#প্রিয়_বিকালফুল(১৪)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
ফরিনা বেগম নিতুকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কিছু মুহূর্ত পূর্বেই তিনি উৎসের সাথে কথা বলেছেন। পুরো ব্যাপারটা ধরতে পেরে, বুঝতে পেরে মনের মধ্যে কেমন খঁচখচানি হচ্ছে। তিনি জানেন উৎস একবার মুখ দিয়ে কোন কথা বের করলে সেটা কখনো হয়নি এমন হয়নি আর যেক্ষেত্রে সে পুরোদমে সঠিক সেখানে তো অন্য কোন অপশন আসার কথাই ওঠে না। নিতুর হঠকারিতার জন্য ফলাফল কী রূপ নেবে কে জানে? যে ব্যক্তি সমস্যা তৈরি করে সে কি সর্বদা সমাধান কষতে পারে? পারে না। সমস্যা হঠাৎ সৃষ্টি হলেও অল্প সময়ে সেটা সমাধানযোগ্য নয়।
ফরিনা বেগমের ডাকে নিতু আনমনে ফরিনা বেগমের রুমে প্রবেশ করল। ফরিনা বেগম ফোন ঘাটছিলেন বসে বসে। নিতু ফরিনা বেগমের খাটের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে শুধালো,
“আম্মা, ডেকেছিলেন আমাকে?”
ফরিনা বেগম ফোনটা পাশেই রেখে নিতুকে ইশারায় কাছে ডেকে বসতে বললেন। নিতুও বাধ্য মেয়ের মতো কাছে গিয়ে বসল। ফরিনা বেগম মৃদু গলায় বললেন,
“তুমি এখনো তোমার ভুল বুঝতে পারছ না?”
নিতু গম্ভীরস্বরে জবাব দিল,“আমি কোন ভুল করিনি, আম্মা। ভুল কীভাবে বুঝব?”
“তোমার মনে হচ্ছে না তুমি যে ভালোবাসার কথা বলেছিলে সেই ভালোবাসার চেয়ে তুমি আমার ছেলেকে অনেক বেশি ঘৃণা উপহার দিয়েছ? এখন যদি তুমি জানতে পারো যে তুমি পুরোটাই ভুল ছিলে তাহলে মুখ লুকোবে কীভাবে বলো তো? একটা সম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। তুমি সেই বিশ্বাসের জায়গাটাই নড়বড়ে করে দিয়েছ।”
নিতু ফরিনা বেগমের দিকে চাইল। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। বারংবার চোখের পলক ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল।
“আম্মা, আমি আপনার ছেলেকে ভালোবাসি বলেই ডিভোর্সি জেনেও বিয়ে করেছিলাম। আমার ভালো একটা ক্যারিয়ার আছে, নিজে একটা ভালো জায়গায় আছি। শুধুমাত্র ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে আমি উনার কাছে থেকে যেতে চেয়েছিলাম। শেষে এসে কী জানলাম? উনি ডিভোর্সি নন। উনি এখনো কারও বর। আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন একজন বাঙালি নারী কখনো নিজের বরের ভাগ অন্য নারীকে দিতে চায় না। আমি কীভাবে এটা মেনে নিতে পারব বলুন তো? উনি যদি শুধু আমার না হন তাহলে উনাকে আমার চাই না।”
নিতু থেমে আবার নাক টেনে বলল,”আম্মা, ছোট বেলা থেকে না পাওয়ার হিসেবের লিষ্টটা অনেক বড়। যতটুকু পেয়েছি ততটুকুও যু*দ্ধু করে পেতে হয় তাই কোনকিছু পাওয়ার পরও সেটার অর্থ না পাওয়া হলে সেখানে আমি নিজেকে কীভাবে ঠিক রাখব বলুন তো, আম্মা? আমিও তো মানুষ। আমারই কেন এত না পাওয়া থাকবে?”
“এবার পেয়েও নিজের দোষেই হারালে, নিতু। এখানে অন্যকারও হাত নেই। তুমি যে পরিমাণ অপমান আমার ছেলেকে করেছ সেটা আমি তোমার থেকে আশা করিনি।” সংক্ষেপে বললেন ফরিনা বেগম।
নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল,
”হয়তো বেশিই করেছি কিন্তু আপনারাও তো আমাকে ঠকিয়েছেন, আম্মা। আমি উনার পাশে অন্য কাউকে আর কীভাবে সহ্য করব? এত এত না পাওয়ার মাঝে তার পরিমাণ আরও বাড়ছে দেখে আমি সহ্য করতে পারিনি।”
“আমার উৎসের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে তুমি খুব ভুল করেছ, নিতু। আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার ছেলেকে এবার একটু শান্তি দাও কিন্তু সে-ই তুমিই আমার ছেলের শান্তি নষ্ট করেছ। আমি জানি না তোমাদের দুজনের পরিণতি কী হবে। আমার ছেলেটা আর কাউকে নিয়ে কোনদিন কিছু ভাবতে পারবে না। আমার খুব বড় ক্ষতি তুমি করলে, নিতু।”
কথাগুলো বলেই ফরিনা বেগম নিজের ফোনের গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে ফোনটা নিতুর হাতে দিলেন। ভ্রু উঁচিয়ে ছবিটা দেখার জন্য ইশারা করলেন তিনি।
নিতু ফরিনা বেগমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ফোনস্ক্রিনে চোখ রাখল। জুম করে প্রতিটা লেখা এবং পুরোটা পড়ে ফরিনা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন,
“এখন যেটা দেখছ সেটা দেখে কী মনে হচ্ছে? ভুলটা অনেক বড় হয়ে গেল না? আমি যে আর এখন কিছুই করতে পারব না বোধ হয়। উৎসর সাথে কথাই বলার সাহস নেই আমার। তুমি মাথা গরম না করে যদি একটু সময় নিতে! আফসোস। ”
নিতু কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,“তাহলে আলমারিতে যেটা ছিল ওটা?”
ফরিনা বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মুখটা ছোট করে বললেন,“উৎসের বউ যখন চলে যায় তখন ডিভোর্সের কথা ভাবতেও আমার ছেলের সময় লেগেছিল। যখন নিজেকে শক্ত করে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে ওর বউয়ের কাছে পাঠালো তার ঠিক দুই দিনের মাথায় ওইদিক থেকে আরেকটা ডিভোর্সের কাগজ এলো বাসায়। মানে ডিভোর্সের কাজ দুই পক্ষ থেকে দুজনই করেছিল। বাংলাদেশী আইনে মেয়ে মানুষও ডিভোর্স দিতে পারে কিন্তু আমার মনের মধ্যে ভালো লাগত না তাই উৎসকে বলেছিলাম উকিলের সাথে কথা বলে বউয়ের পাঠানো কাগজ যেন নষ্ট করা হয়। উৎসের দিক থেকে ডিভোর্স সম্পন্ন হয়৷ যেহেতু বউয়ের পাঠানো কাগজে আর কাজ হয়নি তাই ওটা ওভাবেই উৎস আলমারিতে ফেলে রেখেছিল। আসলটাও হয়তো কোথাও রেখেছে।”
নিতু ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল এবার। ব্যাপারটা যে এরকমও হতে পারে সেটা কোনভাবেই মাথায় আসেনি তার। অসহায় চোখে শাশুড়ির দিকে চেয়ে ক্রন্দনরত গলায় বলে উঠল,
“আমার যে বড্ড ভুল হয়ে গেল, আম্মা। আমার তো মাথা ঠিক ছিল না তখন। কোন মেয়েই বা ওটা ঠান্ডা মাথায় মেনে নিবে বলেন তো? আমি এখন কী করব, আম্মা?”
ফরিনা বেগম পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন,“এখন যা হবে সেটা চুপচাপ দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার বা বলার নেই, মা। তুমি আমার ছেলেটার সাথে খুব খারাপ করেছ।”
__
আজ বিকেলেই নিতুকে তার বাসায় রেখে আসতে চেয়েছিল উৎস। বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রুমের কোথাও তো দূরের কথা বাড়ির কোথাও নিতুকে খুঁজে পায়নি উৎস। নিতুর ব্যাগটা গুছিয়ে রেখেছিল নিতু নিজেই। সেটাও রুমের এক কোণায় পড়ে আছে কিন্তু নিতু নেই। ফোনটাও বন্ধ। উৎস নিতুর অপেক্ষায় বসে আছে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা হলো। নিতুর আসার কোন নাম নেই। উৎস সমস্ত ঘরে পায়চারি করছে। মুখের বর্ণ ভয়ংকর। ফরিনা বেগম একবার এসে ঘুরে গেছেন। ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন – এত সহজে বিয়ের সম্পর্ক ভাঙা বোকামি হবে। মেয়েটা ভুল করেছে সেটা বুঝতেও পেরেছে। তাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।
উৎস প্রথমে মায়ের কথায় রাগ দেখালেও সে মাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছে। বিয়ে ভাঙার মতো কাজ সে কিছুতেই করবে না কিন্তু নিতুর এই হঠকারিতার জন্য পানিশমেন্ট প্রয়োজন। সহজেই কাউকে তার ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিলে সে পরবর্তীতে আবার ভুল করে বসবে, ভাববে মাফ তো সহজেই পাওয়া যায়। উৎসের কথার ওপরে ফরিনা বেগম আর কিছু বলেননি। ছেলের ওপর ভরসা রাখতে ইচ্ছে হয়েছে উনার।
নিতু ফিরল সাড়ে সাতটার দিকে। হাতে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা। আয়তনে বেশ খানিকটা লম্বা এবং চওড়া। রুমে প্রবেশ করেই সে উৎসকে বিছানায় বসে থাকতে দেখতে পেল। ভয়ে ভয়ে হাতের জিনিসটা রাখবে তখনই উৎস বলে উঠল,
“কোথায় গিয়েছিলে?”
নিতু কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিল,“আমাদের সেদিন ছবি তোলা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে একটা বাঁধাই করে এনেছি। এই যে ফ্রেম।”
উৎস ঘড়িতে সময় দেখল। প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। চোখ মুখ শক্ত করে নিতুর দিকে চাইল সে।
“আমাকে না বলে বেরিয়েছ কোন সাহসে? বিকেলে আমাদের বেরোনোর কথা ছিল। এখন এত রাতে কি বের হওয়া সম্ভব? যাব কখন আর ফিরব কখন?”
নিতু অসহায় ভঙ্গিতে বলল,“যাব না তো। আমি আর ওমন করব না কখনো। আপনি যা বলবেন তাই করব। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনি তো জানেন আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
উৎস তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো। শক্ত গলায় বলল,
“ভালোবাসা মাই ফুট।”
দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফ্রেমটা হাতে নিল সে। ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। চোখের পলকে কিছু কাঁচের টুকরো প্যাকেটের ভেতরে ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল। অকস্মাৎ এমন কান্ডে ভয় পেয়ে গেল নিতু। বুকে হাত দিয়ে অবাক চোখে উৎসের দিকে চেয়ে রইল সে। উৎস রক্তিমচোখে চেয়ে বলল,
“নাটক শুরু করেছ? চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে চরিত্রের দফারফা করে দিয়েছ আবার সেই মানুষের সাথেকার ছবি ফ্রেমে বাঁধাই করে এনেছ? মেয়ে মানুষ নাটক কম জানো না তাই না?”
নিতু মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল,“আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমাকে মাফ করে দিন। শুধু এবারের মতো?”
“শুতে চাইছো আমার কাছে? চরিত্রহীন মানুষের কাছে শুতে সম্মানে বাঁধবে না? এত ভালো মানুষ আবার আমার সহ্য হবে না। তার চেয়ে ভালো চলে যাও।”
নিতু ফুঁপিয়ে উঠল। ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল,“আমি আপনাকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র রাগের মাথায় বলা কথাগুলোর জন্য এত বড় শা*স্তি দেবেন না। খুব ভালোবাসি আপনাকে।”
উৎস তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। নিতুর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে শুধালো,
“কেউ কাউকে ভালোবাসলে এভাবে অসম্মান করতে পারে? এত অবিশ্বাস দানা বাঁধতে পারে? এভাবে চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে পারে যেখানে সে নিজেই দুই মাসে সেই ব্যক্তির কোন স্পর্শ পায়নি?”
“আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমার মাথা শুধু বলছিল- তোর মানুষ অন্যকারো মানুষ, সে তোকে নয় অন্য কাউকে ভালোবাসে, তুই তাকে কখনো পাবি না, তোকে সে ঠকিয়েছে।”
উৎস এবার আচমকা নিরব হলো। মৃদু হলো তার কণ্ঠস্বর। চাহনির সবটুকু নিতুর মুখে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেল। পলকহীন চোখে চেয়ে বলে উঠল,
“তুমি শুরুতে যে মায়া দেখিয়েছিলে সেটা গত দুইদিনে নড়বড়ে হয়ে গেছে। আমি তোমার কুৎসিত রূপটা দেখেছি। বিশ্বাস আমাকে তুমি করো না। আমার কথায় ভরসা নেই। অথচ এ সমস্ত কিছু থাকলে আমাদের গল্পের সমাপ্তিতে পূর্ণতা থাকত।”
“ক্ষমার অযোগ্য ভুল করে ফেলেছি তাই না?” ছলছল চোখে উৎসের দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ল নিতু। চোখের পলক ফেলতেই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
কী একটা কারণে উৎস নিতুর দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। হয়তো কোন কারণ আছে আবার হয়তো নেই। পুনরায় মৃদু গলায় বলল,
“আগামীকাল সকালে যেতে হবে৷ এবার আর সময় পাল্টাতে রাজি নই আমি।”
#চলবে….