প্রিয় বেলা পর্ব-৩০+৩১

0
514

প্রিয় বেলা

৩০.
আদ্র গোসল সেরে বের হয়েছে মাত্র। একহাতে চুল মুছতে মুছতে পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো সে। ভ্রু কুঁচিত হলো। তিক্ত হলো মন, মস্তিষ্ক, মেজাজ। চুলের ডগা থেকে জলরাশির সূক্ষ্ণ রেখা কপাল ঘেঁষে গড়াতেই তা তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেললো সে। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। একরাশ হতাশা নিয়ে। বেলা রুমে নেই। চলে গেছে হয়তো। মেয়েটা একটা কথাও শোনে না তার। থেকে যেতে বলার পরও অবাধ্যতা করে চলে গেছে সুড়সুড় করে। বিছানার একপাশে গিয়ে বসলো আদ্র। কণ্ঠে ক্রোধের ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে উঁচুস্বরে ডাকলো,
—“বেলা।”

বেলা বারান্দায় ছিল। বিস্তর নভস্থলের দাগযুক্ত চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। আজকে চাঁদটা বেশ বড় করে উঠেছে। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে আশপাশের কালো আঁধারি জায়গাগুলো। দৈবাৎ আদ্রর রাশভারি কণ্ঠের ডাক শুনে থমকালো সে। পিছু ফিরে তাকালো। আদ্র একমনে মাথা মুছতে মুছতে ঘাড় কাত করে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখশ্রী অসম্ভব বিকৃত। অসন্তোষ ভাব। বেলা সময় নিলো না। দ্রুত পায়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। চোখ বড় বড় করে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কি হয়েছে? এভাবে ডাকছেন কেন?”
আদ্র একটু বিস্মিত হলেও তা চেহারায় বিন্দু মাত্র প্রকাশ পেল না। স্বাভাবিক ভাবে সে প্রশ্ন করলো,
—“তুমি এতক্ষণ বারান্দায় ছিলে?”
—“হ্যাঁ।”
—“তোমাকে আমি বিছানায় বসে থাকতে বলেছিলাম। বারান্দায় গেলে কেন?”

আদ্রর গম্ভীর প্রশ্নের পিঠে অবুজ চোখে চেয়ে রইলো বেলা। উত্তর দিতে পারলো না। ভেঁজা তোয়ালে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে হঠাৎ-ই মাথা নিচু করে ঝুঁকলো আদ্র। ঘাড়ের পেছনে হাত বুলালো ব্যগ্র ভাবে। অধৈর্য কণ্ঠে ভীষণ অতৃপ্তি নিয়ে বললো,
—“তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছো বেলা। অধৈর্য করে ফেলছো।”

বেলার অবুঝ নেত্রজোড়ার পরিবর্তন ঘটলো। লাজুক গালগুলো ভারী হলো। নেত্রপল্লব লেগে আসতে চাইলো যেন। বার দুয়েক পলক ঝাপটে সে দৃষ্টি নুয়ালো। মৃদু স্বরে বললো, “আপনি দুপুর থেকে কিছু খাননি। খাবেন না? আমি নিয়ে আসবো?”
—“উহু! তোমার সঙ্গে থাকতে চাইছি এখন।” নিঃসঙ্কোচ, সুপ্ত বাসনা। বেলাকে আরও লজ্জায় মিইয়ে দিলো। আড়ষ্টতা জেঁকে ধরলো।
আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রগাঢ় গলায় শুধালো,
—“তুমি এত লজ্জা পাও কেন বেলা? আমার মতো লজ্জাহীনের মুখে সামান্য থেকে সামান্য কথাও আটকায় না। সহ্য করতে পারবে তুমি?”

