প্রেমজাল পর্ব-২৯+৩০

0
1022

#প্রেমজাল
পর্ব ২৯
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

কাধে কারোর আলতো স্পর্শ অনুভব করতেই স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। রুহি নামের মেয়েটার আইডি কার্ডে নিশ্চলভাবে আমার হাতে ও চোখে নিবদ্ধ। আমি দৃষ্টিপাত ছিন্ন করে স্পর্শকৃত মানবের পানে নজর স্থির করলাম। কাঙ্খিত মানুষ্টির মুখশ্রীতে গাম্ভীর্যের আভা।

-‘ চলো। বাড়ি ফিরতে হবে’

আয়ানের থমথমে স্বর আমার শ্রুতিগম্য হতেই তিনি প্রস্থান করলেন। আমি নীরবে এক ফালি দীর্ঘশ্বাস নিশ্বাস অপসারণ করে আইডি কার্ডটা সন্তপর্ণে বেড সাইড টেবিলে রাখলাম। হাসপাতালের বেডে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা শ্যামলা বর্ণ অধিকারিণীর মলিন মুখমন্ডলের অভিমুখে দৃষ্টিগোচর করেই সঙ্গে সঙ্গে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম। অদুরে সটান দাঁড়িয়ে আয়ান নার্সের সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত। আমি সামনে গিয়ে যেতেই সে স্তব্ধ হলো। উনি ইশারা দিতেই নার্সটা যাওয়ার জন্য উদ্যাগী হলো যা আমার দৃষ্টি এড়ালো না। আমি আনমনেই নার্সিটা যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। আকস্মিক ভাবে হাতে কারোর শীতল স্পর্শের সাথে কিঞ্চিৎ টান অনুভব হতেই আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো। উনি আমার হাত উনার হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে অগ্রসর হলো তার নিজের গন্তব্যে।

——————————-

মধ্যরাতে চতুর্দিকে লক্ষ্য বিরাজমান রেখে পা আলতো টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে সোনালী কেশবতী রমনী। বারংবার সে সতর্কতা পালন করছে কেও পারিপাশ্বিকে আছে কি না। সে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয় তার কাঙ্খিত পথে। পুনরায় ডানে বামে মাথা এলিয়ে দেখে নেয় কেও আদৌ আছে কি না। কারোর উপস্থিতির টের না পেয়ে গভীর ভাবে বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করে স্বস্তি পায় সে। তার কম্পিত হাতে দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই সিগারেটের ধোওয়া আচ্ছন্ন বদ্ধ ঘর তাকে গ্রাস করে। আচমকা এমন বেঘুটে গন্ধের ফলশ্রুতি সে কাশতে থাকে নিরন্তর। তার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা!!

মুখে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে ঘরের বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে সুঠাম দেহী এক যুবক। চোখ-মুখে তার লাল আভা। চুলগুলো উশকো খুশকো হয়ে এলোমেলো হয়ে আছে। যুবক তার সন্নিকটে সোনালী কেশবতীকে দেখে মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে তুলে। মেয়েটি মুখে হাত চেপে কাশতে কাশতে বলে উঠলো,

-‘ ঘরের এই অবস্থা কেনো? আর তোমাকে না আমি বলেছি এসব সিগারেট না খেতে। একদিন তো এসব খেয়েই মরে যাবে’

মেয়েটির প্রতিত্তোরে যুবকটি সিগারেটটা মুখ থেকে সরিয়ে ঘর কাপিয়ে হুংকার দিয়ে হেসে উঠে। মেয়েটা হতভম্ব!! ইতিমধ্যে মেয়েটির ভ্রু যুগল হালকা কুচকে গেসে।

যুবকটি সিগারেটটা এ্যাশ ট্রেতে রাখতে রাখতে তাচ্ছিল্য হাসি টেনে বলে উঠলো,

-‘ বেচে থেকেই কিবা হচ্ছে রিয়া বেবি? এমন বাচার থেকে মরে যাওয়াও ভালো। এতোকিছু থেকেও আমি যে আজ নিঃস্ব। কেনো বলতে পারো?’

শেষের উক্তিটি মুখ শক্ত-পোক্ত করে বললো সুঠাম দেহী যুবক। তার মুখশ্রীর ললাটের রগগুলো কিঞ্চিৎ ফুলে ওঠেছে। মুখে তার হিংস্রতার আভাস।

রিয়া মলিন মুখে আহত গলায় বলে উঠলো,

-‘ তুমি প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছো, তুমি বুঝছো না? কেনো এতো অবুঝ হয়ে পরছো? লোভ-লালসায় প্রতিশোধের খোরাক তোমাকে যে স্তরে নিয়ে যাচ্ছে তাতে শুধু ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নেই যে’

রিয়ার বার্তা সম্পন্ন হতেই যুবকটির সংস্পর্শে থাকা সিগারেটের এ্যাশ ট্রে স্বজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। সাথে সাথে সারা ঘর বিকট শব্দে তরাঙ্গিত হয়। রিয়া এমন কান্ড প্রত্যাশিত না করায় ভয়ে কেপে ওঠে। যুবকটি বড় বড় পা ফেলে কয়েক কদমে রিয়ার বাহু খামচে শক্তভাবে চেপে ধরে কর্কশ কণ্ঠে বলতে শুরু করলো,

-‘ এতো চেটাং চেটাং কথা কীসের? হ্যাঁ? একটাই তো কাজ দিয়েছিলাম!! তাও তো করতে পারলা না। বলেছিলাম আয়ানকে আয়ত্তে আনতে, আর তুমি কি করলে? কিন্তু তা তো পারলেই না বরং অই আহানার দিকে আরো পাঠিয়ে দিচ্ছো। আমাদের কি আদৌ এই পরিকল্পনা ছিলো? সব হিতে বিপরীত হচ্ছে। যা মোটেও কাম্য নয়। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড রিয়া? না হলে এর পরিণতি কি হবে তা আমি আগেই জানিয়েছি তোমাকে’

রিয়ার ব্যথায় চক্ষু কোটর অঢেল পানি টলমল করতে লাগলো। সে তার অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে,

-‘ নিজের সংসার বাচাতে আরেকজনের হতে বলছো? কেনো বাধ্য করছো আয়ানকে বিয়ে করতে? আমার ভালোবাসার প্রতিদান এভাবে কেনো চাইছো?’

রিয়ার কথা শোনামাত্র যুবকটি তার হাত আলগা করে ফেলে। সে স্থানেই সটান দাড়িয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় রিয়ার থেকে। যুবকটির কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে রিয়া স্মিত হেসে মোলায়েম স্বরে খোচা খোচা দাড়িতে আবৃত ডান গালে আলতো করে স্পর্শ করে বলে উঠলো,

-‘ আমাদের এতোদিন পর আজ দেখা হলো তাও কেনো একবারো জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি? শুধু তুমি পরে আছো সেই আয়ান আহানাকেই নিয়ে। দেখেও না দেখার ভান করো কেনো আমাকে? আমাকে কি একটু মনে পরে নি তোমার? একটুও কি আদর করতে মন চায় না? জানো আমার না তোমার আদর খেতে খুব ইচ্ছা করে। একটু আদর করবা আমাকে? জাস্ট একটু করলেই হবে। প্লিজ!! না করো না। আমি তোমার অস্বস্তিত্ব অনুভব করতে চাই। তোমার বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে এইটুকু হক তো আমার আছেই, তাই না? বলো না করবা’

রিয়ার সম্মুখে থাকা যুবকটি প্রতিত্তোরে মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসে। সে তার হাত দিয়ে রিয়ার কোমর আকড়ে সামনে টেনে নেয়। যুবকটি রিয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। রিয়ার শিড়দাড়া বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায়। রিয়া খামচে চেপে ধরে অগত্য যুবকটির শার্টের কলার। ক্ষণিক পর যুবকটি স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ায়। দেখতে পায় রিয়া চোখ বুজে আছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রগাঢ়। গভীরভাবে ভালোবাসার পরশ একে দেয় রিয়ার কপালে। আর সময় বিলম্ব না করে যুবকটি বাঁকা হাসি দিয়ে কোলে তুলে নেয় রিয়াকে। সন্তর্পণে শুয়ে দেয় বিছানায়। লাইট বন্ধ করে ডুবে যায় এক ভালোবাসার সাগরে। ভাসতে থাকে ভালোবাসার ভেলায়। একে অপরকে কাছে টেনে নেয় ভালোবাসার ছোয়ায়।

_________________________________

একের পর একের পর ওয়াইনের বোতল ভাংছে মিসটার আহনাফ। রাগে তার সারা শরীর চেপে বসেছে। সব মদের বোতল ভেঙ্গেই সে ক্ষ্যান্ত হয়। সারা ঘর জুড়ে খন্ড বিখন্ড হয়ে পরে আছে চুরমা হয়ে যাওয়া ওয়াইনের বোতলের অংশ। সাথে পরে আছে মোচড়ানো লিগ্যাল নোটিশ। যেখানে স্পষ্ট লিখা আছে যদি ৩ দিনের মধ্যে ব্যাংক থেক কোম্পানির টেন্ডারের নামে ধারকৃত টাকা ফেরত না দিলে পথের ভিকারি হয়ে যাবে সে। ব্যাংক কর্তৃকপক্ষ তার বাড়ি গাড়ি অফিস সব সিইজড করে ফেলবে। এককথায় কেড়ে নিবে সবকিছু। তার সাম্রাজ্য মূহুর্তের মধ্যে ধ্বংসলীলায় পরিণত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। মিস্টার আহনাফ মাথায় হাত রেখে ধপ করে বসে পরে মাটিতে। মিস্টার আহনাফের সব কর্মকান্ড অদূরে দাঁড়িয়ে সব দৃষ্টিপাত করছে মিসেস আহনাফ। মুখে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। মিসেস আহনাফের টাকা শুধানোর জন্য কোনো ভ্রুক্ষেপ বিরাজমান নেই তার মাঝে। কারণ মিস্টার আহনাফ তার কৃতকর্মের ফল পাবে কোনো না কোনোভাবে। পর মুহুর্তে হতাশা আর বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তার অন্তর। মিস্টার আহনাফের ধ্বংসের এরূপ পরিণতি যে খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলতে চলেছে অনেকের জীবনে। ভাবতেই তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কণা জমা হয়। এতো বছরের আগের সত্য কি তাহলে পাহাড় সমান মিথ্যার চাপার আচ্ছাদন থেকে বেরিয়ে আসবে? বেরিয়ে আসবে সকল সম্পর্ক? সবার কুকর্ম? জেনে যাবে সবাই আসল সত্য? এর পরিণাম কি আদৌ সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে? কিছু জিনিস যে জোড়া লাগাতে গিয়ে ভেঙ্গে যাবে অনেক কিছু। যা মোটেও শোভনীয় নয়!!

#চলবে……

#প্রেমজাল
পর্ব ৩০ [ ধামাকা পর্ব ]
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

ধরণীর বুক জুড়ে আধার নেমে সন্ধ্যা থেকে রাত হতে চললো। সারা বাড়ি খাবারে গন্ধে মৌ মৌ করছে। চর্তুদিকে যে যার হৈ চৈ করতে ব্যস্ত। অতিথিদের ফিরত যাওয়ার সমাগম আরম্ভ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সুপ্পুর এনগেজমেন্টের বেশি অর্ধেক মেহমান চলে গেছে। আর বাকিরা খেতে মশগুল। সারাদিনের ক্লান্তি যেনো আমাকে গ্রাস করছে। স্টেজে আমার পাশে বসেই সুপ্পু লাজুক লাজুক চাহনি নিয়ে হাতের আংটি দেখছে। আরেক পাশে অদূরে রিমিসহ কয়েকজন সেলফি তুলছে। আমি এবার আমার ফোনটা নিয়ে গেম খেলায় মনোনিবেশ করলাম।

-‘ আরে বেয়ান শালিকা, সারাজীবন কি বোনের সাথেই চিপকে থাকবেন নাকি? অন্যদেরও সময় দেন’

ক্ষণিক পরেই রসিকতার কন্ঠ স্বর আমার কর্ণপাত হতেই ফোন থেকে মুখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রিয়ান স্যার আর নিলয় ভাইয়া দাঁড়িয়ে। রিয়ান স্যার সামনের হলদেটে দাত কেলিয়ে হাসছে। এই রিয়ান নামক লোকটাকে দেখলেই মেজাজ বেঘুটে হয়। তার পাশে নিলয় ভাইয়া জোরপূর্বক হাসি টেনে তার মধ্যে থাকা একটু-আধটু সংকোচ বোধ নিরাময় করতে চাইছে।

আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে না পারলেও পরে ভাবাদয় হলো। নিলয় ভাইয়া হয়তো একটু একান্ত সময় সুপ্পুর সাথে অতিবাহিত করতে চাইছে। আমার ছোট্ট প্যাচহীন মাথায় উদ্দীপনা দিলো আমি যেনো একটু ফরমালিটি দেখিয়ে দূরে সরে যাই যাতে তারা নিজেদের মতো কথা বলতে পারে। তবে কিছু বলার আগেই আকস্মিক ভাবে আয়ান রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,

-‘ সুহা সব পিচ্চি আন্ডাবাচ্চা নিয়ে ঘরে যা’

এরূপ কথায় সুপ্পু নড়ে চড়ে সটান হয়ে বসলো। আর আমি অপলকভাবে তাকিয়ে রইলাম আমার উনির দিকে। উনার সুদর্শন দেহের গড়নে গাঢ় নীলের মধ্যে কালো সুতার ডিজাইনের পাঞ্জাবী বেশ মানিয়েছে। সাথে পরেছে সাদা পায়জামা। বুকে মাঝে দুই হাত গুটিয়ে রাখায় উনার হাত ঘড়ির কিঞ্চিৎ অংশ দেখা যাচ্ছে। তার চুলগুলো সন্তর্পণে কপালে পরে আছে। কপাল বেয়ে ঘাম কণা গুলো চিকচিক করছে যে লাইটিং কারণে বেগ পেতে হলো না আমার। বেচারা হয়তো অনেক খাটছে। গতকাল বাসার ফেরার পর থেকে ২৪ ঘন্টা হয়ে গেছে, কথা বলা তো দূরের কথা উনার মুখ দর্শন আমার হয় নি। আচ্ছা উনি কি আমার অপর রেগে আছেন? তাও বোঝার কোনো জোয়ার নেই। তার চোখ মুখে শান্ত চাহনিতেই ফুটে আছে চরম বিরক্তি। রিয়ান স্যার আয়ানের প্রতিত্তোরে বললো,

-‘ আরে সমোন্ধি সাহেব যে! বলছিলাম কি…’

আয়ান রিয়ান স্যারকে কথা শেষ না করতে দিয়েই নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-‘ কাল বাদে পরশু বিয়ে। তখনি না হয় মন খুলে যত ইচ্ছা কথা বলো। এখন না হয় রেস্ট নিক’

রিয়ান স্যার চোখ মুখ কুচকে নিলো। আয়ানের কথা নিলয় ভাইয়া মাথা অপর নিচ হেলিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে সম্মতি জানালো।

সুপ্পু মলিন মুখ নিয়ে রিমি আর বাকিদের ডাকাডাকি করতে লাগলো ঘরে যাওয়ার জন্য। অর্থাৎ আমার লাটসাহেব বরে হুকুমে এখনি এই মূহুর্তে প্রস্থান করতে হবে। আয়ান আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই আমি ফটাফট যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। যাওয়ার সময় নিলয় ভাইয়া সুপ্পুকে ইশারায় ফোন করতে বললো সাথে ফ্লায়িং কিসও করলো যা আমার মতো পিচ্চি মেয়ের চোখ এড়িয়ে গেলো না। আমি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বাগান থেকে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। বাগান আর বাড়ির মাঝ প্রান্তে বড় করে কালো বোর্ডে সোনালী অক্ষরে “Suhana & Niloy Engagement” লেখা। চারপাশে হরেক রঙের মরিচাবাতি জ্বল জ্বল করছে। আজ আমাদের বিয়ের স্বাভাবিক ভাবে হলে হয়তো এভাবেই অনেক অনুষ্ঠান আয়োজন হতো। আমি তপ্ত শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলাম বাড়ির দিকে।

———————-

হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে চারজনকে দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন ছেলে আরেকজন মেয়ে। মেয়েটা কান্না করতে করতে ভয়ের চোটে গরগরে তার অপরাধের স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। সামনের চেয়ারে বসে টেবিলে রিভয়েলবার রেখে হাত দিয়ে তা ঘুরাচ্ছে সিক্রেট পুলিশ এজেন্ট মাহিন। সাথে বসে আছে তার সহধর্মিণী তিথিয়া তিথি। দু’ জনের মুখেই হাসির ঝলক। অপরাধীর তার স্বীকারোক্তি শেষ করতেই তিথি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলো,

-‘ ছিঃ মিস মাধুরী! আপনার লজ্জা করে না? একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়ের মান-সম্মান নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন? আহানা তো আপনার সহপাঠী ছিলো তাই না? কিভাবে পারলেন তিন তিনটা মানুষরূপী জানো’য়া’র মাঝে নিষ্ঠুরতার সাথে ছেড়ে দিতে? আমার তো ভাবতেও বিবেকে বাধে। শেম অফ ইউ (Shame of you)…….|একটু থেমে| যতই আপনি টাকার লোভে প্ররোচিত হোন না, কীভাবে পারেন এসব? কীভাবে পারেন ফুলের মতো দেখতে নিষ্পাপ ছেলে মেয়েদের ড্রাগ’স এর মতো ক্ষতিকারক জিনিসের অপর ঠেলে দিতে? আপনাকে আর কি বা বলবো ? আপনি নিজেও শিক্ষিত হয়ে এডিক্টেট। নিজে তো জীবন শেষ করছেন সাথে অন্যদেরও করেছেন বা করছেন। শুনেন, ছাত্র ছাত্রীরা দেশের রক্ষক, ভ’ক্ষক নয়। আপনার মতো কিছু মানুষের জন্য নতুন প্রজন্ম ধ্বং’সের পথে। জাতির কর্ণধাররা এখন হুমকির মুখে। আপনার কৃতকর্মের শাস্তি আপনি পাবেন এই এট এনি কস্ট। দেখলেন তো এতো পালিয়েও রেহাই পেলেন না। কথায় আছে না, রাখে আল্লাহ মারে কে? হাজতের ভাত আপনার কপালে ঠিকই আছে যতই উড়ি উড়ি করেন না কেনো। নাহলে ইনিয়ে বিনিয়ে আইনের আওতায় এসেই পরতেন নাকি। শুধু আপনি কেনো আপনার উপর যে নাটগুরু আছে, যে সব কিছুর কলকাঠি নাড়ছে সেও পাবে না। তার পরিণতি হবে আরো ভয়ানক। কারোর প্রাণভমড়ার উপর হাত দেওয়ার প্র‍য়াস করেছে সে। শুধু একবার নয় দুই বার ইজ্জত হরণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে সে’

মাধুরী বাকা হাসি দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো,

-‘ আমি না হয় ধরা খেলাম। কিন্তু সে খাবে না। চার্জশিট রেডি করার আগেই দেখবেন টুপ করে হাওয়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল টেকনোলজি এতোটাও বিস্তৃত না যে সেকেন্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে সব আটকে দিবে’

মাধুরীর কথায় মাহিন ও তিথি দুজনেই হো হো করে ঘর কাপিয়ে হেসে উঠলো। মাধুরী খানিকটা ভড়কে গেলো। সম্প্রতি তার ভ্রু যুগল সংকুচিত হয়েছে।

মাহিন রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,

-‘ টেকনোলজি কতোটা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানা নেই। তবে সরকার আমাদের ঘাস কাটার জন্য রাখে নি। আমাদের তৈরি করা জাল কতটা বিস্তৃত আমরা তা জানি। এই যে আমার স্ত্রীকে তিথিকেই দেখুন প্রতিদিন দু’বেলা গরুর ঘুটে দেয় বাড়িতে। কিন্তু সে আন্ডারকোপ এজেন্ট!! আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আপনার সঙ্গীকে আপনার সামনে দেখতে পারবেন মিস মাধুরী’

