প্রিয় সুখ পর্ব-১৯

0
35

প্রিয় সুখ-১৯
_________________
জাওয়াদের অনুপস্থিতির কারণ জানতে পেরে নীহারিকা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তার খুব জরুরি কাজ পড়ায় সে অনেক আগেই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। নীহারিকার এখন ঘরময় ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগছিল। এক আপদ যেন মাথা থেকে ঝেরে দেওয়া গেল। আনন্দে আনন্দে মামার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল বিয়ে বাড়িতে জাওয়াদের সাথে তাযিনও মিসিং ছিল। জাওয়াদ ছিল না বলে মিসিং। আর তাযিনকে তো চোখের সামনেই দেখল না নীহারিকা। ভারী অবাক করা বিষয় হলেও নীহারিকার ভালো লেগেছে। মিতু আপুর বিয়ে নিয়ে তাদের মাঝে টানটান আনন্দ হলেও মিতু আপু সব ঠেকরে বলে দিল তার বিয়ে এক দু’ মাসের আগে হচ্ছে না। তিনি মাস্টার্স শেষ করে তারপর বিয়ে করতে চান। যেহেতু তার হ্যাঁ বলাটা খুবই দূর্লভ ছিল তাই সহজে তিনি যাই বলছে সবাই মেনে নিচ্ছে। ছোটখালামনি যেন তার কথায় উঠছে বসছে। মিতু আপু ভাবে আছেন। তার হাবভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে কতটা ফুলে বেলুন তিনি। ফাবিহার মুড একদম অফ। সবার সাথে সে হু করছে তো সবার সাথে না। সবাই হাসলে হাসছে। এক কথায় সে সবাইকে অনুকরণ করছে। মিতু আপু তো কিছুক্ষণ পর পর এসে ধাতানী দিয়ে বলছে,’ মুখরে তুই এমন করে রাখছস ক্যান? দেখতে তো আরও কালা লাগে।’
এতে ফাবিহার কোন ভাবান্তর হলো না। শুধু আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। বিয়ের আয়োজন শেষে নতুন মামনির সাথে খুব ভাব জমে গেল মিতু আপুর আর নীহারিকার। তারা অনেক সময় নিয়ে গল্প গুঁজব করল। নীহারিকা অনেক দিন পরে যখন তার দুই অপছন্দের পুরুষের কাছ থেকে ছুঁটকারা পেল ঠিক তখনই তার বাবা গুরুতর ভাবে তাদের ঢাকা চলে আসতে নির্দেশ দিল। নীহারিকা প্রথমেই বলল সে আরও কিছুদিন থাকতে চায়। কিন্তু যখন শুনল বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখন না চাইতেও সে দ্রুত ব্যাগ গোঁছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিতু আপু তো কেঁদেই দিল। নীহারিকা বুঝে না মিতু আপু এমন বাচ্চা বাচ্চা স্বাভাবের কেন। যখন তখন তিনি কেঁদে বুক ভাসায়। নীহারিকা সহজে কাঁদে না। কান্না তার একদম অপছন্দ। খুব ঝামেলার সময় তার কান্না আসে। যখন সে চারপাশের সব অন্ধকার দেখে। তা না হলে সে খুব একটা কাঁদে না। বিশেষ করে যদি কেউ মারাও যায় তখনও তার কান্না আসে না। মানুষের মৃত্যুতে শেষ কেঁদেছিল দাদুর মৃত্যুতে। ছোট বেলা থেকেই তারা যাওয়ার সময় মিতু আপু গগনবিদারী কান্না জুড়ে দেয়। ফাবিহা রাজ ফাহাদেরও খুব মন খারাপ। প্রিয়মের জন্য রাজ তো কেঁদে ভাসাচ্ছে। প্রিয়ম খুব কম নানুবাড়ি আসে। আর একবার আসলে তার খুব বন্ধুবান্ধব হয়ে যায়। যারা তাকে খুবই ভালোবাসতে শুরু করে। প্রিয়মের পার্সোনালিটিই এমন। সে খুব একটা শান্ত নয় আবার খুব একটা চঞ্চল নয়। তবে ঘাড় ত্যাড়া খুব। যেখানে সেখানে বন্ধু পাতানো তার ব্যক্তিত্বের সাথে মিশে আছে। খেলার প্রতি প্রবল ঝোঁকের কারণে ছেলেরা সহজেই তাকে আপন করে নেয়। সেভাবেই বন্ধু পাতানো শুরু। সে যাবে শুনলেই গ্রামের ছেলেরা খুবই মন খারাপ করে। নীহারিকার ব্যাগ গোঁছাতে বেশি সময় লাগে। তাই প্রিয়ম তাকে খোঁচা মেরে বলল,’ এতো আলস মানুষ হয়? তোরে না দেখলে আমার এই চোখ পৃথিবীর শ্রেষ্ট অলসকে না দেখতে পেয়ে আন্ধা হয়ে যেত।’
‘ তুই চুপ যা।’ নীহারিকা নিজের উড়না ছুড়ে মারে প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম দ্রুত উড়না ধরে নেয়। দাঁত কেলিয়ে সে নীহারিকাকে চেঁতাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। জামা কাপড় গুঁছিয়ে নিতে নিতে নীহারিকা অবাক করা জিনিস দেখে। সেই চুঁড়ির বক্স। এটির কথা তো সে ভুলেই গিয়েছিল। কি মনে করে যেন সে বক্সটি খুলে। ভাবে কি করবে সে এই চুড়ির? কে দিল এই চুড়ি? মিতু আপু থাবা মেরে নিয়ে নিল। তারপর ভাগ করা শুরু করে বলল,’ তোর এই সাদা লাল আর কালো। বাকি গুলো আমার আর ফাবিহার।’
নীহারিকা সব ছুঁড়ে দিয়ে বলল,’ সব গুলো তোরা নে। আমার প্রয়োজন নেই।’
‘ আরে কিভাবে প্রয়োজন নেই বল? এগুলো তোর এক্স ফিওনসে দিয়েছে বলে কথা।’
‘ তোকে কে বলেছে উনি দিয়েছে? ফালতু কথা বলে শেষ মুহূর্তে মেজাজ খারাপ করবি না বলে দিলাম।’
‘ ওকে স্যরি স্যরি।’
মিতু আপু দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নীহারিকাকে। সাথে ঝাপিয়ে পড়ে ফাবিহা। তাদের মাঝের সম্পর্কটা অনেকটা খাট্টা, অনেকটা মিঠা, মাঝে মাঝে মরিচের ঝাঁঝ পাওয়া যায়। তবে যেটা সব সময় বিদ্যমান তা হলো ভালোবাসা। কড়া ঝাঁঝের ভালোবাসা। একের সাথে অপরের ভালোবাসার এই সম্পর্ক গুলোই অল্প দূরত্বে কষ্ট পায়।
‘ তোকে খুব মিস করব নীহু।’ মিতু আপুর ইমোশনাল কথা গুলো শুনে নীহারিকা হাসতে শুরু করে। তার হাসি দেখে রাগে জ্বলতে জ্বলতে মিতু আপু ঠেলা মারে। নীহারিকা বিছানায় পড়ে যায়। এতে একটা ঝাঁপাঝাঁপি লাফালাফির সৃষ্টি হয়। ফল স্বরূপ বিছানা মটমট করে ভেঙ্গে পড়ে। নিচের কিছু কাঠ নড়বড়ে ছিল। যা ভেঙ্গে এখন হয়েছে খণ্ডখণ্ড। সামনে চলে আসা এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে মিতু আপু চিৎকার চেঁচামেঁচি শুরু করে। কোমড়ে ব্যথা পেয়েছেন করুন ভাবে। নীহারিকা উঠতে গিয়ে দু’ বার পড়েছে। কোমড়ের ব্যথা ভুলে তারা নানুর কথা ভাবছে। অনেক বকা গিলতে হবে। নীহারিকার বকার ঝুঁড়িতে কম যুক্ত হবে। কারণ সে চলে যাবে । ব্যাপারটা ভাবতেই মিতু আপুর, ফাবিহার খুবই দুঃখ হলো। চলে যাওয়ার চেয়েও বকা কম শুনার দুঃখ তাদের মাঝে বেশি।
