প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-১৫

0
730

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|পনেরো তম পর্ব |

আমরা বাঙালিরা বিশেষ করে নারীরা শাড়ি পরিধান করতে পছন্দ করি। বর্তমানে শাড়ি পরিধান করা যেন এক প্রকার ফ্যাশন। যেখানে পূর্বে নারীদের প্রধান পোষাক ছিলো শাড়ি। নিজ হাতে কারুকার্য খচিত শাড়ি পরিধান করতেন তাঁরা। উঠতি বয়সী থেকে শরু করে বয়স্কদের সকলের প্রধান পোষাক ছিলো শাড়ি। কিন্তু আজকাল যেন সেই সোনালী দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
রুপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। রুপ বর্তমানে আয়েশা আজাদের ঘরে অবস্থান করছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কাঁচের চুড়ি রাখা আছে। শাড়িটির রং সোনালী যার মধ্যে শামুকের আকৃতি কারুকাজ করা। হালকা গোলাপি রং আছে বলা যায়। রুপ ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চুড়িগুলো হাতে নিয়ে পরতে থাকে। চুড়ি পরতে পরতে এক সময় চোখ যায় ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের দিকে। লালচে রং ধারণ করা আঙ্গুলের দিকে নজর পড়তেই রুপ লজ্জায় নুয়ে যায়। ভাবতে থাকে সকালের নাদিফের করা কাণ্ডের কথা,

সকালে রুপ সকলের সামনে লজ্জায় রাঙা হয়ে রাজি হয় নাদিফকে খাইয়ে দিতে। রুপ লোকমা করে হাত উপরে তোলার আগেই নাদিফ নীচু হয়ে রুপের হাত থেকে খেয়ে নেয়। যেন নাদিফের তর সইছে না। মুখে খাবার রেখে চোখ বন্ধ করে খেয়ে বলে,

” অনেক মজার খাবার।” পরমুহূর্তে সকলের অগোচরে রুপের সামনে নিচু কন্ঠস্বরে বলে,
” ঠিক তোমার মতো।”
রুপ যেন এবার স্তব্ধ বনে গেল নাদিফের কথায়। নাদিফ যে এত ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের তা রুপ পূর্বে টের পায়নি। রুপ একপ্রকার অন্যমনস্ক হয়ে’ই নাদিফের মুখে আরেক লোকমা তুলে দেয় সাথে সাথে রুপ আর্তনাদ করে উঠে। কেননা দুষ্টু নাদিফ রুপের আঙ্গুল চিকেন মনে করে কামড়ে দিয়েছে। রুপ আড়চোখে খাবারের টেলিবের উপস্থিত সবার দিকে নজর ঘুরালো। অবাক করা বিষয় হচ্ছে সকলে যার যার কাজে ব্যস্ত। রুপ এবার সাহস করে নাদিফকে বলে,

” রাক্ষস একটা। কামড়ে খেলে ফেলবেন নাকি? আমি মানুষ; গরু, ছাগল না।”

” তুমি তো আমার অপরুপ, যার প্রমত্তে বুদ হয়ে যাচ্ছি বারংবার। কি করতে কি করে ফেলি নিজের’ই অজানা।”

রুপ যেন গলিত মোমের ন্যায় গলে যাচ্ছে নাদিফের এক একটা জাদুকরী কথায়। পুরো এক প্লেট ভাত শেষ করে তবেই রুপ ছাড়া পায় নাদিফের কবল থেকে। নাদিফ যাওয়ার আগে রুপকে বকশিস দিতে ভুলে নি। সকলের সামনে রুপের হাতে মোটা দুটো পাথরের বালা উপহার স্বরূপ প্রদান করে। এসব কিছু ক্যামেরাবন্দী করে রাখে রাইসা সেই শুরু থেকেই।

কারো আগমনের আভাস পেয়ে রুপের চেতনা ফিরে আসে। এক এক করে রেশমি চুড়ি পরে নেয় কোমল হাতে।

” আমার দেয়া চুড়ি দুটো পরবে না অপরুপ?”

