প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-৩১

0
692

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|একত্রিশ তম পর্ব |

“হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব’রে

সুরমা-কাজল পরাও কন্নার ডাগর নয়নে,
আলতা বিছপ রাঙা দুটি, রাঙা চরণে
ভরা কলস ছলাৎ ছলাৎ ডাঙা এ নিতল।”

নব্বই দশক বা হাজার দশক যেই সময় হোক না কেন বিয়ে বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠানে হলুদের গান না চালালে যেন অনুষ্ঠানের মজা হয় না। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে পূর্বে প্রতিটা বিয়ে বাড়ির হলুদের অনুষ্ঠানে এই গান বাজানো হতো।
প্রেম নীড়ে আজ বাজছে উক্ত গানটা। গানের তালে তালে ছোট-বড়ো সকলেই নেচে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে না এটা শহুরের হলুদের অনুষ্ঠান। মনে হচ্ছে গ্রামের কোন হলুদের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।

প্রেম নীড়ের বাগানের একপাশে গ্রাম্যভাবে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এখন সময় মধ্যাহ্নের শুরু। বর কনেকে আলাদা আলাদা হলুদ মাখানো হবে। যেহেতু বর কনে এক বাড়িতে, তাই প্রথমে বরকে তারপর কনেকে।

গ্রাম্যভাবে সাজিয়েছে আসলামপুরের মানুষজন অর্থাৎ আদুভাই ও তাঁর স্ত্রী শেফালী বেগম। মায়ার পরিবারজনেরাও এসেছেন বিয়েতে। মায়ার বাবা হামিদ বেজায় খুশি সাথে মায়ার মা মিতালিও। তাঁর কারণও অবশ্য আছে। মায়ার জন্য বড়োলোক পাত্র পেয়েছে মিতালি। নাদিফের বিয়ের পর পর’ ই মায়ার বিয়ে হবে। মিতালি নাদিফকে দেখিয়ে দিবে যে তার মেয়েরও বড়োলোকের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে।

সবুজ ঘাসের উপর শুধুমাত্র পাটি বিছিয়ে রেখেছে। মাথার উপর ত্রিপল দিয়ে বাঁধায় করা হয়েছে রোদ, বৃষ্টির ভয়ে। সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত নাদিফ এসে দাঁড়িয়েছে সকলের মাঝে। আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে খোঁজে চলছে অপরুপকে। পরিচির মুখশ্রীতকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয় নাদিফ। বিড়বিড় করে বলে,
” সামনে আসলে কি হয়! আমি কি খেয়ে ফেলবো নাকি তাকে, আজব!”

নাদিফ এর সবকিছু অবলোকন করছিল ফাহিমা। ফাহিমা গর্ভবতী বলে এখানে আসা মানা করেছে। চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে ফাহিমাকে। মুরুব্বিদের কথা, এই অবস্থায় হলুদ মেহেদী গায়ে লাগানো যাবে না তাহলে নাকি বাচ্চার ক্ষতি হবে। অবশ্য সকলেই জানে এগুলো কুসংস্কার কিন্তু বড়দের কথা মেনে নিয়েছে ফাহিমা। কাছে আসছে না সে। ফাহিমা সকলের সামনে নাদিফের চালচলন দেখে চিৎকার করে বলে উঠে,

” ছোট ভাইয়া তুমি যাকে খুঁজে চলছো, সে এখানে নেই। সে এখন ব্যস্ত সাজগোজ করতে। তোমাকে হলুদ মাখা মাখা শেষ হলে তাকে এখানে আনা হবে। তখন না হয় দেখে নিও!”

ফাহিমার কথা শেষ হতেই সকলে হেসে ওঠে। মায়ার মা মিতালি বেগম নাদিফের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

” কি ব্যাপার ছোট মিয়া! সহ্য হচ্ছে না? এইতো আর কিছু সময়। তারপর তো দেখতেই পাবে। এবার এসে দাঁড়াও তো দেখি! আমি তোমার আব্বা আমাকে ডেকে নিয়ে আসছি। তারাই তো তোমাকে প্রথম হলুদ ছুঁয়ে দিবে।”

মিতালি বেগমের কথা শেষ হতে না হতেই নাদিফ মাথা চুলকে ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।

আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব নিচে চলে আসেন। নিজের ছেলেকে সবার আগে এসে উপস্থিত হতে দেখে দুজনেই চোখ বড়ো করে ফেলেন। এই প্রথম ছোট ছেলেকে কোন কাজে সবার আগে পেলেন অবশ্য পাবেনই বা না কেন! পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হচ্ছে যে!

একপাশে আজাদ সাহেব তো অন্য পাশে আয়েশা আজাদ। দুজন’ই ছেলেকে হলুদ ছুঁয়ে দিলেন। তারপর এলো সবার পালা। নাবিলসহ একে একে সকলে হলুদ ছুয়ে দিল নাদিফকে। আশেপাশে রঙের খেলা শুরু হয়ে গেলো যে যেমন পারছে তেমন হলুদ রং দিয়ে খেলে যাচ্ছে।

” রাইসা, নিচে কি হচ্ছে?”

প্রেম নীড় ভবনের জানালা থেকে উঁকি মেরে বাহিরের আনন্দ দেখছিল রাইসা। রূপের কথা শুনে রাইসা দাঁত কেলিয়ে বলে,

” তোমার দোলার হলুদ ছোয়া সেটা হচ্ছে গো রুপ! সেটাই দেখছি।”

রাইসার কথায় রুপ বিরক্তি প্রকাশ করে। রাইসার কাছে এসে মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

” দোলা আবার কেমন ডাক। তুমি দিন দিন এত খারাপ হয়ে যাচ্ছ কেন রাইসা! আগে তো এভাবে উল্টা পাল্টা কথা বলতে না! এসব কে শেখায় তোমাকে?”

” আমার সোয়ামি গো সোয়ামি। বুজলে রুপ! কথায় আছে না! ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ আমিতো অসৎ এর পাল্লায় পড়েছি। সে আমাকে এসব মিষ্টি, দুষ্টু তিতা কথা শেখায়।”

রুপের মাথায় হাত রাইসার কথা শুনে। রুপ ভাবছে, এই মেয়েটা এত পরিমাণে দুষ্টু হয়েছে তা বলার বাহিরে।
রুপ রাইসার খুনসুটির মাঝে তাদের ঘরের দরজা করাঘাত করে কেউ। রাইসা জানালা দিয়ে বাহিরের আনন্দ দেখছে। রুপ বুঝতে পারে রাইসা এখন দরজা খুলবে না, মরে গেলেও না। অগত্যা রূপ গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

দরজা খুলতেই রুপের চোখ বড়ো হয়ে যায়। রুপের চোখের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে হলদে মাখা নাদিফ। নাদিফের মুখে দুষ্টুমির হাসির রেখা। রুপ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল নাদিফের দিকে। নাদিফ কি করতে চাইছে বুঝতে চেষ্টা করলো কতক্ষণ। পরিশেষে যখন বুঝতে পারলো নাদিফের মতিগতি, ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
নাদিফ এসেছে রুপকে সর্বপ্রথম হলুদে রাঙিয়ে দিতে। অবশ্যই এত কষ্ট করতে হয়নি। নিচে সকলে মজা করছে, আনন্দে আছে। এই ফাঁকে নাদিফ চলে এসেছে রুপের কাছে। রুপের দুই গালে আলতো করে হলুদ মেখে কপালে গাঢ় করে চুমু এঁকে চলে যায় নাদিফ। রুপ নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিফের কার্যকলাপ সব মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর আয়েশা বেগম ঘরে আসেন দুই মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রুপের এই অবস্থা দেখে আয়েশা বেগমের মাথায় হাত। আয়েশা বেগমের আর বুঝতে দেরী হলো না যে এই কাণ্ড কে করেছে।

” ওই বাঁদর ছেলেকে তুমি নিষেধ করতে পারলে না! তোমার গালে যে এভাবে মেহেদী লাগিয়েছে। আগামীকাল মেকআপ করতে হবেনা! মেকআপ কি বসবে মুখে? আমি তো নিয়ত করে এসেছিলাম তোমাকে একদম আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখবো। কাউকে হলুদ লাগাতে দেব না। এখন দেখছি আগে তোমার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। যাও মুখ মুছে আসো নিচে সবাই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আর রাইসা কি করছে এখানে দাঁড়িয়ে? তোমার বর তো এখানে আসবে না, তাহলে উঁকি দিয়ে কাকে দেখছো?”

“তোমার স্বামীকে দেখছি গো! তোমার স্বামীকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে না ভাবছি বাঁদরটাকে বাদ দিয়ে তোমার স্বামীর গলায় ঝুলবো।”

রাইসার দুষ্টুমি মার্কা কথা শুনে আয়েশা আজাদ রেগে যান। রাইসার কাছে এসে কান মলে দেন, এরপর শক্ত কন্ঠস্বরে বলেন,

” তোর বাবা লাগে পাজি মেয়ে! বাবাকে এসব বলতে হয়? যা পাজি মেয়ে নিচে আয়!”

“আহা মা জননী রাগ করো না, আমি তো দুষ্টুমি করছি।”

রুপ, রাইসাকে একসাথে নিচে নিয়ে আসা হয়। দুজন’ই কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। কাঁচা ফুলের গহনা সাথে পরেছে। নাদিফের দেয়া হলুদের থেকে রুপকে লাগানো হয় আর এদিকে আকাশের বাসা থেকে নিয়ে আসা হলুদ লাগানো হয় রাইসাকে।

আনন্দ হাসি তামাশা মাঝে হলুদের অনুষ্ঠানে পর্ব শেষ হয়। প্রেম নীড় যেন আজ খুশির আমেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রেম নীড় যেন আজ পরিপূর্ণ। অপেক্ষা করছে নতুন ভোরের।

