প্রিয় সুখ পর্ব-০৬

0
6

প্রিয় সুখ-৬
_______________
সরু রাস্তাটা ধরে উদাসীন মনোভাব নিয়ে এলোমেলো ভঙ্গীতে হাঁটছে নীহারিকা।কালো অন্ধকারে ঢেকে থাকা আকাশের মাঝ থেকে উঁকি দিয়ে জানিয়ে দিতে চাইছে চাঁদ, তুমি একা না আমিও আছি।মেঘ যেন বিপরীত।খুব রেগে সে।বার বার সে চাঁদকে আড়ালে নিয়ে কি যেন কানে কানে বলছে।নীহারিকা একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো।তারপর আবার ছোট ছোট কদমে হাঁটতে শুরু করলো।তাকে খুব একটা ব্যস্ত পথিক বলে মনে হচ্ছে না।বাড়ি পৌছানোর তীব্র কোন ইচ্ছে কাজ করছে না তার ভেতরে।ইচ্ছা যেন আজ বড্ড অগোছালো।কি সব আজেবাজে চিন্তা মাথায় জেকে বসে ঘুরপাক খাচ্ছে।বিমুগ্ধ নামক স্বল্প পরিচিত মানুষটা বিরক্ত করছে তাকে খুব।অসহ্য লোক একটা।বিদঘুটে অনুভূতি।কেন যে তার জীবন জুড়ে একটা কালো রাত এলো?বুঝতে পারে না সে।বোকামী আর ভুল মিলিয়ে সে মস্ত এক কাজ করেছে।সেই কাজের কৈফিয়ত যেন সারাটা জীবন দিতে হবে তাকে।তিক্ত বিরক্তি নিয়ে সে রাস্তার পাথর ঘষতে চাইছে।হঠাৎ মনে পড়ে মানুষটা তো হোটেলেই নিজের গিটারটা ফেলে এসেছে।পরক্ষণে মনে পড়ে বন্ধুদের সাথে তো একবার বের হয়েছিলো।তখন মনে হয় তাদের সাথেই রেখে এসেছে।কি সব ভাবছে সে?মস্তিষ্কের নিউরনগুলো সব কেমন উল্টেপাল্টে এক কথায় গিয়ে ঠেকছে।বিরক্তিতে নীহারিকা কয়েক সেকেন্ড শুধু আকাশের লুকোচুরি খেলা দেখে নিলো।তার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।অপেক্ষা করতে মন চাচ্ছে না।বসে পড়তেও সে পাড়ছে না।ব্যাপারটা কি?তার কিছু ভালো লাগছে না কেন?নিজের মনের অবাধ্য সব বার্তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নীহারিকা আবার হাঁটতে পা বাড়ায়।বাস কই?কিছু দেখা যাচ্ছে না।কত ঘন্টা সে হাঁটছে সে নিজেও জানে না।প্রকৃত অর্থে ঘন্টা হয়নি।সে খুব ধীরচ ভাবে হাঁটছে।একদম অদ্ভুত ভঙ্গীতে।
কিছু ছেলে দেখা যাচ্ছে সামনে।নীহারিকা পাত্তা না দেওয়ার একটা উদাসীন মন মরা ভাব দেখিয়ে এগিয়ে যায়।হঠাৎ পথ আগলে ধরে একটা ছেলে।বিদঘুটে হাসি ঠোঁটে টেনে দিয়ে সে বলল,’ কই যাও?’
নীহারিকা উত্তর দিলো না।সহজ ভঙ্গীতে সে হাতের পাশ কাঁটিয়ে সরে আসে।অবাক বিস্মৃত হয়ে ছেলেগুলো নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করছে।তারপর কি মনে করে ছুটে এসে হাত আগলে দিয়ে পথ ঘিরে দাঁড়ায়।নীহারিকা বিরক্তি মুখে তাকিয়ে বলল,’ কি চাই?’
একজন খুবই বিশ্রী মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল,’ তোমাকে।’
নীহারিকা এবার হাতের নিচে ঝুঁকে বেড়িয়ে আসে।যেন এসব কথায় তার কিছু যায় আসে না।এবার একটা ছেলে পিছন থেকে হিজাবের পিছনের লম্বা অংশ টেনে ধরে।নীহারিকা চমকায়।এবার বুকে কামড় পড়ে।সে ফিরে তাকায়।জ্বলজ্বল করে কিছু রাক্ষস যেন তাকিয়ে আছে।ভীতু হয়েও তা প্রকাশ না করে সে বলল,’ ফাইজলামু হচ্ছে?’
ছেলেগুলো এবার সউচ্চ শব্দে হেসে উঠে বলল,’ হ হইতাছে।মজার ফাউজলামু।আনন্দ লাগে তো।’
‘ হিজাব ছাড়ুন।’কঠোর গলায় বলল নীহারিকা।ছেলেগুলো বিশ্রী হাসি ঠোঁটে ঝুঁলিয়ে রেখে বলল,’ এতো তাড়া কিসের?প্রেমিক অপেক্ষা করে বুঝি?’
পিছন থেকে একটা হাস্যউজ্জ্বল কন্ঠে বলে উঠলো,’হ ভাই।বুঝেন না এতো রাতে মেয়েরা ক্যান ঘুরে রাস্তায় রাস্তায়।’
দলের লোক ভেবে ছেলেটি বলল,’ হ রে বুঝি বুঝি।তবে প্রেমিকরে পরে খুশি করো আগে আমগোরে করো।এই মাইয়ার একটা নাম দেওয়া উচিৎ ঠিক না?’
‘ অবশ্যয়।দেন ভাই।’ কন্ঠটা কেমন যেন শুনালো।তবুও পিছনে না তাকিয়ে ছেলেটি বলল,’ কি নাম দিমু ক’তো?’
