প্রেমনেশা পর্ব-২০+২১

0
5

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা

২০.

চারু কটমট চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে ওর শরীর কাঁপছে কারণ ধ্রুব ওকে জোর করেই গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। চারু গাড়ি থেকে নামার জন্য ছটফট করেছে। কিন্তু নামতে পারে নি।
এজন্য এখন চেঁচামেচি করছে,’ অসভ্য লম্পট বদমাইশ।’
ধ্রুব এগিয়ে এসে চারুর ওরনা টেনে নিল। তা দেখে চারু চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। ভয়ে ওর আত্মা শুকিয়ে গেল।
তোতলানো কন্ঠে চারু বলল,’ আ প নি কি ক র ছেন প্লিজ ভালো হবে না বলে দিচ্ছি একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।’
ধ্রুব চারুর হাত ওরনা দিয়ে বেঁধে দিল তারপর টেপ দিয়ে মুখ আটকে বলল,’ তোমাকে কিডন্যাপ করে নিলাম মিস চারুলতা বেগম।’
চারু হাত মুচড়ামুচড়ি করছে‌। মুখ দিয়ে উহ উম করছে। ধ্রুব চারুর সিট বেল্ট লাগিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল। চারু রাগে লাল হয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব খারাপ জানত কিন্তু এতো খারাপ কখনোই ভাবেনি। রাগে দুঃখে এখন কান্না পাচ্ছে। বিয়ে করাই তো এর থেকে ভালো ছিল। এই লোকটার হাতে পরার থেকে ওই লোকটাকে বিয়ে করা ভালো ছিল। চারুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। নিজের মাথায় নিজেকেই বাড়ি দিয়ে মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। এতো খারাপ লাগছিল ওর এই মুহূর্তটা। বারবার আজকে পালানোর জন্য আফসোস হচ্ছিল। এক সর্বনাশ আটকাতে ও আগুনে ঝাঁপ দিল। ধ্রুব ওকে এভাবে কব্জা করবে কখনোই কল্পনা করেনি চারু। ধ্রুবকে নিজের ভাবনার থেকেও বেশি জঘন্য লাগছে আজকে।

ধ্রুব ড্রাইভিং করার ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছিল চারুর দিকে। চারুর চোখে জল দেখে ও চমকে উঠল। ধ্রুব ফিসফিস করে বলল,’ তুমি যদি চাও আমি তোমার মুখ খোলে দিতে পারি কিন্তু তাহলে তোমায় মুখটা শান্ত রাখতে হবে। চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারবে না।’
ধ্রুবর কথায় চারু মুখ ফিরিয়ে নিল।
ধ্রুবর ওর রাগ দেখে বিড়বিড় করল,’ রাগ করে লাভ নাই রাজি হলে বলো খোলে দেই।’
চারু রেসপন্স করল না ধ্রুব তবুও কিছুদূর গিয়ে গাড়ি ব্রেক করে নিল। তারপর নিজে থেকেই হাতের বাঁধন খুলে দিল।
চারু মুখের টেপ খুলে দিল।
মুখটা খোলা পেয়েই চারু গমগমে কন্ঠে বলল,’ আপনি এসব কেন করছেন এসব করে কি পাচ্ছেন?’
ধ্রুব চারুর কথায় হেঁসে উঠল। শব্দ করে হাসছে ওর হাসি দেখে চারু বিরক্তের চরম সীমায় পৌঁছে গেল। ধ্রুব হাসি থামিয়ে বলল,’ অনেক কিছু পাচ্ছি। যা পাচ্ছি তা নিয়েই দেখো না মন খোলে হাসতে পারছি।’
‘ শুধু নিজের হাসির কথা ভাবছেন কত স্বার্থপর আপনি। আরেক জনের উপর জুলুম করে তাকে কষ্ট দিয়ে নিজের সাময়ীক আনন্দে কথা ভাবছেন এতো নিচ আপনি ছিহ।’ রাগে ঘৃণায় মুখটা ফিরিয়ে নিল চারু।
ধ্রুব চারুর হাত ধরে টেনে বলল,’ আমার দিকে তাকাও। কি বললে তুমি আমি স্বার্থপর? কার উপর জুলুম করছি?’
