায় মশগুল তখনও। আচমকাই বলে উঠল,
‘আরাভ ভাই, তোমাকে তো আজকে একদম হিরো হিরো লাগছে।’
আরাভ চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ তা অন্যদিন কেমন লাগে?’
পৌষী কিঞ্চিৎ সুর টানল,
‘ হুমম, অন্যদিনও লাগে। তবে আজকে একটু বেশি লাগছে। তা কোথাও যাবে না’কি?’
আরাভ মাথা নিচু করে জবাব দিল, না।

পৌষী নাক টানল তখন। মুখ বাকিয়ে বলল,
‘তাহলে এত কড়া পারফিউম কেন দিয়েছো? আমার তো নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেরে দিবা না’কি?’

আরাভ যেন আকাশ থেকে পড়ল। এই মেয়ে বলল তার গায়ের পারফিউমের গন্ধ বেশ ভালো লাগে। তাহলে সামনে এমন নাক সিটকাচ্ছে কেন? অদ্ভুত তো! না’কি তাকে বুঝতে দিতে চায় না। সে পড়ল মহা বিপাকে। নিজের টিশার্ট শুঁকে বলল,
‘বেশি সমস্যা হচ্ছে তোর?’
পৌষী মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, ‘হুমম।’
আরাভ চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। বলে উঠল,
‘ঠিক আছে চেইঞ্জ করে আসছি।’

আরাভ যেতেই পৌষী মুখ টিপে হাসল। পারফিউমের গন্ধটা দারুণ ছিল। কিন্তু আরাভকে জব্দ করতে পেরে তার বেশ শান্তি লাগছে। এভাবে মাঝেমধ্যে জব্দ করা যাবে। আরাভের চুপসে যাওয়া মুখটা ভাবতেই তার দমবন্ধকর হাসি পেল। তার আরাভ ভাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সেই মুখটা ভাবতেই পারছে না সে। আহ! বেচারা কি লজ্জাটায় না পেল। পৌষী মনের সুখে বেসুরা গলায় গান ধরল,

‘নীলে নীলে আম্বর পার চাঁদ যাব আয়ে,,,

বাকী গান তার গাওয়া হল না। আচমকাই আরাভ প্রবেশ করল তার রুমে। আগের টিশার্ট চেইঞ্জ করে নীল রঙা গেঞ্জি পরেছে। সে তো যারপরনাই অবাক। তার আরাভ ভাই নীল রঙের গেঞ্জি পরেছে। কি দারুণ লাগছে তার আরাভ ভাইকে। যেন এক খন্ড নীল রঙা আকাশ তার সামনে বসে আছে। তার তো চোখেই সরছে না। সে হা হয়ে আছে। হুট করে বলে উঠল,

‘নীল রঙের গেঞ্জিতে কিন্তু তোমাকে দারুণ লাগছে, আরাভ ভাই। জানো নীল রঙ কিন্তু আমার প্রিয় রঙ। আজকে তো একদম নীল রঙা আকাশ হয়ে গেছো তুমি। মনে হচ্ছে এক খন্ড নীল রঙের আকাশ আমার সামনে বসে আছে।’

নিজের এমন ভূয়সী প্রশংসা শুনে আরাভ যেন মুহুর্তে লজ্জায় গুটিয়ে গেল। লজ্জা ঢাকতে মুখে এক হাত রাখল সে। নাকের আশেপাশে অযাচিত হাতের বিচরণ করল। কথার জবাব খুঁজে না পেয়ে পৌষীকে ছোট্ট করে বলল,
‘তো এখন আমি কি করব?’
পৌষী মুচকি হেসে বলল, ‘আরাভ ভাই তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো? তোমার মুখ কিন্তু ব্লাসিং করছে।’

আরাভ ততক্ষণে চেয়ারে বসে পড়েছে। বেশ কষ্ট করে নিজের গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে তখনও। চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক নিল। মুখে রাখা হাত দিয়ে নিজের থুতনি বুলাচ্ছে বার বার। লজ্জা ঢাকতে তার যত কৌশল। কতক্ষণ পারবে কে জানে। কিন্তু পৌষী যেন নাছোড়বান্দা। মুখের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে সে তার মুখ রাখল একদম আরাভের মুখ বরাবর। সাথে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল,

