প্রিয় প্রহর পর্ব-১২

0
636

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১২
ধ্রুব ছাত্রিদের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়। সবাই তাকে দেখে হাসছে তা বুঝতে পারে। ধ্রুবর নিজেরো লজ্জা করছে কেনো এভাবে তাড়াহুড়ো করে আসলো! পুরো ক্লাসে একবার নজর বুলিয়ে দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে শুধু একটা মেয়ে বাদে। যে মেয়েটি হাসছে না সেই মেয়েটি গোলাপি-সাদা মিশেলে থ্রিপিস পড়েছে। ধ্রুব লক্ষ্য করে ওই মেয়েটার পাশে বসা একই চেহারার বেগুনী-সাদা মিশেলে থ্রিপিস পড়া আরেকটি মেয়ে। তবে অপর মেয়েটি হাসছে।
ধ্রুব বুঝতে পারে মেয়ে দুটি জমজ এবং স্বভাবত কিছুটা হলেও ভিন্ন। ধ্রুব যখন আয়ানার দিকে তাকিয়েছিল তখন আয়ানা একটা মিষ্টি হাসি দেয় আর ধ্রুবও সৌজন্য হাসি দেয়।

ধ্রুব শুধু নিজের নাম, কোথায় পড়াশোনা করে তা বলে বই খুলে পড়াতে শুরু করে। এভাবেই ক্লাস টাইম শেষ তো ধ্রুব চলে যায়।
কোচিং শেষে আরোহী আয়ানাকে বলে,
–বইন বিশ্বাস কর, এই পূর্ব(ধ্রুব) স্যারটা পুরাই একটা গর্দভ। প্রথম ক্লাসে কেউ এক ধারছে পড়ায় নাকি? শুধু নিজের নাম, পরিচয় বলে সে পড়ানো শুরু করে দিলো।

আয়ানা প্রতিবাদের স্বরে বলে,
–অথারিটি থেকে তো একজন এসে বলল, উনি আজকে প্রথম কোন কোচিংয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। আর প্রথম হিসাবে নার্ভাস তো হবেনই। আরে তোরা কি করলি? পুরো ক্লাস মিলে হাসলি!

আরোহী বাঁকা চোখে আয়ানার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
–ব্যাপার কি ম্যাডাম? আপনার এতো গায়ে লাগছে কেন?স্যারের বোকামির কারণে আমরা হেসেছি। তাছাড়া আমরা কেউ উচ্চস্বরে হাসিনি। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে হেসেছি। স্যার দেখে ফেললে তা আমাদের কিছু করার ছিলনা।

আয়ানা হতাশ হয়। তাই সে আর কিছু বলতে ইচ্ছুক না। হঠাৎ আরোহীর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপে। তাই সে দুষ্টুমি করে একটু পিঞ্চ করার মত করে আয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে,

–তোর আবার ভাইয়াকে ভালোটালো লাগেনি তো! না মানে ভাইয়া কিন্তু যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। মেডিকেলের রেংকিংও ভালো। ঢামেক না হয়েছে তো কি হয়েছে! সরোয়ার্দি সেকেন্ডে আছে তাই না।

আয়ানা আরোহীর এমন প্রশ্নে নির্বাক হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে না এই প্রশ্নটা কি আদৌ যৌক্তিক! মানে প্রশ্নটা কেনো করলো? আয়ানা তাড়াহুড়ো করে বলে,

–কি বলছিস এসব? সে আমাদের শিক্ষক হয়। আমাদের পড়াতে এসেছে। আর আমি তাকে ভালোবাসো মানে কি আশ্চর্য! কি বলিস?

আরোহী ব্যঙ্গ করে বলে,
–এহ আসছে শিক্ষক! সে আমাদের থেকে এক ক্লাসের বড় মাত্র। সিনিয়র বলবি সিনিয়র। তোর কাছে কাজিন মানে ভাই! সিনিয়র মানে শিক্ষক! পুরাই আঁতেল তুমি। মানলাম সে আমাদের পড়াতে এসেছে তাই সে আমাদের শিক্ষক। এটাকে স্কুলের বাবার বয়সি স্যারদের সাথে তুলনা করিস না প্লিজ। এই পূর্ব ভাইয়া আমাদের থেকে মাত্র ১ বা ২ বছরের বড় হবে।