হন্তদন্ত হয়ে সবাই ছুটে এসে দেখে এলোমেলো চুলে তিনজনই বসে আছে ভাঙ্গা বিছানার নিচে। তাযিন খুব সাবধানে এসে দাঁড়ায়। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে দরজার পাশে জায়গা করে নেয়। এই প্রথম সে এতো এলোমলো তিনজনকে দেখল। না চাইতেও সে মৃদূ হাসল। নীহারিকা চুল গুলো আরও এলোমেলো করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’ মিতু আপু তোকে আমি নিজের হাতে খুন করব। অসভ্য মেয়ে। ‘
নানু এসে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর ভয়াবহ রেগে হুঙ্কার ছেড়ে বলে উঠেন,’ পাগল হইলি সবগুন? কেমনে ভাঙ্গলি? জন্তু জানোয়ার নি কোন? দুঃখ পাইছস কেমন? ওই তোরা টেনে উঠা এগুলোরে।’
তাদের দ্রুত তোলা হল। কিন্তু হাত পায়ে প্রচন্ড ব্যথা রয়ে গেল। নীহারিকার বাম হাতা ছিড়ে হাত কেঁটে রক্তাক্ত। মিতু আপুর কোমড় ছিড়েছে। জায়গাটা তো তিনি এই মুহূর্তে দেখাতেও পারবে না। তাই খুব চেপে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কিন্তু নানুর চিলের মত চোখের দৃষ্টি থেকে তিনি বেঁচে ফিরলেন না। ফাবিহাও কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে। নীহারিকা নিজের হাতের দিকে একবার দেখে দ্রুত ওড়না দিয়ে তা প্যাঁচিয়ে লোক চক্ষুর আড়ালে ঢেকে দিয়েছে। সে জানে মা যদি একবার দেখে তাহলে খুব চেঁচামেঁচি করবেন। সাথে বকাও খেতে হবে মারাত্নক লেভেলের। তাই চুপ থাকা ভালো। মা যখন প্রশ্ন করলেন সে ব্যথা পেয়েছে কি না বিনিময়ে নীহারিকা শুধু বলল না। রুম থেকে সকলে যেতেই নীহারিকা দৌড়ে ছাদে চলে গেল। তারপর লাইট জ্বালিয়ে চেক করতে লাগল কতটা লেগেছে। হাতের একটা পাশে এখন ছোট করে লেগে রয়েছে কাঠের গুড়ি। সে বুঝতে পারছে জখম গরুত্বর। কিন্তু এই মুহূর্তে সে পানি দিয়ে পরিষ্কার করা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। ছাদের উপরে পানির টেপ রয়েছে একটি। নানু গাছে পানি দেওয়ার জন্য এটি লাগিয়ে ছিল। নীহারিকা পশ্চিমের দিকে গিয়ে টেপ ছেড়ে পানি হাতের কাঁটা স্থানে লাগাতেই অদ্ভুত ব্যথা দায়ক জ্বালা অনুভব করে উঠে। ছাদের ফ্লোরে সে চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। তারপর আবার পানি ঢেলে দেয়। বেশি ক্ষত নয় তবে চামড়া ছিড়ে গিয়েছে। মায়েদের আজব কিছু বিচিত্র গুনাবলির মাঝের একটি ছেলে মেয়ে ব্যথা পেলে তার উপরে আরও ব্যথা দেওয়া। কথা গুলো ভেবে নীহারিকা নিজে নিজে হাসল। হঠাৎ তার মনে হল কেউ পাশে এসে বসেছে। চমকে পাশে তাকিয়ে নীহারিকা অবাক হয়ে গেল। এটা তো তাযিন! সে এখানে কি করছে? নীহারিকা আগে নিজের হাত লুকিয়ে নিয়ে ক্রদ্ধের সাথে জিজ্ঞেস করল,’ প্রবলেম কি? এখানে কি করছেন?’
তাযিন উত্তর দিল না। সে নীহারিকার হাত টেনে সামনে নিয়ে আসে। বিরক্ত হয়ে নীহারিকা হাত টানতে শুরু করে। তাযিনের তেমন পাত্তা পাওয়া গেল না। এত শক্ত করে কাঁটা জায়গাটা চেপে ধরল যে ব্যথায় কুঁকড়ে গেল নীহারিকা,’ পাগল হয়ে গেলন না কি? ওহ! আমার হাত।’ আর্তনাদ ভরা কন্ঠ তার।
তাযিন কেঁচি হাতে কাট কাট করে জামার হাতা কেটে ফেলল। নীহারিকার আগুন চোখ ফাঁটা ফাঁটা হয়ে গিয়েছে। সে বুঝতেই পারছে না হচ্ছেটা কি? তাযিন কাঁটা স্থানে বোতল ভর্তি পানি ভালো করে ঠেলে দিল। তারপর মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করা শুরু করল। নীহারিকা কৌতুহলি হয়ে তাকিয়ে রইল তাযিনের স্বাভাবিক হয়ে থাকা চেহারার দিকে। লাইটের আলো এসে পড়েছে পিছনে। চেহারা ভালো করে বুঝা যাচ্ছে না। নীহারিকা তবুও তাকিয়ে আছে। তাযিন নিচু গলায় বলল,’ জানি আমি হ্যান্ডসাম। কিন্তু সবার আমাকে এভাবে দেখার অনুমতি নেই। আপনার জন্য তো নিষিদ্ধ। বউ হলে দেখতে পারবেন।’
ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে নীহারিকা অন্যদিকে তাকায়। খুব লজ্জা জনক ব্যাপার। নিজের অপমান মেনে নিতে না পেরে সে কর্কশ গলায় বলল,’ আপনার মত মানুষের চেহারা আমি দেখতেও চাই না। এখানে এসেছেন কেন?’
সোজা হয়ে ভাঙ্গা হাঁটুতে হাত রেখে তাযিন বলল,’ ব্যথা পেলে বলা উচিত। লুকিয়ে রাখা নয়।’
‘ সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার না দেখলেও চলবে।’ একটু থেমে সে আড় চোখে তাকিয়ে বলল,’ এক মিনিট আপনি কিভাবে জেনেছেন আমার হাত কেঁটেছে? সেখানে তো আপনি উপস্থিত ছিলেন বলে মনে হচ্ছে না।’
শান্ত চোখে এবার তাকাল তাযিন। সে উপস্থিত ছিল। সবার চিৎকার শুনে সেই আগে এসেছিল। কিন্তু পাশের দেয়ালের দিকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। তখন সে দেখল নীহারিকার কাঁটা হাতটি। ওড়না প্যাঁচানোর বিষয়টিও চোখ এড়ালো না। তাই সে ফাস্টেড বক্স নিয়ে ছাদে এসেছে। নীহারিকা জবাবের আশায় থেকে বিরক্ত হয়ে পড়ে। তাযিন যেন মুখে কুলু পেতে বসে আছে। কথাই মুখ থেকে বের হচ্ছে না। এখানে কি চুপ করে বসে থাকতে এসেছে? আজব।
তাযিন এবার সত্যি মুখ খুলল। প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত। সে জানতে চাইল,’ গাড়ি কখন?’
অবাক হলেও উত্তরে নীহারিকা বলল,’ সকালে। মানে ভোরে ভোরে। আপনারা যাবেন না? না কি এখানেই থাকার ধান্দা রয়েছে?’
‘ এমন কিছুই নেই। আমরাও কাল সকালে চলে যাব।’
‘ সিলেট?’
‘ আম্মি আর আনজুম যাবে। আমি ঢাকা যাব।’
‘ বাড়ি সিলেট?’ নীহারিকার জহুরি নজর দেখে তাযিন না চাইতেও হেসে ফেলল। হাসলে তার সামনের দাঁত গুলোর নিচের গুলো দেখা যায় দারুন ভাবে। এবার নীহারিকাও হেসে ফেলল। তাযিন মৃদূ কন্ঠে বলল,’ সে আপনার জানা।’
‘ শিকার করছেন আপনি একজন বিশাল মিথ্যাবাদী?’
‘ অস্বীকার করেছি বলে মনে হচ্ছে না।’ তীর্যক চোখে তাকিয়ে কাঁট কাঁট গলায় তাযিন উত্তর প্রদান করল।
‘ দেখা হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই আপনি আমাকে চিনেছেন? রাইট।’
‘ এটা সত্য নয় যে আমি আপনাকে কিছুক্ষণ পরে চিনেছি।’
‘ আবার মিথ্যা বলছেন?’
‘ এবার সত্য এটাই।’
‘ কাহিনী বুঝতে পেরেছি আপনি হয় তো ভয় পেয়েছিলেন।’
‘ ভয় কেন? ‘
‘ আপনার ফিওনসে যদি জানতে পারে আপনি সারা রাত একটি মেয়ের সাথে ছিলেন তাহলে নিশ্চয়ই নেগেটিভ নিবে তাই এমন করেছেন রাইট? ‘
‘ আমার ফিওনসে তো এখন আপনি।’
‘ আবার ফালতু বকছেন? হঠাৎ আপনার কি হয়েছে?’
তাযিন বিনিময়ে হাসি বিলিয়ে দিল। নীহারিকা ভ্রু কুঁচকিত করে কারণ খুজল। তারপর বলল,’ যাই হোক। ধন্যবাদ। হাতেন জন্য নয়। কারণ এটা আপনি জোর করে বেঁধেছেন। মিতুআপুর জন্য। আমি আপুকে অনেক বছর পরে এত খুশি দেখেছি। উনি সত্যি খুব খুশি।’
‘ এতে আমি কি করেছি?’
‘ জানি না। কিন্তু কিছু একটা তো করেছেন। তা না হলে শাহিন ভাই এখানে আসত না। যাই করেছেন ধন্যবাদ তার জন্য।’
‘ আমি অন্যের জন্য কিছুই করি না। যা করি নিজের জন্য। তাই ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই।’
নীহারিকা বুঝতে পারছে না মিতু আপুর বিয়েতে উনার লাভ কি? তাযিনের পিছনে কিছুর কিচকিচ শব্দ এতক্ষণে নীহারিকার কান ছুঁয়ে গেল। সে একটু ঝুঁকে পিছনে দেখার চেষ্টা করল। তাযিন হাত বাড়িয়ে একটি ঘরের মত সুন্দর খাঁচা বের করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ এটি আপনার জন্য।’ চরম ভাবে বিস্মৃত হয়ে তাকিয়ে রইল নীহারিকা। তার ঠোঁট দুটি আপন গতিতে ছিটকে দূরে সরে গেল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,’ পাখি ভর্তি খাঁচা আমাকে কেন দিচ্ছেন?’
‘ যে দিয়েছে তার কাছে প্রশ্ন করুন। আমাকে নয়।’
‘ এমন অদ্ভুত কান্ড আপনি ছাড়াও কেউ করতে পারে? কে সে?’
‘ আম্মি দিয়েছে।’
‘ খালামনি? আমাকে? কেন?’
তাযিন জবাব দিলো না। সে আবার চুপ। আশ্চর্য লোক তো! কিছুক্ষণ পর পর চুপ হয়ে যায় কেন? বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে উঠে নীহারিকার চোখমুখ। সে ভালো করে দেখে। দুটি হলুদ পাখি। একদম টকটকে হলুদ রং শরীরে জড়িয়ে তারা এক দোলনা থেকে অন্য দোলনায় উড়ে গিয়ে বসছে। এই পাখির নাম কি হতে পারে? নীহারিকার পাখি সম্পর্কের অভিজ্ঞতা খুবই স্বল্প। এসব তার খুব একটা পছন্দের জিনিসও নয়। তাই সে একটু বিরক্তই হচ্ছে। খালামনি হঠাৎ পাখি কেন দিবে? এটা কেমন জিনিস হলো? সে আবার জিজ্ঞেস করে বলল,’ আপনার ভুল হচ্ছে এটা আমার নয়।’
স্বাভাবিক গলায় তাযিন বলল,’ এগুলো আপনারই।
রেগে গেল নীহারিকা। আগুন চোখে তাকিয়ে সে বলল,’ হলুদ রং আমার একদম পছন্দ নয়। পাখির রং হলুদ। ঘরের রং হলুদ। দেখেই তো মাথা খারাপ হচ্ছে। তাই আমি এটা নিচ্ছি না। স্যরি।’
‘ উপহার হিসেবে দেওয়া জিনিস আপনি এভাবে ফিরিয়ে দেন?’ তাযিনের কণ্ঠ উত্তপ্ত।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নীহারিকা খাঁচাটি হাতে নিল।
‘ আপনি এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? ঠিক আছে নিলাম। কিন্তু এতে আপনার লাভ কি?’
‘ আমি আগেই বলেছি অন্যের প্রয়োজনে বা লাভে আমি কিছুই করি না।’
‘ আচ্ছা বুঝলাম। মিতু আপুর বিয়েতে আপনার লাভ কি?’
‘ আবার যখন দেখা হবে তখন বলব।’
চমকে উঠে আর্তনাদ ভরা কন্ঠে নীহারিকা চেঁচাল,’ আপনার সাথে আর জীবনেও দেখা করতে চাই না আমি। কাকতালীয় ভাবেও দেখা করতে চাই না।’
তাযিন শব্দ করে হাসতে লাগল। শরীর কাঁটা কাঁটা হয়ে উঠল নীহারিকার। সে বলল,’ হাসবেন না। একদমই না।’
নীহারিকা পাখি গুলোকে দেখতে শুরু করল। তাযিন হাসিতে মেতে গম্ভীর হয়ে বলল,’ কাকতালীয় , সমাপতন,আকস্মিক ভাবে এই শব্দ গুলোর কোন মানে মানুষের জীবনে নেই। আপনি কি এটা জানেন?’
‘ কি সব আজব বকছেন? কাল থেকেই মাথা খারাপ দেখছি।’ কিঞ্চিত আফসোস ভরা নীহারিকার কণ্ঠে।
কথাটা মূল্যায়ন না করে তাযিন বলল, ‘ প্রকৃত অর্থে এসব মানুষের সৃষ্ট কিছু অবাস্তব বাক্য। মস্তিষ্ক সব সময় নিজেকে সঠিক প্রমান করতে চায়। কোন ঘটনা যদি মস্তিষ্ক পর্বে বুঝতে না পারে কিন্তু তা ঘটে যায় সেটা মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারে না। তাই সে হঠাৎ, কাকতালীয় বা আকস্মিকের নাম দেয়। আসলে তো সব কিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকে। সে অনুযায় মানুষের জীবন চলে। পৃথিবীর কোন কিছুই শুধু শুধু বা হঠাৎ হয় না। প্রতিটি ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত এবং কারণ সম্পূর্ন। কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। কাকতালীয় বাক্যটি সম্পূর্ন মিথ্যা। মস্তিষ্ক নিজের বোকামির পরিচয় গোপন করতেই এটির জন্ম দিয়েছে। তাই আপনার সাথে আমার দেখা হওয়া কোন ভাবেই কাকতালীয় হঠাৎ বা আকস্মিক নয়। ভবিষ্যতে দেখা হলেও সেটি কাকতালীয় হবে না। একে বলা হয় ভাগ্য। ভেবে নিবেন নিশ্চুয়ই কারণ রয়েছে।’
আহাম্মকের মত কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নীহারিকা বলল,’ দূর্ঘটনা তো কাকতালীয়ই হয়।’
‘ মোটেও না। সেটা ঘটার পিছনেও কারণ আছে এবং সেটি পূর্বের পরিকল্পিত। মস্তিষ্ক এটি ধরতে পারে না এতে কার দোষ? ঘটে যাওয়া ঘটনার না কি তার নিজের? এবার ফালতু বকা বন্ধ করুন। প্যারাসিটামল খাবেন হাতের ব্যথা কিছুদিন থাকবে। পানি বেশি লাগাবেন না। ব্যান্ডেজ দুদিন পরপর পরিবর্তন করবেন।’
তাযিন উঠে গেল। হঠাৎ করে সে বসে নীহারিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে। অস্বস্তিকর কান্ডে হতভম্ভ হয়ে পরে নীহারিকা। দু হাত পিছনের দিকে রেখে সে দূরে সরে যায়। তাযিন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠে,’ যদি একটি পাখিরও কিছু হয় আপনাকে কিন্তু দিনের বেলায় তারা দেখিয়ে ছাড়ব।’
দাঁড়িয়ে তাযিন নিজের পোশাক পরিষ্কার করল। হঠাৎ সে উদ্গ্রীব হয়ে ডাকল,’ নীহারিকা! ‘
চকিতে তাকাল নীহারিকা। চোখ ছোট করে হাত তুলে প্রশ্ন করল,’ কি হয়েছে?’
নির্নিমিষ চেয়ে রইল তাযিন। কোন কথা বললনা। নীহারিকা আবার হাত নাচাল। তাযিন উত্তর দিল না। সে তাকিয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করছে। সময় দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাযিন ম্লান হেসে বলল,’ কিছু না। শুধু আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো।’
কথাটা বুকে একটি বড় অদৃশ্যমান ঝড়ের সৃষ্টি করল। কিছু কথার জন্মই হয়েছে মানুষের হৃদয় নাম স্থানে ক্ষত সৃষ্টি করার জন্য।
_____________________
বাসের জানালার সিটটি নীহারিকার। সে সব সময় এই পাশেই বসে। কুমিল্লা থেকে বাস ছেড়েছে কিছুক্ষণ আগে। সবাইকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগলেও নীহারিকার সাথে অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। সে নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করছে না। তার মনে হচ্ছে সে একা না। দুটি অবুঝ পাখি তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। কিচিরমিচির করে শব্দ তুলছে। কি সুমধূর শব্দ মনে হচ্ছে তা নীহারিকা বলে বুঝাতে পারবে না। তার ভালো লাগছে। না খুবই ভালো লাগছে। সকাল সকাল কড়া বৃষ্টির স্রোত। বৃষ্টির ঝাঁপটার শব্দের সাথে পাখির কিচিরমিচির মৃদূ কোলাহল পূর্ন মধূমিতাময় শব্দ বিমোহিত করছে নীহারিকাকে। রাতে সে অনেক ভেবেছে পাখির কিভাবে যত্ন নিবে। কিন্তু সেটার সমাধানও আনজুম করে দিয়েছে। সে একটি কাগজে পাখিদের খাবার সম্পর্কে সব লিখে দিয়েছে। তাবুও নীহারিকার বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সত্যি দারুন লাগছে। পাখির খাঁচাটি সে বুকে জড়িয়ে ধরে। সবার সাথে দেখা হলো আসার আগে। শুধু তাযিনের সাথে হলো না। সেদিন রাতের কথা ভেবে নীহারিকা হাসল। লোকটা নিশ্চুয়ই ফাইজলামি করেছে। সত্যি কি আবার দেখা হবে? এবার নীহারিকা দেখা করতে চায় না। হতে পারে এবার তার নতুন কোন রূপের সাথে দেখা হবে। বারে বারে নতুন রূপ নেওয়া যায় না। থাকনা দূরে। বহু দূরে। কিছু মানুষের দূরত্ব কাছে থাকার চেয়েও উত্তম। অদ্ভুতরে পাগল লোক। এত রূপ একটা মানুষের হয় কিভাবে? একবার বিমুগ্ধ একবার তাযিন পরের বার দেখা যাবে অন্য কোন নামে অন্য কোন রূপে এসে হাজির হবে। নীহারিকা জানালার দিকে হেলান দিল। এখানের স্মৃতি গুলো সব বারের চেয়ে আলাদ। একদন আলাদা। তার মনে পড়বে খুব। একটু বেশিই মনে পড়বে। সে ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারবে না। নীহারিকার মনে হচ্ছে তার হৃদয় নামক খাঁচাটির দরজা খুলে যাচ্ছে। হু হু করে বাতাস যেন হামলে পড়ছে।
__________________
কলিং বেলের বিশ্রি শব্দটি কানে এসে ডেকে যেতেই ঘুমে বিভোর মুখটি এঁকেবেঁকে যায় নীহারিকার। বালিশটি কানে চেপে ধরেও সে শব্দের বীভৎষ আওয়াজ থেকে বাঁচতে পারল না। রাগে ফেঁটে যাচ্ছে শরীর তার। বিছানায় বসে পড়ে সে। কিছুক্ষণ বেলটি বেজেই চলল। না পারতে নীহারিকা উঠে গেল। রুমটি অন্ধকার হয়ে আছে। কিন্তু নীহারিকা আলোতে ঘুমায়। রুমে সামান্য অন্ধকারের উপস্থিতিও তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। সেই জন্যে রুমের পর্দার রং সাদা। আজকের আকাশ মেঘলা। অন্যদিন হালকা অন্ধকারের রেখা হলেও সে অনুভব করে। আজ তা অনুভব হল না। হতে পারে আজ প্রিয়ম লাইট অফ করে দিয়েছে। অসহ্য অনুভূতি নীহারিকার। দেওয়ালের সাথে মাথায় খুব জোরেই ধাক্কাটি লেগেছে। মাথার এক পাশে ব্যথার সাথে ফুলে উঠাও অনুভব করছে সে। আজকের দিন বাকি সব দিনের চেয়েও জঘন্য হবে। পায়ের একটি আঙ্গুলের সাথে সোফার কোনার সংঘর্ষটিও বাজে অনুভূতির শিকার। পা আর মাথা চাপতে চাপতে নীহারিকা দরজা খুলে চিঠিটি হাতে নিল। চিঠি হলে অবশ্য নীহারিকার এত বিরক্ত লাগত না। একটি ধবধবে সাদা কাগজ কোন এক অসভ্য প্রতিসকালে তার জন্য পাঠায়। ভিতরে শুধু খালি পৃষ্ঠা বেতিত কিছুই নেই। দীর্ঘ এক মাস তেঁইশ দিন ধরে সে তিপ্পান্নটি কাগজ পেয়েছে। কম করে হলেও সে দুই তিনটি খাতা তৈরি করে নিতে পারবে এই কাগজ দিয়ে। এমন অদ্ভুত মজা কে করছে তাকে আজও খুজে পেল না সে। প্রথম প্রথম তো সে নিজেও সেই ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে জানতে চাইত কে করছে এসব। উত্তরে সে চিঠিই ফিরত পেত। কিন্তু খালি চিঠি। শূন্য লেখার পৃষ্ঠা মাত্র। সোফার উপরে উপুত হয়ে শুয়ে প্রতিদিনের মত নীহারিকা কাগজটি এপাশ ওপাশ করে দেখল। কিছু তো একটা থাকার কথা। তা না হলে পাগলও খালি পৃষ্ঠা দেওয়ার কথা নয়।
পানি ভর্তি মগের সম্পূর্ণ পানি নীহারিকার মাথায় এসে পড়ল। সে ভিঁজে চুপচুপ হয়ে গেল সেকেন্ডেই। হা করে যখন সে উপরের দিকে তাকাল প্রিয়মের জহুরী নজরের দেখা পেল।
‘ তুই এখানে কি করছিস? তোর না আজ পরীক্ষা?’ ধমক ভর্তি প্রিয়মের কণ্ঠস্বর। পানি ঝারতে ঝারতে নীহারিকা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রিয়মের লম্বা বলিষ্ঠ দেহ। বাহু গুলো বেশ শক্ত। বয়সে নীহারিকা বড় হলেও লম্বায় প্রিয়ম তাকে ছাড়িয়েছে বহু আগে। শক্ত বাহু গুলোতে নীহারিকা ইচ্ছে মত থাপড়ে বলল,’ পানি মারলি কেন?’
‘ কারণ তুই না পড়ে সোফায় পড়ে ঘুমচ্ছিস।’ প্রিয়মের গলা স্বচ্ছ।
‘ আমি তোর বড় না ছোট? তোর সাহস তো কম না? শুন পরীক্ষা আমার আমি দেখে নিব। নিজের চরকায় তেল দে।’
‘ আমার চরকায় তেল অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই বাবা বলেছে তোকে একটু ধার দিতে। তোর মাথা তো সম্পূর্ণ খালি।’ কথাটা বলে প্রিয়ম মগটি টি-টেবিলের উপরের খালি স্থানে রাখল। মনে মনে নীহারিকা রেগে আগুন হলেও তা এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ তার আগের সেমিস্টারের রেজাল্ট ছিল ভয়াবহ করুন। বাবা তো প্রচন্ড ঝেরে ছিল। এই পরীক্ষা খারাপ হলে খবর আছে।
‘ আমার পরীক্ষার দু’দিন আগে থেকে ঘুম হারাম হয়ে যায়। আর তোর কিভাবে এত ঘুম পায় আপু? হাউ ক্যান দিস প্রসিবল? ’
‘ পৃথিবীতে অসম্ভব কিছুই নেই। পরীক্ষার আগে ঘুম আসা অতিব সাধারণ ব্যাপার।’
সোফার কোন ঘেঁষে নীহারিকা নেতিয়ে পড়ল। প্রিয়ম গলা কেঁশে হাক দিয়ে ডাক বসাল,’ বাবা, বাবা।’
ঘুম তাড়িয়ে নীহারিকা লাফিয়ে উঠে বলল,’ তোর সমস্যা কি?’
শয়তানী হাসি হেসে প্রিয়ম ভ্রু জোড়া উপর নিচ করে বলল,’ পড়তে বস। তাহলেই মাফ। তুই কি আবার ডাব্বা পেতে চাস? বাবার ইজ্জত ডুবানোই তোর কাজ। চল।’
ঠোঁট জোড়া আপন শক্তিতে আলাদা হয়ে গেল নীহারিকার। ছোট, হ্যাঁ প্রিয়ম তো ছোটই হয়। কিন্তু ছেলেটা বড় ভাইয়ের মত বিহেব করে সব সময়। দীর্ঘ রাগী শ্বাস ফেলে নীহারিকা ত্যাড়া চক্ষু দৃষ্টি ছুঁড়ে মারল। প্রিয়মের নীল রঙ্গা শার্ট। দু’ হাতে তা টেনে সে বলল,’ চল।’
নীহারিকার রুমটি কর্ণারের দিকে। যেতে যেতে সে আবার ধাক্কা খেল। আজকের দিনটি তার জন্য সম্পূর্ণ রূপে কুফা। প্রিয়ম পিছনে পিছনে এসে হাজির। তার হাতে খাবারের থালা। নীহারিকা ভাবল তার জন্য বোধ হয়। কিন্তু প্রতিবারের মত ভুল প্রমানিত করে প্রিয়ম বলল,’ আমার প্লেটে ডিম আছে। তোর জন্য আজ ডিম হারাম।’
‘ বড় বোনকে একটু তো সম্মান কর।’
‘ এই মুহূর্তে এত সম্মান আসে না।’ মুখের মাঝে ডিমের একটি অংশ পুরে নিতে নিতে প্রিয়ম বলল। মুখ বাঁকা করে নীহারিকা অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাগে তার নাজেহাল অবস্থা। বাবা বাসায় না থাকলে সে দেখাত প্রিয়মকে নীহারিকা কি জিনিস। যেতে যেতে নীহারিকা হাঁড়িপানা মুখ করে আবিল গলায় বলল,’ কুত্তা একটা।’
হনু প্রিয়ম শুনে নিল। সে বেশ অনাবিল কন্ঠে জানাল,’ কুকুরের বোন মানুষ তো হয় না। সে হিসেবে তুইও কুত্তা।’
একফোঁটাও অপমানিত বোধ করল না নীহারিকা। দু’জনের মাঝে এমন কম বেশ ঝগড়া রোজ রোজ হয়। আগে কাজের মেয়ে পারুল থামাতে চেষ্টা করত খুব। এখন সেও উপভোগ করে। শুধু বাবা বাসায় থাকলে ব্যাপারটা একটু কম ঘটে।
রুমের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এলোমেলো বিছানার চাদুর, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জামা কাপড়, পড়ার টেবিলে বইয়ের ছোট খাটো স্তুপ, একটি বালিশ একদম নিচে শুয়ে আছে, পানির বোতলের ঢাকনা খোলা, ড্রেসিং টেবিলের উপরে সব পিন অগোছাল। এসব দেখে প্রিয়মের মাথা রিতিমত গরম হতে শুরু করল। নীহারিকা টেবিলের উপরে মাথা ফেলে দিল। স্বউচ্চ কণ্ঠে প্রিয়ম চেঁচামেঁচি করে বলল,’ আপু তোর রুমের এমন অবস্থা কেন? গুঁছিয়েও রাখতে পারিস না? তুই না একটা মেয়ে? ছিঃ। এই একদম ঘুমাবি না। বাবাকে কিন্তু ডাক দিব।’
না চাইতে পড়তে হচ্ছে নীহারিকাকে। প্রিয়ম লেখাপড়ায় দারুন ছাত্র। প্রতিটি ক্লাসে সে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পায়। নীহারিকার চেয়ে একটু ভালো হওয়ায় সে খবর দারিটা ভালোই করে। বই পড়তে পড়তে নীহারিকা মৃদূ কণ্ঠে বলল,’ পৃথিবীর বেশির ভাগ মেয়েদের ঘরই এমন অগোছালো থাকে। নাটক সিনেমার মত মেয়েরা এত গোঁছাল হয় না।’
‘ কিন্তু রৌদমিলার ঘরটা গোঁছাল ছিল সুন্দর করে।’ উদাসীন গলা প্রিয়মের, সে অনেক গোঁছাল।’
ঘুম উড়ে যাওয়ার জন্য বোম ফাঁটানো এই কথাটাই যথেষ্ট। দুই হাটু চেয়ারে ভাজ করে রেখে নীহারিকা উদ্বেগী হয়ে জানতে চাইল,’ রৌদমিলাটা কে?’
