প্রিয় প্রহর পর্ব-১১

0
608

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১১
ভাগ্ন হৃদয়ের দুরন্ত কিশোরী হঠাৎ কয়েকদিন খুব চুপচাপ হয়ে যায়। খুব কম কথা বলে। দুষ্টামি করে না। বিষয়টা সবার চোখে লাগলে, আরোহীকে সবাই জিজ্ঞাসা করে। তখন আরোহী জবাব দেয়,
–তার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। তাই সে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আছে।

সেদিনের এক সপ্তাহ কেটে গেছে। একদিন আরোহী আর আয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে,
–আচ্ছা আয়ু! তোর কাছে শুভ্র ভাইকে কেমন লাগে?

আয়ানা ভুরু কুঁচকে সন্দিহান চোখে আরোহীর দিকে তাকায়। দুই বোন নিজেদের রুমে পড়ছিল। কালকে বাংলা ১ম পত্র পরীক্ষা। হঠাৎ পড়ার মাঝে আরোহীর এমন ধরনের প্রশ্নে কিছুটা সন্দিহান হয় আয়ানা। তারপর জিজ্ঞাসা করে,
–ঠিক বুঝলাম না।
আরোহী জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে গিলে বলে,
–না মানে ভাইয়া তো অনেক রাগী। সেদিন যে আমরা উনাদের বাসায় গেলাম, উনি কিন্তু একবারও আমাদের সাথে কোনরকম কুশল বিনিময় করলেন না। এমনকি আমাদের সাথে ভদ্রতার খাতিরে একবার দেখাও করতে এলেন না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম তোকে, উনাকে তোর মানুষ হিসাবে বা সম্পর্কের খাতিরে কেমন লাগে?

আয়ানা এবার কথাটাকে সহজভাবে নিলো। তাই জবাবে বলে,
–কেমন লাগবে আর! বোনের কাছে ভাইকে যেমন লাগে ঠিক তেমনি লাগে। হ্যাঁ, ভাইয়া একটু রাগী। তুইতো দুরন্ত, চঞ্চল তাই তোর কাছে উনার ব্যবহারগুলো রুড মনে হয়েছে। সেদিনতো ভাইয়ার শেষ পরীক্ষা ছিল তাই হয়ত ঘরের মধ্যে রেস্ট নিচ্ছিল তাই আর আমাদেরকে দেখা করেনি।

আরোহী কথাটা আসলে জিজ্ঞাসা করেছে, আয়নার মনের ভাব জানার জন্য। তাই সে সিউর হবার জন্য আয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে,

–তুই যে ভাই বলছিস! উনি কিন্তু আমাদের আপন ভাই না। নীড় ভাইয়া ও মেঘ ভাইয়ের মত না। কাজিন ব্রাদার হয়। তাই কথায় কথায় এরকম ভাইয়ের চোখে! বোনের চোখে! এগুলো বন্ধ কর। তুই এরকম সহজ সরল বলে কি, সবাই এরকম সহজ সরল নাকি বল?

আয়ানা বুঝতে পারে না আরোহীর কথার মানে তাই জিঙ্গাসা করে,
–মানে?
–মানে হচ্ছে, তুই ওনাকে ভাই ভাবলেও উনি তো তোকে বোন নাও ভাবতে পারে তাই না! অন্যকিছুও তো ভাবতে পারে। উনি কিন্তু তোকে অনেক কেয়ার করে এভাবে।
–তুই কি গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড বুঝাচ্ছিস?

আরোহী মনে তীব্র ব্যথা নিয়েও মুখে হাসি ফুঁটিয়ে জবাব দেয়,
–এইতো এতক্ষনে বুঝতে পেরেছিস।

আয়ানা এবার হেসে উঠে। এরপর হাসতে হাসতেই বলে,
–সিরিয়াসলি আরু! গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড উনি আর আমি!! নট এট অল। শুভ্র ভাইয়া আমার কাছে মেঘ ভাইয়া ও নীড় ভাইয়ার মতই ভাই।

আরোহী প্রোমোদ হাসে আপন মনে। এরই মাঝে আয়ানা আবার বলে,
–হ্যাঁ, তুই এটা ঠিক বলেছিস যে আমরা কাউকে ভাই ভাবলেও বিপরীত পাশের মানুষটা আমাদের বোন নাও ভাবতে পারে। আবার আমরা কাউকে মুখে ভাই বললেও মনে মনে কিন্তু তাকে ভাইয়া মনে করিনা অনেকসময়।

আরোহী বুঝে যায়, ভবিষ্যতে এটা লাভ ট্রায়াঙ্গেলের থেকেও ভয়ানক কষ্টের হবে। কে কার ভালোবাসা পাবে আর কে পাবে না তা এখন সুদূর ভবিষ্যতে বুঝা যাবে।
আরোহী আর এই বিষয়ে কথা না টেনে আয়ানাকে পড়তে বলে নিজেও পড়তে থাকে।

