প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-১৩

0
716

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|তেরো তম পর্ব |

আমাদের দেশে শহুরে বাসকৃত কর্মরত বাসিন্দারা একমাত্র বলতে পারবেন দৈনন্দিন ব্যস্ত শহুরের যানজটের কথা। ঘন্টার পর ঘন্টা গরমে বসে থাকতে হয় কখনো। এ যেন নিত্যদিনের রুটিন। ভ্যাপসা গরমে একেক জনের জান যায় যায় অবস্থা।

রুপ, রাইসা যাচ্ছে শপিং মলে; সাথে যাচ্ছে প্রেম নীড়ের সকল মানুষজন। ছোট্ট প্রাইভেট কারে মানুষজনের সংখ্যা বেশি। প্রাইভেট কারের সামনের সিটে নাবিল এবং আজাদ সাহেব বসে আছেন। আর পিছনের সিটে চার রমণী অর্থাৎ রুপ,রাইসা, ফাহিমা,আয়েশা আজাদ। চারজন মহিলা একসাথে বসা মানে তো বুঝাই যাচ্ছে কি একটা অবস্থা! রাইসা তো এক প্রকার রুপের কোলে চড়ে বসে রয়েছে। রুপ অস্বস্তি অনুভব করছে সকলের সাথে শপিং মলে যেতে।
আজাদ সাহেব আজ সুস্থবোধ করছেন। সকাল সকাল স্ত্রী,ছেলেদের তাগিদ দেন শপিংয়ে যাবে বলে। রুপ, রাইসাকে বলতে ভুলেনি। কেননা আজাদ সাহেবের নিকট এখন রুপ,রাইসাও প্রেম নীড়ের সদস্যদের মধ্যে দুই জন মনে করেন। রুপ প্রথমে অমত করেছিলো কিন্তু আজাদ সাহেবের একটা’ই কথা,” শপিং মলে গেলে দুই মেয়ে সহ প্রেম নীড়ের সকলে যাবে।” অগত্যা রুপ রাজি হয়ে যায়। রাইসা তো শপিংয়ের কথা শুনে একদম রেডি হয়ে যায়।
সকলের আনন্দের মাঝে একজন নিরুদ্দেশ আর সে হলো নাদিফ। নাদিফ বাসায় থাকলে আর এত কষ্ট হতো না। গাড়িতে গাদাগাদি করে বসতে হতো না। নাদিফের সহিত একজন চলে যেতো।

রুপ ভাবছে নাদিফের কথা। রুপরা মূলত শপিং মলে যাচ্ছে নাদিফের জন্মদিন উপলক্ষে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। রুপ হাতের ছোট্ট ব্যাগে টাকা দেখে নেয়। রুপের কাছে বর্তমানে ছয় হাজার তিনশত টাকা আছে। সেখান থেকে অর্ধেক বাড়ি ভাড়া দিবে আর বাকিগুলো টাকা দিয়ে পুরো মাস চলবে। কিন্তু নাদিফের তো আগামীকাল জন্মদিন। বাড়ির মানুষের জন্মদিন আর কোন উপহার দিবে না এটা খারাপ দেখায়।
রুপের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ বাহিরের দিকে নজর যায়। নাদিফের মতো দেখতে একজন মোটরবাইক চড়ে রুপদের গাড়ির পাশাপাশি আগাচ্ছে। রূপ ভালো করে খেয়াল করে দেখলো মানুষটা সত্যিই নাদিফ। চোখে কালো সানগ্লাস পরে সম্মুখে তাকিয়ে প্রাইভেট কারের গতির সাথে তাল মিলিয়ে আগাচ্ছে। রুপের মনে হচ্ছে নাদিফ ইচ্ছে করেই এমন করছে রুপকে দেখার আশায়। রুপ নিজের ভাবনাতে লজ্জা পায়।

” কি ব্যাপার রুপ! তোমার গাল এমন লালচে হলো কেন? রোমান্টিক কিছু দেখেছো নাকি?”

