প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-১৬

0
749

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|ষোল তম পর্ব |

বাড়ন্ত বয়স বলে একটা সময় আছে বলা বাহুল্য। অনেক মানুষ আছে হাতে পায়ে বড়ো হলেও আক্কেল জ্ঞানের দিকে ছোট’ই থাকে সবসময়।
রাইসা আজ পরিধান করেছে, কালো রংয়ের শাড়ি। অবশ্যই আয়েশা আজাদ উপহার স্বরুপ প্রদান করেছেন। চলতি মাসে’ই রাইসা নতুন ফোন কিনেছে। স্মার্ট ফোন। যার দ্বারা’ই সকালে রুপ, নাদিফের খুনসুটি ক্যামেরাবন্দী করেছিল। রাইসা আপাতত ব্যস্ত নিজের ছবি তুলতে। মুখশ্রীতে বিভিন্ন ব্যঙ্গ করে ছবি তুলছে রাইসা। আকাশ দূর থেকে রাইসার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছিল এতক্ষণ। রাইসার ভাবভঙ্গি দেখে না হেসে পারছে না আকাশ। এগিয়ে আসে রাইসার দিকে। খুক খুক কেশে বলে,

” মুখ তো এবার বেঁকে যাবে সুন্দরী! সুন্দরীকে তো শাড়িতে আজ অনেক সুন্দর লাগছে। সুন্দরীর রুপের রহস্য কি?”

রাইসার একটা স্বভাব আছে কারো মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনলে একেবারে মাথায় চড়ে বসে। আকাশের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার পর রুপের মত লজ্জা না পেয়ে সরাসরি বলে,

” আমার রূপের রহস্য তিব্বত স্নো। আপনি লাগালে আপনিও সুন্দর হয়ে যাবেন আমার মতো। যাই হোক ধন্যবাদ প্রশংসা করার জন্য। ছবি তুলবেন আমার সাথে?

আকাশ রাইসার সরলতায় মুগ্ধ হয়। চলে আসে রাইসার সাথে ছবি তোলার অজুহাতে পরিচিত হতে।

——-

আকাশ বাদলা রুপ ধারণ করেছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। অদূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি ঝড়ছে।
সাথে রুপের আঁখি যুগল থেকেও অশ্রুকণা ঝড়ে যাচ্ছে অনবরত। প্রেম নীড়ের ছাদের চিলেকোঠা ঘরে রুপ বসে আছে। রুপ ভাবছে কিছুক্ষণ আগের কথা,
রুপ নাদিফের নিকট মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। রুপ যা বলতে এসেছিলো তা না বলে ভুলভাল বলে ফেলে নাদিফের সামনে। এদিকে নাদিফ মনে মনে মহা খুশি। নাদিফ ভাবছে রুপ হয়তো নাদিফের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে। নাদিফের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। নাদিফ শুধু পারছে না সকলের সামনে অপরুপকে বক্ষঃস্থলে আবদ্ধ করতে। কিন্তু পরমুহূর্তে নাদিফের সকল আনন্দ ধূলিসাৎ হয়ে যায় রুপের কথা শুনে,

” আজকের এই দিনে দয়া করে রেগে থাকবেন না। তবুও আবার আমার জন্য। আমি খুব সাধারন মানুষ কারোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। অন্ততপক্ষে আজকের দিনটা আপনি মন খারাপ করে থাকবেন না। আপনার বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে আজকে এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমি চাইনা আমার কারনে অনুষ্ঠানের কোনো কমতি হোক বা তারা কষ্ট পাক। দয়া করে আমার উপর রহম করুন। আমি আপনার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য না। গ্রহণ করতে পারছি না আপনার ভালোবাসা।”

রুপের কথার প্রত্যুওরে নাদিফ কিছু বলেনি। উল্টো রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর থেকেই রুপ এখানে এসে বসে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নেমে আসে পুরো পৃথিবীতে। রুপ চোখের পানি মুছে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। রুপের কাছে এখন নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে। নাদিফের চোখে আজ রুপ কিছুক্ষণের জন্য হলেও আনন্দ দেখেতে পেয়েছে। কিন্তু রুপের না বলায় মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছে, চলে গিয়েছে বাড়ি থেকে।

” ম্যাডাম ভিজে যাচ্ছেন তো? আপনাকে নিচে আন্টি ডাকছে।”

ফাল্গুনীর ডাকে রুপের স্তম্ভিত ফিরে। চোখের পানি মুছে রুপ ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসে।

” তুমি কি ফয়সালকে ভালোবাসো?”

ফাল্গুনী এই মুহূর্তে ভাবতে পারেনি নিজের শিক্ষকের মুখে এমন কথার। ফাল্গুনী এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে সময় নিয়ে উওর দেয়,

” তেমন কিছু না, বন্ধু মাত্র।”

ফাল্গুনের উত্তরের রূপ মুচকি হাসি থেকে নামতে নামতে উত্তর দেয়

“ভালোবাসা অনেকে পায় কিন্তু সে ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দিতে পারে না। আবার অনেকে ভালোবাসা পেয়েও সেই ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারে না। কখনও ভালোবাসাকে ঠুকনো মনে করবে না।”

ফাল্গুনী রূপের কথার মানে বুঝতে পেরেছে কিনা তা জানেনা রুপ। ফাল্গুনীকে নিয়ে চলে যায় অনুষ্ঠানে।
———

আয়েশা আজাদ খুবই বিরক্ত স্বামীর উপর। এত সুন্দরী স্ত্রীকে রেখে কোথায় যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। সদর দরজা দিয়ে নাদিফকে আসতে দেখে আয়েশা আজাদ ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলেন। ছেলের চোখ মুখের থমথমে অবস্থা দেকে আয়েশা আজাদের অন্তর কেঁপে উঠে। এগিয়ে গিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,

” কি হয়েছে আমার বাবার?”

মায়ের দিকে তাকিয়ে নাদিফ মলিন স্বরে বলে,

” ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন বলতে পারো মা?”

আয়েশা আজাদ কিছু বলবেন তাঁর আগেই নাদিফ অন্য প্রান্তে চলে গেলো। আয়েশা আজাদ গভীর ভাবনায় পড়ে গেলেন। ছেলেকে যে প্রেম নাশক অসুখে ধরেছে বুঝতে পারলেন।

” বুঝলে ললিতা! এই বয়সে তরুন ভাব জন্মাচ্ছে মনে। চারদিকে সব মৌমাছি যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তোমার তো আমার দিকে কোন নজর নেই।”

আয়েশা আজাদ ছেলের বিরহে কাতর। স্বামীর কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করলেন না। আজাদ সাহেব তৈরি হয়ে এসেছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের কয়েকটা বাণী শুনবেন কিন্তু স্ত্রীকে গভীর ভাবনায় বিভোর হতে দেখে বললেন,

” তুমি ঠিক আছো ললিতা?”

” আমার মনে হচ্ছে নাদিফকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুপের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা উচিত। ছেলে আমার কোন মেয়ের কাছ থেকে ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে আসছে।”
————-

রজনীর শেষ বেলায় দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় রুপের। এটা নতুন কিছু না, রুপের ঘুম রাইসার মতো এতটা গভীর না। আবছা আলোতেই রাইসার ব্যাঙের ন্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা রুপের চোখে এড়ালো না। অন্ধকারে হাতিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো রুপ। রাইসার নতুন ফোন নিয়ে পর পর কয়েকটা ছবি তুলে রাখলো রুপ। সকালে রাইসাকে দেখাবে বলে। রুপের ঘুম ভেঙে গিয়েছে বিধায় ঘর থেকে বের সয়ে গেলো। উদ্দেশ্য ছাদের চিলেকোঠা ঘরে যাবে। সেখানে বসে ব্যস্ত শহরের দালানের চূড়ায় সূর্যের আগমন দেখবে।

ছাদে যাওয়ার পথে আজাদ সাহেব এবং নাদিফের কামরা পাড় হতে হয়। রুপ আস্তেধীরে এগিয়ে যাচ্ছে যেন কোন শব্দ না হয়। আজাদ সাহেবের কামরার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রুপের কর্ণধারে আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের কন্ঠস্বর শোনা যায়। আজাদ সাহেবের কামরার দরজা কিছুটা উন্মুক্ত। সেখান দিয়েই দেখা যাচ্ছে আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ বিছানায় বসে এই রাতে লুডু খেলছে। রুপ দু’জনের অবস্থা দেকে ললাটে হাত ধরে। এই দু’জন মানুষকে রুপের মাঝে মাঝে জুকারের ভাই-বোন মনে হয়। যখন,তখন তা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায় এরা।

” নাদিফের বাবা, আমার গুটি কা’ট’লে আগামীকাল পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা খাওয়াবো কিন্তু বলে দিলাম।”

রুপ খেয়াল করলো খেলার এক পর্যায়ে আয়েশা আজাদ স্বামীকে ভয়ানক হু’ম’কি দিচ্ছে। কিন্তু আজাদ সাহেব স্ত্রীর হু’ম’কি পরোয়া না করে চারের ঘরের গুটি কেঁটে দিলো। তা দেখে আয়েশা আজাদ ভীষণ ক্ষেপে। আজাদ সাহেব হেসে বললেন,

” সুযোগ যখন আসে তখন তাঁর সদ্ব্যবহার করা উচিত। পরে যা হবার হবে। বর্তমানে তুমি কি করে আনন্দ পাও তাই করো।”

রুপ চলে আসলো আজাদ সাহেবের কামরার সামনে থেকে। অন্যের ঘরে উঁকি ঝুঁকি দেয়া ঠিক না। নাদিফের কামরার দরজা খোলা কিন্তু অন্ধকার। হয়তো ঘুমের ঘোরে দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছে। রুপ আর কিছু ভাবলো না। আস্তে ধীরে ছাদে চলে গেলো। ছাদের দরজা চাপিয়ে পূর্ব প্রান্তে চলে এসে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করলো রুপ। যেন এই নিঃশ্বাসের সঙ্গে জীবনের সকল কষ্ট বের করে দিয়েছে।

” এতো রাতে ভুতের সাথে প্রেম বিনিময় করতে এসেছো বুঝি?”

রুপের শরীর কাঁপছে ভয়ে। যদি কোন মানুষ গভীর ভাবনায় বিভোর থাকে তখন আচমকা কারোর আওয়াজে ভয় পায়, মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়। নাদিফ রুপের কাছে এসে রুপের মাথায় হাত রাখে। আশ্বাসের স্বরে বলে,

” ভয় পেয়েছো কি? আমি ভুত না, মানুষ। তোমার ভাষ্যমতে রাগী লোক। ঘুম আসছিলো না তাই ছাদে এসেছিলাম।”

রুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। মাথায় লোকটার ভরসার হাত পেয়ে চোখের কোণা ভিজে আসলো। নাদিফ ততক্ষণে রুপের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেয়। নাদিফের যে অনুমতি নেই রুপের সংস্পর্শে আসার। রুপ রে অধিকার দেয়নি তাঁর জীবনে দখলদার করার।

” এতো রাতে ছাদে কেন?”
” ঘুম ভেঙে গিয়েছে তাই চলে এসেছি।”
” ভয় লাগছে না আমাকে?”
” না।”

দুজনের মধ্যে নীরবতা। রুপের কেমন অস্থিরতা কাজ করছে নিজের মধ্যে। একজন পুরুষের সন্নিকটে আসা সত্যিই অস্বস্তিকর। রুপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নাদিফ বলে উঠে,

” আরেকপু সময় থেকে যাও। একসাথে সূর্যোদয় দেখবো।”

রুপ নাদিফের কথা অগ্রাহ্য করতে পারলো না। নাদিফের পাশে কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।
অদূরের দালানের কোণ ঘেঁষে লাল সূর্য উদয় হচ্ছে। রুপ অবাক চোখে সে দৃশ্য দেখছে। আর নাদিফ! সে তো লাল আভায় অপরুপকে দেখতে ব্যস্ত। আকস্মিক নাদিফের কি যেন হলো, রুপকে রেখে হুড়মুড় করে নিচে চলে গেলো। রুপ নাদিফের চলে যাওয়া দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। এবার রুপ ছাদে ঘুরবে। মনের সুখে গান গাইবে, পাখিদের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশে উড়াল দিবে, ভেসে যাবে মেঘের ভেলাতে।

ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে
বহে কিবা মৃদু বায়,
ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে
বহে কিবা মৃদু বায়,
তটিনী হিল্লোল তুলে
কল্লোলে চলিয়া যায়
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
কুহূ কুহূ কুহূ গায়,
কি জানি কিসের লাগি
প্রাণ করে হায় হায়!
ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে
বহে কিবা মৃদু বায়!

রুপ মনের সুখে গান গাইছে। আশেপাশের কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। নাদিফ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুপের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে রুপের উদ্দেশ্যে বলল,

” এই মেয়ে, আমাকে যন্ত্রণায় ফেলতে খুব ভালো লাগে তোমার তাই না? গান গাইছিলে কেন? তোমার কাছ থেকে যতই দূরে সরে যেতে চাইছি তুমি ততই কাছে ডেকে নিচ্ছো। কি চাও তুমি? আমি উন্মাদ হয়ে যাই! রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াই?”

রুপ নিশ্চুপ। কোন কথা বলছে না। রুপের নজর আপাতত নাদিফের পাঞ্জাবীর বক্ষঃস্থলে বাম পাশের কারুকার্যের দিকে। কি সুন্দর ময়ূরপঙ্খী আঁকা পকেটে। রুপের ইচ্ছে করছে কারুকার্যের উপর হাত বুলিয়ে দিতে। তাই করলো রুপ। আপনমনে বক্ষঃস্থলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। নাদিফ রুপের কাজ দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। নিজেকে সংযত করে রুপের থুতনিতে হাত রেখে মুখ উপরে তুলে। রুপের চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করে,

” এভাবে ছুঁয়ে দিয়ে আমাকে আর প্রমত্তের দিকে ধাবিত করো না অপরুপ! আমি আর সইতে পারবো না।”

চলবে………..