#প্রিয়_বিকালফুল(১৯)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
নিতুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছে। একাধিক পরিমাণে ঘুমের ওষুধ সেবন করেছিল সে। ডাক্তার, নার্স সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিতুকে সুস্থ করার।
উৎস বাহিরে পায়চারি করছে। করিডোরে যাতায়াত করা মানুষগুলো উৎসকে আঁড়চোখে দেখছে। ভেতরটা প্রচন্ড ছটফট করছে উৎসের। দুই হাতের তালু ঘষে ঘষে কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
নিতুর মা হাসপাতালে পৌঁছলো খুব তাড়াতাড়িই। উৎস হাসপাতালে পৌঁছেই নুরজাহান বেগমকে জানিয়েছিল। তিনি আসার পর থেকে কান্না করেই যাচ্ছেন। থানা থেকে কল আসায় উৎস উপায় না পেয়ে অল্প কিছু সময়ের জন্য বেরিয়েছে। হাসপাতাল থেকে জানিয়েছে নিতু সজ্ঞানে আসতে এবং কিছুটা সুস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। উৎস তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছে তাকে আবার সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হবে।
নুরজাহান বেগম বাহিরে একা বসে বসে কান্না করছেন অনেকক্ষণ যাবৎ। বারবার আল্লাহকে ডাকছেন তিনি। আজকের হয়ে যাওয়া ঘটনা তাকে এক সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছে যেন। স্বামীর অতিরিক্ত ভালো ব্যবহার কখনো কোন বিষয়ে মনে সামান্য সন্দেহও আসতে দেয়নি। মেয়ের কথা তিনি এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়ে সংসার করেছেন। কখনো কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া অবধি লাগেনি। নুরজাহান বেগম দেখেছেন নুরুল ইসলামের শুধু একটাই হতাশা ছিল আর সেটা হচ্ছে নিতু কেন তাদের সাথে থাকে না, তার বাবার কাছে কেন আসে না? নুরুল ইসলাম নিজেই নুরজাহান বেগমকে দিয়ে বারবার নিতুকে বাড়ি ফিরতে বলেছে। নিতু যে কয়েকবার দেশে এসেছে নুরুল ইসলাম খবর পেলেই নুরজাহান বেগমকে জোর করেছেন নিতুকে রেখে দিতে৷ এসব কিছুর মাঝে অন্ধের মতো ভালোবাসা দেখেছিলেন শুধু। নুরুল ইসলামের নোংরা মন তিনি দেখতে পাননি।
নিতুর কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। নিতুর এখনো সেভাবে জ্ঞান ফিরেনি। নার্স ভেতরে আছে। উৎস যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে নিতুকে যেন কোনভাবেই একা রাখা না হয়। নার্স একবার নুরজাহান বেগমকে ডাকতে বাহিরে এসেছিল কিন্তু নুরজাহান বেগম মেয়ের প্রাণ ভিক্ষায় নামাজরত। নিজের এতদিনের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। মেয়ের সামনে যেতে লজ্জা করছে তবুও হাজার হলেও মেয়ে তো! মেয়েকে তো এই অবস্থায় ছেড়ে যাওয়া যায় না।
রাত প্রায় বারোটা। নুরজাহান বেগম মেয়ের পাশে বসে আছেন। অনবরত চোখ থেকে পানি ঝরছে। উৎস বাহিরে বসে আছে। মা, ফরিনা বেগমকে সে কল করে জানিয়েছে সকালেই নিতুকে নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে। নিতুর সাথে কথা বলার জন্য, একবার প্রাণভরে দেখার জন্য মনটা বড্ড ছটফট করছে উৎসের। আজ হঠাৎ এত টান কেন অনুভব করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। থেকে থেকে অসম্ভব কিছুও করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নিতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে- নিতু, আমি আছি। আমি আর কখনো তোমাকে একা ছাড়ব না। এরপর থেকে তুমি যা বলবে তা-ই হবে।
