প্রেমময়ী তুমি পর্ব-২৬+২৭

0
525

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_২৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আরও গাঢ় করে পড়তে হবে? কিন্তু আমি তো গাঢ় করে কাজল পড়তে পারিনা! তবে কি আজ গোমড়া মুখোটার কথা রাখা হবেনা আমার?”

দোটানায় জর্জরিত চাঁদ! দারুন হীনমন্যতায় আচ্ছন্ন। বহু জল্পনা-কল্পনার সমাপ্তি টেনে চাঁদ আয়নার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নির্বিঘ্নে কাজলটা হাতে তুলে নিলো। নিজের উপর শতভাগ আত্নবিশ্বাস রেখে খুব সতর্কতার সহিত চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে দেওয়া কাজলটা আরও গাঢ় করতে লাগল! মনে মনে আওড়ে বলল,,

“নূর ভাইয়া যেহেতু বলেছে কাজলটা আরও গাঢ় করতে হবে, তার মানে গাঢ়-ই করতে হবে! সচারচর ছেলেরা তো মেয়েদের সাজ-গোজের বিষয়ে তেমন বুঝে না। সেই কুঁড়ে অভিজ্ঞতা থেকেই যেহেতু বলেছে কাজলটা আরও গাঢ় করতে তার মানে কাজলটা আরও গাঢ় করলেই আমাকে ভালো লাগবে!”

সেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে চাঁদ কাজলটা খুবই গাঢ় এবং নিঁখুতভাবে চোখে লাগাল! কাজ শেষ হতেই আয়নার দিকে তাকিয়ে ব্যাপক চমকে ওঠে মুখটা হা করল! অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,

“ওহ্ মাই গড! আমি এতো সুন্দর করে কাজলও পড়তে পারি?”

সম্বিত ফিরে পেতেই চাঁদ মৃদু হেসে মুখটা হাত দিয়ে লজ্জায় ঢেকে নিলো! আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে মিনমিনে গলায় বলল,,

“ইশশশ! আজ তো আমি ছেলেদের পটিয়ে-ই ছাড়ব! একটু পর তো নীড় ভাইয়ার শ্বশুড় বাড়িও যেতে হবে। তখন তো ছেলেদের লাইন পড়ে যাবে এই অপ্সরি চাঁদের পিছনে! মাতাল নূর তো বলেছিল আমি নাকি পার্ফেক্ট নই৷ কোনো ছেলে-ই নাকি আমাকে পছন্দ করবে না! আজ তার প্রমাণ আমি দেখিয়ে-ই ছাড়ব! আর সেই দৃশ্য নূর চোখের সামনে সব দেখবে আর নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানাবে!”

প্রচণ্ড জেদের বশবর্তী হয়ে চাঁদ মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। ভাবলেশ ভঙ্গিতে চোখের পাপড়িতে আইলেস পড়ে ঠোঁটে টকটকে লাল-খয়েরি রঙের লিপস্টিক পড়ল। ঘন কালো রেশমি চুলগুলো সাইড সিঁথি করে দু’পাশে ছেড়ে দিলো। কপালের মাঝ বরাবর বড়ো এক লাল টিপ পড়ল। ব্লাইজের লাল রঙের সাথে মেচিং করেই লাল টিপটা পড়া! দু’হাতেই ডজন ডজন হলুদ এবং লাল রঙের মিশ্রণে রেশমি চুড়ি পড়ল। বাঁ হাতের মধ্যমা আঙুলে হলুদ পাথরের একটি মাঝারি আংটি এবং তর্জনী আঙুলে লাল রঙের একটি বড়ো আংটি! আয়নায় শেষবারের মতো নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চাঁদ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। পিছু ঘুরে শাড়ির আঁচলটা ভালোভাবে বাঁ হাতে টেনে ধরল। আঁচলের সম্পূর্ণ অংশটা বাঁ হাতে ছেড়ে চাঁদ আনমনা হয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হলো। অমনি খেলো সাদমানের সাথে এক জোরচে ধাক্কা!

সাদমান মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে চাঁদের মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে! অবিলম্বেই হাত থেকে তার গিফটের বড়ো প্যাকেটটি মাটিতে খসে পড়ল! সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ অস্থির হয়ে মুখে হাত দিয়ে পড়ে যাওয়া গিফটের প্যাকেটটির দিকে তাকালো। অধীর গলায় বলল,,

“হায় আল্লাহ্! গিফটটা তো পড়ে গেল সাদমান ভাই।”

দিন-দুনিয়া ভুলে সাদমান পলকহীন দৃষ্টিতে কেবল চাঁদকেই দেখছে! আশেপাশে কী ঘটছে না ঘটছে কিছুর-ই খেয়াল নেই তার। এই মুহূর্তে যেনো তার জান যাই যাই করছে! চাঁদ ব্যস্ত গিফটের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে আফসোস করতে! অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও সাদমানের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া দেখে চাঁদ শাড়ির কুঁচি সামলে তড়িঘড়ি করে খানিক কুজো হয়ে নিচে উঁকি দিলো। গিফটটের প্যাকেটটা হাতে তুলে সটান হয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল। প্যাকেটটা সাদমানের দিকে এগিয়ে ইতস্তত গলায় বলল,,

“ভাইয়া ধরুন গিফটটা।”

