প্রিয় বেলা
১৪.
আদ্রর বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে লেপ্টে আছে বেলা। কান্না থেমেছে ক্ষীণ। ডুকরে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গাঢ় নিশ্বাসগুলো আদ্রর শার্ট ভেদ করে শরীরে উষ্ণতা ছুঁয়ে দিচ্ছে যেন। আদ্রর পুরুষালী শক্ত ডান হাতটি মোলায়েম ভাবে বেলার চুলের ভাঁজে রাখা। আলতো করে হাত বোলাচ্ছে সে। লহু স্বরে বলে,
—“শান্ত হন বেলা। শার্ট ভিঁজিয়ে দিয়েছেন আমার। চোখের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে না?”
বেলা সরে এলো তৎক্ষণাৎ। সময় নিলো না। ভীষণ অভিমানী হয়ে অন্যদিকে তাকালো। আদ্র হাসলো। নিঃশব্দে, প্রাণ ভরে, দীর্ঘক্ষণ। ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমি আপনার কে হই বেলা? এই পাষাণ নেতার জন্য কাঁদছেন কেন?”
ক্রদনের দরুণ নাকের ডগা রক্তিম হয়ে আছে তার। ফুলে আছে অল্প। নেত্রে পানির অস্তিত্ব না থাকলেও পাঁপড়িগুচ্ছ এখনো ভেঁজা। গালে দাগ বসে গেছে নিষ্ঠুর পানির রেখায়। বেলা অন্যদিকেই চেয়ে রইলো। অভিমান ভুলে বেশ কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো,
—“কেউ হন না।”
আদ্র তার রেশ ধরেই বললো,
—“কেউই হই না?”
বেলা জবাব দিতে পারে না। তার আবারও কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে যদি কান্না করা যেত, খুব শান্তি পেত সে। আদ্রর কপালের ব্যান্ডেজটা অস্পষ্ট হয়ে বারবার ভাসছে চোখে। কি করুণ সেই দৃশ্য! কি ভরাবহ! বেলা চোখ বুজে ফেলে। নিশ্বাস নিতে থাকে ধীরস্থির ভাবে।
তার জন্য চিন্তিত, আতঙ্কিত মুখটির দিকে তাকিয়ে এক আলাদা প্রশান্তি অনুভব করলো আদ্র। অধরে হাসি এসে হানা দিলো আরও একবার। মেয়েটা কিভাবে যেন তার সর্বত্র দখল করে নিয়েছে৷ যার কারণ অবশ্য আদ্রর জানা নেই। জানার ইচ্ছেও হয়নি কখনো। কিছু জিনিস না জানাই শ্রেয়। সংগোপনে থাকা কারণটা বুড়ো বয়সে বেলাকে নিয়েই ভাববে সে। পুরোনো দিনের কথা ভেবে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে হাসবে, উল্লাস করবে। ভাবতেই তো সুখময় আনন্দে মৌ মৌ করছে পরিবেশটা।
বেলার কব্জি জোড় করে টেনে নিজের বুকে আবারও মিশিয়ে নিলো আদ্র। বেলা সরতে চাইলো। বাঁধন শক্ত হলো, গভীরতা বাড়লো। আদ্র থমথমে আওয়াজে সাবধান করলো,
—“নড়বেন না বেলা। হাতে ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু।”
বেলা থেমে যায়। ভুলেও আর নড়চড় করে না। লোকটা পাশে থাকলে নিজেকে দূর্বল লাগে তার। শরীরের সব শক্তি রোধ হয়ে কেমন নেতিয়ে পরে। আদ্রর বুকের বা’দিকটায় মাথা রেখে হেলে পরলো বেলা। শার্ট ভেদ করে গলার কাছে নজর যেতেই সাদা রঙের আরও একটি ব্যান্ডেজ দেখতে পেল। বেশ দীর্ঘ ব্যান্ডেজ। দেখা মাত্র সরে আসতে চাইলো বেলা। আদ্র দিলো না। বাধ্য হয়ে ওভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনার বুকে ওটা কিসের ব্যান্ডেজ?” ক্ষীণ ব্যগ্র শোনালো তার কণ্ঠ। আদ্র নির্বিকার স্বরে উত্তর দিলো,
—“আঁচড় লেগেছে বোধহয়।”
—“সামান্য আঁচড়ে কেউ এত বড় ব্যান্ডেজ করে? আপনার আমাকে বোকা মনে হয়?”
