প্রেমনেশা পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
10

#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৭.

যুথিকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডিনার এ নিয়ে যেতে হচ্ছে। রাগে মুখ মন্ডল লাল করে রেখেছে ধ্রুব। ওর চেয়াল শক্ত হয়ে আছে। রাগে মাথা দপদপ করছে। যুথি লজ্জা ব্রাশিং খাচ্ছে শুধু ওর লাজুকতা দেখে আরো বেশি রাগ উঠছে ধ্রুবর। কিন্তু মুখে বলছে না কিছুই। যুথি একটু পর পর ওর দিকে তাকাচ্ছে। ধ্রুব ভুলেও ওর দিকে তাকাচ্ছে না।
যুথি ধ্রুবর মুখে রাগের ছাপ দেখে মিনমিন করে বলল,’ তুমি কী কিছু নিয়ে টেনশনে আছো?’
ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায় যুথি। কিন্তু ধ্রুব উত্তর দেবে বলে মনে হচ্ছে না। যুথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ তুমি কী আমার উপর বিরক্ত?’
ধ্রুব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,’ হ্যাঁ।’
ঠোঁটের আগায় ছিল যেন উত্তর চোখ জোড়া টলমল করে উঠল যুথির।
‘ তুমি কি বিয়েতে অখুশি?’
‘ দেখ তোর সাথে আমি কথা বলতেই চাচ্ছি না। মায়ের মাথাটা তো খেয়েছিস। এখন কিছু বললেই বাসায় গিয়ে আবার কি না কি বলবি। তাই চুপ করে থাক আমার মেজাজ খারাপ করবি না।’
‘ তুমি এমন করছো কেন বলোতো। এনগেজমেন্ট হ‌ওয়ার পর থেকেই দেখছি তুমি আমার উপর অকারণেই মেজাজ করছো!’
হঠাৎ করেই ধ্রুব মেইন রোডে ব্রেক কষে। হেলে উঠে যুথি।
ধ্রুব লাল চোখে তাকায় ওর দিকে তারপর বলে,’ আমার তোর উপর মেজাজ করার কারণের অভাব নেই।’
‘ কারণ গুলো আমি জানতে চাই।’ বলে উঠল যুথি।
‘ তোকে বলতে আমি বাধ্য না।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল ধ্রুব।
‘ এমন করছো কেন বলোতো। তুমি তোমার প্রবলেম আমায় না বললে আমি বুঝব কীভাবে?’ মলিন কন্ঠে বলল যুথি।
ধ্রুব বলল,’ তুই নিজেকে কি খুব বড়ো কিছু মনে করিস? আমার প্রবলেম আমি তোকে বলব সলভ করার জন্য?
যুথি বলল,’ তুমি আমাকে এক ফোঁটাও বিলিভ করোনা তাই না?’
‘ নাহ।’
যুথি ধ্রুবর হাত টেনে ধরল আচমকা। ধ্রুব চমকে উঠল।
‘ হাত ছাড়।’
যুথি হাত ধরে বলল,’ আংটি ক‌ই?’
বিস্মিত কন্ঠে বলল যুথি। ধ্রুবর হাতে এনগেজমেন্ট রিং নেই। যুথি বিমূঢ় হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ধ্রুব একটানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’ ফেলে দিয়েছি।’
যুথির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যেন। ও মৃদু চিৎকার করে উঠল,’ হোয়াট?’
‘ চিৎকার করছিস কেন?’
‘ কী সব বলছো তুমি? ওটা আমাদের এনগেজমেন্ট রিং তুমি সেটা খুলে ফেললে?’ একের পর এক চমক খাচ্ছে যুথি ওর জন্য আর কত চমক অপেক্ষা করছে মাথা ঘুরছে ওর।
ধ্রুব বলল,’ শুধু খুলিনি। ফেলে দিয়েছি।’
যুথির মুখটা হা হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,’ তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি ডায়মন্ডের রিং টা ফেলে দিয়েছো? ওটার প্রাইজ কত বেশি ছিল জানো না?’
‘ জানতে চাই না‌। বাট তুই এখনো রিং হাতে রেখেছিস কেন?’