সাদমানের ধ্যান ভাঙল! মাথা ঝাঁকিয়ে সে চাঁদের থেকে বেখেয়ালি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। চাঁদ যেনো তার দৃষ্টির পরিমাপ বুঝতে না পারে সেজন্য তড়িঘড়ি করে গিফটের প্যাকেটটার দিকে তাকালো। চাঁদ জোরপূর্বক হাসল। নিচু গলায় বলল,,

“সরি ভাইয়া। আমি আসলে খেয়াল করিনি৷ আমিও রুম থেকে বের হচ্ছিলাম আর আপনিও সামনে চলে এলেন! তাই বাই মিস্টেকে ঘটনাটা ঘটে গেছে।”

সাদমান তাড়াহুড়ো করে চাঁদের হাত থেকে গিফটের প্যাকেটটা হাত বাড়িয়ে নিলো। মাথা নুঁইয়ে ছোটো আওয়াজে বলল,,

“ইট’স ওকে।”

সাদমান প্রস্থান নিলো! চাঁদের সামনে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে হয়তো এক্ষণি তার হার্ট ফেল হবে! চাঁদ নির্বোধ দৃষ্টিতে সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কপাল কুঁচকে বলল,,

“সাদমান ভাইয়ার আবার কী হলো?”

দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাঁদ তার গন্তব্যপথে তাকালো। সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নামতেই সে লজ্জার মুখে পড়ে গেল! কারণ ড্রয়িংরুম জুড়ে কেবলই নীড়ের ফ্রেন্ডসার্কেল এবং কলিগদের আস্তানা! সবাই আড়চোখে চাঁদকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে! কানে ফুসুর ফুসুর করে কী সব যেন বলছে! চাঁদ অস্থির দৃষ্টিতে জায়মা, সাদিয়া, নাদিয়া এবং রুহিকে খুঁজে চলছে। এই মুহূর্তে তাদের খুঁজে পেলে হয়তো তার লজ্জাবোধটা একটু কাটবে। ইতোমধ্যেই হঠাৎ চাঁদের নজর পড়ল ড্রয়িংরুমের বাঁ পাশে। তৎক্ষনাৎ চাঁদের চক্ষুজোড়া আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠল! কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই চাঁদ শাড়ি সামলে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল ড্রয়িংরুমের বাঁ পাশে। সবার মাঝখান থেকে সে খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে সামিয়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরল! উৎফুল্লিত গলায় বলল,,

“কেমন আছো মা?”

সামিয়া আহমেদ মৃদু হাসলেন। চাঁদকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললেন,,

“ভালো আছি মা। তুই কেমন আছিস?”

“ভালো আছি মা। কখন এলে তুমি হ্যাঁ? আমার সাথে আগে কেন দেখা করলে না?”

“জায়মা বলছিল তুই নাকি রেডি হচ্ছিস? তাই তোকে ডিস্টার্ব করিনি মা।”

সামিয়া আহমেদের বুক থেকে চাঁদ মাথা তুলল। আহ্লাদি গলায় বলল,,

“বাবা আসেনি মা?”

মমতায় সিক্ত হয়ে সামিয়া আহমেদ চাঁদের মাথায় পর পর দুটো চুমু খেলেন। জবাবে বললেন,,

“এসেছে তো। তোর বাবা, ছোটো আঙ্কেল, তোর মামা সবাই এসেছে।”

“কোথায় ওরা?”

“তোর বড়ো আঙ্কেলের সাথে বাইরে বসে কথা বলছে।”

“আমি যাই ওদের কাছে?”

“আগে তো একটু নজর টিকা পড়িয়ে দিই আমার মেয়েটাকে! কী সুন্দরটাই না লাগছে আমার চাঁদ মা কে!”

চাঁদ লজ্জায় রঙিন হয়ে উঠল। মাথা নুঁইয়ে কানের পেছনে চুলগুলো গুজে বলল,,

“সত্যি বলছ মা?”

“মায়েরা কখনো মেয়ের সৌন্দর্য নিয়ে মিথ্যে বলতে পারে?”

চোখে থেকে আঙুলে কাজল তুলে সামিয়া আহমেদ চাঁদের কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন! নজর কাটাতে বললেন,,

“কারো নজন যেনো না পড়ে আমার মেয়ের উপর।”

মৃদু হেসে চাঁদ এক এক করে তার ছোটো খালামনি এবং মামানীকে জড়িয়ে ধরে তাদের সাথে কৌশল বিনিময় করল। বাড়ির সবাইকে কাছে পেয়ে চাঁদ যেনো খুশিতে আত্মহারা! সাবরিনা আবরার তার ছোটো বোনদের কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলেন। ক্ষণে ক্ষণে মিনমিনিয়ে কাঁদতে লাগলেন! বারবার তাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন! অতীতের সব ভুলে আবারও সবাই এক হয়ে গেলেন। তবে সেলিনা চৌধুরী তাদের সবার থেকে দূরে দূরে থাকছেন! এক অদৃশ্য অভিমানেই উনি কারো সাথে মিশতে চাইছেন না!

সবার মাঝখান থেকে জায়মা চাঁদকে ড্রয়িংরুমের এক কোণায় টেনে নিয়ে এলো। ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে চাঁদের বিস্তীর্ণ মুখমণ্ডলে তাকালো। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,

“তুই কী সত্যিই নিজে নিজে সেজেছিস চাঁদ?”

চাঁদ বেশ ভাব নিলো! চোখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো পিঠের দিকে ছুড়ে মারল। বাঁ হাতের তর্জনী আঙুল দ্বারা নাক ঘঁষে বলল,,

“উহ্হ্হ্ তোকে কেন বলব?”