রুপ ভাবছে! আদৌও কি রাইসা রুপের ছোট? এই মেয়েটা রুপকে সবসময় উল্টা পাল্টা কথা বলে লজ্জায় ফেলে।

” আজকাল তোমার মুখ একটু বেশিই চলে। মুখে লাগাম দাও, নয়তো খসে পড়বে।”

রাইসা হাসে রুপের কথা শুনে। এদিকে রুপ চোরা চোখে নাদিফকে দেখে যাচ্ছে। গরমে নাদিফের শরীরে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। রুপ শুকনো ঢোক গিলে। চোখ দ্বারা কোন পর পুরুষকে এভাবে ধ’র্ষ’ণ করায় আসতাগফিরুল্লাহ পড়ে।
এদিকে নাদিফ সানগ্লাসের আড়ালে রুপের অবস্থা দেখে বাঁকা হাসে। চোখ থেকে সানগ্লাস নাকের ডগায় এনে রুপের উদ্দেশ্যে বলে,

” চোখ দ্বারা’ই আমাকে শেষ করে দিলে! তোমার কি একটুও দয়া মায়া নেই! এখন কে আমাকে বিয়ে করবে? তোমার নজর পড়াতে যে আমি কালো হয়ে যাবো।”

রুপ সাথে সাথে গাড়ির জানালার কাঁচ আটকে দিলো। কি ভয়ানক কথা বার্তা। রুপ কেন নজর দিতে যাবে লোকটার উপর! লোকটা না চোখে কালা পট্টি বেঁধে রেখেছিলো? তাহলে রুপকে দেখলো কীভাবে?
রুপের ভাবনার মাঝেই শপিং মলে পৌঁছে যায় সবাই।

শপিং মলের সামনে মোটরবাইকে হেলান দিয়ে আপনমনে ফোনে কি যেন করছে নাদিফ। যেন সে অনেকক্ষণ হয় অপেক্ষা করছে পরিবারের জন্য।
আয়েশা আজাদ নাদিফকে দেখে অবাক। কেননা নাদিফ এই প্রথম মেয়েদের সহিত শপিং মলে এসেছে।

” কিরে নাদিফ! তুই এখানে কি করছিস?”

” তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরি করলে কেন?”

আজাদ সাহেবের মতো নাদিফকেও অভিনেতার খেতাব প্রদান করা যায়। রুপ একপ্রকার হা করে তাকিয়ে আছে নাদিফের পানে।

সকলে শপিং মলে প্রবেশ করেছে, রুপ ব্যতীত। যখন রুপ হা করে নাদিফের মিথ্যা কথা হজম করছিল তখন। এদিকে নাদিফ মুচকি হেসে রুপের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,

“মুখ বন্ধ করো অপরুপ! মশা-মাছি সহ তেলাপোকারা আশ্রয় নিতে পারবে তোমার মুখের গহ্বরে।”

তাৎক্ষণিক রুপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। রুপ কটমট চোখে নাদিফের পানে তাকায়। নাদিফ চোখ টিপে সানগ্লাস পরে চলে যায় শপিং মলে। যাওয়ার আগে অবশ্য রুপকে সাবধান করতে ভুলেনি,

” চলে এসো রূপসী, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ভাববে ফুলটুসী। পাবে না আমাকে যেখানে সেখানে, বাঁচতে পারবে কোন খানে।”

রুপ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। নাদিফের পিছু পিছু এক প্রকার দৌঁড়ে প্রবেশ করে শপিং মলে।
——–

আজাদ সাহেব খুব ভাবের সহিত শপিং মলে হাঁটা চলা করছেন। যেন তিনি একজন যুবক আর উনার আশেপাশে অনেক যুবতীরা ঘুরঘুর করছে। আজাদ সাহেব আজ পাওয়ার যুক্ত চশমার বদলে কালো কুচকুচে সানগ্লাস ব্যবহার করেছেন চোখে। যার দরুন চোখের সামনে সমাতল রাস্তা উঁচু-নীচু মনে হচ্ছে। আজাদ সাহেব তবুও অনড়। মানুষের সামনে দেখাতে হবে তো! যে আজাদ সাহেব এখনও শক্তিশালী যুবক।

মহিলারা দোকানে দোকানে ঘুরছে। নাদিফ বাবার মত লিফ্টের পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ফোনে কাজ করছে। দূর থেকে বাবাকে হেলেদুলে চলাচল দেখে মুচকি হাসে। নাদিফের বাবা যে এখন মেয়েদের ইম্প্রেস করার জন্য কানা মামা থেকে ভালা মামা সেজেছে তা নাদিফের জানা।
আজাদ সাহেব ছেলেকে এখানে দেখে মনে সাহস পায় । ধীরে পায়ে ছেলের দিকে এগিয়ে বলে,

” আজকাল জোয়ান ছেলেদের চোখে বেশি সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যেখানে তাকাই সেখানে’ই ছেলেরা এক কোখ বন্ধ রেখে এক চোখ খোলা রাখে। কারণটা কি?”

