প্রিয় সুখ পর্ব-১৮

0
36

প্রিয় সুখ-১৮
________________
মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে দুঃখ কষ্টের অধ্যায়। সবার জীবনেই কিছু বিশেষ দিক রয়েছে। চলার পথে অনেক অতীতকে জোগার করতে করতে মানুষ এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে। এই সব ঝুড়ি ভর্তি অতীত গুলোর মাঝের কিছু অংশ খুবই অপ্রিয় হয়। যা মানুষ দুঃস্বপ্নের ন্যায় ভুলে যেতে চায়। যদি জীবনের পাতায় পেন্সিলের লেখা হতো তাহলে রাবারের সাহায্যে কষ্টকে মুছে শুধু সুখ সঞ্চয় করে যেত মানুষ। মুছতে না পারার ব্যর্থতা স্বরূপ কিছু বিষাক্ত অতীত বহন করতে হয় আজীবন। শান্তর জীবনটা তেমন। সে বহন করছে তিক্ত জীবনের অংশবিশেষ। তার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়েছে তার বয়স যখন দশ তখন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। মাও করেছেন। তাকে বলা হয়েছে দু’জনের মাঝে একজনকে বেছে নিতে। মানুষকে যদি বলা হয় হৃৎপিন্ডের শব্দ বা নিঃশ্বাস থেকে যে কোন একটিকে বেছে নিতে তখন সে কোনটি নিবে? শান্ত কাউকে নিতে পারল না। এক বছরের মাথায় বাবা তার দ্বিতীয় বিয়েও ভেঙ্গে দিলেন। আসলে তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। শান্ত জানে ডিভোর্স তার বাবার নয় মায়েরই বেশি প্রয়োজন ছিল। মা কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে ভাবল। সে দেখেছে বিদেশী নারী গুলো স্বার্থপর হয় খুব। হুট করে ছেড়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে লক্ষ করল বাংলাদেশের নারী গুলো তেমন নয়। এরা শত শত কষ্ট সহ্য করে বিয়েকে টিকিয়ে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা করে। হাস্যকর হলেও এটা সে নিজের চোখে দেখেছে। দুই নারীই তো নারী তাহলে তাদের মাঝে এত পার্থক্য? না কি হঠাৎ তার এমন মনে হচ্ছে। হতে পারে বাংলাদেশের নারীরাও তেমন! শান্ত বিয়েতে প্রচন্ড ভাবে অবিশ্বাস করে। তার মতে বিয়ে হওয়া উচিঁৎ এমন যেটা কখনো ভাঙ্গবে না। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে দেখল বিয়ে ভেঙ্গে চুড়মার হয়। তার বাবার প্রেমের বিয়ে ছিল। ভালোবেসে বিয়ে করেও সে বিয়ে টিকল না। কেন? এই প্রশ্ন গুলো দশ বছর বয়স থেকেই তার মাথায় প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করত। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে ভাঙ্গার পরে তিনি শান্তকে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসলেন। সংসার শুরু হলো তার আর বাবার। রোজ বাবা রান্না করতেন। তাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। তার সব কাজ তিনি করতেন। যা মায়ের করা উচিত। শান্ত কখনো মায়ের অভাব অনুভব করেনি। কিন্তু শূন্যতা বড্ড খারাপ। যে স্থান একবার খালি হয়ে যায় তা কখনো পূরণ সম্ভব নয়। মা তো সবচেয়ে গভীরতা। শান্ত চুপচাপ সিঁড়িতে বসে ভাবছে। বিয়ে সে এই জীবনে করবে না। বাবাও হবে না সে।মরে গেলেও না। এই দুই জিনিস বাদে তার জীবন হবে সবচেয়ে সুন্দর। ফাবিহা এসে সামনের সিঁড়িতে বসে। তাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। বাহিরের হলুদ আলো। এসে পড়ছে গুচ্ছ গুচ্ছ ভাবে। একবার চোখ তুলে দেখে। শান্ত আর তাকাতে চায় না। এই মেয়েকে পেতে হলে না কি বিয়ে করতে হবে। হাস্য কর ব্যাপার। এত এত সুন্দরী মেয়েকে ডেট করে এখন না কি বিয়েই করতে হবে! অসম্ভব। বাংলাদেশের এই নিয়ম তার পছন্দ হলো না। চেনে না জানে না এমন মেয়েকে বিয়ে করতে হয় কেন? প্রেম হবে ভালোবাসা হবে। দু’জন নিজেদের সংসার সাজাবে। যদি কখনো মনে হয় এক সাথে জীবন কাঁটানো সম্ভব তখন তারা বিয়ে করবে। ধরেই বিয়ে করে তার বাবার মত বোকামি সে করবে না। তারপর দেখা যাবে সারাটা জীবন ছ্যাঁকা খেয়ে মদের বোতলে জীবন ডুবাবে। যতসব। সে আমেরিকান নাগরীক। যথেষ্ট সচেতন পাবলিক।
ফাবিহা কিছু সময় বসে রইল। তারপর ঠোঁট জোড়া গোলাকার করে শব্দ করল,’ হিশ হিশ ।’
শান্ত শুনেও না শুনার ভান ধরল। জীবনে প্রথম সে কোন মেয়ের জন্য চিঠি লিখল। তাও বাংলায়। এই মেয়ে সেই চিঠি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। কেমন মেয়ে? পছন্দ হয়েছে বলে কি মূল্য নেই না কি? শান্তর জন্য তো মেয়ের অভাব পড়েনি। হাজার হাজার আছে। শ্যামকন্যা না হলে সাদাকন্যাই ঠিক।
ফাবিহা চুক চুক শব্দ করল। শান্ত বিরক্ত হয়ে বলল,’ ডিস্টার্ব করছেন কেন? সমস্যা কোথায়? রাতে এত বাজে ব্যবহার করে মন ভরেনি? আবার চলে এসেছেন? অসহ্য।’
শান্ত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কথাটা কাঁটার মত গায়ে ছড়িয়ে পড়ল। ফাবিহার বুকটা ভার হলো। মুখ থেকে সেই উচ্ছ্বাস উদ্দিপনা উবে গেল মুহূর্তে। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে আসল। চোখে পানি আসি আসি ভাব। অপমানে তার শরীর একপ্রকার কেঁপে উঠল। রাগ হলো খুব। নিজেকে শুধরে সে বলল,’ আসলে আমি স্যরি বলতে এসেছি। আর এই আপনার চিঠি। মিতু আপু আপনারটা ছিড়ে ফেলেছে। আমি একদম হুবহু লিখে দিয়েছি। আর আপনার চকলেট গুলো। আমি ডিস্টার্ব করতে চাইনি। দুঃখিত।’
ফাবিহার নুপুর নেচে উঠে। ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে সে দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করে। শান্ত আহাম্মকের মত তাকিয়ে থাকে। সে কি খুব বাজে ব্যবহার করেছে? শুধু তো একটু বিরক্তি নিয়ে কথা বলেছে। রাগ করল কেন? আশ্চর্য। এই দেশের মেয়ে গুলো হচ্ছে বিচিত্র ধর্মী। নীহারিকাকে দেখে তার একুটু অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। চিঠি খুলে শান্ত হতভম্ব। দুটি চিঠি। একটি তারটা। হুবহু আছে। মেয়েটি লিখে দিয়েছে? এতটা মনে রাখল কিভাবে? সারা রাত মুখস্ত করেছে না কি? অন্যটি খুলে প্রথম লেখা দেখে শান্ত অবাক হলো। তাতে লেখা,
অশান্তি,
সম্বোধন শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই জীবনে অশান্তি নেমে এসেছে।তবে দুঃখিত রাতের ব্যবহারের জন্য। আমি কখনো আমার মিতু আপুর সাথে বাজে ব্যবহার করিনা। আমাদের মাঝে বনে কম। কিন্তু আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আপনার দেওয়া চিঠি যখন আমি পড়ছিলাম আপু তখন খুব রেগে গেল। এতে আমার আপুর কোন দোষ নেই। অশান্তি তো আপনি। প্রকৃত অর্থে মিতু আপু প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না। একজনকে উনি খুব ভালোবেসে ছিল। কিন্তু তিনি আপুকে ধোঁকা দিয়েছিল। বিয়ে করবে বলে করেনি। আপনি শুনলে অবাক হবেন আপু বিয়ের পোশাক পরে দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক্ষণ। শাহিন ভাই আসবে বলে তিনি দীঘির পাড়ে বসে ছিল সারা দিন। কিন্তু উনি আসেনি। আপু যা কষ্ট পেয়েছে তা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মূলত শাহিন ভাইয়ের জন্যেই মিতু আপুর জীবনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রথমে বিয়েতে রাজি হলেও মিতু আপু উনার সাথে অনেক যোগাযোগ করতে চেয়েছিল। উনি করনি। ইচ্ছে করেই করেনি। কলেরও জবাব দেয়নি। মিতু আপু কত দূরে গিয়ে উনাকে ফোন করেছিল ভাবতেই আমি বিস্মৃত। কোন চিঠির জবাব দেয়নি। শাহিন ভাই এত কিছু করেছে বলেই আপু এসব বিশ্বাস করে না। আপু মনে করেছে আপনার সাথে আমার প্রেম ট্রেম টাইপের সম্পর্ক গড়ে উঠছে। হাস্যকর না। আপনার মত ছেলের সাথে আমি প্রেম করব? মাথা খারাপ না আমার। আরে বিদেশী ছেলেরা একটু এমনই হয়। প্রণয়চাতুর্যে এরা মাহির। আমি যে সুন্দর নই আমি জানি। তাই আমার সাথে আর যদি ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করেন আপনাকে খুন করে দিব। মজারও লিমিট থাকা উচিঁৎ। একদম হালকা ভাবে নিবেন না আমার কথা। আমি মোটেও আপনাকে এসব লিখছি না শুধু আমি কিন্তু থ্রেট দিলাম। সো বি কেয়ার ফুল মিষ্টার অশান্তি। আমি ভালো মেয়ে তাই আপনার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করে আমার একটুও ভালো লাগেনি। আমি একটা চকলেট খেয়ে নিয়েছি। সত্যি অসাধারণ ছিল। স্যরি খেয়ে নিয়েছি বলে। বেশি খেলে আবার মিতু আপু রাগ করত। অন্যদিকে চকলেট আমার প্রিয়। খেয়েছি বলে আপনি হয় তো রাগ করবেন। তবে এতে আমার দোষ নেই। দিলেন কেন তাহলে? মন বলেছে খেতে তাই খেয়েছি। আর মনের কথা শুনতে হয়। দুনিয়া যাক গর্তে।