জায়মাকে উপেক্ষা করে চাঁদ বাইরে তার বাবা এবং মামার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো! জায়মার পিছু ডাক সে একদণ্ডের জন্যেও কানে তুলল না। দ্রুত পায়ে হেঁটে নীড়ের গেস্টদের পাশ কাটিয়ে সে সদর দরজার কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ নূরের মুখোমুখি হয়ে গেল! ইয়া বড়ো এক স্পিকার হাতে নিয়ে নূর হলুদের স্টেজের উদ্দেশ্যে হেঁটে আসছিল। এরমধ্যেই আকস্মিক চাঁদের মুখোমুখি হয়ে গেল!

কাজের অস্থিরতা ভুলে নূর মোহময় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো! কাজল কালো সুনিপুণ দু’চোখের দিকে তাকিয়ে যেনো সে হারিয়ে ফেলা নিজেকে বারবার খুঁজে পাচ্ছিল! বুকের বাঁ পাশে প্রতিধ্বনিত হওয়া ঢিপঢিপ শব্দটা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল! ইদানিং চাঁদকে দেখলেই নূরের বুকের ভেতর কিছু অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সেই ব্যাকুল করা অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় না দিলে কেমন যেনো তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দম বন্ধকর এক গুমুটে অনুভূতি লাগে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বেপরোয়া অনুভূতিগুলোকে তার প্রশ্রয় দেওয়া!

নূরের উদাসীন চাহনি দেখে চাঁদ বাঁকা হাসল! গলা খাঁকিয়ে নূরকে লক্ষ্য করে বলল,,

“কী যেনো বলেছিলেন ঐ সময়? আমাকে আজব চিড়িয়া দেখাবে তাই তো? আমার জন্য নীড়ের ভাইয়ার গেস্টদের সামনে আপনাদের ফেইস লস হবে?”

তড়িৎ বেগে নূর চাঁদের তৃষ্ণার্ত মুখশ্রী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো! এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। ফুসফুসে দম সঞ্চার করে ধীর গলায় বলল,,

“সামনে থেকে সরো। তোমার সাথে আজাইরা প্যাচাল পারার সময় নেই আমার!”

নূরের একটি কথাও চাঁদ আমলে নিলো না। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে উল্টে ঝগড়ুটে গলায় বলল,,

“এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী দেখছেন হ্যাঁ? আমার দিকে তাকান। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন৷ দেখুন, আজ আমাকে কতোটা সুন্দর লাগছে! ছেলেরা কীভাবে আজ চাঁদের পেছনে ঘুরে জাস্ট দেখতে থাকুন।”

দৃষ্টি ঘুরিয়ে নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। আচমকা মুখটা উল্টে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,,

“ওয়াক! কেমন যেনো বমি বমি ভাব হচ্ছে! তোমাকে দেখার পর থেকেই শরীরটা আরও বেশি করে গোলাচ্ছে!”

চাঁদ আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলে উঠল! কোমড়ে হাত গুজে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“কী বললেন আপনি? আমাকে দেখে আপনার বমি বমি ভাব হচ্ছে? না-কি সকালে কিছু উল্টো পাল্টা খেয়েছেন বলে শরীর গোলাচ্ছে?”

নূর আবারও বমি করার ভাব করে বলল,,

“আরেহ্ না! তোমাকে দেখার পর থেকেই গাঁ-টা কেমন যেনো গোলাচ্ছে!”

“ধূর আপনার সাথে কথা বাড়ানো-ই পাপ! আপনার চোখে আমাকে সুন্দর লাগল কী লাগল না এসব আমার দেখার বিষয় নয়। অন্য ছেলেদের চোখে আমাকে কতোটা সুন্দর লাগল এটাই দেখার বিষয়!”

দুষ্টুমি ভুলে নূর রাগী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। খড়খড়ে গলায় বলল,,

“তার মানে ছেলেদের চোখে নিজেকে সুন্দর প্রমাণ করার জন্য তুমি এভাবে সেজেছ? নিজের জন্য সাজো নি?”

“আরেহ্ ধ্যাত! এটা তো আপনার সাথে করা আমার চ্যালেঞ্জ! ঐদিন বলেছিলেন না? আমাকে নাকি কোনো ছেলেই পছন্দ করবে না? কেউ আমার সাথে প্রেমও করবে না? আজ তার প্রমাণ আপনি স্বয়ং চোখে দেখবেন! চাঁদ চাইলে কী কী করতে পারে জাস্ট দেখতে থাকুন।”

মুখটা বাঁকা করে চাঁদ নূরের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। নূর মাথাটা পেছন দিকে ঈষৎ বাঁকিয়ে চাঁদের দিকে অস্থির গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই কোথায় যাচ্ছ?”

কোমড়টা হেলিয়ে দুলিয়ে চাঁদ হাঁটছিল! পেছনে না তাকিয়েই সে নূরকে লক্ষ্য করে বলল,,

“ছেলে পটাতে!”

নূর চোয়াল শক্ত করল! রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,

“চূড়ান্ত অসভ্য একটা মেয়ে! ইডিয়ট, ননসেন্স রাবিশ।”

স্পিকারটা নিয়ে নূর হলুদের স্টেজের এক কোণায় রাখল। চেয়ার টেনে স্পিকারটার পাশে বসল। ফোনের লাইনটা স্পিকারে কানেক্ট করে স্লো মোশনে মিউজিক ছেড়ে দিলো। রাগে গজগজ করে সে সদর দরজার দিকে তাকাতে লাগল। চাঁদকে এই মুহূর্তে তার কেন জানিনা খু’ন করতে ইচ্ছে করছে! অকারণে তার রাগ হচ্ছে। খুব বেশি অভিমান হচ্ছে। চাঁদকে সত্যিই মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করছে! এরমধ্যেই হঠাৎ আয়মন এসে পেছন থেকে নূরের কাঁধে হাত রাখল। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,,

“কী রে? এখানে বসে কী করছিস? ভাবির বাড়ি যাবি না?”

নূর রেগে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,

“রাখ তোর ভাবির বাড়ি! ঐদিকে যে তোর বোন ছেলে পটানোর ধান্দায় আছে খবর রাখিস এসবের?”

আয়মন কপাল কুঁচকালো। নির্বোধ গলায় বলল,,

“মানে?”

“মানে আবার কী? চাঁদকে দেখিস নি কীরকম মাঞ্জা মেরে সেজেছে? উদ্ভটভাবে সেজে আবার বলছে ছেলে পটাবে!”

আয়মনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পেছন থেকে সাদমান এসে নূরের মুখের কথা টেনে নিলো! বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বেহাল গলায় বলল,,

“মে তো লুট গেয়া ইয়ার! পটানোর আগেই আমি পটে গেছি!”

নূর অস্থির হয়ে উঠল! সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী?”

সাদমান সম্মোহনের গলায় বলল,,

“সত্যি বলছি রে ভাই। তাকে দেখে আমার হঠাৎ পালস রেট বেড়ে গেছে! অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি কিছুতেই যেনো পালস কমছে না! আমি এখন কী করব রে ভাই? একটা পথ দেখা প্লিজ।”

আয়মন বিরক্তবোধ করল। কপাল চাপড়ে বলল,,

“ধূর বা*! আমি এখান থেকে রাস্তা মাপি। দুই পাগলের কারখানা বসেছে এখানে! যতো ইচ্ছা ততো বকতে থাক!”

আয়মন প্রস্থান নিলো। নূর গটগট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল। আচমকাই সিগারেটটা সাদমানের হাতে ধরিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এটা টান ভালো লাগবে! যতসব আউল ফাউল কথা!”

নূর প্রস্থান নিলো। চাঁদকে হন্ন হয়ে খুঁজতে লাগল। চাঁদের ছেলে পটানো আজ সে ঘুচাবে! দ্রুত পায়ে হেঁটে নূর সদর দরজা পাড় হতেই নীড় পেছন থেকে নূরকে ডাকল। উঁচু গলায় বলল,,

“এই নূর শোন? এক্ষণি একবার অনুদের বাড়ি যেতে হবে তোদের। পান, সুপারি মিষ্টি, সাথে করে বড়ো একটা বোয়াল মাছ নিয়ে যেতে হবে। আর শোন? বাড়ির সব মেয়েদেরও সাথে নিয়ে যাস।”

নূর বিব্রতবোধ করল। পিছু ঘুরে নীড়ের দিকে আপত্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দ্বিমত পোষণ করে বলল,,

“প্লিজ ভাইয়া মেয়েদের নিয়ে না যাই? এদের নিলেই আলাদা ঝামেলা। কখন কোন দিক থেকে ছেলেটা ওদের পটিয়ে ফেলে!”

পেছন থেকে জায়মা, নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি নূরের কথা টেনে নিলো। নাকি কান্না করে নীড়ের হাত চেপে ধরল। আবদানসূচক গলায় বলল,,

“না ভাইয়া আমরা সবাই যাব প্লিজ।”

ইতোমধ্যেই সোহানী এসে তাদের পেছনে দাঁড়ালো! হলুদের সাজে সোহানীও বেশ জাঁকজমকভাবেই সেজেছে। হলুদ শাড়ি এবং হালকা সাজে অপরূপা লাগছে সোহানীকে! চার বোনের পাশে দাঁড়িয়ে সোহানী মৃদু হেসে তাদের অভয় দিয়ে বলল,,

“যাবি যাবি। আমরা সবাই যাব। নূরের একার কথা হবে না-কি হ্যাঁ?”

ক্ষুব্ধ হয়ে নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। বাড়ির এক কোণায় দাঁড়িয়ে এক প্রকার পেরেশান হয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগল। চাঁদের প্রতি জন্মানো কিউরিসিটি কমাতে লাগল! মনে মনে রোজকে ভাবতে লাগল! চাঁদের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে চাইল না। অবাধ্য অনুভূতি থেকে নিজেকে দূরে সরাতে চাইল। নেশায় বিভোর হয়ে উঠল।

নীড় পিছু ঘুরে সোহানীর দিকে তাকালো। এক প্রকার অদ্ভুত দৃষ্টিতেই নীড় সোহানীর দিকে তাকালো। সোহানী কপাল কুঁচকালো। এক ভ্রু উঁচু করে বলল,,

“কী?”

নীড় মাথা দুলালো। ম্লান হেসে বলল,,

“কিছু না!”