নিতুর জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ আগে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। সামনে মা বসে কাঁদছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই যেন। আজ কোনকিছুর প্রতি বা কারও প্রতি মায়া লাগছে না তার। নিজের প্রতিও না। নুরজাহান বেগম বারবার মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইছেন। মাথা, মুখে, শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। নিতুর মন কিছুতেই গলছে না। এক প্রকার জোর করেই মায়ের কান্না সহ্য করছিল সে৷ যখন আর পেরে উঠল না তখন কড়া মেজাজে বলে উঠল,
“মরে গেলেই ভালো হতো৷ তোমার এই ন্যাকা কান্না আর শুনতে হতো না। ভালো লাগছে না আমার এই কান্নাকাটি। অসহ্য লাগছে। চলে যাও এখান থেকে। বাহিরে গিয়ে যত ইচ্ছে কান্নাকাটি করো। এখানে কান্নাকাটি করে কোন লাভ নেই৷”
নুরজাহান বেগম মেয়ের হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চেয়ে বললেন,“তুই বলেছিলি না আমার চোখের কালো কাপড় সরবে? সরে গেছে রে, মা। আমি এখন সব বুঝতে পারছি। ওই লোকটার আসল উদ্দেশ্য এত নোংরা ছিল আমি বুঝতে পারিনি। এত বছর এত নোংরা ইচ্ছে মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বিয়ের এতগুলো বছর সে আমার সাথে এত ভালোভাবে থেকেছে একটা দিন কথা কাটাকাটিও হয়নি। ভালো মানুষির মুখোশ পড়ে ছিল সে, আমি বুঝতে পারিনি। আমি তো ভেবেছিলাম তুই তাকে অপছন্দ করিস বলে….”
নিতু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আজ বিশ্বাস হলো তো? তোমাকে, যাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিয়ে করলাম তাকে কীভাবে ক্ষমা করব আমি? তোমাদের ক্ষমা করলে তো নিজের সাথে বেইনসাফি করা হবে। নিজেকে আর নিজে ঠকাতে পারব না।”
নুরজাহান বেগম কান্নাকাটি থামিয়ে কিছুক্ষণ নিরব রইলেন। নিতু এতক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছে। নুরজাহান বেগম একটা প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বললেন,
“এখানে সব দোষ আমার। জামাই-বাবার কোন দোষ নাই। তুই তাকে দোষের চোখে দেখিস না।”
নিতু ফিরে তাকালো৷ ভ্রু কুঁচকে বলল,“তার কোন দোষ নেই? আমি ভুল বুঝে, রাগের মাথায়, সহ্য করতে না পেরে তাকে ক’টা কড়া, নোংরা কথা বলেছিলাম বলে সে আমাকে ডিভোর্সের ভয় দেখিয়ে বাড়িতে রেখে গেছে তবুও বলছো তার কোন দোষ নেই? বাহ! তোমার কাছে আর এর থেকে বেশি কী-ই বা আশা করব!?”
নুরজাহান বেগম কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম ওড়না দিয়ে মুছে নিলেন৷ বললেন,
“তুই কি আমার আর উৎসের কথাবার্তায় বুঝিসনি আমাদের আগেও কথা হয়েছে? তুই যখন বাড়িতে ফিরলি আমি বেশ স্বাভাবিক ছিলাম। একটাবারের জন্যও জানতে চাইনি, হঠাৎ বাড়িতে কেন? সাথের ছেলেটা কে? এসব কিছুই জানতে চাইনি তাও তোর সন্দেহ হয়নি কিছু?”