আচ্ছা আপনার মোট কতটি সাদা বিলাই ছিল? বা আছে? সাদা বিলাই মানে গার্লফ্রেন্ড। আপনি তো আবার বিদেশী। এসব ছেলে একদম ফালতু ক্যারেক্টারের হয়। আপনার মা বিদেশী না কি বাবা? আমেরিকা দেশটা আমার ভালো লাগে না। শুধু আমার না মিতু আপু বা নীহু কারোরই ভালো লাগে না। তাই আপনার দেশ নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। আপনার সাথে তাযিন ভাইয়ের পরিচয় কিভাবে হয়েছে? উনি কেমন? সে আমাদের ভাই হয় অথচ ভয়ে তার সাথে কথাই বলতে পারি না। তাই তার সম্পূর্কে কিছুই জানি না। নীহু তো উনার নাম শুনলেও চেতে যায়। তবে আমি জানতে চাই। আর আপনার সামনে গেলে আমি সব ভুলে যাই। তাই চিঠিতে প্রশ্ন করছি। আপনি বাংলাদেশে এসেছেন কত বছর? এখন কি এখানেই থাকেন? যাবেন কবে? আল্লাহ আমি তো সব প্রশ্নই করছি। আচ্ছা থাক আজ আর কিছু বলার নেই। রাতের জন্য কিন্তু ক্ষমা করে দিবেন।
ওয়েট ওয়েট আপনাকে একটা কথা তো বলাই হলো না। আপনি যতই খারাপ শয়তান ধর্মী মানুষ হন না কেন আপনার কথা গুলো খুব সুন্দর। যখন তাযিন ভাইয়ের সাথে ঝাঁঝালো ইংরেজিতে কথা বলেন বিশ্বাস করুন আমি এত ভালো ইংরেজি পড়েও অর্ধেক বুঝি না। কিন্তু ভালো লাগে। দারুন ভঙ্গীতে আপনি কথা বলেন। তবে আপনি খুব শুকনো। খাওয়াদাওয়া করেন না নাকি? আমি খুব খেতে পছন্দ করি। তাই তো মোটু। আপনারও খাওয়া উঁচিৎ। এই হাড্ডির শরীর গনা যাবে। বেশি বেশি খাবেন। এত সাদা কেন আপনি? এত সুন্দর হওয়া উঁচিৎ নয়। আর আপনি যে আমার এত তারিফ করেছেন তা থেকে আমি যেটা বুঝেছি আপনার সৌন্দর্য ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। কালোদের সৌন্দর্য সব মানুষ খুঁজে পায় না। জানি আমি সুন্দর নই। কিন্তু আপনার চিঠি পড়ে মন চাইছে আমি সত্যি অনেক সুন্দর হয়ে পড়ি। আয়নায় দাঁড়ালে আমার ভালো লাগে। মনে হয় সত্যি আমি সুন্দর। তবে আর কখনো যদি আমার সাথে প্রেম করার চান্স খুজেন তাহলে খুন করে দিব। সাদা ছেলেদের সাথে প্রেম হারাম।
ইতি শ্যামক্যানা।
শান্ত স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুমুহূর্ত। তাকে তো সরাসরি অপমান করল মেয়েটা। কত বড় সাহস। তাকে ক্যারেক্টার লেস বুঝাল। তারপর আবার শয়তান, অশান্তি, ও মাই গড! তবে মেয়েটি খুব কথা বলতে জানে। শুধু সেটা প্রকাশ করতে চায় না। বাচাল একটা বলেই হঠাৎ হেসে উঠে সে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,’ মনে হয় না, আপনি সত্যি খুব সুন্দর শ্যামক্যানা। খুব বেশিই সুন্দর। আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে বিয়ে করে নিজেকে বিপদে ঠেলে দিতে। ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা না থাকায় আজ প্রথম খুব আফসোস হচ্ছে। তা না হলে আপনাকে বিয়ে করে জীবন কেমন হবে দেখে নিতাম। আমি কিন্তু মোটেও ফ্লার্টিং করিনি। আপনি সত্যি আমার দেখা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুন্দর চোখের মেয়ে। কিন্তু এটা সত্য আমার ক্যারেক্টারে একটু সমস্যা আছে। বেশি নয় শুধু একটু।’
চিঠি ভাজ করতে গিয়ে শান্ত দেখল তার হাতের সব রগ দেখা যাচ্ছে। হাড্ডি সত্যি গনা যাবে। এতে তার খুবই দুঃখ অনুভব হচ্ছে। তাহলে কি ফাবিহার তাকে পছন্দ নয়? তাও হাড্ডির জন্য? হেসে উঠে সে। সত্যি সে বেশিই শুকনো। হঠাৎ মনে পড়ে সে খুব রুডলি কথা বলেছিল শ্যামক্যানার সাথে। দ্রুত উঠে সে ঘরের ভিতরে যায়। নিজেকে নিজে ইংরেজিতে বলল,’ তুই একটা গাঁধা। ‘
_____________________
ঝিঁঝি পোকার বিলাপ ঠেলে মিতু আপু জঙ্গলে হাজির। বিন্দু মাত্র ভয় তার মাঝে কাজ করছে না। অথচ এই উনিই ভয়ে মরে যায়। এখন উনার দুনিয়ার কোন বস্তুকে ভয় লাগছে না। বিরাট শিমুল গাছের নিচে দাঁড়ালেন তিনি। ছায়াটা ক্রমেই এগিয়ে আসে কাছে। কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে কে জানে। মুখটা আবছা চাঁদের আলোতে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠে মিতু আপু। তিনি বুঝতে পারেননি যার কাছে যাচ্ছে সে এখানেই থাকবে। ভাউ করে শব্দ করে শাহিন ভাই। কয়েক সেকেন্ড দম বন্ধ করে থাকে মিতু আপু। দম ছেড়ে তিনি বললেন,’ এটা কেমন অসভ্যতা?’
‘ মজার অসভ্যতা। তা তুই এখানে আইছস ক্যান?’
‘ আপনি এখানে কি করছেন?’
‘ আমি জানতান তুই আইবি তাই অপেক্ষা করতাছিলাম।’
মিতু আপু একটু দূরে সরে যায়। তারপর বলেন,’ আপনার সাথে কথা ছিল।’
সন্দেহান চোখে তাকালেন শাহিন ভাই। দ্রুত বললেন,’ বল।’
দুই সেকেন্ডের মাঝে তিনি আবার চেঁচিয়ে বললেন,’ এখন বলিস না তুই বিয়ে করবি না। তোর পায়ে ধরলে আমার ইজ্জত যাইব। তা না হইলে মাফ চাইতাম। তবুও বিয়া ভাঙ্গীস না। মায়েরে অনেক কষ্টে রাজি করাইছি।’
‘ কে করাইতে বলছে? আমি? ‘
‘ তুই কি চাস আমি সারা জীবন চিরকুমার থাকি?’
‘ সেটা কখন বললাম। বিয়ে করে নিন।’
‘ সেটাই করতাছি। বউ রাজি হইতাছে না এহন আমি কি করুম? তুই ক?’ ঠোঁটের দুষ্টু হাসি মিতু আপু চাঁদের ক্ষীণ আলোতেও দেখতে পাচ্ছে।
‘ আমি বাদে দুনিয়াতে মেয়ে নেই?’
‘ আমার লাইগা তো নাই।’ নিচু কন্ঠে বলল শাহিন ভাই।মিতু আপু বিরক্ত হয়ে উঠেছে। শাহিন ভাইয়ের সাথে আগের মত কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দুই এক সেকেন্ডেই বিরক্ত হয়ে পড়েন তিনি। ব্যাপারটা ধরতে পেরে চুপ করে যায় শাহিন ভাই। মিতু আপুও চুপ। গাছে গাছে পাখিদের লাফালাফি ঝাপাঝাপির শব্দ। শিঁ শিঁ একটা শব্দ ভেসে আসছে। নিরবতার পর্দা ছিন্ন ভিন্ন করে মিতু আপু প্রলয়ের মত ঝড়ের সৃষ্টি করেছে নিজের কথার জাল দিয়ে। সহজ ভাষায় তিনি বলে উঠেন,’ আমি বিয়েতে রাজি। ‘
বজ্রের আঘাতের মত শরীরে আঘাত করে বসে কথাটি। শাহিন ভাই বিস্ময়ে কিংকর্ত্যাববিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন। আলো নেই বললেই চলে। অল্প আলোতে ভালো দেখা যাচ্ছে না। মুখের সেই ভঙ্গিমাটা মিতু আপুর চোখ এড়িয়ে গেল। তিনি চলে আসতে চাইলেন। এই কথাটাই বলার ছিল। হঠাৎ হাতে দীর্ঘদিনের বিন্দু বিন্দু করে সৃষ্টি হওয়া চেনা অস্পষ্ট অনুভূতির স্পর্শে থমকে দাঁড়ায় তিনি। অবিশ্বাস্য একটি হাওয়া তার হৃদয়ের লুকায়িত ব্যাথার উপরে আবার খোঁচা প্রয়োগ করে। ব্যথায় কেঁপে উঠা প্রানীর নেয় তিনিও কম্পিত হয়ে হাত সরিয়ে নিতে চায়। শাহিন ভাই হাঁটু ভেঙ্গে বসে বললেন,’ মাপ করা যায় না মিতুয়া? সব আগের মত করা যায় না? আমি আর তুই। আগের মত হওয়া যায় না?’
