প্রিয় সুখ-৪৫
হাফসা আলম
.
সকাল সাতটা। এই সময়টা ঘুমানোর। নীহারিকা রাত জেগে পড়ালেখায় জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেছে। বিশেষ করে ঘুমের সময় মেরেছে। পৃথিবীতে ঘুমেরও স্বাধীনতা আছে। সময় মত না ঘুমানোর ফলে নীহারিকা তার ঘুমের টাইম বাড়িয়েছে। এই সুন্দর সকালের মিষ্টি ঘুমটি বেশি সময় স্থায় হতে পারলো না। তার মনে হলো নাকেরজলে চোখের জলে ভাসিয়ে একটি মেয়ে তার খুব কাছে বসে আছে। চুপচাপ তাকে গভীর নজরে দেখছে। আশ্চর্য্য এক রাতের মধ্যে সে কি খুব সুন্দর হয়ে গেছে না কি? বহু কষ্টে চোখ দুটি খুলল সে। বাহিরে ঠান্ডা আবহাওয়া। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। এই সময়টা এমনই। ঘোলা অন্ধকারে ডুবে থাকে সব সময়। বালিশের নরম কোল থেকে ঘুরে নীহারিকা সামনের নারীমূর্তি দেখে আরও এক চট বিরক্ত হলো। নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে বসে নীহারিকা আবিষ্কার করলো জগতের সবচেয়ে অদ্ভুৎ মানুষ গুলোকে আল্লাহ খুব সুন্দর প্যাকেটে করে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এ নতুন কিছু না। বিরক্ত হতে হতে চোখ সোজা করে বসলো সে। নিজের বিরক্তিকে সোজাসোজি প্রকাশ করে বলল,’ কয়টা বাজে জানো? ভদ্র মেয়েরা কখনো এভাবে ক্লাসমিটের বাসায় আসে না। বিশেষ করে মেয়েরা। তুমি এসেছ বেস ভালো কথা আমার রুমে আমার অনুমতি ছাড়া এসে এমন বিশ্রী কান্না জুড়েছ কেন?’
রৌদ্রমূখি বেশ দুঃখ পেলো। সে বহু শুনেছে আজ অনুভব করলো অতিশোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। সেও তো নারী জানে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার দুঃখ কত কষ্টের। তবুও সান্ত্বনার সুরে বলল,’ দুঃখ পাবেন না আপু। আরে বিয়ে হচ্ছে দিল্লিকা লাড্ডু। খাইলেও পস্তাবেন না খাইলেও পস্তাবেন। তাই না খাওয়াই ভালো।’
‘ আমি দুঃখ পাচ্ছি তোমাকে কে বলল?’ গম্ভীর গলা নীহারিকার। যেন সে শিক্ষক। রৌদ্রমূখী একটু ভয়ই পায় এই নারীকে। অবাক হয়ে জানতে চাইলো,’ পাচ্ছেন না?’
‘ দুঃখ পাওয়া খুব জরুরী?’
‘ অবশ্যয়। আপনার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। এই দুঃখে আপনার দুই তিনবার সুইসাইড করতে যাওয়া উচিৎ। কেঁদে পৃথিবীকে ভাসিয়ে দেওয়া উচিৎ।’
প্রিয়ম ঘুমঘুম চোখে বোনকে ডাকতে আসলো। সকাল সকাল বাড়িতে ডাকাত পরেছে এমন অবস্থা। সবাই হইহুল্লোড় করে ছুটাছুটি করছে। মিতু আপুর ছোট ভাইটা পায়ের নিতে পড়তে পড়তে বেঁচেছে। এদের চোখে ঘুম নেই কেন? প্রিয়ম হাই তুলে বলল,’ আপু তোকে মা ডাকছে..’
কথা গলায় আটকে গেছে। এই মেয়ে এখানে কি করছে? ঘুম পালিয়ে রাগ ভর করলো মাথায়।
‘ তুমি আবার আমাদের বাসায় এসেছ? তোমার এতো সাহস?’
রৌদ্রমূখী দ্রুত ভয়ে নীহারিকার পিছনে লুকিয়ে মুখটা বিড়ালের মত বের করে বলল,’ আমি তো আপুর কাছে এসেছি।’
‘ এই মেয়ে আমার আপুর থেকে দূরে থাকো।’ প্রিয়মের মাথা গরম।
‘ তোমার আপু তো কি হয়েছে? তাই বলে কেউ উনাকে আপু ডাকতে পারবে না এমন কোন নিয়ম আছে না কি? আপনি বলুন আপু আছে?’
‘ না।’ গম্ভীর গলাটা এখনো ঝুলে আছে। প্রিয়ম বোনের দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,’ আপু তুই শুধু আমার আপু। সরতে বল ওই মেয়েকে?’
‘ সরে বসো।’ নীহারিকাকে এরা যা বলছে সে করছে। দুজনের তুমুল ঝগড়া শেষ হওয়ার নাম নেই। এবার রেগে ধমকে উঠলো নীহারিকা,’ চুপ করো তোমরা। হয়েছে কি? সকাল সকাল চিল্লাফাল্লা করছ কেন? আমার পরীক্ষা আছে প্রিয়ম। ঘুমাবো একটু।’
রৌদ্রমূখী বিস্মৃত গলায় বলল,’ আপনার তো এখন শোক পালন করার কথা। আপনি ঘুমাবেন এখন? আবার বলছেন পরীক্ষাও দিবেন?’
‘ তুমিই তো বলেছ বিয়ে এমন কোন বড় বিষয় নয়। তাই ঘুমাবো। দুজনই রুম ত্যাগ করো। দ্রুত।’
প্রিয়ম ঠোঁট উল্টে বোনের পাশে শুয়ে পড়ে বলল,’ এই মেয়েকে যেতে বলো। আমিও ঘুমাবো।’
রৌদ্রমূখী বুঝলো যেই সান্ত্বনা সে দিতে এসেছে তা প্রয়োজন নেই। নিজের কাজে সে হতাশ হলো। মন খারাপ করে রুম ছাড়তে গিয়ে শুনলো নীহারিকা চিৎকার করে বলছে,’ মা রৌদ্রমূখীকে নাস্ত করাও।’
রৌদ্রমূখীর মনটা ভালো হয়ে গেলো। সে ছুঁটে এসে শুয়ে পড়া নীহারিকার গালে চুমু খেয়ে বলল,’ আপনি একটু রাগী কিন্তু খুব মিষ্টি। আপনার ভাইয়ের মত নন।’
নীহারিকার মুখের পরিবর্তন হয়নি। আগের মত থেকেই বলল,’ আমি আমার ভাইয়ের মতই। রুম থেকে বের হও। বিয়ের জন্য আমরা শোক দিবস পালন করতে পারবো না।’
রুক্ষ কথাটা গায়ে লাগলো না রৌদ্রমূখী। কেউ যখন তাকে নাস্তা করার কথা বলে, সেই মানুষটা তার প্রিয় হয়ে যায়। তার ব্যস্ত পরিবারের কখনো সময় হয় না তার বিষয়ে খবর নেওয়ার। কেন যেন প্রিয়মনের এই বোনকে তার অসাধারণ ভালো লাগে। আর প্রিয়ম!