তড়িঘড়ি করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিতেই নীড় হঠাৎ মাহিনের মুখোমুখি হয়ে গেল। মাহিনকে পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। ব্যস্ত গলায় বলল,,

“সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠে যা। আর এক্ষণি ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হ। ওখান থেকে ফিরলেই আমাদের এখানে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সো ঐখানের কাজ সেরে যত দ্রুত সম্ভব এই বাড়িতে ফিরে আসবি। কথাটা মাথায় রাখিস।”

মাহিন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। দায়িত্ব নিয়ে বলল,,

“ওকে ভাইয়া। ইউ জাস্ট ডোন্ট ওরি। সব কাজ ঠিকভাবেই হবে।”

আয়মন, সাদমান, মাহিন এবং সাব্বির নিজ দায়িত্বে পান, মিষ্টি এবং মাছ নিয়ে গাড়িতে এক এক করে সব সাজিয়ে রাখল। মেয়েদেরকে আস্তে ধীরে গাড়িতে উঠতে বলল। সোহানী হন্ন হয়ে চাঁদকে খুঁজতে লাগল। তবে বাড়ির কোথাও চাঁদের দেখা মিলল না!

আয়মনের কানে কথাটা যেতেই আয়মন উদগ্রীব হয়ে উঠল। তন্ন তন্ন করে বাড়ির আঙ্গিনায় হাজার খুঁজেও চাঁদকে কোথায় দেখতে পেল না! উদ্বিগ্ন হয়ে সে এক দৌঁড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় আড্ডা দিতে থাকা নূরের বাবা, মেঝো আঙ্কেল, ছোটো আঙ্কেল এবং নূরের মামার মুখোমুখি দাঁড়ালো। পেরেশানি গলায় বলল,,

“চাঁদকে তোমরা কেউ দেখছ?”

সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদের বাবা ঘাবড়ে উঠলেন। তৎপর গলায় বললেন,,

“হ্যাঁ দেখেছিলাম তো। এইমাত্র আমাদের সবার সাথে দেখা করে গেল।”

“তাহলে এখন কোথায় গেল? পুরো বাড়ি চুষেও তো চাঁদকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।”

চাঁদের নিঁখোজ হওয়ার খবরটা পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পড়ল! সবাই অস্থির হয়ে চাঁদকে খুঁজতে লাগল। সামিয়া আহমেদের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। সবার চোখে-মুখে এখন ব্যাপক দুঃশ্চিতার ছাপ। সবার সাথে সাথে নূরও বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। চাঁদকে ঘিরে খারাপ কিছুর আভাস পেতে লাগল!

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_২৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

চাঁদের নিঁখোজ হওয়ার খবরটা পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পড়ল! সবাই অস্থির হয়ে চাঁদকে খুঁজতে লাগল। সামিয়া আহমেদের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। এতোদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়েও নিজের কাছে রাখতে পারল না। সবার চোখে-মুখে এখন ব্যাপক দুঃশ্চিতার ছাপ। সবার সাথে সাথে নূরও বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। চাঁদকে ঘিরে খারাপ কিছুর আভাস পেতে লাগল!

বিয়ে বাড়ি মুহূর্তের মধ্যেই মরা বাড়িতে পরিণত হলো! বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনে অজানা ভয়, শঙ্কা এবং আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। চাঁদ কোথায় যাবে কোথায় যেতে পারে এসব নিয়ে সবার মধ্যে নানান ধরনের জল্পনা-কল্পনা এবং কৌতূহলের সৃষ্টি হলো। বাড়ির মহিলারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল! বাড়ির ছেলে এবং পুরুষরা মিলে সম্পূর্ণ এলাকাটাও চুষে নিলো। তবে চাঁদকে কোথাও পেল না! সব আশা খুঁইয়ে সামিয়া আহমেদ এবার মেয়ের শোকে অঝরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন! সোহানী তার ব্যথীত হৃদয়কে খানিক সামলে নিলো। তার মা’কে জড়িয়ে ধরে শান্তনার স্বরে বলল,,

“কেঁদো না মা। আমরা চাঁদকে ঠিক খুঁজে পাব। এখানেই হয়তো কোথাও আছে চাঁদ। ঠিকভাবে খুঁজলেই পেয়ে যাব। তুমি তো জানোই মা? চাঁদ কতোটা চঞ্চল? হয়তো আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ইচ্ছে করে পাঁজিটা আমাদের সাথে মজা নিচ্ছে।”

সামিয়া আহমেদও সোহানীকে জড়িয়ে ধরলেন। দ্বিরুক্তি প্রকাশ করে কান্নাজড়িত গলায় বললেন,,

“আমার মন বলছে মা, আমার মেয়েটা বড় কোনো বিপদে পড়েছে! আমি জানি আমার মেয়ে চঞ্চল! তবে এতোটাও ছেলেমানুষ নয় যে, আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমাদের সবাইকে বিভ্রান্ত করবে। বিশেষ করে তার মা’কে কষ্ট দিবে। আমি চিনি তো আমার মেয়েকে। খুব ভালো করেই আমার চাঁদকে আমি চিনি।”

ইতোমধ্যেই নীড় অস্থির হয়ে নূর, মাহিন, আয়মন এবং সাদমনের দিকে তাকালো। তাদের প্রত্যেককে লক্ষ্য করে বেশ তৎপর গলায় বলল,,

“আই থিংক এভাবে খুঁজে আর কোনো লাভ নেই। এক্ষণি আমাদের পুলিশ ইনফর্ম করতে হবে।”

সবার মধ্য থেকে আয়মন বেশ পেরেশান হয়ে উঠল। অধীর গলায় বলল,,

“তাহলে আর দেরি কীসের ভাইয়া? চলো আমরা এক্ষণি রওনা হই।”

সবাই প্রস্তুতি নিতে লাগল থানায় যাওয়ার। এরমধ্যেই রুহি ঘর্মাক্ত হয়ে নূরের পাশে এসে দাঁড়ালো। শুকনো ঢোক গিলে নূরের বাঁ হাতটা টেনে ধরল। ব্যগ্র চাহনিতে নূর পাশ ফিরে রুহির দিকে তাকালো। রুহি খানিক উঁকি দিয়ে নূরের কানের কাছে তার মুখটা ঠেকালো। ফিসফিসিয়ে বলল,,

“ভাইয়া? আমি হয়তো জানি চাঁদ আপু কোথায়!”