‘ বিয়ে করতে চাইছেন। করছি। বাড়ির সবাই চাইছে আমিও অনুমতি দিলাম। আর কি চাই?’
‘ ক্ষমা।’
মিতু আপু বিদ্রুপের হাসি হাসলেন। মুখে বললেন,’ কিছু জিনিসের ক্ষমা হয় না। আপনি জানেন না?’
‘ কেন হয় না? তুই করলেই হবে। এসবই ভাগ্য। কিছুই করার ছিল না আমাদের। আগের মত কথা বলনা মিতুয়া।’
‘ আগের মত আমাকে করে দিতে পারবেন আপনি? সেই আগের মিতুয়া?’ কন্ঠে প্রচন্ড অভিমানের পাহাড়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছে যেন শাহিন ভাই। তবুও বললেন,’ আমি চাই আগের মত তোর ভালোবাসা পেতে।’
‘ আগের মত সময় তো এখন নেই। সাথে আগের মিতুও নেই। তাহলে ভালোবাসা আগের মত থাকবে ভাবলেন কিভাবে?’
‘ ভালোবাসা পরিবর্তন হয় না মিতুয়া। শুধু সময়ের ধুলোবালি আর অভিমানের পর্দা উপরে জড়িয়ে যায় জঙ্গলার মত।’
‘ ধরে নিবেন সেই জঙ্গলা আর সরানো সম্ভব না।’
‘ তাহলে বিয়েতে রাজি কেন হয়ে গেলি?’ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলল শাহিন ভাই। মিতু আপু প্রচন্ড আক্রসে ধাক্কা প্রয়োগ করে কলার ধরলেন। চেঁচিয়ে বললেন,’ আপনি প্রস্তাব নিয়ে কেন হাজির হয়েছেন? কেন? আমার জীবনে কেন ফিরে এসে আবার তছনছ করে দিচ্ছেন? ফাইজলামি পেয়েছেন সবাই? যখন ইচ্ছে ভালোবাসব। যখন উচ্ছে দূরে চলে যাব। যখন উচ্ছে হবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিবেন যখন ইচ্ছে আবার সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে দিবেন। অন্যের জীবন এত সস্তা?’
‘ আমি প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গিনী। কথা দিয়েছি বিয়ে তো আমি করবই।’
‘ তাই না কি? যেই জিনিস জীবিত মানুষের জন্য করার কথা সেটা তার মৃত্যুর পরে করলে কি সমান হবে?’ মিতুআপু মাতালের মত হাসলেন। শাহিন ভাই তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার কাছে কথাই নেই।
‘ আগের মত হয়ে যেতে বলছেন তাই না? তাহলে আগের আমাকে ফিরিয়ে দিন। দিতে পারবেন? তাহলে আমি আগের মত হয়ে যাব।’
‘ সুযোগ দে।’
‘ যে প্রতিশ্রুতি তুমি রাখতে পারবে না সে প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়ে পাপীর খাতায় নাম লেখাবে না, আশা করি আপনার মনে থাকবে।’
‘ আর হ্যাঁ আমি এখানে আপনাকে ওয়ার্নিং দিতে এসেছি। আমাকে বিয়ে করলে আপনার জীবন জাহান্নাম হয়ে যাবে। বাঁচতে চাইলে বিয়েতে না বলুন। তা না হলে আপনার অবস্থা যে কি হবে তা ভেবেই আমার আফসোস হচ্ছে।’
‘ আমার হইতাছে না। আর হইবও না। প্রমিস।’
‘ প্রতিশ্রুতি দিতে মানা করেছি।’
‘ প্রেমিকদের কাজই প্রতিশ্রুতি দেওয়া। একটা না হইলে আরেকটা তো সে রাখতেই পারবে। তাই বেশি বেশি প্রতিশ্রুতি দিমু।’
শাহিন ভাই হাসল। মৃদুমন্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেই হাসি। চোখ বুজে শ্বাস নেয় মিতু আপু। জীবন বড্ড অদ্ভুতুড়ে। যা আমরা ভাবি তা হয় না। যা ভাবি না তাই হয়। এই বিয়েটা যদি আরও আগে হয়ে যেত? তাহলে অনুভূতি কেমন থাকত? আর আজ কেমন আছে? সত্যি অনেক পার্থক্য। অনেক। দূরের অন্ধকারে মিতু আপু মিলিয়ে যেতেই শাহিন ভাই গাছের নিচে বসে গেলেন। আজ রাত ভর তিনি এখানেই বসে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন। মিতু আপুর কথা গুলো তাকে খুব ব্যথিত করেছে। যা শুনে এত কষ্ট তা সহ্য করা কতটা কষ্টের ভেবেই নিজেকে মিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই গভীর কালো অন্ধকারে।” অনুশোচনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শাস্তি!”
__________________
শামা খালামনি একটু ঝুঁকে আফিয়াকে প্রশ্ন করেন,’ এই আমি শুনেছি মিতুর না কি ডিভোর্স হয়েছে? সত্য না কি?’
মন খারাপের প্রলেপ মেখে আফিয়া বিলকিস বললেন,’ হ বুবু। এত ভালো একটা মেয়ের সাথে আল্লাহ যে কেন এমন করল।’
‘ ওর বিয়ে হয়েছে কখন? এখনও তো বাচ্চাই লাগে আমার কাছে।’
‘ মাস্টার্স করছে। বিয়ে হইছে আরও অনেক আগে। তখন ইন্টারে ছিল সে মনে হয়। এখন তো আমরাই ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু মেয়েটা ভুলেনি। এত দিনে কত যে বিয়ের জন্য এসেছে বলার বাহিরে। একটাতেও রাজি হয়নি।’
‘ শাহিন নামের ছেলের সাথে কি ছিলোরে?’
‘ ওরা একে অপরকে পছন্দ করত। শাহিন ছেলেটা খুবই ভালো বুবু। কিন্তু যা হয়েছিল সেই সময়, তা বলে বুঝানো যাবে না। ‘
‘ মিতু এই বিয়েতে রাজি হইব?’
‘ মনে তো কয় না। আবার হইতে পারে হ। ‘
‘ না মনে হয় কা তোর? ‘
‘ শাহিনরে এখন একদম সহ্য করে না মিতু। ’
‘ আর হ কেন মনে হইল?’
আফিয়া বিলকিস হাসল। বললেন,’ জানি না বুবু। তা তোর বউমা তো বিদেশি জুটেছে।’
‘ হুম। বিদেশী বলতে জন্ম সেখানে। মেয়ের মা বাংলাদেশি। শান্ত আছে না ওর ফুফুর মেয়ে।’
‘ পরিচয় হলো কিভাবে?’
‘ বিমুগ্ধের আব্বির খুব ভালো বন্ধু শান্তর বাবা। সেখান থেকেই পরিচয়। এতবছর আমরা এক সাথেই থেকেছি। পাশাপাশি বাসায়। মেয়েটা ভালো হবে না?’
‘ অবশ্যই হবে। আমার তো পছন্দ হয়েছে দারুন। নামটাও সুন্দর। রূবাইদা। ‘
‘ নীহারিকা আর প্রিয়মের কথা বল। কত বড় হয়ে গেছে। নীহারিকাতো পুরাই মা। এত মিল কিভাবে সম্ভব। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি যখন শুনেছি। দেখে তো অবাক।’
‘ হুম ও মায়ের কপি পুরা। নাফিজ তো আম্মা বলেই ডাকে। তবে মেয়েটা খুব জেদী বুঝলি বুবু। কখন কি করে একদম ভাবে না। প্রিয়মকে নিয়ে চিন্তা নেই আমার। শুধু ওরে নিয়াই চিন্তা। ওর বাবাও ওকে টাইট দিতে থাকে ও নিজেও অবাধ্য হয় খুব।‘
‘ আমার যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত মেয়েই মনে হয়। তোরা দুইডাই মেয়ে গুলোরে নিয়ে বেশি চিন্তা করছ। তোদের লক্ষীমন্ত মেয়েগুলোকে দেখলে আমার নিজেরই চিন্তা হয়।’
‘ লক্ষী? তাও নীহু? তুই কিছু জানিস না বুবু। এই মেয়ে মারাত্নক সব কাজ করে বেড়ায়।’ আফিয়া খুব জোর গোলায় বললেন। শামা খালামনি বেশ উৎসুক হয়ে বললেন,’ কি করেছে? বাচ্চা মেয়ে সর্বোচ্চ কি আর করতে পারবে।’
‘ সব রকমের পাগলামি করতে পারে বুবু।’
শামা খালামনি হাসলেন। আফিয়া বিলকিস বোনের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল। চোখ পড়ে সামনের দিকে। মিতু আপুকে দেখে, পরিবারের সবার দৃষ্টি বিস্মৃত। তিনি খুব সেজে গুঁজে এসে হাজির। পরনে তার লাল টুকটুকে জামদানি। হেলে দুলে তিনি এসে সবার সাথে বসে। নীহারিকা এক কোনে বসেছিল। মিতু আপুকে দেখে সবার মুখের রংটা পাল্টে গেলেও নীহারিকার ভাবান্তর হলো না। সে বেশ চুপচাপ কোণায় বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে কি যেন ভাবছে। মিতু আপু চেয়ার টেনে টেনে পাশে এসে বলল,’ নীহু দেখ আমাকে কেমন লাগছে?’
নীহারিকা একবার চোখ তুলে দেখে বলল,’ ভাল লাগছে।’
মিতু আপু ঘোষনা করে পরিবারের সকলের উদ্দ্যেশে বললেন,’ আমি বিয়েতে রাজি। ‘
প্রথমে কেউ শুনল না। যে যার মত ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলছিল। ঠোঁটের হাসি আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন,’ মা নানু খালামনি মামা সবার উদ্দেশ্যে বলছি আমি বিয়েতে রাজি।’
সবার মাথায় যেন বর্জ্রের আঘাত পড়েছে। মুখটা চমকে উঠে নীল রঙ্গের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে আবার নিভে যায়।
‘ মানে ?’ ছোট খালামনি আগে বলল।
মিতু আপুর ভাব দেখে বুঝাই যাচ্ছে বড় কিছু মাথায় চলছে। নীহারিকার জহুরি নজর তা এড়িয়ে গেল না। ফাবিহা চমক ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করেই বসে। মিতু আপু ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন,’ আপনারা সবাই তারিখ ঠিক করতে পারেন। শর্ত একটাই। কোন অনুষ্ঠান হবে না। রাজি হলে বিয়ের ঢোল পিটাতে মন চাইলে পিটানোর ব্যবস্থা করুন। আর আমাকে এভাবে দেখাও বন্ধ করুন। আমি জানি আমি সুন্দরী। ‘
মিতু আপুর হঠাৎ বৃষ্টির ন্যায় পরিবর্তন হয়ে উঠা মেজাজ কারো বোধগম্য হলো না। নীহারিকা নম্র ভাবে প্রশ্ন করল,’ তোর মাথায় কি চলছে মিতু আপু? গুরুতর কিছু নিশ্চয়ই?’
মিতু আপু ঝুঁকে পিঠ লাগায় নীহারিকার বাহুর সাথে। স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে উঠেন,’ আমার বিয়েটাই তো গুরুতর নীহু। তার সাথে যুক্ত সব কিছুই হতে হবে গুরুতর।’
মামার হলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে ছোট করে। কিন্তু তাতে হয়েছিল আনন্দ। রূবাইদার জীবনে সে দুটি মাত্র বাংলাদেশের বিয়ে দেখেছিল। একটি ছিল তার ছোট মামার। আর অন্যটি তাযিনের মামার। বাদ বাকি বিয়ে সে বিদেশেই দেখেছে। তার বেশি আনন্দ হয়েছে। সে যখন চারপাশের গ্রামীন জীবনের হাস্যউজ্জ্বল বিয়ে দেখতে শুরু করল সে বুঝতে পারল খুব কোলাহল পূর্ণ হলেও অসম্ভব হইহুল্লোড় আমেজে মাতা বিয়ে ছিলো এটি। সে খুব উপভোগ করতে শুরু করল। রূবাইদার কন্ঠ মিহি। দারুন সুন্দর। সে একটি ইংলিশ গানও গেয়েছে। মিতু আপু নাচে ভাল। ফাবিহা গান পারে ভাল। সবাই কিছু না কিছু স্পেশাল করেছে। কিন্তু খুবই করুন ব্যাপার হলেও সত্য নীহারিকা এসব কিছুই পারে না। ছোট থেকেই নাচ গানের প্রতি তার বেশি অনিহার কারণে বাবা মা কেউ তাকে জোর করেনি। বাবা এসব পছন্দও করেনা তেমন। তাই সে এসবে আরও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সবার মাঝের গুনাবলি দেখে নীহারিকা অনুভব করল ইশ সে তো কিছুই পারে না। হয় তো কিছু মোটা বই সে গিলতে পারে। কিন্তু সে রূবাইদার ধারে কাছে যায় না। মেয়েটা যেমন সুন্দর তেমন প্রতিভার অধিকারী। আবার নীহারিকা ভাবে সে হঠাৎ তুলনার পাল্লায় পড়ল কেন? সে তো কখনো নিজের সাথে কম্পেয়ারের ব্যাপারটা মিলাতে পছন্দ করে না। তাহলে আজ কেন তার মনে হচ্ছে ইশ গানটা একটু পারা দরকার ছিল। তবে এসব নিয়ে সে বেশি ভাবল না। তার মাথার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুঁটে বেড়াচ্ছে তাযিন বিমুগ্ধ। মনে তার হাজার প্রশ্ন। সে তো খানিকটা নিশ্চিত যে মুহিতা কথাটা পুরোপুরি সত্য বলেনি। যদি দু’জন আলাদা মানুষই হয় তাহলে শামা খালামনি কেন একই ব্যক্তিকে দুই নামে ডাকে? তাদের বন্ধু মহল এক, কি করে হতে পারে? বা তাদের চেহারার এত নিখুঁত মিলই বা কি করে? মিতু আপুর ঝাঁকিতে হুশ ফিরে। রিনরিনে গলায় তিনি জিজ্ঞেস করে,’কি হইছে তোর? এমন করে রাখছস ক্যান মুখটা? এই জাওয়াদকে দেখা যাচ্ছে না কেন রে? অনেক সময় নিয়ে তার দেখা মিলছে না। কাহিনী কি?’
নীহারিকা বিরক্তের সহিত বলল,’ আমি জানি না। পৃথিবীর সব মানুষের খবর তো আর আমার কাছে নেই।’
‘ সব মানুষের খবর রাখতে কে বলেছে তোরে? শুধু নিজের মানুষের খবর নিবি। বুঝতে পেরেছিস?’
মিতু আপু ঠোঁট টিপে চোখ নাচায়। নীহারিকা অবাক হয়ে ভাবে এই মেয়েটাই কিছুক্ষণ আগে কেঁদে রেগে একাকার ছিল। ভাবা যায়? অবশ্যই হঠাৎ কেউ দেখলে মোটেও ভাবা যায় না। মিতু আপু আবার চারপাশে তাকিয়ে বলল,’ ভাই তাযিন ভাই কই?’
এবার নীহারিকা যথেষ্ট গরম শ্বাসে উত্তর দিল,’ আমি জানি না।’
‘ শুনেছি উনার দুইটা ফ্রেন্ড গায়েব হয়ে গেছে। মানে চলে গেছে।’
‘ ভাল হয়েছে। তুই চুপ থাক।’
‘ আচ্ছা তোর উনাকে কেমন লাগছে? উনি কি ভালো? না কি খারাপ?’
‘ এতে আমাদের কি?’
‘ আরে ভাই হয় তো। বল না।’
নীহারিকা রাতের আধারের দিকে তাকিয়ে বলল,’ অসভ্য একটা।’
‘ সিরিয়াসলি? তোর সাথে কি অসভ্যতা করেছে? বল বল শুনি।’ মিতু আপু খুবই আগ্রহীত। নীহারিকা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’ ছেলেটা জঘন্য। উনাকে একদম সহ্য হয় না আমার। কেমন বাজে ব্যবহার করে দেখলি না। কাউকে সম্মান করে না। বিদেশে ছিল কতই বা আর ভালো হবে। ইতর নাম্বার ওয়ান। সাথে বদমাইশ।’ মিতু আপু চুপ করতে ইশারা করে। নীহারিকা পাত্তা না দিয়ে মনের যত বিশ জমা ছিল সব ঢালা পদ্ধতিতে মুখের ভাষা ছড়িয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল,’ চুপ করতে বলছিস কেন? উনি আসলেই অসভ্য। আমার দেখা এখন পর্যন্ত সেরা বেয়াদপ। আকড়ু একটা। মুখটা অপ করে ফুলিয়ে রাখে। যাস্ট শয়তান একটা। দেখ আপু তুই বার বার চুপ করতে বলবি না। তুই যদি ভাবিস বড় ভাই বলে আমি অতিবমাত্রায় এই বেয়াদপকে সম্মানীত করে আকাশে বাতাশে উড়িয়ে দিব তাহলে ভুল ভাবছিস। মাথা ব্যথা করে রেখেছে আমার। ওহ অসহ্য। এসব ছেলেদের আমি পাত্তাও দি না। বান্দর। আমাকে এই আমাকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এই অসভ্যটা।’
‘ নীহু বোন আমার চুপ কর।’
‘ কেন করব?’
‘ করতে বলেছি তাই।’
নীহারিকা হেসে উঠে বলল,’ এখন বলিস না যে উনি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘ এটাই বলতে চাচ্ছি।’
নীহারিকা হাসতে গিয়েও আর হাসল না। মিতু আপু খুবই সাবধানে উঠে যায়। নীহারিকা জোর করে ঠোঁটজোরা টেনে রেখে পিছনে ধীরে ধীরে তাকায়। তাযিন দু’পকেটের ভিতরে হাত পুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শান্ত কন্ঠে সে জানতে চায়,’ আমি বেয়াদপ? অসভ্য? ইতর? আরও কি কি যেন বললেন আপনি?’
নীহারিকা চুপ করে যায়। চারপাশে জায়গা খুঁজে, সে পাশ কাটিয়ে গায়েব হয়ে যেতে নেয়। তাযিন জায়গা মত দাঁড়িয়ে। নীহারিকা চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে বলল,’ সব শুনেছেন?’
‘ মনে তো হচ্ছে।’ তাযিনের তিছড়া চোখ দেখে কিছু সময়ের জন্য নীহারিকার ভয় হতে শুরু করল। তবে তা বেশি সময় রইল না। গলায় জোড় চাপিয়ে সে বলল,’ হ্যা বলেছি। তো কি করবেন? আপনি এসব তাই আমি বলেছি। আর আপনি যদি ভাবেন আমি এসব বলে অস্বীকার করব বা আপনাকে ভয় পেয়ে কথা ঘুরিয়ে বলব তাহলে ভুল ধারণা। আমি সোজা কথা সোজা ভাবে বলি। রাস্তা ছাড়ুন।’
তাযিন হাসল। সে খুব অবাক হওয়ার ভাব নিয়ে বলল,’ আপনি তো ভারী অদ্ভুতুরে মেয়ে।’
‘ যেমন?’
‘ কখনো আপনি গর্তের গভীরতার মত সম্মান প্রদান করেন। কখনো আবার যত্নের চিন্তার সমুদ্রে ভাসান। মাঝে মাঝে খুব বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করেন।’
‘ আমি বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করি?’ ঝাঁঝাল কন্ঠস্বর নীহারিকার। তাযিন বুঝল সে রাগীয়ে দিয়েছে। মনে মনে খুব হাসলেও মুখে তা প্রকাশ না করে গুরুগম্ভীর হয়ে বলল,’ হুম করেন।’
‘ অসভ্য স্বাদে বলি? মেয়েদের সাথে কথা বলতেও আপনি পারেন না। রূবাইদা আপুকে কি এই চেহারা দেখিয়ে পটিয়েছেন?’
‘ আমার পটাতে হয় না। চেহারা দেখেই পাগল হয়ে যায়।’
নীহারিকা বীভৎস হাসি হাসল। খুব হাস্যকর কোন কৌতুকে মানুষ যেভাবে হাসে। ঠিক সেভাবে। তাযিন কিছু বলল না। নীহারিকা নিজে থেকে বলল,’ আপনার চেহারা বুঝি নায়কের মত? কোন এঙ্গেল থেকে বলুন তো?’
‘ নায়কের মত চেহারা হলেই যে মেয়ে পটবে কে বলেছে আপনাকে? জাওয়াদ তো দেখতে নায়কের চেয়েও ভাল উনি কি আপনাকে কাবু করতে পেরেছে?’
নীহারিকা মনে মনে বিড়বিড় করে। এই লোক জাওয়াদে টপ করে চলে যায় কেন? শত্রুতা আছে না কি? তাযিন কথা ঘুরিয়ে বলল,’ মিতুয়ার মাথায় কি চলছে? ‘
নীহারিকা অবাক হয়ে বলল,’ মানে?’
‘ আপনি তাহলে জানেন না। আমি নিশ্চিত তার মাথায় কিছু চলছে। সেটাই খুঁজে বের করতে বলছি। বের করুন।’
‘ কিছু চলছে না। উনি ছেলেটিকে ভালোবাসত তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। এত প্যাঁচাচ্ছেন কেন? যতসব।’
তাযিন তীর্যক চোখে মিতু আপুকে কিছুসময় দেখে। তারপর মৃদূ হাসির রেশ মেখে বলল,’ মানুষ চিনে নেওয়ার তাগড়া অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার।’
‘ তাহলে আপনি নিজেই খুঁজে বের করুন। বিরক্ত করছেন কেন আমাকে?’
নীহারিকা সত্যি বিরক্ত। লোকটিকে তার একদম পছন্দ নয়। কি, কেন, কিভাবে সে বুঝে না। শুধু জানে এই লোকের ব্যবহার, কথা বলা সব তার অসহ্য অনুভূতির জন্ম দেয়। হঠাৎ মনে পড়ে সে তো এই মানুষটার সাথে কথা বলবে না বলেছিল তাহলে এখন কেন বলছে? তাযিন চলে যেতে যেতে থেমে যায়। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে উঠে,’ আপনার কাকে বেশি পছন্দ তাযিন না কি বিমুগ্ধ?’
নীহারিকা চমকে উঠে। তার সেই চমকিত মুখ দেখে তাযিন ঘুরে তার মুখমুখি দাঁড়ায়। অল্প সময়ে খুব কাছে চলে আসে। নীহারিকার চোখে রাখে চোখ। দু’টি অদ্ভুত চোখ। নীহারিকা এই চোখ খুব কাছ থেকে দেখেছে। তার ভুল হতেই পারে না। গভীরতায় আবৃত চক্ষু জোড়া। শান্ত শীতল বরফের ন্যায় চোখ। আলোর ফলে সেটি চকচক করছে। নীহারিকার চোখের পাতা একবার নিভে। আবার সে তাকিয়ে থাকে। দু’জনের মাঝের কোন কথা নেই। মানুষের জমজমাট আমেজের রেশ যেন গায়ে এসে লাগছে না। শামাখালামনি দূর থেকে ডাকলেন বিমুগ্ধ বলে। নীহারিকা নিচু কোমল গলায় সেটি অনুকরণ করে উচ্চারন করল,’ বিমুগ্ধ।’
তাযিন তখন ঈৎষ হাসল। শামা খালামনি দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,’ তোমার আব্বি কল করেছিল। বলল তোমাকে না কি কলে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন কই?’
তাযিনের মনে পড়ে ফোন তো সে ঘরেই রেখে এসেছে সে দ্রুত গতিতে জায়গা ত্যাগ করে। অনেকটা দূরে গিয়ে সে একবার নীহারিকার দিকে তাকায়। বেশি সময় নষ্ট না করে দ্রুত সে ছাদ থেকে নেমে পড়ে। শামা খালামনি হেসে বলল,’ আব্বির জন্য পাগল ছেলেটা।’
নীহারিকা বলল,’ খুব ভালোবাসে?’
‘ অসম্ভব পরিমাণে।’ আনজুমের কথায় নীহারিকা পাশে তাকায়।
‘ মানুষ তো বাবাকে ভালোবাসে। আমার দাভাই আব্বির জন্য পাগল। এক কথায় তার জীবনের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার অংশ জুড়ে আব্বির স্থান। আম্মির জন্য তো তার অর্ধেকও নেই।’ আনজুম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসল। শামা খালামনিকে ঈর্ষান্বিত দেখাল।আনজুম নীহারিকাকে বলতে শুরু করল,’ আব্বি যদি দা ভাইকে বলে যে তুমি এই মুহূর্তে এখান থেকে ঝাঁপ দেও আমি নিশ্চিত সে দিবে।’
নীহারিকার চোখ বড় হয়ে আসে। সে ভারী আশ্চর্য হয়ে বলল,’ সিরিয়াসলি?’
‘ অবশ্যই। দাভাই তার অনেক প্রিয় জিনিস আব্বির জন্য বাদ দিয়েছে। তার মনে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই সে সবের জন্য। আব্বি বলেছে বাদ মানে বাদ। শেষ কথা।’
নীহারিকা ইন্টারেস্ট অনুভব করল। একটু ব্যাঙ্গ করে বলল,’ এত ভালো ছেলে পৃথিবীতে আছে?’
‘ আছে। আমার দা ভাই তো তেমনই। ভাই তখন টেনে পরীক্ষা দিয়েছে। আম্মির কাছে বাইক চেয়েছিল। তো তিনি কিনে দিয়েছে। এবার ভাই তো শান্ত ভাইয়া তারপর তার আরও ফ্রেন্ডদের নিয়ে চালানো শিখে ফেলেছে। তারা রোজ বাইক নিয়ে বের হত। আব্বি একটু ব্যস্ত। তাই তেমন একটা বাইকের কথা জানত না। কিন্তু যখন জানতে পারল দাভাইকে সাথে সাথে নিষেধাজ্ঞা জারী করল। আমার তো বিশ্বাসই হলো না দাভাই একবলায় নিজের চাবি দিয়ে দিল আব্বিকে। করণ বাইক তার অনেক অনেক প্রিয় ছিল। বুঝ এবার কতটা বাবা ভক্ত সে।’
নীহারিকা হেসে ফেলল। সে তো এমন এক মেয়ে বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে না বলেই পালিয়েছিল। ভাবতেই তার অবাক লাগছে। তাযিন এত ভালো ছেলে? ও মাই আল্লাহ। নীহারিকা হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ আপনারা ভাই বোন কয়জন?’
আনজুম খুব হাসল। বলল,’ এতদিন পড়ে এটা জিজ্ঞেস করছ তুমি?’
‘ না মানে এমনেই কৌতুহল জেগেছে।’
‘ আমি আর দাভাই বাদে আর কেউ নেই। দু’জনই।’
‘ আপনি শিউর?’ নীহারিকার এমন অদ্ভুত প্রশ্নে আনজুম থ বনে গেল। নিজের ভাই বোনের সংখ্যা বলতে তার শিউর হতে হবে? ভারী আজীব তো। নীহারিকা নিজেকে সামলে চাপা হাসল। আনজুম ভাবল মজা। মনে মনে খুব ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে নীহারিকা। তাকে এভাবে বকা বানানোর মানে কি? ফাইজলামী যেন সব। তাযিন এবং তার বন্ধুবান্ধ সবকটাকে অসভ্য আর মিথ্যুক বলেই মনে হলো তার।
______________________
সাদা পাঞ্জাবী গায়ে তাযিন বিছানায় ঘুমচ্ছে। তিশা বেশ রাতেই তাদের রুমে এসে হাজির। ব্যাপারটায় অর্পণ প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল,’ তোর সমস্যা কি? এত রাতে ছেলেদের রুমে কি কাজ?’
তিশা বেশ হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে। হাসি মুখে সে সব রাগ গিলে নিতে পারে। তা যদি হয় অর্পণের দেওয়া তাহলে তো সে খুশি খুশি হজম করবে। উত্তরে সে উচ্চ হেসে বলল,’ কথা ছিল।’ কণ্ঠ এবং হাসির দিক দিয়ে তার উচ্চ গলাটা অর্পণের সহ্য হয় না। সে বেশ রূক্ষ স্বরে জানতে চাইল,’ কি কথা?’
‘ দাঁড়া শান্তরে উঠাই।’ তিশা নিজের হাতে শান্তর শরীর স্পর্শ করতে যাবে সাথে সাথে অর্পণ হাত ছুঁড়ে বলল,’ বিশ্বাস কর মন চায় তোকে লাথ্থি মারি।’
‘ ক্যান ক্যান?’
‘ কারণ তুই বেয়াদপ। তা না হলে একটা ছেলের গায়ে হাত দিতে যাস কিভাবে?’
‘ আমি তো ডাকছিলাম।’
অর্পণ খুবই সচেতন ছেলে। সাথে একটু ত্যাড়া। তিশাকে ডাকতে না দিয়ে সে নিজেই শান্তকে কয়েক বার ডাকল। ধাক্কাল। জোরে জোরে কানের কাছে ডাকল। শান্ত শুনেও বালিশ কানে দিয়ে শুয়ে রইল। যা দেখে অর্পণ রেগে আগুন। হঠাৎ তাযিন লাথি মেরে শান্তকে ফেলে দিল। যা দেখে অর্পণ চাপা হাসল। শান্ত চেঁচাতে চেঁচাতে উঠে বসে বলল,’ তুই যতই বলিস যে অর্পণ তোর শত্রু আমি এটা বিশ্বাস করি না। ঠিক এই কারণেই। হালা ঘুমের মাঝেও অর্পণের ফাঁটা গলার প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়লি। হারামী।’
তাযিনের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। সে গভীর ভাবে ঘুমিয়ে থাকলেও তার কান খরগশের মত খাঁড়া থাকে। সারা ক্লাস সে ঘুমাত। কোন স্যার যদি লেকচারের মাঝে তাকে প্রশ্ন করত,’ বল কোথায় পড়াচ্ছি?’ সবাইকে অবাক করে সে সাথে সাথে বলে দিতে পারত। এমন কি, কি পড়াচ্ছে সে সবও বলে দিতে পারত। ফলে সে খুব কম শাস্তির সম্মুখিন হয়েছে। অর্পণ মনে মনে খুব আনন্দ অনুভব করলেও তা প্রকাশ করল না। শান্ত উঠে বিছানায় বসে বলল,’ ফকিন্নির ঝি বল কি বলবি।’
তিশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,’ তোরা এমন করিস কেন? কেউ তো সুন্দর করে কথা বল।’
শান্ত এবার খুব বিনিত সুরে, হাত জোর করে বলল,’ আমার আম্মার আম্মা আপনার মনে যদি একটুও দয়া হয় তাহলে আমাদের মত নাতিদের উপরে দয়া বর্ষণ করতে করতে আপনার মুখের সেই মিষ্টি ভাষা বের করুন। এবং বলুন কেন এসেছেন? আর আমাকে ঘুমাতে দিন।’
শান্তের চোখ লাল। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। তার রসিকতা দেখে তিশা হেসে ফেলল। পাশে বসে বলল,’ ধর তুই কাউকে ভালোবাসিস।’
সাথে সাথে শান্ত লাফিয়ে উঠে বলল,’ আমি মোটেও ফাবিহাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসার ফাংশন তো আমার হৃৎপিণ্ডেই নেই। সবচেয়ে বড় কথা তোর ভুল হচ্ছে।’
অর্পণ এবং তিশা ভ্রু কুঁচকালো। শান্ত আবার বলল,’ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? পছন্দ বলেছি। ভালোবাসি তো বলিনি। আমি কি চোর যে তোরা এভাবে তাকাবি?’
তিশা চিমটি কাঁটল শান্তর রোগা শরীরে। মৃদূ নাটকীয় ভঙ্গিতে শান্ত চেঁচিয়ে উঠল,’ রাক্ষসী নি কোন?’
‘ হ আমি রাক্ষসী। আর ফাবিহার নাম একবারো নিছি আমি? ভাই তুই যে না ঘুমাই ওই মাইয়ার কথাই ভাবতাছস আমি জানি।’
‘ ওর নাম ফাবিহা।’ তাযিনের ঘুমের মাঝের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে চমকে গেলে তিশা। বলল,’ হইছে তুই ঘুমা। যা বলতে আসছি দ্রুত শুন তোরা। ধর তুই কাউকে ভালোবাসিস। এবং তুই এটাও জানিস যে তাকে তুই পাবি না। রিজেক্ট হওয়ার ভয়ে তুই ভালোবাসার কথা তাকে বলতে পারছিস না। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে বলা উচিত কি না?’
অর্পণ ছোট চোখে তাকিয়ে উত্তরে বলল,’ অবশ্যই বলা উচিত নয়। যেখানে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেখানে বলে শুধু শুধু নিজের ইজ্জত খারাপ করার কোন মানে নেই।’
শান্তের দ্বিমত ,’ বলা উচিত । কারণ হতে পারে বলার মাধ্যমে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা না বললে সারা জীবন আফসোস হবে। ইশ যদি বলে দিতাম। আফসোস করে বেঁচে থাকার চেয়েও বলে হারিয়ে ফেলা উত্তম।’
এমন উত্তর যেন তিশার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। সে ঝাঁপিয়ে শান্তকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে শান্ত ছিটকে দূরে সরে বলল,’ এই মুটকি আমাকে মারার প্লান করে এসেছিস বুঝি? তোর মত মিনি হাতি গায়ের উপরে পড়লে আমার মত মিনি পিঁপড়ার কি হাল হবে একবার ভাব। দূর হ।’
ক্ষেপা গলায় অর্পণ বলল,’ এমন বেহুদা প্রশ্ন করতে এত রাতে তুই রুমে হাজির হয়েছিস? এটা তো তুই নিজে নিজেই চিন্তা করে নিতে পারতি। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত গ্রহন কেন্দ্র হচ্ছে হার্ট। এই হৃৎপিণ্ড যা বলবে তাই শুনবি। মনের কথা পৃথিবী বিখ্যাত।’
তিশা লুটিয়ে পড়ার একটা অভিনয় করে বলল,’ তুই এত সুন্দর করে কথা বলছিস কেন? দোস্ত তাইলে তো আমি হার্ট অ্যাটাক করমু। পরে সার্জারি কিন্তু তোকেই করতে হবে।’
‘ আমি সব সময় সুন্দর করেই কথা বলি। তোর কানে সমস্যা। কথা গুলো পৌছয় না।’
‘ কিন্তু যাকে বলব সে যদি আমাকে খারাপ ভাবে?’
তিশা নখ কামড়াতে লাগল। অর্পণ আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,’ এমন রিয়েক্ট দিচ্ছিস কেন? মনে তো হয় না যার কথা তুই বলছিস তাকে তুই এতটা ভালোবাসিস।’
‘ অর্পণ।’
‘ ওহ তোর গলা আমি কোন একদিন ছিঁড়ে ফেলব, গরু। একজীবনে পৃথিবীর সবার কাছে ভালো হওয়া যায় না। যাকে তুই পাবিই না সে খারাপ ভাবলেও কিছু যায় আসে না। ভালো ভাবলেও যায় আসে না। আর যাকে তুই পেয়েই যাবি সে তো আর তোকে নিয়ে খারাপ ভাববে না। দুই দিকেই নো লস।’
কখন যে তাযিন উঠে বসেছে কেউ লক্ষ্য করল না। শান্ত আর তিশা খুবই মনোযোগী। তাদের ভাবটা এমন যেন তারা গুরুত্বপূর্ণ লেকচারের স্বাক্ষী হচ্ছে। অর্পণের মুখে একটা দাপুটে ভাব।
‘ তোর মাথা ভর্তি এত বুদ্ধি কবে থেকে অবস্থান করছে? আমি তো তোরে আপাদমস্তক গাঁধাই ভাবতাম।’ শান্তর কণ্ঠে অবাকতার উপস্থিতি দেখে অর্পণ বাঘের মত ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’ আমি একজন ডাক্তার। তুই এভাবে অপমান করার সাহস কই পাস? তুই তো একটা গরু, ছাগল, সাথে ইডিয়েট। কিছুক্ষণ আগেই তো কাঁদতে বসে ছিলি। ফাবিহা কথা বলেনি দেখে।’ ইজ্জতের এমন খারাপ অবস্থা দেখে শান্ত নিচের সেন্ডেল খুলে ছুড়ে মারল অর্পণের গায়ে। অর্পন আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল। শান্ত দ্রুত মুখ চেপে বলল,’ তিশা বাহিরে যা। তোর কাম তো শেষ। যারে ভালোবাসিস তার গলায় ঝুলে পর। এখান থেকে যা।’
অর্পণের মুখ লাল হয়ে উঠে। তিশা হাসতে হাসতে বেরই হয়ে যাচ্ছিল। তাযিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল,’ বলে দিলে কি বুকের ব্যথা কমবে?’
শান্তর হাতে কামড় বসিয়ে অর্পন বলল,’ তোর বুকে ব্যথা হচ্ছে কি? আগে বলিস নাই কেন? এদিকে আয় চেক করি।’
অর্পণ বুকে হাত দিতেই তাযিন ক্রোদ্ধে ফেঁটে পড়া চোখে তাকিয়ে বলল,’ ধুর হারামী। দূরে থাক। ভবিষ্যৎ ওয়াইফ জানলে তো আমার উপরেই সন্দেহ করবে। আমি জানি তোর চরিত্রে প্রবলেম আছে। তাই বলে কি আমারও আছে মনে করেছিস না কি? সর।’
হাতটা একদম ভাঙ্গার মত যন্ত্রণা হতেই অর্পণ হালকা নড়ল। প্রচন্ড ব্যথা পেলেও সে হাত ছাড়াতে তাযিনের উল্টো হাতে অ্যাটাক করে। দুজনের প্রায় দস্তাদস্তি শুরুই হচ্ছিল। হঠাৎ তাযিন ছেড়ে দিয়ে বলল,’ তুই হার্টের ডাক্তার না?’
অসহ্য কর অনুভূতি প্রকাশ করে অর্পণ বলল,’ আমার তো তাই মনে হয়।’
‘ তাহলে তুই দেখ তো। আমার হার্ট প্রচন্ড লাফালাফি করে। দম বন্ধ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে একটা চাপা ব্যথা অনুভব হয়। কারণ কি?’
অর্পণ প্রথমে চেকই করতে যাচ্ছিল। পরে কি মনে করে বলল,’ তোরা বাহিরে যা আমি একা কথা বলতে চাই।’
শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল,’ তোর কি সত্যি চরিত্রে প্রবলেম আছে? না কি আমার সাথে দেখা হওয়ার আগে ছিল?’
চোখ রাঙ্গানী ছুঁড়ে দিতেই শান্ত গিজগিজ করতে করতে তিশাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তিশা থেমে বলল,’ যাকে আমি ভালোবাসি তাকে মনের কথা চিঠিতে বললে ভালো হবে না কি মুখে?’
‘ আমার মাথা দিয়ে বল। গরু। যা ভাগ।’ ধমকের সুর অর্পণের। তিশা জিভ কাঁটল। শান্ত তিশাকে ঠেলে বের করে তাযিনের কানে কানে বলল,’ তিশার মত পাগল আমি বাংলাদেশে না আসলে মিস করতাম। যাকে সে ভালোবাসে তার কাছেই জানতে চাইছে কিভাবে ভালোবাসার কথা বলবে। সো ফানি।’
তাযিন আবার চুপ করে রইল। তার গোমড়া মুখ দেখে শান্ত নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল। তাদের দু’জনের মাঝের কোন কথাই শান্ত তিশা শুনতে পেলো না। তবে তিশা খুবই করুন ভাবে কান চেপে রেখেছিল দরজার কাছে। সব নিষিদ্ধ জিনিসে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের আগ্রহ বোধ হয় একটু বেশিই।
____________________
রিনিঝিনি বাতাসে নড়েচড়ে উঠছে গাছের সবুজে অবৃত নৌকোর মত পাতা গুলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা এসে টুপ টুপ করে মিশে যাচ্ছে শরীরের সাথে। কয়েকটি বেসামাল বিন্দু কণার ন্যায় ক্ষুদ্র ফোঁটা অধর যুগল ছুঁয়ে দিয়ে আনন্দ করছে। দূর দূর গাছের সমারহ। গ্রামের গায়ে একটি আলাদা মিশ্র সুন্দরী গন্ধ বাস করে। চিবানোর মত সাদ সেই গন্ধে থাকে। খাবারের স্বাদ যেমন চিবানোর ফলে একটু একটু করে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমন শ্বাস যত গভীর হয় ঘ্রাণ তত ছড়িয়ে পড়ে। মস্তিষ্কে, হৃৎপিণ্ডে, শরীরে, হাড়ের মাঝে মাঝে। যখন সেই ঘ্রাণের শরীর বেয়ে বৃষ্টির ঘ্রাণ যুক্ত হয় তখন তা মোহনীয় হয়ে উঠে। নেশা ধরানো অনুভূতির জন্ম দেয়। বৃষ্টি এমনই। নিজের সাথে সে অন্যকে এমন ভাবে ভিজিয়ে দেয় যে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য সে। যেমন এখন নীহারিকা তার প্রেমে পড়েছে। পড়তে বাধ্য হয়েছে। বৃষ্টিকে সে সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে ভিজা, কাঁদা কাঁদা ভাবত। কিন্তু বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে বুঝিয়ে দিল সে কতটা সতেজতা বহন করে। এই অনুভূতির মালিক কিন্তু অন্য কেউ। নীহারিকা জানে। কিন্তু সে এখন শুধু বৃষ্টিকে অনুভব করতে চায়। শুধু তাকে। তার ফোঁটার মত মুক্তদানাকে। হাতটা বাড়িয়ে দেয়ে নীহারিকা। আগে তার তারা দেখতে ভালো লাগত। তাই রাতে সে মেঘ সহ্য করতে পারত না। অথচ এখন তার রাতের আকাশ ভর্তি মেঘের রাজত্ব পছন্দ। মানুষের মন পৃথিবীর সবচেয়ে আজব জিনিস। পরিবর্তনশীল খুব। চোখ বন্ধ করে নীহারিকা। হঠাৎ বাতাসের তীব্র ছাপটায় চোখ মুখ ভিজে যায়। মাথার ডান পাশের রগ লাফাতে লাফাতে তাকে ভাবায়, আচ্ছা সে যদি সেদিন লোকটির সাথে পালিয়ে যেত! ব্যাপারটা কেমন হত? নীহারিকা নিজে নিজে হাসল কিছু মুহূর্ত। এক রাতের পরিচিত ব্যক্তিকে তার এতই ভালো লাগল যে সে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা আজও করছে।
‘ প্রেম মানে বুঝেন?’
চোখ খুলে নীহারিকা পাশে তাকায়। তেছড়া চোখে কয়েক পলক দেখে সে আবার আগের ন্যায় সামনে তাকায়। গলা শীতল করে তাযিন বলল,’ নীহারিকা! রাইট।’
কথাটা শুনেও কিছু বলল না নীহারিকা। নিজের সাদা ওড়না টেনে দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসল। নিরব থাকতে চাওয়া তার আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। তাযিনের আচরণ অদ্ভুত। সেও বসল। এবার নীহারিকা একটু চমকাল। তাযিন নিঃশব্দে একটু একটু পাশে ঘেঁষে বসল। নীহারিকা এবার মুখ খুলে অস্ফুটে জানতে চাইল,’ কি?’
তাযিন হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠল,’ আপনার নামই তো নীহারিকা? মহাজাগতিক মেঘ। তাই না? ‘
‘ না। কুয়াশা।’
কথায় দম আছে। তাযিন চোখ ছোট করে। পাঁচ আঙ্গুলের থাবা দিয়ে মাথার চুল ঝাকরে নেয়। মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,’ তাই ধরা যায় না।’
মুখ শক্ত করে নীহারিকা বলল,’ হুম।’
‘ তবে আমি মেঘ ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েছি অনেক। তাই কুয়াশা মেঘ আমার কাছেই থাকে।’
‘ ফালতু বকা বন্ধ করে যেতে পারেন।’
বৃষ্টির বেগ একটু তিব্র। ভিজে যাচ্ছে দু’জনই। নীহারিকার গায়ে সাদা জামাটা পানি পানি হয়ে যাচ্ছে। আজ হলুদে নীহারিকা অদ্ভুত ভাবে সাদা রং পড়েছে দেখে সবাই অবাক হলেও মা হলেন না। তিনি জানে হলুদের সাথে নীহারিকার চরম শত্রুতা আছে। সে হলুদ থেকে দূরে পালায়। কিন্তু তাযিন কেন সাদা পড়ে এসেছে? আড়চোখে নীহারিকা দেখন পাঞ্জাবীর রং সাদা। এই ছেলে নীরঘাত পাগল। তা না হলে হলুদ শেষে পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে কেন? হাতা গুলোও ভাজ করেছে অনেক উপরে করে। পাঞ্জাবিতে সাদা সুতোর মিহি কাজ। ভ্রু কুঁচকাল নীহারিকা।
‘ আমি ঘুমানোর সময় পাঞ্জাবী পড়ি। আব্বির মত।’
মৃদূ হিম হিম বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে নীহারিকা বলে উঠল,’ আপনি আপনার বাবাকে ভালোবাসেন খুব তাই না?’
মুখের দিকে ফিরে তাকায় তাযিন। বৃষ্টির কারণে চোখ সম্পূর্ন খুলে রাখা কষ্ট কর। তবুও তার চোখ একদম স্বাভাবিক। কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে না। নীহারিকা অবাক চোখ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাযিন খুব সহজ ভাষায় নরম কণ্ঠে বলে ফেলল,’ আমি আপনাকেও ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি।’
নীহারিকার কানে কথাটা বিজলীর মত শব্দ করে উঠল। উত্তেজিত হয়ে সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়েই রইল। হঠাৎ যেন তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শ্বাস রূদ্ধ করে সে খোলা চোখে তাযিনকে দেখল অনেক সেকেন্ড সময় নিয়ে। তাযিনের কোন ভাবান্তর হলো না। সে বেশ স্বাভাবিক হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। বৃষ্টিতে নীহারিকার দম আটকে আসতে নিল। সে বুকে হাত দিয়ে রূদ্ধশ্বাস ফেলল। তাযিন মৃদূ ঠোঁট ঝুলিয়ে হাসল। সে বুঝতে পারছে না এমন কি বলল যে দম বন্ধ করে থাকতে হবে? নিঃশ্বাস আটকে আসবে! লাফিয়ে উঠে যে দাঁড়াতেই নীহারিকা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,’ আপনার সাহস দেখে আমি অবাক। মজা করার আর জায়গা পাচ্ছেন না? আমার সাথেই? আজব বেয়াদপ ছেলে। অসভ্য। ধ্যৎ।’
রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছিল নীহারিকার। তার ঠোঁটের উশৃঙ্খল লাফালাফি দেখতে ভালো লাগছে। তাযিন হাত একটি আর একটির উপরে রেখে দেখছে। চোখের পল্লবের উপরে জমা হচ্ছে বৃষ্টির নেশা। নীহারিকা রাগে লাল হয়ে উঠেছে। তার সাথে এত বড় মজা করার কোন মানেই নেই। কথাটা কখনো সহজ বা স্বাভাবিক হতে পারে না। তাদের মাঝে এমন কিছুই ছিল না। আর তাযিনের মাঝে তো পছন্দের বিন্দু মাত্র অনুভূতি প্রকাশ পায়নি। ভালোবাসা লাফিয়ে ঝাপিয়ে আসল কোথা থেকে? হুট করে মানুষ বলে না কি? ঝড়ো হাওয়ার মত হাতটি আকড়ে ধরে তাযিন গোল করে ঘুরিয়ে দেয়। গোল জামাটি বৃষ্টির তালে নেচে উঠে। নীহারিকা তাজ্জব হয়ে পরে। এসব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির সাথে জামার তাল ভাল। তাযিনের কোমল নরম গলার কন্ঠস্বরও তাল মিলায়,’ যদি হঠাৎ ভালোবাসা হতে পারে তাহলে বলাও চলে। হ্যা আমি আপনাকে ভালোবাসি।’
তাযিন আরো কাছে আসল। ওড়না নাড়িয়ে দিয়ে, চার আঙ্গুলকে বৃদ্ধা আঙ্গুলের মাঝে রেখে জমে থাকা পানির ছিটে মুখে ছড়িয়ে দিল। নীহারিকার মেরুদন্ড যেন শীতলতায় বরফ হয়ে গেল। মুখের পানি মুছে সে ক্রদ্ধে ফাঁটা হাসি হেসে বলল,’ আপনি ফাইজলামি করার মত মেয়ে খুজে পাচ্ছেন না? আমার সাথেই করতে এসেছেন। আমি কেমন মেয়ে জানা আছে আশা করি।’
‘ এটাই আমার পছন্দ। কারণ আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারি না। আপনার সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমি জানতে চাই। তাই ভালোবাসতে চাই।’
নীহারিকার মনে হল আজ তাযিন নেশা করেছে। সে একটু দূরে সরেই দাঁড়াল। ব্যাপারটায় তাযিন হাসল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’ আরে আপনার সাথে প্রেম করার সখ নেই আমার। সো কুল।’
‘ আপনার হবু বউয়ের কাছে গিয়ে এসব করেন। সামনে থেকে সরুন আমি যাব। বাই দ্যা ওয়ে আপনি কি ড্রাংক?’
‘ কেন? এমন মনে হচ্ছে?’ তাযিন খুব হাসল। নীহারিকা কিছুই বুঝল না। এই ছেলের হলো কি? মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি? আজ কাল নীহারিকার নিজেকেই পাগল মনে হচ্ছে। সে চলে যেতেই নিবে তাযিন বলল,’ বিয়ে তো আপনাকেই করছি মিস মহাজাগতিক মেঘ। সে হিসেবে ঠিক মানুষের কাছে এসে এসব বলছি।’
সূক্ষ্ম দৃষ্টি তার। নীহারিকার বুকে খুব শব্দ হচ্ছে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে থমকে থাকা হাতটি নিজের হাতের নিল তাযিন। তালুতে তালু রাখল, হাতটা ভারী গরম। নীহারিকার হীম হয়ে আসা হাতটি তাযিন নিজের দু’ হাতে ঘষে গরম করার চেষ্টা করল। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় দৃষ্টি নীহারিকার। ফু দিয়ে দুই গরম হাতের মাঝে শীতল হাতটি রাখল। হুশে ফিরতেই নীহারিকা ছাড়িয়ে নিল। তাযিন ছাড়ল না। উল্টো নানুর হাসনাহেনার পালকের মত লম্বা ঢালের ফুল গুলো ছিড়ে হাতের মাঝে দিয়ে বলল,’ আপনি দাদুর মত সুন্দর নন। কিন্তু আমার মনের মত সুন্দর। আই লাইক ইট। পছন্দ, আমার পছন্দ হয়েছে আপনাকে। মানুষটা অদ্ভুত। হুম ভারী অদ্ভুত। রাগটা দারুন। তাই আমি আপনাকে ভালোবেসে যেতে চাই। আপনার ঠোঁট জোড়া একদম দাদুর মত। চোখজোড়া একদম ভিন্ন। বাকি সব দাদুর মতই। আপনি তার কপি হলেও সে বেশি সুন্দর।’
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে নীহারিকা প্রশ্ন ছুড়ল,’ আপনার দাদুর সাথে আমার মিল হতে যাবে কেন? কে আপনার দাদু?’
‘ যার মাধ্যমে আমি আপনাকে ভালোবেসেছি।’
কথা থামিয়ে তাযিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে চেয়েও দিল না। নিজে নিজে হাসল। আজ এসব হচ্ছেটা কি? নীহারিকার জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র একটি দিন আজ। তাযিনের দাদুটা কে? নীহারিকার হঠাৎ মনে পড়ে। সে তো তার দাদুর মত হয়েছে। একদম অবিকল মিল। তাযিন কি তার কোন ফুফুর ছেলে? ধ্যৎ খালামনি ফুফু কিভাবে হবে? নিজের ঠোঁট নিজে চেপে ধরে নীহারিকা আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল। তাযিন দৃষ্টি সরিয়ে মাথায় টোকা দিল। নীহারিকা তীব্র ভাবে ব্যথা পেল। সে কপালে হাত দিয়ে বলল,’ আপনার মাথা আজকে সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। পাগল।’
হাসতে হাসতে তাযিন কয়েক পা পিছিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল দুজনের মাঝে। তার শরীর ভিজে গেছে অনেক। ভাজ বুঝা যাচ্ছে। নীহারিকার গলা শুকিয়ে কাঁট কাঁট হয়ে যাচ্ছে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। তাযিনের হঠাৎ কি হল? যে পাগলামি করতে চলে আসল? নীহারিকার তাকানো দেখে তাযিন দ্রুত বলল,’ এভাবে তাকাবেন না একদম। আপনি জানেন আপনার জন্য আমার হার্ট অ্যাটাক হতে হতে আমি বেঁচেছি।’
‘ আমি এমন কি করলাম?’
‘ যা করার চোখ এই তো করছে। আপনি করলে তো মরেই যেতে হবে।’
তাযিন ফু ফু করে মুখের উপরে ফু দিল কয়েক বার। নীহারিকার মুখের পানির কারণে আরও শীত শীত করতে লাগল। ভরা শীতের মত ঠান্ডা অনুভব হতেই সে দু’হাতে মুখ ঢাকল। স্মিত হয়ে দম দম পা ফেলে তাযিন সিঁড়িতে নেমে পড়ে। নীহারিকা বিস্মৃত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিঁজতে লাগল। হঠাৎ ফিরে এসে তাযিন নীহারিকার দিকে ছুঁড়ে দিল একটি ক্যানের বোতল। নীহারিকা আহাম্মকের মত তাকাল বোতলের দিকে। তাযিন নিজে এক পাশে বসে অন্যপাশে হাত দিয়ে থাবা বসিয়ে বলল,’ এখানে বসুন।’
নীহারিকা বোতল দেখিয়ে বলল,’ নিজের মত মাতাল মনে করেছেন না কি? আমি মদ খাই না।’
‘ ওটা স্প্রাইট। নট মদ। যাকে আমি প্রথম ভালোবাসার কথা বলব তার সাথে বসে বৃষ্টিতে ওয়াইন খাওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার। সেটা আবার আপনি খাবেন না। বসুন।’
বোতল হাতে নীহারিকা এক পাও সরল না। সে বলল,’ আপনার সব বেয়াদপি মাফ করা হবে না। এসব বন্ধ করে এখান থেকে যান।’
‘ শর্ত শর্তই। পাশে বসে এটা শেষ করুন। আমি চলে যাব।’
নীহারিকা বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েই কড়া স্প্রাইটের ঝাঁঝ উপেক্ষা করে শেষ করে ফেলল। দম প্রায় বন্ধই হয়ে এসেছিল। জোড়ে শ্বাস ত্যাগ করে সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ এবার সামনে থেকে সরুন।’
কথা মত তাযিন চলেই যাচ্ছিল আবার কি মনে করে সে ছুঁটে এসে কঠিন গলায় বলল,’ জাওয়াদের থেকে দূরে থাকবেন। আমার ফিলিংস হালাকা ভাবে নেওয়ার চেষ্টাও করবেন না।
দ্রুত গতিতে সে স্থান ত্যাগ করল। হালকা একটা অনুভূতি তার শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড ঠান্ড তরল হওয়ার শিকার হচ্ছে। এই হাওয়াটা শান্তির। প্রশান্তির। সত্যি মনের কথা বলার পরের অনুভূতি বিপদজনক। নীহারিকা ভিজতেই থাকল। সে নিষেধ করল না। চলে আসতে বলল না। নায়কের মত ছাতাও এগিয়ে দিল না। সে জানে নীহারিকার প্রচন্ড জ্বর হতে পারে। ভয়ংকর জ্বরে সে আক্রান্ত হয়ে ঔষুধের শরণাপন্ন হতে পারে। কিন্তু তবুও সে কিছু বলল না। ভিজুক। হাসিতে ফেঁটে পড়া ঠোঁট তার।
‘ কিছু বর্ষা আমার হয়ে,
তাকে ভিঁজিয়ে দিক।
ঝরো হাওয়ার পাতার ন্যায়,
উড়তে ভালোবাসুক।
রুপোর হাসি খিলখিলিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
তাহার সেই সোনালী নামে,
শহর জুঁড়ে বৃষ্টি নামুক।
ঝাপসা কুয়াশার ন্যায়
কিছু ভালোবাসা অবুঝ থাকুক।
_______________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
সবার জন্য ভালোবাসা অবিরাম।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..