প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৩০

0
126

#প্রিয়_বিকালফুল(৩০)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

নিতুর ঘুম ভাঙলো ভোর হতেই। মাত্র চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। দূর-দূরান্তে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই কিছুক্ষণ শুয়ে রইল সে। হঠাৎ মনে পড়ল আজকেই বিকেলে উৎসের চলে যেতে হবে। ব্যাগ গোছগাছ করা হয়নি, তার জন্য কিছু খাবার বানানো যায়নি যেগুলো সে গাড়িতে বসে রাস্তায় খেতে পারে।

নিতু দেশের বাহিরে একা একা থাকার দরুন দেশি-বিদেশি অনেক রান্নাই শিখেছে৷ শিখতে হয়েছে এবং নিজে নিজে রান্না করে খেতেও হয়েছে। বাহিরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের মতো হেল্পিং হ্যান্ডের এত সুযোগ সুবিধা নেই। সেখানে নিজের কাজগুলো নিজেকেই করতে হয়। ঘর- বাহির নিজেকেই সামলাতে হয়।

এখন আগে থেকেই উৎসের জন্য কিছু করতে হবে ভেবেই চোখ মেলে তাকালো নিতু। উৎসের দিকেই পাশ ফিরে শুয়ে ছিল সে। চোখ মেলে তাকাতেই উৎসের দিকে চোখ গেল তার। উৎসকে এসময় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো। আশেপাশে একটু তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। ভেতর থেকে বাহিরের হালকা আলো বোঝা যাচ্ছে তবে এখনো অন্ধকার। উৎসের দিকে ফিরে তাকালো সে।

“ঘুম ভাঙলো কখন তোমার?”

উৎস মৃদু গলায় বলল,“ঘুমোলাম কখন?”
“ঘুমোওনি? কিন্তু কেন?”
“ঘুমিয়ে রাত পার করলে তোমাকে দেখব কখন?”

মুচকি হাসলো নিতু। উৎসের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বুকে মুখ গুজলো।

“এজন্যই বুঝি পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালানো?”

উৎস নিতুর মাথায় চুমু খেলো। চকিতে বলে উঠল,
“অন্ধকারে বউকে দেখব কীভাবে?”
“রাতেই কেন দেখতে হবে? দিনের আলো আছে কী করতে?”
“এরপরের রাতগুলো তো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেব, আজ নাহয় আমার বিকালফুলকে দেখেই কাটালাম!”

নিতু উৎসের বুক থেকে মাথা তুলে মুখটা বালিশে সরিয়ে নিল। উৎসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“আমাদের আরও কিছু সময় একসাথে থাকা হলো না কেন? আরও আগে সবকিছু কেন ঠিক হলো না? আমি এতদিন কীভাবে থাকব? এই বিছানা, ঘরে আসলেই তো ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। ঘুম হবে না আমার।”

নিতু ফের বলে উঠল,“এখন মনে হয়, তুমি সবসময় আমার সাথে থাকলেও মনে হবে সময় খুব অল্প ছিল।”

উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিতুকে ছেড়ে যেতে তো তারও ইচ্ছে করছে না। রাতের প্রথম রাত্রি বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজে কাটাতে হয়েছে তার। মাঝেমাঝে নিতুকে সময় দিয়েছে। নিতু ঘুমোনোর অনেকক্ষণ পর নিজের কাজ শেষ করে শুয়েছিল নিজেও। ঘুম আসেনি চোখের তারায়। কতক্ষণ এপাশ ওপাশ ফিরে বুঝতে পারল আজ হয়তো ঘুম আসবে না। টেবিল ল্যাম্পটা অন করে নিতুর দিকে তাকাতেই চোখটা আটকে গিয়েছিল। এই মুখটার দিকে তাকিয়ে পুনরায় দীর্ঘ ছুটির পর কাজের ফেরার উচ্ছ্বাস সে আর পায়নি। কাজ ছাড়া অন্য কোন সম্পর্কের টান সে গত কয়েক বছরে পায়নি অথচ এই একটা মানুষ তার সবকিছুর প্রতি আগ্রহ শেষ করে দিয়েছে। উৎসের ইচ্ছে করল সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে, ইতি টেনে এই মানুষটার কাছে থেকে যেতে।

উৎসের নিরবতা ভঙ্গ হলো। বিছানা থেকে উঠে বসে বলল,“বের হবে?”
”এখন?”
“হ্যাঁ। নীল শাড়ি আছে?”
“আছে।”
উৎস ফোনস্ক্রিনে সময় দেখল। পরক্ষণেই নিতুকে বলে উঠল,
“নীল শাড়ি, কানে ঝুমকো, চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে তৈরি হয়ে নাও। আমি বাইকটা বের করি। দুজনে ঘুরে আসি চলো। সূর্যের আলো ফুটতে বেশ দেরি। আমার চেনা একটা টঙের দোকান আছে। দারুণ মালাই চা পাওয়া যায়।”

নিতুও উঠে বসলো। মুখ গোমড়া করে বলল,
“আমার বানানো চা এখন ভালো লাগে না?”

উৎস হেসে নিতুর গাল টেনে বলল,“চায়ের সাথে এই চাওয়ালীকেও অসম্ভব ভালো লাগে। একদম বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখার মতো ভালো লাগে।”

নিতুর আবারও মন খারাপ হলো। মুখ নিচু করে বলল,”বুকে না রেখে এখানে ফেলেই তো চলে যাচ্ছ।”
“যাব না? তুমি বললে জবটাও ছেড়ে দিতে পারি। সারাদিন বউয়ের আঁচলের তলায় থাকব আর এই মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব।”
“ঢং করতে হবে না।”
“আমার ভালোবাসাকে তোমার ঢং মনে হচ্ছে?”

নিতু কিছুক্ষণ উৎসের দিকে চেয়ে রইল। চাপাস্বরে বলল,“তোমার এই কয়েকদিনের এত ভালোবাসা যে আমাকে মাসের পর মাস কাঁদাবে। তোমাকে না পেয়ে বছরের পর বছর একা তো থেকেছি কিন্তু তোমাকে এভাবে পেয়ে মাসগুলো যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।”

উৎস বলল,“উহু একদম মন খারাপ না। আমি খুব চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি ফেরার। আজ সারাদিন মন খারাপ না, প্লিজ। চলো, তৈরি হও। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা আমরা দুজনে একসাথে একটু ভালো থাকি। আজকের দিনটা আমার ভালো কাটুক তোমার সাথে। আজকের ভালো থাকার কারণটা তুমি হও।”
___

দুপুরের রান্না শেষ করে তিনজন একসাথে খাওয়া শেষ করল। ফরিনা বেগম খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গেলেন। নিতু নিজেও উৎসকে রুমে পাঠিয়ে উৎসের জন্য বানানো কিছু খাবার নিয়ে রুমে এলো।

সারা সকাল দুজন এখানে ওখানে ঘুরেছে। নিতু উৎসের কথামতো আলমারিতে যত্নে রাখা নীল শাড়িটা পরেছিল। উৎসের পছন্দসই সাজও সেজেছিল। দুজনে আজ যেন সব ভুলে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। বাসায় যেন ফিরে তাড়াহুড়ো করে নাশতা বানাতে যেতে না হয় তাই নাশতা নিয়েই বাড়ি ফিরেছিল দুজনে। ধীরেসুস্থে নিতু উৎসের জন্য পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছিল দুপুরে। এরপর আবার কবে উৎস বাসায় ফিরবে কবে এমন আয়োজন করতে পারবে কে জানে!

উৎসের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং জামাকাপড় নিজ হাতে গুছিয়ে দিল নিতু। উৎস হাতে হাতে নিতুকে সাহায্য করল৷ সব কাজ যখন মোটামুটি শেষ তখন নিতু বিছানায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আর কিছু বাকি আছে কি না দেখো। থাকলে দিয়ে দিচ্ছি।”

উৎস ব্যাগটা বিছানা থেকে নামিয়ে নিচে রেখে নিজে গিয়ে নিতুর পাশে বসল। বলল,
“আছে তো। বউটা বাকি আছে৷ তাকে নিয়ে গেলে ভালো হতো।”
“কিন্তু বউ তো যেতে পারছে না, সাহেব।”
“সেটাই দুঃখের বিষয়।”

উৎস ঘড়িতে সময় দেখলো। সময় থেমে নেই। চলেছে নিজ গতিতে আর এখন সময় কানে কানে বলছে চলে যাওয়ার সময় নিকটে এখনই তৈরি হতে হবে দেশের ভালোবাসায় সাঁড়া দিতে।

“আমার তৈরি হতে হবে, নিতু।”