প্রিয়মের ভোলা মন,’ আরে আমাদের ভার্সিটির নতুন মেয়ে। কথা নেই বার্তা নেই ধরেই আমার খাতা আর্তশাদ করল। তারপর টেনে হিচড়ে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেল। বেহায়া টাইপের আচরণ। বাবা অনেক বড় লোক তো তাই।’
‘ তোকে ঘরে নিয়ে গেল?’ বিণৎ অদ্ভুত কণ্ঠ নীহারিকার। প্রিয়মের বুদ্ধি খুলল। দু’ চোখ বন্ধ করে সে শুধলো। ফিঁসফিঁসিয়ে বলল,’ তুই কিন্তু অন্য পথে হাঁটছিস।’
‘ মোটেও না। তোকে একটা মেয়ে নিজের রুমে মানে ঘরে নিয়ে গেল। আর তুই কিছুই বললি না? এটা আমি বাবাকে নয় মাকে বলব। দাঁড়া।’
নীহারিকা আড়মোর ভেঙ্গে উঠছিল। প্রিয়ম দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,’ ভুলেও না। আপু দেখ তুই কিন্তু ভুল ভাল বকছিস। মেয়েটার সাথে আমার কথাই হয়েছে মাত্র তিন চার বার। বেশি কিছুই না। মাকে বলিস না। খবর করে দিবে। প্লিজ।’ দূর্বল গলায় বলল সে। নীহারিকা এবার বসল রাজার মত। বলল,’ ঠিক আছে বলব না। তবে মেয়েটাকে তোর পছন্দ হলে আমার সাথে সব শেয়ার করতে পারিস।’
‘ তেমন কিছুই না। মেয়েটা পাগলী। সব কাজ উলটপালট করে। আমার ভালো লাগে না।’
‘ এই না’ য়ের মাঝেই যতসব হ্যাঁ। তুই যদি হ্যাঁ বলতি তাহলেও আমি এত দুঃখ পেতাম না। যতটা ‘ না’ বলায় পাচ্ছি।’ প্রিয়মের সকালের নাস্তায় নীহারিকা সহজেই ভাগ বসাল। প্রিয়ম চিন্তিত হয়ে বলল,’ ঠিক আছে তাহলে হ্যাঁ পছন্দ।’
‘ কি বললি! তুই কি বললি! ‘ চমকে উঠে নীহারিকা আগুন চোখে তাকাল। অগ্নিকুণ্ডের মত আগুন যদি চোখ দিয়ে বের করা যেত তা নীহারিকার চোখে স্থান পেত।
‘ তুই নিজেই তো বললি না বলায় কষ্ট পেয়েছিস। তাই হ্যাঁ বললাম। আমার কি দোষ?’
মিটমিটিয়ে হেসে নীহারিকা বলল,’ তাই তো, তোর কি দোষ?’
‘ আপু মজা বন্ধ কর।’
নীহারিকা সিরিয়াস হয়ে বলল,’ যা বন্ধ। তোর যদি পছন্দ হয় তাহলে তুই বিয়ে করবি। তোর বউ রাক্ষসী হলে তোর লস। বউ ভালো হলেও তোর লাভ। আমার বা আমার বাপের কিছুই যায় আসে না। এখন আমার কাজ কর।’
‘ কিসের কাজ?’
‘ এই যে তোর কত বড় উপকার করলাম তার প্রতিদান দে।
‘ সেটা কিভাবে?’
‘ বেশি কিছু না আমার রুম ভালো করে নিজের মত গুঁছিয়ে দে। দ্রুত। না বললে খবর আছে।
কিছুই করার নেই। হাত পা বাঁধা অবস্থায় যেমন নদীতে ফেলে দেওয়া হয় তার অবস্থা তেমনই। না পাড়তে সে সব সুন্দর করে গুছিয়ে দিল। বের হতে হতে বলল,’ তুই এত সকালে উঠলি কিভাবে?’
‘ সেই চিঠির জন্য।’
‘ সাদা কাগজের জন্য? লোকটা মনে হয় তোকে ভালো করে চিনে। তা না হলে তুই যে সব সময় পরীক্ষায় ডাব্বা পাস ও কিভাবে জানল?’
‘ পরীক্ষার সাথে সাদা কাগজের কি কানেকশন?’ রাগান্বীত কণ্ঠস্বর নীহারিকার। প্রিয়ম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ তোর খাতায়ও শূন্য থাকে চিঠিও শূন্য লেখায় আসে।’
বিছানার বালিশ ছুঁড়ে মেরে প্রিয়মকে রুম থেকে বের করে দিল নীহারিকা। পাখির ডাকে নীহারিকা সকালের মিষ্টি রোদ দেখতে বারান্দায় এসে পা রাখল। আজ আকাশ ভর্তি মেঘ। রোদের দেখা নেই। পাখি গুলো একটু বড় হয়েছে। ছেলে পাখিটির নাম বেরিক, মেয়ে পাখিটির নাম বেশ অদ্ভুত। তুতু। ছেলেটির নাম প্রিয়মের দেওয়া। তাই একটু উন্নত। এসব কাজে নীহারিকা কম বুদ্ধিসম্পর্ণ মানুষ। বৃষ্টি এসে বারান্দার দুয়ার বেয়ে কড়া আঘাত করতেই নীহারিকা দ্রুত পাখির খাঁচার পিছনে এসে দাঁড়াল। নিজের পিঠ ভিঁজিয়ে ফেলল সে। পাখি গুলো কিঁচির মিচির শব্দে পরিবেশ মুখরিত করে তুলল। এরা নীহারিকার পরিবারের অংশ এখন। খুব যত্ন করে সে। ব্যাপারটায় বাসা ভর্তি বাকিরা অবাক। পাখির শব্দ যার পছন্দ হয় না সে এখন পাখির মা। প্রিয়ম পিছন থেকে ডাক বসাল,’ ওই পাখির মা পরীক্ষা দিবিনা না কি? রেডি হ আপু।’
এটাও প্রিয়মের দেওয়া কুৎসিত নাম। নাকটা কিঞ্চিত উঁচু করে নীহারিকা খাঁচা নিয়ে রুমে ঢুল।
___________________
বাড়ির আশেপাশে হাতে হাত রেখে অনেক গাছ দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবেশি রূপে। সামনের খালি জায়গাটা এখন দখলে রয়েছে অন্য কারও। বাবা বলেছে তিনি এই জায়গা সম্পর্কে কিছু জানেন না। অথচ দাদাভাই বলেছে এটি তাদেরই সম্পদ। আচ্ছা উনি কি এই জমি বিক্রি করে দিয়েছে? বাসায় এসে দাদাভাইকে প্রশ্নটা করতে হবে। নীহারিকার মাথায় পানি রঙ্গের শুভ্র ছাতা। গায়ে খয়েরি কালোর মিশ্রনে আবৃত বোরকা। বিপদ যখন আসে সব দিক দিয়ে আসে। আজ বাবা তাকে নিয়ে যেতে পারবে না। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টি। এই সময় দ্রুত ভার্সিটিতে পৌছনো একটু কঠিন। নীহারিকা উপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে। ছাতাটা তার বাবার এক পরিচিত বন্ধু তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। বিদেশি ছাতা। বহু দিনের সখ নীহারিকার। ছাতা মাথায় না ভিঁজে বৃষ্টি দেখার। বাবা তাকেই সেই ছাতা দিয়ে দিয়েছে। কারণ নীহারিকা জানে না। না খুঁজলে বাবা তার জিনিস খুব কমই দেয়। মাথায় কারও হাতের স্পর্শে চমকে গেল সে। সামনে তাকিয়ে নিজের সামনে আবিষ্কার করল একটি গাছ। একটুর জন্য সে তৃতীয় বারের মত ধাক্কার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। চোখ গোলাকার করে নীহারিকা হাত দিয়ে রক্ষাকারীর দিকে তাকিয়েই তার মাথা গরম। জাওয়াদ তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে। দু কঁদম পিছিয়ে নীহারিকা স্বগতোক্তি হয়ে চিন্তা করল, এই লোক এখানে কি করছে? দীর্ঘসময়ের বিরক্তি তার। লোকটি পিছনেই পড়ে আছে। যখন তখন এসে হাজির হচ্ছে। আশ্চর্য! চরম আশ্চর্য! রাগে শরীর জ্বলে উঠল নীহারিকার। গলার স্বর ঝাঝাল করে সে বলল,’ আপনি আমার পিছনে পিছনে ঘুরছেন কোন হিসেবে?’
সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় জাওয়াদ বলল,’ আমি তো তোমার সামনেই রয়েছি। পিছনে দেখলে কিভাবে?’
নীহারিকা পা ঝাড়ল। ক্রমান্বয়ে তার রাগ শরীর বেয়ে মাথায় চড়ছে। লোকটা যথেষ্ট থ্যাতা ধর্মী। এই এক দুই মাসের মাথায় তুমি পর্যন্ত ডাকতে শুরু করেছে। প্রতিদিন ফোন করবে। না ধরলে আরও বিপদ ঘরে এসে হাজির হয়। বাসা ভর্তি সব যেন তার রূপে মুগ্ধ। বাবা জি বাবা জি টাইপের ভাব। অসহ্য হয়ে পড়েছে নীহারিকা। কথা না বলে সে সামনে হাঁটা শুরু করল। জাওয়াদ খয়েরি রঙ্গের টি-শার্ট পড়ে এসেছে দেখে নীহারিকা আরও অবাক হল। এই লোক সব সময় কিভাবে জেনে যায় সে কোন রঙ্গ পড়বে? সামনে হাঁটতে থাকল নীহারিকা। জাওয়াদ উল্টো পায়ে হেঁটে তার সাথে সাথে চলতে শুরু করল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল নীহারিকা। জাওয়াদের এতে কিছুই যায় আসে না। সময় আছে মাত্র একঘন্টা। তাকে হসপিটালে পৌছাতে হবে। এই একটা ঘন্টা সে নীহারিকার আশেপাশে থাকতে বেশি পছন্দ করে। ফলে তার দিন ভালো যায়। মানুষ যেই জিনিস খুব পছন্দ বা ভালোবাসে সেই কাজটি করার ফলে তার মন ভালো হয়ে যায়। ভালো মনে সব কিছুই ভালো হয়। জাওয়াদের অবস্থা তেমন।
‘ তোমাকে আমি ভার্সিটি পৌছে দিব। গাড়ি নিয়ে এসেছি।’
পাত্তাই দিল না নীহারিকা। সে নিজের মত হাঁটছে। জাওয়াদ নিজের ছাতা বন্ধ করে দিল। তাকে ভিজতে দেখে নীহারিকা আক্রশে বলল,’ সমস্যা কি? এখন ভিঁজছেন কেন? আজব।’
‘ আমার ইচ্ছে। তুমি হাঁটো। আমিও হাঁটব।’ মুখ গোমড়া করে বলল জাওয়াদ।
‘ এটা আপনার বাড়ি নয়। আমার কলনি। অনেকে চিনে আমাকে। দেখলে উল্টোপাল্টা ভাববে। বাবার কানে গেলে খবর আছে।’
‘ উল্টোপাল্টা সর্বচ্চো ভাববে তোমার বয়ফ্রেন্ড। এতে আমার সমস্যা নেই।’ জাওয়াদ ফিচেল হাসল। চলা থামিয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনি যদি ভাবেন আমার সাথে সব কিছুতে জিদ করে কিছু হবে তাহলে ভুল ভাবছেন। দূরে থাকুন।’
জাওয়াদ একটু খানি সরল। তারপর বলল,’ আমি ভিঁজে যাচ্ছি।’
ত্যাড়া চোখে একবার দেখে স্পষ্ট ভাষায় নীহারিকা জানিয়ে দিল,’ ছাতা তো সাথেই আছে।’
জাওয়াদ এবার সেটাও ফেলে দিল মাঝ রাস্তায়। চমকিত চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল নীহারিকা। তারপর হাঁটতে শুরু করল।
‘ আমার আজকে সার্জারি আছে। অসুস্থ হয়ে পড়লে রোগী মারা যাবে কিন্তু।’
‘ এতে আমার বাপের কিছু না। আপনার লাইসেন্স যাবে।’
‘ তোমার বাপেরই অনেক কিছু। ভবিষ্যৎ জামাই তার।’
এবার নীহারিকা আগ্নিশর্মা চোখে তাকাল। জাওয়াদ বুকে হাত দিয়ে বলল,’ ভস্ম করার ইচ্ছে থাকলে রোদের দিনে করো। এখন তো বৃষ্টি আগুন জ্বলবে না।’
জাওয়াদের লম্বা চুল গুলো ভিঁজে পানি পড়ছে। কিছুক্ষন পর পর সে পানি ঝারছে। তার খাড়া লম্বা নাক। সুন্দর দাঁড়ি। গোলাপি রঙ্গের ঠোঁট। হালকা লাল গাল। সব ভিঁজে যাচ্ছে। নীহারিকা একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলল,’ আপনি সত্যি ডাক্তার?’
‘ কেন?’ অবাক হয়ে যানতে চাইল জাওয়াদ।
‘ কারণ আমার আপনাকে পাগল মনে হয়। হসপিটাল রেখে আপনি আমার পিছনে বেশি ঘুরেন। ডাক্তারের এত সময় কোথায়?’
‘ আগেই বলেছি পিছনে নয় আমি আপনার সাথে সাথেই থাকি। যাকে ভালোবাসি তার জন্য আমি সব সময় ফ্রি। অবসরে নয় প্রয়োজনের সময়ে যে নিজের প্রিয় মানুষকে সময় দিতে পারে সেই প্রকৃত প্রেমিক। অবসরে তো সবাই দেয়। আমি প্রয়োজনের সময় থেকে সময় বাঁচিয়ে দি। আমার মত প্রেমিক তুমি জনম জনম খুঁজলেও পাবে না। এখন প্লিজ দ্রুত এসো। আমার সকাল দশটায় সার্জারি রয়েছে।’ বিনিত সুরে বলল জাওয়াদ। নীহারিকা ঘাড় ত্যাড়া মেয়ে। যাবে না বলেছে যখন যাবেই না। সে দ্রুত হাঁটতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল, যদি সত্যি জাওয়াদ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সার্জারি করতে সমস্যা হবে। ফলে এটা উঁচিত হবে তো? জাওয়াদ আর হাটলো না। মনটা তার বিষাক্ত হয়ে উঠল। বুক ভারী ভারী হয়ে উঠল। মেয়েটা এমন কেন? সব সময় এমন এভয়েড করে কেন? কখনো কি একটু সময় দেওয়া যায় না? সুন্দর করে দু’টো কথা বলা যায় না? রাগটা সব সময় বজায় রাখা জরুরী? জাওয়াদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। তার বুকটাও লাফাচ্ছে। পৃথিবীর সব কাজে সে সফল। ভালো ছেলে, সুন্দর রূপ, ভালো ডাক্তার, টাকা গাড়ি বাড়ি সব আছে তবুও সে প্রেমে কিভাবে ব্যর্থ হতে পারে? ভাবতেই তার রাগ উঠছে। নীহারিকা একবারও তাকাল না। জাওয়াদ আশাহত চোখে তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছে করতে শিশুদের মত কাঁদতে। এসব তাকে মানায় না বলে সে পাড়ছে না। গাড়িতে উঠে বসল সে। পিছন থেকে তোয়ালে নিতে গিয়ে দেখল নিজের অনুভূতির পাগলামী গুলোকে। সে যেদিন নীহারিকার সাথে দেখা করতে আসে অনেক টি-শার্ট বাসা থেকে নিয়ে আসে। যাতে তার পোশাকের রঙ্গের সাথে মিলাতে পারে। এটাই তার রহস্য। মাথাটা সে দু’ হাতের উপরে ঠেকাল। তার খুব গরম লাগছে। শ্বাস ভারী হচ্ছে। নাক জ্বলছে। তার কান্না পাচ্ছে। কখনো নীহারিকা তার পাশে বসে না। জাওয়াদ নিজের পাশের সিটের দিকে তাকাল। খালি খালি শূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। তার প্রায় ঘুম চলে আসছে। হঠাৎ পিছনের দরজায় কড়া ধাক্কা পড়ে। রেগে জাওয়াদ চেঁচাল,’ কে এমন করছে?’
নীহারিকা সামনের জানালায় এসে বলল,’ পিছনের দরজা খুলুন।’ চমকে উঠে জাওয়াদের চোখ ছানাবড়। সে থ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নীহারিকা বিরক্ত হয়ে বলল,’ আমার দেরি হচ্ছে দ্রুত করুন।’
‘ পিছনেই বসবে? সামনে বসা যায় না?’ জাওয়াদের অসহায় কণ্ঠ। নীহারিকা রূক্ষ ভাবে বলল, না যায় না।’
জাওয়াদ নিচের ঠোঁট উল্টে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল। পরমুহূর্তে খুশি হয়ে দরজা খুলে দিল। নীহারিকা পিছনের সিটে বসল। জাওয়াদ সামনের গ্লাস তার দিকে ফিরাতেই সে ধমকের সুরে বলল,’ একদম এদিকে ঘুরাবেন না। আমি নেমে যাব বলে দিলাম।’
‘ বার বার পিছনে তাকাব তাহলে। ফলে এক্সিডেন্ট হতে পারে। চয়েজ ইজ ইউর।’
‘ স্টুপিড।’ নীহারিকা বিড়বিড় করে বলল। সে জানালা খুলে বসল। জাওয়াদ আয়নায় বার বার দেখছিল। হঠাৎ বলল,’ বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছ তো। অসুস্থ হয়ে যাবে।’
‘ আমার ইচ্ছে। আমি ভিজছি। আপনার কি?’
‘ আমারই সব।’ জাওয়াদ জানালা বন্ধ করতে চাইল। নীহারিকা চিৎকার করল,’ একদম উঠাবেন না। কাঁচ নামান।’
ভয় পেয়ে জাওয়াদ নামিয়ে দিল। নিজেরটাও নামাল। নীহারিকা বুঝে না এই লোক তাকে এত অনুকরণ করে কেন? জাওয়াদ একদিন বলেছিল তার মায়ের অসুস্থতার কারণে সে মন খারাপ করে সার্জারি জয়েন করেছিল। ফলে খুব সিরিয়াস ভুল হতে হতে বেঁচে ছিল। রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে ছিল। এই লোকের মন খারাপ হলেও সমস্যা। মানুষ মরে যাবে। জাওয়াদ গাড়ি ড্রাইভ করছে আর নিজে নিজে হাসছে।
‘ তুমি তো আমাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিয়েছ।’
‘ আপনি নিজেই ড্রাইভার হতে এসেছেন।’
‘ তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? জাওয়াদ একটু থামল। তারপর গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলল,’ আমি কি দেখতে খারাপ?’
‘ আপনি গাড়ি কেন থামালেন? আর এসব ফালতু প্রশ্ন আপনি দেখা হলেই কেন করেন?’ বিরক্তের সহিত বলল নীহারিকা। জাওয়াদ পিছনে ঘুরে তাকাল। নীহারিকা আরো পিছনে ঝুঁকে বলল,’ সমস্যা কি?’
‘ কিছু না। তুমি অনেক সুন্দর।’ জাওয়াদ কথাটা বলে বিস্ময়কর হাসি হাসল। নীহারিকা বেকুব হয়ে প্রশ্ন করল,’ চেহারা তো দেখাই যাচ্ছে না। সুন্দরের কি দেখলেন।’
গাড়ি আবার চালাতে চালাতে জাওয়াদ বলল,’ তুমি সত্যি অনেক সুন্দর। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। তোমার চোখ গুলোতে যখন রোদ পড়ে সেটি হালকা সোনালি হয়ে যায়। তখন তোমাকে দেখতে হরিণীর মত লাগে।’
নিজের চোখে হাত বুলিয়ে নীহারিকা বলল,’ কিন্তু আমি তো মানুষ।’
জাওয়াদ হাসতে লাগল। নীহারিকার এই জিনিস গুলো তাকে মুগ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ করে। হঠাৎ জাওয়াদ খুব সিরিয়াস হয়ে বলল,’ আমি দেখতে সুন্দর, আমার ক্যারিয়ার ভালো, একজন ভালো ডাক্তার, বাবার অনেক অর্থ, ভদ্র, সবাই ভালো বলে। মেয়েরা আমার জন্য পাগলের মত লাইন দিয়ে পড়ে থাকে। সৌন্দর্য, অর্থ, শিক্ষা সব আছে তবুও তুমি কিভাবে এখনো আমার প্রেমে পড়লে না নীহারিকা? কিভাবে?’
জাওয়াদের মুখের ভাব খুব আগ্রহীত। সে জানতে চায় এমন কেন হচ্ছে? নীহারিকা দেখল একনজর। পরে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বলল না। জানালার বাহিরের ধিমি ধিমি বৃষ্টির দিকে নজর পড়ল। অন্য শহরে মেঘ জমিয়ে সে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে জানে। সত্যি তো জাওয়াদের মত ছেলেকে তার পছন্দ হচ্ছে না কেন? প্রেম কেন হলো না? কেন তার বুক শব্দ করে উঠে না? কেন জাওয়াদকে দেখলে খুশিতে আনন্দে তার বুক ধুকপুক ধুকপুক করে না? কেন অনুভূতিরা তার সাথে খেলে না? দূরত্বে কেন তার দম বন্ধ অনুভব হয় না? এসব কেন অন্যশহরের নামে না চাইতেও হয়ে যায়?
জাওয়াদ গাড়ি একটু ধীর গতিতে এগিয়ে নিয়ে যায়। সে চায় এই সময় এখানে থেমে যাক। সে না হয় সারা জীবন দেখেই কাঁটিয়ে দিবে। দেখতে কিন্তু মন্দ নয়। উল্টো অজস্র ভালো লাগা কাজ করে। বুকের শব্দ তীব্র হয়। নীহারিকা যখন কল্পনীক হয়ে পড়ে তার চোখ ছোট হয়ে আসে। মুখটা মলিন হয়ে পড়ে। সেই সময়টায় অন্য এক হৃদয় কাড়া সৌন্দর্য বিরাজ করে। এই মুহূর্তে সে সেই সৌন্দর্যই খুব মিস করছে। করণ সে জানে নীহারিকা কাল্পনীক হয়ে ভাবছে। বৃষ্টির ফোঁটা তার চোখে মুখে এসে পড়ছে। জাওয়াদ এভাবেই দেখতে চায় নীহারিকাকে সারা জীবন। এটা তার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা বলে কথা। ভালোবাসা গুলো এমনই। যাকে ভালোবাসা হয় তার সব ভালো লাগে। তার রাগ, অভিমান, তার কুৎসিত এবং সুন্দর সব দিকই প্রিয় হয়ে উঠে। ভালোবাসা হচ্ছে শব্দ। বুকের শব্দ। হাঁড়ে হাঁড়ে ছড়িয়ে পড়া নেশা। যার আক্রমণে ভালোবাসার মানুষের দুনিয়াটাই ভালো লাগে নিজের করে নিতে। ভালোবাসায় কি মোহনীয় জাদু আছে? নীহারিকা যদি তার জীবনে না আসত তাহলে তো সে বুঝতেই পারত না। ইশ ভাগ্যিস এসেছিল! ভালোবাসা গুলো এভাবেই একটি মানুষের মন, মস্তিষ্ক, অঙ্গ অঙ্গের সাথে অন্যমানুষকে জুড়ে দেয়। এর নামই ভালোবাসা!
____________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
সবার জন্য ভালোবাসা অবিরাম।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..