বলতে বলতে ধ্রুব ফট করেই যুথির হাত টেনে ধরল। আর এক টানে রিংটা খুলে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। যুথি মুচড়ামুচড়ি করেও ধ্রুব কে আটকাতে পারল না। ঘটনা অতিদ্রুত ঘটে গেল। ধ্রুব রিং ফেলতেই যুথি গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলো। কিন্তু ধ্রুব ওকে নামতে দিল না। গাড়ি করে ফেলল।
যুথি কাঁদতে কাঁদতে নাকের জল চোখের জল এক করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে দরজা খোলার ছটপট করছে।
ধ্রুব বলল,’ আমি তোর বড়ো ভাই কোন সাহসে তুই আমাকে বিয়ে করার জন্য হাতে রিং পরে থাকিস বল?’
‘ তুমি এটা কেন করলে? আমি কত হ্যাপি ছিলাম। আমার কত দিনের স্বপ্ন ছিল তোমার হাতে আংটি পড়ব। তোমার ব‌উ হবো আর তুমি এভাবে আমার হাত থেকে আংটি খুলে নিলে। প্লিজ গাড়ির লক খুলো আমি বের হবো।’
ধ্রুব গাড়ির লক খুলল না। কার স্টার্ট করল যুথি কাঁদতে কাঁদতে বেসামাল অবস্থা। ধ্রুব ওকে নিয়ে ডিনার এ এসে টেনে গাড়ি থেকে নামালো। যুথি রেস্টুরেন্টে বসেও কাঁদছে আসেপাশের সবাই ওর কান্না দেখছে ফিরে ফিরে।
যুথি এক সাইড দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে আরেকদিক দিয়ে চলে আসছে।
ধ্রুব ওকে ধমকে উঠল,’ স্টপ।’
‘ আমাকে বাসায় নিয়ে চলো‌।’ কাঁদতে কাঁদতে বলল যুথি।
ধ্রুব বলল,’ এতো কাঁদার কি আছে? সামান্য একটা রিং এর জন্য? তোর বিয়েতে আমি তোকে একটা ডায়মন্ডের সেট গিফট করবো যা। আর আজকে তোকে তোর ফিয়ান্সি হয়ে ডিনার করাচ্ছি না। তোর বড়ো ভাই হিসাবে করাবো। অনেক কাঁদছিল তাই একটু মন মতো খাওয়া-দাওয়া কর‌ মন ভালো কর।’
যুথি কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না কেন?’
‘ তোকে তো আমি জীবনেও বিয়ে করতাম না। তুই কি আমার ওয়াইফ হবার যোগ্য? ছোটো বেলা থেকে তোকে আমি বোনের মতো ট্রিট করে এসেছি আর তুই এখন আমাকে বিয়ে করতে না পারার শোকে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিস। ছি তোর লজ্জা করছে না বড়ো ভাইকে হাজবেন্ড এর চোখে দেখতে।’
‘ আমাদের বিয়ের কথা তো অনেক আগেই থেকেই ঠিক হয়ে আছে।’
‘ হ্যাঁ বাবা মার মাথায় তো গবর ভরা। আর তাছাড়া আমি অলরেডি মেরিড।’
‘ কি বলছ? তুমি আমার সাথে ফান করছো তাই না?’
‘ আমি কি পাগল তোর সাথে ফান করব? শোন তার সাথে ফান করার ফালতু টাইম এবং মুড কোনটাই নাই আমার। আমি অলরেডি মেরিড। তাই আমাকে নিয়ে এসব ফালতু চিন্তা ভাবনা বাদ দে‌। এনগেজমেন্টের আগেই আমি তোকে সব বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই তো আমার সাথে কথা বলার টাইম ই বের করতে পারলি না। শুধু শুধু একটু তামাশা ঘটে গেল।’ বিরক্তিকর কন্ঠে বলল ধ্রুব।
যুথি চোখে মুছে বলল,’ আমার তোমার কথা বিলিভ হচ্ছে না। তুমি এভাবে কিভাবে বিয়ে করতে পারো‌।’
‘ তোর বিলিভ করার আমার বিয়েটা না হয়ে যাবে না।’
‘ আচ্ছা তাহলে বাসায় তুমি কিছু জানাওনি কেন?’