হঠাৎ নাদিফের কন্ঠস্বরে চমকে উঠে রুপ। আয়নায় স্পষ্ট নাদিফের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। সোনালী পাঞ্জাবীতে রাজপুত্র লাগছে। রুপের রাজপুত্র। রুপ ভাবছে, রুপের রাজপুত্র নাম দেয়াটা এই রাগী লোকটার জন্য ভুল হয়নি। সত্যিই লোকটা রাজপুত্র। রুপ আয়নাতে দেখতে পাচ্ছে নাদিফ আস্তেধীরে এগিয়ে আসছে রুপের দিকে। রুপ এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে ভয় পেয়ে যায়। মনের ভেতর আলাদা নিষিদ্ধ অনুভূতি তৈরীর ব্যপারে খুব করে বকে দেয়। নাদিফ রুপের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। নাদিফের আগমনে রুপও বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। লতার ন্যায় লম্বা কেশবে আঙুল ছুঁয়ে দেয়। রুপ নাদিফের এহেন কাজে চোখ বন্ধ করে নেয়।
কিছুক্ষণ পর রুপ অনুভব করে লতানো কেশব কেউ খুব যত্ন করে গুছিয়ে দিচ্ছে। রুপ আস্তে করে চোখ খুলে নেয়। নাদিফ খুব যত্নে রুপের মাথার কেশব গুছিয়ে দিচ্ছে। নাদিফের মুখে উজ্জ্বল হাসি। নাদিফের হাসিতে রুপও হেসে ফেলে আনমনে।

” কি ম্যাডাম! সারাক্ষণ মাথায় উল্টা-পাল্টা ভাবনা ঘোরাফেরা করে হুম! আপনার এই প্রেমিক পুরুষ যেমন লাগামহীন তেমন যত্নবান। আপনাকে যেমন ভালোবাসবে, তেমন যত্নও করবে। এখন শুধু শুভ সময়ের অপেক্ষা। আপনি রাজি তো ডাকবো কাজি!”

রুপ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে নাদিফের কথা শুনে। রুপ ভেবেছিলো, রুপ শুধুমাত্র নাদিফের মোহ। হঠাৎ দেখায় ভালো লেগেছে, কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রুপের ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত হলো।

” আপনি ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। যার কোন অস্তিত্ব নেই, তার পিছনে সময় অপচয় করছেন। একজন এতিম মেয়ের জন্য ভালোবাসা জন্মানো সঠিক না। আমি শুধুমাত্র মোহ, কয়েকদিন পর আপনার মোহ কেঁটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

রুপ এই প্রথম নাদিফের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলল। দর্পণে নাদিফের রক্তিম চোখ জোড়া দেখে রুপ আবারও নিজের চোখ জোড়া নিচে নামিয়ে নেয়। পরমুহূর্তে অনুভব করে লতানো কেশবে বলিষ্ঠ হাতের টান। নাদিফ রুপের কেশব হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে যার ফলে ব্যাথায় কাতর হয়ে যাওয়া রুপ চোখ বন্ধ করে আল্লাহ বলে উঠে।

” ব্যাথা পাচ্ছি।”

” আমার অনুভূতিকে নিচু মনে করেছো, অপমান করেছো আমার প্রথম ভালোবাসার অনুভবকে। আজ থেকে তোমার কাছে আমি আর আসবো না। দূরে দূরে থাকবো। তবে মনে রেখো, ভালো কিন্তু তোমাকেই বাসবো।”

নাদিফ হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রুপ সেখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলো রুপের আঁখি অশ্রুতে ভর্তি। কাঁপা কাঁপা হাতে রুপ চোখের জল ছুঁয়ে দিলো। রুপ ভাবছে এটা কিসের অশ্রু! কিছুক্ষণ আগে নাদিফের দেয়া আঘাতের অশ্রু? নাকি নাদিফ মনে যে আঘাত পেয়েছে সে ব্যথার অশ্রু। রুপ বুঝতে পারছে না কি করবে নাদিফের ভালোবাসায় সায় দিবে! নাকি নিজের মনের কথা শুনবে।
রুপ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের মুহূর্ত মনে করতে চেষ্টা করলো। রুপ যেন এক নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে দিন দিন। নাদিফের দুষ্টু কথা, রাগী চাহনি, ভালোবাসাময় পাগলামি; সবকিছু যেন রূপকে নিষিদ্ধ অনুভূতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রুপ চোখের পানি মুছে নিলো। আজকের একটি শুভদিনে রুপ চাচ্ছে না রুপের জন্য নাদিফ কষ্ট পাক। টেবিলের উপরে রাখা পাথরের বালা দুটো হাতে পরে চলে গেল ঘরের বাহিরে।
————

আয়েশা আজাদ হাতে পাঞ্জাবি টুপি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সদর দরজার সামনে। রাগে গজগজ করছেন আপাতত। গতকাল রাতে পাঞ্জাবি খানা আয়রন করে রেখেছেন স্বামীর জন্য কিন্তু হলো কি! প্রিয় স্বামী আয়েশা আজাদকে হেনস্তা করার জন্য পাঞ্জাবি খানা কুঁচকে আলমারিতে রেখে দেন আয়েশা আজাদের অগোচরে। ঘরে রুপকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে চলে আসেন সেই পাঞ্জাবি হাতে স্বামীকে দু’চারটে কথা শুনানোর জন্য। কিন্তু আয়েশা আজাদের স্বামী নিরুদ্দেশ, কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। এতক্ষণ সদর দরজার কাছে চেয়ারে বসে কাজের তদারকি করছিলেন কিন্তু এখন কোথায় গেলো? আয়েশা আজাদের ছটফটের মাঝে ফয়সাল এবং ফাল্গুনী প্রবেশ করে প্রেম নীড়ে। ফাল্গুনীর মুখ হাসিখুশি কিন্তু ফয়সালের মুখ বেজার যেন কেউ ফয়সালের মুখে তিতা করল্লার রস জোড়পূর্বক ঢুকিয়ে দিয়েছে।

” এসো তোমরা। ভালো আছো তো! সেদিন ভালোভাবে কথা হয়নি তোমাদের সাথে।”

আয়েশা আজাদ হাসিমুখে ফাল্গুনী ফয়সালকে স্বাগতম জানাচ্ছে।

” এজন্যই তো ভাইয়া আজ আমাদের আসতে বললো আপনার সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য।”
ফাল্গুনীর হাসিমুখে জবাব। এদিকে ফয়সাল এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে মিনমিন কন্ঠস্বরে বলল,

” দেখা হয়ে গিয়েছে, কথাও হয়েছে, এবার চল ফাল্গুনী বাসায় যাই। যমের বাড়ি যে তিতার হাড়ি। একবার কবলে পড়তে পারলে রক্ষে নেই।”

ফাল্গুনীর এখন ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে হাসতে। নাদিফ ভাইয়া যে ফয়সালকে আচ্ছা সবক শিখিয়েছে সেটা দেখে।
” জন্মদিনের দাওয়াত খেতে এসেছি। কেক না খেয়ে যাচ্ছি না।”
ফয়সাল যেন পড়েছে মহা বিপদে। মনে মনে ফাল্গুনীকে শ’খানেক কঠিন গালি দিতে ইচ্ছে করছে।

” ফাল্গুন! বান্ধবী আমার। আমার হাত খরচের যত টাকা জমিয়েছি সব টাকা দিয়ে তোকে কেক খাওয়াবো, ঘুরতে নিয়ে যাবো, শপিং করিয়ে দিবো। আর কি করতে হবে বল সব করবো।”
ফাল্গুনী এই সুযোগ মিস করতে চাচ্ছে না। ফয়সালের উদ্দেশ্যে দুষ্টু হেসে বলে,

” এখনই প্রপোজ কর।”