‘আরাভ ভাই, লজ্জা পেলে তোমাকে কিন্তু অনেক কিউট লাগে।’

পৌষীকে এত কাছে দেখে আরাভ যেন আৎকে উঠল। তাদের দূরত্ব যৎসামান্য মাত্র। এতটা কাছে, সে চাইলে পৌষীর সাথে যেকোন কিছু ঘটাতে পারে। নিয়ন্ত্রণাধীন হতে পারে যেকোন মুহুর্তে। কিন্তু এমন অযাচিত কিছু দু’জনের জন্য কখনও ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এতে হিতের বিপরীত হতে পারে। কিন্তু এখন তাকে চটজলদি পৌষীকে থামাতে হবে। মুহুর্তে আরাভ যেন আগুনের ফুলকির মত দপদপ করে জ্বলে উঠল। জলন্ত লাভার ন্যায় চোখেমুখে অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। ফোঁস করে বলল,

‘এতটাও কাছে আসবি না, যতটা কাছে আসলে আমি বেপারোয়া হয়ে যাই। মাইন্ড ইট।’

পৌষী মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল আরাভের দিকে। তার আরাভ ভাই তাকে হুমকি দিল না’কি সর্তক করল। তার ছোট্ট মাথায় ধরল না। আর কীসের বেপারোয়া হবে? আর কেনই বা হবে? এটাই বুঝল না। সে’তো মজা করছিল শুধু। এটা নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে? আশ্চর্য তো! এরপর সে আর টুঁশব্দও করেনি। মাঝে মাঝে সে এই আরাভকে বুঝতে পারে না। কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। তার ভীষণ মন খারাপ হল। নিশ্চুপ বইয়ের পাতায় চোখ বুলালো। আজ থেকে সে আর আরাভের সাথে কোন কথাই বলবে না।

আরাভও নিভৃতে দেখল পৌষীর চুপসে যাওয়া থমথমে মুখ। আক্ষেপে পুড়ল। কিন্তু সে বা কি করবে? সে যে কারও কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চাইলেও কিছু করতে পারবে না। বাক্য বিনিময় ছাড়াই দু’জনে হু হা তে কথা বলল। পড়ানো শেষ করে আরাভ বেরিয়ে গেল চুপচাপ। তখনও পৌষী মুখ কালো করে রেখেছে। যেন আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ জমেছে তার মুখ জুড়ে। যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে ঝমঝমিয়ে।

সন্ধ্যা গড়ালো ধরণী তলে। প্রিয়া বিকেলের নাস্তার জন্য ডাকল পৌষীকে। কিন্তু সে নিশ্চুপ নিজের রুমে পড়ে আছে, বেরুইনি একদম। আরিবা এসে ডাকল,
‘পৌষী আপু, তোমাকে ডাকছে নাস্তা খাওয়ার জন্য। এসো না জলদি।’
পৌষী ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘খিদে নেই।’
আরিবা বাধ সাধলো। বলল,
‘চল না আপু, এমন গো ধরে বসে আছ কেন? কি হয়েছে তোমার?’

আরিবার এমন অনুনয় বিনয় শুনে পৌষী বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এল। আরিবা এক হাত ধরে রেখেছে তার। এসে দেখল সবাই খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। আরাভ তখনও আসেনি। পৌষী বসতেই হুট করে আরাভও পাশে এসে বসল। পৌষী দেখেও না দেখার ভান করল। আরাভের গায়ে নীল রঙা গেঞ্জিটা এখন আর নেই। কালো গেঞ্জি পরেছে। মুখে হাসি নেই তার। থম মেরে আছে। সৌরভ গৌরব পাশাপাশি। দুজনেরই নজর আরাভ পৌষীর দিকে। দুজনে আজ এত চুপচাপ। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। তাদের সন্দেহ জাগল মনে। তাই গৌরব পৌষীকে বলে উঠল,