নিতু চুপচাপ মায়ের দিকে চেয়ে রইল। নুরজাহান বেগম ফের বললেন,“তুই একদিন জামাই-বাবার ফোন থেকে আমাকে ফোন দিয়েছিলি। নিজের ফোন দিয়ে হয়তো বিপদ বুঝেই কল করিসনি। তোর সাথে কথা হয়নি ঠিকই কিন্তু উৎসের সাথে কথা হয়েছিল। তুই বিয়ে করেছিস জেনে খুব খুশি হয়েছিলাম। জামাই-বাবার সাথে পরিচয় হওয়ার পর বেশ কয়েকদিন তোর খোঁজ- খবর নিয়েছি। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল সেটা তাকে বলার পর তোর শ্বশুরবাড়িতে যেতে বলেছিল উৎস। আমার পক্ষে তো সেটা সম্ভব না। আমিই বাচ্চা মেয়ের মতো উৎসের কাছে আবদার করি তোকে যেন আমার কাছে নিয়ে আসে। উৎস রাজি হয়নি প্রথমে। তুই তাকে বলেছিস, তোর বাবা তোর ক্ষতি চায় এমনকিছু। সে কখনোই চায়নি এ বাড়িতে তোকে নিয়ে আসতে। তোর বাবা যখন চট্টগ্রাম গেল তখন আমি বেশ কয়েকদিন উৎসকে বলি তোকে আমার কাছে দুইদিন অন্তত রাখার জন্য৷ বাড়িতে আমি একাই থাকতাম। উৎস এক প্রকার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে এ বাড়িতে আনতে রাজি হয়েছিল। তুই আগে থেকে জানলে আসতে চাইবি না তাই আগে থেকে কথাবার্তার ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়। তোকে রাখতে এসেও বেচারার মন খারাপ দেখেছিলাম আমি। তোকে রেখে যেতে চায়নি। তুই ছেলেটাকে কষ্ট দিস না, মা। এই বিপদ আসার ছিল তাই এসেছিল। আমাকে যা শা*স্তি দেওয়ার দে কিন্তু বিশ্বাস কর ছেলেটার এক ফোঁটাও দোষ নেই। উৎস একমাত্র এক মায়ের আবদার রাখতেই তোকে রেখে গিয়েছিল। ও বলেওছিল পরদিন সকালেই তোকে নিয়ে যাবে। এই একটা রাত যেন আমি তোকে দেখে রাখি। তোকে ভালোবাসে ছেলেটা। তোর বিপদ জানানোর সাথে সাথে ছুঁটে এসেছে তোকে বাঁচাতে। ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে তোকে।”
নুরজাহান বেগমের সব কথা শুনে নিতুর চোখ দিয়ে হয়তো দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে অন্য হাতে সেটা মুছেও নিল।
নুরজাহান বেগম বললেন,“ছেলেটা বাহিরেই বসে আছে। তোর সাথে কথা বলতে চাইছে কিন্তু অপরাধবোধের জন্য আসতে পারছে না। একবার কথা বল তার সাথে।”
নিতু পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। শক্ত গলায় বলল,“আমি উনার কোন কথা শুনতে চাই না। উনাকে চলে যেতে বলো।”
“একটাবার কথা বল শুধু৷ বড্ড খারাপ অবস্থা ছেলেটার। সারাদিন হয়তো কিছু খায়নি। চোখ-মুখের অবস্থা দেখলে মায়া লাগছে। কী অবস্থা হয়েছে সারাদিনে!”
নিতু কিছু বলল না৷ এই লোকটার সাথে সে কোন কথা বলতে চায় না৷ দেখতেও চায় না৷ সামনে এলেই তো সবকিছু আবার এলোমেলো হয়ে যাবে। তার হঠকারিতা, ভুলের জন্য আজ এই অবস্থা। সব আগে থেকে বললে অন্তত এই মুহূর্তে তাকে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে হতো না। সবকিছু অন্যরকম হতো৷ এসবের জন্য মাফ করে দিলেও কী হবে? সম্পর্ক তো আর ঠিক হবে না। যে মানুষ বলেই দিয়েছিল, কোনদিন কাউকে ভালোবাসতে পারবে না তার পিছু ছুটে আর কী-ই বা করবে সে!
নুরজাহান বেগম উৎসকে ভেতরে ডেকে নিজে দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে বাহিরে চলে গেলেন৷ উৎস অপরাধীর মতো মাথানিচু করে ধীরপায়ে নিতুর বেডের পাশের চেয়ারটায় এসে বসল। কিছুক্ষণ দুজনের কেউই কোন কথা বলল না হয়তো বলতেই পারল না। কিছু সময় এভাবেই কেটে গেলে উৎস নিরবতা ভেঙে বলে উঠল,
“এখন ঠিক আছ? আগের চেয়ে ভালো লাগছে একটু?”
