প্রিয় সুখ পর্ব-১১

0
13

প্রিয় সুখ-১১
_______________
পাখিটি ঝুঁকে বসে জানালার দুই শিকের মাঝের উন্মুক্ত জায়গা জুড়ে। সূর্যের প্রথম শুভ্র কিরণ এসে গায়ে লেপ্টে পড়ছে তার।কালো সোনালি রংটি উজ্জ্বল হয়ে উঁকি দিয়ে উঠছে সৌন্দর্যের মহিমায়। এত রূপবতী কেন পাখিটি?মিতু আপুর ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল সকাল। অনেক সময় নিয়ে বিছানার এপাশ ওপাশ গড়িয়ে তিনি চক্ষুনিদ্রার অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। নিদ্রা বড় নিষ্ঠুর। কাজলের মত সহজেই মিশে যায় না চোখের সাথে। ধীরে ধীরে চোরের মত এসে জেকে বসে। একবার ছুঁটেছে তো আর আসার নাম নেই।উঁপুত হয়ে পিঠ ঝুঁকিয়ে মিতু আপু শালিকের রূপের রহস্য উদঘাটন করছিল। ফুঁ ছড়ানো বাতাসে জানালার দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সে খুব সাবধানে উঠে অত্যন্ত শান্ত ভাবে জানালা ঠেলে দিলেন। আবার এসে শান্ত হয়ে বসলেন।চোখ রাখলেন জানালার দিকে। পলকহীন তাকিয়ে রইলেন শালিকের দিকে।মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন দূরের জঙ্গলের দিকে।দূর থেকে মৃদু কলকল শব্দ। তারপর আবার পুরাতন রুমটি নতুন চোখে দেখছেন। রুম জুড়ে একটি আলমারি রয়েছে। একটি টেবিল।দূর্বল চেয়ার। আর,আর মিতু আপু রুম দেখা বন্ধ করে দিলেন। নীহারিকার মুখের কাছে এসে থামলেন। হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে পড়লেন। গাঢ় কন্ঠে থেমে থেমে বললেন,’ নীহু শুন, তোকে একটা কথা বলি।জীবনে প্রেমে পড়তে জাসনে। প্রেম হচ্ছে জঘন্য পীড়া।’
নীহারিকা ঘুমে বিভোর। তার খবর নেই। মুখের উপরে তার এঁকেবেঁকে পড়ে আছে দীর্ঘ কালো চুল। গলার পাশ ভিঁজে চুপচুপ। গরম পড়ছে খুব। সে ঘামছে। শান্ত মুখশ্রী। মায়ার আখড়া একটা। মিতু আপু একদম ঘুরে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকার দিকে। অত্যন্ত নরম গলায় বললেন,’ আমি ফাবিহাকে কখনো প্রেম করতে দিব না নীহু। ও তো আমার কাছে থাকে। সাবধান করতে পারি। কিন্তু তুই! তুই তো অনেক দূরে থাকিস। তাই বলছি প্রেম করবি না। বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকেও বিয়ে করবি না। যদি কাউকে ভালো লেগে বসে তখন সোজা বলবি.’
মিতু আপু চুপ করে কিছুসময় ভাবলেন। তারপর কপালের উপরে দীর্ঘ আকারের তিন টুকরো ভাঁজ বিছিয়ে বললেন,’বলবি যদি বিয়ে করতে চাও তাহলে চলো বিয়ে করে নি। তারপর প্রেম করব। কারণ প্রেমের ভরসা নেই।দেখা গেল তোদের কপাল হবে আমার মত। প্রেম করবি একজনের সাথে। বিয়ে করবি আর একজনকে।’
মিতু আপু কপালে হাত রেখে হেসে উঠলেন। আহ, কষ্টকর জীবন তার। এত এত হাসি, সাজের মাঝেই কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। আবার সাজতে হবে। খুব সাজবে।এত এত সাজবে যে কেউ ধরতেই পারবে না। মিতু আপুরও যে কষ্ট হয়! বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়েন মিতু আপু। ফ্যাঁসফ্যাঁস কন্ঠে নীহারিকার কানের কাছে বললেন,’প্রেম হচ্ছে বৃষ্টির মত। প্রথমে যখন শুরু হবে।মনে হবে দুনিয়া সুখের। আনন্দের, ভালোবাসা ভালো লাগার খেলা। ইচ্ছে করবে ছুঁটে সেই বৃষ্টিতে নিজেকে ভিঁজিয়ে দিতে। রঙ্গে রঙ্গীন হয়ে ভাসতে। বিন্দু বিন্দু ফোঁটা মনে হবে এক একটি মাতাল হাওয়া। নেশা ধরানো সুগন্ধি। কুয়াশার মত স্নিগ্ধ। সব মনে হবে কতই না মহনীয়, মন মাতানো।সুঘ্রান মনে হবে চারপাশে বাসা বেঁধেছে। নিজেকে শূন্যে অনুভব করবে। মন তখন বিড়বিড় করবে,এই সুখ যেন শেষ না হয়। বৃষ্টি যেন এভাবেই বর্ষণ হয়। প্রেমিক মানুষটাই আমার প্রিয় সুখ। দূরত্ব যেন ধরতে না পারে। বৃষ্টি যেন আমাকে ভিঁজিয়ে বেড়ায় ঠিক এভাবে।
কিন্তু বৃষ্টির থেকেই যে বন্যার সৃষ্টি। সেই বন্যায় ডুবে মরে কত মানুষ। মন তো আরও নাজুক। একে বারে ডুবে তলিয়ে যাবে রে। গভীর অতল সাগরে। সেই স্বর্গীয় সুখ আর প্রিয় থাকবে না। হয়ে উঠবে তিক্ততায় ভরা সত্য। প্রেমে পড়বি না বুঝলি।’
মিতু আপু নীহারিকার কপাল জুড়ে বাচ্চাদের মত চুমু বসিয়ে দেন। উঠে সাজের জিনিস বের করে সাজতে শুরু করলেন। ঠিক করেছেন ভয়ংকর সুন্দর করে সাজবেন।যাতে সবাই দেখে ভয় পেয়ে যায়। সুন্দর সাজ দেখে কি কেউ ভয় পায়? ভয় পাবে ভুতের মত সাজ দেখে। আচমকা ভূতুরে মুখ দেখে সেন্সলেস হয়ে পড়বে। সুন্দর সাজ দেখে তো মানুষ বিমোহীত হয়ে পড়বে। আজ বিমোহীত করলে কেমন হয়?
ঠোঁট জুড়ে লাল লিপস্টিক লাগিয়ে নেয় তিনি।

নীহারিকা মাথা তুলে তাকাতেই ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত বুকে থুথু ছিঁটিয়ে নিয়ে আশ্চর্যিত কন্ঠে বলে উঠে,’এত সকালে সাজতে বসেছিস কেন?’
মিতু আপু জবাব দিলেন না। গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলেন, “ আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো”
পুনরায় প্রশ্ন না করে ওয়াসরুমের দিকে হাঁটা শুরু করে সে।ঘামে শরীর আঠালো হয়ে গিয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। পাখাটা বন্ধ। গ্রামের এই একটা সমস্যা। যখন তখন ক্যারেন্ট গায়েব হয়ে যায়। ক্যারেন্টের সাথে গ্রামের সম্পর্ক মনে হয় ভালো না। কোন এক কারণে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। না পারতে সার্ভিস দিচ্ছে। দুঃখ।
____________________
উপহারকৃত চুড়ির প্রকৃত মালিক কে? দিয়েছে কে? কেন দিয়েছে? যদি নীহারিকার জন্য হয় তাহলে নাম নেই কেন?এত অনুভুতিতে মিশিয়ে কে লিখেছে চিরকুট নীহারিকার জন্য? কে লিখবে? হঠাৎ মনে পড়ে,জাওয়াদ তাকে তুমি তুমি করে ডাকে। টনক নড়ে উঠে নীহারিকার। ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে কান। এলোমেলো ভাবে মুখের উপরিভাগে ঝুলে পড়া চুলগুলো দু’আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয় সে। অসহ্য অনুভুতি কাজ করছে। অপছন্দের ব্যক্তিগুলো আশেপাশে কেন থাকে সে বুঝে না। জুতোর চপ চপ শব্দ তুলে সে বাড়িময় হাঁটছে। বিয়ের আয়োজন হচ্ছে মহা ধুমধামে। সারা বাড়ি সাজিয়ে তুলছে মামার বোনেরা। এটা পরিষ্কার করছে। ওটা সাজাচ্ছে। মামার বয়স কম নয়। তিরিশ পার হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু তিনি বিয়ে করেন নি এত দিন।বোনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তিন বোনের একটি ভাই।তাদের ছাড়া ভাই কিভাবে বিয়ে করবে? তার সেই অপেক্ষার ফল হচ্ছে সামনে। রুমের সামনে অল্প জায়গা জুড়ে হাঁটছিল সে।
‘ ভিতরে আসুন।’
চমকাল নীহারিকা। কেউ তাকে ডাকছে। পাশ ফিরে চায় সে। রুমটা কার যেন? ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তাযিনের। উনি কি নীহারিকাকেই ডাকছে? কিন্তু কেন? অজস্র প্রশ্ন এসে বাড়ি খায় নীহারিকার শূন্য মস্তিষ্কে। কিছুসময় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে। খুব তাড়া দিয়ে তাযিন আবার ডাক বসাল,’ আপনাকেই ডাকছি। ভেতরে আসুন।’
ধীর পায়ে এসে রুমের চৌকাঠে দাঁড়ায় নীহারিকা। মাথায় ওড়না টেনে উঁকি দেওয়ার মত করে মুখটা বাড়িয়ে দেয় রুমের দরজার মাঝে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে তাযিন। মাথার উপরে একটি হাত বিছান। কোলের ভাঁজে কাগজ পত্র। সামনে একটি আইপড(iPod)। শুকিয়ে আশা চিন্তিত গলায় নীহারিকা বলল,’আমাকে কিছু বলবেন?’
হাত না সরিয়ে তাযিন শান্ত ভাবে উত্তর পাঠাল,’ হুম।’
‘ কি?’ বেশ অবাক শুনাল নীহারিকার গলা। তাযিন হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে অর্ডার করার ভঙ্গীতে বলল,’চা নিয়ে আসুন। দ্রুত।’
‘ হোয়াট?’ চোখ বড় করে নিয়েছে নীহারিকা। মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে রেখে তাযিন বলল,’কানে সমস্যা আছে আপনার?’
‘ আমার কেন কানে সমস্যা থাকবে।’
‘ তাহলে সোজা কথা শুনছেন না কেন? চা চিনেন? সেই চা নিয়ে আসতে বলেছি। সকালে আমার চা খাওয়া হয়নি।আপনাদের বাড়ির মানুষের কোন ডিসিপ্লিন নেই। সকালে চা দিতে হয় এটা পর্যন্ত জানে না।’
নীহারিকার মুখ হা হয়ে যায়। তাযিন হাতের কব্জি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,’চা নিয়ে আসুন। আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ন কথা রয়েছে।’
‘ আমার সাথে?’
নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে নীহারিকা ক্ষীণ কন্ঠে জানতে চাইল। তার সাথে কি কথা থাকতে পারে? তাও গুরুত্বপূর্ন। এই একটা মানুষ তার চিন্তাশক্তিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিচলিত না হওয়া নীহারিকাকে হঠাৎ করেই বিচলিত করে দিতে কয়েকটা শব্দ শুধু মুখ থেকে বের করে। তাতেই সে বিচলিত।
‘ চা নিয়ে আসবেন? না কি আপনাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে চা খাওয়ার জন্য? আমার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। যাওয়ার হলে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করুন।’
কন্ঠটা খুবই রুক্ষ। দ্রুত পা চালিয়ে নীহারিকা জায়গা ত্যাগ করে। একে বারে বাহিরের রান্নার ঘরে গিয়ে চা নিয়ে আসে।দরজার কাছে আসতেই নীহারিকা দেখল দরজা ভেজানো।ঠকঠক শব্দ তুলতেই ভিতর থেকে ভেসে এল,’ধাক্কা দিয়ে আসুন।’
চা টেবিলের উপরে রেখে নীহারিকা বের হয়ে চলে আসতে নেয়। ওড়নায় টান পড়তেই সে প্রচন্ড আক্রোশে রেগে পিছনে তাকায়। তাযিন তখন চায়ের নেশায় মগ্ন। নিজের ওড়নাকে সে লক্ষ করল বিছানার কোণার চিপায় ফেসেছে।মুখটা মুহূর্তে নাজুক হয়ে উঠে।টেনে নেয় সে ওড়না।চায়ের চুমুকে চুমুকে তাযিন বলল,’মিতুয়ার ডিভোর্স হয়েছে কত সালে??’
কথাটা তীরের মত ছুঁটে এল নীহারিকার কানে।তরিৎ গতিতে সে ফিরে তাকাল তাযিনের মুখের পানে।তাযিন খুব স্বাভাবিক ভাবে বইয়ের পাতায় কলমের দাগ বসিয়ে দিয়ে বলল,’ বসুন।’
নীহারিকা বসল। মগ্ন চোখে সে পর্যবেক্ষণ করছে তাযিনকে।ফর্সা খানিকটা মিশান শ্যামলা মুখশ্রী। গালে চাপা দাঁড়ির জোগাড়। লম্বা নাকটা চায়ের ধোয়ায় লাল হয়ে উঠেছে। কলম ভ্রু, কপালের আশেপাশে ঘঁষে বইয়ের লাইন দাগাচ্ছে।হঠাৎ ঘুরে বসে সে।নীহারিকার মুখোমুখি তাকিয়ে চোখে রাখে চোখ।কড়া সেই দৃষ্টি চায়ের গরম ধৌয়ার মতই উত্তপ্ত। শুধলো নীহারিকা। মুখটা শক্ত করে বলল,’ আপনি কিভাবে জেনেছেন।’
তাযিন এবার হালকা ঠোঁটে হাসল।চায়ের চুমুকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,’ সেটা বড় কথা নয়। হয়েছে কবে সেটা বলুন।’
‘ আমি তেমন জানি না। তখন অনেক ছোট ছিলাম। আপু যখন ইন্টার প্রথম বর্ষের ছিল তখন বিয়ে হয়েছিল। এক বছরের মাথায় কোন একটা কারণে বিয়ে ভেঙ্গে যায়।আমাদের জানান হয়নি। সাহস করে মিতু আপুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি এসব নিয়ে।’
তাযিন গোয়েন্দার মত চোখ করে ভাবল কিছু। তারপর চট করে বলল,’ মিষ্টার শাহিনের সাথে সম্পর্কের সূত্রপাত কখন বলতে পারবেন?’
‘ এটাও জানেন?’ তাযিন চোখ শক্ত করতেই বলল,’জানি না।’
কথাটা বলে নীহারিকা নিচের দিকে তাকাল। লোকটার পা অনেক ফর্সা। ধবধবে সাদা। মুখের সাথে পায়ের হাতের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এই লোকের আলৌকিক শক্তি কাজ করছে!আশ্চর্য হয়ে নীহারিকা প্রশ্ন করে বলল,’আপনি সব জানলেন কিভাবে?’
‘ ঘটে যাওয়া জিনিস না জানার কি আছে।’
চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল নীহারিকা। মনোযোগ দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে নিচ্ছে তাযিন। খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু পড়ছে। মুখে সিরিয়াস ভাব। কপাল জুড়ে দুই চার ভাজ।মগটা ধরেছে ভারী অদ্ভুত ভাবে। মগের মুখের উপরে দু’আঙ্গুল ঘুরিয়ে রাউন রাউন করে বলল,’আপনাকে যতটা বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম তার ধারে কাছেও পড়েন না আপনি।’
ধপ করে জ্বলে উঠে নীহারিকা। বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,’ আমরা মানুষকে যেমন ভাবি মানুষ কিন্তু সব সময় তেমন হয় না। কাউকে সম্পূর্ণ না জেনে ধারণা করা অনেক বড় অপরাধ। আপনি জানেন সেটা?’
ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ উপরের দিকে অদ্ভুত ভাবে তুলে তাকাল তাযিন। ততটা বোকা নয় এই মেয়ে। চেহারার মাঝেই বুদ্ধির ছড়াছড়ি।
‘ ক্লাসের টপার?’
‘ হঠাৎ এই প্রশ্নে চলে আসলেন কেন?প্রসঙ্গ পাল্টে দিচ্ছেন?