‘ ক্ষেপা মহিলা।কথায় কথায় কেমন ক্ষেপে যাচ্ছে দেখেন না?পুরাই মিস ক্ষেপা মহিলা।’
ছেলেটি চাপা বিরক্তি প্রকাশ করে পিছন ঘুরতে ঘুরতে বলল,’ এইডা একখান নাম হইলো?ফুলটুসি, ফুলমতি, গোলাপি,লাল টুকটুকি,বা কালা ফুলও দিতে পারতি।ওই বেটা তুই কে রে?’
নীহারিকা চরম ভাবে চমকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলো এতো বিমুগ্ধ।অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাসে কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে গেল।কথার একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না সে।শুধু আশা ভরা দুটি চোখে তাকিয়ে রইলো।বিমুগ্ধ হেসে উঠে পিঠ চাপড়ে বলল,’ আরে ভাই আমি আপনাদেরই দলের।চিন্তা করবেন না।কি করতে যেন চাচ্ছেন?’
বেশ আগ্রহীত শুনালো কন্ঠটি।নীহারিকা দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।বিমুগ্ধ পিঠে হাত রেখে বন্ধুর মত করে বলল,’ গাছের মালিক আপনাকে আম নিজের হাতে দিলে বেশি আনন্দ হবে, না কি গাছ থেকে পেড়ে খেতে??কোনটা সহজ ভাই?’
তারা ভাবলো এ মনে হয় মাতাল হবে।তাল মিলিয়ে হেসে উঠে বলল,’ মালিক দিলে।’
‘ তাইলে জোর জবরদস্তি করেন ক্যান ভাই।জোর করে কিছু করলে আপনাদেরই কষ্ট।কালকে শুধু শুধু হেড লাইন হবেন।সেটা বড় কথা নয়।হেড লাইন হলেই যে আপনার আমার ফাঁসি হবে না সেটা আমি আপনি এবং উনিও জানেন।কিন্তু কিছু দিন দেশের অতীব মাত্রায় প্রতিবাদী জনগন আপনার আমার ছবি ফেসবুক নামের সেই বইয়ে কেঁটে ছিড়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা করবে।ব্যাপারটা খুবই বিশ্রী হবে তাই না?’
একটা ছেলে ক্ষেপে বলল,’ এই ছ্যামড়া কে রে তুই?জ্ঞান দিতে আইছস?’
বিমুগ্ধ দু’গালে দু’হাত রেখে বলল,তওবা তওবা ভাই কি যে বলেন।জ্ঞান দিতে হলে প্রয়োজন জ্ঞানের।আমি জ্ঞান শূন্য পথিক।ভাই আপনি না কয়েক দিন আগে বিয়ে করেছেন? তারপরও রাস্তা ঘাটে এসব করে বেড়ান। বউ কিছু বলে না?
একটু অবাক হওয়া কন্ঠে বিমুগ্ধ বলল।হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটি।বিড়বিড় করে বলল,’এই হালা জানলো কেমনে?’থেমে একটু জোড়েই বলল,’ জানলি কেমনে?’
‘ ম্যাজিক ভাই ম্যাজিক।ওটা একটু পাড়ি এই আর কি।’
মুচকি হাসলো বিমুগ্ধ।নীহারিকা এখন অবাক হচ্ছে না।এই ছেলে যদি তাকে মেরে পুতে পাশের জঙ্গলে ফেলে দেয় তাও সে অবাক হবে না।সব মনে হবে স্বাভাবিক।লোকটি সরে গেলো।আর একজন ধাক্কা দিয়ে বলল,’ কে বে হালা তুই?ডিস্টার্ব করছ ক্যান?’
‘ ডিস্টার্ব মানে কি ভাই?’ অবুঝের মত জানতে চাইলো বিমুগ্ধ।’
ছেলেটি কিছু বললো না।হাত ধরতে গেলো নীহারিকার।কাছে যাওয়ার আগেই খপ করে বিমুগ্ধ ধরে বসে বলল,’ হাত না।মেয়েরা না বললে নাই হয়।এটাকে হ্যা করার বৃথা চেষ্টা করে ফল কি হয় জানেন?ফল খুবই খারাপ।সারা জীবন ঘাড় মটকায় বসে বসে।আচ্ছা শুনুন ভাই জোড় করে এসব মজা নিয়ে তো আনন্দ পাওয়া যায় না।তার চেয়ে ভালো অফার আছে আমার কাছে।সবার জন্য ভালো হবে।সাথে মজা আনন্দ ফ্রী।’একজন আগ্রহ দেখিয়ে বলল,’ কি জলদি ক?’
‘ মিস ক্ষেপা মহিলাই নিজের ইচ্ছায় আপনাদের আনন্দের ব্যবস্থা করে দিবে।’
শুকনো কাশি দিয়ে উঠে নীহারিকা।ভয়ে হাত পা কাঁপছে এবার।কি বলছে এই পাগলের ডাক্তার?মাথা আছে?একজন উঠে হাসতে লাগলো।বলল,’ কোন মেয়ে বুঝি নিজের ইচ্ছায়এমন উদার হয়?’
‘ আরে উনি অনেক উদার।’
‘ তুই আগে থেকে চিনিস?’
‘ আরে না উনি যে বিবাহিত,আপনার যে দুইটা প্রেমিকা আছে,আর আপনার বাপ যে আপনার মাকে ছেড়ে অন্য নারী নিয়া আপনার মায়ের সাথেই থাকে,আপনার যে চাকরী হচ্ছে না,আর আপনার বোন যে আপনারই এক বন্ধুর সাথে প্রেমে লিপ্ত এসব আমি যেভাবে জানি ঠিক সেভাবেই বুঝেছি।’
চরম হতভম্ভ হয়ে সবাই তাকিয়ে রইলো।বিমুগ্ধ স্বাভাবিক।উত্তেজিত হয়ে এক জন বলল,’ আমার কিছু জানছ না?’
‘ আপনার বাবা মারা গিয়েছে।মা কাজ করে খায়।চাচা শরীরিক অত্যাচার করে।ছোট থেকে দেখে দেখে বড় হয়েছেন।সেই ভাবেই এসব বন্ধু পাঁকিয়েছেন।দু’বছর আগে এক মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।মদের নেশায় মেয়ে হারিয়েছেন।তার বিয়ে হয়ে গেছে আপনি আবার মদের নেশায় ডুব দিয়েছেন।আর রাস্তা ঘাটে নারীদের উত্যক্ত করছেন।’
এবার সবার মাঝে ভয় কাজ করছে।কিভাবে জানলো সব?ভাবতে ভাবতেই ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কপাল,গলা বেয়ে।বিমুগ্ধ মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।তাদের মাঝে একটা ছেলে বলল,’ তুই যখন সবই জানছ তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানা হয়ে গেছে যে তুই খুব মার খাবি আমাদের সবার হাতে?ওই সব ধর শালারে।’
হাতা গুঁটিয়ে নিয়ে সবাই এগিয়ে আসার আগেই বিমুগ্ধ হেসে উঠে দু’পকেটে হাত রেখে বলল,’ আমি এটাও জানি যে কেউ আমাকে মারবেন না।পাশেই এক হোটেলে পুলিশের রেট পড়েছে।পুলিশ আশেপাশেই আছে শোরগোল হবে শুধু শুধু ফেঁসে যাবেন ভাই।আমি তো আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী।’
একজন আর একজনের দিকে চেয়ে রইলো অনেক্ষণ।সবার মুখটা চুপসানো।একজন উঠে আগ্রহীত কন্ঠে জানতে চাইলো,’ তুই কি বলতে চাস সোজা সোজি বল।’
বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে তাকালো।সে নির্বাক-নিস্পন্দকাঠের মত আড়ষ্ট হয়ে একস্থানে একভাবে দাঁড়িয়ে আছে।বিমুগ্ধ মুখের উপরে হাত নাড়িয়ে বলল,’ দাঁড়িয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছেন?’
নীহারিরা সহজ ভাবে বলল,’ ফালতু বকবেন না।’
কন্ঠ সহজ হলেও গলার কাঁপন ধরতে পেরে বিমুগ্ধ হাসলো কিছুক্ষণ।তারপর একটু আয়েশ করে অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,’ মিস ক্ষেপা মহিলা অত্যধিক বড় লোক বুঝলেন।অনেক টাকা আছে।সব জমানো।সে আপনাদের টাকা দিয়ে দিবে।আপনারা সবাই না হয় আলাদা আলাদা মেয়ে নিয়ে আনন্দ করে আসবেন।’
নীহারিকা ফোড়ন কাটলো,’ কোথা থেকে?’
চোখ বাঁকিয়ে একবার তাকালো বিমুগ্ধ।চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে মনে মনে নীহারিকার বোকামি দেখে হাসছে।মুখে বলল,’ বাংলাদেশে টাকা বিলি করলে অনেক মেয়ে পাওয়া যায়। তাদের কাজই উনাদের মত মানুষকে বিনোদন দেওয়া। অনেক পছন্দের মেয়ে পাবেন।জোর করতে হবে না।টিভির হেড লাইন হবেন না।পুলিশ ধরে টানা টানি করবে না।ফেসবুকে অতিমাত্রায় দুই দিনের প্রতিবাদে নিজেদের ফেমাস করতে হবে না।তারাও টানা হেচড়া করবে না।পরিশ্রম কম আনন্দ বেশি কি বলেন ভাইয়েরা?’
সবার মনে হয় পছন্দ হয়েছে।বিমুগ্ধ নীহারিকাকে জিজ্ঞেস না করেই তার ব্যাগ টেনে নিয়ে নেয়।ব্যাগ খুঁজে গোটাগোটা কিছু টাকা বের করে নিয়ে তাদের দিয়ে বলল,’ সব আপনাদের ভাই।মজা আনন্দ নিয়ে ভালো থাকুন।আজকের রাত হয়ে উঠুক আনন্দে পরিপূর্ণ।’
সবাই টাকা হাতে নিয়ে পিছনে ফিরে কিছু আলাপ করল নিজেদের মধ্যে। বিমুগ্ধ খপ করে হাত ধরে নীহারিকার। চমকে উঠে সে।বিমুগ্ধ দৌড়ে সেই জায়গা দ্রুত ত্যাগ করে।ছেলেগুলোর মাঝের একজন বলল,’ ভাই আমার পছন্দের মাইয়ার তো এহনো বিয়া হয় নাই?হে কইলো যে?’
‘ বলদ তখন হ হ করলি কা?কই গেলো দুইজন?’
পিছনে তাকিয়ে তারা কাউকেই দেখলো না। বুঝাগেল বিমুগ্ধ তার বুদ্ধি দিয়ে সবাইকে ব্যস্ত রেখছে। যাতে পালানো সহজ হয়। তাছাড়া তার বলা কিছু বাক্য সত্য ছিল। তাই তারা সহজে গুলিয়ে গেল।
______________
নীহারিকা অত্যন্ত রাগ প্রকাশ করে বলল,আপনি সব টাকা দিয়ে দিলেন কেন?’
দু’হাঁটুতে ভর দিয়ে শ্বাস ছাড়ে বিমুগ্ধ।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের পাশে বেয়ে পড়া ঘাম গড়িয়ে পড়া থেকে বাঁচিয়ে হাতের পিঠে অবস্থান করিয়ে থামিয়ে দেয় সে।ফস করে নিঃশ্বাস নিয়ে সে মুখ তুলে ফিচেল হাসি হাসলো।নীহারিকা ক্ষেপে ভ্রু উপরে তুলে বলল,’ একদম হাসবেন না।অসহ্য লাগে আপনার হাসি।’

বিমুগ্ধ তবুও হাসলো।নীহারিকা কষ্টে দুঃখে রাস্তার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো।বিড়বিড় করে সে বিমুগ্ধকে কিছু অকথ্য ভাষা শুনিয়ে দিয়েছে।বিমুগ্ধ পাশে বসতেই কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,’আমার ইচ্ছে করছে আপনার গালে কষিয়ে এক চড় মারি।আমি বাড়ি যাবো কিভাবে?সব টাকা দিয়ে দিলেন?কেন?কেন?’ নীহারিকা কপালে হাত ঠেকিয়ে হাঁটুতে হাতের কনুই ভর দিয়ে কেঁদে দিলো।বিমুগ্ধ হাসি চাপছে।ঠিক বুঝতে পারছে নীহারিকা।লোকটি কিভাবে এত হাসতে পারে?কিভাবে?বিমুগ্ধ পিছনে দু’হাত রেখে বলল,’আকাশ কালো বৃষ্টি হবে।’
একটু থেমে বলল,’ টাকা বড় না নিজের সম্মান বড়?রেপ হতে ভালো লাগতো আপনার?তাহলে চলুন নিয়ে যাই।টাকা বাঁচাই।’
নীহারিকা থমকায়।এতসময় তো এতো বড় একটা কথা তার মাথায় আসেনি।বাড়ি না হয় সে হেঁটে যাবে কিন্তু চরিত্র!অত্যধিক কৃতজ্ঞতায় চোখের পাপঁড়ি উপর করে সে বিমুগ্ধের ঘামে ভেঁজে উজ্জ্বল চিকচিক করা জলে ঢাকা মুখমন্ডলের দিকে তাকালো।শ্রদ্ধা,সম্মান,ভালো লাগায় হৃদয়ের প্রতিটি কানা ভর্তি হয়ে উঠেছে মানুষটার প্রতি।এত ভালো মানুষ হয়?নীহারিকা অপলক তাকিয়ে হারিয়ে গেলো একটি আলাদা জগতে।বিমুগ্ধ গলা ছেড়ে বলল,’ মিস ক্ষেপা মহিলা মেঘ সরে যাচ্ছে আবার।এখন আপনি বলুন তো বৃষ্টি হবে কি না?পারলে একটি চকলেট কিনে দিবো নিজের টাকায়।অবশ্যয় সেটা হবে দশটাকার।’
গালে হাত দিয়ে নীহারিকা বিমুগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আমি চকলেট খাই না।অন্যকিছু দিলে বলবো।’
‘ চিপস চলবে??মেয়েরা এসব বেশি খায়।’
‘ আপনার কেনো এমন মনে হয়?’
‘ এদের মাঝে সব সময় একটা বাচ্চা উপুত হয়ে লুকিয়ে থাকে।’
নীহারিকা খিলখিল শব্দ তুলে হাসতে লাগলো।বিমুগ্ধ চোখ ফিরিয়ে শান্ত গভীর চোখে একবার তাকালো।মনে মনে সে ভাবলো মেয়েটি হাসতে জানে?বাহ! বিমুগ্ধ নিজেও হাসলো।নীহারিকা বলল,’ চলবে।আজ বৃষ্টি হবেই।’
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না।আমার প্রেমিকারা বলে আমার মাঝে কি যেন যাদু আছে।বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে সেই যাদু বিপক্ষের উপরে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রভাবিত হয়।’
থতমত খেয়ে নীহারিকা চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো।অস্বস্তি হচ্ছে তার।গরম লাগছে।বোরখা নিকাব খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
‘ হয়েছে এবার উঠুন।বাড়ি যাবেন না?’বিমুগ্ধ উঠে দাঁড়ালো।নীহারিকা অসহায়ের মত বলল,’ আমার কাছে তো টাকা নেই।’
‘ তো কি হয়েছে পা তো আছে।’
‘ হেঁটে যাবো?’অবাক হওয়া কন্ঠ তার।বিমুগ্ধ পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,’ হুম যাবেন।তো?
‘এতো দূর!’
‘ পৃথিবীর কিছু মানুষ পায়ে হেঁটে পৃথিবী ভ্রমন করছে।আগের যুগে হেঁটে হেঁটে হজ্জে যেত।ঢাকা একটা ব্যাপার হলো?’
‘ আপনি কিছু টাকা ধার দিলেই তো পারেন।’ বিড়বিড় করে বলল নীহারিকা।চোখ বড় বড় করে বিমুগ্ধ বলল,’ পাগল না কি?আমি মেয়েদের ধার দিনা।এরা কখনো ধারের টাকা শোধ করেনা।ছেলেটা তো দয়ার সাগর হয়।লজ্জায় মাফ করে দেয়।আমি আগেই মাফ চাই।’
নীহারিকা উঠে হাঁটা ধরে।বিমুগ্ধকে সাথে সাথে আসতে দেখে বলল,’ আপনি আমার সাথে যাচ্ছেন কেন?’
‘ সেটা আপনাকে কেন বলবো?’
‘ আচ্ছা আপনি ফিরে এসেছেন কেন?’
‘ বেশি প্রশ্ন করে দেরি করছেন কেন?হাঁটুন তো?’
‘বাকিরা কই??’
‘ আপনার শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।যাবেন শ্বশুর বাড়ি?’
নীহারিকা একটু কপাল কুঁচকালো।বুঝতে পেরেছে প্রশ্ন করা মানেই উল্টোপাল্টা উত্তর।
______________
মেঘ সরে আকাশ হঠাৎ পরিষ্কার স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে।বিমুগ্ধ হঠাৎ দেখলো আকাশে তারাও দেখা দিয়েছে।হঠাৎ একটি তারা ঝুক করে ঝলসে পড়ে এপাশ থেকে ওপাশে।চলন্ত পা জোড়া চপ করে থামিয়ে দিয়ে সে বলল,’ মিস ক্ষেপা মহিলা উইশ করুন।’
নীহারিকা ভারী অবাক হয়ে বলল,’ কি উইশ করবো?’
‘ যা খুশি।তারা পড়ছে আকাশ থেকে।’
‘ এসব ভুয়া কথা।এসব আমি মানি না।’
‘ মানেন না মানে কি?আমার আপনার বাপ দাদারা মেনে বড় হয়েছে আমরাও মানছি আপনিও মানবেন শেষ কথা।কিছু মিথ্যে জিনিস মানলে তো ক্ষতি নেই।’
নীহারিকা বিরক্ত হয়ে চোখ বুজে নেয়।এক চোখ খুলে সে দেখে খুবই আগ্রহ নিয়ে বিমুগ্ধ মুনাজাতের মত করে কিছু পড়ে নিচ্ছে।পশ্চিমে তার মুখ।চোখ তার উপরে আকাশের দিকে।নীহারিকা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বলল,’ আপনি মুসলিম?’
‘ কোন দিক থেকে অন্যধর্মের মনে হচ্ছে?’
‘ না এমনেই বললাম।’
নিজেই লজ্জা পেয়ে বসে সে।মনে মনে সে কিছুই চাইলো না।শুধু তাকিয়ে রইলো লুকিয়ে।বিমুগ্ধের চিন্তামুক্ত সাধারণ মুখশ্রীর দিকে।চিপস টা মনে হয় আর খাওয়া হবে না।কিপটে লোক থেকে দশটাকা মারা মানে অনেক কিছু।কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি।
চাঁদের আলোর তলদেশ বয়ে হাঁটছে এক’জোড়া মানুষ।কেউ কথা বলছে না।নিস্তবন্ধ হয়ে আছে পরিবেশ।প্রকৃতি।পায়ের শব্দ হচ্ছে তাদের।মানুষটা কি আবার জুতো খুলে নিয়েছে?তাকালো পায়ের দিকে নীহারিকা।না খুলেনি।নিজের কান্ড দেখে হাসলো কিছুক্ষণ।হঠাৎ মেঘেরা কোথা থেকে যেন উড়ে আসে।জুড়ে বসে আকাশে।চাঁদের বুকে।শরীর অন্ধকার করে।একয়েক মুহূর্ত সময় না দিয়েই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করে।নীহারিকা অসহ্য এক চিৎকার দিয়ে ছুঁটে পাশে চলে আসে।বিমুগ্ধ আসে না।পানি গায়ে মাখিয়ে সে মাখনের মত লেপ্টে যাচ্ছে জলরাশির সাথে।দু’হাত সামনে নিয়ে এসে কোষের মত করে সে নিজের চুল গুলো পিছনে ঠেলে দেয়।নীহারিকা চেঁচিয়ে বলে উঠে,’ ভিঁজে যাচ্ছেন তো?’
বিমুগ্ধ ভিঁজতে ভিঁজতে বলল,’ আমি ভিঁজতে পছন্দ করি।’
এই প্রথম কোন ছেলে মেয়ের চেয়েও বেশি বৃষ্টির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে দেখে নীহারিকা অবাক।সে মেয়ে হয়ে বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না।একদম ভালো লাগে না তার।বৃষ্টি মানে বিষন্নতা।সবদিকে দুঃখরা পানির নেয় ছড়িয়ে পড়ে।বিরক্তিকর অনুভুতি।দু’হাতে নিজেকে বাঁচিয়ে নীহারিকা আরো পাশে সরতে থাকে।বিমুগ্ধ হেসে বলল,’ আপনি তো দেখছি মেয়েদের নাম ডুবাবেন।’
‘ কেন?’ চোখ তুলে বললো নীহারিকা।
‘ বৃষ্টি মানেই মেয়েদের পাগলামি।আপনি তো সহ্যই করতে পারছেন না।’
‘ পাগলামির মত কিছু দেখছি না।সবই তো পানি।’
‘ এটা অনুভব করার বিষয়।আপনার অনুভুতিরা কাজ করে কম।’বিমুগ্ধ এসে দাঁড়ায় পাশে।নীহারিকার কেমন যেন অস্বস্তিতে শরীর কাঁটা দিচ্ছে।ভাঁজা শরীরে সে একটি স্বল্প পরিচিত পুরুষের সামনে!বিমুগ্ধ বলল,’ ওখানে বসুন।’
নীহারিকা পাশে তাকায়।একটি ছনের ছাউনি।চারপাশ খোলা।বসতে হবে নিচে।এছাড়া উপায় নেই।নীহারিকা দ্রুত ছুঁটে যায়।সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপে।বিমুগ্ধ পাশে দাঁড়িয়ে বলল,’ পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা প্রানী মেয়েরা।’
চোখ ফিরিয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনার চোখে মেয়েরাই খারাপ সে আমি জানি।’
‘ কারণ ছাড়া বলছি না।মেয়েরা নিজেদের সম্মান নিজেরা কমায়।যেখানে এদেরকে সৃষ্টিকর্তা সবচেয়ে উপরের স্থান দিয়েছে,আর এরা কিনা নিজেদের নামিয়ে পুরুষের সমান আসতে চায়।বেশি স্বাধীনতা ভালো নয়।পুরুষ নারী আলাদা সত্ত্বা।এটা মানতেই হবে।তাই আমি বলবো একা আর কখনো বের হবেন না।পৃথিবীটা একটা রুমের ভেতরে থেকে যতটা সহজ মনে হয় মাঝ রাস্তায় দাঁড়ালে ততোটাই গোলমেলে ভয়ংকর মনে হবে।আপনার সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানেন?’ নীহারিকা বলল,’ কি?’
‘ আপনি মন খুলে কথা বলতে পারেন না।বাবাকে যদি বলতেন আপনি বিয়ে করতে চান না আপনার বাবা আপনাকে কখনোই বিয়ে দিতো না।শুধু শুধু পাগলামিটা করলেন।’
‘ আপনি সব জানেন কিভাবে?’ বিমুগ্ধ হাসতে শুরু করলো।নীহারিকা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।মানুষটা কি সত্যি ম্যাজিক জানে।ম্যাজিক করে কি সব জেনে নিতে পারে?তাহলে সে কি ধরতে পেরেছে তার মনে এক অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে মানুষটার জন্য?বিমুগ্ধ বলল,’ আপনি যতটা ভালো আমাকে ভাবছেন আমি কিন্তু ভালো নই।আপনার দুই একটা উপকার করেছি আপনি বরফ থেকে পানি হয়ে গিয়েছেন।মেয়েরা এমনই।এসব অনুভুতি নিয়ে ভাবা বন্ধ করুন।’

দু’জনে বসে পড়লো নিচে।বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণ থামছে না।বিমুগ্ধ নিজের কথায় যেন নীহারিকাকে আরো বিমুগ্ধ করে তুলছে।কতক্ষণ বসে থাকবে তারা?সে জানে না।শুধু মনে মনে চাইছে এই সময় থেমে যাক।পৃথিবী থমকে যাক।বুকের শব্দ গুলো আরো বাজুক।এলোমেলো বৃষ্টি এসে শরীরে আঁছড়ে পড়ুক।তবুও মানুষটা পাশে থাকুক।একদম পাশে।এই অনুভুতির নাম জানা নেই নীহারিকার।তার সব ভালো লাগছে।সুখ সুখ অনুভুতি হচ্ছে।এতো এতো প্রিয় হয়ে উঠেছে এই সুখ,যে সে কখনো এই প্রিয় সুখ ছেড়ে যেতে চাইছে না।মানুষটার মাঝে সত্যি ম্যাজিক আছে।পাগল করে অনুভুতিতে মিশিয়ে নিজেকে বিলিন করার ম্যাজিক।বিমুগ্ধ বিমোহিত একটি কাজ করে বসলো।নীহারিকার পা টা সে হাতে তুলে নিলো।চোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছিলো পাঁপড়ি জড়ানো পানি।চমকে উঠে দ্রুত পা সরিয়ে নিতে চায় সে।বিমুগ্ধ পকেট থেকে ভেঁজা রুমাল বের করে বলল,’ সামান্য কেঁটেছে তবুও কাপড় পেঁচিয়ে দিচ্ছি।মেয়েদের বিশ্বাস নেই হতে পারে বাড়ি গিয়ে কেইস করে দিবেন।তাতে লিখবেন,এ’কদা আমি নিজের বিবাহ থেকে পালাইবার সময় ট্রেনে এক অসভ্য,বেয়াদপ,পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হইয়া ছিলো।অলক্ষী আমি ট্রেনে উঠেয়াছি বলিয়া ট্রেন বাবাজি থামিয়া গেলো।সেই পুরুষ আমাকে মোটেও সাহায্য করিতে চাইলো না।তবুও আমি লেজ গুঁটিয়া তাহার সঙ্গে তাহার মুসিবত হইয়া হাঁটা ধরিলাম।হোটেলে নিয়া আসিয়া সে আমাকে টি-টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা মারিয়া ফেলাইয়া পায়ে জখম করিয়াছে।আমি আইনের কাছে বিচার চাইবার জন্যে আসিয়াছি।আমি তার ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি।তা না হলে আমি ফেসবুকে তুমুল ঝড়তুলিতে বাধ্য হইবো।
ইতি, মিস ক্ষেপা মহিলা।
ও তখন তো আপনি নিজের পুরো নাম দিবেন।আপনার নাম জেনো কি?’
মানুষটা নামও জানেনা।নীহারিকার মনটা বড্ড কষ্টে ব্যথিত হয়ে উঠে।একটা অভিমান করে বসে সে।পা টানতে নিয়ে দেখে পায়ে রুমাল বাঁধা শেষ।বিমুগ্ধ হেসে উঠে বলল,’ মিস ক্ষেপা মহিলা আবার ক্ষেপেছে।’
নীহারিকার আর রাগ হলো না।সে ডান হাতের দু’টি ভিঁজে আঙ্গুল বার বার নিজের গায়ে মুখে শুকিয়ে নিয়ে ছুঁয়ে দেয় রুমাল।নীহারিকার দম বন্ধ এক অনুভুতি হচ্ছে।নিঃশ্বাস নেই।বুক কাঁপছে।শব্দ হচ্ছে।এই মানুষটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় কেন মনে হচ্ছে?আবেগে আপ্লুত হয়ে নীহারিকা অনেক সময় পরে বলল,’ আমার না আপনার সাথে সারাটা জীবন থাকতে ইচ্ছে করছে।’
এতো উদ্ভট কথাটাও বিমুগ্ধকে কিঞ্চিত চমকাতে পারেনি।সে যেন সব জানে।এমন একটা ভাব নিয়ে সে বলল,’ শুধু ভাবুন তো মাত্র কয়েকঘন্টার পরিচিত একটি ব্যক্তির উপকার পেয়ে আপনি তার সাথে সারা জীবন থাকতে চাইছেন।অথচ যাদের উপকারে,ভালোবাসায় আপনি এত সুন্দর একটি মানুষ হয়ে উঠেছেন তাদের ফেলে চলে এলেন।আপনার মনে হচ্ছে না আপনি সুযোগ পেলে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন?’
বিস্মৃত হয়ে তাকিয়ে রইলো নীহারিকা।সত্যি তো?তার বাবা মা তাকে কত ভালোবাসা দিয়েছে আর সে কিনা তাদের ফেলে চলে এসেছে।তাকে না পেয়ে তাদের অবস্থা কি হবে সে ভাবেনি?নীহারিকার মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে।নিজেকে খুব নিচু মনের খারাপ মেয়ে মনে হচ্ছে।সে কেঁদেই দিলো।বলল,’ আমি খুব বাজে মেয়ে তাই না?’বিমুগ্ধ চুপ করে রইলো।কিছু বললো না সে।তাহলে কি সত্যি সে খারাপ?
‘ আপনি সামান্য উপকারে এতো বিমোহিত হয়ে পড়লেন যে সারা জীবন থাকতে চাইছেন।তাহলে তো আপনার উচিৎ আপনার বাবা মায়ের সাথে জান্নাত,স্বর্গ সব জায়গায় এক সাথে থাকা।’
নীহারিকা ভুল তো আগেই বুঝেছে।এখন সে অনুশোচনায় দগ্ধ।বিমুগ্ধ হেসে পরিবেশ স্বাভাবিক করে বলল,’ মিস ক্ষেপা মহিলা দেখি কাঁদছেও?এটা ছাড়া আপনারা আর কিছু করতে পারেন না?গরু একটা।’
নীহারিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে।সত্যি সে গরু।কয়েক মুহূর্ত নিরব থেকে নীহারিকা বলল,’ আপনার পরিবারে কে কে আছে?’ ‘ কেন কেন?এই ভুলেও আমার মায়ের দিকে যাবেন না।তাকে ভুলানো সহজ না।’
‘ ভুলাতে যাবো কেন?’
‘ কারণ আপনার তো তার ছেলেকে মনে ধরেছে!’ বিমুগ্ধ চোখ টিপ মারে।নীহারিকা মুখ বিকৃত করে বলল,’ ধ্যৎ আমি কি পাগল যে আপনার মত পাগলের ডাক্তারকে পছন্দ করবো?’
‘ হুম হুম বুঝি বুঝি।’
বিমুগ্ধ রসিকতা করছে।নীহারিকা হাসলো।চোখে সে হাসি প্রকাশ পেলো।এই প্রথম মন থেকে হাসছে যেন।বিমুগ্ধ চোখ ফিরিয়ে নিতে চেয়ে আবার তাকালো।দু’টি চোখই তো।কত কি বলে!নীহারিকা বুকে হাত রেখে বলল,’ আমার কেমন যেন অনুভুতি হচ্ছে?আপনার কথা ভালো লাগছে।হাসি ভালো লাগছে।বিরক্তিকর সব ব্যাপার ভালো লাগছে।আপনার সাথে বসে থাকতে ভালো লাগছে।এতো ভালো লাগছে কেন??আমি কি মরে যাবো?আপনি তো ডাক্তার।মনের ডাক্তার।বলুন তো।’ বিমুগ্ধ শ্বাস ফেলে বলল,’ আপনি তো দেখছি প্রেম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মিস ক্ষেপা মহিলা?
নাকচ করে নীহারিকা বলল,’ যতসব ফালতু কথা।আপনি প্রেম ছাড়া কিছু বুঝেন না?’
‘ আর কি বুঝবো?প্রেমই তো সব।’
‘ কিভাবে সব??’
‘ পরে কখনো বলবো।’
‘ আমাদের আবার দেখা হবে?’
‘ বলতে পারছি না।যদি হুট করে দেখা হয়ে যায়।তখন তো আপনি আমাকে চিনবেন না।সাথে তখন বাচ্চা কাচ্চাও থাকতে পারে।আমি নিজেই না হয় তখন হুট করে সামনে এসে চোখের দিকে তাকিয়ে বলবো,এই যে মিস ক্ষেপা মহিলা আপনি যানতে চেয়েছিলেন না প্রেম কিভাবে সব সেটা এখন বলবো।বাচ্চাটাকে একটু চুপ করাবেন?’
নীহারিকা হাসতে লাগলো।সময় পেরিয়ে যেতে লাগলো।কথার আশর জমিয়ে দিলো বিমুগ্ধ।মানুষটা সব পারে।সবচেয়ে বেশি পারে মনের কথা বুঝতে।সাথে মনকে ঘুরিয়ে দেওয়ার আসীম ক্ষমতা আছে তার।একদম আসীম!
_________________
বাসটা এসে থামে স্টেশনে।ঝক করে থামায় নীহারিকা ঝুঁকে পড়ে বুকে।বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকায়।মেয়েরা কেন জানালার সিট-টা চায়?কেনই বা পাশের মানুষটার বুকে,ঘাড়ে আছড়ে পড়ে?মাথাটা সরিয়ে দিতে চেয়েও সে দিলো না।মেয়েটা অনেক কষ্টে সেদিকে চেপে বসেছিলো।ঘুমের ঘোরে পড়েছে এসে বুক পকেটে।একটু না হয় থাকুক।জাত ক্ষতিতে পড়বে না তো আর।

নীহারিকার ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা বুক পকেটের উপরে।ছ্যাৎ করে মাথায় খেলে যায় সব।দ্রুত উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করে দু’টি তীক্ষ্ন চোখের সামনে।স্যরি বলে উঠে পাশে বসে সে দেখে আশেপাশের সব সিট খালি।শুধু তারা দু’জন।একজন এসে বলল,’ ভাই আর কতক্ষণ থাকবেন।’
বিমুগ্ধ বলল,’ মহিলাদের তো চিনেন ভাই।এরা জীবনের সব কিছুতেই সময় ব্যয় করে।এই যে উনি উঠেছে এখনই নামবো।’
নীহারিকা কাঁচুমাঁচু করে বলল,’ কত সময় হয়েছে?আমরা কি ঢাকা চলে এসেছি?’
‘ ইয়েস ঢাকায় আপনি।এসেছেন বেশি না ১ঘন্টা ২৭ মিনিট হয়েছে মাত্র।’
অবাক হয়ে নীহারিকা বলল,’ আমায় ডাকেন নি কেন?’
বিমুগ্ধ দ্বিগুণ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,’ ডাকিনি মানে?হাজার বার ডেকেছি।শুধু গায়ে হাত দিয়ে ডাকা বাকি ছিলো।’ নীহারিকা অবাক হলো।এক ডাকে উঠে যাওয়া মেয়ে সে।হয় তো অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছে তাই এমন হয়েছে।সে দ্রুত নামতে চাইলো।বিমুগ্ধ জায়গা করে দিলো।দুজনেই একসাথে নিচে নেমে আসলো।নীহারিকা প্রশ্ন করলো,’আপনিও যাবেন আমার বাসায়?’
‘ পাগলা কুত্তা কামড়িয়েছে আমাকে?বিপদে পড়তে যাবো শুধু শুধু।’
‘ বিপদে কেন পড়বেন?’
‘ কারণ আপনার বাপ মা আমাকে আপনার প্রেমিক মনে করে যদি বিয়ে পড়িয়ে দেয়?আমি প্রচন্ড বুদ্ধিমান ছেলে বুঝেছেন মিস ক্ষেপা।’
নীহারিকা হাসলো।একটি রিক্সা ডেকে দিলো বিমুগ্ধ।কিন্তু ভাড়া না দিয়ে বলল,’ ভাড়া কে দিবে জানি না।আপনার থেকে আমি প্রায় ৯০০টাকা পাই।’
ওহ দাঁড়ান।বিমুগ্ধ ছুঁটে দোকানে যায়।একটি পটেটো চিপস হাতে দিয়ে বলল,’ এটা আপনার পাওনা শোধ করলাম।আমারটা দেখা হলেই যেন শোধ করেন।তা না হলে কেইস করবো।বলে দিলাম।’ নীহারিকা কিছু বললো না।সে শুধু তাকিয়ে রইলো।বিমুগ্ধ বাসের টিকিট নিয়ে আবার সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে বলে বাসের সামনে এসে দাঁড়ায়।নীহারিকা এখনো রিক্সায় বসে আছে।চাচাকে সে বলেছে অপেক্ষা করতে।ভাড়া বেশি দিবে।তিনিও অপেক্ষা করছে।সে নেমে পড়লো।বিমুগ্ধকে বাসের প্রথম সিঁড়িতে দেখে নীহারিকা বলল,’ আমি রিক্সা ভাড়া দিবো কিভাবে?সবটাকা তো দিয়ে দিয়েছেন।!
বিমুগ্ধ মুখ ফিরিয়ে তাকালো।নীহারিকা ভেবেছে বিমুগ্ধ চমকে যাবে তাকে দেখে।কিন্তু এবারো সে চমকালো না।নেমে এসে বলল,’ বাসায় যাবেন।কাঠের চেয়ারে নিশ্চয়ই বাবা বসে থাকবে।হুট করে ঢুকে বাবার বুক পকেট থেকে খপ করে হাত দিয়ে টাকা নিয়ে নিবেন।রিক্সা ভাড়ার বাহিরেও অনেক টাকা থাকবে।ওসব আপনি নিজের নামে করে নিবেন।মেয়েকে পাওয়ার বিনিময়ে আপনার বাবা নিজের দুনিয়া দারি দিয়ে দিতে পারবে তখন।সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে পারেন।বুদ্ধি ফ্রীতে দি না।পরের বার দেখা হলে ১০০টাকা বেশি দিবেন।মোট একহাজার টাকা।ইংরেজিতে ওয়ান থাউজেন্ড ম্যানি।’
বিমুগ্ধ গাড়িতে উঠে বসে।নীহারিকা তাকিয়ে থাকে।চোখে তার কাতরতা।মানুষটার কোন ভাব নেই কেন?সে কেন তার প্রতি অনুভুতি অনুভব করতে পারছে না।যে প্রিয় সুখ সে পেয়েছিলো তা কেন মানুষটা ফিল করতে পারেনি?কেন?কষ্টে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে।খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।ঠোঁট কাঁপিয়ে নাক জ্বালিয়ে সে কেঁদে দিলো।গাড়িটি চলে যেতে লাগলো।জানালা দিয়ে মুখ বের করে মানুষটা বিজলির বেগে হেসে হৃদয় কাঁপিয়ে তুলে বলে উঠলো,’প্রিয় জিনিস ছাড়া বাঁচা যায়।কিন্তু প্রিয় সুখ ছাড়া?জীবন বড্ড তেঁতো হয়ে যায়।বাঁচার মত বাঁচতে হলে প্রয়োজন প্রিয় সুখ।সেই সুখ অপেক্ষা করছে বাড়িতে প্রিয় মানুষের ভীরে।ভালো থাকবেন মিস ক্ষেপা মহিলা।’
হৃদয়ের এক অব্যক্ত ব্যথা নাড়িয়ে দিয়ে গাড়িটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।নীহারিকা এখনো তাকিয়ে আছে।কি কষ্ট!এতো কষ্ট কেন হচ্ছে!মানুষটা তার জীবনে কতটুকু জায়গা পেয়েছে?মনে হয় একটু বেশি।না কি পুরোটুকু?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে এক বুক কষ্ট চেপে বিক্সায় উঠে বসে।রিক্সা চলে।মৃদূ হাওয়া দোল খায়।নীহারিকা নিজের শরীর থেকে অনুভুতিতে জর্জরিত হওয়ার মত ঘ্রাণ পায়।কারো শরীরের মিশ্র সুবাস।এক ধাক্কায় সে যেন আরো তলিয়ে যায়।অতল সাগরের গহ্বরে।মনে মনে সে কান্নায় আটকে আশা গলায় আওড়ায়,আমার প্রিয় সুখ গুলোর ভীরে হঠাৎ হওয়ার বেগে আপনিও যে যোগ হয়ে গেলেন!
__________
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..