মাধুরী বেশ বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে।

একজন গার্ড কাচুমাচু করতে করতে সিক্রেট পুলিশ এজেন্ট মাহিন ও তিথির সামনে এসে দাঁড়ায়। মাহিন গার্ডের দিক প্রশ্নাসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই গার্ডটা ভয়াত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-‘ স্যার!! আমাদের নতুন এস. সি. আই. রুহি কুরিয়ার গতকাল কুরিয়ার রিসিভ করলেও কোনো হুদিস পাওয়া যাচ্ছে না সাথে তার ফোনও সংযোগ ছিন্ন বলছে’

মাধুরী নাক ছিটকিয়ে হাসতে লাগলো।

মিস্টার ও মিসেস মাহিন কে হতাশা গ্রাস করলো। তাহলে কি সত্যের আলো পেয়ে আলোকিত হয়ে প্রকাশ পাবে না?

—————–

শাড়ির আচল খুলে গা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। প্রচুর গরম লাগছে। সাথে চরম রকমের অস্বস্তি। সাওয়ার নিতে পারলে আরাম দায়ক হতো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সম্ভব হয়। সুপ্পু ওয়াসরুমে ফ্রেশ হচ্ছে।

আচমকা ঘরের দরজার খুলার “খট” করে শব্দ হতেই তাড়াতাড়ি উঠে আচল টেনে গায়ে সহ মাথায় জরিয়ে নেই। রিয়ান স্যার তার সামনের হলদেটে দাত কেলিয়ে হাসছে। আমি হতভম্ব!! এই লোক এখানে এই সময় করে। ভয় যেনো আমাকে চেপে বসে। আনমনেই শুকনো একটা ঢোক গিললাম। আমি শাড়ি আকড়ে ধরে কাপা কাপা কণ্ঠে বলে উঠলাম,

-‘ আ..আরে.. রিয়ান স্যা..স্যার আপনি!! হঠাৎ এই সময় কেনো? কি..কিছু লাগবে? বাইরে চলুন আমি কাওকে ডেকে দিচ্ছি’

রিয়ান স্যার আরো চওড়া হাসি দিয়ে বললো,

-‘ আরে আহানা, তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি? বাহ রে ভয় পেতে হয় নাকি? আমার তো তোমাকে দরকার। অন্য কাওকে দিয়ে কি করবো ফুল্টুসি?’ বলে সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো।

আমি নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে উঠলাম,

-‘ মা..মানে ক..কিইইই?’

-‘ মানে কি বুঝো না সোনা? মানে আমি তোমাকে দেখতে এলাম। অনেক কথা বলবো। আজ রাতে একসাথে সব সুখ দুঃখ ভাগ করে নিবো কেমন’

-‘ আপনি যান তো এখন এখান থেকে’ বলে বিছানার সাথে লেপ্টে দাড়ালাম। আমার পিছনে অবশিষ্ট কোনো জায়গা নেই। রীতিমতো ভয়ে হাত পা কাপছে আমার।

-‘ আরে বেয়ান শালিকা কাছে আসো। নাহলে আদর করবো কিভাবে? একটু কাছে আসো না। তোমাকে আদর করার যে বড্ড শখ জাগছে আমার। আজকে রূপার মতো নীল রঙের শাড়িতে বেশ রূপ্সী লাগছে। তোমাকে দেখে এমনিই আমার যৌব’নের জ্বা’লা উঠে। আজ তোমাকে নিজের না করতে পারলে তো রাতের ঘুম হারাম ফুলটুসি’ বলে রিয়ান স্যার আরো এগোতে লাগে।

আমি চিৎকার করতে চেয়েও যেনো পারছি না। গলার মধ্যিখানে সব কণ্ঠ যেনো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আমার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা!! আল্লাহ কাছে দোয়া করতে লাগলাম যাতে এই অমানুষটা থেকে রেহাই পাই।

রিয়ান স্যার এগোতে এগোতে আমার ছুই ছুই। সে পৈশাচিক হাসি দিয়ে আমার আচল টান দিতেই আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেই। তিনি কিছু পিছিয়ে যাই। আমার বুক ধরফর করতে লাগে। এদিক অদিক তাকিয়ে রক্ষা পাওয়ার পথ খুজতে লাগলাম।

রিয়ান স্যারের চোখ মুখ নিমিষেই লাল বর্ণ ধারণ করে। চরম রকমের ক্রোধিত হয় সে। বড় বড় পা ফেলে তেড়ে এসে আমার বাহু খামচে ধরে ককর্শ গলায় বলে,

-‘ তোর এতো দেমাগ। তুই আমাকে? এই রিয়ানকে প্রত্যাহার করিস?’

ইতিমধ্যে আমি কেদে দিয়েছি। আমি চিৎকার করতেও চেয়েও আমার সামর্থ্য এ কুলালো না। তার আগেই এই মানুষ রূপী শয়’তান আমার মুখ তার অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরলো। আমি গ’লা কা’টা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলাম।

রিয়ান স্যার আমার দিকে লোভাতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আপ্রাণ ছাড়ানোর জন্য করতে লাগলাম। কিন্তু প্রতিবারই বৃথা হচ্ছি।

-‘ আহানননায়ায়ায়ায়ায়া’

বলে বেশ জোরালো চির পরিচিত সুপ্পুর আওয়াজ শুনতেই রিয়ান স্যার বিষম খেলো। সে সুপ্পুকে এভাবে প্রত্যাশা করেনি। তার ভাবার্থ এমনি প্রকাশ পাচ্ছে।

রিয়ান স্যার আমাকে ছাড়তেই আমি এক প্রকার দৌড়ে এসে সুপ্পুকে জরিয়ে ধরলাম। সুপ্পুকে দেখে যেনো আমার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। কান্না করতে করতে ইতিমধ্যে আমার হিচকি উঠে গেছে। নিশ্বাস হয়ে আসছে প্রগাঢ়।

রিয়ান স্যার আমতা আমতা করতে বলে উঠলো,

-‘ সুহানা তুমি যা মনে করছে তেমন কিছু কিন্তু নয়’

বলতে দূরে সরে আসলো।

সুপ্পু আমাকে শান্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেছে। রিয়ান স্যারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই। সুপ্পু আলতো ভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অতিরিক্ত ভয়ের মাঝে কান্না করায় নিশ্বাস জোরে জোরে ওঠা নামা করছে। সুপ্পু আমাকে নিয়ে বিছানায় বসায়। আমি বেশ শক্তভাবে সুপ্পুকে জরিয়ে ধরে আছি। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলে হয়তোবা “রিয়ান” নামক লোকটা আমাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাবে। তার মাঝেই ফাক ফোকড় দেখে রিয়ান স্যার কেটে পরতে নেয়। আমি হাতে ইশারায় করে বলতে নিই। কিন্তু ব্যর্থ হই। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকি। সুপ্পু উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকে,

-‘ কিচ্ছু হয়নি তোর বোনু। শান্ত হো। আমি ঠিক সময় এসে গিয়েছি তো’

ইতিমধ্যে দরজা ঠেলে আয়ানসহ অনেকেই হুড়মুড়িয়ে আসে। আয়ানকে দেখে কান্না আরো চেপে বসলো। যতটুকু থেমে ছিলাম তার থেকেও আরো বেড়ে গেলো।

আয়ান তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয়। তার কপালের রগ গুলো ফুলে গেছে। চোখ মুখ চোয়াল শক্ত করে নেয়।

সুপ্পু জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ আয়ান ভাই!! এই শয়’তান টাকে ছেড়ো না। ও আহানার সাথে…’

পুরোটা সম্পূর্ণ করার আগেই স্বজোরে রিয়ানের বুক বরাবর লাথি মারে। পরিপ্রেক্ষিতে সাথে সাথে দূরে ছিটকে পরে। আয়ান তেড়ে গিয়ে দুই হাতে রিয়ানের কলার ধরে টেনে তুলে চিৎকার করে বলে,

-‘ তোর সাহস কি করে হয়? আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমারই বউ…..

#চলবে..