প্রিয়ম কতক্ষণ গোল গোল চোখে এই মেয়ের কাজ দেখলো। দ্রুত লাফিয়ে উঠে কাঁথা দিয়ে বোনের গাল ঘসে বলল,’ বের হও রুম থেকে বেয়াদপ মেয়ে। আমার বোনের আশেপাশে আসবে না তুমি ফাজিল।’
রৌদ্রমূখী জিব দিয়ে ভেঙ্গালো। যেতে যেতে বলল,’ আপু আপনার সাথে খাবো। এখন একটু আন্টিকে জ্বালিয়ে আসি। আই লাভ জ্বালানো।’
খুব খোশ মেজাজী মেয়ে সে। সব সময় আনন্দে তলিয়ে থাকে। নিজেকে খুশি রাখাই তার জীবনের একমাত্র কাজ। তাই যখন যা ইচ্ছে হয় করে। বিয়ের খবরটা সে কালই পেয়েছে। তাই সকাল সকাল চলে এসেছে। সেও জানে সকাল সাড়ে ছয়টায় কেউ কারো বাসায় আসে না। অপরিচিতরা তো আরও না। কিন্তু ওই যে মন! মনের উপরে রৌদ্রমূখী কাউকে পরোয়া করে না। কাউকে না।
আরও একবার ঘুরে দেখলো দুই ভাই বোন দুটি কাঁথা দিয়ে মাথা ঢেকে ঘুমাচ্ছে। বড় বোনকে সম্মান করে মাঝে প্রিয়ম নীহারিকার কোলবালিশটি দিয়ে রেখেছে। এরা এতো আদুরে পরিবার কেন? না কি শুধু তার কাছেই লাগে।
_____
সখের নারী বা পুরুষ বলতে একটি রূপকথার বাক্য আছে। পুরুষের জীবনের সখের নারী ঠিক স্বপ্নের মত। নারীর জীবনেও ঠিক তেমনই। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। সেই সকল মানুষকে পাশকাটিয়ে আপনি যখন আপনার সখের, যত্নের, খুব খুব প্রত্যাশার নারী পুরুষকে পেয়ে যাবেন তখন আনন্দ, আপনার ভিতরের আবেগ কিভাবে ফুটে উঠবে এটি কেউ বলতে পারবে না। কারণ প্রতিটি মানুষের চেহারা, আকার, আকৃতির মত তার ভিতরের সকল কিছুই ভিন্ন। নিজের ভিতরটা সকলে প্রকাশ করতে পারে না। শুধু সে জানে তার ভিতরের সেই স্রোত, সেই ঝড় কতখানি উচ্ছ্বাসের, কতখানি হৃদয়হীম করা। দীর্ঘশ্বাস খবরের কাগজে ঢেলে নাফিস উদ্দিন ভাবলেন তার সখের নারীকে পাওয়ার গল্প। শামাকে ভাইয়ের বউ হিসেবে একদম পছন্দ ছিলো না উনার। তাদের পরিবার সেই বিয়ে খুব সাধারণ ভাবে মেনেও নেয়নি। তবুও তার ছোট বোনের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে তিনি ভুল করেই জড়িয়েছিলেন। প্রথমে অবশ্য
জানতেন না। যখন জানতে পেরেছেন তখন ফিরে আসা অসম্ভব। তারপরের গল্প রূপকথার মতই। কপাল খারাপ ভালোবাসার কাছে হার মেনে নিয়েছিলেন তিনি। তবে আফিয়ার বাবা কখনো তাদের বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিভাবে তিনি রাজি করিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন। সেই গল্প ভয়ংকর মনে হয়। এখনো চিন্তা করলে অন্তর কাঁপে। সত্যি বলতে শ্বশুরকে বেশ ভয় পেতেন তিনি। বহু কষ্টের সখের নারী আফিয়া তার। তাই তিনি জানেন সখের নারীকে কিভাবে রাখতে হয়। কিভাবে যত্ন করতে হয়। কিভাবে আগলে রাখতে হয়। অথচ চোখ বুজে নিলে নিজেকে তার তেমন পরিপূর্ণ মনে হয় না। চায়ের কাপ হাতে আফিয়া বিলকিস স্বামীর পাশে বসে বললেন,’ কিসের এতো দীর্ঘশ্বাস আপনার?’
চশমান কাঁচ গলিয়ে দেখছেন তার বহু পুরনো কিন্তু সব সময় নতুন রূপে প্রেমে পড়া নারীকে। আজ হঠাৎ বহু বছর পরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’ তুমি আমার সাথে সুখি আফিয়া?’
চমকে উঠে আফিয়া বললেন,’ অবশ্যয়। হঠাৎ প্রশ্ন কেন?’
‘ আচ্ছা একজন হাজবেন্ড কেমন হওয়া উচিৎ তোমার চোখে?’
‘ একদম আপনার মত।’ নিরবিচ্ছিন্ন জবাব। জিবের আগায় প্রস্তুত ছিলো,’ কারণ আপনি একজন যত্নশীল পুরুষ। প্রয়োজনে তো সবাই সময় দেয়। আপনি আপনার জীবনের অবসর সময় গুলোও আমাকে দিয়েছেন। আমার যত্ন নিয়েছেন। আমাকে অসম্ভব ভালোবেসেছেন। এটাই যথেষ্ট।’
‘ তোমার মেয়ের জন্য তুমি কেমন হাজবেন্ড চাও।’
আফিয়া গড়গড় করে বলল,’ অবশ্যয় আপনার মত।’
নাফিস উদ্দিন মনে মনে খুশি হলেও মুখে বললেন,’ হয়েছে কি আজকে শুধু অবশ্যয় আপনি আপনি করছ কেন!’
‘ কারণ আপনি আমার চোখে সেরা। পৃথিবীর সেরা জিনিসই মানুষ নিজের সন্তানের জন্য চাইবে এটাই স্বাভাবিক তাই না?’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি বললেন,’ আমার চোখে আমি সেরা নই। আমি চাই আমার মেয়ে আরও ভালো জীবনসঙ্গী পাক। জাওয়াদ তেমনই ছিলো।’
বড় আফসোসের সুরে বললেন তিনি। আফিয়া বিলকিসের মাথা গরম হতে সময় নিলো না। এমনেতে ভদ্র মহিলা শান্তই থাকে। শুধু বাচ্চাদের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করে এই যা।
‘ তুমি কি চাও আমার বোনের একমাত্র ছেলেটা মারা যাক? এই তোমার ভালোবাসা?’
‘ ভালোবাসায় একদম প্রশ্ন তুলবে না। ওই ছেলে নিজের যত্ন নিতে পারে? সারাদিন কি সব পড়ে ঘুরে বেড়ায়। মুখ এমন করে রাখে যেন করলা খাইয়ে দিয়েছি। দেখতেও তো ওতো সুন্দর না। তার মাঝে আবার উদ্ভট কাজ কারবার করে। আমার মেয়েকে আমি ওই বেয়াদপের হাতে দিয়ে তো একদিনও ঘুমাতে পারবো না শান্তিতে।’
‘ তোমার চোখে তো ভালো কিছুই পরবে না। জাওয়াদের ভুত এখনো নামে নি যে। লাখে একটা ছেলে। কত ভালো পরিশ্রমী! সবচেয়ে বড় কথা রান্না করতে পারে। নিজের মেয়ে এমন কি পারে যে উনার জন্য সাত সমুদ্র পার করে রাজপুত্র আসবে? ডিম ভাজতে পারে তোমার মেয়ে? দেখো ঘুমাচ্ছে! ঢং।’
‘ একদম মেয়ের পিছনে পড়বে না। সে পড়েছে রাত জেগে। আমি তো রাজপুত্রই খুঁজে নিয়ে এসেছি। তোমার বোনের ছেলের হজম হলো না।’
‘ ভাইয়ের ছেলের আকুতি মিনুতি দেখে আমি পাগল হয়ে হসপিটালে নিয়ে যাই নি। সাতদিন হসপিটাল বাড়িতে দৌড়ঝাপও করিনি। মেয়েকে দান করে দিয়ে আসিনি।’
মুখ বাঁকালেন তিনি। কোথায় ভাবলেন জামাই একটু রোমান্টিক মুডে আছে দুটো সুন্দর কথা বলবে ধ্যৎ। তিনি ভুলে কেন জান এরা কত নিরামিষ। মেয়ে একটাও হয়েছে বাপের মত। তিনি চলে গেলেন রান্না ঘরে। কিছুক্ষণ পরেই সবাই খেতে চলে আসবে।
নাফিস উদ্দিন থমথমে মুখে আবার পেপার পরছেন। তিনি ভয়ে আছেন কখন এসে এই ছেলে আবার পা ধরে বসে বলে বিয়ে করবে তার মেয়েকে! নিজের মেয়েকে তিনি একদম দিতে চাইছেন না ওই উজবুকের কাছে। তবে মনে মনে ভালো দিক গুলো খুঁজে বের করছেন।
_______
সাদা রঙ্গের বাড়িটির শরীর বেয়ে এই কয়েকদিনে বেশ লতা প্যাচিয়েছে। অপরাজিতা গাছের ফুল গুলো ঘন হয়ে ফুঁটেছে সাদার শরীরে। বেশ মানানসই। এই এলাকা জুড়ে এমন বাড়ি খুজে পাওয়া দুষ্কর। ডিজাইন খুব ইউনিক। তাদের পুরানো আমলের বাড়িটি সম্পূর্ণ রূপে নিরুদ্দেশ হয়েছে। পিছনে ঘুরে তারপর যেতে হবে। আগে কত সুন্দর সবুজ একটি মাঠ ছিলো। খেলা করে বড় হয়েছে নীহারিকা প্রিয়ম। অবসরে বসে কত চা খেয়েছেন খোলা মাঠে। মনে মনে চাপা রাগটি মাথা চারা দিয়ে উঠতে দিলেন না। এটাই এই জগতের একটি বিচিত্র নিয়ম। দিনে দিনে প্রতিটি মানুষ যেভাবে নিজের বাড়িঘর তৈরি করছে বেশি দিন নেই সুন্দর বনজঙ্গল গুলো হারিয়ে যেতে। আমাজনের মত বিশাল ফরেস্ট যেখানে একটু একটু করে মানবজাতির দখলে চলে আসছে সেখানে তার খোলা এই মাঠ কি আর এমন জিনিস! ভাইকেও খুব একটা দোষ তিনি দিচ্ছেন না। উপরে উপরে যতই অপছন্দ করুক ভিতরে তো রক্ত। রক্তের টান জগতে সবচেয়ে আনমোল। ডান পাটা তিনি রাখলেন বেশ ধীরেই। এই প্রথম। আফিয়া বিলকিস উনার অপেক্ষায় নেই। বয়সের ধার না ধেরেই বোনের বাড়িতে ছুটছে। নাফিস উদ্দিনের থমথমে মুখ। কি খারাপ দিন আসলো তার। এই চৌকাঠে পা দিচ্ছেন। ভিতরে ঢুকে মনে মনে আরও চমকে গেলেন। কি অভিনব সুন্দর ডিজাইন! বিস্মৃত হতে বাধ্য। আসবাবপত্র সব সাদা। পর্দা গুলোতে হালকা একটি শান্ত গোলাপের রং আঁচড় কেটেছে। সোফাটি অত্যন্ত সুন্দর। একটি সোফা দোলনার মত। চাইলেই দোল খাওয়া যাবে। নাফিস উদ্দিন এবং তার পরিবারকে দেখে শামা খালামনির হাতের সবজির প্লেট ধপ করে নিচে পড়ে চক্র আকারে ঘুরতে শুরু করেছে। বিকট এই শব্দে
‘ কি হয়েছে?’ প্রশ্ন করে দোলনায় বসে থাকা নবীন উদ্দিন হতচকিত হয়ে খবরের কাগজটি সরিয়ে সামনে তাকালেন সাথে সাথে তিনিও তব্দা খেলেন। চোখ ভালো করে ডলে আবার তাকালেন। শামাখালানিকে বললেন,’ আমি যা দেখছি তুমিও কি তাই দেখছ শামা?’
‘ তাই তো দেখছি। ও গো মাথা মনে হয় দুইজনেরই গেছে।’
শামা খালামনি বিশ্বাসই করতে পারলেন না তার বোনের জামাই এবং দেবর, নাক উচু একজন ব্যক্তি তার চোখের সামনে তারই বাড়িতে দাড়িয়ে আছে। আনজুম দ্রুত মাকে ধরে ফেলল। হতভম্ব তিনি এখন পড়েই যাচ্ছিলেন। নবীন উদ্দিন হুড়াহুড়ি করে নিজের বাবাকে গৃহপ্রবেশ করালেন। সোফায় বসিয়ে তার পায়ের কাছে বসে বললেন,’ তোমার শরীর ভালো বাবা?’
দাদামোশায় চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,’ ভালো না হলে তোমার বাসায় এসেছি কিভাবে? তুমি তো এটাই চাও আমি হসপিটালের বিশ্রী বেডে শুয়ে থাকি।’
প্রখড় বুদ্ধিমান নবীন উদ্দিন আজকে নিরবুদ্ধিতার পরিচয় দিলেন। আসলে উনার মাথা কাজ করছে না। এটা উনার জন্য বিষ্ময়ের। ছোট ভাইয়ের দিকে একবার তাকান। আফিয়া মিটিমিটি হাসছে। শামা খুশি। খুব খুশি। পাগল পাগল হয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আফিয়ার হাত ভর্তি খাবারের বক্স। নাফিস উদ্দিনের হাতে বাহারি মিষ্টান্ন। নবীন উদ্দিন ছুটলেন ছোট ভাইয়ের কাছে। গম্ভীর মুখ তার। কথা বলছে না। নির্জীব দাড়িয়ে।
‘ তুই আমার বাসায় সত্যি এসেছিস?’ বোকা বোকা গলা।
‘ না। এটা আমার ভুত। তোর বাসায় মানুষ আসে না কি?’ সিরিয়াস কন্ঠে ঠাট্টা। নবীন উদ্দিন এই প্রথম ভাইয়ের কোন কথা গায়ে লাগালেন না। হাতের প্যাকেট গুলোর স্থান হলো ফ্লোর। তিনি খুব উত্তেজিত। জীবনে প্রথম তার ভাই তার বাড়িতে এসেছে। যদিও বাড়ির বয়স কম। সংসারের তো বয়স হয়েছে। সেটাতেই আসলো কই! আনজুম মিষ্টি হেসে প্রিয়মের চুল নেড়ে বলল,’ কি অবস্থা ছোট সাবেহ?’
একটু হাসল সে। পরিবেশ আনন্দঘন। ছোট খালামনিও সাথে এসেছে। মিতু আপু বেশ লাফঝাপ করে বাড়ি দেখছে। কিছু কিছু ডেকোরেশন দেখে আত্মহারা গলায় বলছে,’ আনজুম তোমাদের বাড়ি তো সেই রকম সুন্দর।’
ছবি তুলে শাহিন ভাইকে পাঠাচ্ছেন। সকলের হইহুল্লোড়ে নিশ্চুপ ভদ্র বাড়িটি তাল হারিয়েছে। তিনজন মানুষ অবশ্য শান্ত। নবীন উদ্দিন ভাবছে কিভাবে কথা আগাবে। নাফিস উদ্দিন থমথমে। আর দাদামশায় দুই ছেলেকে দেখছে। এদের মান অভিমান শেষ হওয়ার নয়। নবীন উদ্দিন আবার বোকার মত বলল,’ ইয়ে মানে কি জন্য এসেছিস বললি না যে?’ পুরাই ব্যাক্কেল মার্কা প্রশ্ন। শামা খালামনি মাথা চাপড়ে বোনকে বলল,’ এই লোকের মাথা গেছে। কি সব বলছে দেখ।’
নাফিস উদ্দিন চুপ করে নেই,’ তোমার ছেলেকে দেখতে এসেছি।’ সিরিয়াস কন্ঠ তার। নবীন উদ্দিন লাফিয়ে উঠার মত করে বলল,’ আনজুম তোমার ভাইকে সাজিয়ে নিয়ে এসো।’
হ করে সকলে তার মুখের দিকে তাকালো ঠিক তখনই। নাফিস উদ্দিনও হতভম্ব। নবীন উদ্দিন হেসে বলল,’ আরে পৃথিবীর সবাই মেয়ে দেখতে যায়। আমাদের পরিবার একটু ব্যতিক্রম তো তাই ছেলে দেখতে এসেছে। শুন আমার ছেলে কিছুদিন আগে এক্সিডেন্ট করেছে তো তাই একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। তুই আবার ওকে খোড়া ভাববি না কিন্তু। ছেলে আমার মাশআল্লাহ সব পারে। রান্না থেকে শুরু করে বাগান সাজানো। কি যে বলবো ওর গুনের শেষ নেই। তুই দেখে নিস। এই আনজুম যাও তোমার ভাইকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসো। শামা নাস্তার প্লেট সাজাও। ছেলের হাতে দিবা।’
আনন্দঘন পরিবেশ মুহূর্তে বিমূঢ়। কেউ মুখে রা তুলতে পারলো না। নাফিস উদ্দিন এতো সময় পরে নিজের ভাইকে খুঁজে পেলেন। আসলে তো এটাই তার পাগল ভাই। খুব বিনোয়ী সেজে পাশে বসলেন নবীন উদ্দিন। লাজুক গলায় জানতে চাইলেন,’ তা মেয়ে আসেনি দেখতে?’
ভিষণ বিরক্ত নাফিস উদ্দিন,’ ফাজলামি বন্ধ করো। ওর পরীক্ষা আছে।’
উঁচু গলায় নবীন উদ্দিন বলল,’ বেশ বেশ। মেয়ে ব্যস্ত আছে। বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে। তারা পছন্দ করলেই বিয়ে পাক্কা ধরে নিবো।’
ফাবিহা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। আনজুমের সাথে হাসতে হাসতে উপরে উঠে বলল,’ তোমরা সবাই এক একটা সোপিস বড় আঙ্কেল।’
নবীন উদ্দিনের মেজাজ ফুরফুরে। প্রচন্ড ব্যস্ততা দেখাচ্ছে সোফায় বসে বসে। যেন আজ তার ছেলেকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। এই ইতিহাস গড়তে পেরে তিনি বেজায় আনন্দে উল্লাসে ফুলে ফেঁপে উঠছেন।
বিমুগ্ধের রুমটি দোতলার দক্ষিন সাইডে। এখান থেকে সরাসরি পিছনের এড়িয়ে দেখা যায়। হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসেছে আজ দুই দিন হতে চলেছে, সেখানে ছিলো সাত দিন। প্রথম দুটি দিন তার স্বপ্নের মত লেগেছে। সর্বোক্ষণ নীহারিকা নামক রাগী মেয়েটি ঘুরে বেড়াতো আশেপাশে ছায়ার মত। রেগে রেগে খাবার খেতে বলতো, যত্ন করত। কোন নার্স বিমুগ্ধের দিকে একটু মুগ্ধ হয়ে তাকালে রাগে তার নাক মুখ গাল লাল হয়ে উঠত। যেন চড় দিয়ে সবাইকে সোজা করে দিবে। বিমুগ্ধ সে সবকিছু গভীর মনযোগের সাথে দেখত। হৃদয় প্রফুল্লচিত্তে আনন্দ।প্রকাশ করার মত না। যতক্ষণ নীহারিকা হসপিটালে থাকত বিমুগ্ধ শুধু তাকে দেখে দিন পার করত। যত দেখত মনে হতো এই দেখার শেষ নেই। নতুন করে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে সেই নারীর রহস্য! সৌন্দর্য্য। কত অজানা ছিলো সে। পরিশেষে বিমুগ্ধ বুঝলো ভালোবাসার নারীর রূপ, লাবন্য জৌলুস শেষ হবার নয়। জনম জনম ধরে সেটি বৃদ্ধমান। সেই প্রিয় নীহারিকা হঠাৎ করে ধোয়া উঠা চায়ের কাপের মত গায়েব হয়ে গেল। দেখা নেই সাক্ষাৎ নেই। সব মিলিয়ে বিমুগ্ধের মন মলিন বিষন্ন। কিভাবে এই মন খারাপ ভালো করা যায় বন্ধুমহলের কেউ জানে না। গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া তাদের কোন কাজ নেই। বন্ধু তাদের এমন জায়গায় মরেছে তারা চাইলেও উদ্ধার করতে পারবে না। প্রেম যে বড় ভয়ংকর এক দুর্যোগ বিমুগ্ধ তাদের শিক্ষা দিচ্ছে পদে পদে। শান্ত হাফ ছেড়ে বলল,’ আর কত সময় এভাবে মুখ লটকাইয়া বসে থাকবি? বেশি মনে পরলে ঘরে হামলা কর।’
এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করে অর্পন শুধালো,’ বললেই হলো? শুন অনেক কষ্ট করে রক্ত ঝরিয়ে বিয়েটা বন্ধ করেছিস। তোর ভুল ভাল কাজে দেখা যাবে তোর হবু ঘ্যাড় ত্যাড়া শ্বশুর বেঁকে বসলো তখন কিন্তু মসিবত।’
এই কথার সাথে শান্ত একমত নয়। তবে মনে মনে সত্যি সেও ভয় পায় নীহারিকা এবং তার বাবাকে। তাই চুপ করে রইলো। বিমুগ্ধ এদের কথায় মন দিচ্ছে না। সে অনুরাগহীন। চোখ দুটি যেন বলছে, তার মত হাস্যউজ্জ্বল ছেলেটির হাসি কেড়ে নিয়ে তুমি ভালো থাকবে না নীহারিকা।
মুহিব বলল,’ যত যাই বলিস জাওয়াদটার জন্য খারাপ লাগছে। বেঁচারার দুই দুই বার বিয়ে ভাঙ্গলো। সারা জীবন দেখলাম মেয়েদের বিয়ে ভাঙ্গে। শালার জীবনটা শেষ।’
বিমুগ্ধ বালিশ ছুড়ে মেরে বলল,’ বেশি দরদ হলে আমার বাসা ত্যাগ করে দরদ দেখা।’
‘ আরে আমি তো মজা করছি।’ মহিব মাথা চুলকে বলল। শান্ত ফিসফিস করে বলল,’ মাথা খুব গরম। সুখপাখিকে দেখে না অনেক দিন। বয়স হয়েছে তো। বিয়ে বিয়ে করছে মন।’
বিমুগ্ধ ঠিক শুনলো তাদের তিরষ্কার। সব গুলোকে ঠেলে বিছানা থেকে সরিয়ে বলল,’ আমার মন তো যথেষ্ট ভদ্র। বিয়ে বিয়ে করছে। তোর মত মেয়ে মেয়ে করে না। সেকেন্ডে সেকেন্ড পাল্টি নেওয়া পাবলিক একটা।’
শান্ত তেড়ে এসেছিলো কিছু বলতে। আনজুমের সাথে দাড়িয়ে থাকা শ্যাম সুন্দর সেই নারীকে দেখে চমকে গেল। আগেও এক দু বার দেখা হয়েছে। কিন্তু তখন বন্ধুকে নিয়েই তাদের যত ব্যস্ততা। আজ এভাবে হঠাৎ করে দেখে শান্ত সত্যি খুব শান্ত হয়ে গেল। ফাবিহার মুখের স্নিগ্ধতা বেড়েছে। উজ্জ্বলতা আনন্দের। সে খুব ভালো আছে তার জীবনে। এটা উপলব্ধি করতে পেরে শান্তর হঠাৎ খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। গলায় নিঃশ্বাস আটকে পড়ার মত খারাপ লাগা। সে সকলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আনজুম লাজুক মুখ করে বলল,’ ব্রো তোমাকে পাত্রী পক্ষ দেখতে এসেছে। একটু সাজুগুজু করো প্লিজ।’
গরম মাথার বিমুগ্ধ রেগে তাকাল। আনজুম পাত্তা না দিয়ে বলল,’ আব্বি বলেছে দ্রুত রেডি হতে।’
‘ রূবাইদার পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি আবার কেন এসেছে মাথা ব্যথা করতে? আশ্চর্য্য।’
শরীরে একটি সাদা ঢোলা টিশার্ট, একটি শর্টস পড়ে বিমুগ্ধ খুড়িয়ে খুড়িয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। আনজুম বহুবার ডাকল সে শুনলোই না। সিড়ির কাছে উপস্থিত হয়েছে সে। নিচে তাকাল। নাফিস উদ্দিনের হাতে শরবতের গ্লাস। তিনিও উচ্চ শব্দ শুনে উপরে তাকালেন। বিমুগ্ধের অবস্থা দেখে তিনি বিরক্ত। দুজনের চোখা চোখি হলো। রিতিমত চমকে গেল বিমুগ্ধ। আনজুম হেসে বলল,’ আমি আগেই বলেছি পাত্রীপক্ষ এসেছে।’
বোনের মাথার সোনালী চুল টেনে নিম্ন স্বরে বলল,’ এখানে হচ্ছে কি?’
‘ সত্যি বলছি তোমাকে দেখতে এসেছে। পছন্দ না হলে রিজেক্ট।’
বিমুগ্ধের কি হলো উপস্থিত কেউ বুঝতেই পারলো না। সে ঝড়ের গতিতে ছুটতে চেষ্টা করলো। যদিও পায়ে খুব ব্যথা। সব উপেক্ষা করে সে নিজের রুমে চলে গেলো। ফাবিহা হো হো করে হেসে বলল,’ পাত্র লজ্জা পেয়েছে।’
নাফিস উদ্দিন স্ত্রীর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে। চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এমন পাগল ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে কখনো মেনে নিবেন না। কখনো না।
প্রায় আধাঘন্টা সময় লাগিয়ে বিমুগ্ধ নিচে এসেছে। সত্যি সত্যি এবারের তাকে কোন অংশে অদেখা করার মত নয়। একজন প্রতিষ্ঠিত সুশ্রী, সুদর্শন পুরুষমানুষের রূপে তাকে প্রচন্ড আকর্ষণীয় লাগছে। কড়া পারফিউমের ঘ্রানে পরিবেশ তখন মুখরীত। পুরুষদিপ্ত মুখটি অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী নিজেকে নিয়ে। নাফিস উদ্দিন হা করে থাকা মুখটি আরও একটু হা হয়ে গেলো যখন গম্ভীর মুখ করা ছেলেটি সুটবুট পড়ে তার সামনে খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হলো। সালামও দিলো মনে হয়। বিমুগ্ধ দোলনায় বসলো। খুব ভদ্রতা তার মাঝে। নাফিস উদ্দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে এদের কান্ড দেখে। পরিবারের সবার পেট ফেটে হাসি আসছে। শান্ত সবার আগে মুখ খুলল,’ আঙ্কেল আপনি প্রশ্ন করুর।’
‘ কিসের প্রশ্ন?’ অপ্রস্তুত কন্ঠ নাফিসের।
‘ আরে মেয়ে দেখতে গেলে যা প্রশ্ন করে আপনি চাইলে ওকে করতে পারেন। আমার বন্ধু রান্না করতে পারে, ঘর গুছিয়ে রাখতে পারে, কাপড় ধোয়া নিয়ে টেনশন নেই। ওর বাসায় ওয়াশিং মেশিন আছে। এছাড়াও ঘরের কাজে একদম সেরা। আরে আরে চিন্তা নেই বাহিরের কাজও ও করবে। আপনার মেয়ে শুধু পায়ের উপরে পা তুলে খাবে আর ঘুমাবে। তবুও দয়া করে বিয়েতে না বলবেন না।’
মুহিব সোফার বালিশ নিজের মুখে চেপে ধরে রেখেছে। হাসি থামানো মশকিল। নাফিস উদ্দিন প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন,’ এই বেয়াদপ আমার সাথে ফাইজলামি করছ তোমরা?’
অর্পন কখনো ফাইজলামি করে না। কিন্তু আজকের এই মুহূর্তে নিজেকে সে দমিয়ে রাখতে পারলো না। খুব সিরিয়াস মুখ তার,’ ছেলে দেখতে শুনতেও ভালো। লম্বা, নাক উচু, চুল আর্মি কাট, খোঁড়া না আবার। এক্সিডেন্ট হয়েছে তো ভালো হয়ে যাবে। স্মার্ট। তবে গায়ের রং একটু চাপা। সে আর এমন কি! যদিও আপনার সুন্দর ছেলে পছন্দ তবুও আমার বন্ধু কোটিতে একটা।’
নাফিস উদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উঠে দাড়িয়ে টেনে নিজের শার্ট ঠিক করে গম্ভীর মুখে চলে যেতে লাগলেন। মুহিব হো হো করে হেসে বলল,’ যৌতুকও দিবে। যা চাইবেন তাই। তবুও প্লিজ বিয়েটা ভাঙ্গবেন না।’
‘ চুপ বেয়াদপের দল।’ নাফিস উদ্দিনের চোখ মুখ ভিষণ কঠিন। তিনি যখন দরজার কাছে বিমুগ্ধ দ্রুত আটকে ধরে বলল,’ আরে আরে বলে তো যান পছন্দ হয়েছে কি না? দেখুন ছোট বাবা আমি কিন্তু খুব অধৈর্য্য। প্লিজ আমার বয়স চলে যাচ্ছে।’
‘ তোমাকে আমি দেখতে এসেছি। হসপিটাল থেকে আসার পর তোমার খালামনি পাগল করে দিচ্ছিলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম মহিলা মানুষের কথা শুনলে জীবনে আমি বিপদেই পড়বো। যা করেছ এনাফ। চড় খেতে না চাইলে যেতে দেও।’
বিমুগ্ধকে ঝুঁকতে দেখে নাফিস উদ্দিন ভয় পেয়ে গেলো। এই ছেলে তো কথায় কথায় পায়ে পড়ে। সে গিয়ে বলল,’ বিয়ের কথা পরে হবে। এখন যেতে দেও।’
‘ পাকা কথা বলেই যাবি।’
বিপদে পড়ে নাফিস উদ্দিন হঠাৎ খুব শান্ত হয়ে গেলেন। কি যেন চিন্তা করে বললেন,’ আচ্ছা বিয়ে কালকেই হবে।’
উপস্থিত সকলে এতসময় মজা করলেও এখন সিরিয়াস খুব। তাদের মুখ থমথমে। সকলে এই সিদ্ধান্তে কেমন যেন ভয় পেয় গেলো। নাফিস উদ্দিনের মনে নিশ্চয়ই কিছু ভয়ংকর পরিকল্প না আছে! বিমুগ্ধের কপালে ভাঁজ পড়লো। নাফিস উদ্দিন এবার ড্রাইনিং টেবিলে বসলো। মৃদূ হেসে বলল,’ খাবার খেয়েই যাবো তাহলে।’
তার এই হাসিতে আফিয়া বিলকিস বিরাট মতলব বুঝতে পারলো। কি দরকার ছিলো সবার মজা করার? তিনি রেগে বোনকে বললেন,’ তোর ছেলের কপালে দুঃখ আছে।’
শামাও বেশ ভয় পেয়ে আছেন। বিমুগ্ধ তাকিয়ে আছে নাফিস উদ্দিনের ঠোঁটের হাসিতে। হাসিটা কেমন যেন পৈশাচিক!
_____________
আকাশ মেঘলা। বাতাস বইছে তীব্রভাবে। ধূলোবালি শুকনো পাতা উড়ছে এলোমেলো। নীহারিকা হল থেকে বের হয়ে ঘড়ি দেখলো তিনটা বাজতে চলেছে। দ্রুত পায়ে রাস্তায় নেমে আসল সে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। এই সময়টা বৃষ্টিময়। টানা ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে কিছুদিন ধরে। কালকে কড়া রোদ ছিলো। আজকের পরিবেশ অন্ধকার। সূর্য ডুবে গেলে যেমন হয় বিকেল ঠিক তেমন। ভার্সিটির গেটের কাছে একটি অশ্বত্থ গাছ আছে। বলা হয় বহু বছর পুরোনো এই গাছটি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখন নামতে শুরু করল। নীহারিকা দ্রুত সেই গাছের ছায়ায় নিজেকে একটু লুকিয়ে নিয়েছে। পাতা ভিজে পানি গায়ে পড়ছে না তেমন। আজকের পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি। তার পরীক্ষা কখনোই সেভাবে ভালো হয় না। তাই খুব একটা আফসোস সে করছে না। কিন্তু ভার্সিটিতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে সে খুব রেগে আছে। নাক মুখ লাল। সিনিয়র কিছু আপু তাকে ইদানিং খুব বিরক্ত করছে। নীহারিকার তো মাঝে মাঝে চড় দিতে ইচ্ছে করে। নিজেকে সামলায় সে। চিন্তা করে কোথাও সে এমন কিছু কি করেছে যার জন্য তাকে এসবে পরতে হচ্ছে? মনে পরছে না। নীহারিকার চিন্তা শক্তি ঘুরলো। বিমুগ্ধকে সে হসপিটালে দেখতে গিয়েছিলো প্রতিদিনই। কিন্তু সে সামনে যায়নি। বিমুগ্ধের আবেগ আবেগ চোখ, শরীর হীম করা দৃষ্টি, নির্নিমেষ তাকে দেখা এসব তাকে এক গভীর উষ্ণতায় ডুবিয়ে দেয়। কিশোরী মেয়েদের মত উড়ো উড়ো করে হৃদয়। লজ্জিত হয় সে। লজ্জা পেলে নিজেকে কেমন লাগে নীহারিকা জানেন না। কিন্তু বিমুগ্ধকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সিক্ত গাল দুটি তার রক্তিম। এক ছটাক রক্তবর্ণ চূর্ণ এসে মিশেছে মুখশ্রীতে।
বৃষ্টির মাঝে হইচই হচ্ছে। নারীদের বেশ ভীর। ভ্রু কুটি করে বিরক্ত নিয়ে নীহারিকা একটু ফাঁক দিয়ে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে রাগ আরো দুই চামুচ বেড়েছে। বিমুগ্ধ গাড়ির উপরে বসে বসে বৃষ্টিবিলাশ করছে। সুদর্শনের চাইতেও তার ফ্যাশনের উদ্ভট বিষয়ের জন্য বিমুগ্ধ মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম। কালো ব্লেজারটি গাড়ির গায়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। সাদা শার্টির বোতাম চারটিই খোলা। খালি বুকে ঝুলছে দুই একটি অদ্ভুৎ লকেট, চেইন, হাতের ব্যাসলেটের মাঝে একটি দামি ঘড়ি আছে। বিমুগ্ধের চোখের উপরে সানগ্লাস। মাথায় একটি গোল কালো ক্যাপ। পিছনে দুটি হাত দিয়ে আপন মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির পানি গিলছে যেন। মেয়েদের দৃষ্টি তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। দেখারই কথা। একজন মানুষ বৃষ্টির মধ্যে নায়ক লুকে বসে থাকলে তাকাবে এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ নীহারিকার পছন্দ হলো না। তার রাগ এবার মাত্রা ছাড়া। বৃষ্টিকে সব সময় অপছন্দ করা সে বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়লো। বিমুগ্ধের গাড়ির কাছে আসতে তার বেশ পরিশ্রম গেছে। কণ্ঠ বেশ গরম,’ এখানে কি করছেন আপনি? আর এসব কি? নামুন।’
বিমুগ্ধ কিছু সময় তবুও বসে ছিলো। নীহারিকা আরও একটি ধমক দিয়েছে। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে। কেউ কেউ বলছে,’ এই লোক তো প্রায় আসে।’
‘ হ্যা হ্যা। এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড হবে।’
‘ ইশশ সো হট ইয়ার।’
নীহারিকা মেয়েটির দিকে আগুণ চোখে তাকালো। এই চোখ জোড়া দেখে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। তারা দ্রুত সরে পড়লো। বিমুগ্ধ একটু বৃষ্টিবিলাশ করছিলো। মেয়েরা যে তার রূপে ফিদা হবে সে জানে। কিন্তু এভাবে তাকে বিপদে ফেলবে বুঝতে পারেনি। নীহারিকার আগুন চোখ তাকে ঝলসে দিচ্ছে। নিচে নেমে আসতে আসতে নীহারিকা রাস্তা ধরে হাটা শুরু করেছে। তখন ঝুম বৃষ্টি। রেগে রেগে মুখ থেকে পানি সরাচ্ছে সে। বিমুগ্ধ পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। নীহারিকা পিছনে ফিরে তাকালো। ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বিমুগ্ধ হাত উপরে তুলে বুঝালো সে ধীরে ধীরে হাঁটবে। নীহারিকা হাঁটছে। বিমুগ্ধ পিছন পিছন। একটু এগিয়ে কাছে গিয়ে বলল,’ আমার মত একজন পুরুষ নারীদের স্বপ্ন পুরুষ বুঝলে। তুমিই যে কেন দাম দিচ্ছো না।’
‘ তাহলে তাদের গলায় ঝুলুন।’ নীহারিকার কন্ঠে জ্বালাময়ি রাগ।
‘ জেলাস? হওয়া ভালো। এতো সুন্দর একজন সঙ্গী তোমার। একটু তো জ্বলতেই হবে রাগেশ্বরী।’ বিমুগ্ধ আড়চোখে তাকালো। নীহারিকা কথা বলল না। রেগে রেগে হাটছে।
‘ এতো ভাব নিচ্ছ কেন? আমার পিছনে জগতের সব সুন্দর মেয়েদের লাইন লেগে আছে জানো? হাত ছাড়া হলে পস্তাবে।’
‘ আমার পিছনেও জাওয়াদের মত সুদর্শন, অত্যন্ত সুন্দর, এবং সকল নারীর হৃদয় থামিয়ে দেওয়ার মত পুরুষের লাইন আছে।’
খোঁচা জায়গা মত পড়েছে। বিমুগ্ধ নিজের সকল অহংকার রূপ ছেড়ে নিকটে গিয়ে মৃদূ ছন্দে পেলব হাতটি নিজের নরম হাতটিতে নিলো। নীহারিকা চমকায় না। অনুভূতি প্রকাশ করে না। শুধু অনুভব করে একজন পুরুষের নরম হাত! সত্যি বিমুগ্ধ অন্যরকম। একদম আলাদা। জগতের সবচেয়ে ইউনিক পুরুষ।
‘ স্যরি রাগ করতে হবে না আর। আমার দেখা শেষ তোমার রাগ। সুন্দর লাগছে খুব। বুকের ভিতরে ধুকপুক বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। বেশি হলে মারা যেতে পারি। তাই এবার রাগ কমাও।’
নীহারিকা মাঝ রাস্তায় দাড়ালো। পিছন ঘুরে নিজের মুখের পানি মুছে বলল,’ কি মতলবে এখানে এসে এতো কাহিনী করছেন বলুন তো?’
বিমুগ্ধের চোখ মুখে শিশুসুলব অভিমান। সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। রাগ উধাও হয়ে গেলো নীহারিকার। সে দেখছে একটি লোকের অভিমান। পুরুষকে অভিমানী রূপে কেমন লাগে? নীহারিকা জানে না। কিন্তু এই অদ্ভুৎ পুরুষকে অদ্ভুৎ সুন্দর লাগছে। মায়াবী লাগছে। পুরুষ কখনো মায়াবী হয়! বিমুগ্ধের নারীদের মত অভিমান খুব একটা মুখে পাত্তা না দিয়ে নীহারিকা বলল,’ চা খাবেন?’
বিমুগ্ধ বিরস মুখে বলল,’ তুমি কখনো আমার স্বপ্নের মত না নীহারিকা। বিয়ের পরেও এমনই থাকবে?’
‘ আমি সব সময় এমনই থাকব। সাবধান আমাকে বিয়ে করবেন না। আপনার জীবন অর্ধেক তো বরবাদ। বাকিটাও শেষ হয়ে যাবে।’
বিমুগ্ধ জবাবে শান্ত চোখে তাকালো। সে ভেবেছে নীহারিকা জিজ্ঞেস করবে আপনার স্বপ্নের নারী কেমন!
নীহারিকার হাত ধরে তাকে নিয়ে গেলো পাশের চা দোকানে। ভেজা শরীরে কাঁপনি ধরেছে নীহারিকার। বাতাসে বৃষ্টি বাঁকা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা একটি ছোট দোকানে ঢুকলো। মানুষ গিজগিজ করছে। বিমুগ্ধ চারপাশে দেখলো বেশ ছেলে পেলে। নীহারিকাকে টেনে সাইডে নিয়ে নিজের বুকের মাঝে দাড় করিয়ে দিলো। দুজনের দূরত্ব বেশ। নিজের ব্লেজার তার শরীরের উপরে দিয়ে বলল,’ একটু সিনেমাটিক হওয়া ভালো।’
নীহারিকা সত্যি কাঁপছে। সে অসহ্য কন্ঠে বলল,’ বৃষ্টি অসম্ভব জঘন্য জিনিস।’
দু কাপ চা নিয়ে বিমুগ্ধ নীহারিকার হাতে ধরিয়ে দিলো। নীহারিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বিমুগ্ধ তাকে ব্লেজারে ঢেকে দিয়ে ভীরের মাঝ থেকে বের হয়ে বৃষ্টিতে হাঁটছে।
‘ বৃষ্টি হচ্ছে কুয়াশায় জমতে থাকা শিশিরের নরম প্রেম। খালি পায়ে সবুজ ঘাসের বুকে না হাটলে এর প্রেমের গভীরতা অনুভব করতে পারা অসম্ভব। তেমনই বৃষ্টিকে না ছুঁয়ে না দেখে, না ভিজে অনুভব করা দুষ্কর। বের হয়ে আসো। আজ আমরা শেষ ব্যাচেলর বৃষ্টিবিলাশ করবো।’
দীর্ঘশ্বাস নেমে আসলো নীহারিকার। শেষ কথায় অবাক হয়ে ঝুম বৃষ্টিতে নেমে পড়েছে সে। হাটার ভঙ্গি শান্ত বিমুগ্ধের। নিবিড় জলকনা গুনে গুনে শরীরে ধারণ করছে সে। নীহারিকা চোখ খুলতে পারছে না বৃষ্টিতে।
‘ এসব আবার কেমন পাগলামী?’
বিমুগ্ধ জবাব দিলো না। জনমানবহীন একটি জায়গায় থেমে নীহারিকাকে এক হাত ঘুরিয়ে হাতের চা নিয়ে নিলো। চা আর চা নেই। পানিতে ভর্তি হয়ে গেছে। নীহারিকার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে সে কতটা বিরক্ত। বিমুগ্ধের এসবে কিছুই যায় আসে না। সে হঠাৎ দুটি পা রাস্তার বুকে রেখে নীহারিকার দুটি হাত নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিয়েছে। গভীর করেছে কন্ঠ। অনুভূতিতে ঠাসা দুটি চোখ। নীহারিকা সেই চোখের দিকে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো। তার সকল ক্লান্তি, বিরক্তি, রাগ বৃষ্টিরজলে ধুয়ে মুছে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সে শুধু শুনছে বিমুগ্ধের কন্ঠ। আর ঘুরছে ছন্দে, ছন্দে!
তুমি বৃষ্টি হয়ে যাও,
বৃষ্টির মতন শীতল, কোমল,
তুমি ঝরে পড়ো আকাশ হতে,
আবার মেঘ হয়ে আকাশেই ফিরে যাও।
তোমার স্পর্শে জাগুক ধরা নব প্রাণে,
হৃদয়ে ফুটুক চির বসন্ত ফুলেরই মতন
তুমি ঝরো, স্বর্গ সুধায় মাতুক মন!
নীহারিকা মুগ্ধ হয়ে শুনলো প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য। তার দূর্লভ হাসিটি ছড়িয়ে দিয়ে বলল,’ আপনার আজ কি হয়েছে বলুন তো?’
‘ আজ আমি খুব খুশি। প্রচন্ড প্রচন্ড প্রচন্ড বেশি। এতো খুশি আমি কখনো হইনি নীহারিকা।’ বিমুগ্ধ চিৎকার করে বলছে। নীহারিকা হাসতে হাসতে বলল,’ এভাবে চিৎকার করলে লোকেও আপনাকে পাগল বলবে।’
তারা হাটতে হাটতে একটি লেকে চলে এসেছে। হাঁসের মত চেহারার নৌকা গুলো তখন লেক ঘেসে। বিমুগ্ধ দুটি চায়ের কাপ হাত নিয়ে বলল,’ দারুন খেতে রাগেশ্বরী।’
‘ ছিঃ। আমি এসব খাবো না।’
‘ তুমি অবশ্যয় খাবে।’
নীহারিকার হাতে জোড় করে ধরিয়ে দিলো সে। খেতে এত বিশ্রী। নীহারিকা তবুও কিছু বলল না। আজ অনেক অনেক দিন পরে সে বিমুগ্ধ নামক এই পুরুষটিকে দেখছে। বহু বছর আগের রূপে। যেই রূপ তাকে মুগ্ধ করেছে। পাগল করেছে। মনে মনে উতলা করেছে। এই হাসিখুশি প্রাণবন্ত বিমুগ্ধ তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে মাতাল করা। তারা এই বৃষ্টিতে ভিজে নৌকায় বসলো। বিমুগ্ধ উঠে চলে গেলো কোথায় যেন। ফিরে এসে নীহারিকার পাশে বসে নৌকা চালাতে চালাতে বলল,’ জিজ্ঞেস করো আজ আমি কেন এতো খুশি।’
নীহারিকা চা খেতে খেতে বলল,’ কেন?’ তার এখন একটুও বাজে লাগছে না পানি পানি চা খেতে। শুধু চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বিমুগ্ধ এবার গম্ভীর হলো।
‘ আজ ছোট বাবা আমাদের বাসায় এসেছে।’ প্রতিয়মান গলা তার। নীহারিকা চমকেছে, ভড়কেছে। পর পর নিজেকে সামলে বলল,’ বাবাকে যে আপনি এতো সম্মান করছেন ভালো লাগছে।’
‘ তিনি বলেছে কাল আমাদের বিয়ে।’
মুখ ফসকে সকল চা বিমুগ্ধের ভিজা মুখে ছুটে চলে গেলো। নীহারিকার গোল গোল বড় হয়ে আসা চোখের দিকে বিমুগ্ধ গাম্ভীর্য্যে ভরা চোখে তাকিয়ে বলল,’ আমি সত্যি বলছি। কিন্তু আমি নিশ্চিৎ তোমার বাবার শয়তানী মাথায় কিছু একটা চলছে।’
‘ নো বিমুগ্ধ। বাবাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা না। মাথা গরম হয়ে যাবে কিন্তু।’
বিমুগ্ধ তবুও রেগে রেগে বলল,’ উনি আসলে আমার জীবনে কাল হয়ে এসেছে। শনির কাল। শান্তিতে থাকতেই দেয় না। শালা কচুর শ্বশুর। জীবনটা গিলে খাচ্ছে।’
‘ এসব কি ধরনের ভাষা? আমি এখনই উঠে যাচ্ছি। আমার বাবাকে এসব কথা বলতে আপনার লজ্জা করলো না? বিয়ে! আপনি বিয়ে করবোই না। সারাজীবন কুমারী থাকবো।’
নীহারিকা উঠে যাচ্ছিলো। সে লক্ষ্য করলো তারা লেকের মাঝে। চারপাশে থৈথৈ করছে পানি। আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি শব্দ মাতাল করা। এই মুহূর্তটা নীহারিকার কাছে আচিনপুরের মনোরম জগৎ মনে হলো। বিমুগ্ধ তার হাত টেনে বসিয়ে একজোড়া হলুদ গোলাপ তার সামনে ধরে বলল,’ তুমি কি জানো তুমি সৃষ্টিকর্তার নিখুঁত সৃষ্টি। তিনি প্রকৃতি, সৌন্দর্য্য, বৃষ্টি বা ভালোবাসা যেমন খুব মায়া করে তৈরি করেছেন তোমাকেও আমার জন্য যত্ন করে সেজিয়ে সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে সুন্দর তোমার রাগ। আমি জানি না মানুষ কখনো কারো রাগের প্রেমে পড়তে পারে কি না, কিন্তু আমি পড়েছি। হলুদ আলোতে ভেসে উঠা একটি ভিতু মুখের আদল আমার মনে ততটা সন্তাপ ছড়িয়ে দেয়নি যতটা তোমার রেগে যাওয়া লাল চোখ দুটি দেয়। আমার বুকের শব্দ গুচ্ছ একত্রিত হয় যখন তুমি রেগে যাও। তোমাকে যত দেখি আমার মনে হয় আমি হারিয়ে যাই। এই দেখার শেষ নেই। অতি প্রিয় সুখের যন্ত্রণা, আবেগ, খুশি, আনন্দ, পরিশেষে ভালোবাসা তুমি। আমি চাই আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তুমি ধর্মীয় মতে, সমাজিক রীতিনীতি মেনে আমার বউ হয়ে আমার পাশে থাকো। আমার সাথে থাকো। আমরা এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো, শিশিরে পা ডুবাবো, জগতের সকল অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ কাজ করবো। তুমি কি আমার সাথে অদ্ভুৎ কাজের সঙ্গী হবে রাগেশ্বরী!’
নীহারিকা জবাব দিলো না। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তার চোখের অশ্রুজল বিমুগ্ধ কি দেখে নিচ্ছে? এই প্রথম বৃষ্টিকে তার ভালো লাগলো। মনে মনে ঠোঁট নাড়িয়ে সে বলল,’ তোমাকে ধন্যবাদ বৃষ্টি। আমার লজ্জিত, ভালো লাগার অশ্রুকে লুকিয়ে রাখার জন্য।’
নীহারিকার মাথার পাশে ফুল গুলো বিমুগ্ধ আটকে দিলো পিন দিয়ে। নীহারিকা ফিরে তাকালো তার চোখের দিকে। বিমুগ্ধ পূর্বেই তাকিয়ে ছিলো। দুটি হৃদয়ের চোখাচোখি হলো অদৃশ্য মায়ায়। বিমুগ্ধের প্রেমিক চোখে তাকিয়ে নীহারিকা বলল,’ যদি রাজি না হই?’
বিমুগ্ধ উদাস চোখে বৃষ্টির ছন্দ দেখতে দেখতে বলল,’ তাহলে আর কি দুজনেই সারাজীবন কুমারকুমারী থেকে যাবো। আমার কোন সমস্যা নেই। শুধু তুমি অন্যকারো না হও। অদৃশ্য ভাবে হলেও এই বিমুগ্ধের হয়ে থাকো।’
নীহারিকা ফুল গুলো ছুঁয়ে দিলো। লাজুক মুখ তার। এই মুহূর্তে এসে নীহারিকা অনুভব করছে নারীদের লজ্জা পাওয়ার বিষয়টাও সুন্দর। এই যে তার হৃদয় শীতল, নিঃশ্বাস গাঢ়। বিমুগ্ধ তার হাতটি ধরে রাখলো শক্ত করে। তারা সমগ্র লেক ঘুরে ঘুরে আসলো। বিমুগ্ধ পরিবেশ হালকা করতে বলল,’ কাল যাই করুক তোমার বাবা শুধু বিয়েটা দিয়ে দিলেই হলো। এরপরে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাবো। সেই মৃত্যুতে আফসোস থাকবে না।’
নীহারিকার চোখ দুটি রাগে ধপ করে জ্বলে উঠলো। বিমুদ্ধের হাত টি জোড়ে খামচি মেরে বলল,’ সখ মিটেনি এখনো? হসপিটাল থেকে এসেছেন কত দিন হয়েছে?’
‘ তোমার জন্য আমৃত্যু আমি মৃত্যুর জগৎ থেকে ঘুরে ফিরে আসতে পারবো আমার রাগেশ্বরী।’ সে হো হো করে হাসতে শুরু করলো। নীহারিকা সেই হাসির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ আমি আমৃত্যু আপনার হয়ে বাঁচতে চাই জ্ঞানীবাবা বিমুগ্ধ।’
কাঁপা হাতে সে বিমুগ্ধের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছে। বিমুগ্ধের হাসি হাসি দুষ্টুমিতে ভরা সব কিছু বরফের মত জমে গেল। বৃষ্টি তাকে কাঁপাতে না পারলেও নীহারিকার মৃদূ স্পর্শ তার সমস্ত শরীর, অন্তর আত্মা থরথর করে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নীহারিকা বিমুগ্ধের বুকে হাত রেখে বলল,’ ভদ্র ছেলে হয়ে পড়ুন হবু বরমশায়। আপনার ব্যাচেলর বিন্দাস জীবন শেষ হতে চলেছে আমার প্রিয় পুরুষ।’
বিমুগ্ধের মনে হলো সে ঢুলছে। অত্যন্ত আবেগ, হৃদয়ের তীব্র শব্দে সে নিজেকে উম্মাদ রূপে আবিষ্কার করছে। শরীর কাঁপছে, ধরাস ধরাস শব্দে নিজের কান ঝা ঝা করছে। শুধু মৃদূ সুরে বলল,’ এই নীহারিকা আমার স্বপ্নের মত।’
___________________
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন। 🕊️