উৎসের উক্ত কথাতেই তার মুখের দিকে চেয়ে রইল নিতু। চোখ দুটো ছলছল করে উঠতে চাইলো। পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে চোখের পানি গায়েব করল সে। সে জানে এ সময় চোখের পানি দেখলে উৎসের চলে যেতে কষ্ট হবে৷ সে পাশেই গুছিয়ে রাখা পোশাকগুলো হাতে নিয়ে উৎসের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“নাও, এগুলো পরে নাও। সাদা শার্টে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে৷ আমি চোখ ফেরাতে পারি না।”

উৎস তৈরি হয়ে নিল। সাড়ে চারটায় বাসা থেকে বের হওয়ার কথা ঘড়ির কাটা এসে চারটা দশে এসে ঠেকেছে। উৎস তৈরি হওয়ার পর প্রায় পনেরো মিনিট যাবৎ নিতু কোন কথাবার্তা ছাড়া উৎসকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। উৎস নিজেও নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। ইচ্ছে করেনি তার৷ কত বছর পর সঠিক ভালোবাসায় খালি বুকটা পরিপূর্ণ হয়েছে তার৷

দীর্ঘ সময় পর নিতু নিজে থেকেই উৎসকে ছাড়ল নিতু। উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখল উৎসের মুখখানা মলিন। নিজেকে সামলে মেকি হাসার চেষ্টা করল সে। বলল,

“মন খারাপ, মেজর সাহেবের?”
“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, নিতু। ” কোনকিছু না ভেবে বলেই ফেলল উৎস।

নিতু উৎসের হাতটা শক্ত করে ধরে ব্যাগের দিকে ইশারা করে বলল,“শুধু আমাকে ভালোবাসলে হবে? দেশ, দেশের মানুষেরও যে তোমাকে প্রয়োজন৷ আমি তোমাকে আটকে রাখতে পারি না। আমি প্রতিদিন কথা বলব। অপেক্ষা করব তোমার ফেরার।”
“জলদি ফিরব আমি৷”
“খুব জলদি।”
“খুব।”

নিতু মুখ উঁচু করে উৎসের চোখে চোখ রাখল। নরম গলায় বলল,
“ভালোবাসি।”
“অসম্ভব রকমের ভালোবেসে ফেলেছি এই মেয়েটাকে।”

আরও কিছু মুহূর্ত দুজনে একসাথে কাটিয়ে বের হলো উৎস। নিতু উৎসের সাথে নিচতলায় নেমে এলো। মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিল উৎস। ফরিনা বেগম দীর্ঘদিন এবার ছেলেকে কাছে পেয়েছিলেন। টানা কয়েক বছরে এত সময় উৎস বাসায় থাকেনি। ছেলেকে ছাড়া থাকতে ভীষণ কষ্ট হতো। এবার হয়তো নিতুর উপস্থিতিতে কিছুটা লাঘব হবে। ছেলেকে বিদায় দিতে বাহিরের দরজার দিকে এগিয়ে এলেন তিনিও। নিতু উৎসের পিছু পিছু হাঁটছে। উৎসকে আড়াল করে বারবার চোখ মুছছে৷ সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো উৎস। গাড়ি আগেই বের করা হয়েছে উৎসকে এগিয়ে দিতে৷ ব্যাগটা গাড়ির ভেতরে রেখে নিতুর দিকে ফিরে এলো সে। নিতুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের দিকে চাইলো।

নিতু এবার নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। উৎসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তেই নিজেকে ছাড়িয়েও নিল। চোখ মুছে বলে উঠল,

“সাবধানে যাবে। সাবধানে থাকবে। মনে রাখবে তোমার জন্য কেউ সর্বদা অপেক্ষায় আছে। তোমার ওপর এখন আমারও অধিকার আছে। আমার জন্য হলেও নিজেকে ভালো রেখো। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো আমার কাছে৷”

নিতুর মুখখানা আঁজলা করে ধরল উৎস। পুরো মুখে নজর বুলিয়ে বলল,”বউয়ের কাছে যে আমাকে ফিরতেই হবে। মেজর তার বিকালফুলের কাছে ফিরতে বাধ্য।”
”জি বাধ্য।”

উৎস মৃদু হাসার চেষ্টা করল।
“আমাকে এখন যেতে হবে।”
”হুম।”
“ভালোবাসি কে বলবে? এই মুখ থেকে ভালোবাসি না শুনে আমি যেতে পারব না।”

নিতু উৎসের চোখে চোখ রেখে বলল,“ভালোবাসি তো।”

উৎস নিতুর দুই হাতে চুমু খেলো৷ চুমু খেলো কপালেও। আবেগি হয়ে বলে উঠল,

“ভালোবাসি, প্রিয় বিকালফুল।”

#চলবে…..