বেলা আর বসে থাকতে চাইলো না। লোকটা পাগল হয়ে গেছে নিশ্চিত। কিসব বুলি আওড়াচ্ছে। ইতস্তত পায়ে বিছানা থেকে তোয়ালে নিয়ে আবারও বারান্দায় চলে গেল সে। কাঠের চেয়ারটাতে বিছিয়ে দিলো সুন্দর করে। আদ্রর বারান্দায় তার মতো রশি বা তাড় ঝুলানো নেই। একদম পরিষ্কার। তবে ফাঁকা পুরোটা। বেলা মনে মনে ভাবলো, বারান্দাটা সে ফুলগাছে ভরিয়ে দেবে।
ভাবনার অকূল পাথারেই আদ্রর শক্ত, শীতল পুরুষালি হাতটি আচমকা কোমড় জড়িয়ে ধরলো তার। হাতজোড়া শাড়ির ওপরে থাকা সত্ত্বেও তীব্র ঠান্ডার স্বতঃস্ফূর্ত আভাসে শিহরিত হলো সর্বাঙ্গ। বেলা চমকিত হলো। খুব ভড়কালো, ভয় পেল। ছোট্ট পিঠটা গিয়ে ঠেকলো প্রশস্ত বুকে। অস্থির নয়নে বাগানের দিকটায় চোখ ঘোরালো সে। দেহরক্ষীগুলো সব এখনো পাহারা দিচ্ছে বাড়িটা। চারিদিকে তাদের বিচক্ষণ দৃষ্টি অনবরত ঘুরছে। স্থির হচ্ছে না। আতঙ্কিত হয়ে হালকা চেঁচালো বেলা,
—“কি করছেন? ছাড়ুন! আপনার হাত অনেক ঠান্ডা।”

আদ্র শুনলো না যেন। হাতও সরালো না। হাসফাস করে বেলা অনুরোধের সুরে বললো,
—“নিচে গার্ডসরা আছেন। আমাদের এভাবে দেখলে কি ভাববে? ছাড়ুন না।”
—“উপরে তাকাবে না ওরা।”
বেলার সন্দিহান কণ্ঠ, “যদি তাকায়?”

প্রতিউত্তরে আদ্র কিছুই বললো না। নিজ গতিতে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো বেলাকে। আদুরে ভাবে। কাঁধে থুতনি ঠেকালো। আকাশের ওই বিশাল চাঁদটির দিকে একবার চেয়ে বেলার দিকে তাকালো আবার। আনমনে বললো,
—“তোমার এই জনপ্রিয় চাঁদটা থেকে আমার আকাশের অপরিচিত চাঁদটাই বেশি সুন্দর বেলা।”

হাসপাতালের কক্ষগুলোয় ফিনাইলের কড়া গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। রুমালটা নাকে চেপে আকিব বেশ চোখ-মুখ কুঁচকে আছে। বিরক্তও সে। কেবিনে লম্বালম্বিভাবে আহত টেক্সিচালক গুলোকে আলাদা, আলাদা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। নিষ্ঠুর, খারাপ লোকগুলোকে দেখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই আসছে না আকিবের। মূলত এজন্যই সে ভীষণ বিরক্ত। নাক কুঁচকে প্রচন্ড রোষপূর্ণ গলায় আদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমরা এখানে কেন এসেছি ভাই? চলুন, চলে যাই। এসব অমানুষদের সাথে কথা বললেও পাপ।”

আদ্র কিছু বলছে না। নিশ্চুপ ভাবে দেখছে টেক্সিচালকগুলোকে। ব্যথায় যখন তারা কাতরাচ্ছে, তখন অভ্যন্তরে সিক্ত আনন্দ দোলা দিয়ে উঠছে বারবার। প্রশান্তি কাজ করছে মনে, মস্তিষ্কে। এদের মাঝের জনকে আদ্র বেশ ভালো ভাবেই চেনে। পাঁচজন মেয়েকে ধর্ষণ করার মামলা আছে এর ওপর। শুধু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে স্বাধীন ভাবে ঘুরছে এই মানুষ রুপি হায়নাগুলো।
আদ্র থমথমে গলায় আকিবকে বললো, “তোমাকে কিছু রেকর্ডিং পাঠিয়েছিলাম আমি। বের করো।”