নিতু অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। উৎসের কথা শুনেও তার দিকে না ফিরে সেদিকেই হয়ে জবাব দিল,
“মরে যাইনি যেহেতু সেহেতু ভালোই আছি।”
নিতুর কথার পৃষ্ঠে কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না উৎস। কেমন কথাগুলো গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে অবিন্যস্তভাবে বলল,
“আম্মা বলেছে কালকেই তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে।”
“যে মানুষ আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তার সাথে ফেরার কোন প্রশ্নই ওঠে না।”
“আমাকে মাফ করা যায় না, নিতু? এটাই প্রথম আর এটাই শেষবার। প্লিজ!”
নিতুর বুকটা কেঁপে উঁঠল। লোকটার কণ্ঠে এত অসহায়বোধ কেন? মুহূর্তের মধ্যে লোকটাকে দেখার বাসনা জাগল মনে৷ মনের বিরুদ্ধে যেতে পারল না সে। ফিরে তাকালো উৎসের দিকে৷
উৎস তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিতু ফিরতেই সে বলে উঁঠল,
“তোমার জন্য আমার এমন কেন লাগছে বলো তো?”
“কেমন লাগছে?” যেন অনুভূতিহীন প্রশ্ন নিতুর।
“আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না তবুও মনে হচ্ছে আজ বড় কিছু হারাতে চলেছিলাম। কিছু ভালো লাগছিল না আমার৷ বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে। এমন অসহায় তো আমার ডিভোর্সের পরও লাগেনি৷ এই অনুভূতির নাম কী, নিতু?”
নিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উৎসের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,“আমার প্রতি তো আপনার মানবিক বোধ ছিল। হয়তো সেটাই। মানবিক বোধের চেয়ে বেশি কিছু অনুভব হওয়া যে অসম্ভব। ”
উৎস কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর প্রশ্ন ছুড়ল,
“তুমি এমন একটা কাজ কেন করেছিলে? যদি তোমার কিছু হয়ে যেত!”
নিতু বোধ হয় হাসলো৷ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি নারী হতেন তাহলে বুঝতেন পুরুষের ওই নোংরা স্পর্শ একটা নারীর শরীর আর মনে ঠিক কীভাবে পচন ধরিয়ে দেয়। মৃত বানিয়ে দেয়। যখনই মনে পড়ে সেসব স্পর্শের কথা তখন ভয়ে পুরো শরীর কেঁপে ওঠে, কান্না পায়৷ ”
নিতু থামলো। তার চোখ দুটো টলমল করছে। কান্নাভারি গলায় ফের বলল,
“যদি নারী হতেন তবে বুঝতেন পুরুষের নোংরা, লোলুপ দৃষ্টিতে ঠিক কী পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থাকে! কীভাবে গলা*টি*পে অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে মেরে ফেলে!”
নিতুর কথায় মাথা নুইয়ে এলো উৎসর। সে মৃদু গলায় বলল,“তুমি বুঝেছিলে তোমাকে ওমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে?”
“ওই লোকের চোখ দেখলেই মস্তিষ্ক পড়ে ফেলতে পারি আমি৷”
“পালানোর চেষ্টা করোনি কেন?”
“আমি রুমের মধ্যে, বাহিরেই দরজার সামনে তিন চারজন পুরুষ। পালানো সহজ? সবকিছু এত সহজ নয়।”
“আমাকে একটাবার কল করতে।”
“কাকে? আপনাকে? যে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল? মরে যেতাম তবুও আপনাকে কখনো ডাকতাম না।”
উৎস মাথানিচু করে ফেলল। মৃদু গলায় বলল,“আ’ম স্যরি, নিতু। আর কখনো এমন হবে না।”
“হওয়ার সুযোগই তো নেই।”
উৎস কথার পথ পাল্টাতে শুধালো,“স্লিপিং পিল এতগুলো কোথায় পেলে? গাড়িতে বলেছিলে বি*ষ খেয়েছ। আমার কী অবস্থা হয়েছিল জানো? স্লিপিং পিলের সাথে আর কী খেয়েছিলে? কেমন গন্ধ পাচ্ছিলাম!”
“আপনার বাড়িতে থাকাকালীনই কিনেছিলাম।” সোজাসাপটা জবাব নিতুর।
অবাক হলো উৎস। জানতে চাইলো,
“কেন?”
“আপনি যখন আমাকে ছাড়ার কথা বলেছিলেন তখন হঠাৎ মনে হয়েছিল আমার আর বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। এক ফাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিনেছিলাম কিন্তু কেন জানি না শেষ অবধি একটা আশার আলো খুঁজে চলেছিলাম তাই খাওয়া হয়নি। যখন এই বাড়িতে আমার রুমের দরজায় হঠাৎ করেই অমানুষগুলোকে দেখলাম তখন মনে হলো ওই পিলগুলো কাজে লাগানোর সময় এসেছে। আমি জানতাম তার হাতে যাওয়া মানেই সম্মান হারানো৷ বিছানায় রাখা পার্সব্যাগটা নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটে যাই। ভেতরে আটকে কয়েকটা স্লিপিং পিল খেয়ে ফেলি। দরজার সিটকিনির অংশ ভেঙে দরজা খুলে জোর করে আমাকে বের করে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িতে কয়েকজন মিলে হাত-মুখ বেঁধে রেখেছিল। হোটেলের রুমে গিয়ে বাঁধন খুলে দরজা আটকে রাখা হয়। একটা শিশিতে কী ছিল জানি না, ওটাও খেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমাকে ছোঁয়ার আগে আমি মা*রা গেলে তো গেলামই আর যদি তা না হয় তাহলে বিপরীতে থাকা মানুষের কোন না কোন ক্ষতি করে দেব। এটা ভেবেই ওই রুমেই মরিচা পড়া একটা ছুড়িও পেয়েছিলাম, ওটা কাছেই রেখেছিলাম কিন্তু তার আগেই সব অন্যরকম হয়ে গেল।”
“কাউকে কল করে সাহায্য না চেয়ে স্লিপিং পিল খেয়ে নিলে?”
“জানি না, মাথা কাজ করেনি আমার। যা মাথায় এসেছে তাই করেছি। এত কম সময়ে কীই বা হতো? সব তো আমার মায়ের বর শেষই করে দিয়েছিল।”
উৎসের চোয়াল শক্ত হলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে পকেট থেকে নিতুর ফোন বের করে নিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার ফোন। থানায় ছিল। ফোনটা যেহেতু কাছেই ছিল তাহলে আমাকে কল না করলেও একবার পুলিশকে কল করতে পারতে।”
“হোটেলের রুমে বসে কল করার সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য সাথে ছিল না। নেটওয়ার্কের সমস্যায় কল যায়নি।”
নিতু ফোনটা নিয়ে পাওয়ার বাটন চাপতেই স্ক্রিনে দেখতে পেল একটা ছোট নোটিফিকেশন। মাকে পাঠানো মেসেজটা ডেলিভারি হয়নি। রুমে আসা লোকটা হয়তো জানতো ফোন কোন কাজে আসবে না তাই হয়তো ফোন বের করা দেখেও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শরীর ঘেঁষে বসেছিল। নিতু মৃদু হাসলো। বিড়বিড় করে বলল,
“ফোনও চায় না আমি আমার অনুভূতি, আবেগ কাউকে দেখাই। বেশ তাই হোক। ”
উৎস উঁঠে দাঁড়াল। নিতুর দিকে তাকিয়ে মলিনমুখে শুধালো,“নিতু, আমরা কালকে একসাথে বাড়ি ফিরছি তাই না? একটা সুযোগ চাই শুধু। আগের মতো চুল পরিমাণ থাকব না কথা দিচ্ছি।”
নিতু জবাব দিল না। মৃদু হেসে শুধু চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এই হাসির অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হলো উৎস।