‘ কার উপর করেছেন বুঝতে পারছেন না? আপনার কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমি বেক্কেল হয়ে যাই।’
‘মাথা মোটা রা হয়‌ই।’

চারু ঝামটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলল,’ এসব করার জন্য তো এনেছেন। আপনি এই সুযোগের অপেক্ষায় ই ছিলেন‌। আপনি সেই প্রথম থেকেই আমার দিকে বাজে নজর দিয়েছেন আমি এতোটাই বোকা না ওকে। মেয়েদের তো আপনারা ভোগ পন্য মনে করেন। আজকে যেই দেখেছেন আমি অসহায় হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি সেই আমার পিছু নিয়েছেন কেন নিয়েছেন আমি বুঝা না ভেবেছেন তাই না? আপনারা বড়োলোকরা এতো নিকৃষ্ট কীভাবে হোন বলেন তো একটুও কি বিবেক বোধ নেই। আপনার যদি এতোই আমার শরীর ভোগ করার ইচ্ছা থাকে তো কাজ করে আমায় ছেড়ে দেন তাও আর অশান্তি দিবেন না। আপনার সাথে যেদিন থেকে দেখা হয়েছে আমার জীবনটা একদম নড়ক হয়ে গেছে। এমনিতে তো কম অশান্তি ছিল না এই ছোটো জীবনে আপনি আবার এলেন আরো এক বিশাল অশান্তি বয়ে নিয়ে প্রতিনিয়ত এসব আর দিতে পারছি না। আমি তো মানুষ বলুন কত সহ্য করব আমার সহ্য সীমা অতিক্রম করে গেছে।’
বলেই কাঁদতে লাগল চারু। কাঁদতে কাঁদতে বেহাল দশা চারুর। চারু কান্না থামিয়ে বলল,’ চুপ করে আছেন কেন আপনার চাওয়া পূরণ আমি করব তো বলেছি এখন অন্তত নিজের কাজ করছে আমায় রেহায় দিন। কালকের সকাল আমার হয়ত দেখা হবে না আমার মতো একজন সামান্য মেয়ে মরে গেলে এই পৃথিবীর কারো কিছুই হবে না। উল্টো একটা আপদ বিদায়…’
চারু কথা শেষ করতে পারল না হঠাৎ শক্ত হাতের একটা থাপ্পর খেল বাম গালে। থাপ্পর টা এতো জোরে ছিল যে চারুর মাথা ভনভন করতে লাগল। চোখে সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়েই গেল। কান ঝিমঝিম করছে চারু এমনিতেই রাতে খাবার খায়নি দূর্বল হয়ে ছিল ওর শরীর তার উপর পালানোর টেনশন, ধ্রুবর অত্যাচার সব মিলিয়ে কাহিল ছিল চারু এই অবস্থা এমন জোরে পুরুষালী হাতের থাপ্পর খেয়ে ও কুলাতে পারল না এক থাপ্পরেই চারু অচেতন হয়ে গড়িয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকে। ধ্রুবর রাগের মাথায় দিয়েছে তো নিজের সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পর কিন্তু চারু কে অজ্ঞান হয়ে পড়তে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠল।
ভয়ে ওর হাত কাঁপছে। কি করবে কিছুই বুজতে পারছে না। চারুর গালে থাপ্পড় দিয়ে ডাকতে লাগল ধ্রুব। চারু নড়াচড়া করছে না।

ধ্রুব চারু কে বুকে নিয়েই মাঝরাস্তায় বসে আছে। কি করবে মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ধ্রুবর ফোনটা তখনি বেজে উঠল। ওর বাবা কল করেছে। ওর মা স্টক করেছে। মায়ের খবর‌ পেয়ে ধ্রুব সব ভুলে গেল চারু কে ওভাবেই বুকে নিয়ে ড্রাইভিং করতে লাগল।
মাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে ধ্রুব মায়ের এমন নিউজ পেয়ে দিশেহারা অবস্থা এই অবস্থায় হন্যে হয়ে হসপিটালে এলো। চারু কে এই অবস্থা গাড়িতে রাখতে পারল না। পাঁজাকোলা করে ও সমেত হসপিটালে গেল। মা কোন ফ্লোরে আছে শুনে চারু কে নিয়েই গেল। ধ্রুবর বাসায় সবাই ধ্রুবর সাথে একটা অপরিচিত মেয়েকে দেখে চোখ কপালে তুলে ফেলল। চারু কে একমাত্র ধ্রুবর বাবা চিনে আর কেউ চিনে না। ধ্রুবর বাবা ডক্টরের সাথে কথা বলছিল তাই ওদের খেয়াল করেনি। এদিকে সবার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে ধ্রুব কোলে থাকা মেয়েটি কে?
ধ্রুব সবার চোখের কৌতুহল বুজতে পারছে সবাইকে পেরিয়ে একটা ফাঁকা কেবিন গিয়ে চারু শুইয়ে দিয়ে বের হতেই সবাই ওকে জেঁকে ধরল মেয়েটি কে? ওর কোলে ছিল কেন? নানান প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগল ওকে। ধ্রুব সবাইকে শান্ত করে বলল,’ উফ চুপ করো তোমরা আম্মু কেমন আছে এখন?’
আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করতেই সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল কারণ তার অবস্থা ভালো না ডক্টর একটু আগেই এসে বলে গিয়েছে অবস্থা ক্রিটিক্যাল।
ধ্রুবর কথায় উত্তর দিতে পারল না কেউ। ধ্রুব নার্স কে ডেকে চারুর কাছে গিয়ে একটু দেখতে বলল। তারপর ডক্টরের সাথে ওর বাবা কথা বলছিল সেদিকে গেল।
ধ্রুব বাবা ডক্টরের সাথে কথা বলছিল ধ্রুব কে দেখেই তারা থেমে যায়। ধ্রুব কপাল কুঁচকে এগিয়ে এসে বলল,’ হোয়াটস হ্যাপেন্ড? আমাকে দেখে আপনারা থেমে গেলেন কেন?’
ধ্রুবর বাবা ডক্টরের দিকে ইশারায় কি যেন বলল। ধ্রুব সবটাই খেয়াল করল। ডক্টর হাসি হাসি মুখ করে বললেন,’ আরে ইয়াং ম্যান!’
ধ্রুবর বাবা ধ্রুবর কাছে এগিয়ে এসে বললেন,’ তুমি কখন এলে তেমন কিছুই না শুধু হাইপার হয়ো না‌। তোমার আম্মু একদম ঠিক আছে।’
ধ্রুব বাবার দিকে সন্দেহের চোখে চেয়ে বলল,’ আব্বু আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না। কি হয়েছিল আম্মু স্টক করল কেন? আমাকে সবকিছু খুলে বলুন।’
ধ্রুবর বাবার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি ঘেমে উঠছেন ধ্রুবর বাবার মুখে ভয় দেখে আরো রেগে গেল।
‘ আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আম্মুর এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী হলে আমি কিন্তু আপনাকে…?’