বাবার কথায় নাদিফের মুখের ভাবভঙ্গি কোন পরিবর্তন হলো না। ফোনের দিকে তাকিয়ে নাদিফ উওর দেয়,

” আজকাল বুড়োরা সাদা চশমা ছেড়ে কালা চশমা পরে ঘুরে বেড়ায়। সামনে দিয়ে কোন আন্টি খালাম্মারা হেঁটে গেলে গলা ছেড়েগান ধরে, ‘গোরে গোরে মুখরেপে কালা কালা চশমা।’

আজাদ সাহেব আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। এসেছিলো ছেলেকে শায়েস্তা করতে এখন ছেলেই আজাদ সাহেবকে শায়েস্তা করে দিলো। সকলের অগোচরে আজাদ সাহেব নাদিফকে চোখে চোখে রাখছিলো। বাহিরে রুপের সাথে করা সকল কিছু আজাদ সাহেব দেখে নেয় এবং বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে। কেননা আজাদ সাহেবের ধারণা, ছেলে বাবার মতো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
——-

আয়েশা আজাদ অনেক কিছু কিনেছেন সকলের জন্য। রুপ, রাইসার জন্যও কিনেছেন কিন্তু তা রুপ, রাইসার অগোচরে। এখন সবাই পুরো শপিং মল ঘুরে ঘুরে দেখছেন। রাইসা রুপকে বলে অনেক আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছে। আয়েশা আজাদ এবং ফাহিমা এটা সেটা বলে সামনে আগাচ্ছেন। পিছনে রুপ একা একা লাল নীল সাদা রং দিয়ে সাজানো দোকানপাট দেখে যাচ্ছে। আচমকা একটা বলিষ্ঠ হাত রুপের নরম তুলতুলে হাতকে টেনে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। রুপের এক হাত দিয়ে বলিষ্ঠ হাতের বন্ধন হতে মুখ হতে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এক ফোঁটাও ছুটতে পারেনি রুপ।

” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

” আমার প্রেমিকাকে দেখাতে।”

” আমি কাউকে দেখবো না।”

” আমাকে রাগিও না অপরুপ! অনেক ভালো মুডে আছি এখন।”

রুপ ভীত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। খুব করে দোয়া করছে যেন পরিচিত কাউকে দেখতে পায়। কিন্তু আফসোস শপিং মলের পিছনের অংশে পরিচিত-অপরিচিত কাউকে দেখতে পায়নি রুপ।
শপিং মলের এই অংশে একদম জনমানবশূন্য প্রায়। বারান্দার মত কিছু অংশে রেলিংয়ের ধারে রুপ এবং নাদিফ দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাস রুপের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। নাদিফ এক ধ্যানে চশমা ওয়ালা অপরুপাকে দেখে যাচ্ছে। পলক ফেলছে না নাদিফ। নাদিফের চাহনিতে রুপ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ হেলানো বাতাসে রুপের মাথার কাপড় পরে যায়। রুপ যেন এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। আলগোছে ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিতে বাঁধা প্রদান করে নাদিফ।

” ছেড়ে দাও না কেশবগুলো! মাতাল প্রেমিকের মতো মুগ্ধ নয়নে দেখবো তোমায়!”

রুপ স্তব্ধ হয়ে নাদিফের কথায়। রুপকে অবাক করে দিয়ে নাদিফ নিজেই রুপের মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। ললাটে গাঢ় করে অধর ছুঁয়ে বলে,

” ভালোবাসা বুঝি এমন! মনের কথা বলতে সময় নিবে আর কতক্ষণ। আমি তো পুষে রাখতে পারছি না অন্তরের জ্বালাতন। ভালোবাসি অপরুপ তোমাকে সর্বক্ষণ।”

রুপের গা কাঁপছে। মনে হচ্ছে ভীষণ অসুখ বেঁধেছে শরীরে। নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে যেন। রুপের চোখের সামনে সব ঘোলাটে লাগছে। রুপ যেই ভালোবাসার ভয়ে ছিলো সেটাই হলো। এমন জনমানবহীন স্থানে এসে এমন এলাহী কাণ্ড করবে জানলে রুপ অনেক আগেই চিৎকার করতো। রুপের এখন ইচ্ছে করছে বলতে,

” ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। রুপ পড়েছে নাদিফের কবলে!”

চলবে……