_____
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছে নিতু। সারা রাত নিজেকে নিয়ে হিসেব কষেছে সে। হিসেবের ফলাফল হিসেবে মস্তিষ্ক তার মনকে জানিয়েছে – এভাবে আর না। তার মতো স্ট্রং পারসোনালিটির মেয়ে আর ভালোবাসা নামক মরিচার পেছনে ছুঁটবে না। জীবনকে সে প্রথমে যেভাবে দেখতে চেয়েছিল সেভাবেই দেখবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আর কোন পিছুটান নয়, নিজেকে সে ঠিক আগের মতো স্ট্রং আর এক্টিভ দেখতে চায়। নিজেকে আর হেরে যেতে দেখতে রাজি নয় নিতু। দুটো মাস তো কম সময় ছিল না সবকিছু নতুন করে শুরু করার জন্য। সে একা একা সবটা চেষ্টা করেছিল বিনিময়ে শুধু উৎসের ভালোবাসা চেয়েছিল সে। একজন খাঁটি মনের মানুষ জানে পুরোনো ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা একটা মানুষের ঠিক কতটুকু থাকে! কীভাবে তাকে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে কেউ। নিতুও সেটাই করেছিল। চেয়েছিল অতীতে যেটা হয়নি বর্তমানে সেটা হোক। ভালোবাসার মানুষটার সাথে সংসার করতে দুনিয়া ভুলে গিয়েছিল সে। দুনিয়া চষে বেড়ানো মেয়ে শুধুমাত্র একজন পুরুষের জন্য একটা বাড়িতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল।
নিতু শুধুমাত্র নিজের ফোনটা নিয়ে সবার নজর এড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছে। চারদিকে মাত্রই অন্ধকার কেটে আলো ফুটছে। একা পথে হাঁটছে সে। গন্তব্য বান্ধবীর সেই ফ্ল্যাট। গাড়ি পাওয়া গেলে এখান থেকে একটা গাড়িতে উঁঠে সোজা বাসার সামনে গিয়ে নামবে সে। ভাড়া? সেটা নাহয় বান্ধবীই দেবে। এটুকু সাহায্য পাওয়ার মতো মানুষ রেখেছে সে নিজের কাছে।
বান্ধবী বন্যার ফোনে কল করল নিতু। কল কেটে যাবে সেই মুহূর্তে রিসিভ হলো৷ ঘুমঘুম কণ্ঠে কথা ভেসে এলো,
“নিতু? এত ভোরবেলা কল করেছিস কেন? ঠিক আছিস?”
নিতু দাঁড়িয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো আছি। বাসায় আসছি গাড়ি পেলেই। ভাড়াটা রেডি রাখিস, আমার কাছে টাকা নেই। শোন, একটু কিছু রান্না করতে পারবি? প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”
ওপাশের ব্যক্তিটি হয়তো এবার উঁঠে বসল। শুধালো,
“সব ঠিক আছে তো, নিতু? এভাবে কেন কথা বলছিস?”
“এসে সব বলব তোকে।”
“আচ্ছা। সাবধানে আয়। আমি কিছু একটা করছি। তুই চলে আয়।”
কল কাটলো নিতু। একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে আবারও চলল নিজের পথে।
উৎস সারা রাত প্রায় জেগে ছিল। কখনো কেবিনের বাহিরে চেয়ারে বসে আবার কখনো দরজার ওপরের অংশের ছোট গ্লাস দিয়ে নিতুকে দেখে সময় কেটেছে। নিতুর মা নুরজাহান বেগম নিতুর সাথেই আছেন ভেতরে।
একটা দিন এবং প্রায় একটা সম্পূর্ণ রাত ক্লান্তিতে কাটলো উৎসের৷ এত ক্লান্তি চোখ দুটো আর নিতে পারছিল না। ভোর চারটার দিকে কেবলই উৎসের চোখ লেগে এসেছিল তখনই নুরজাহান বেগম এক প্রকার চিৎকার করতে করতে বাহিরে আসেন। উৎস চোখ মেলে তাকাতেই তিনি বলে ওঠেন,
“নিতু ভেতরে নেই, বাবা। আমি ওয়াশরুমেও দেখেছি। কোথাও নেই ও।”
উৎস দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঁঠে এদিক ওদিক, কেবিন সবটা খুঁজে দেখল। বেডে নিতুর ফোনটাও নেই। নিতুর ফোনে কল করতেই টের পেল নিতুর ফোন বন্ধ। নুরজাহান বেগম উৎসের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। বলে উঠলেন,
“নিতু পালালো! কিন্তু কেন?”
#চলবে….