ডক্টর আঙ্কেল এগিয়ে এসে ধ্রুবকে বলল,’ রাগ করো না আমার সাথে আসো তোমার সাথে কথা বলছি আমি।’
‘ আম্মু কেমন আছে সেটা আগে স্পষ্ট করে বলুন।’
ডক্টর নিজের চেয়ারে বসে ধ্রুব কে বসতে ইশারা করলেন। ধ্রুবর বাবা ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবকিছু ওকে বলার প্রয়োজন নেই ছোটো মানুষ।’
ধ্রুব রেগে উঠল।
‘ আমাকে বলতে মানা করেছেন কেন? তার মানে কোন তো গন্ডগোল আছেই। আমাকে তো জানতেই হবে। কি করেছেন আপনি।’
ধ্রুবর বাবা ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ তোমার মায়ের অবস্থা বেশি ভালো না। আমাদের যা করনীয় আমরা করছি কিন্তু আমরা কোন আশা দিতে পারছি না।’
ধ্রুব হাতটা ধপ করেই পরে গেল টেবিলের উপর থেকে। ওর বুক কাঁপছে। মাকে হারানোর যন্ত্রণায় ওর চোখে জল চিকচিক করতে লাগল। কখনোই মায়ের ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। সবসময় বন্ধু বান্ধব পার্টি আড্ডা এসব নিয়েই বিজি থেকেছে। মায়ের প্রতি করা অবহেলার কথা মাথায়ই আসতেই ধ্রুবর সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে এলো। আমরা থাকতে মূল্য দেয়না। গতকাল রাতেও ধ্রুবর মা ধ্রুব কে কল দিয়েছিল। ওকে নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাই কিন্তু ধ্রুব থাকে ধমক দিয়েছিল। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও মায়ের কথায় পাত্তা দেয়না সেরকম। অপরাধে ধ্রুবর গলা কাঁপছে। ধ্রুব ডক্টরের হাত ধরে বলল,’ প্লিজ আঙ্কেল আম্মু কে সুস্থ করে দিন।’
এই ডক্টর ধ্রুবর বাবার বন্ধু। খুব পরিচিত। তিনি ধ্রুবকে বলল,’ আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব কিন্তু বাঁচানোর মালিক তো আমরা না। আল্লাহ চাইলে তিনি অবশ্য‌ই সুস্থ হতে যাবে।’
ধ্রুব মায়ের জন্য পাগল হয়ে উঠল। ধ্রুবর বাবা ধ্রুবকে শান্ত করতে চাইছে।

#চলবে…..

প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
২১.

চারু যখন চোখ মেলে দেখল ও হসপিটালে এবং ওকে একটা নার্স ইনজেকশন পুশ করার বন্দোবস্ত করছে ও লাফিয়ে উঠল।
‘ আপনি এসব কি করছেন?’ ভয়ে আঁতকে উঠে বলল চারু।
চারুকে ভয়ে ভীত হতে দেখে নার্স বলল,’ আপনি উঠেছেন কেন শুয়ে পরুন।’
চারু বলল,’ আমি শুবো কেন?’ বলেই চারু এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে ও গাড়ি থেকে হসপিটালের বেডে চলে এলো কখন? চারু বসা থেকে নেমে গেল নিচে। চারু কে দাঁড়াতে দেখে নার্স বলল,’ আরে আরে করছেন কি?’
চারু রেগে বলল,’ আমার কিছুই হয়নি। আপনি আমায় ইনজেকশন পুশ করতে চাইছেন কেন?’
নার্স বলল,’ আপনার শরীর দূর্বল জন্য আমরা আপনাকে স্যালাইন দিব। আপনি শান্ত হয়ে শুয়ে পরুন। আপনার হাজব্যান্ড আমাদের তো স্যালাইন দিতে পারমিশন দিয়ে গেছে।’
হাজব্যান্ড শুনে তো চারু চোখ কপালে উঠে গেল। কি বলছে এই নার্স? ওর হাজব্যান্ড এলো কোথায় থেকে? ও কি তাহলে বাসা থেকে পালাতে পারেনি? ওর কি ওই লোকটার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে? কিন্তু ও তো পালিয়ে গেল স্পষ্ট মনে পড়ছে তাহলে সেসব কি ছিল? ও কি সব স্বপ্ন দেখেছে? মাথা ধরে এলোমেলো হয়ে বসে র‌ইল চারু। নার্স এসে ওকে বলল,’ শুয়ে পরুন। আপনার স্যালাইন প্রয়োজন।’
চারু শুয়ে পড়ছে না দেখে নার্স বেরিয়ে আরেকজন নার্সকে ডেকে নিল তারপর চারুকে দুজনে মিলে স্যালাইন দিয়ে দিল। চারু ছটফট করেছে কিন্তু থামাতে পারেনি। ও বিস্মিত হয়ে ভাবছে ওর হাজব্যান্ড কে?