নূর ব্যাকুল হয়ে উঠল! আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে রুহির দিকে তাকালো। উত্তেজিত গলায় রুহিকে শুধালো,,

“কোথায়?”

“পুচিদের বাসায়!”

“আমরা তো একটু আগেই পাশের বাসা থেকে চাঁদকে খুঁজে এলাম। কই কোথাও তো চাঁদকে খুঁজে পেলাম না।”

“আমি সত্যি বলছি ভাইয়া। চাঁদ আপু পুচিদের ফ্ল্যাটেই আছে! গাঁজাখোর ছেলেটা হয়তো চাঁদ আপুকে আটকে রেখেছে!”

নূর উতলা, উদগ্রীব হয়ে উঠল! চক্ষুজোড়ায় ঘোর আতঙ্ক নিয়ে রুহির দিকে তাকালো। প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“গাঁজাখোর ছেলেটা মানে?”

রুহি এক এক করে ঐদিনের সব ঘটনা নূরকে খুলে বলল। সব শুনে নূর ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। আর এক মুহূর্ত ব্যয় না করে এক দৌঁড়ে পাশের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো! ঝড়ের বেগে দৌঁড়ে নূর পাশের বাসায় পৌঁছালো। হন্ন হয়ে দুতলায় ওঠে অনবরত পুচিদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপতে লাগল। কয়েকদফা বিশৃঙ্খল শ্বাস ছেড়ে ঘাড়ের রাগ টান টান করে তুলল। চিৎকার করে বলল,,

“চাঁ…দ? কোথায় তুমি?”

ঐপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ এলো না! নূর এবার অধৈর্য্য হয়ে উঠল। ঘামে সিক্ত সামনের চুলগুলো টেনে শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে দরজায় সজোরে কষে এক লাথ মা’রল! পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করে হাতের কনুই দ্বারাও অনবরত দরজা ধাক্কাতে লাগল। এতেও যেনো কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। নূরের অবাধ্য হাঁকডাকে পাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বের হয়ে এলো! সবাই এসে নূরকে ঘিরে ধরল। কৌতূহলী হয়ে কী হয়েছে জানতে চাইল। নূর জবাবে তাদের কিছু বলল না। শুধু অসহায়ের মতো তাদের কাছে হেল্প চাইল! সবাইকে একসাথে দরজা ধাক্কাতে বলল। ফ্ল্যাটের সমস্ত পুরুষ একজোট হয়ে নূরকে হেল্প করল! সবাই দরজা ধাক্কাতে লাগল।

এরমধ্যে আবার আয়মন, সাদমান, নীড় এবং মাহিনও পাশের বাসায় ছুটে এলো। তারাও পেরেশান হয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগল। চাঁদের নাম ধরে ডাকতে লাগল। ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে এসে ঐদিনের সেই গাঁজাখোর ছেলেটা জনরোষে পড়ে দরজা খুলে দিলো! খালি গাঁয়ে রক্তিম চক্ষু জোড়ায় উপস্থিত সবার দিকে তাকালো! মাতালদের মতো ঢুলতে লাগল। সামনে সবার আক্রোশিত রূপ দেখে ছেলেটি মুহূর্তের মধ্যেই চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“কী হয়েছে? আপনারা এভাবে আমার রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন?”

অমনি নূর চোয়াল শক্ত করল! শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে ছেলেটির তলপেটে জোরে এক লাথ মারল! মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“মাদার**। বল চাঁদ কোথায়?”

ছেলেটি তলপেটে হাত রেখে ব্যথায় কুঁচকিয়ে উঠল। এক গজ দূরে ছিটকে পড়ল। মাগ্গো মা বলে এক আর্তনাদ প্রকাশ করল। অমনি সবাই এক এক করে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। সাদমান এবং মাহিন রাগে বোম হয়ে ছেলেটিকে ইচ্ছে মতো মারধর করতে লাগল! নাক-মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল ছেলেটির! তবুও সে শিকার করছিল না চাঁদ কোথায়? অন্যদিকে নূর, নীড় এবং আয়মন পুরো ফ্ল্যাট তন্ন তন্ন করে চাঁদকে খুঁজতে লাগল। তিন তিনটে রুম পাগলের মতো খুঁজেও তারা চাঁদকে কোথাও দেখতে পেল না! হতাশ হয়ে নূর পরিশেষে শূণ্য আশা নিয়ে কিচেন রুমে ঢুকতেই ফ্লোরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা চাঁদকে দেখতে পেল!