‘কি হয়েছে আম্মাজান? আজ এত চুপ কেন? কেউ কিছু বলেছে?’
পৌষী জবাব দেয়ার আগেই নাজমা টিপ্পনী মারল,
‘আরাভ ছাড়া আর কে হবে? নিশ্চয়ই ও কিছু বলেছে। সে ছাড়া তো এত দুঃসাহস আর কারো নাই।’

আরাভ খাওয়ার মাঝেও বিষম খেল। এটা তার দাদু না’কি সিআইডি অফিসার। কেমনে সব বুঝে যায় কে জানে?
সৌরভ আরাভের দিকে পানি এগিয়ে দিল। মায়ের তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
‘শুধু শুধু আমার বাবাজীর উপরে দোষ দিও না’তো আম্মা। পৌষীও নিশ্চয়ই কোন অন্যায় করেছে।’

নাজমা পৌষীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘হ্যাঁ রে পৌষী তুই আরাভকে কামড় মারতে পারিস নি। আগে তো কথায় কথায় কামড় দিতি। এখনও আরাভের কাঁধে, বুকের মধ্যে আর পেটে তোর কামড়ের দাগ আছে।’
পৌষী হতভম্বের মত নিজের দাদুর দিকে চেয়ে আছে। টেবিলের সবার দিকে একপলক নজর বুলালো। সবাই মুখ টিপে হাসছে তাকে নিয়ে। আরাভ নিশ্চুপ খেলেও সে জানে এই লোক বেশ মজা নিচ্ছে তার। ছিঃ! কি লজ্জা! লজ্জায় তার মরমর অবস্থা। সে সত্যি আগে আরাভকে কথায় কথায় কামড় বসাতো। আর এটা নিয়ে রীতিমতো সবাই হাসাহাসি করে এখনও। মাঝে মাঝে আরাভও তাকে এটা নিয়ে ক্ষেপায়। সে না’কি রাক্ষুসী রানী কটকটি। সে ভাত না খেয়ে তাকে কামড়াতো শুধু।

অবস্থা বেগতিক দেখে গৌরব পৌষীর পক্ষ নিয়ে বলল,
‘দোষ শুধু আমার আম্মাজানের ছিল না, তোমাদের আদরের আরাভ সে কি কম ছিল? আরিবাকে নিয়েই তো তখন দুজনের মাঝে ঝগড়া হত। ঝগড়া নয় শুধু রীতিমতো যুদ্ধ হত। পৌষী আরিবাকে কোলে নিতে চাইতো, আর আরাভ আরিবাকে ছুঁতেও দিত না। এজন্য পৌষী ক্ষেপে গিয়ে কামড় বসাতো। বেচারীর কি দোষ বল?’

আরিবা হা হয়ে সবার কথা শুনছে। হুট করে বলে উঠল,
‘ভাইয়া, পৌষী আপু ছোটবেলায় তোমরা দু’জন আমাকে নিয়ে এত ঝগড়া করতে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! কিন্তু এখন তোমরা কি নিয়ে ঝগড়া কর? আমি তো বড় হয়ে গেছি।’

আরাভের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল মুহুর্তে। নিজের বোনের কি জবাব দিবে এখন। চটজলদি বলে উঠল,
‘আমরা ঝগড়া করলাম কখন? পৌষীকে পড়ার জন্য বকেছি বলেই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সেটাও কি আমার দোষ?’

পৌষী প্রতিবাদ করে উঠল তড়িৎ,
‘মোটেও পড়ার জন্য আমাদের মাঝে ঝগড়া হইনি। আমি তো শুধু আরাভ ভাইকে বলেছি তোমাকে,,

‘তোকে যে বই থেকে এলোমেলো ভাবে অংক করতে দিয়েছিলাম, তার মাঝে কয়টার উত্তর দিতে পেরেছিলি? সেটা বল আগে?’
পৌষী পুরো কথা শেষ করার আগে আরাভ জবাব দিয়ে দিল। বেচারি মুহুর্তে চুপচে গেল। নিজের বাবার দিকে তাকাল একপলক। এখন কি তার বাপ বকবে? সে চট করে গৌরবের দিকে তাকাল,

‘বড় পাপাহ, তুমি কিছু বলো না। তোমার ছেলে সারাক্ষণ আমার পেছনেই লেগে থাকে। আমি আর তোমার ছেলের কাছে পড়ব না।’

সৌরভ ধমকে উঠলেন।
‘পড়াশোনা না করলে এই বাড়িতে থেকে তোমার কাজ নেই। ভাবছি পাত্র দেখব। তারপর তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেব।’

হাস্যোজ্জ্বল পৌষী বাকরুদ্ধ হয়ে গেল হঠাৎই। হতভম্বের মত তাকাল নিজের বাবার মুখপানে। সত্যিই বিয়ে দিয়ে দেবে? দু’চোখ ছলছল। খাবার তার গলা দিয়ে নামল না আর। চেয়ার ছেড়ে নিজের রুমের দিকে ছুটল দ্রুত। আরাভ মুখে হাত দিয়ে বিড়বিড় করল, মাথামোটা একটা।

চলবে,,

#প্রিয়_পৌষমাস ১০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

গত দু’দিন স্কুলে যায়নি পৌষী। ঘরের কোণে দিন কাটিয়েছে বেশিরভাগ। খাবার খেয়ে চুপটি করে বসে থাকত নিজের রুমে। বাবার চোখের সামনে একদমই পরেনি। কিন্তু আজ তার মত বদলে ফেলেছে। সে স্কুলে যাবে। তাই একদম তৈরি হয়ে স্কুলের জন্য বের হচ্ছে। বসার ঘরে নাজমা বসে আছে। বেশ অবাক হল নাতনীর আকস্মিক পরিবর্তনে। গত দু’দিন বলে বেড়িয়েছে আর স্কুলে যাবে না সে। কিন্তু আচমকা মত বদল হয়ে গেল কেন তার? সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল নাতনীর দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘তুই স্কুলে যাবি না বললি, পড়াশোনাও আর করবি না। তাহলে এখন স্কুলে কেন যাচ্ছিস?’

‘পাত্র খুঁজতে।’
পৌষীর সোজাসাপ্টা জবাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেল নাজমা। দ্বিতীয়বার সে কিছু বলার আগে পৌষী পুনরায় বলে উঠল,
‘তোমার ছেলেকে বলবে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আমি আর এ বাড়িতে থাকব না। পড়াশোনাও আর করব না।’

নাজমা দু’চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। মুচকি হাসল। জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই পাশ থেকে দ্রুত আরাভের জবাব এল,
‘বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও পড়তে হবে। জামাইও তোকে ধরে বেঁধে পড়াতে বসাবে। তখন কি করবি, পৌষমাস?’

দরজার সামনে দাঁড়ানো আরাভের শান্ত সুরের অপমান কানে এল পৌষীর। মনে মনে ভেঙচি কাটল। আরাভের উপর বেশ বিরক্ত সে। তাই জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বের হল। আরাভও চুপচাপ দেখল শুধু কিন্তু পুনরায় আর কিছু বলেনি আর।

দু’দিন পর স্কুলে বান্ধুবীকে দেখে একটু বেশিই খুশি হল তিতলি। কানের কাছে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমার কাজটা করেছিস?
পৌষী বুঝল না কিসের কাজ। হা হয়ে তাকাল শুধু। সে জবাব দিল, কিসের কাজ তোর?
তিতলি আশাহত হল। তাই অসহায় মুখে পৌষীর ব্যাগে হাত দিল নিজের চিঠি খুঁজতে। পৌষী ধমক দিল ব্যাগে কি খুঁজিস? তিতলি শুনল না। সে ব্যাগ খুঁজে নিজের রেখে দেওয়া চিঠি ভেবে হাতে নিল একটা কাগজ। কিন্তু পৌষী তার আগেই ছোঁ মেরে নিজে নিয়ে নিল। ভাঁজ করা চিঠিটা মেলে পড়তে নিতে হা হয়ে গেল। সে তিতলির দিকে তাকাল। এটা তো আরাভের ভাইয়ের হাতের লেখা। তিতলিও বেশ অবাক।

‘এসব ভুজুংভাজুং প্রেমের চিঠি না লিখে পড়ায় মনোযোগ দাও। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট কর, তারপর না হয় আমরা প্রেম বিনিময় নিয়ে ভাববো।’

পৌষী আচমকাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল আরাভের তিতলিকেও পড়ার চাপ প্রয়োগ দেখে। তিতলি বেচারি হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। নিজমনে আরাভকে গালি ছুঁড়ল, এত নিরামিষ কেন এই লোক? এভাবে প্রেমপত্রে কেউ পড়ালেখা নিয়ে কথা বলে। তারপর থেকে তিতলি সাহস করে আর কখনও আরাভকে চিঠি দেয়নি, আর না আরাভ থেকে কোন চিঠি পেয়েছে। সময়টা এভাবে যাচ্ছেই। পৌষী না চাইতেও আরাভের কাছে এখনো টিউশন পড়ছে। তার নবম শ্রেণীর ফাইনাল পরিক্ষা চলছে। তবে আগের মত তেমন বাক্য বিনিময় হয় না দু’জনের মাঝে। শুধুমাত্র পড়াশোনার মত জরুরী বিষয় ছাড়া।

ঠিক দু’মাস পর, আরাভের জন্মদিনের আগের রাতে পৌষী নিজের টেবিলে একটা চিঠিসহ প্যাকেট দেখতে পায়। বেশ কৌতুহল জাগল তার। কিন্তু প্যাকিং করা ছিল বিধায় দেখতে পেল না ভেতরে কি আছে? তাই পরেরদিন স্কুলে এসে তিতলির হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটা খোল জলদি। ভেতরে কি আছে দেখব।
তিতলি প্যাকেট খুলে অবাক। সেখানে একটা কালো গ্রাউন, আর কিছু পাথরের গহনাদি। এগুলো পরে একটা রেষ্টুরেন্টে যেতে বলেছে তাকে। এসব দেখে পৌষীর অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। তার আরাভ ভাইও তাহলে তিতলিকে পছন্দ করে। ভালোই তো। কোথাও যেন তার একটু হলেও খারাপ লাগছে। কিন্তু কেন, তার কারণ জানা নেই তার। আজকে তার আরাভ ভাইয়ের জন্মদিন। তার ইচ্ছে ছিল দারুণ কিছু উপহার দেয়ার। কিন্তু সেই উপহার তার দেয়া হল না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে মন চাইল না তার। মন যেখানে যাচ্ছে, সেও ছুটছে সেদিকে।
__

রেষ্টুরেন্টে বিকেল থেকে বসে আছে আরাভ। নিজমনে বিরক্ত হল এই মেয়ে এত দেরি করছে কেন? সময় যেন তার ফুরাচ্ছে না। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর কাঙ্খিত মুখ দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটল। কিন্তু মুখের মাস্ক খুলতে যাকে দেখল পুরাই বাকরুদ্ধ। তার গলা কাঁপছে। বলে উঠল,

‘তুমি এখানে? আর এই গ্রাউন তোমার পরনে কেন?’

তিতলি আরাভের আচরণ দেখে হতভম্ব। এতক্ষণ মুখে মুচকি হাসি ছিল। কি সুন্দর তাকে দেখছিল। আচমকা সেই হাসিমাখা মুখ কোথায় গায়েব হয়ে গেল। আর তার সাথে এভাবে কেন কথা বলছে। নিজের কৌতুহল দমিয়ে দ্রুত জবাব দিল,
‘আমি না আসলে কে আসবে? আপনি তো আমাকে এই গিফট পাঠিয়েছেন।’

আরাভের চোয়াল শক্ত হল। বলে উঠল, ‘হোয়াট রাবিশ? তোমাকে কেন আমি উপহার পাঠাতে যাব?’

সে আরও কিছু বলতে চাইল কিন্তু হুট করে তার মুঠোফোন কম্পিত হল সেই মুহুর্তে। নিজের রাগ সংবরণ করে কলটা রিসিভ করল দ্রুতই। কিন্তু ওপাশ থেকে যেই উত্তর আসল তাতে চোখেমুখে উদ্বেগের আর্বিভাব ঘটল তৎক্ষনাৎ। পৌষী বাসায় ফেরেনি এখনো। স্কুল ছুটি হয়েছে তিন ঘন্টা হতে চলছে। কোথায় গেছে কেউ বলতেও পারছে না। সে তিতলির দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল। বলল,

‘পৌষী কোথায়? নিশ্চয়ই তোমার বাসায় আছে?’

তিতলি বেকুব বনে গেল। পৌষী কোথায় সে তো জানে না। তার বাসায় তো যায়নি। পৌষী যদি নিজের বাসায় না ফেরে তাহলে কোথায় এটা তো, সেও জানে না। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ করে পৌষীর গায়েব হয়ে যাওয়া, আরাভের এমন ব্যবহার, তার সাথে কি হচ্ছে বুঝতে পারল না। তিতলির নিশ্চুপতায় আরাভ বেশ বিরক্ত হল। চটজলদি ধমকের সুর তুলল মুখে,

‘মুখে কুলুপ দিছো? জবাব দাও না কেন?’

‘আমি জানি না, পৌষী কোথায়?’

দ্রুতই কাঁপা গলায় জবাব দিল তিতলি। কিন্তু আরাভ বিশ্বাস করল না তার কথা। পুনরায় জিজ্ঞেস করতে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ার অবস্থা প্রায়। নিজের কান্না সংবরণ করে পরে সবকিছু প্রথম থেকে খুলে বলল। তার চিঠি দেওয়া, জবাবে আরাভের চিরকুট পাওয়া। আবার আজকে সকালে পৌষী তার হাতে চিঠিসহ উপহারের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া। সেটাও বলল। কিন্তু স্কুল থেকে বের হবার পর পৌষী কোথায় গেছে সে জানে না। এসব শুনে আরাভের কন্ঠরোধ হয়ে এল। সেই চিঠি তাহলে পৌষীর নয়, তিতলির ছিল। অথচ সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। কিন্তু পৌষী বাড়ি ফিরল না কেন এখনো। সে কোথায়? তার কোন বিপদ হয়নি তো। রেষ্টুরেন্টে আর দাঁড়াল না। তিতলিকে রেখে বেরিয়ে পড়ল আরাভ।

মাথায় ঘুরছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যদি সে রকম কিছু ঘটে পৌষীর সাথে! ভয়ে তার দমবন্ধ হবার উপক্রম। সৌরভ কল দিল তখন। তারা সবাই হাসপাতালে। মাসুদের অবস্থা আশংকাজনক। তাই নিজের দাদাকে জীবিত দেখতে চাইলে দ্রুত আসতে বলল আরাভকে। তার দাদার অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ভালো নয়। আজকাল হুঁশজ্ঞান নেই। সকাল থেকে কেমন নির্লিপ্ত দেখেছে সে। দাদার জন্য মন আনচান করল তার। অন্যদিকে পৌষীও কোথায় গেল বুঝল না। গৌরব পুলিশকে কল দিয়েছে। সৌরভ এখনো নিজের মেয়ে সম্পর্কে কিছুই জানে না। গৌরব ভুলিয়ে রেখেছে অনেক আগে থেকে।

পৌষীর মুঠোফোন বাড়িতে, তাও বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে টেবিলের ড্রয়ারে। তার সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই এই মুহুর্তে। মেয়েটার ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু কেন ফেরা হয়নি তা নিয়ে নানা রকমের উৎকন্ঠায় মস্তিষ্ক অসাড় তখন। জ্যামের মাঝে বাইক ক্ষানিক দাঁড় করালো আরাভ। আর তখনই চোখ তার এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখল, যা তার জীবনের মোড়টায় পরিবর্তন করে দিল। দু’চোখ আপনা আপনি বন্ধ করল। নিজমনে বিড়বিড় করল,
এত কাছে থেকেও তোকে ছুঁতে আমার ছিল হাজারও দ্বিধাবোধ। আর সে তুই অন্যের কাঁধে হাত রাখিস। এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি এতকাল অপেক্ষা করেছি।

দু’চোখে জল চিকচিক করছে তখন। বাইক ঘুরালো হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালের করিডোরে পা রাখতেই মুঠোফোনে টুংটাং শব্দ তুলল। জরুরি কারো মেসেজ ভেবে স্ক্রিনে চোখ ভুলালো। প্রায় ডজন খানেক ছবিতে ভর্তি তার হোয়াটসঅ্যাপের ইনবক্স। একটা ছবিতে ক্লিক করতে দেখল পৌষীর হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। পাশে বসা সাফওয়ানের অপলক দৃষ্টি তার উপর। বাকী ছবি দেখার ইচ্ছে হল না আর। টেক্স আসল তার একজন বন্ধু থেকে।

‘তোর কাজিনের সাথে সাফওয়ান ডেট করছে। আজকে বিকেলে দু’জন একসাথে ঘুরছে দেখলাম।’

পরিবর্তে তার সেই বন্ধুর কোন রিপ্লাই দিল না সে। কদম বাড়াল হাসপাতালের ভেতরে। ততক্ষণে কেবিনে কান্নার চাপা গুঞ্জন শোনা গেল। তার দাদাজান সদ্য প্র‍য়াত হয়েছেন। আরাভ দাদার মাথার পাশে দাঁড়াল। আচমকাই চোখের জল গড়ালো। কিন্তু এ জল তার সদ্য বুকের ভেতরে জমে থাকা সেই কষ্টের না’কি সদ্য প্রয়াত হওয়া তার দাদার জন্য, বোধগম্য হল না।

সন্ধ্যার ক্ষীণ আলো ছড়ানোর আগে বাসায় ফিরল পৌষী। বাসা খালি তখন। সে বাসায় পৌঁছানোর কিছু সময় বাদে মাসুদের মরদেহ নিয়ে আসা হয়। মাসুদকে নিয়ে ব্যস্ত বিধায় পৌষীর দিকে কারো নজর ছিল না। দাফন সম্পন্ন হল রাতের বেলায়। বাড়ির ভেতর থমথমে অবস্থা। কিন্তু এর ঠিক চারদিন পর আচমকাই কাউকে কিছু না জানিয়ে আরাভ উড়াল দিল কানাডার উদ্দেশ্য। কারো জানা হয়নি আরাভ আচমকা কানাডা কেন চলে গেল? গৌরব ছেলেকে অজস্র প্রশ্ন ছুঁড়ল। কিন্তু আরাভ প্রতিবারই নিরুত্তোর। ছেলের জবাব না পেয়ে শেষে বাধ্য হয়ে সেও পরিবারসহ কানাডায় পাড়ি জমালো।

আরাভের দেশ ছাড়ায় পৌষী বেশ অবাক হয়েছিল। কিন্তু জিজ্ঞেস করার মত কোন সুযোগই ছিল না তার। তাই তিতলিকে জিজ্ঞেস করেছিল একদিন, সে কিছু জানে কি’না? কিন্তু জবাবে সে যা বলল তাতেই বাকরুদ্ধ সে। এরপর কতবার চেষ্টা করেছে সে আরাভের সাথে কথা বলার। কিন্তু আরাভ কথা বলেনি আর। তবে যাওয়ার আগে একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিল তার বইয়ের মধ্যে।

‘আমি তোকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি পৌষমাস।’

ছোট্ট এক বাক্যে। কিন্তু এই বাক্যের ব্যাখ্যা আজও তার কাছে নেই। কেন তার আরাভ ভাই তাকে ঘৃণা করে?

চলবে,,