প্রিয় রোদ্দুর পর্ব-০৫

0
198

#প্রিয়_রোদ্দুর🤍
#লেখনীতে:অনুসা_রাত❤️(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৫

বিকাল কয়টা বাজে জানি না।আকাশের কোণে লাল রঙের আভা দেখা যাচ্ছে।ব্যস্ত পাখিরা নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।পাখির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে চারিদিক থেকে।ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি আমি।দৃষ্টি আকাশের সেই লাল আভার দিকে।পরপর দুদিন স্যার এলো না।
কেন এলো না জানি না।কলও দিলো না।আম্মুও জিজ্ঞেস করেনি।তার ধারণা পরীক্ষা থাকতে পারে।
আমারো তেমন মাথাব্যাথা নেই।কিন্তু উনি দুদিন ধরে কেন আসছেন না?তবে কি উনি অসুস্থ!
আজ নিয়ে তিনদিন হবে।আজ কি উনি আসবেন?
না আসলে তো আমারি ভালো।আমার ভাবনার মাঝেই কল এলো টিনার।কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই বলে উঠলো,

-“কলেজে অনুষ্ঠান আছে।আসবি না?”

-“হুম দেখি…”

-“তুই না এক্সাইটেড ছিলি কত্ত!এখন হুম দেখি বলছিস কেনো?”

আমি মুখ দিয়ে জোরে শ্বাস ছেড়ে বললাম,

-“অনুষ্ঠান কবে?”

-“এইতো দুদিন পর।”

-“আচ্ছা। ”

টিনা কিছু সময় চুপ থেকে বললো,

-“অতসী,তোর কি মন খারাপ? ”

আমি ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে এসে বললাম,

-“না তো।ঠিক আছি।”

-“মনে তো হচ্ছে না তুই ঠিক আছিস।কি হয়েছে বলতো?এনিথিং রং?”

আমি আকাশের দিকে চোখ রেখেই বাঁধানো গলায় বললাম,

-“দুদিন ধরে শুধু মনে হচ্ছে সারাদিনে কি যেন একটা কাজ আমি করিনি।কি করিনি সেটাই বুঝতে পারছি না।”

-“ওমা।এটা আবার কেমন রোগ।”

-“জানি না।”

টিনা কিছু বলতে গিয়েও বললো না।পরিশেষে বললো,

-“আচ্ছা হয়ত তোর স্যার আসার সময় হচ্ছে। যা পড়তে বস।”

-“স্যার আসে না দুদিন যাবত।আজ আসবে কিনা জানি না।”

টিনা কিছু সময় চুপ করে রইলো।আমি আবার বললাম,

-“হ্যালো?”

-“হুম হুম।ভাবছি..”

-“কি ভাবছিস!”

-“না তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।ভাইয়া আসছে না কেনো?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

-“জানি না।আম্মুর ধারণা ওনার এক্সাম।কিন্তু এক্সাম থাকলে তো আমায় বলে যেত।বলেনি তো।”

-“হয়ত ব্যস্ত।”

-“হামমম…আচ্ছা উনি অসুস্থ নয়ত?”

-“কে জানে।”

-“আমার মনে হচ্ছে উনি অসুস্থ।অযথা মিস দেয়ার মানুষ তো রোদ্দুর স্যার নন।”

-“হতে পারে।”

-“বুঝতে পারছি না।”(অস্থির হয়ে)

-“তোর অস্থিরতা দেখে তো আমারই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ”

ওর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।তুতলিয়ে বললাম,

-“অস্থিরতা? কিসের অস্থিরতা!”

-“এইযে তুই জানার জন্য পাগল হয়ে গেছিস।”

-“আরে না তেমন কিছু না।”

-“আমি তো সেটাই বলার চেষ্টা করছি যে তেমন কিছু না।তোরই তো ভালো।না আসলে তোর শান্তি।”

-“হ..হ্যা তাই তো।তাই তো।”

-“আচ্ছা রাখি রে।মা ডাকে।পরে টেক্সট করছি।”

-“বায়।”

বলেই আমি কল কেটে দিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।মনটা বিষন্ন লাগছে কেন জানি না।
মনে হচ্ছে চারিদিকে সব খারাপ হচ্ছে! সবকিছু খারাপ হচ্ছে! চোখ ভরে উঠলো আনমনে।তবে কি আমি রোদ্দুর স্যারকে মিস করছি?

রোদ্দুর স্যারের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর টিনা।ঢুকবো কি ঢুকবো না বুঝতে পারছি না।এই প্রথমবারের মত তার বাসায় এলাম।কিছু নিয়েও এলাম না।মিষ্টি নিবো ভেবেছিলাম কিন্তু যদি স্যার অসুস্থ থাকে তাহলে মিষ্টি জিনিসটা মানায় না।সব ভেবেচিন্তে একটা মিষ্টির বক্সই নিলাম।আমি তো আর জানি না যে কেউ অসুস্থ নাকি অন্যকিছু।কলিং বেল চাপতেই একজন ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন।তারপর আমার দিকে কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।উনি কিছু একটা বলছিলেন যা ওনার মুখেই মিলিয়ে গেলো।আমি মিষ্টি হেসে বললাম,

-“আন্টি আসসালামু আলাইকুম।”

-“ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা।অতসী তুমি?”

আমি অবাকের শীর্ষে!ওনার সাথে সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি আমার।অথচ উনি আমায় চিনে ফেললেন?আবার নামও বলে দিলেন।কি আশ্চর্য! আমার বিস্ময় দেখে উনি হাসার চেষ্টা করে বললেন,

-“কেমন আছো মা?”

আমিও বাস্তবে ফিরে এলাম।হেসে বললাম,

-“জ্বী আন্টি ভালো।আপনি ভালো তো?শরীর ভালো?”

-“হ্যা।ভেতরে এসো না!”

আমি ভিতরে যেতে যেতে ওনার হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বললাম,

-“আন্টি আপনাদের জন্য আনলাম।আর এটা আমার বান্ধবী।”

টিনার সাথে পরিচিত হওয়ার পর উনি বললেন,

-“এসব আনার কি দরকার ছিলো।”

-” না আন্টি,আম্মু বলে কারোর বাসায় খালি হাতে যেতে নেই।”

উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“খুব ভালো মেয়ে।”

আমি আশেপাশে তাকিয়ে রোদ্দুর স্যারকে খুঁজতে লাগলাম।ওনার জন্য আসলাম আর উনিই নেই!জোনাকির সাথে আলো জ্বালাতে যাননি তো? ভেবেই কেন যেন আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠলো।আন্টি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“কিছু খুজছো?”

আমি কেঁপে উঠে বললাম,

-“ন..না আন্টি।আসলে রোদ্দুর স..স্যার…”

-“ও তো রুমে।এই দেখো আমি ভুলেই গেছিলাম।কাকলি?এই কাকলি? গরম দুধটা নিয়ে আয় জলদী।”

বলেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“তুমি কিছু খাবে?বসো না!আমি ব্যবস্থা করছি।”

-“না না আন্টি।কিছু খাব না।(কিছুক্ষণ চুপ থেকে)স্যার কোথায়?”

-“ওর ধুম জ্বর।রুমে আছে।”

আমার বুকটা কেমন ধরফর করে উঠলো।অবাক হয়ে বললাম,

-“জ্বর? কিভাবে?”

আমরা ওনার পিছনে স্যারের রুমে দিকে যেতে লাগলাম।উনি বলতে লাগলেন,

-“আর বলো না মা!বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলেই জ্বর ঠান্ডা লেগে যায়।ওর অল্পতেই ছোঁয়াচে।আমি বলেছিলাম বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে না লাগাতে।সেদিন বৃষ্টি হলো না? বাসায় আসতেই জ্বর।”

বলতল বলতে রুমে ঢুকলেন।ঢুকতেই দেখলাম উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন উনি।চোখ বন্ধ। গায়ের উপর চাদর।
জানালা খোলা!ওনার বেডের বা পাশেই একটা মস্ত বড় জানালা।মানে জানালার সাথেই বেডটা।বেডে বসে খুব সুন্দর জানালা দিয়ে বাতাস খাওয়া যাবে।বেডসাইড টেবিলে ওনার একটা ছবি।নীল পাঞ্জাবি পড়া।কি সুন্দর হাসি!এমন করে যদি প্রতিদিন হাসতো!রুমটা পুরো সাদা রঙের।আর রুমের এক পাশের দেয়ালে ওনার নানান বয়সের ছবি দিয়ে ভরা।আরেকপাশে বুক শেলফ।কত্ত বই!আর ওনার টেবিল।একটা সোফাও আছে।বারান্দার দিকে চোখ গেলো আমার!বারান্দাটা বুঝি আরো সুন্দর? গাছের ডালপালা দেখা যাচ্ছে।
আন্টির কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার,

-“জানো না। একটা কথা শোনে না আমার।এইযে জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে।পরে আবার রাত জেগে জেগে পড়াশোনা করবে।এই ছেলেটাকে নিয়ে পারি না আমি।আমার একটা কথা যদি শুনতো।”

বলতে বলতে উনি রোদ্দুর স্যারের পাশে বসে ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“রোদ্দুর! দেখ কে এসেছে! ”

আমি ওনাকে থামিয়ে বললাম,

-“আন্টি ডাকবেন না।উনি অসুস্থ তো।রেস্ট নিক।”

আমার কথা শোনা মাত্রই উনি আস্তে আস্তে চোখ খুললেন।আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।ওনার চোখে ওনার অসুস্থতা প্রকাশ পাচ্ছে। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। বুকটা কেঁপে উঠল কেন!মনে হচ্ছে আমার কাছে যদি কোনো ম্যাজিকাল পাওয়ার থাকতো!তা দিয়ে যদি ওনার জ্বরটা চট করে গায়েব করে দিতে পারতাম।কত ভালো হত!ওনার কষ্ট কম হতো!উনি আধশোয়া হয়ে বসলেন।পড়নে কালো রঙের গেঞ্জি। আমার দিকেই তাকিয়ে।আন্টি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“বসো মা…”

আমি স্যারের পায়ের কাছে বসে পড়লাম।টিনাও পাশে বসলো।আমি স্যারের দিকে বারবার তাকাচ্ছি।বরাবরের মতই আমার দিক তাকিয়ে।
আমি ইতস্ততভাবে বললাম,

-“আব..কেমন আছেন স্যার?”

উনি কাশলেন।তারপর অসুস্থ গায় বললেন,

-“এইত আছি।তুমি?”

-“আমি?হুম ভালো।”

খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,আমি ভালো নেই।কেন ইচ্ছে হলো জানি না।কিন্তু ইচ্ছে হলো।আন্টি ওনার দিকে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিলেন।উনি সেটা খেয়ে নিলেন।আন্টি আবার বললো,

-“তোমরা বসো,আমি নাস্তা নিয়ে আসি ”

-“না না আন্টি।তার দরকার নেই।আমরা চলে যাব।”

-“আরে তা কি করে হয়।বসো তো।”

বলেই চলে গেলেন।আমিও কাচুমাচু হয়ে বসে রইলাম।টিনা ওনাকে প্রশ্ন করছে,

-“ভাইয়া আপনি নাকি তিনদিন ধরে যান না।এই শোকে আমার বান্ধবী পাগল হয়ে….”

আমি ওর হাতে জোরেশোরে চিমটি কাটলাম।টিনা আর্তনাদ করে বললো,

-“এটা কি হলো!”

-“বেশ হলো!”(দাঁতে দাঁত চেপে)

ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।তারপর বললেন,

-“কি হলো!তুমি ওকে মারলে কেন?”(ধমক দিয়ে)

কি রে ভাই!জ্বরের মধ্যেও কি তেজ!আমায় ধমক দিচ্ছে। আমি নিম্ন স্বরে বললাম,

-“ও মিথ্যা কথা বলে।”

টিনা হাত ঘষতে ঘষতে বললো,

-“স্যার ওয়াশরুমটা কোনদিকে?”

স্যার ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিতেই ও চলে গেল।আমি হাত কচলাচ্ছি।অনুভব করছি,এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ আমায় পর্যবেক্ষণ করছে গভীর ভাবে।তাও এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি।হঠাৎ স্যার আমায় বললো,

-“চুলগুলো বেঁধে আসলে পারতে!”

-“জ্বী?”

-” না কিছু না।একটু পানি খাওয়াবে?”

-“হ্যা..”

বলেই আমি তাড়াতাড়ি করে ওনার বেডসাইড টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে গ্লাসে ঢেলে ওনার হাতে দিলাম
উনি গ্লাসটা ধরতেই আমার হাতে হাত পড়লো।ওনার চোখ পড়লো আমার চোখে।ওনার চোখে আজ অন্য ভাষা খুঁজে পেলাম আমি।কিন্তু এরমানে আমি জানি না!কি এর মানে?

চলবে…