ধ্রুবর সাথেই তো ছিল ও সে কোথায় আর হঠাৎ হসপিটালে আসলো কিভাবে তাহলে পালানোর সবটাই ভ্রম ছিল? চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল চারুর কোনভাবেই চারু নিজের ভাগ্য কে মেনে নিতে পারছে না।
চারু কে কাঁদতে দেখে নার্স বলল,’ কি‌ হয়েছে কাঁদছেন কেন?’
চারু বলল,’ আমার হাজব্যান্ড কে ডাক দেন তো..!’
নার্স বলল,’ উনার মা অসুস্থ তাই তিনি সেখানেই আছে।’
বলেই নার্স চলে গেল। চারু নিজের পোড়া কপাল দেখে শুধু কাঁদতেই আছে। চারু পারছে না ভাবতে ওই লোকটাকে হাজব্যান্ড।
কত কিছু করবে ভেবেছিল সব মিথ্যা হয়ে গেল। ওর শাশুড়ি অসুস্থ? এসব কেন ওর মনে পড়ছে না? আর ও তো এখনো বিয়ের আগের রাতের ড্রেস পরে আছে ওর বিয়ে হলো কখন? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব কিছুই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে চারুর।
চারু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সব কিছুই ওর স্বপ্ন লাগছে। ওভাবে চারু ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই চারুর ঘুম ভাঙল ও দেখতে পেল ওর মাথার উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুব। কপাল কুঁচকে চারুর দিকে তাকিয়ে আছে। চারু চোখ মেলে ধ্রুবকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল। এই লোক এখানে কেন? ওর হাজব্যান্ড কোথায়? এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে হঠাৎ চারুর টনক নড়ে উঠল। ও পালানোর সময় ধ্রুব যে পোশাক এ ছিল এখনো সেই ট্রি শার্ট পরে আছে তার মানে কি চারু সত্যিই পালাতে পেরেছে?
তাহলে ওর হাজব্যান্ড শাশুড়ি ওসব কি ছিল?
ও কি পাগল হয়ে গেল! এসব কি হচ্ছে ওর সাথে!
ধ্রুব বলল,’ এখন কেমন লাগছে তোমার?’
চারু চোখ খোলে আবার বন্ধ করে এসব বিশ্লেষণ করছিল ধ্রুবর কথায় চমকে উঠে চাইল।
‘ আমার হাজব্যান্ড কোথায়?’ বোকা কন্ঠে বলল চারু।
ধ্রুব কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে বলল,’ হোয়াট?’
চারু মিনমিনে স্বরে বলল,’ আমার শাশুড়ি অসুস্থ আমার হাজব্যান্ড আমাকে এখানে এডমিট করেছে নার্স বলল। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে বিয়ের আগে আমি পালিয়েছি কিন্তু আমার বিয়ে হলো কীভাবে? আপনিতো সাথে ছিলেন আমার। কিছুই মনে পড়ছে না একটু খোলে বলুন তো প্লিজ।’
চারুর কথা মনোযোগ সহকারে শুনল ধ্রুব। তারপর হো হো করে ওর বোকা বোকা কথা শুনে হাসতে লাগল। মায়ের এই অবস্থা দেখে ওর মনটা
একদম বিষন্ন হয়ে গিয়েছিল কিন্তু চারুর কথায় না হেঁসে পারল না। ধ্রুব কে কথায় কথায় এমন অদ্ভুত ভাবে হাসতে দেখে চারুর রাগ হলো।
‘ আজব আমি আতঙ্কে আছি আর আপনি হাসছেন? এমন কাজ আপনার দ্বারাই সম্ভব।’ গম্ভীর স্বরে বলল চারু।
ধ্রুব নিজের হাসি অনেক কষ্টে দমন করে বলল,’ চারু তুমি শুধু হাতেপায়ে বড়ো হয়েছো মাথায় এখনো একফোঁটা বুদ্ধি নেই।’
‘ কি বলতে চাইছেন আপনি?’