আদ্রর কপালে দৃঢ় ভাঁজের দেখা দিলো, “একদম না।”
বেলা সেকথা কানেই তুললো না। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“মিথ্যে বলছেন কেন আদ্র? এসব কিভাবে হয়েছে? হাত, বুক, কপাল এগুলো ছাড়াও কি আরো ক্ষত আছে?”
—“আছে।”
যতটা শান্ত আর নির্লিপ্ত ভাবে আদ্র কথাটা বললো, তার থেকেও দ্বিগুণ অশান্ত হলো বেলার মন। চোখে দারুণ জ্বালা হচ্ছে। তবে না কাঁদার অসহ্য প্রয়ার চালিয়ে যাচ্ছে সে। ধারালো নখ গিয়ে খামচে ধরলো আদ্রর বুকের শার্ট। আদ্র ব্যথা পেলেও কিছু বললো না। বেলা শুকনো গলায় আওড়ালো,
—“আপনি আমাকে এখনো বলছেন না, কিভাবে হয়েছে এসব?”
বেলার কেশবহুল মাথায় নিজের গাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আদ্র। ওয়ানওয়ে রোড দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাক, গাড়ি সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে। বাতাসের গতি একটুর জন্যে বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। সেসময় একটা ট্রাক আদ্রদের গাড়ি অতিক্রম করতেই অনলের ভীষণ তেজি ঝাপটা এসে ছুঁয়ে দিলো তাদের। বেলার চুল আবারও এলোমেলো হলো। আদ্র হাত বাড়িয়ে তা সযত্নে গুঁজে দিলো কানের পেছনে। গম্ভীর গলায় খুব কঠিন করে বললো,
—“এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না বেলা। রাজনীতিবিদদের প্রাণের নিশ্চয়তা থাকে না। আমি তো তাও বেঁচে ফিরেছি। ইনশাল্লাহ এই নির্বাচনে আমারই জয় হবে।”
নখের সাহায্যে খামচে ধরা হাতটা দৃঢ় করলো বেলা। বলতে চাইলো, “রাজনীতি ভীষণ খারাপ আদ্র। ছেড়ে দিননা এসব। নিজের প্রিয়জন থেকেও কি এই পেশা আপনার কাছে বেশি প্রিয়?”
তবে বলা হয় না তা। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে শুধু। হৃৎপিণ্ডে হাহাকার তৈরি হয়।
–
বেলাকে এলাকার মূখ্য গেটে নামিয়ে গাড়ি ঘোরায় আদ্র। বাসায় এখন যাওয়া যাবে না। নির্বাচনের কিছু কাজও বাকি আছে। আপাতত দলের ক্লাবের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাচ্ছে সে। জানালার কাছে স্থির থাকা ফোনটায় আয়াজের কল আসছে বারবার। আদ্র ধরেনি একবারও। উলটো ফোন সাইলেন্ট করে দিয়েছে। কিন্তু যখন দেখল অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে, তখন সপ্তমবারের কলটি রিসিভ করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে আয়াজ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
—“এই তোর ফোন কোথায় থাকে? কতবার কল দিয়েছি খেয়াল আছে? কই তুই?”
আদ্র জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকালো একবার। আয়াজের চিৎকার পরোয়া না করে স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলো,
—“রাস্তায়। ক্লাবে যাচ্ছি।”
—“তুই অসুস্থ ভাই। এখন অনতত এসব কাজ বাদ দেয়। তোর চিন্তায় কান্না করছে মা। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।”
আদ্র ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
—“কয়েকদিন পরই নির্বাচন আয়াজ। এখন কোনোভাবেই কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।”
আদ্রর নাছোড়বান্দা ব্যবহারে বেশ বিরক্ত আয়াজ। অনেকটা রাগ নিয়েই বললো,
—“আমার তোকে নিয়ে সবসময় ভয় হয় ভাই। বাবার মতো তোকেও হারানোর ইচ্ছে নেই আমার। তবুও আমি তোর স্বপ্নকে সম্মান করি। প্রাধান্য দেই। কখনো তোকে বাঁধা দেই না। আজ যখন বাঁধা দিচ্ছি তখন তার পেছনে নিশ্চই কারণ আছে। আর কারণটা তুই ভালোভাবেই জানিস। আমি একা মায়ের কান্না থামাতে পারছি না। মা তোকে খুঁজছে বারবার। তুই কি আসবি?”
