প্রিয় বিকালফুল পর্ব-০৯

0
185

#প্রিয়_বিকালফুল(০৯)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

নিতুর জ্বর ঠিক হতে আরও তিন চারদিন সময় লাগল। এই কয়েকদিনে জ্বর যতটুকু না কাবু করেছে তার চেয়ে বেশি দূর্বল করেছে উৎসর যত্ন। মানুষটা খুব প্রয়োজন ছাড়া একটা বারের জন্য নিতুকে একা রেখে বাহিরে যায়নি। সারাক্ষণ নিতুর আশেপাশে থেকেছে। সময় করে খাবার এবং ওষুধ খাইয়েছে। এক সময় এসে নিতুর মনে হয়েছে এই জ্বর, শরীর খারাপ যদি আরও কিছুদিন থাকত! উৎসকে আরও কিছুদিন এভাবে পাওয়া যেত। তাছাড়া কোনভাবে দূরত্ব কমলে পুরুষ মানুষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে। কিন্তু সেটা আর হলো না। জ্বর ঠিকই বিদায় নিল। নিতু এ কয়েকদিনে উৎসর সবচেয়ে কাছে কাছে থেকেছে। যতটা কাছে থাকলে একটা পুরুষের গায়ের গন্ধ পরিচিত হয়ে যায় ঠিক ততটুকু কাছাকাছি সে থেকেছে। এই সুযোগে সে কতকিছু করিয়ে নিয়েছে উৎসকে দিয়ে! এই তো গতকাল সন্ধ্যা পর মাথাটা কেমন ভারি ভারি লাগছিল নিতুর। উৎস বিছানায় বসে বসে ফোনে কিছু একটা করছিল। নিতুকে উঠে বসতে দেখেই ফোন রেখে উৎস ব্যস্ত গলায় বলে উঠল,

“কিছু লাগবে তোমার?”

উৎস এই কয়েকদিন বাড়িতে থেকে, নিতুর কাছাকাছি থেকে তার সাথে কখন যে আপনি থেকে ‘তুমি’ তে নেমেছে দুজনের কেউই ধরতে পারেনি। নিতু পরবর্তীতে খেয়াল করলেও উৎসকে আর সেই ভুলটা ধরিয়ে দেয়নি সে। তার মুখে আপনি নয় বরং তুমিটাই বেশি মানায়। আপন আপন লাগে।

উৎস জানতে চাইলে নিতু কপালে হাত দিয়ে বলল,“মাথাটা ব্যথা করছে হালকা।”
“ওষুধ খাবে?”
“তেল নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তেল দিতে পারেন? ”

উৎস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“আগে আম্মাকে দিয়ে দিতাম। অনেকদিন হলো কাউকে মাথায় তেল দিয়ে দেই না।”

নিতু বলল,“শুধু মাথার মাঝখানে অল্প একটু দিলেই হবে। পুরো মাথায় দিতে হবে না আর এত বড় চুলে আপনি দিতেও পারবেন না। আমার চুলের বারোটা বাজাতে চাই না। বড্ড শখের চুল আমার।”

“বোসো আমি চেষ্টা করছি।”

উৎস নিখুঁতভাবে এত সুন্দর করে মাথায় তেল দিতে পারবে কল্পনাও করতে পারেনি নিতু। তেল দেওয়ার সময় এত সুন্দর করে মাথা নেড়ে দিচ্ছিল, নিতু প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল গতকাল।

আজ সকাল থেকেই নিতুর শরীরটা বেশ ঝরঝরে। তবুও দুপুরের রান্নাটা উৎস নিতুকে করতে দেয়নি৷ বাহিরে থেকে খাবার আনিয়ে নিয়েছিল সে। খাওয়া দাওয়া করে দুজনে ঘুমিয়েছিল। বিকেলের দিকে উৎস ফোনে কারও সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছিল সেই উচ্চশব্দে কথা বলার কারণেই ঘুম ভেঙেছে নিতুর। শরীরটা ভালো লাগায় ফ্রেশ হয়ে সোজা চা বানাতে রান্নাঘরে চলে গেল সে। ফরিনা বেগম বাড়িতে এখনো ফিরেননি। আগামীকাল হয়তো বাড়ি ফিরবেন। বাড়িটা একদমই ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাকে ছাড়া৷ এত বড় বাড়িতে মানুষ মোটে দুইজন। পুরো বাড়ি যেন ভূতুড়ে বাড়ির মতো শুনশান।