“আরোহী ভুলে যাবে না শুভ্রকে। ভালোবেসে যাবে নিজের মতো করে তবে সবটা লুকিয়ে। ভবিষ্যতের এক সুপ্ত আশা সে মনে রাখার জন্য নিজের বোনের অনুভূতি জানার ছিল। যা সে জেনে নিয়েছে। এখানে সবারটাই একতরফা। তাহলে আরোহী নিজে কেনো আগে আগেই নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিবে!! ভবিষ্যতে যা হবে সেটা সে মেনে নিবে। দেখা যাক ভবিষ্যৎ কি লিখে রেখেছে।”
এগুলো ভেবে আরোহী পড়াতে মনোনিবেশ করে।

______
এদিকে ভার্সিটি ও মেডিকেলের ভর্তি পরিক্ষা চলছে।শুভ্রর অনেক ইচ্ছে সে অনেক ভালো একজন হার্টসার্জন হবে। সাথে সে বিদেশ থেকে ডাক্তারি পড়তে চায়। কিন্তু তাকে তার বাবা বলেছে,
” বাংলাদেশে একটা ভালো মেডিকেলে চান্স পেলে বিদেশে স্কলারশিপের মাধ্যমে পড়তে পারবে। ”

শুভ্র তাই খুব মনোযোগ দিয়ে মেডিকেলের প্রিপারেশন নিচ্ছে। অন্যদিকে এখন আর মাথা ঘামানোর সময় নেই। আর তার প্রেয়সী! সে তো তার বাবা-ভাই ছাড়া অচেনা পুরুষকে ভয় পায়। এজন্য শুভ্র নিশ্চিত যে আয়ানাকে সে হারাবে না। শুভ্র চায়, বিদেশ থেকে ভালো ডাক্তার হযে ফিরে এসে আয়ানাকে নিজের ভালোবাসাতে আবদ্ধ করবে।

____ডিসেম্বর মাস। শীতের প্রকোপ বাড়ছে। শুভ্রর ২১তম জন্মদিন। আর চারদিন পর জার্মানির ফ্লাইট শুভ্রর। বিদেশ বিভূয়ে পাড়ি জমাবে তার স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে। প্রতিবার জন্মদিন ঘোরোয়াভাবে করে কিন্তু এবার শুভ্র জার্মানিতে চলে যাচ্ছে বলে আত্নীয়-স্বজন ও কিছু বন্ধু-বান্ধবকে ইনবাইট করেছে। শুভ্রর ফুপির মেয়ে সামিরা, শুভ্রর পিছনে পিছনে ঘুরছে আর আরোহী তা দূর থেকে দেখে মিটমিট করে তাচ্ছিল্য হাসছে।

আয়ানা ও আরোহী নবম শ্রেণীর ফাইনার পরিক্ষা দিয়েছে। আর সামিরা অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি। জেএসসি পরিক্ষা শেষেই কয়েকদিন নিজের গ্রামের বাড়ি ঘুরে এসে যখন সামিরা শুনেছে শুভ্র বিদেশ চলে যাবে তখন সে তৎক্ষণাৎ শুভ্রদের বাসায় এসে পড়ে। সামিরা অনেকটা গায়ে পড়া স্বভাবের। শোঅফ করা তার স্বভাব। এইটুকুন মেয়ে রূপচর্চা করে, দামি ফোন নিয়ে ঘোরাফেরা করে, ফেসবুক চালায় মানে পুরোটাই ওভারস্মার্ট। আর শুভ্রর পিছে আঠার মতো লেগে থাকে যা শুভ্রর একদম পছন্দ না। শুভ্রর সামনে ন্যাকামি আর দিনে কয়টা প্রপোজ পায় ফেসবুকে, তার ছবি ফেসবুকে কতো লাভ রিয়াক্ট, কমেন্ট আসে তা বলে। সাথে এটাও যে সে ওসব পাত্তা দেয় না।

শুভ্রর কাছে এগুলো বিরক্ত লাগে। তাই সে দুই সপ্তাহ যাবত এই মেয়ের থেকে বাঁচতে বাড়িতে থাকলে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখে।

জন্মদিনে শুভ্র তার বন্ধুদের সাথে ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কুশল বিনিময় ও কথাবার্তা বরতে যেখানেই যাচ্ছে তার পেছনে পেছনে সামিরাও যাচ্ছে। আরোহী তো এগুলো দেখে হাসছে কারন শুভ্র যে খুব বিরক্ত হচ্ছে তা তার মুখ অবয়ব দেখে বুঝা যাচ্চে কিন্তু শুভ্র জোরপূর্বক হাসছে। আরোহীকে হাসতে দেখে আয়ানা ওর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে,

–কিরে তুই এমন পাগলের মতো একা একা হাসছিস কেনো?
আরোহী হাসতে হাসতেই বলে,
–শুভ্র ভাইয়ের কাজিনটা কিভাবে শুভ্রর ভাইয়ের পেছোনে ঘুরতেছে। কিন্তু এই বোকা মেয়ে জানেই না যে, শুভ্র ভাই তাকে কাশ্মিককালেও পাত্তা দিবে না। তার মনে যে অন্য কারো বাস!

আয়ানা অবাক হয়ে আরোহীকে জিঙ্গাসা করে,
–সত্যি! শুভ্র ভাইয়া কাউকে ভালোবাসে? এই এই বল না ভাবি কে? কি নাম? কোথায় সে?

শেষ কথাটা উৎফুল্ল চিত্তে বলে আয়ানা। আরোহী এরকম উৎফুল্ল স্বর শুনে তাচ্ছিল্য হাসে। এরপর কথা কাটানোর জন্য বলে,
–সেটা আমি কেমনে বলবো? তুই শুভ্র ভাইকেই জিঙ্গাসা করে নে।
এই বলে আরোহী সেখান থেকে চলে যায়। আর আয়ানা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তার ভাবির নাম জানতে না পারায়।

_______
শুভ্র বিদেশে গেছে সাড়ে তিন বছর হতে চলল। আরোহী ও আয়ানা এইচএসসি পরিক্ষা দিয়ে এখন মেডিকেল ভর্তি পরিক্ষার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। ওদের দুই বোনকে নীড় ও মেঘ দুই ভাই মিলে কোচিংযের ওরিয়েন্টশন ক্লাসের জন্য দিয়ে গেছে। এই কোচিংয়ে ওরা দুই ভাইও সময় পেলে ক্লাস নেয়। উদ্ভাস-উন্মেষ কোচিং সেন্টার।
নীড় ও মেঘ দুজনেই এখন অনার্স ফোর্থ ইয়ারে। একজন সিএসসি ও আরেকজন ফার্মেসী ডিপার্টমেন্টে পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটির। দুই ভাইয়ের একজনের বুযেটের ও আরেকজনের মেডিকেলে পড়ার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়ায়, বুয়েটের ইচ্ছা থাকা নীড়ে সিএসসিতে ও মেডিকেলের ইচ্ছা থাকা মেঘের ফার্মেসীতে পড়ছে।

প্রথম দিন ওরিয়েন্টশন তো কোনো পড়ায় না তাই আরোহী ও আয়ানা বাসায ফিরে আসে। নীড় ও মেঘ গাড়ি নেয়নি। তারা ড্রাইভারকে বলে গেছে যেনো ছুটি হওযা পর্যন্ত ওদের দুইবোনের জন্য অপেক্ষা করে।

দ্বিতীয় দিনে মানে ক্লাসের প্রথম দিন ফোর্থ ইয়ার মেডিকেলের স্টুডেন্ট দিয়ে ক্লাস করায়। খুব সুন্দরভাবে ভাইয়া (শিক্ষক) নিজের পরিচয় ও সংক্ষেপে স্টুডেন্টদের পরিচয় নিয়ে ক্লাস করায়।

কিন্তু ক্লাসের দ্বিতীয় দিন একজন নতুন শিক্ষক আনে। যার এর আগে কোনো কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। হ্যাঁ, ধ্রুব। সরোযার্দি মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষে সে উঠবে এখন। ইয়ার প্রফের আর চারটা পরিক্ষা বাকি কিন্তু সেগুলার তারিখ পরেছে দেড় সপ্তাহ পরে একটা ও তার ঠিক দুইদিন পর পর বাকি গুলা। এক সপ্তাহে আটটা পরিক্ষার চারটা দিয়ে তার পরের দিনই কোচিংয়ে প্রথম ক্লাস করাতে এসেছে। আজ সকালেই তাকে জানানো হয় ক্লাসের কথা।
ধ্রুব প্রথমদিন অনেক নার্ভাস। মূলত শখের বশে ছাত্র-ছাত্রি পড়ানোর ইচ্ছা থেকেই পড়াতে আসা। ধ্রুবদের নিজস্ব গাড়ি নেই। একটা তিনতলা বাড়ি আছে নিজেদের। গাড়ি নেই বলে সবসময় বাসে আসা যাওয়া করতে হয়। ঘামে প্রায় ভিজে আছে ধ্রুবের পরনের খয়েরি চেক শার্টটা। দেখে মনে হচ্ছে মাত্র দৌড়ে এসেছে ক্লাস নিতে। ঘুম থেকে দেড়ি করে উঠেছে কারন এক সপ্তাহ রাত জেগে পড়াশোনা করার পর কাল রাতে আরামে ঘুমানোর ফুসরত পেয়েছে। তাই দেড়ি করে উঠেই মোবাইলে মেসেজ দেখে না খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছে।

ধ্রুবকে দেখে মেয়েরা মুখ চেপে হাসছে কারন ধ্রুব রিতিমতো হাপাচ্ছে। কিন্তু আয়ানা একমাত্র হাসছে না। আয়ানার পাশে বসে আরোহী সেও হাসছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।