সময় এখন সায়াহ্নের শেষ সময়। সোফার ঘরে মানুষজনে পূর্ণ। সকালে গল্পগুজবে মগ্ন। রাতের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে বাহিরে। সোফার ঘরের এক পাশে বসিয়ে রেখে মেহেদি দেয়া হচ্ছে রুপ রাইসাকে। নাদিফ সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে রুপের সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে রুপকে পাওয়া মুশকিল। এজন্য নাদিফ খুবই হতাশ। করুণ চোখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে যেন বাবা কোন ব্যবস্থা করে দেয়। আজাদ সাহেব ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বুকে হাত গুঁজে অপর পাশে ফিরে তাকিয়ে রইলেন। আজাদ সাহেব আর ছেলের পাল্লায় পরতে চান না। কেননা তার ছেলে যে কেমন কাজ করবৈ তা জানা আছে। নাদিফ মুখে বিরক্তি ভাব ফুটে ওঠে আলগোছে চলে আসে তখনই সামনে পড়ে মায়া। সেদিন আসলামপুরে প্রথম দেখার মতোই শাড়ি পরেছে। মায়ার মুখে হাসি। নদিফের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলে,

” আমাকে তো সেদিন তুমি পছন্দ করো নি। দেখো এখন আমি তোমার চেয়েও ভালো ঘরের বউ হয়ে যাবো। তোমাকে দেখিয়ে দিবো যে আমিও কম সুন্দরী না তোমার বউয়ের থেকে। আজ দেখোতো আমাকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে না তোমার বউকে? অবশ্যই আমাকে আমি জানি।”

নাদিফ মায়ার বাচ্চামো কথা শুনে মুচকি হাসে। মায়ার মাথায় হাত রেখে বলে,

” তোকে আমি কিন্তু আমার ছোট বোন বলেই মানি। তোকে আজ খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে। একদম আমার ছোট বোনের মত। আমার ছোট বোনকে যেমন মিষ্টি দেখাচ্ছে! অপরদিকে আমার বউকে তেমন অপরুপ দেখাচ্ছে। রুপের কাছে আমার ছোট, বড় বোনেরা কিছুই না। তোর বিয়েতে অবশ্যই আমি উপস্থিত থাকবো। ছোট বোনের জামাইয়ের সাথে দুষ্টুমি করতে হবে না!”

নাদিফ দাঁড়ালো না। এগিয়ে গেলো নিজের ঘরে। এখন একটু বিশ্রাম নিতে হবে। কিছুক্ষণ পর তো আসল কাজে নামতে হবে।

রজনীর মধ্যাংশ সময়। রুপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। উদ্দেশ্য নিজ ঘরে একটু সময় ঘুমিয়ে নিবে। বিয়ে বাড়িতে যে যেখানে পেরেছে সেখানেই ঘুমিয়ে পরেছে। নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই রুপের চোখ ছানাবড়া। এক বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই পা ফেলানোর। রুপের শ্বশুর শাশুড়ির নাকি কোন আত্মীয় নেই। তাহলে এতো মানুষ আসলো কোথায় থেকে কে জানে!

রুপ আর ঘরে প্রবেশ করলো না। দরজা চাপিয়ে বাহিরে চলে আসলো। সব ঘর আটকে রাখা। রুপ কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। এদিকে রাইসা যে কোথায় তাও জানা নেই রুপের। এক সাড়ির ঘরগুলো পেরিয়ে ছোট্ট বারান্দা পড়ে। সেখানেই রুপ গিয়ে দাঁড়ায়। চাঁদের আলো পড়ছে বারান্দায়। রুপের এই মুহূর্তে ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু একা যাওয়া সম্ভব না। আর হলুদ গায়ে ছাদে যাওয়া ও ঠিক হবে না।

” অবশেষে তোমায় পেলাম অপরুপ!”

নাদিফের কথায় রুপ কেঁপে উঠে। আজকাল রুপের বর রুপকে বড্ড জ্বালাতন করে। রুপের কাছাকাছি থাকতে চায় সদা। কিন্তু রুপ এক প্রকার পালিয়ে বেড়ায় নাদিফের কাছ থেকে। আজ কি করবে রুপ তা ভাবছে।”
” ঘুমান নি?”

” আসছে না তোমাকে ছাড়া।”

” আমি কি করলাম।”

” এই যে এভাবে মাঝরাতে দাঁড়িয়ে আছো। মায়া হচ্ছে তো! তোমার পা ব্যথা করছে না? চলো আমার রুমে, ঘুমাবে।”

নাদিফের মুখের দুষ্টু কথায় রুপ নাদিফের পেটে খোঁচা দিলো। মুখে রাগান্বিত ভাব এনে বলে,

” ভালো হয়ে যান, বদ লোক!”

” আমি তো সবসময়েই ভালো, তোমার জন্যইতো খারাপ হয়ে যাই।”

রুপ হাসে নাদিফের কথায়। চাদের আলোতে এভাবে সারারাত গল্প করে পাড় করে দেয় রুপ,নাদিফ।
আগামীকাল যে বিশেষ দিন রুপ, নাদিফের জন্য।

চলবে……..