ফয়সাল ফাল্গুনীকে সেখানে রেখে আয়েশা আজাদ সেই কখন চলে আসে বাগানে স্বামীকে খুঁজতে। এক সময় পেয়েও যায়। কিন্তু কাজের বাহানায় আবারও ছুটে যায় অন্য পাশে। আয়েশা আজাদের চোখ যায় প্রেম নীড়ের প্রধান ফটকে। যেখানে গাড়ি থেকে নামছে শেওড়া গাছির পেত্নি অর্থাৎ ফাহিমা। অতিরিক্ত মেক আপে অপ্সরীর উপরেরটা মনে হচ্ছে ফাহিমাকে। ফাহিমা এসেই শাশুড়ির হাত ধরে কান্না শুরু করে দেয়,

” মা তোমার কথা না শুনে আমার কি হলো গো! আমাকে ঐ মহিলারা পরী সাজাইতে গিয়া কিরিম আপা সাজাইয়া দিছে। আমার সুন্দর মাথার চুলকে বাউলের বাসা করে দিয়েছে।”

আয়েশা আজাদ পুত্রবধূকে বকবেন কীভাবে ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়েটাকে সত্যিই অদ্ভূত সাজিয়ে দিয়েছে মহিলারা। আয়েশা আজাদ ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করে ফাহিমাকে নিয়ে হাঁটা ধরলেন। উদ্দেশ্যে নিজের ঘর, সেখানে ঘষেমেজে ফাহিমাকে মানুষ বানাবেন।
———-

যথা সময়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। নাদিফ গম্ভীর মুখে বসে আছে সোফায়। পুরো প্রেম নীড়ে মানুষজন ভর্তি। রুপের দেখা পাওয়া মুশকিল। নাদিফ জানে রুপ আসবে নাদিফের মান ভাঙাতে কিন্তু নাদিফের মন গলবে না বলে পন করেছে। হলোও তাই! নাদিফের ধারণা সঠিক। হাতের চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজে রুপের আগমন ঘটে। নাদিফ অনুভব করছে রুপ নাদিফের আশেপাশে’ই। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, রুপ রাইসার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কিন্তু দৃষ্টি নাদিফের দিকেই। নিদিফ বাঁকা হাসলো। সোফা থেকে উঠে নাদিফের বন্ধু মহলের দিকে এগিয়ে গেলো।

জন্মদিনের রীতি অনুযায়ী কেক কাটার ব্যাবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু নাদিফ প্রতিবারের মতো কেক কাটবে না। কেকের উপর কিছু একটা লিখে দুজন লোক ডেকে পাঠিয়ে দেয় নিদ্দির্ষ্ট স্থানে।

বন্ধুমহলের কেন্দ্রবিন্দু নাদিফ। বর্তমানে আলোচনা হচ্ছে রুপ নামক অপরুপকে নিয়ে।

” তুই শিউর, তুই মেয়েটিকে ভালোবাসিস!”

” একশত পার্সেন্ট শিউর। তাহলে এত দুরত্ব কেন?”
” সে চায় না আমাকে।”

” তোর মাথা ঠিক আছে তো! তোর মতো ছেলেকে ঐ মেয়ে চায় না, অবিশ্বাস্যকর।”

আকাশ, নাদিফের মধ্যে কথা হচ্ছে। আকাশ বন্ধুর জন্য খুবই খুশি। কিন্তু পরমুহূর্তে আহত হলো রুপৃর অবস্থা শুনে। আকাশের কথায় নাদিফ বলে,

” সে সবার চেয়ে আলাদা, অপরুপ।”

আকাশ হাসে বন্ধুর কথা শুনে। প্রেমে পড়লে কি সত্যিই চোখে যা দেখে তাই ভালো লাগে! আকাশ ভাবছে।
আকাশ, নাদিফের কথোপকথনের মাঝে রুপ নাদিফের নিকটে আসে। চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলে,

” আমি’ই পরাজিত হয়েছি। চলে এসেছি স্ব-শরীরে আপনার কাছে।”

চলবে……………..