নিতু চা বানিয়ে নিজেদের দুইজনের জন্য দুই কাপ নিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো৷ আজকের বিকেলটা সুন্দর। নীল, সাদার মেলা বসেছে যেন৷ গত দুই দিন হলো আর বৃষ্টি হয়নি। নয়তো নিতু উৎসকে আরও একটু কাছে পেতে তারই অগোচরে আরও একটু ভিজে নিত।

নিতু চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করবে ওমনি উৎসর সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে একটুর জন্য বেঁচে যায়। বাঁচতে বাঁচতেও দুই ফোঁটা চা গিয়ে নিতুর পায়ের ওপর পড়ল। নিতু পায়ের দিকে তাকাতেই উৎস বলে উঠল,

“শরীরটা ভালো লাগছে বলে, আমাকে না জানিয়েই এখানে ওখানে ছুটবে? এত লাফাঙ্গা কেন মানুষজন?”

নিতু পায়ের দিকে নজর না দিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো৷ মৃদু হেসে বলল,
“ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আপনার মেজাজ খারাপ অথচ আজকের আকাশটা সুন্দর। ভাবলাম এমনি এমনি ছাদে যাওয়ার কথা বললে আমার ওপরও রেগে যাবেন তাই ঘুষ হিসেবে চা করে নিয়ে এলাম।”

উৎস ঘড়ি দেখে বলল,“এখন ছাদে?”
“হ্যাঁ। বৃষ্টি এলে দারুণ হতো৷ বৃষ্টি চা খাওয়া যেত।”
“তাহলে তো চায়ের স্বাদই হারিয়ে যেত।”
“উহু। কয়েকগুণ বেড়ে যেত। একদিন খেয়ে দেখবেন। এখন বলেন, ছাদে যাবেন? গেলে চা পাবেন নয়তো..”
“না গেলে পাব না?”
“না।”
উৎস নিতুর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“অভ্যেস বাজে করে ফেলছো আমার। চলো। এই চায়ের জন্য আবার দাম হিসেবে ছাদে নিয়ে যেতে হবে। জলদি ফিরতে হবে।”

নিতু মুচকি হেসে উৎসর পিছু নিল। মনে মনে বলল,
“আপনি আর কয়েকটা দিন আমাকে সময় দিন, আমাকে নিয়ে ভাবুন এভাবে আমার আশেপাশে থাকুন, উৎস। আপনি বাধ্য হবেন আমাকে ভালোবাসতে। আপনার কঠিন হৃদয়ে জন্ম নেবে পুষ্পের মতো নরম আর সুবাস ছড়ানো ভালোবাসা যেমন আপনার বিকালফুলের বুকে আজন্মকাল ভালোবাসার চাষ হচ্ছে। ভালোবাসা বড্ড ছোঁয়াচে রোগ, উৎস। এই অসুখ আপনাকে জর্জরিত করে ফেলবেই। আমি আপনাকে ভালোবাসা বিনা সুখী দেখতে চাই না।”
__

আজ শুক্রবার। গতরাতে হালকা বৃষ্টি হলেও সকালে সূর্যের দেখা মিলেছে। প্রকৃতি দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে গতরাতেই বৃষ্টি হয়েছে। নতুন পাতিলের মতো প্রকৃতি যেন চকচক করছে। গাছের পাতায় আটকে থাকা ময়লাগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সূর্যের আলোতে আরও বেশি ঝকঝকে তকতকে দেখাচ্ছে।

বেশ কয়েকদিন পর উৎস আজ ব্যায়াম করতে বেরিয়েছে। প্রতিদিন যেটা অভ্যাস সেটা কয়েকদিনের জন্য বাদ গেলে শরীর ঝিমিয়ে যায়। আজ এলার্ম বাজতেই সে আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। উৎস বের হওয়ার পরপরই নিতুও উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা তৈরি করতে নিচে রান্নাঘরে চলে এসেছে। গতরাতে ফরিনা বেগমের সাথে তার কথা হয়েছে। আজ তিনি নাশতা বেলার পরই বাসায় ফিরবেন বলে জানিয়েছেন।

আজ নিতু দুপুরের রান্নাটাও করবে। রাতে যখন উৎসকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে কী খেতে চায়? উৎস কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়া জানিয়েছে,

“বৃষ্টি হোক আর না হোক কাল খিচুড়ি, মাংস, বেগুন ভাজা আর একটু আচার হলে মন্দ হবে না।”

সুতরাং নিতু আজ এসব খাবারই রান্না করবে। দেখতে দেখতে কতগুলো দিন কেটে গেল। ভালো সময় হয়তো চোখের পলকেই কেটে যায়। ঠিক যেমনটা এখন হচ্ছে। দিন শুরু হতেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠার পরই কেমন ঘুমোতে যাওয়ার সময় চলে আসছে। এই কয়েকদিনে যে নিতু আরও বেশি করে জড়িয়ে গেছে উৎসের সাথে। সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকা পুরুষটা এখন তার অভ্যেস হয়ে উঠেছে। তার ব্যাপারটাও কি এমন? বুঝতে পারে না নিতু।

উৎসের বাহিরে একটু কাজ থাকায় ফরিনা বেগম বাড়িতে ফেরার পরপরই নাশতা করে বেরিয়ে গেল সে। বের হওয়ার সময় নিতুকে জানিয়ে গেল সে একেবারে দুপুরে বাসায় ফিরবে। তার জন্য যেন কোন কাজ ফেলে না রাখা হয়। প্রয়োজনে খাবার খাওয়ার সময় হলে সেটাও যেন মায়ের সাথে খেয়ে নেয়।

নিতুও রান্নার সব ব্যবস্থা করে ফেলল চটপট করে। যেন রান্না করতে এসে এটা ওটার জন্য আর দেরি না হয়। একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ফরিনা বেগমের সাথে সেভাবে কথা হয়নি ভেবে সোজা তার রুমে চলে গেল সে। এক ঘণ্টা সময় এখনো হাতে আছে ভেবে শাশুড়ির সাথে গল্পের আসরে বসে গেল সে। এতগুলো দিন বাহিরে কেমন কাটলো, কী কী হলো সব শুনলো নিতু। ফরিনা বেগমও কথা বলার মানুষ পেয়ে আরামে, আনন্দে সব কথা বললেন। বোনের সাথে কী কী কথা হয়েছে, তারা কবে এ বাড়িতে বেড়াতে আসবেন, নিতুর ছবি দেখে কী বলেছে, বোনের ছেলের বউটা কেমন, নাতির অসুস্থতা, ছেলেটার জব হচ্ছে না, ওখান থেকে আরেক ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সব ঘটনাই ফরিনা বেগম নিতুকে একে একে বললেন।

নিতুর রান্না শেষ হলো দেড়টার দিকে। খাবার টেবিলে সব সাজিয়ে রেখে ফরিনা বেগমের খাবার এবং ওষুধ তার রুমে রেখে নিজে ওপরে এলো গোসল করতে। আলমারি থেকে বেছে বেছে কালো রঙের একটা সুন্দর শাড়ি বের করল গোসল করে পরবে বলে। সে খুব ভালো করে জানে পুরুষ মানুষের নজর গোছানো, পরিপাটি আর বিশেষ করে শাড়ি পরিহিতা নারীতেই আটকে যায়। চোখে যদি একটু কাজল থাকে তাহলে তো কোন কথাই নেই। নিতুর চুল এমনিই বড় বড় সুতরাং রূপবতী হওয়ার যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন সবই তার আছে। নিতু হেসে মনে মনে বলল,

“কতদিন আপনার মন আমার থেকে দূরে থাকে সেটাই দেখব আমি, মেজর সাহেব। আমাকে ভালো না বেসে আপনি থাকতে পারবেন না। কিছুতেই পারবেন না।”