শুনে আদ্র অনেক্ষণ চুপ রইলো। হাতে ব্যথা পাচ্ছে সে। অবশ হয়ে আসছে যেন। আয়াজ আবারও ডাকতেই গাড়ি বাড়ির পথে ঘোরালো সে। মুখে বললো, “আসছি।”
এরপর বাড়ি আসার পর রেখা এক মুহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করলেন না আদ্রকে। জড়িয়ে ধরে রইলেন। কাতর কণ্ঠে আহাজারি করে উঠছিলেন,
—“তুই রাজনীতি ছেড়ে দেয় বাবা। আমরা এমনিতেই তো ভালো আছি। ছেড়ে দে না বাবা। রাজনীতিতে কি আছে?”
আদ্র তখন শুধু এটুকুই বলেছিল, “রাজনীতি আমার স্বপ্ন মা।”
–
গভীর রাত। বিছানার এপাশ ওপাশ করছে বেলা। ঘুম আসছে না। কতক্ষণ যে সে এমনিই চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল তার ইয়ত্তা নেই। তবুও চোখে ঘুম ধরছে না। তন্দ্রা যেন তুখর শত্রুতা করেছে তার সঙ্গে। সূদুর হতে এক নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘুম না আসার কারণ হিসেবে বেলা সেই পাখিটিকেই দোষারোপ করলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় মানুষজন নেই। দোকানপাট বন্ধ। যতদূর চোখ যায় সবার বাড়ির বাতি নেভানো। শুধু বাহিরের ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। ঘুমের অতলে ভাসমান সবাই। একা কি তবে সে-ই শুধু জেগে আছে? প্রশ্নের চাক্ষুষ উত্তর হিসেবে হঠাৎ আদ্রকে ছাদে দেখতে পেল বেলা। আদ্রর বারান্দা দিয়ে যেমন তাদের ছাদ দেখা যায়, তেমনি বেলার বারান্দা দিয়েও আদ্রদের ছাদ দৃশ্যমান।
রেলিংয়ের ওপর স্থির হয়ে বসে আছে আদ্র। হাতাকাটা গেঞ্জি পড়ায় শরীরের ক্ষত গুলো সুস্পষ্ট। বিশেষ করে হাতের ক্ষতটি। রেলিংয়ের ওপাশে পা দু’টো ঝুলিয়ে রেখেছে সে। বেলা আঁতকে উঠলো। লোকটার কি সাহস! ওখানে বসে থাকতে ভয় করছে না? কি নিশ্চিন্তে সিগারেট ফুঁকছে! বেলা না চাইতেই চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ওখানে বসে আছেন কেন? পরে যাবেন তো। নামুন!”
আদ্র অল্প চমকালেও তা নজরে এলো না। ঘাড় বেঁকিয়ে বেলার দিকে তাকালো সে। বেলাকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
—“এখনো ঘুমাননি কেন? বারান্দায় কি?”
বেলা জবাব দেয় না। উলটো আবারও চেঁচিয়ে বলে, “নামছেন না কেন? এমনিতেই আপনি অসুস্থ। এখান থেকে পরলে কি হবে জানেন?”
কথাটা বলে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় বেলা। খুব জোড়েই কথা বলে ফেলেছে সে। বিহান বিরক্ত হয়ে ওদিক ফিরে শুয়েছে। বলছে, “এভাবে চিল্লাচ্ছো কেন বুবু? ঘুমাচ্ছি তো!”
বেলা দমে গেল। ছাদের দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখল, আদ্র হাসতে হাসতে রেলিং থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। সিগারেট নেই হাতে। নত বেলার দিকে চক্ষুদ্বয়ের বেহায়া চাহনি স্থির করে প্রশ্ন করলো,
—“আপনাকে কখন বেশি সুন্দর লাগে তা জানেন?”
বেলার জানতে ইচ্ছে করলো খুব। লজ্জায়, জড়তায় মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলো না। চুপ রইলো। আদ্রর দিকে তাকালোও না। আদ্র বেলার দিকে চেয়েই রইলো। ঘোর লেগে গেছে যেন। আবিষ্ট কণ্ঠে বললো,
—“আপনার কান্না দেখার জন্য হলেও আপনাকে আমার লাগবে বেলা।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
প্রিয় বেলা
১৫.