‘ আমি প্রসঙ্গ পাল্টে কথা বলতে পছন্দ করি। নিজের আয়ত্তের বাইরে কিছু হলে আমি নিজেকেই বদলে রেখেদি।এটা তো প্রসঙ্গ বদলান মাত্র।’
চোখের তেজ দীর্ঘ। স্বাধীন চিন্তার মানুষ বলা চলে মেয়েটিকে। তাযিন মজা পাচ্ছে। নিজেকে খুব মূল্য দিতে জানে যারা তাদের সাথে বরাবরই তাযিনের ভালো সম্পর্ক।কিন্তু তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক জানিয়ে দিচ্ছে এই মেয়েটির সাথে তার কঠিন সম্পর্ক হবে। শক্তপক্ত। চোখের এই তেজ!ওহ্ তাযিন দু’ঠোঁট চেপে ধরে বলল,’ আমার দিকে তাকানোর সময় দৃষ্টি সহজ করে তাকাবেন। তেজ পছন্দ না।’
‘ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ চায় তার সামনের জন দূর্বল চিত্তের অধিকারী হবে। তেজ থাকবে শুধু তার চোখে।সমানে টক্কর দিতে মানুষ পছন্দ করে না।’ নীহারিকা হাসল। মাথার ওড়না আরো পেঁচিয়ে নিল। টেনে দিল ঘোমটার মত করে। তাযিন আড়চোখে তাকিয়ে প্রতিমুহূর্ত চক্ষুবন্ধী করে নেয়। দারুন এটেটিউট। বই বন্ধ করে সে চেয়ারে হেলে বসল। শান্ত শীতল গলায় বলল,’ আই নিড ইউর হেল্প।’
মনে মনে খুব চমকে উঠে নীহারিকা। বলে কি এই লোক।তার সাহায্য! নিজেকে সামলে কৌতুহলি কন্ঠে জানতে চাইল,’ কেমন সাহায্য? দ্রুত বলুন।’
‘ আমি দ্রুত কাজ করতে সবচেয়ে অপছন্দ করি। তাই যদি দ্রুত শুনতে হয় চলে যেতে পারেন।’
কিছু সময় চলল নীরবতা। নীরবতা ভেঙ্গে নীহারিকা বলল,’আচ্ছা ধীরে ধীরে বলুন।’
তাযিন হাসল। নিঃশব্দের সেই হাসি মুহূর্তে বুকের হাড়ে এসে থাক্কা খায় নীহারিকার। অসহ্য একটা দৃষ্টি নিয়ে সে চোখ নিচের দিকে রাখে। পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর ঘঁষে। বুকে হঠাৎ ধুকপুক শব্দের জন্ম হচ্ছে। সে দূর্বল হচ্ছে। কেন?এই মানুষটার জন্য? যে তাকে চিনেই না। হয় তো সেও চিনে না।তাযিন নীহারিকার মুখের খুব কাছে এসে বসে।ভয় পেয়ে পিছনে ঝুঁকে পড়ে নীহারিকা। চোখে কুটিল রেখা এঁকে তাযিন বলল,’ শাহিন ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। মিতুয়ার সাথে দারুন যাবে।’
আৎকে উঠা কন্ঠে নীহারিকা বলল,’ পাগল হলেন আপনি?আপু খুন করে দিবে আমাদের।’
‘ আপনার মত ভীতু মানুষের খুন করা সহজ হলেও আমার মত মানুষকে করা প্রচন্ড কঠিন।’
তাযিন নিজের শান্ত কন্ঠে নীহারিকাকে ক্ষণকালের জন্য নীরব করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই সে বিছানার উপরে দু’পা তুলে আরও দুরে সরে যেতে যেতে বলল,’ মিতু আপু উনাকে অনেক ঘৃণা করে। প্রচন্ড মাত্রায়। তাই উনার সাথে ভুলেও মিল করাতে যাওয়া উঁচিৎ হবে না।’
তাযিন হঠাৎ উঠে দরজার কাছে যায়। ভয় পেয়ে নীহারিকা নেমে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তাযিন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় নীহারিকা। সে মোটেও ভীতু প্রকৃতির মেয়ে নয়। কিন্তু এই একটা মানুষের আচরণ তাকে ভয় পেতে প্রবল ভাবে সাহায্য করে। লম্বা শ্বাস নিয়ে নীহারিকা বলল,’ এগুলো কোন ধরনের অসভ্যতা? দরজা খুলুন। আমি বাহিরে যাবো।’
‘ খুলে দিব। কথা বাহিরে যাচ্ছে। আপনার মিতু আপু শুনলে আমার কিছুই হবে না। আপনার অবস্থা খারাপ হবে।’
‘ খুব দেখছি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছেন।’
‘ নিজের প্রতিটি জিনিস নিয়ে আমি খুব চিন্তিত।’ কথাটা এত আস্তে বলল যে নীহারিকাকে দু’বার কি বললেন,কি বললেন বলতে হয়েছে। তাযিন দরজার বুকে হেলান দিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,’ ভালোবেসেছেন কাউকে?’
অত্যন্ত বিচলিত চোখে তাকিয়ে রইল নীহারিকা। কি বলবে উত্তর খুজতে সময় লেগে গেল কয়েক মিনিট। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে সে বলল,’পরিবারের সবাইকে আমি ভালোবাসি।’
‘ এই ভালোবাসা সেই ভালোবাসা নয়। পৃথিবীতে সম্পর্কের ভিত্তিতে ভালোবাসা ভিন্ন হয়। অপরিচিত কোন ছেলেকে হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছেন এমন মনে হয়েছে কখন?’
তিক্ত একটা অনুভূতিতে শরীর ঝিম হয়ে গেল নীহারিকার।একটা অচেনা অপরিচিত মানুষের জন্য আজও তার বুকে সিক্ত কোমল আলোচনা হয়।মাঝে মাঝে সে সমালোচনাও করে তার। খুব গোপন অনুভূতি সে। অনুভবে ডুবে থাকার অনুভূতি।নিচের দিকে তাকিয়ে রইল নীহারিকা। তার রাগ হচ্ছে। খুব রাগ তার। হুট হাট অনুমতি ব্যতিত এসে হাজির হয় এই রাগ। এই যে এখন তার ইচ্ছে করছে গাল লাল করে দিতে সামনের মানুষটার। কেন তার গোপন অনুভূতিতে হাত রাখল? দু’পাশের চোয়াল শক্ত করে নীহারিকা বলল,’ এসব প্রশ্ন করার অধিকার আমি কাউকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। কাজের কথা বলুন আর আমার পথ ছাড়ুন।’
তাযিন ঈষৎ হেসে বলল,’ভালোবাসা যে অনুভব করতে পারে না সে অন্যের ভালোবাসার অনুভূতি বুঝতে পারে না। আপনার মিতু আপু ভালো নেই।’
হ্যাঁ মিতু আপুর জীবনে কিছু বিষাক্ত অতীত রয়েছে। কিন্তু আপু তো কষ্ট তেমন পায় না। হাসি খুশি জীবন তার। কি সব বলছে উনি। নীহারিকার আগ্রহ বাড়ে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে সে। এই মুহূর্তে তার আর ভয় করছে না।মানুষকে হুট করে ভরসা করার অভিজ্ঞতা পুরনো। সরু চোখে তাকিয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনার তো ভালোবাসার উপরে অনেক অভিজ্ঞতা দেখছি। তা বুঝিয়ে বলুন। আমিও শুনি।’
‘ অর্ডার পছন্দ করিনা।’
‘ আপনার পছন্দ মত সব হবে না।’
তাযিন চোখ ছোট করে বলল,’ আপনি তো ক্ষেপে যাচ্ছেন মিস।’
মানুষটার কি তার কথা মনে পড়ছে? নীহারিকা শান্ত হয়ে প্রশ্ন করে,’ আপনার কি জমজ ভাই আছে? যে দেখতে ঠিক আপনার মত। কিন্তু খুব ভালো। সুন্দর করে কথা বলে। সব সময় হাসে। কখন রাগ করে না। তার মস্তিষ্ক দারুন ভাবে কাজ করে। হুট করেই সে আলৌকিক ভাবে অনেক কিছু বলে দিতে পারে। খুব সুন্দর করে হাসতে পারে। এত সুন্দর হাসি যা পৃথিবীর খুব কম মানুষ পারে। জুতো খুলে হাঁটতে পছন্দ করে। উদ্ভট কাজ করতে পছন্দ করে। সাধারন মানুষের সাথে তার কোন মিল নেই। কোন মিলই নেই। সে আপন সত্ত্বার অধিকারী নিজের মত মানুষ। আছে বলুন?’
হঠাৎ মুখের রং পাল্টে নিয়ে তাযিন চোখে মুখে কাঠিন্য নিয়ে এসে বলল,’ আমার ভাই বোনের কাহিনী জেনে আপনার কি কাজ?’
‘ আরে আপনি তো আমার আপন খালাত ভাই। জানার অবশ্যই অধীকার রয়েছে।’
‘ আমি আপনার ভাই?’
‘ অবশ্যই। আজ থেকে ডাকবো তাযিন ভাই। খুশি। এবার বলুন।’
স্তম্ভীত চোখে তাযিন তাকিয়ে রইল। যতটা শক্ত কঠিন মনে হয় মেয়েটা তার চেয়েও অনেক গুন ছোটদের মত আচরণ করতে পারে। অসম্ভব বাচ্চামু লুকিয়ে রেখেছে নিজের মাঝে। সত্যি সে এই প্রথম কারো আচরনের ব্যাপারে অবাক হচ্ছে। নীহারিকা থেমে যায় ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে কথার মুড পাল্টে নিয়ে বলল,’ মিতু আপুর কথাই বলুন।উনার খোঁজ আর করব না। সে যাক জাহান্নামে।’
‘ জাহান্নামে কেন যাবে? আপনি কি তাকে নাস্তিক মনে করছেন? অন্যের সম্পর্কে না জেনে ধারনা করা অপরাধ।’
অবাক হয়ে তাকায় নীহারিকা। বেশ উদ্বেগী গলায় বলে,’আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন?’
‘ ফিরিয়ে কোথায় দিলাম।আমি তো নিজের মুখে বললাম।আর কথা ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।’
‘ বিরক্ত করবেন না। দ্রুত আসল কথা বলুন।’
সিরিয়াস ভাব মুখে ফুঁটিয়ে তাযিন চেয়ারে বসে পড়ে।গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,’আমাকে মিষ্টার শাহিনদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন আপনি। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। শুরু থেকে জানতে চাই।’
‘ আমি নিয়ে যাব?’
‘ হুম আপনি।’
‘ আমিই কেন?’ মুখটা একদম বাচ্চা শিশুদের মত করে বলল নীহারিকা। তাযিনের মুহূর্তের জন্য হাসতে ইচ্ছে করল। সে হাসল না। চেপে বলল,’ফাবিহা কখন রাজি হবে না। আপনি ছাড়া উপায় ছিল না। আপনি কি চাইছেন না আপনার বোন জীবনে হ্যাপি হোক।’
‘ আপনি এত কিছু কিভাবে জানলেন?’
তাযিন উত্তর দিল না। গুরুগম্ভীর হয়ে বসে রইল।নীহারিকা নীরবতার সুতো কেঁটে বলল,’মিতু আপুর জন্য আপনি এত ভাবছেন কেন? বাকিরা তো ভাবে না। হুট করে এসেই আপনি ভাবা শুরু করে দিয়েছেন ?’
‘ প্রতিটি মানুষ হুট করেই ভাবে। আমিও ভাবছি। তার আনন্দ চাচ্ছেন না?’
‘ অবশ্যই চাই। আপু তো এমনেই আনন্দে রয়েছে।’
‘ শুধু ভালোবাসলেই হয় না সে মানুষটার অস্তিত্বের খোঁজ করতে হয়।’
নীহারিকা মানে বুঝল না। অন্যভাষায় বলা হয়েছে মত করে সে তাকিয়ে রইল। তাযিন বলল,’কতটা ভালোবাসলে এত অভিমান করে নিজের চুড়ি ভেঙ্গে হাত কাঁটতে পারে সেটা বুঝার ক্ষমতা আপনার হয়নি। আজকে আমি অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি। লিস্ট ফুল। আপনি বিকেলে আমার সাথে যাবেন। ফাইনাল। দ্যান ইউ গো।’
নীহারিকা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মানুষের ভাষা এত পেঁচানো হয়? আশ্চর্য। উঠে দরজার ছিটকিনি খুলে নীহারিকা পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে বলল,’শুধু একটা প্রশ্ন করি?’
তাযিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’ হুম করুন।’
‘ মিতু আপুর জন্য আপনি অনেক ভাবছেন। এত কিছু তার জন্য কেন করছেন?’
একটা পা আর এক পায়ের উপরে রেখে তাযিন ঝুঁকে মাথা নামিয়ে চোখ উপরের দিকে তুলে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর পৌছাল,’ অন্যের জন্য আমি কখন কিছু করিনা। যা করি শুধু নিজের জন্য করি। আমি প্রচন্ড স্বার্থপর মানুষ। মাত্রার বাহিরে।’
নীহারিকা দ্রুত রুম ত্যাগ করে বাহিরে আসে। মিতু আপু একদম বসে আছে সামনের রুমে। ভাগ্যিস দরজা লাগিয়েছিল। তা না হলে তার গর্দান যেত। শাহিন ভাইয়ার কথা শুনলেই আপু আগুন হয়ে যায়। তেজি সিংহীর মত আক্রোমন করে বসে। আচ্ছা আপু কি এখনও শাহিন ভাইয়াকে আগের মত ভালোবাসে? না কি প্রচন্ড ঘৃণা করে।ভালোবাসা আর ঘৃণা কি পাশাপাশি থাকে? এক মানুষের অস্তিত্বে?
_____________________
গৌধূলি বিকেলের আলো মুঠো মুঠো ভর্তি হয়ে ছড়িয়েছে দীঘির সবুজ পানির উপরে। ছলছল পানি দোল খাচ্ছে।মিষ্টি মধুর ঘ্রাণ ভেসে ভেসে আসছে। দূরের সবুজ গাছ গুলো গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। এক টুকরো সোনালি রোদ এসে পড়ছে নীহারিকার মুখশ্রীর উপরে। বাতাসের মৃদু স্পর্শ গুলো ছুয়ে দিচ্ছে শরীরের আনাচে কানাচে। ছোট ছোট জঙ্গলার ঘাসের উপরে সে দাঁড়িয়ে। রোদে চিকচিক করে উঠছে ঘামে বিন্দু বিন্দু ভিজা মুখমন্ডল। পা ব্যথা করছে।ঝি ঝি করছে তালু। কয়েক বার পা টেনে ঝেরে নিল সে। নিঃশ্বাসের সাথে বিরক্তি, রাগ মিশে অস্থির অবস্থা। এত মেপে মেপে চলা মানুষটা এত দেরি করছে? চোখ মুখে অদ্ভুত অস্থিরতার রেখা টেনে নীহারিকা এবার ঘাসের উপরে পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ে। অপেক্ষা করছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। চোখদুটো জ্বালা করছে। এতসময় নিয়ে সে তাকিয়ে ছিল পথের দিকে চেয়ে। মানুষটা কি পথ ভুলে গিয়েছে? ভুলারই কথা। এত আঁকাবাঁকা পথে ঘেরা এই গ্রাম। কিন্তু আজ মামার কাছে অদ্ভুত কিছু বাক্য শুনেছে সে। তাযিন তার বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের অর্ধেকের বেশি অংশ ঘুরে এসেছে। নীহারিকার মাথায় এটা আসছে না রাস্তা চিনে বাসায় চলে আসল কিভাবে? সে হলে হারিয়ে যেত নিশ্চিত। সে হিসেবে এই লোক পথ ভুলার মানুষ নয়। ইচ্ছে করে দেরি করছে। কোন ভাবে নীহারিকার উপরে প্রতিশোধ নিচ্ছে না তো? কিন্তু সে তেমন কিছুই করেনি যার কারনে প্রতিশোধ নিবে। মশা কামড়ে পায়ের খালি পাতা লাল করে তুলেছে নীহারিকার। বিরক্ত খুব, বিরক্ত সে।আর অপেক্ষা করবে সর্বোচ্চ দশমিনিট। এর বেশি এক মিনিটও নয়।

একটু দূরে বসেছে তাযিন।গ্রাম বাংলায় সুপারী গাছের অস্তিত্ব দারুন ভাবে আকর্ষণীয়। বিশাল সুপারী বাগান। তার মাঝে বাঁকা সাপের মত রাস্তা। মাঝে কিছু ছড়ান ছিটান আম গাছ রয়েছে। লাল লতানো ফুলের একটি হিজল গাছের নিচে বসে তাযিন। সুঠাম শরীর বাঁকিয়ে তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। এই স্থান থেকে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির মুখশ্রী। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে। এত রাগ মেয়েদের হয়? কথায় কথায় রাগের ফোয়ারা নিয়ে বসে মেয়েটি। ঠোঁটে মৃদূ হাসি ঝুলিয়ে পিছনে দুহাত রেখে দৃষ্টি স্থির করে তাযিন। জীবনে এই প্রথম কাউকে বিরক্ত করতে তার খুব ভাল লাগছে। যাকে বলে, অসম্ভব ভাল লাগা। সূর্যের রশ্নী লেপ্টে নিয়ে রূপের বাহার বাড়িয়ে তুলছে প্রকৃতি। ঘাসের উপরে বসে আছে কালো পোশাকের মেয়েটি। মাথায় হিজাব বাঁধা। কাঁধ পিঠ ছড়িয়ে দু’হাতের ভাঁজে এসে থেমেছে ওড়নাটা। বিড়বিড় করে কোমল ঠোঁট নাড়াচাড়া করে অকথ্য ভাষায় তাযিনকে যে গালি দিচ্ছে সেটা এই দূর প্রান্ত থেকে টের পাচ্ছে সে। পৃথিবী কেন যে পছন্দের সময়ে থমকায় না? কেন সময় গুলো দ্রুত দৌড়ে বেড়ায়? কেন অনুভূতির সাথে সময় খেলা করে? বুকের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায় সে। এখানে বসে একটি মেয়েকে অপলক দৃষ্টি ছুড়ে দেখার কোন মানে হয় না। তার কাছে তো একদমই অর্থ বিহীন কাজ এটি। মুখটা শক্ত করে সে হেঁটে এগিয়ে যায় সমনের দিকে।

উঠে দাঁড়ায় নীহারিকা। বাড়ির পথে পা বাড়ায়। অযথা কিছু সময় নষ্ট আর মশার বাজে চিবানোর শিকার হয়েছে সে। এই মানুষটা থেকে সম্পূর্ন দূরত্বে থাকতে হবে তাকে। মোটেও স্বাভাবিক সুবিধার পুরুষ নয় সে। পথ আগলে দাঁড়ায় কেউ। চমকে উঠে একটু দূরে সরে যায় নীহারিকা। চোখের পাতা উল্টে উপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।প্রচন্ড রোদে কাঠ হয়ে যাওয়া মানুষ যেমন হঠাৎ একচিলতে বাতাসের সন্ধানে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে নীহারিকার চোখ জোড়া ঠিক তেমন ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠে। হাসিতে ভাসিয়ে দিতে যাওয়া ঠোঁট হালকা মেলে নীহারিকা বলল,’ আমি ভেবেছি আপনি আসবেন না।’
‘ আমি কথার খেলাপ করি না।’ কঠিন ভাষায় জবাব দিয়ে তাযিন নৌকা খুঁজতে শুরু করে। হেঁটে পার হওয়ার কোন চারা নেই। যেতে হবে নৌকো বা সাঁতার কেঁটে। এত দীর্ঘ পথ সাঁতরে পার করা অবশ্যই বোকামি। ঠোঁট উল্টে নিয়ে নীহারিকা পানির দিকে তাকিয়ে রইল। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে এই লোকের কথায় এখানে এসেছে। অথচ কি বাজে বিহেভ। শালা আস্ত একটি ইডিয়েট। নিস্তব্ধ নীরব দু’জনেই। তাযিন আগে কথা বলল,’ বাড়ির কেউ জানে?’
‘ কি?’ পাল্টা প্রশ্ন নীহারিকার।তাযিন পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,’ আপনি এখানে এসেছেন এই নিউজ।’
‘ না জানে না।’
‘ আপনার জাওয়াদও না?’
চাপা কন্ঠে বলল তাযিন।আশ্চর্য রকমের অবাক হয়ে নীহারিকা বলল,’ আমার মানে?’
তাযিনের পাশ থেকে কোন উত্তর পৌছাল না।রেগে নীহারিকা বলল,’ আপনি এক কথা বলে চুপ করে জান কেন? আমার মানে কি বলুন? ‘
‘ আমি শুনেছি উনি আপনার কাছের মানুষ।’
নীহারিকা মনে মনে আওড়াল কাছের মানুষ! শব্দটা।তাযিন ততক্ষণে নৌকার মাঝির সাথে কথা বলছে। নৌকা ঠিক করে সে বলল,’ হাত এগিয়ে দিন। আমি সাহায্য করছি।’
নাক মুখ ফুলিয়ে অযথা রাগ ছুড়ে দিয়ে নীহারিকা বলল,’কোন প্রয়োজন নেই। শুধু আপুর জন্য এখানে এসেছি। তা না হলে আপনার সাথে আমার কথাই বলতে ইচ্ছে করে না। অসহ্য লোক।’
তাযিন ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল। মুখটা গম্ভীর করে সে বুঝিয়ে দিচ্ছে তারও বিন্দুমাত্র কথা বলার ইচ্ছে নেই।নীহারিকা নৌকায় উঠতে গিয়ে পড়ে যেতে নেয়।তাযিন ধরে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,’ আমি জানি আপনি জীবনে এক কি দুবারের বেশি নৌকায় উঠেন নি।’
‘ আপনি সব আগে আগে যেনে যান কেন বলবেন? যা জানার তা তো ভুলেই বসে আছেন।’
‘ কি জানার দরকার ছিল আমার?’
তাযিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে চমকে উঠে নীহারিকা।থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে এই লোক শাহিন ভাইয়াদের বাড়ি যাবে? কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তাযিন নৌকায় উঠে বসে পড়ে। নীহারিকা এখনো পড়ে দাঁড়িয়ে। বেশ ঝামেলায় পড়ে সে হাত বাড়িয়ে বলল,’ ধরুন তো।’
‘ অর্ডার করছেন?’
মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীহারিকা বলল,’দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন তাযিন ভাইয়া।’
তাযিন কিঞ্চিত হাসল। মনে মনে দীর্ঘ সুর টেনে শ্বাস নিল।হাতটা ধরতেই নীহারিকা চোখ তুলে তাকায়। হাত এত গরম কেন? কোন মানুষের হাত এত গরম হতে দেখেনি নীহারিকা। শরীরে গরম তাপ ছড়িয়ে পড়ে তার। মুহূর্তে শিরশির করে উত্তপ্ত হয়ে উঠে হাতের চারপাশ। জ্বলে উঠে তালু। চোখে চোখ রাখতেই অন্যজগৎে পা রাখে সে।শিহরিত হয়ে উঠে শরীরের ভাঁজ ভাঁজ ।চিকন আঙ্গুল গুলো কেঁপে উঠে পিয়ানোর পিঠে বাজান আঙ্গুলের মত।তাযিন শান্ত নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ আপনি কাঁপছেন?’
নীহারিকা লক্ষ করছে সে সত্যি কাঁপছে। কোন অচেনা পুরুষের স্পর্শে সে কাঁপে। হাত দ্রুত সরিয়ে নেয় সে। গরম তালু তাকে পুড়িয়ে দেবি যেন। আবার হাত এগিয়ে সে বলল,’ আপনার হাত খুব গরম। অস্বাভাবিক।’
‘ আমার রক্ত গরম তাই। শুধু আমার না আম্মি আর আনজুর হাতও গরম। কিন্তু আপনার হাত এত ঠান্ডা কেন?ভয় পাচ্ছেন?’ নীহারিকা নৌকায় উঠে এসে বসে বলল,’ মোটে ও না। আমি যাকে তাকে ভয় পাই না।’
তাযিন বসল এক পাশে।বাকি সম্পূর্ন পাশ নীহারিকাকে ছেড়ে দিয়ে সে শীতল চোখে তাকিয়ে রইল টলমল করে উঠা পানির দিকে। ফোন বের করে কার কার সাথে গুরুত্বপূর্ন ভঙ্গীতে কথা বলল। কৌতুহলি কন্ঠে নীহারিকা বলল,’ আপনি কি পাগলের ডাক্তার?’
‘ পাগল বলতে পৃথিবীতে কেউ আছে বলে আমি মন করি না। যাদের বলা হয় তারা মানসিক রোগী। তাই পাগলের ডাক্তার বলতেও কিছু নেই আমি জানি।’
‘ আপনি তাহলে কি? মানে কি করেন?ছোট বোন হিসেবে জানতে চেয়েছি মাত্র।’
হাসার চেষ্টা করে নীহারিকা বলল। তাযিন বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে বসে রইল।কিছু বলল না। অর্ধ পথে এসে নীহারিকা বলল,’ আপনি এই পোশাকে শাহিন ভাইয়ার বাসায় যাবেন?’
তাযিন একটু চোখ তুলে নীহারিকার দিকে, একবার নিজের দিকে দেখে বলল,’ খারাপ কি এতে?’
‘ অর্ধ পোশাকে যাবেন?’
‘ অর্ধেক কি দেখেছেন আপনি?’
‘ এই যে প্যান্ট অর্ধেক।’
তাযিন হেসে উপরে তাকাল একবার। তারপর কথা উপেক্ষা করে বলল,’ মিষ্টার শাহিনের পেশা কি??’
‘ আমি জানি না।’
‘ পরিবারে কে কে আছে?’
‘ শুনেছি দুই ভাই দুই বোন। ভাইয়া বড়। অনেক আগে কথা হয়েছিল। আগে আপুর সাথে রোজ দেখা করতে আসত। বিয়ের পরে আপু আর কখন দেখা করেনি। এর মাঝে দেখা হয়েছে কি না আমি জানি না। আসলে আমি এখানে থাকি না।’
তাযিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীহারিকার মুঠো ফোন শব্দ করে উঠে। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে কেউ বলে উঠে,’ তুমি কোথায় নীহারিকা?’
বিস্মিত গলায় নীহারিকা বলল,’ আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?’
জাওয়াদ হাসল। দীর্ঘ সুর টেনে বলল,’ পাওয়াটা কি প্রয়োজন নয়?’
‘ অবশ্যই না। আমার নাম্বার আমি অপরিচিত ব্যক্তিকে কখনো দি না। বাবা দিয়েছে?’
‘ আঙ্কেল কখন দিবে না সেটা তুমিও ভালো করে যান।’
‘ তাহলে কোথায় পেয়েছেন?’
‘ সে তো আসল কথা নয়। তুমি কোথায় বল। আজ সারা দিন তোমাকে দেখা হয়নি।’
‘ আমাকে দেখে আপনি কি করবেন?’
জাওয়াদ বিরক্ত হয়ে বলল,’ সব সময় এমন রূক্ষ ব্যবহার কেন উপহার দেও বলবে? ‘
‘ দেখুন আপনাকে ভাল এবং ভদ্র ভাষায় বলছি এসব আমার পছন্দ নয়। একদমই না।’
‘ কোন সব?’
‘ আমার নাম্বার অপরিচিত কারো কাছে থাকুক এসব।’
‘ আচ্ছা নাম্বার ডিলেট করে দিব। ফোন আর করব না।তুমি কোথায় আছ বল।’
‘ বলব না।’
‘ কেন?’ খুব উঁচু কন্ঠেস্বরে বলল জাওয়াদ। তার কন্ঠ খুব চিন্তিত উদ্বেগী শুনাচ্ছে। নীহারিকা ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে দিল। লোকটা তাকে নিয়ে বেশি ভাবছে। মাত্রা অতিরিক্ত। যা তার ভাল লাগছে না। তাযিন নৌকা টপকে পাড়ে উঠে আসে। নীহারিকা তাকিয়ে দেখে সে নেই প্রায়।অনেক দূর চলে গিয়েছে। নৌকা থেকে নামার সময় দু’বার পড়েছে সে।কি পরিমানে খারাপ মানুষ ভাবা যায়! হ্যাল্প না করেই চলে গেল?

গাছপালা ঘেরা জঙ্গল পেরিয়ে মাঠের অপর প্রান্তে মাঝি পাড়া। তাদের যেতে হবে সেখানে। জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটছে তারা। দু’জন দুই প্রান্তের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কারো সাথে কারো যোগ সূত্র নেই। তাযিন মুখটাকে এমন ভঙ্গীতে রেখেছে যে মানুষ তো দূর জঙ্গলের গাছপালাও তার সাথে কথা বলতে ভয় পাবে। নীহারিকা হাঁটছে আর আড়াআড়ি ভাবে দেখছে। ভেবসা গরমে তাযিন ঘেমে একাকার।টিশার্টের পিঠ ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টে রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা দু’টো হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। পা চালান থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরে তাযিন। কিছুদূর পথে এসে থামে নীহারিকা। পিছনে তাকিয়ে দেখে তাযিন জমে বরফের মত দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু পরিমাণ নড়ছে না। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠে,’ সাপ!’
চমকে কয়েক পা দূরে সরে যায় নীহারিকা। নরম গলায় বলে,’ কোথায়? কোথায় ? ‘
‘ পায়ে।’
নীহারিকা ভয়ে ভয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে লতা জড়িয়ে আছে তাযিনের ফর্সা পা পেঁচিয়ে। চোখ তুলে আবার তাযিনের মুখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা নিজের মুখ চেপে ধরে হাসি থামায়। বেশ ভয় পাওয়া গলায় বলল,’ এখন কি হবে?’
‘ আমি কিভাবে বলব ? আপনি কিছু করুন।’
‘ আমি কি করব?’
‘ যা খুশি করুন। এটাকে সরিয়ে দিন।’
‘ অর্ডার করছেন?’ নীহারিকা মুড দেখিয়ে বলল। তাযিন চোখ বন্ধ করে রেখেই বলল,’ আমার কথা আমাকে শুনাচ্ছেন কেন? সাপ আমার অনেক বড় দূর্বলতা। সে কি কামড়ে ধরেছে পা?’
নীহারিকা শব্দ করে হাসতে লাগল। সবাইকে ভয় দেখিয়ে কথা বলা মানুষ নিজে ভয় পাচ্ছে। বাহ দারুন তো। সে পুরো দমে মজা লুফে নিচ্ছে। তাযিনের হাত কাঁপছে। বুঝাই যাচ্ছে সাপ কামড়ে দিক বা না দিক ভয়ে সে উপরে চলে যাবে। এত ভয়! আশ্চর্য রকমে চমকে উঠে নীহারিকা।
________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..