পরক্ষণেই মনে মনে প্রশ্নের উত্থান ঘটে নিতুর,”এই লোকটা কি তার কোন কিছুতেই একবারের জন্য হলেও প্রেমে পড়েনি? মুগ্ধ হয়নি? কী করলে খেলার সংসারটা ভালোবাসার হবে? কতদিনে উৎস পুরোপুরিভাবে তার হবে? যখন উৎসের মনে হারানোর ভয় থাকবে না, সে বুঝবে সব মানুষ ঠকাউ না! কেউ কেউ জীবন দিয়ে ভালোবাসতে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে।”

নিতু গোসল শেষ করে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে টুকটাক প্রসাধনীতে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছিল। চোখে কাজল দিয়ে নিজেকেই নিজে আয়নাতে দেখে মৃদু হাসলো। জ্বরে শরীরটা শুকিয়ে গেলেও চেহারার জৌলুস খুব একটা কমেনি। পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে গেল নিতুর। এত কিছু করেও কি তার মন পাওয়া যাবে? মনকে দমে যেতে দিল না। প্রিয় মানুষকে নিজের করে নেওয়াও তো একটা যু*দ্ধের মতো। যু*দ্ধের ময়দানে নেমে সেখান থেকে অনুভূতি নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কোন যো*দ্ধার কাজ নয়।

আনমনে ভেজা চুল মুছছিল নিতু। দু চোখের দৃষ্টি জানালার বাহিরে কদমফুল গাছের ডালে অবস্থানরত দুটি পাখির ওপর। কী সুন্দর দুটো পাখি একসাথে বসে সুখ-দুঃখের আলাপ করছে! কাছাকাছি, পাশাপাশি প্রেমালাপে মগ্ন।

হঠাৎ দরজার দিকে থেকে উৎসের গলা ভেসে এলো,
“এই রুমে আরও একজন মানুষ থাকে, পুরুষ মানুষ। এটা হয়তো কেউ কেউ ভুলেই যাচ্ছে। যখন তখন যেভাবে সেভাবে এই রুমে থাকা চলবে না।”

নিতু উৎসর কথার অর্থ বুঝল। শাড়ির আঁচল কোমরে গোজা ছিল তার। ফর্সা আবেদনময়ী কোমর হয়তো সম্পর্কে ভিন্নতা থাকলে অন্যকিছুর ব্যাখ্যায় আসতো কিন্তু এক্ষেত্রে তা এলো না। নিতু কোমর না ঢেকে ওভাবে রেখেই বলে উঠল,

“আপনারও বোঝা উচিৎ, আপনি বিয়ে করেছেন। রুমে আপনার বউই থাকে। আপনি কোন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাননি বা কোন ভাইয়ের বউয়ের সামনে পড়েননি যে সবসময় আপনার সামনে কেউ ঘোমটা টেনে বসে থাকবে। আপনার বউ আমি। ইচ্ছে হলে কোমর বের করে থাকব, ইচ্ছে হলে হাফ প্যান্ট পরে থাকব আবার ইচ্ছে হলে গরমে শাল জড়িয়ে কাঁপা-কাঁপি করব পুরোটাই আমার মর্জি।”

নিতু ঠোঁট টিপে হেসে পরক্ষণে আবার বলে উঠল,“আপনার নজর খারাপ সেটা স্বীকার করুন। রুমটা এত বড়। রুমে এতকিছু সাজানো গোছানো সুন্দর সুন্দর জিনিস রয়েছে অথচ আপনার চোখ গেল সেই আমার অল্প একটু বের হয়ে থাকা কোমরে।”

উৎস অস্বস্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই মেয়ের সাথে সে কথায় কখনোই পেরে উঠবে না। কথায় তাকে মাত করা সম্ভবই নয়। এটা নিয়ে কথা বাড়ানো মানে নিজেকে আরও বিপদে ফেলা। সুতরাং সে এসব নিয়ে আর কথা না বলে বলল,

“খিদে পেয়েছে, এসে খেতে দাও।”

নিতু সামনে নিয়ে মোছা চুলগুলো এক ঝটকায় পিছনে সরিয়ে দিয়ে বলল,“যান, আমি আসছি। এদিক ওদিক না দেখে সোজা খাবার টেবিলে চলে যান। আজকাল নিজের রুমেও নিজের সেফটি নেই, কী দিন-কাল এলো!”

#চলবে…