‘ আচ্ছা তোমার কথামতো হাজব্যান্ড আমি আর অসুস্থ শাশুড়ি আমার আম্মু হয়।’
‘ কি সব বলছেন?’ কপট রাগী গলায় বলল চারু।
ধ্রুব বলল,’ রিয়েলি। এই হসপিটালে আমার আম্মু এডমিট আছে। এবং তোমাকে ও আমিই এডমিট করেছি।’
ধ্রুবর ঠোঁটের কোনে হাসি। ওর হাসি দেখে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জ্বলে উঠল চারুর। শেষমেশ কিনা এই লোকটা কে নিজের হাজব্যান্ড বলে ছিলাম। ছিহ ছিহ রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে চারু।
তারমানে ও পালাতে পেরেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল চারু। ওই লোকটার সাথে বিয়ে হয়নি এইতো স্বস্তি শান্তি এসব বড়ো কোন ব্যাপার না। চারুর স্যালাইন শেষ ধ্রুব এগিয়ে এসে খুলে দিতে গেলে চারু হাত সরিয়ে বলে,’ নার্স কে ডাকুন।’
‘ কেন আমি খুলে দেই।’
‘ নাহ।’
ধ্রুব নার্স কে ডেকে এনে বলল,’ খুলে দিন’
‘ আপনি তো খুলতে পারেন স্যার। আমার ওখানে প্রয়োজন বেশি।’
বলেই নার্স চলে গেল। ধ্রুব বলল,’ কি আমার কাছে খুলবে নাকি অপেক্ষা করবে।’
চারু মুখটা ঘুরিয়ে শুয়ে র‌ইল। ধ্রুবর মিটিমিটি হেঁসে খুলে দিল। হাতে ক্যানোলা লাগানো দেখে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,’ এটার কি প্রয়োজন?’
‘ আরেকটা দিতে হবে এজন্য হয়তো রেখেছে।’
‘ আপনি আমায় হসপিটালে এনেছেন কেন? আমি কি বলেছি হসপিটালে আনতে?’ রেগে বলল চারু।
ধ্রুব বলল,’ আসলে হয়েছে কি আমি আসলে তোমার অনুমতি ছাড়া এখানে তোমায় আনতাম না। কিন্তু তুমি তো অজ্ঞান হয়ে গেলে একটা থাপ্পর খেয়েই যে অবস্থা? যাইহোক শোনো অনুমতি না দেওয়ার জন্য তুমি সজ্ঞানে থাকলে নাহয় তোমার কথা শুনতে পারতাম। বাট তুমি তো..!’
চারু ভয়ংকর রেগে গিয়ে চাইল ধ্রুবর দিকে ধ্রুব গালে হাত দিয়ে বলল,’ থাপ্পরের বিপরীতে আবার থাপ্পর দিতে চাও নাকি। ভুলেও এই কাজ করবে না বাইরে আমার সব পরিবারের লোকজন আছে তারা যদি দেখতে পায় একটা মেয়ের হাতে তাদের বাড়ির ছেলে থাপ্পর খাচ্ছে আমার আর মানসম্মান কিছুই থাকবে না।’
চারু আঙুল তুলে বলল,’ আপনি একদম আমার পিছু আসবেন না আমি এখনি এখানে থেকে চলে যাব।’
চারু আঙুল নামিয়ে বের হতে পা বাড়াল পেছনে থেকে হাত টেনে ধরল ধ্রুব।
চারু রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকাল ধ্রুবর দিকে তারপর গমগমে কন্ঠে বলল,’ আবার?’
ধ্রুব ঢোক গিলে হাত ছেড়ে বলল,’ এতো রাতে তুমি কোথায় যাবে? সকাল হলে না হয় চলে যেও..!’
‘ নাহ আমি এখনি চলে যাব। আর আমার চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আপনি কেমন সেটা জানার বা বুঝার বাকি নেই আমার। তাই ভালোমানুষী দেখাতে আসবেন না আমাকে।’
ধ্রুব চারুর ঘাড়ত্যারা কথায় রেগে ফের ছেড়ে দেওয়া হয় শক্ত করে চেপে ধরল। চারু হাত মুচড়ামুচড়ি করে বলল,’ অসভ্য ছাড়ুন আমার হাত।’
‘ ভালো কথা শোনার মেয়ে না তুমি। দেখো আমার মন মেজাজ এখন ভালো নেই। আম্মুর অবস্থা ভালো নয় একটু পর অপারেশন হবে আমি খুব টেনশনে আছি। প্লিজ তুমি আর যন্ত্রণা দিও না। চুপচাপ এখানে শান্ত হয়ে বসে থাকো। আমি তোমার সাথে রাগারাগী করতে চাইছি না।’
বলেই ধ্রুব চারুকে বিছানায় বসিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে থেকে দরজা লক করে গেল। চারু হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। উঠে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে দেখল দরজা লক করা ওর সারা শরীর রাগে কাঁপতে লাগল।
কয়েকবার চিৎকার চেঁচামেচি করে ব্যর্থ হয়ে বিছানায় বসে র‌ইল।
লোকটা এতো খারাপ নিজের মায়ের এই অবস্থায় ও ওকে এভাবে জ্বালা দিচ্ছে। তোর মায়ের অবস্থা খারাপ তুই কোথায় আল্লাহর নাম নিবি তা না আমাকে আটকে রাখছিস। কেন যে আমাকে আটকে রেখে তোর কি লাভ হচ্ছে? এখন এই দরজা খুলবে কীভাবে। নিজেকে বন্দি বন্দি লাগছে। কি সব হচ্ছে ওর সাথে এসব।
চারু জানালা দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারল না ও কয় তালায় আছে। কি করবে এখন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে‌‌। চারু রুমের ভেতরে পায়চারি করছে। হঠাৎ দরজা খুলে আবার এলো নার্স এসে ওর দিকে হাসি মুখ করে তাকাল। তারপর নিজের হাতে করে আনা প্যাকেট দিয়ে বলল,’ খেয়ে নিন আপনার হাজব্যান্ড পাঠিয়েছে।’
রাগে মুখটা লাল টকটকে হয়ে উঠল চারুর। বারবার ওই অসভ্য ধ্রুব কে হাজব্যান্ড ফলে সম্বোধন করায় ওর ভেতরটা রাগে ফেটে যাচ্ছে। ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ যাকে তাকে আমার হাজব্যান্ড বানিয়ে দিচ্ছেন কেন আজব?’
‘ যাকে তাকে কেন বানাবো ম্যাম আপনার হাজব্যান্ড মিস্টার ধ্রুব তো পাঠালো।’
‘ আমি কিছুই খাব না এসব নিয়ে যান। আর মিস্টার ধ্রুব ফ্রুব আমার হাজব্যান্ড না। আমি..’
নার্স মিটিমিটি হেঁসে বলল,’ ম্যাম স্যারের উপর রাগ করেছেন নাকি? রাগ করবেন না তিনি আপনাকে খুব ভালোবাসে তার মায়ের এতো ক্রিটিক্যাল অবস্থা তবুও সে আপনার কত কেয়ার নিচ্ছে। আপনি খুব ভাগ্যবতী।’
‘ আপনি এখানে থেকে যাবেন? নাকি এই খাবারটা আমি আপনার মুখে ছুড়ে মারব?’
চিৎকার করে উঠল চারু।
নার্স ভয় পেয়ে চলে গেল‌ আর এবার দরজা আটকাতে ভুলে গেল। এটার সুযোগ নিলো চারু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল দরজা খোলা পেয়ে ওর চোখ জোড়া চকচকে করে উঠল। এইতো সুযোগ হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। চারু আলগাছে কেবিন ছেঁড়ে বেরিয়ে গেল।
#চলবে…