আদ্রর ঘোরলাগা দৃষ্টি তখনো স্থির। ঠোঁটের কোণে বাঁকানো হাসির অস্তিত্ব খুব প্রখর ভাবেই আছে। বেলা এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ঘন ঘন পলক ফেলছে। আদ্রর চাহনির পরিবর্তন ঘটছে না। সে অনড়, ক্ষান্তহীন। প্রগাঢ়তায় ভরা সেই চাহনির বিপরীতে প্রচন্ড লজ্জায় আড়ষ্ট বেলা। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
—“অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনার ঘুমানো প্রয়োজন।”
আদ্র শুনলো না বোধহয়। আশপাশটায় একটু তাকালো মাত্র। আরও একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো বেলাকে। আদেশ সমেত বললো,
—“ছাদে আসুন।”
রাত্রি গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। বেলার মাথায় ঘোমটা নেই। দিতে ভুলে গেছে সে। বিহান ঘুমের মাঝে নড়চড় করছে বারবার। বেলা সচকিত হলো। মানা করে বললো,
—“আপনি অসুস্থ। সকালও হবে কিছুক্ষণ পর। চলে যান। আমি আসব না।”
বলে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদ্যোগী হলো সে। আদ্র রেলিংয়ে দুহাত রেখে আরাম করে দাঁড়ালো। নভস্থলে গভীর দৃষ্টি মেলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
—“আমি তবুও অপেক্ষা করবো বেলা। কারণ আপনি আসবেন।”
বেলার পা থমকালো না। বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো হালকা শব্দে। দরজার কাঠে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। মুখ থেকে আগত উষ্ণ নিশ্বাসগুলো অবিন্যস্ত হলো। চোখ বুজে এলো। হঠাৎ কি মনে করে জানালার পর্দা অল্প সরালো সে। আদ্র এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। একইভাবে আকাশপানে কি যেন দেখছে। লোকটা কি সত্যিই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাহিরে শীত কম নয়। শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। তারওপর আদ্র অসুস্থ। বেলা আর রুমে থাকতে পারলো না। গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বের হলো, ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠলো। সর্বশেষে ছাদে এসেই দেখতে পেল আদ্রকে। তার আসার আভাস পেয়ে লোকটা তার দিকে তাকিয়েছে। ঠোঁটে এসে হানা দিয়েছে স্নিগ্ধ হাসি। কি সুন্দরই না লাগছে মানুষটাকে!
বেলা আরেকটু এগিয়ে আসতেই আদ্রর হাসি আরও গাঢ় হলো। অস্থির চোখজোড়া বেলার মুখশ্রী জুড়ে ঘুরতে লাগলো। সে বললো, “আমি জানতাম, আপনি আসবেন।”
আদ্রর পেশিবহুল ফোলা ফোলা হাতের বাহু অনাবৃত। গলা বড় হওয়ায় বুকের ব্যান্ডেজটার ক্ষীণ অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে সে। চোখের ঠিক ওপরে, ভ্রুয়ের কাছ ঘেঁষে লম্বালম্বি দু’টো দাগ দেখা যাচ্ছে। এমন অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও লোকটা কেমন দিব্যি হাসছে। বেলা দৃষ্টি লুকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“আমি এসেছি। এবার চলে যান।”
—“আপনাকে জড়িয়ে ধরা এখনো বাকি আমার।”
তৎক্ষণাৎ এক কদম পেছালো বেলা। গলা কাঁপিয়ে লহু চিৎকার করলো, “না।”
আদ্র হেসে ফেললো। মেয়েটাকে ভয় পেলেও দারুণ লাগে। দৃঢ় গলায় বললো,
—“এখানে আসুন বেলা। দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছেন কেন?”
বেলা এবার একটু রাগ নিয়েই বললো,
—“এক্সিডেন্ট করে আপনার মাথা গেছে একদম।”
বিনিময়ে আদ্র আবারও হাসলো। গুরুগম্ভীর নেত্রজোড়াও চঞ্চল হলো। হিমেল হওয়া হঠাৎই থেমে গেল। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ, তারা দু’জন। আদ্র ঠোঁটের হাসি ধূলিস্যাৎ করে ধারালো কণ্ঠে সূক্ষ্ণতা নিয়ে বললো,
—“আপনাকে আমার কাঁদাতে ইচ্ছে করছে বেলা। আপনার কান্নারত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।”
বেলা চমকিত হয়। হকচকিয়ে তাকায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। এত ভয়ংকর কারো ইচ্ছে হয়?
–
ক্লাবে সব দামি দামি জিনিস। দরজা, জানালা সব বন্ধ করা। মাথার ওপর ফুলস্প্রীডে ফ্যান চলছে। সাদা বাতির আলোয় আলোকিত বড়সড় রুমটা। আদ্র টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার সামনেই দলের ছেলেগুলো দাঁড়ানো। তাদের মাঝে মধ্যিকানের তন্ময় নামের ছেলেটি ক্ষীপ্ত গলায় বললো,
—“ভাই, বিপক্ষের ছেলেগুলো এবার বেশি করছে। আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে নিজেদেরগুলো লাগাচ্ছে। কিছু হলেই মারামারিতে এসে যাচ্ছে। আপনি শুধু আদেশ দেন আমরা–।”
তন্ময়কে থামিয়ে দিলো আদ্র। হাতের কিউবটা নাড়াতে নাড়াতে শান্ত স্বরে বললো, “নির্বাচনের বেশিদিন নেই। আর কয়েকদিন যাক। ব্যাপারটা দেখব আমি।”
তন্ময় অসহায় কণ্ঠে বললো,
—” ভাই, আমরা কিছু বলছি না দেখে ওদের সাহস বেড়ে গেছে। আপনার ওপর হামলা করলো। কালকে আবার আমাদের দুজন ছেলের হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। একজনের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনি কি এখনও কিছু বলবেন?”
কিউবটা সশব্দে টেবিলে রাখলো আদ্র। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে প্রকাণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো,
—“আমাকে আগে জানানো হয়নি কেন?”
—“আপনাকে কল করছিলাম ভাই। আপনি ধরেন নাই।”
আদ্র তবুও রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিকে। রাগ আর প্রকাশ করলো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,
—“আজ রাতেই যা করার করবি। দু’একজন ছুঁড়ি নিলেও প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করবি না। সবাই হকিস্টিক নিবি। যেভাবে পারিস একেকটার হাত-পা ভেঙ্গে দিবি। আর সাবধান। কেউ যেন তোদের চেহারা না দেখে।”
টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো আদ্র। আকিব এগিয়ে আসলো দ্রুত। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
—“এখন কোথায় যাবেন ভাই?”
—“বাসায়ই যাবো। আসো।”
আদ্র গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। আকিবও পেছন পেছন আসলো।
জ্যামে আটকে পরেছে আদ্রর গাড়িটা। এসি চলছে। তবুও গরমে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। চুল অগোছালো। বিরক্ত মনে জানালা গলিয়ে বাহিরে দৃষ্টি ফেলল সে। ফুটপাতে অল্পবয়সী একটা মেয়ে চুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাঁচের চুড়ি। লাল, নীল, কালো, হলুদ, সবুজ। আরও কত রঙের! লাল রঙের চুড়িগুলোয় চোখ আটকে গেল আদ্রর। বেলার কথা মনে পরলো। পাশে বসা আকিবকে ডাকলো,
—“আকিব, শুনো।”
আকিব সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, “জি ভাই বলেন।”
—“ওখানে চুড়ি দেখছো না? লাল রঙের সব চুড়ি নিয়ে আসো। টাকা নিয়ে যাও।”
আকিব মাথা দুলালো। দ্রুত রাস্তার গাড়ি, রিকশা পেরিয়ে ফুটপাতে বসা মেয়েটি থেকে চুড়ি নিতে লাগলো। আদ্র সেদিকে তাকিয়ে জোড়ালো নিশ্বাস ফেললো। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। বেলার মুখশ্রী ভেসে উঠছে। রাতে না ঘুমানোয় তন্দ্রা এসে জেঁকে বসছে দৃঢ়তার সঙ্গে। আদ্র ঘুমিয়ে যেতে লাগলো। তার আগ অব্দি অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড়িয়ে অভিযোগ করে উঠলো, “আপনি আমার সঙ্গে এভাবে মিশে যাচ্ছেন কেন বেলা? পাগল করে দিচ্ছেন আমায়।”
–
১৮ই মাঘ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ঘড়ির কাটায় বিকাল পাঁচটা বাজছে। প্রভা বেগম পায়েস রান্না করেছেন আজ। বেলাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন একবাটি পায়েস যেন রেখাকে দিয়ে আসে। বেলা দিরুক্তি করলে শান্ত গলায় কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,
—“ওরা কিছু বানালে আমাদেরকে দেয় নি এমন কখনো দেখেছিস? আমাদেরও তো দায়িত্বে পরে কিছু বানালে ওদেরকে দেওয়ার, তাই না? যা না মা। এমন অবাধ্য হচ্ছিস কেন?”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রদের বাড়ি উপস্থির হলো বেলা। রেখা ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে ছিলেন। টিভিতে সময় চ্যালেন চলছে। দলনেতা হয়ে স্টেজে স্পিচ দিচ্ছে আদ্র। পরনে মুজিব কোর্ট। সবসময়ের মতো ভ্রু কুঁচকে একের পর এক হাঁড় কাঁপানো বাক্য বলে যাচ্ছে সে। কণ্ঠে সে কি তেজ, কাঠিন্যতা, দাম্ভীকতা! সবাই হইহই করে তালি দিচ্ছে।
রেখা বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠিক হয়ে বসলেন। মুচকি হেসে বললেন,
—“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বেলা? এদিকে আসো। আমার পাশে বসো।”
টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বেলা সোফায় বসলো। পায়েসের বাটিটা রেখাকে দিয়ে বললো,
—“এটা আপনাদের জন্য মা পাঠিয়েছে।”
এমনিতে হলে রেখা এতক্ষণে উৎফুল্লতায় ভরে উঠতেন। অথচ আজকে মুখটা মলিন। একটু করে হেসে বললেন,
—“তোমার মা ভালোই করেছে পায়েস পাঠিয়ে। খেতে ইচ্ছে করছিল।”
বলে পায়েসের বাটিটা টেবিলে রেখে দিলেন। বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনি ঠিক আছেন আন্টি? না মানে, আপনাকে কেমন অসুস্থ লাগছে।”
—“হ্যাঁ। প্রেসার বেড়ে গেছে একটু।” হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।
এর পিঠে বেলা কি বলবে খুঁজে পেল না। ভেতরে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য মন স্থির করতেই হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো আরু। বেলাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। বললো, “কেমন আছো আপু? আমি এখন তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম। তোমাকে ডাকতে।”
বেলা অবাক নয়নে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে ডাকতে? কোনো প্রয়োজন ছিল আরু?”
—“হ্যাঁ, তা তো ছিলই। চলো আমার সঙ্গে উপরে যাবে। আসো।”
বেলা একপলক রেখার দিকে তাকালো। উনি ইতিমধ্যে পায়েস খাচ্ছেন। এদিকে খেয়াল নেই অত। আরুর সাথে উপরে চলে গেল সে। আরু তাকে আয়াজের রুমে নিয়ে এসেছে। সাধারণ, অল্প অগোছালো রুম। স্বাভাবিক ভাবে ছেলেদের রুম যেমন হয়। আয়াজ আগে থেকে বিছানায় বসে ছিল। বেলা আসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। বিস্তর হেসে বললো,
—“এসেছো? বসো। তোমার মূল্যবান জিনিসটা আগে দিয়ে দেই। নয়তো ভাই আমাকে আস্ত রাখবে না।”
বলতে বলতে সে আলমারি থেকে একটা প্যাকট বের করে ধরিয়ে দিলো বেলাকে। বেলা সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আয়াজ মিটিমিটি হেসে বললো,
—“খুলে দেখো কি আছে।”
বেলার অস্বস্থি হচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে প্যাকেটটার দিকে তাকালো সে। খুললো। অনেকগুলো লালচুড়ি দেখে বিস্ময় যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল। আয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“এতগুলো চুড়ি– কে দিয়েছে?”
উত্তরে আয়াজ আগের ন্যায়ই বললো,
—“ভেতরে একটা কাগজও আছে। বের করে পড়ো। তোমার উত্তর ওখানে আছে।”
বেলা কাঁপা হাতে চুড়িগুলো ক্ষীণ সরালো। হলুদ রঙের কাগজ বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে। বেলা কাগজটা বের করলো। কালো কালি দিয়ে খুব সুন্দর হাতের লিখা ভেসে উঠছে সেখানে,
—“আপনার হাতের মাপ আমার জানা নেই বেলা। তাই সবগুলোই নিলাম। একদিন এগুলো পরে আমাকে চমকে দেওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
~আদ্র ইয়ানিদ।”
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা