#প্রিয়_বিকালফুল(২৭)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
“কী অবস্থা, মেজরের বিকালফুল?”
‘বিকালফুল’ শব্দটা দেখেই চোখে মুখে চিন্তার ছাপ দেখা দিল উৎসের মুখে। সাথে সাথে নিতুকে ডাক দিল সে। নিতু দরজাটা খুলে ফেলেছে এতক্ষণে। উৎসের ডাকে ফিরে সে। উৎস বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
“মেজরের বিকালফুল মানে?”
নিতু খেয়াল করল তার ফোনটা উৎসের হাতে। চোখবন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। সবকিছু এখনই বলা ঠিক হবে কি না সেটাই ভাবছে সে। উৎস ফোনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো। নিতু অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। উৎস কোমলস্বরে বলল,
“বন্যা তোমাকে এই নামে ডাকে?”
নিতু দুই পাশে মাথা নাড়ল৷ মাথা নিচু করে বলল,
“কেউ একজন ডাকতো।”
উৎসের চোখেমুখে প্রবল আগ্রহ। এই নামটা যে একসময় তার ভালো লাগার, ভালোবাসার কারণ ছিল তারপর সব এলোমেলো করে দিয়েছিল। এই নামটাই তাকে ছন্নছাড়া, ভালোবাসায় ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। মনকে বুঝিয়েছিল সবাই কাছে আসে শুধুমাত্র মন ভাঙতে, ঠকাতে।
উৎস বার কয়েক প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিজের অতিরিক্ত আগ্রহকে দমানোর চেষ্টা করল কিন্তু সব চেষ্টা যেন বৃথা গেল। মনে একটাই প্রশ্নের উত্থান- একই নামে সে কাউকে ডেকেছিল আবার সেই নামেই কেউ নিতুকে ডেকেছে!
নাহ, উৎস কিছুতেই আর চুপ থাকতে পারল না। নিজের এই অতি আগ্রহের ফলস্বরূপ নিতুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“‘বিকালফুল’ নামে কে ডাকতো তোমায়?”
“কেন? কেউ ডাকতে পারে না?” উল্টো প্রশ্ন নিতুর।
উৎস নিতুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসালো। চোখ বন্ধ করে পুনরায় প্রলম্বিত শ্বাস টানলো। নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“হেয়ালি নয়। প্লিজ ক্লিয়ার করো বিষয়টা৷ আই কা’ন্ট ওয়েট।”
“আগে চা করে আনি? এই বিষয়ে ধীরস্থিরভাবেও তো কথা বলা যায়। এত উতলা হচ্ছেন কেন?”
“তুমি বুঝতে পারছো না৷ এটা জানা খুবই জরুরি। তুমি শুধু বলেই চলে যাও।”
নিতু মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ রইল। ভাবতে থাকলো, তবে কি আজকের সকালটাই সেই সকাল যখন সব সত্যি সামনে আসবে? কিন্তু উৎস বিশ্বাস করতে পারবে সবটা? ভাববে না তো এর মাঝে নিতুর কোন দোষ আছে?
নিতুকে চুপ থাকতে দেখে উৎস ফের বলে উঠল,“নিতু, বলবে না?”
নিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপর- নিচ মাথা নাড়ল। কোমলভাবে বলল,
“যা বলব, মাঝের কয়েকটা বছর ভুলে বিশ্বাস করে নিতে পারবেন তো? প্রয়োজনে আমি সবকিছু বলার আগে আপনি আপনার আম্মার সাথে কথা বলে নিতে পারেন। আমি আপনার গত কয়েক বছরের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানি না। আপনার কাছেও আগ্রহ দেখাইনি। উনার কাছেও জানতে চাইনি। সুতরাং আমি যা বলব সেটা সত্য এবং আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
উৎস নিতুর চোখে চোখ রাখল।
“এমনকিছু আছে যা আমি অবিশ্বাস করতে পারি?”
“এমনকিছু আছে যা আপনার গত এগারো বছরে মনের সাথে মিশে থাকা সত্যকে এক নিমিষেই মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারে।”
উৎস কিছুক্ষণ চুপ রইল। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। এগারো বছর! এই সংখ্যাটা কেন নিতু বলল? এগারো বছর পূর্বের কি তবে কোন অতীত আছে যা উৎস জানে না? সে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার আর তোমার কি কোন অতীত আছে? আমরা কি কোনভাবে পূর্বপরিচিত? ”
“যদি বলি হ্যাঁ?”
চুপ হয়ে গেল উৎস। নিতু উৎসের চুপ হয়ে যাওয়া দেখে অবাকের মাত্রা এবার আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“যদি বলি আপনার ‘বিকালফুল’টাই আমি তাহলে কি আকাশ থেকে পড়বেন?”
উৎসের চোখ যেন বিস্ফোরিত হওয়ার অবস্থা। কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসটাও থেমে গেল। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো সে। একহাত নিজের কোমর এবং অন্য হাতে কপাল কচলে বলে উঠল,
“কী বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে?”
নিতু মৃদু হাসলো৷ সে আগে থেকেই জানতো সত্য এত সহজে বিশ্বাসযোগ্য কিছুতেই হবে না। মানুষকে ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যা কথা সহজেই বিশ্বাস করানো গেলেও তিক্ত সত্যিটা যে বিশ্বাস করা কঠিন।
নিতু চাপাস্বরে শুধালো,“আঁতকে উঠলেন কেন? এই নামে কাউকে ডাকতেন? আমি মিথ্যা কথা বলতেই পারি কিন্তু এটা তো সত্য আপনার অতি ব্যক্তিগত কিছু আমার জানার কথা না।”
“সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে আমার৷ ওয়েট আমি বলি আগে। আমি বুঝতে পারছি না কিছু। আমি আমার অতীত নিয়ে বর্তমানের সাথে কথা বলতে চাই না তবুও বলতে হচ্ছে, আমি এই নামে জুইকে ডাকতাম।”
“উহু, আমাকে ডাকতেন।”
“মানে? কী সব বলছো, নিতু?”
নিতু এবার নড়েচড়ে বসল। সিদ্ধান্ত নিল সব হেয়ালি ছেড়ে এবার সত্যিটা সামনে নিয়ে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নিতু শুধালো,
“এগারো বছর আগের সেই কোচিংয়ের কথা মনে পড়ে আপনার? আপনার বন্ধু আমাদের কোচিংয়ে বাংলা ব্যাকরণ পড়াতো। আপনি তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছিলেন৷ ছুটিতে বাড়ি এসে এক মাসের মতো আপনার বন্ধুর জায়গায় আপনি কোচিংয়ে পড়িয়েছিলেন কারণ স্যারের মা অসুস্থ ছিল। এখানে ওখানে যেতে হচ্ছিল।”
উৎস দ্রুত এসে নিতুর পাশে বসলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“তার মানে তুমি সেই কোচিংয়ের স্টুডেন্ট ছিলে?”
“হ্যাঁ। আপনি যেদিন প্রথম আসেন কোচিংয়ে সেদিনই আপনাকে দেখে পছন্দ হয়েছিল। তখন আমি প্রথম বাটন ফোন কিনেছিলাম। অনেক জিদ করার পর মা কিনে দিয়েছিল কিন্তু আপনার নম্বর কীভাবে পাব তার জন্য আমার ফোন হারিয়ে গেছে, পাচ্ছি না বলে আপনার ফোন থেকে ফোন করানো হয়েছিল।”
উৎস ভ্রু কুঁচকে বলল, “সেটা তো জুই করেছিল।”
“আমিই ওকে দিয়ে করিয়েছিলাম।”
“তোমরা বন্ধু ছিলে?”
“হ্যাঁ। আপনার সাথে তারপর আমার মেসেজে কথা শুরু হয়। আমার যেমন আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগত সেরকম আপনারও ভালো লাগতে শুরু করে।”
উৎসের চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসার যোগার। কিছুতেই এত প্যাঁচালো অতীত বিশ্বাস হচ্ছে না তার৷ একটা মানুষ এত ডিটেইলে কীভাবে আরেকজনের ব্যক্তিগত কথা জানতে পারে যদি না সে সত্যি বলে? কিন্তু জুই! কিছু মাথায় ঢুকছে না উৎসের।
নিতু ফের বলে উঠল,“আপনি আমাকে ‘বিকালফুল’ নাম দেন। আমি নিজের নাম আপনাকে তখন জানাইনি শুধু বলেছিলাম আমার নাম কোন এক ফুলের নামে। তখন আপনি ওই নামটা দেন কারণ আপনি বিকেলেই আসতেন কোচিংয়ে। বিকেলে আমাদের সাক্ষাৎ হতো আর ফুলের নামে আমার নাম এই দুটো জিনিস মিলিয়ে আপনি আমার নাম বিকেলফুল দিয়েছিলেন৷ যদিও আমি আমার পরিচয়ে কখনো আপনার সামনে যাইনি। আর ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আপনার, আমার কী কথা হতো সবকিছু জুই জানতো। একদিন আমার ফোনটা সত্যি সত্যি চুরি হয়, আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হই তখনই৷ কোচিংয়ে যেতে পারিনি সপ্তাহখানেক৷ এরপর যখন গেলাম ততদিনে আমার সর্বনাশ আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী করে ফেলেছে। সে আপনার কাছে আমি সেজে কথা বলে, দেখা করে আপনার সাথে রিলেশনে গিয়েছে। বিশ্বাস করুন, এটা দেখে আমি আবার অসুস্থ হয়ে যাই৷ পরে ভেবেছিলাম সব সত্যি আপনাকে জানাবো কিন্তু জুই আমার বাড়ি এসে হাতে পায়ে ধরে রিকুয়েষ্ট করে আমি যেন না জানাই আপনাকে এসব। আমিও কুরবানি দেই আমার ভালোবাসা। তবে আপনার সাথে ওকে সহ্য করতে না পেরে যেকোন মতে মাধ্যমিক দিয়ে বিদেশ চলে যাই। ”
নিতুর পুরো কথা চুপচাপ মন দিয়ে শুনলো উৎস। যতদূর মনে করতে পারল নিতুর বলা কথার সাথে অতীতের ঘটনাগুলো মিলে যাচ্ছে। তবে ছয়টা বছর যাকে ভালোবেসেছিল তাকে অবিশ্বাস করতে মন চাইছে না। মানুষ এভাবেও মিথ্যের মাধ্যমে কারও জীবনে এসে সারাজীবন থেকে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে? মিথ্যের মাধ্যমে এসেছিল তার জন্যই বোধ হয় টিকে থাকতে পারেনি। ভালোবাসা ভরপুর থাকার পরও বিচ্ছেদ ঘটেছে কোন না কোনভাবে।
উৎসের বুক ভারি হয়ে আসছে। মানুষ চিনতে সে এতটা ভুল করেছে! এভাবেও মানুষকে ঠকানো যায়! তার গলা ভারি হয়ে এলো। বাঁধা বাঁধা শব্দে বলল,
“আমাকে এভাবে ঠকানো হয়েছে? আমিও তখন এতটাই অন্ধ ছিলাম যে বিশ্বাসও করে নিয়েছিলাম!”
নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কিছুই করার ছিল না। আমরা একদিনও কলে কথা বলিনি। বললে হয়তো কণ্ঠস্বরে চিনতে পারতেন। তাছাড়া জুই তো পুরোটাই আমার নকল করে আপনার সাথে আমি হয়েই ছিল।”
উৎস নিতুর দিকে অসহায় চোখে তাকালো। জোরপূর্বক হেসে বলল,“বিচ্ছেদের এতগুলো বছর হয়ে গেছে, একটাদিনও যোগাযোগ করার ইচ্ছে হয়নি আমার। প্রথম কিছুদিন কষ্ট হয়েছিল এটা সত্যি কিন্তু এখন আমার তাকে একটা বার কল করতে ইচ্ছে করছে। জানতে ইচ্ছে করছে, ঠিক কী ক্ষতিটা আমি তার করেছিলাম যার জন্য সে আমার জীবনটা এমন করে দিয়েছিল?”
নিতু উৎসের হাতগুলো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলল,“আপনাকে হারানোর পর আমার আর কাউকে দেখে ভালো লাগেনি, অনুভূতি জাগেনি। আপনার সাথে আবার যেদিন দেখা হলো, দূর্ঘটনাবশত জানতে পারলাম আপনিই সেই উৎস, বিয়েও হলো তখন থেকে আমি শুধু আপনার সাথেই থাকতে চেয়েছি। এই যে এই মুহূর্তে আপনাকে সব জানাতে পেরে কী যে স্বস্তি লাগছে আমি সেটা বুঝাতে পারব না।”
“আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না জানো? কোন সত্য এরকমও হয়! মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি বা কোন গল্প পড়ছি।”
“হলো তো। মানুষের জীবনেই যে গল্পের চেয়ে অনেক অন্যরকম ঘটনা ঘটে।”
“তোমার বন্ধুর ওপর তোমার রাগ নেই? আমার তো প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।”
নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। মৃদু হেসে বলল,
“ছিল। এখন নেই। যাকে না পেয়ে ক্ষোভ ছিল সে এখন আমার। পুরোটাই আমার। তবে তার সাথে কখনো দেখা হলে জানতে চাইবো, তার যেহেতু ছেড়ে যাওয়ারই ছিল তাহলে আপনাকে আমার কাছে থেকে ওভাবে ছিনিয়ে কেন নিয়েছিল? সূচনার আগেই কেন সে আমার ভালোবাসার ইতি টেনেছিল!?”
“আমি একটা মানুষ যার জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে মিথ্যের মধ্যে। যে মানুষটা ঠকালো তাকেই ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার কারণে আমি তোমাকে হারাতে বসেছিলাম। কত বোকা আমি!”
নিতু কোমলস্বরে শুধালো, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন? আমি আপনাকে সত্যিটা জানাতে ভয় পাচ্ছিলাম৷ মনে হয়েছিল আপনি আমাকেই ভুল বুঝবেন।”
উৎস নিতুর গাল ছুঁয়ে বলল,“আমি অবুঝ নই, নিতু তবে সত্যিটা হজম করতে কিঞ্চিৎ সময় লাগছে এবং লাগবে।”
“আপনি বিশ্বাস করেছেন তো যে আমি মিথ্যা বলিনি? আমিই আপনার..”
নিতুকে থামিয়ে দিয়ে উৎস বলে উঠল,
“প্রিয় বিকালফুল।”
#চলবে…….