শুভ্র মুখের আদলে কাজল লেপ্টে এক বিদঘুটে অবস্থা চাঁদের! ঘন কালো রেশমি চুলগুলো জট বেঁধে এলোমেলো অবস্থা। হাতে, পায়ে এবং মুখে চড়ের কালসিটে দাগ! চাঁদের এই মুমূর্ষু অবস্থা দেখে নূরের মাথা ঘুরে এলো! চোখ বুজে নিজেকে স্থির করার প্রয়াসে লেগে পড়ল। কয়েকদফা তব্ধ শ্বাস ছেড়ে শরীরে শক্তি যোগাল। কপাল থেকে বেয়ে পড়া ঘামগুলো মুছল। ধীর পায়ে হেঁটে চাঁদের দিকে অগ্রসর হলো। হাঁটু মুড়ে চাঁদের মুখোমুখি বসল। কম্পিত হাতে চাঁদের থুতনিতে হাত ঠেকাল! অমনি চাঁদের মাথা বেয়ে টুপটুপ করে রক্ত গড়াতে লাগল! সঙ্গে সঙ্গেই নূরের বুকটা কেঁপে উঠল! হাত-পা কেঁপে উঠল! মুখে বাঁধা টেপটা খুলে দিলো। উত্তেজিত গলায় চাঁদের গালে আলতো চাপড় মেরে বলল,,

“চাঁদ? এই চাঁদ? চোখ খুলো। কী হয়েছে তোমার?”

চাঁদের হিতাহিতজ্ঞান লুপ্ত প্রায়। এই মুহূর্তে ধ্যান-জ্ঞান কিছুই কাজ করছে না তার! কেবল নূরের চাপড়ের সাথে তাল মিলিয়ে মাথাটা নিষ্ক্রিয়ভাবে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ঢুলছে! ভয়ে নূরের শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হতে লাগল। খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল। তড়িঘড়ি করে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো নূর। রান্নাঘরের ট্যাব ছেড়ে অধীর হয়ে চাঁদের চোখে-মুখে পানি ছিটাতে লাগল। পাঁচ থেকে ছয়বার একনাগাড়ে পানি ছিটানোর পর চাঁদের জ্ঞান ফিরতে শুরু করল! চোখের পাপড়ি একটু একটু করে নড়তে আরম্ভ লাগল। এরমধ্যেই নূরকে খুঁজতে খুঁজতে আয়মন এবং নীড় কিচেন রুমের দিকে চলে এলো। নূর এবং চাঁদকে ঐ অবস্থায় দেখামাত্রই দুজন দৌঁড়ে এলো তাদের কাছে। চাঁদের নির্জীব অবস্থায় দেখে আয়মন শুকনো ঢোক গিলল। চাঁদের দু’গালে হালকা চাপ দিয়ে বলল,,

“চাঁচাঁচাঁদ? কীকীকী হহয়েছে বোন? চোচোচোখ খুল।”

সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ শুকনো কেশে উঠল! পেটে হাত রেখে সে কাশতে কাশতে দলা মোচড়া হয়ে উঠল! চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ক্ষুদ্র আওয়াজে বলল,,

“পুপুপুচি!”

নূর যেনো আলোর দিশা খুঁজে পেল! শুষ্ক মুখে ম্লান হেসে বলল,,

“আর ইউ ফাইন চাঁদ?”

চোখ বুজা অবস্থাতেই চাঁদ খুক খুক করে কাশল। ক্ষীণ বলায় বলল,,

“পুচি ভালো নেই! শয়তানটা আমার পুচিকে জানে মে’রে ফেলেছে!”

আয়মন রেগে গেল! তটস্থ গলায় চাঁদকে বলল,,

“কী কখন থেকে পুচি পুচি করছিস হ্যাঁ? নিজের শরীরের কথা না ভেবে তুই পুচির কথা ভাবছিস?”

চোখের পানি ছেড়ে দিলো চাঁদ! কথা বলতে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চাঁদ চোখ বুজে আর্ত গলায় বলল,,

“আমার চোখের সামনে পুচিকে শয়তানটা মে’রে ফেলেছে ভাইয়া! পুচির মা’কেও মে’রে ফেলেছে! আমার তলপেটে লা’থি মেরে’ছে। দেয়ালের সাথে আমার মাথাটাকে ধা’ক্কা মে’রেছে। হাত-পা বেঁধে আমাকে এখানে ফেলে রেখেছে! আমি তো এখানে তার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি ভাইয়া। শুধু পুচিকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম! ভেবেছিলাম পুচিকে নিয়ে ভাবিদের বাড়িতে যাব। ছেলেটা আমাকে কথা দিয়েছিল পুচিকে আমার সাথে যেতে দিবে। তার কথায় বিশ্বাস করেই তো আমি তার রুমের ভেতর ঢুকতে রাজি হয়েছিলাম ভাইয়া। আর তখনি ছেলেটি দরজা আটকে আমার সাথে জোর-জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছিল! আমার মুখে টেপ বেঁধে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমার সাথে না পেরে সে পুচিকে এবং পুচির মা’কে গলা টি’পে মে’রে ফেলে! আমাকে আ’হত করে কিচেনরুমে বেঁধে রাখে। আমি বুঝতে পারিনি ভাইয়া আন্টি সত্যিই বাসায় নেই! বুঝলে হয়তো কখনো ছেলেটির কথার ফাঁদে পা দিতাম না!”

আয়মন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কান্নাজড়িত চোখে চাঁদের দিকে তাকালো। বুকের ভেতর চাঁদকে চেপে ধরে ভগ্ন গলায় বলল,,

“আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে চাঁদ। আজ হয়তো পুচির জায়গায় এবং পুচির মায়ের জায়গায় তুই থাকতি! তোর নসিব ভালো ছিল বলেই এই যাত্রায় বেঁচে গেলি।”

চাঁদ ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। আয়মনকে জড়িয়ে ধরে বলল,,

“ছেলেটা আজ আমাকে মে’রে ফেললেও হয়তো আমার এতোটা কষ্ট হতো না ভাইয়া! পুচি এবং পুচির মা’কে মে’রে ফেলে ছেলেটা আমাকে নরক যন্ত্রণা দিয়ে গেল। পুচির মুখটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিনা ভাইয়া! কষ্টে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। পুচিকে আর কখনো দেখতে পারবনা ভেবেই বুকটা ভারী হয়ে আসছে।”

তাৎক্ষণিক নূর জেদী হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো! আয়মনকে চাঁদের বুক থেকে সরিয়ে জীর্ণ শীর্ণ চাঁদকে বসা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো! নিস্তেজ চাঁদকে টেনে এনে আধমরা হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটির সামনে এনে দাঁড় করালো! মাহিন এবং সাদমানকে ঠেলে নূর চাঁদের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,

“যতো ইচ্ছে মা’রো ঐ স্ক্রাউন্ডেলটাকে! যতক্ষণ না রাগ শান্ত হবে ঠিক ততক্ষণ মা’রবে। একে মে’রে এরপর হসপিটালে ভর্তি করাব আমরা। প্রয়োজনে একে কবরে পু’তে দিয়ে আসব।”

চাঁদ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নূরের হাতটা ছাড়িয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। নূরের দিকে বেদনাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“এই নেশাখোরটাকে মে’রে আর কী লাভ হবে নূর ভাইয়া? আমার পুচিকে তো আমি আর ফিরে পাব না! সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম আমি পুচিকে।”

নূর নির্বিকার নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। একটা ছোটো প্রাণীর উপর চাঁদের এতো স্নেহ, মায়া-মমতা, ভালোবাসা দেখে নূর থমকালো। সাদমানের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল! চাঁদকে এই বিভৎস অবস্থায় একটুও সহ্য করতে পারছেনা সে! কাঁদতে কাঁদতে চাঁদ ব্যথাযুক্ত শরীর নিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফার তলা থেকে নি’হত পুচি এবং পুচির মা’কে টেনে বের করল! হাউমাউ করে কেঁদে চাঁদ পুচি এবং পুচির মা’কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। আত্নচিৎকার করে বলল,,

“শেষ অবধি আমি তোদের বাঁচাতে পারলামনা রে পুচি! যখন ঐ নরপিশাচটা তোদের গলা টি’পে ধরেছিল না? তখন আমি চেয়েও তাকে আটকাতে পারছিলাম না! বাঁচার জন্য তোরা যতোটা না ছটফট করেছিলি? তার চেয়েও অধিক আমি তোদের বাঁচানোর জন্য মুখে টেপ এবং হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছটফট করেছিলাম! আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থণা করেছিলাম শুধুমাত্র একবারের জন্য তোদের বাঁচিয়ে দিতে। আমার কাছে তোদের ফিরিয়ে দিতে।”

চাঁদের হাহাকার দেখে উপস্থিত সবার চোখে জল জমে এলো! আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠল সবাই। নূরের চোখের কোণে জলের আনাগোনা শুরু হতেই নূর হাঁটু মুড়ে চাঁদের মুখোমুখি বসল! আবেগ ধরে রেখে ক্ষীণ গলায় বলল,,

“প্লিজ ডোন্ট ক্রাই। কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে আরেকটা পুচি এনে দিব!”

চাঁদ ফুঁপাতে ফুঁপাতে কান্নাসিক্ত দু’চোখে নূরের দিকে তাকালো। কান্নায় আবারও ভেঙে পড়ে বলল,,

“জানেন নূর ভাইয়া? যখন ঐ খারাপ লোকটা পুচির গলা টি’পে ধরেছিল না? তখন পুচি আমার দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কতো শতো আকুতি প্রকাশ করছিল! ছোটো ছোটো থাবায় আমার কাছে আসার চেষ্টা করছিল! জিভ বের করে মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। কিন্তু ঐ লোকটা নির্মম পিশাচের মতো একটু একটু করে আমার পুচিকে মে’রে দিচ্ছিল!”

মুহূর্তের মধ্যেই চোখ বুজে নিলো চাঁদ! অজ্ঞান হয়ে নূরের বুকে লুটিয়ে পড়ল! নূর হঠকারি দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করে চাঁদকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো! ফ্ল্যাটের সবাইকে ঠেলে চাঁদকে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলো। প্রানপণে দৌঁড়ে চাঁদকে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নূরের সাথে সাথে আয়মন এবং সাদমানও রওনা হলো। নীড় এবং মাহিন এই দিকটায় থেকে ছেলেটাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করল। ফ্ল্যাটের লোকজনদের থেকে জানা গেল ছেলেটি মিস শাহেলা আক্তারের দেবর হয়। শাহেলা আক্তার উনার বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছেন তিনদিন হলো। তাই দেবরকে বাড়িতে রেখে গেছেন বাড়িটা দেখে শুনে রাখার জন্য। ছেলেটি হলো এক নম্বরের গাঁজাখোর এবং নেশাখোর। ছেলেটির ভাই প্রবাসী। মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা ভাইয়ের একাউন্টে পাঠিয়ে দিন দিন ভাইকে বিগড়ে তুলছেন!

চাঁদকে বাড়িতে এনে ডক্টর দেখানো হয়। মাথায় ব্যান্ডেজ এবং কিছু পেইনকিলার দেওয়া হয়। বিয়ের রীতি রক্ষার্থে নীড়ের শ্বশুড় বাড়িতে কেবল আয়মন, সাদমান এবং মাহিন যায়। নূর এবং নীড় বাড়িতে থেকে যায়। মেয়েরা আর কেউ যাওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করেনি। সবাই চাঁদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

#চলবে…?