আকিব দেড়ি করলো না। একহাতে নাক চেপে অন্যহাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। রেকর্ডিং-এর ফাইলটি বের করে বললো,
—“বের করেছি ভাই।”
—“প্রথমটা চালু করো।”

আকিব চালু করলো। সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করলো রেকর্ডারটি। যেখানে স্পষ্ট ইখতিয়ারের কণ্ঠ ভেসে উঠছে। সে বলছে,
—“ওদের না মেরে আমাকে একটা উটকো ঝামেলায় সত্যিই ফেলে দিয়েছো আদ্র সাহেব। এখন ওদের রিলিজের অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই খেলা শেষ।”

বলে হো, হো করে হাসতে লাগলো সে। কর্কশ কণ্ঠের হাসিতে ভয়ে তটস্থ হলো সবার মুখ। চোখের দৃষ্টি ভীতু। হঠাৎ-ই শরীর গরম হতে শুরু করেছে যেন। কপাল ঘামছে। গলা শুকিয়ে পিপাসা পাচ্ছে প্রচন্ড। মাঝখানে পাতলা, কৃষ্ণবর্ণের লোকটি অনেকটা তোতলিয়ে বললো,
—“এখন আমগো কি করতে হইবো ভাই?”

আদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। অদৃশ্য হাসি। কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,
—“বেশি কিছু না। ইখতিয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে স্বাক্ষী দিতে হবে।”
লোকগুলো একে অপরের মুখপানে একে একে চাইলো। পরক্ষণেই একসাথে হইহই করে উঠলো,
—“আমরা দিমু ভাই। সবাই স্বাক্ষী দিমু। শুধু আমগো ওই ইখতিয়ার থেইকা বাঁচাইয়েন।”

আদ্র কেবিন থেকে বেরিয়ে পরলো। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকিবও এলো পিছু পিছু। ধীরস্থির ভাবে অপরাধীর ন্যায় বললো,
—“আমাকে ক্ষমা করবেন ভাই। আমি শুধু শুধুই আপনাকে ভুল ভেবেছিলাম।”

আদ্র শুনলো। হাঁটতে হাঁটতে পালটা প্রশ্ন করলো,
—“মাক্স পরো মুখে। রুমাল চেপে আছো কেন?”
—“আনতে মনে নাই ভাই।”
লজ্জিত হেসে উত্তর দিলো আকিব।

সময় গড়াচ্ছে। সকাল পেরিয়ে পৃথিবীর আকাশে দুপুর নেমে এসেছে। মেঘেরা প্রবল ঝগড়া করে একে অপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দীর্ঘক্ষণ আগে। শুভ্রতা হারিয়ে কালো রূপ ধারণ করেছে মেদুরগুলো। তাদের রেশারেশির তীব্রতা বেড়ে গেল হুট করেই। কালো বিস্তর নভস্থলে সূর্যের দেখা মিললোই না আর। বৃষ্টি শুরু হলো। মুষলধারে বৃষ্টি। বেলার বেকুলতা বড্ড বেড়ে গেল। আদ্র দুপুরে খেতে আসবে বলেছিল। এখনো আসছে না কেন? ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ৩টা বেজে এক মিনিট। অশান্ত মনে সে বিছানায় গিয়ে বসলো। এবাড়িতে কেউ কাজ করতে দেয় না তাকে। টুকটাক রেখা আর আরুর সঙ্গে কথা বলেই কেটে যায় কিছুটা সময়। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বেলার ভালোলাগে না। আদ্রকে মনে পরে। ভীষণভাবে মনে পরে।

রাস্তা থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ এখান অব্দি শোনা যাচ্ছে। বেলার সম্বিৎ ফিরলো। বসে থাকতে থাকতে প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল সে। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। বাহিরে উঁকি দিতেই দেখতে পেল আদ্রর কালো গাড়িটা। বেলা কালবিলম্ব করলো না। ব্যস্ত পায়ে দ্রুত ছুটে গেল নিচে। কলিংবেল বাজার পূর্বেই দরজা খুলে দিলো। আদ্র মাত্রই কলিংবেল চাপতে যাচ্ছিল। হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়ায় অবাক হলো। প্রিয়তমার স্নিগ্ধ মুখশ্রী চোখে ভাসতেই ক্লান্তি উবে গেল যেন। সতেজ হয়ে উঠলো ভেতরটা। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা দেখা দিলো।
বেলা কিছুপলক তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। আলতো স্বরে বললো,
—“ভেতরে আসুন।”

আদ্র ঢুকলো। ড্রইংরুমে বসে থাকা আয়াজের দিকে তাকালো একবার। খুব আস্তে করে বললো,
—“রুমে আসো।”
—“আসছি।”

আয়াজ ফোন চাপছিল। আদ্রকে দেখে সরাসরি তাকালো। তাড়াতাড়ি ডাকলো,
—“ভাই শুন। কথা আছে তোর সঙ্গে।”

আদ্র তখন সিঁড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছিল প্রায়। আয়াজের কথায় দাঁড়ালো। ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি?”
—“ব্যবসায় ইদানিং সমস্যা করছে একলোক। কোন ইখতিয়ার নাকি কি! অবৈধ কাজ করতে চাইছে। তোর বিপক্ষদলের মনে হয়। ওরে আউট কর তো!”
আদ্রর ছোট্ট উত্তর,
—“পারবো না।”
সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভট কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালো আয়াজ,
—“কেন? কেন পারবি না? তোকে কি মাগনা মাগনা রাজনীতিতে ঢোকার জন্য সাপোর্ট করেছিলাম আমি? সময় এসেছে, আমি আমার সাপোর্টের মূল্য চাই।”
—“পরে দেখা যাবে।”

চলে যাওয়ার আগে আদ্র আবারও বেলাকে ইশারা করলো রুমে আসার জন্যে। তা দেখে আয়াজ পেছন থেকে খুব চেঁচালো, “ইশারায় কথা বলছিস কেন? আমি দেখব না মনে করেছিস? নিজে তো বিয়ে করেনিলি। আমার মতো নিরীহ মানুষটাকে এখন লোভ দেখাচ্ছিস। শুধু চৈতির সঙ্গে আমার বিয়েটা হতে দেয়। অসভ্য আমিও হতে জানি।”

আয়াজের কথা থামলো না। লাজুক বেলা কোনোমতে চলে এলো সেখান থেকে। রুমে পা রাখতেই আদ্রকে ক্ষীণ ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠা হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এগিয়ে এসে তাগাদা দিয়ে বললো,
—“আপনি এখনো ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ফ্রেস হয়ে আসুন। যান।”
আদ্র গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে কি যেন বের করলো। পরক্ষণেই অনেকটা কাছে টেনে নিলো বেলাকে। গলায় কিছু একটা পরিয়ে দিলো। বেলা তাকালো। পাথরের গলার চেইন। জ্বলজ্বল করছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর। বেলা মৃদু হাসলো। হাত বারিয়ে চেইনটা ছোঁয়ার আগেই তাকে নিজের বক্ষের মধ্যিখানে টেনে আনলো আদ্র। কানের পেছনে এলোমেলো চুলগুলো গুঁজে দিলো খুব যতনে। জিজ্ঞেস করলো,
—“আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

বেলা মাথা দুলালো আস্তে আস্তে। সে অপেক্ষা করছিল। আদ্র বিস্তর হাসলো। আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। নিবিড় হলো সবটা। প্রগাঢ় হলো স্পর্শ। বেলা মিনমিন কণ্ঠে বললো,
—“আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। শার্ট পালটে আসুন। শার্ট বের করে দেব আমি?”
কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি, সন্তুষ্টি ভাব নিয়ে আদ্র উত্তর দিলো,
—“শার্ট-টার্ট পাল্টাতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে আসো। চুল মুছে দেবে।”

___________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

৩১.
এসির তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমিয়ে কী-বোর্ডের ইংরেজী অক্ষরগুলোয় অতি দক্ষতার সঙ্গে আঙুল চালাচ্ছে আদ্র। ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে পাশেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বেলা। বলিষ্ঠ দেহের পেশিবহুল বাহুর সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে লেপ্টে আছে। ভীষণ আদুরতা নিয়ে। ঘড়িতে বারোটা বেজে বিশ মিনিট তখন। তন্দ্রা যেন খুব তাড়াতাড়িই চলে এসেছে আজ। আষ্টেপৃষ্টে নেত্রপল্লবে এঁটে আছে। চোখ মেলে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ আদ্রর কাজ শেষ হতেই চাচ্ছে না। চোখ বুজে আবারও হামি দিয়ে উঠলো বেলা। পিটপিট করে একবার জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকালো। ঘন কালো আঁধার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ক্ষীণ বিরক্তিতে লহু ভাঁজ পরলো কপালের মাঝ বরাবর। হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনার কাজ কখন শেষ হবে? ঘুমাবেন না?”

ব্যস্ত আদ্র একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মুচকি হাসলো। ঝুঁকে গিয়ে অধরের উষ্ণ, গাঢ় স্পর্শ দৃঢ় ভাবে এঁকে দিলো ললাটের একপাশে। পরক্ষণেই তীব্র আলোয় ভরা ল্যাপটপের স্ক্রীনে স্থির দৃষ্টি ফেলে বললো,
—“তোমার কি ঘুম এসেছে? এলে ঘুমিয়ে যাও। কাজটা শেষ করতে আরও এক-আধ ঘণ্টা লাগবে আমার। জেগে থেকো না। ঘুমাও।”

বেলা একদমই শুনলো না যেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ আদ্রর কাজ করা দেখলো। কাজ করার সময়ও লোকটা ভ্রু কুঁচকে রেখেছে। চোয়াল শক্ত, চোখে তীক্ষ্ণ ভাব। একটু আগের নমনীয়তার ছিঁটে ফোঁটাও নেই। নেত্রকোণের কাঁটা দাগটা স্ক্রিনের সরাসরি আলোয় জ্বলজ্বল করছে যেন। আদ্র চুল কেটেছে। আগের থেকে অনেকটা ছোট দেখাচ্ছে ঝাঁকড়া চুলগুলো। মসৃণ গালকে অমসৃণ করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো হালকা ঘন হয়ে গজিয়েছে। ওষ্ঠযুগল মৃদু নড়ছে। বেলা চেয়ে রইলো। আনমনে বললো,
—“আপনি চুল কেটেছেন কেন?”
—“ভালো লাগছিল না। বেশি বড় হয়ে গিয়েছিল। এখন পার্ফেক্ট আছে।”
—“একদমই না। বরং তখন বেশি ভালো লাগতো।”

আদ্র বাঁকা চোখে তাকালো। ঠোঁটে দীপ্ত হাসি রেখে শুধালো,
—“এখন ভালো লাগে না?”
আমতা আমতা করলো বেলা। উত্তর দিতে পারলো না। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। অস্থির হলো বক্ষস্থল। নিজের ওপর খুন রাগ হলো তার। সে এত লজ্জা পায় কেন? এই যে, লোকটার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। তার আগেই অসভ্য গালদু’টো গরম হয়ে উঠছে, প্রচন্ড ভারি লাগছে। উফফ! এ কেমন অসহ্য যন্ত্রণা?
আদ্র বেলার কেশবহুল মাথায় আলতো হাত বুলালো। কোমলস্বরে বললো,
—“শুধু শুধু জেগে আছো কেন? ঘুমিয়ে যাও বেলা।”
বেলা অবুঝ মেয়ের ন্যায় বললো তখন, “আপনার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না।”

ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা অল্প হাসিটা বিস্তর হলো। ল্যাপটপটা ছোট্ট টি-টেবিলে নিঃশব্দে রাখলো সে। বিছানায় শুয়ে বেলাকে নিজের বুকে চেপে ধরলো। অদৃশ্য ক্ষমতাবোধ নিয়ে। দূর্বল চিত্তে। কানের পেছনে গোছানো চুলগুলো আবারও গুঁজে দিয়ে নরম সুরে আওড়ালো,
—“এবার ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো।”

বেলা চোখ বুজলো না। চোখের পাতা ঝাপটালো দু’তিনবার। বেশি করে তাকিয়ে অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“আপনার কাজ শেষ হয়ে গেছে?”
—“না। পরে করবো।”

বেলা খানিক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। কি যেন ভাবলো মনে মনে। মুহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে বললো, “বিয়ের পর না মেয়েদের বাবার বাড়িতে যেতে হয়? আমি কালকে যাই?”
কথাটা খুব একটা ভালো লাগলো না আদ্রর। চেহায়ায় অসন্তোষ ভাব ফুটে উঠলো খুব স্পষ্ট ভাবে। রোষপূর্ণ গলায় ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“কেন যাবা?”
—“বিয়ের পর সবাই যায়।”
—“তুমি যাবা না।”

বেলার ভ্রু কুঁঞ্চিত হলো। হতবিহ্বল হয়ে প্রফুল্লহীন কণ্ঠে বললো, “এভাবে বলছেন কেন? বাবার বাড়ি তো পাশেই। গেলে কি হয়?”
আরেকটু কুঁচকালো তার সুর্দশন, গৌড়বর্ণ মুখশ্রী। দিশেহারা চোখজোড়া গম্ভীর হলো। থমথনে হলো কণ্ঠ,
—“পাশে হলে যেতে হবে কেন? বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলো। দরকার হলে বাবা, মাকে এখানে নিয়ে আসো। ওখানে যাওয়ার কি দরকার?”
হতবুদ্ধী বেলা কি বলবে ভেবে পেল না। নেত্রেজোড়ায় একরাশ বিস্ময় সৃষ্টি হলো। জিজ্ঞাসু অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে রইলো সে।
আদ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। বেলার স্নিগ্ধ মুখপানে তাকিয়ে কোনোরুপ জোড় করতে পারলো না। ভীষণ অনিচ্ছা নিয়ে হার মানলো, “কতক্ষণের জন্য যেতে চাও?”
—“এখনো ঠিক করিনি।”
—“আমি আসার আগে চলে আসবে, কেমন?”

চিন্তিত, বেকুল কণ্ঠের অসীম পাগলামোর পিঠে বেলা আলতো মাথা দুলালো মাত্র। অতি সন্তপর্ণে মুখ লুকালো বিস্তর বুকে। মোলায়েম স্বরে আদ্র আবারও বললো,
—“আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি বেলা। জেগে থেকো না। ঘুমাও।”

ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরে গেল। সময়ের গভীরতা বাড়লো। বেলা ঘুমিয়ে গেছে। দৃঢ় নিশ্বাসের ছোঁয়া বুকে উত্তাল উষ্ণ উম্মাদনা তৈরি করছে। আদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো তার প্রিয় বেলাকে। দীর্ঘক্ষণ, অনিমেষ, একমনে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার। মোহিত হলো তৃষ্ণায় কাতর চক্ষুদ্বয়। গলা শুকালো। আলিঙ্গন আরেকটু ঘনিষ্ট করতে গিয়েও আবার থেমে গেল সে। অনেকগুলো কাজ এখনো বাকি আছে। কিছু ডকুমেন্ট রেডি করা হয়নি। খুব সাবধানে বুক থেকে মাথা সরিয়ে বেলাকে বালিশে ওপর শুইয়ে দিলো আদ্র। ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আবারও গুতোগুতি শুরু করলো।