‘ বাসায় বললেই কি বিলিভ করবে দেখা যাবে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করে তোর সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিবে।’
‘ ওয়াইফ নিয়ে এসে বলবে তাহলে তো বিলিভ করবে।’
‘ তা করবে কিন্তু সমস্যা তো এখানেই তোর ভাবিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ওকে না পাওয়া পর্যন্ত আমি বাসায় কিছু জানাতে পারছি না।’
যুথি কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না। মাথা এলোমেলো হয়ে আসছে। ধ্রুব কী ঠিক বলছে ও কি সত্যি বিয়ে করেছে? নাকি ওর সাথে মিথ্যাচার করছে? আচ্ছা ওকে পরীক্ষা করছে না ত!
যুথি মাথায় দুহাত চেপে ধরে বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে পানি খেলো।
‘ কিছু অর্ডার কর। বাসায় ফিরতে হবে।’
যুথি জড়ানো কন্ঠে বলল,’ তুমি বিয়ে করোনি তাই না?’
খুব আশা ওর চোখজুড়ে। একরাশ আশায় চেয়ে আছে বুক পেতে যুথি এই বুঝি ধ্রুব বলবে হ্যাঁ রে আমি বিয়ে করিনি আমি তো তোর সাথে ফান করেছি। আমি তোকেই বিয়ে করব তোকে আমি ভালোবাসি।
ভাবনায় ডুবে গেল যুথি। স্বপ্ন গুলো কত সুন্দর হয়ে থাকে। এই যে ওর সুন্দর স্বপ্ন চট করেই ভেঙে গেল দুঃস্বপ্ন হয়ে।
ধ্রুব রাগী কন্ঠে বলল,’ এক কথা বারবার বলতে আমার রাগ লাগছে যুথি। আমি বিয়ে করেছি। তোকে আমার বিয়ে করা ইম্পসিবল। আমি চাইনা বাসায় এখনি সবাই জানুক বিষয়টা তুই আজকে আমাদের মধ্যে যা কথাবার্তা বলো নিজের মধ্যে রাখবি আশা রাখছি। আমি চারু কে একবার খোঁজে পাই সোজা ওকে নিয়ে বাসায় সবার সামনে হাজির হবো।’
যুথি আচমকা উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে গটগট করে রেস্টুরেন্টে বাইরে চলে গেল।
ধ্রুব ওর পিছনে হেঁটে বলল,’ কিছু না খেয়েই চলে যাচ্ছিস?’
‘ তোমার কথায় আমার পেট ভরে গেছে।’

#চলবে….

#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৮.

যুথি বাসায় আসার পর থেকে রুমের দরজা লক করে বসে আছে। যুথির মা মেয়ের চিন্তায় একটু পর পর দরজায় নক করছে। যুথি সাড়া শব্দ দিচ্ছে না। যুথির মা টেনশনে ধ্রুবর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,,’ যুথির কি হয়েছে ও দরজা খুলছে না কেন?’
ধ্রুব কফির মগ এ চুমুক দিচ্ছিল পরম শান্তিতে চাচিকে সামনে দাঁড়াতে দেখে ভ্রুক্ষেপ না করে এক মনে কফি খাচ্ছে।
ধ্রুব নিস্তব্ধতা দেখে তিনি রেগে গেলেন,’ কথা বলছো না কেন? যুথির সাথে কি করেছো? মেয়েটা তোমার সাথে কত খুশি মনে গেল কিন্তু এলো মুখ গোমড়া করে। কিছু তো করেছো আমার মেয়েটার সাথে কি করেছো বলো।’
‘ চাচি আমি আপনার মেয়ের সাথে কিছুই করিনি। আর যুথি কি ছোটো বাচ্চা ও কি দরজা একটু বন্ধ করে থাকতে পারবে না। এতো উত্তেজিত হ‌চ্ছেন কেন?’
ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল ধ্রুব।
রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন তিনি। ধ্রুব ড্রয়িংরুম এ একাই বসে কফি খাচ্ছিল।
মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। যুথির মা চাবির গোছা থেকে যুথির রুমের চাবি খোঁজে লক খুলতে চেষ্টা করল। সাথে ছিল পিনাক‌। দরজা খুলতেই পিনাক চিৎকার করে উঠল আপু বলে।
যুথি নিজের হাতের শিরা কেটে বসে আছে নিরব হয়ে ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। পিনাক এতো জোরে চিৎকার দিয়েছে যে বাসার সবাই ওর চিৎকার এ ছিটকে উঠেছে।
কাজের বুয়া কে দৌড়ে উপর থেকে নামতে দেখে ধ্রুব কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’ কি হয়েছে? সবাই এতো চিৎকার চেঁচামেচি করছে কেন?’
বুয়া বলল,’ ভাইজান যুথি আপায়..’
বুয়া কিছু বলতে পারল না পেছনে থেকে অচেতন যুথিকে কে পাঁজাকোলা করে নিচে নামলো যুথির বাবা। যুথির হাত চেপে ধরে রেখেছে যুথির মা তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ধ্রুবর হাত থেকে ঠাস করে কফির মগ ফ্লোরে আঁচড়ে পড়ল যুথির এমন অবস্থা দেখে। মুখের কথা উবে গেল। যুথি হাত চেপে ধরে রেখেছে কিন্তু তবুও টপটপ করে ফ্লোরে রক্তের ফোঁটা পড়ছে। ধ্রুব হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের ধাক্কা খেয়ে ধ্রুব চমকে উঠল।
‘ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করো। মেয়েটার কি হয়ে গেল আল্লাহ।’
ধ্রুব দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। ওর মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যুথি এমন কিছু করবে ও কল্পনাতে ভাবেনি। যুথির কন্ডিশন খুব খারাপ অনেক সময় ধরে বিল্ডিং হচ্ছিল তারমানে কি বাসায় এসেই এই কাজ করেছে। বুক কাঁপছে ভয়ে ধ্রুবর যুথির কিছু হয়ে যাবেনা তো। দুশ্চিন্তায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না ধ্রুব। এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে চোরের মতো।ওর অমত শুনেই কি যুথি সুইসাইড এর চেষ্টা করেছে।
ধ্রুবর চাচা ধ্রুবর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ধ্রুব চাচির দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি কেমন জানি রাগী চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। ধ্রুব ঢোক গিলে নিল।
যুথি এই বিয়ে নিয়ে এতো সিরিয়াস? বাট কেন? আমি তো ওকে বোন ছাড়া আর কোন নজরেই কখনোই দেখিনি তাহলে ও কেন আমার কথা শুনে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইল। বিয়েটা কি এতোটাই ইম্পর্ট্যান্ট ওর জন্য যে বিয়ে নাহলে ও মরে যেতে চাইবে। কি করবে ধ্রুব কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রচুর বিল্ডিং হয়েছে তাই রক্ত লাগল অনেক। ধ্রুব দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।‌ ধ্রুবর বাবা এলো খবর পেয়ে হন্যে হয়ে।
পিনাক আর ধ্রুবর মা বাসায় রয়েছে। পিনাক তো আসার জন্য কান্নাকাটি করছিল কিন্তু ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আসতে হয়েছে।
ধ্রুবর চাচি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ধ্রুবর সামনে ধ্রুব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বললেন,’ যুথি সুইসাইড করল কেন?’
ধ্রুব নড়েচড়ে দাঁড়াল।
‘ আই ডোন্ট নো.’
ধ্রুবকে তিনি বললেন,’ মিথ্যা বলোনা ধ্রুব তুমি এমন কিছু করেছো যার জন্য আমার মেয়েটা মরার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। কি বলেছো বলো।’
ধ্রুব তার সামনে থেকে সরে এলো। কডিটরে এসে বসে আছে চুপ করে।

দুই দিন পর যুথি কে বাসায় নিয়ে আসা হলো‌। ধ্রুব দুই দিন ধরে যুথির সাথে কথা বলার ট্রাই করছে কিন্তু ওর সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। ধ্রুব মল থেকে যুথির জন্য একটা গিফট নিয়ে বাসায় ফিরল।
যুথির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যুথি ওকে দেখেই মুখের উপর দরজা আটকে দিতে চাইল। ধ্রুব কোনরকম দরজা লক করার আগে আটকে বলল,’ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে যুথি।’
যুথি বলল,’ তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। প্লিজ তুমি চলে যাও‌।’
‘ বড়োদের কথা শুনতে হয়।’ কড়া কন্ঠে বলল ধ্রুব।
যুথি বলল,’ প্লিজ তুমি চলে যাও আমি তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাই না।’
ধ্রুব জোর করেই রুমে ঢুকে বলল,’ তুই আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবি নাকি? দেখ বিয়ে করব না শুনেই মরতে বসে গেলি। আমি সত্যি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুই সামান্য একটা কথায় এভাবে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইবি কল্পনা ও করিনি। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি তোকে তো চিনতেই পারছি না। এতো সাহস কোথায় পেলি রে?’
‘ ভালোবাসলে সাহস আপনাআপনি চলে আসে তুমি হয়ত কাউকে কখনোই ভালোবাসোনি তাই জানো না ভালোবাসা সব পারে‌।’
ধ্রুব বিছানার উপর আয়েশ করে বসে বলল,,’ তুই কি বলতে চাচ্ছিস? তুই আমাকে ভালোবাসিস!’
যুথি মৃদু হেঁসে বলল,’ এখনো বুঝতে পারছো না?’
‘ নাহ।’
যুথি বলল,’ তুমি সবটাই বুঝতে পারছো আমি জানি। কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসা স্বীকার করার ভয়ে বুঝতে চাইছ না।’
‘শোন এখানে এসে বস তোর সাথে এখন ঝগড়া তর্ক করতে চাইছি না।’
যুথি দাঁড়িয়ে আছে।
ধ্রুব ওর হাত ধরে ওকে বসিয়ে বলল,’ আমি তোর বড়ো ভাই তাই সেই অধিকারে কিছু কথা বলতে চাই।’
যুথি ছলছল চোখে তাকাল তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল।
ধ্রুব ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,’ দেখ তোকে আমি খুব ভালোবাসি। একটা বড়ো ভাই তার বোনকে যেমন ভালোবাসে আমিও ঠিক তাই। তুই এতো ইমোশনাল জানলে আমি ওভাবে তোর সাথে ওইদিন কথা বলতাম না। আমি সত্যি খুব অনুতপ্ত তোর ওই অবস্থা দেখে আমার তো জান উড়ে যাচ্ছিল। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি তো নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতাম না। আর চাচা চাচি কখনোই ফ্রেস করতে পারতাম না। থ্যাংক গড তুই ঠিক আছিস।’
‘ তুমি চলে যাও প্লিজ।’
‘ তোর জন্য গিফট এনেছি নিবি না?’
‘নাহ আমি তোমার দেওয়া কিছুই চাই না‌। দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও‌।’
ধ্রুব ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,’ তুই আবার সুইসাইড করার চেষ্টা করবি তাই না?’
যুথি বলল,’ এর বিনিময়ে তুমি আমায় বিয়ে করবে?’
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ তোর জন্য আমি সব করতে পারব কিন্তু বিয়ে পসিবল না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। বুঝার চেষ্টা কর।’
যুথি উঠে দাঁড়াল।
ধ্রুব গিফটের প্যাকেট বিছানায় রেখে উঠে চলে যাচ্ছিল যুথি বলে উঠল,’ তোমার গিফট তুমি নিয়ে যাও ভাইয়া আমি তোমার দেওয়া কিছুই চাই না‌।’
‘ এতো অভিমান?’
‘ অভিমান করেও লাভ নেই তোমায় তো পাব না।’ ফুঁপিয়ে উঠল যুথি।
‘ আমার থেকেও ভালো কাউকে পাবি।’
যুথি বেলকনিতে চলে গেল ধ্রুব প্যাকেট রেখেই চলে গেল। যুথি যদি বাসায় সব জানিয়ে দেয় খুব বিপদ হয়ে যাবে। দুইদিন খুব ভয়ে ছিল আজকে এজন্য মানাতে এসেছিল কিন্তু এই মেয়ে ওর কথা শুনতেই চায়‌না।
ধ্রুব চিন্তা মুখে রুমে বসে আছে।
ডিনার টেবিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যুথির দিকে। যুথিকে সবাই জিজ্ঞেস করছে ও কেন এই কাজ করেছে। কি হয়েছে ওর।
যুথি হয়ত ধ্রুবর উত্তেজনা টের পেয়েছে। সবাই চলে যাওয়ার পর যুথি চুপিচুপি ধ্রুব কে বলে,’ আমি কাউকে কিছু বলব না এতো ভয় পাবার কিছু নেই ভাইয়া।’
#চলবে….

#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
৩৯.

‘ আমি বিবাহিত কেন আপনারা বুঝতে পারছেন না। আমি এই বিয়ে করতে পারব না প্লিজ আমাকে যেতে দিন। এভাবে আমার সাথে জোর জবরদস্তি করবেন না আপনারা।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল চারু।
কিন্তু ওর কথা কেউ শুনছে না। বিয়ে করা ছাড়া যেন ও আর কিছুই করার নেই। কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।
ওর কাছে বসে আছে অবন্তি ওকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করছে,’ আপু তুমি কাঁদছো কেন?’
চারু ছলছল চোখে ছোটো অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে একটা মেয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে ওকে সাজতে চাইছে না। ওকে জোর করে গোলাপি রঙের বেনারসি পরানো হয়েছে। একটু পর আহান এর সাথে ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে।
রিতা আন্টির বাসা থেকে চারু বেরিয়েছিল সকালে। সেখানে থেকে চারু বাসায় ফিরে গিয়েছিল এ ছাড়া তো আর জায়গা নেই রাস্তায় ঘুরবে কতক্ষণ?
ওকে পেয়ে তো চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিল ময়না বেগম ও সিঁথি। ওকে আহ্লাদ করে ঘরে নিয়ে বসায় তারপর ময়না বেগম বলতে লাগলেন,’ কোথায় ছিলি মা তোর চিন্তায় তো আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছিলাম।’
চারু ময়না বেগম এর বিহেভিয়ার এ তদ্ধা খেয়ে যায়। বিমূঢ় হয়ে চারু ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ ও ভয়ে ছাল বাসায় ফেরার পর ময়না বেগম ওর সাথে কি আচরণ করে কি শাস্তি দেয় কিন্তু এ তো উল্টো কাহিনী ঘটে গেল।
চারু বিস্মিত হয়ে রুমে গিয়ে বসে এদিক ময়না বেগম আহ্বানকে কল করে বাড়িতে ডাকে তারপর জোর করে আহানের সাথে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। ফোনে ফোনে নাকি আহানের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আজকে সকালেই সিঁথি আর ময়না বেগম গ্রামে এসেছে আজকে বিয়ে পড়ানো হবে।
চারু এই বাসা থেকে পালানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। ধ্রুবর সাথে যোগাযোগ করার ও চেষ্টা করেছে কিন্তু ওর ফোন এখানে আসার‌ আগে ময়না বেগম রেখে দিয়েছে। চারু কে সাজিয়ে রেখে মেয়েটা চলে গেল। চারু আর অবন্তী বসে ছিল।
চারু অবন্তী কে ফিসফিস করে বলল,’ অবন্তী একটা হেল্প করতে পারবে?’
‘ কি হেল্প আপু?’ চোখ ছোটো ছোটো করে বলল অবন্তী।
চারু কাঁপা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে বলতে নিবে অমনি দেখে সিঁথি এসে রুমে ঢুকছে। চারু ছিটকে সোজা হয়ে বসে। সিঁথি কপাল কুঁচকে চারুর‌ কাছে এসে বলল,’ কিরে চারু অবন্তীর সাথে কি এতো ফিসফিস করছিস?’
অবন্তী ড্যাবড্যাব করে তাকায় সিঁথির দিকে। চারুর গলা শুকিয়ে আসে সিঁথিকে দেখে কারণ অবন্তী যদি বলে দেয় ওর কাছে চারু কোন হেল্প চেয়েছিল।
সিঁথি সন্দেহের চোখে চেয়ে আছে চারু আমতা আমতা করতে লাগে।
সিঁথি অবন্তীর হাত চেপে ধরে বলে,’ অবন্তী চারু তোকে কি বলছিল রে।’
অবন্তী একবার চারুর দিকে তাকাচ্ছে তো একবার সিঁথির দিকে তাকাচ্ছে। চারুর মুখটা ভয়ে ছোটো হয়ে গেছে। চারু ইশারায় অবন্তী কে চুপ থাকতে বলছে। সিঁথি চট করেই চারুর দিকে তাকিয়ে বলল,’ এই তুই অবন্তী কে কী ইশারা করছিস বল। তুই আবার কোন পরিকল্পনা করছিস তাই না পালানোর?’
চারু বলল,’ আমার কোন পরিকল্পনা করার প্রয়োজন হয়না। এসব তো তোদের করতে হয়।’
সিঁথি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ এই ছোটো মেয়েকে ও ছাড় দিলি না ফিসফিস করছিস ওর সাথে।’
চারু মুখ ফিরিয়ে নিল। সিঁথি বলল,’ এতো দেমাগ তোর আসে কোথা থেকে বলতো চারু। তুই কি ভাবিস ধ্রুব তোর বিরহে দিন পাড় করছে? ও তোকে ভালোবাসে না তোর মতো দুইটাকার মেয়েকে ও ভালোবাসবে না। ওতো ওর ফিয়ান্সির সাথে ফূর্তি করছে। তাকেই বিয়ে করবে তুই জাস্ট টাইমপাস ছিলি। তাই আলগা দেমাগ বাদ দিঢ়ে আহান কে বিয়ে করে নে। তোর মতো মেয়েকে আমার মামাতো ভাই বিয়ে করছে এই তো তোর সৌভাগ্য।’
চারু বলল,’ আমার এতো সৌভাগ্যের দরকার নেই। তোর দরকার তুই বিয়েটা করে নে। অনেক দিন ধরেই বিয়ে করতে উঠেপড়ে লেগেছিস নিজের বিয়েটা হচ্ছে না বলেই কি এমন করছিস?’
সিঁথি চিৎকার করে উঠল। চারু ওর চিৎকার দমে গেল না। বলতেই লাগল। সিঁথি চলে গেল রাগে ফুসফুস করে।
চারু অবন্তী কে বলল,’ তুই চুপ করে ছিলে কেন?’
‘ সিঁথি আপু তো তোমায় পছন্দ করে না এজন্য আমি চুপ ছিলাম আমি চাইনি তুমি আপুর কাছে বকা খাও।’
চারুর চোখ জোড়া টলমল করে উঠল অবন্তীর কথায়। অবন্তী কে বলল কোন ভাবেই যে কারো ফোন ওর কাছে পাঁচ মিনিট এর জন্য নিয়ে আসতে। ও একবার লাস্ট চেষ্টা করতে চায়। ধ্রুব কে কল করতে চায়। নিজের ফোন হাতে থাকা অব্দি চারু ধ্রুবর নাম্বার বন্ধ পেয়েছে। আচ্ছা ধ্রুব কি ওর সাথে যোগাযোগ করতে চায়না বলেই নাম্বার অফ করে দিয়েছে?
চারু দুরুদুরু বুকে বসে আছে। ধ্রুব ওকে ঠকিয়ে থাকলেও এই বিয়ে চারু করবে না‌। ও একবার বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ধ্রুব ওকে না মানলেও চারু ধ্রুব কে স্বামী হিসেবে মেনেছে। আর কারো সাথে এই বিয়ের খেলা খেলতে চাই না।
চারু দেখল অবন্তী আহান এর নাম্বার নিয়ে এসেছে। আতংকে কেঁপে উঠল চারু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল উত্তেজনায়। এ কি সর্বনাশ অবন্তী আহান এর ফোন নিয়ে এসেছে?