আয়ানা আর কোনো কথা বাড়াতে চাইলো না তাই গাড়ীতে উঠে বসে পরে। মুখে কিছু না বললেও তার মনের মধ্যেও ধ্রুবকে নিয়ে কিছু একটা হচ্ছে। যা সে মানতে চাইছে না ছাত্র-শিক্ষক বেঁড়াজালে বাইরে গিয়ে।

পরেরদিনও ধ্রুবরই ক্লাস পরল আর আয়ানাদের সাথে। আজকে ধ্রুব একদম পরিপাটি হয়ে এসেছে। ব্লাক শার্ট, হোয়াইট ডেনিম প্যান্ট, পায়ে মেইল কেইডস। শার্টের হাতা গুলো কনুইয়ের একটু নিচ পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে। উজ্জল শ্যামবর্ণ গায়ে ব্ল্যাক কালারটা খুব দারুন মানিয়েছে। হাতা গুলো গুটিয়ে রাখার দরুন অসাধারণ সুন্দর লাগছে। চুলগুলো মিডিয়াম সাইজ করে কাটা তবে সামনের গুলো সামান্য বড় তাই সেগুলো কপালের উপর এক সাইড করে রেখেছে। কোচিংয়ে কালকে যেই মেয়েগুলো ধ্রুবকে দেখে হাসছিল আজকে তারা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আর আরোহী একবার তার বোনকে দেখছে আরেকবার সামনে ধ্রুবকে দেখছে। মানে সে খেয়াল করেছে তার বোন কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে।

ধ্রুব আজকে সবার সাথে সুন্দর করে সবার নাম, পরিচয় জানতে চাইল। তারপর আস্তে ধীরে পড়াতে আগালো। এবং সে আজকে কনফিডেন্স নিয়ে এসেছে আজকে সে তার ইম্প্রেশন নষ্ট করবেনা। ফ্রাস্ট ইম্প্রেশন নষ্ট হয়ে গিয়েছে তো সেকেন্ডটা নষ্ট করবে না।
কোচিং শেষে সবাই বলা শুরু করেছে,পূর্ব স্যার কত সুন্দর, কত হ্যান্ডসাম দেখতে আর কালকে মনে হয় প্রথমদিন তাই নার্ভাস ছিল। আর আয়ানা এগুলো শুনছে আর মিটিমিটি করে হাসছে। আরোহী ডিটেকটিভের মতো বোনকে দেখছে।

কালকের মতো আজকেও আরোহী আয়ানাকে জিঙ্গাসা করে,
–আয়ু। আজকে পূর্ব ভাইয়াকে কতো সুন্দর লাগছিলো তাইনা? মানে কালকের সাথে তো আমি মিলাতেই পারছিলাম না। বাকি মেয়েগুলো কেমন হা করে তাকিয়েছিল দেখেছিস।

আয়ানা তো একটা কথাও শুনছে না। সে তো ক্লাসের প্রথমে ধ্রুবকে দেখে যখন সব মেযেরা হা করে ছিল তখন আয়ানা ধ্রুবকে কালকের মতো সালামের সাথে মিষ্টি হাসি দিয়েছিল। এরপর যখন পরিচয় পর্বে আয়ানা-আরোহী জমজ সেটা নিয়ে কথা বলে ধ্রুব তখন ধ্রব আয়ানার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দেয়।
আয়ানা এগুলোই ভাবছিল আর আরোহীর হঠাৎ ধাক্কানোতে ভাবনা-চিন্তা থামায়।

–কিরে আয়ু! আমি যে তোকে কিছু বলছি সেটা কি তুি শুনছিস?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ বল।
–না আমি বলবো না। তুই বল। তুই কি নিযে ভাবছিলি?

আয়ানা আমতা আমতা করে বলে,
–কি ভাববো। কিছু না। তুই বল কি বলছিলি।
আরোহী বাঁকা চোখে সন্দেহ নিয়ে আয়ানার দিকে তাকায়। আরোহীকে এভাবে তাকাতে দেখে আয়ানা থতমত খেয়ে যায়। সে কথা ঘোরানোর জন্য বলে,
–আরে বাদ দেতো এসব।

আরোহী বুঝেও চুপ করে যায়।
এভাবে প্রতিনিয়ত মাঝে মাঝে ধ্রুব ওদের ক্লাস পেতো। কিন্তু যখন ক্লাস নিতো তখন ধ্রুব ও আয়ানার মধ্যে যেন চোখে চোখে কিছু একটা হতো।

তিনমাস কোচিং শেষে যখন ভর্তি পরিক্ষার ফর্ম তোলার সময আসে সেদিন ধ্রুব নিজে এসে ওদের দুইবোনকে সাহায্য করে। আরোহী সবটা বুঝতে পারে। এখন আরোহীর মনে হচ্ছে তার বোনো ধ্রুবকে মন দিয়ে ফেলেছে। ধ্রুব সেদিন নিজের মোবাইল নাম্বার ওদের দিয়ে বলেছিলো, কোনো দরকার হলে যেনো তাকে জানায়। আয়ানা তো পুরোটা সময় লাজুক হয়ে চুপ করে ছিলো।

এতোকিছুর মধ্যে আরোহীর শুভ্রর কথা ঠিক মনে আছে। কিন্তু এখন তার শুভ্রর জন্য খারাপ লাগে। শুভ্র যখন ফিরে এসে জনতে পারবে তার মনের শুভ্রতারা অন্যের মনের আকাশের তারা হয়ে গেছে, তখন তার কেমন লাগবে? খুব কষ্ট হবে তাইনা! ঠিক যেমনটা আরোহীর নিজের হয়েছিল আর হয়েছিল ওই শিলা নামের মেয়েটির! শিলা মেয়েটির সাথে তো বন্ধুত্বটাও নষ্ট করে ফেলেছে।

আর বেশি ভাবতে চায় না আরোহী। বাকিটা সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছে।

______
মেডিকেলের ভর্তি পরিক্ষা শেষ। আরোহী ও আয়ানার পাবলিক মেডিকেলে মাত্র এক-দুই নাম্বারের জন্য হয়নি। জাহাঙ্গীরনগরের D ইউনিটে হয়েছে আরোহীর আর আয়ানারো। তবে সাবজেক্ট ভালো পায়নি। বোটানি ও জুলোজি পেয়েছে। বায়োকোমেস্ট্রি, জেনেটিকস ও বায়োটেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসী এগুলোর মধ্যে কোনো একটা পেলে ভেবে দেখতো। আর মেঘ নিজে মেডিকেলের স্বপ্ন দেখে হারিয়েছে বলে তার দুই বোনকেও হারাতে দিবে না। মা-বাবা দুজনেই যেহেতু নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আর এতো বছরে তাদের পদন্নোতি প্রফেসর। তাই মেঘ ও নীড় দুজনেই তাদের দুই বোনকে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াবে। ওদের বাবা-মায়েরো কোনো আপত্তি নেই।

____আবারো প্রকৃতিতে ডিসেম্বর মাস। শুভ্র জার্মানি গেছে চার বছর হয়েছে। হঠাৎ সন্ধ্যে বেলায় আরোহী রুমে নেই। আয়ানা এই সময়ে ধ্রুবকে ফোন করবে বলে ভাবলো। জাহাঙ্গীরনগরের রেজাল্টের পর আরোহীর পিড়াপিড়িতে আয়ানা ধ্রুবকে ফোন করেছিল। সেদিন শুধু কুশল বিনিময় ও কোথায় চান্স পেয়েছে এটুকু বলে আর কথা হয়নি।

আয়ানা ফোন করলে কয়েকবার রিং হবার পর কেটে যাবার আগে অপরপাশ থেকে রিসিভ হয়।
আচমকা আয়ানা অনেকটা লজ্জা পেতে থাকে তাই সে ফোন কানে নিয়ে কোনো কথা না বলে চুপ করে আছে।

অপরপাশ থেকে ধ্রুব বুঝতে পারে এটা আয়ানা। তাছাড়া সে সেদিন নাম্বার সেভ করে রেখেছিলো কিন্তু জানতো না এটা ওদের দুইবোনের মধ্যে কার। আয়ানা চুপ করে আছে তাই ধ্রুব প্রথমে কথা বলে,

–আসসালামুআলাইকুম।
আয়ানা এবার সালামের জবাব দেয়।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম।
–কেমন আছো ‘তারা’?

ধ্রুবের মুখ থেকে নিজের “তারা” নামটা শুনে কেমন যেনো অন্যরকম ভালো লাগলো আয়ানার। কই শুভ্র ভাইও তাকে “তারা” বলে ডাকে। তখন তো এমন অনুভূতি হয় না!

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।