গুলাগুলির আওয়াজে ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে জনগণ। নিস্তব্ধ পরিবেশে বৃষ্টিহীনই বাজ পরছে যেন। প্রচন্ড শব্দ কানে আঘাত করছে। পাখিদের হাহাকারে ভরা ছোটাছুটি একগাছ থেকে অন্যগাছে যাওয়া অব্দিই সীমিত। যে যেভাবে পারছে কলেজ ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে। আশপাশ ঘেঁষছে না একদমই।
গাড়ি থেকে বের হতে হতে প্যান্টের পেছন থেকে সিলভার রঙের ভারি বন্দুকটি হাতে নিলো আদ্র। দ্রুত পায়ে কলেজের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—“কলেজের পেছন দিক দিয়ে সবার বের হওয়ার ব্যবস্থা করো আকিব। তন্ময়কে বলো ছেলেদের নিয়ে ওখানে যেতে। দাঁড়িয়ে থেকো না। দ্রুত যাও।”

হন্তদন্ত পায়ে আকিব তন্ময়ের কাছে দৌঁড় লাগালো। পুলিশরা আগেই এসে গেছেন। ড্রাগসসহ ইখতিয়ারকে হাতে নাতে ধরলেও হঠাৎ গুলাগুলির কারণে আহত হয়ে মাটিতে পরে ছিলেন প্রায় তিনচার জন। আদ্র বন্দুক তাক করলো ক্যাম্পাসের দিকটায়। অভ্যস্ত হাতে ট্রিগার চাপতেই সূক্ষ্ণ সোনালী রঙের গুলিটি বেরিয়ে এলো। কালবিলম্ব না করে প্রচন্ড তীব্র গতিতে এলাকার বখাটে ছেলেটির ডান হাতের মধ্যিখানে গিয়ে বিঁধলো। হাত থেকে ধারালো দা পরে গেল তার। অসহনীয় যন্ত্রণায় অন্যহাত দিয়ে বাহু চেপে কুকিয়ে উঠলো। নিচে ধপ করে শুয়ে পরলো। বিশুদ্ধ মাটি দূষিত রক্তে নোংরা হলো মুহুর্তেই।
আকিব চলে এসেছে। গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকা ইখতিয়ারকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুঁড়লো সে। নিমিষেই কানের পাশ গলিয়ে চলে গেল তা। কানের লতি টনটন করে উঠলো। ভয়ে একমুহুর্তের জন্য জড়োসড়ো হয়ে গেলেও পরক্ষণেই লাফিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো ইখতিয়ার। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাকে দু’জন পুলিশ অফিসার ধরে ফেললেন। হাঁটু গেড়ে বসিয়ে বন্দুক ছিনিয়ে নিলেন। আচমকা সব ঘটায় কিছুই করতে পারলো না সে। প্রবল ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠলো শুধু। ধমকাধমকি করতে লাগলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য।

এরপর সবটা শান্ত। বিপক্ষদলের অন্য ছেলেদেরও ধরে ফেলা হয়েছে ততক্ষণে। কিছুসংখ্যক পালিয়েও গেছে। ফাঁকা মাঠটাতে এক এক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ড্রাগসের বিশাল বিশাল কার্টন। সূদুরে সংবাদিকরা ভীর জমাচ্ছে। তাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ইখতিয়ারকে আদ্রর সামনে আনতেই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো সে। বিশ্রী মুখটা আরও বিশ্রী ভাবে কুঁচকে ফেললো। প্রথমেই মন্দ কণ্ঠে গালিগালাজ করলো কিছুক্ষণ। গগনবিহারী চিৎকার দিয়ে উঠলো,
—“কাজটা তুই ভালো করিস নাই আদ্র। তোর বাপের মতো তোকেও যন্ত্রণা দিয়ে মরবো আমি।ছাড়বো না কাউকে। মাত্র দুইদিন! দুইদিন লাগবে আমার জেল থেকে বের হইতে। তারপর দেখব তুই কি করিস। তোর না একটা প্রেমিকা আছে? সাবধানে দেখে রাখিস। বলা তো যায় না, মন চাইলে তুলেও আনতে পারি।”