অবন্তী ছুটে এসে বলল,’ ধরো নাম আপু।’
‘ তোমার ভাইয়া দেখে নি তো?’
‘ ভাইয়া তো বিয়ের জন্য রেডি হচ্ছে ফোন বিছানায় ছিল আমি গেইম খেলার কথা বলে নিয়ে এসেছি।’
হাত পা কাঁপছে চারুর ও কাঁপা হাতে ফোন স্পর্শ করলো।
অবন্তী কে চারু বলল দরজায় নজর রাখতে কেউ আসলে যেন ওকে সতর্ক করে। চারু দেখল অবন্তী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটো মেয়েটা ওকে কত সাহায্য করছে। চারুর চোখ ভর্তি জল চলে এলো‌। চারু চোখ মুছে ফোনে টাইপ করতে লাগল নাম্বার। ওর হাত কাঁপছে ভয়ে নাম্বার তুলতে গিয়ে বারবার ভুল হচ্ছে। বেশি উত্তেজনায় ভয়ে ওর হাত কাঁপছে নাম্বার তুলতে। চারু চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে নিল। শান্ত করে নাম্বার তুলে ডায়াল করল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। ফোন তুলতে সময় নিচ্ছে কেন ধ্রুব। আজকে তো ফোন অন তাহলে তুলছে না কেন?
চারু ফোনের রিং এর সাথে নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। রিং হয়ে কেটে গেল কল ধ্রুব রিসিভ করেনি কল। চারু দ্বিতীয় বার ট্রাই করতেই দরজার দিকে এগিয়ে এলো আহান।
চিৎকার করে ডাকছে অবন্তী কে। অবন্তী এক ছুটে এগিয়ে এলো চারু ভয়ে হাত থেকে ফোন ফেলে দিয়েছে ফ্লোরে। অবন্তী আর চারু দুজনেই ভয়ার্ত চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
চারু দেখল আহান গমগমে সুরে এগিয়ে এসে বলল,’ ফোন পড়ল কীভাবে?’
চারু ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে দাঁড়িয়ে। অবন্তী বলল,’ চা..’
চারু কথা টেনে নিল,’ এমন চিৎকার করে ডাকছেন ছোটো মানুষ ভয়ে ফোন ফেলে দিয়েছে।’
কথাটা বলেই ঢোক গিলল। আহান ফ্লোর থেকে ফোন তুলে বলল,’ চারু মিথ্যা বলার জায়গা পাওনা? কাকে কল দিছো এটা কার নাম্বার?’
বলেই আহান কল কেটে দিল।
চারু কথা বলছে না দেখে আহান চিৎকার করে উঠল,’ মুখ বন্ধ কেন? ‘
‘ আমার হাজব্যান্ড কে কল দিয়েছিলাম।’
ঠাস করে চড় মেরে বসল আহান। তারপর আঙুল তুলে বলল,’ তোর সাহস তো কম না। একটু পর আমার বউ হবি। আর তুই অন্য পুরুষকে হাজবেন্ড বলে সম্বোধন করিস।’
চারু পাল্টা চড় দিয়ে দিল রাগে। আহান গালে হাত দিয়ে চারুর দিকে তাকাল রক্ত লাল চোখে। তারপর হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে চারুর চুলের মুঠি কেটে ধরল। চারুর ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানির ধারা নামতে লাগল। চারু দেখল দরজা খুলে চাচি সিঁথি অবন্তীর মা এগিয়ে আসছে।
অবন্তীর মা ছেলেকে টেনে চারুর থেকে সরিয়ে ছেলেকে এলোপাথাড়ি থাপ্পর দিতে লাগল। আর বকতে লাগল।
ছেলেকে জোর করে ঘর থেকে বের করিয়ে দিল‌ চারু ফ্লোরে পরে ঠকঠক করে কাঁদছে। সিঁথি আর ময়না বেগম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চলে গেল যেন কিছুই হয়নি। চারু পাথরের মত বসে আছে শক্ত হয়ে ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে‌‌।

#চলবে…

( ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)