ইখতিয়ার থামলো। মুখ থেকে একদলা থুতু ফেললো মাটির সবুজ, সতেজ দুর্বাঘাসে। অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই। বিকৃত হেসে। আকিব তৎক্ষণাৎ কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে ধমক লাগালো,
—“সমস্যা কি আপনাদের? একে নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তামাশা করাতে চাচ্ছেন নাকি দেখতে? তাড়াতাড়ি এই নোংরা লোককে নিয়ে গাড়িতে যান। যাচ্ছেন না কেন?”

ইখতিয়ার চলে গেল। গাড়িতে ওঠার পূর্বে আবারও তাকালো আদ্রর দিকে। সেই চালক-চতুর চোখে। ঠোঁটে অসহ্যকর হাসিটা। আদ্র কঠিন নেত্রে তাকিয়ে রইলো শুধু। কিছুই বললো না। আকিব একটু অবাকই হলো এতে। দৃষ্টি তুলে তাকালো। দেখলো, আদ্র চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সাদা শিরা-উপশিরাগুলো আস্তে আস্তে রক্তিম রঙ ধারণ করছে। গাম্ভীর্যের মাত্রা বেড়ে ভয়ানক রাগের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে। কপালের রগ ফুলে বেরিয়ে এসেছে। আকিব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“ভাবীকে এত কিছু বললো ওই জানোয়ারটা। আপনার বাবাকেও বলেছে। ওকে কি এভাবেই ছেড়ে দিবেন ভাই?”

আদ্র উত্তর দিলো না। দৃষ্টিও সরালো না শুণ্য মাঠ হতে। আকিব আবারও কিছু বলবে তার পূর্বেই ফোন বেজে উঠলো তার। স্ক্রীনে ‘VABI’ নামটা ভাসছে। আকিব দেড়ি করলো না। ফোন এগিয়ে ছটপট বললো, “ভাবী ফোন দিয়েছে ভাই।”

আদ্র তাকালো ফোনটির দিকে। নিলো। রিসিভ করে কানে রাখতেই ওপাশ থেকে অস্থির বেলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
—“হ্যালো, আকিব ভাইয়া? কোথায় আপনারা? উনাকে ফোন দিচ্ছি আমি। ধরছেন না। উনি কি ঠিক আছেন? উনাকে একটু দিন না। আমি কথা বলবো।”

আদ্র শুনলো শুধু। প্রতিউত্তর করলো না। ওপাশে থাকা বেলা জবাব না পেয়ে আরও অস্থির হয়ে উঠলো। অজানা ভয়ে বুক কাঁপলো। জোড় গলায় আবারও বললো সে,
—“হ্যালো? কথা বলছেন না কেন? উনি কি আপনার পাশে আছেন? ঠিক আছেন তো? হ্যালো?”

চোখ ভিঁজে এলো। কণ্ঠে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়ে ভেঙ্গে আসলো যেন। কান্নারত হয়ে উঠলো। এ পর্যায়ে গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো আদ্র,
—“আমি ঠিক আছি বেলা। কাঁদবে না। একটুখানি অপেক্ষা করো। আসছি।”

বেলার কান্না থামলো না। দীর্ঘ অভিমানে ডুকরে উঠলো। তপ্তশ্বাস ফেলে আদ্র ঢিমে যাওয়া কণ্ঠকে শক্ত করে বললো, “কাঁদতে মানা করেছি বেলা। আমার ভালো লাগছে না তো।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা