প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৪০+৪১

0
497

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৪০
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এই এইদিকে তাকাও। আমি এইদিকে। চকলেটগুলা এভাবে নষ্ট করার জন্যই কি আমি এতদূর থেকে ফ্রেন্ডকে রিকুয়েস্ট করে এই চকলেটগুলা তোমার জন্য এনেছিলাম?”

ভীতসন্ত্রস্ততা ভুলে চাঁদ সচকিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। কপালে অপার বিস্ময়তার ছাপ প্রগাঢ়ভাবে ফুটিয়ে তুলল। কৌতূহলপ্রবণতা ক্রমাগত বাড়তে লাগল। যা শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখা সম্ভব হলোনা। নূরের অঢেল রাগমিশ্রিত মুখপানে তাকিয়ে সে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী বললেন আপনি? চকলেটগুলো আপনি এনেছিলেন?”

আশ্চর্যের বিষয় হলো নূর তার বেফাঁস কথাটায় নূন্যতম অুনশোচনাবোধও করলনা! গলায় সেই একই রূঢ়তা বজায় রেখে বলল,,

“কানে কালা নাকি তুমি? শুনতে পাও নি?”

ভয়-ভীতি বিসর্জন দিয়ে চাঁদ নির্ভীক গলায় বলল,,

“কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন চকলেটগুলো সাদমান ভাইয়া আমার জন্য পাঠিয়েছেন!”

টনক নড়ল নূরের! বুঝতে আর বেগ পেতে হলোনা রাগের চোটে সে সব সত্যি উগলে দিয়েছে! যা এই মুহূর্তে করা তার মোটেও সাজেনি! যাই হোক পরিস্থিতি তো এবার সামাল দিতে হবে। তাই নূর রুক্ষতা ভুলে গলা ঝাড়লো৷ চাঁদের অশান্ত দৃষ্টিতে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গলা খাদে এনে বলল,,

“একই তো হলো! সাদমান-ই তো চকলেটগুলো তোমার জন্য এনেছে!”

পুনরায় কপাল কুঁচকালো চাঁদ। নূরের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। মতিভ্রম হলো নাকি লোকটার? একবার বলছে নিজেই এসব এনেছে এখন আবার বলছে সাদমান ভাইয়া এসব এনেছে। লোকটার মাথায় কি সত্যি সত্যি গণ্ডগোল হয়ে গেল? আবোলতাবোল কিছু খায়নি তো আবার? সকাল থেকেই দেখছি কেমন উল্টো পাল্টা করছেন উনি! একটু আগেও আমার সাথে কীসব নাটক-ফাটক করছিলেন। যতসব আবেগি কথাবার্তা বলছিলেন। আমার হাতের তালুতে চুমুও খেয়েছিলেন! এখন আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। দু’রকম কথা বলতে শুরু করলেন। নিশ্চয়ই একটু আগের ঘটনাগুলো একদম ভুলে গিয়েছেন উনি। নেশার রেশ কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন! তবে আমার এখন কী হবে হ্যাঁ? আমি যে সত্যি সত্যি ভেবে নিয়েছিলাম আমার মতো লোকটার হার্টবিট ফার্স্ট হয়ে গিয়েছিল আমাকে দেখে! এতো অল্প সময়ের মধ্যেই কী আমার মনটা ভাঙল বলে? সে যাই হোক আগে নিজের কনফিউশন ক্লিয়ার করি। জেনে নিই কে এই চকলেটগুলো আমার জন্য এনেছে। ভাবুক হয়ে চাঁদ সন্দিহান দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো৷ গলা ঝেড়ে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“একসেকেণ্ড একসেকেণ্ড। সাদমান ভাইয়া এনেছেন নাকি আপনি এনেছেন? কে এনেছেন?”

সোজা হয়ে দাঁড়ালো নূর। দ্বিধা ভুলে বেশ তৎপর ভঙ্গিতে চাঁদের দিকে তাকালো৷ চাঁদের থেকে আর কিছু লুকানোর ইচ্ছে হলোনা তার। আর এটা লুকানোর মতোও আহামরি কোনো বিষয় নয়। উল্টো বিষয়টা চাঁদ যতো জলদি জানতে পারবে নূরের জন্য ততোই ভালো হবে। সাদমান আসার আগে আগেই চাঁদের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে পারবে! চাঁদকে ফিল করাতে পারবে নূরের চেয়ে বেশি ভালো এই যামানার কেউ তাকে বাসতে পারবেনা! হাজার জনম ঘুরে এলেও পারবেনা। চাঁদের জন্য নূর চোখ বুজে সব করতে পারে! যা হয়তো চাঁদও এখন বুঝতে পারছেনা। গলায় স্বাভাবিকতা টেনে ধরল নূর। কোমল স্বরে বলল,,

“আমার রিকুয়েস্টে-ই সাদমান চকলেটগুলো ইন্ডিয়া থেকে এনেছে ওকে? শুধু তোমার জন্য। বুঝতে পেরেছ এবার?”

চাঁদ মুখটা হা করে নিলো। উৎসুক গলায় পুনরায় শুধালো,,

“সত্যি আপনি এসব এনেছেন?”

“তো? অ্যানি ডাউট’স?”

“তার মানে তো হলো চকলেটগুলো আপনি-ই এনেছেন না? সাদমান ভাইয়া তো জাস্ট আপনার কথামতো কাজটা করছিল। তো বললেন কেন সাদমান ভাইয়া আমার জন্য এসব পাঠিয়েছেন? তাই তো আমি চকলেটগুলো খাইনি। সাদমান ভাইয়ার চকলেট আমি কেন খেতে যাব হুম?”

মনে মনে নূর বেশ খুশি হলো। সাদমানের প্রতি চাঁদের কোনো ইন্টারেস্ট নেই সেই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হলো! তবে ভেতরের প্রফুল্লতা সে বাইরে প্রকাশ করলনা। মুখশ্রীতে গুরুগম্ভীর ভাব ফুটিয়ে চাঁদকে আরও একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বলল,,

“কেন? সাদমানকে তোমার আপন মনে হয়না?”

“কোন এঙ্গেল থেকে আপন মনে হবে হ্যাঁ? আপনাদের ফ্রেন্ড বিধায় উনার সাথে টুকটাক কথা হতো। আর এখন তো পুরো ছয়মাস পাড় হয়ে গেল উনার সাথে কোনো দেখা নেই, খোঁজ-খবরও নেই।”

নূর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। নীলাভ লোচনদ্বয়ে চাঁদের জন্য প্রখর ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলল। নেশাধরা দৃষ্টিতে অপলক চাঁদকে দেখতে লাগল। ঠোঁটের আলিজে বাঁকা হাসির রেখা দীপ্তি ছড়াতে লাগল। ধ্যান-জ্ঞান ভুলে চাঁদ নূরের প্রেমসিক্ত মুখপানে তাকিয়ে রইল! বুকে দুড়ুদুড়ু ভাব তার। শরীর উত্তেজনায় ভরপুর। মন উচাটন, ভাবনারা সব উত্তাল। কী আছে নূরের ঐ নীলাভ চক্ষুজোড়ায়? কোন মোহমায়ায় আবিষ্ট সে? কেন আজ তার নূরের প্রতি এতো আসক্তি কাজ করছে? কোন সে মায়ায় সে একটু একটু করে নূরের মায়ায় এতোটা গাঢ় গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ছে? এই অনুভূতির নাম কী শুধুই ভালো লাগা? নাকি এরচেয়ে আরও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু?

জায়মা পাশ থেকে ঝেড়ে কাশল। কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থাকতে তার কুণ্ঠিত বোধ হলো। চটজলদি সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। বিড়বিড় স্বরে বলল,,

“বাপরে রোমান্টিক সিন চলছে এখানে! হাই লেভেলের রোমান্টিক সিন। এই মুহূর্তে এখানে থাকাটা আমার অশোভনীয়। চাঁদ কি সত্যি সত্যিই নূর ভাইয়ার প্রেমে টেমে পড়ে গেল নাকি? ব্যাপারটা তো সুবিধার ঠেকছেনা।”

তড়িঘড়ি করে জায়মা জায়গা থেকে সরে এলো। রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যে অগ্রে পা ফেলতেই আকস্মিকভাবে চাঁদের ভীরু গলার স্বর তার কানে এসে বিঁধে গেল! উৎকণ্ঠিত গলায় চাঁদ জায়মাকে থামিয়ে বলল,,

“জায়মা যাসনা প্লিজ!”

থমকে দাঁড়ালো জায়মা। পিছু ফিরে চাঁদের আড়ষ্ট মুখপানে তাকালো। তীব্র ছটফাটানির ছাপ ফুটে আছে চাঁদের বিস্তর মুখমণ্ডলে। বড্ড অবাক হলো জায়মা। এই চাঁদ আর একটু আগের চাঁদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে লাগল। জল্পনা কল্পনা ভুলে জায়মা নির্বাক গলায় কিছু বলার পূর্বেই নূর জায়মাকে থামিয়ে দিলো৷ স্বাভাবিক গলায় বলল,,

“জায়মা তুমি এখন যাও! ওর সাথে আমার কিছু পার্সোনাল কথা আছে।”

চাঁদ পূর্বের তুলনায় আরও বেশি শঙ্কিত হয়ে উঠল! বুকটা ধড়ফড় করে কাঁপতে লাগল। নূরের মারাত্নক প্রেমভরা চাহনিতে দৃষ্টি মেলানোর সাহস পেল না সে। অবিলম্বেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো চাঁদ। বুকের চিনচিনে ব্যথা নিয়ে জায়মাকে বলল,,

“না জায়মা যাস না প্লিজ।”

জায়মা পড়ল মহা মুশকিলে! কার কথা ফেলে সে কার কথা রাখবে তাই ভেবে চিন্তিত হয়ে উঠল। চাঁদের থেকে মগ্ন দৃষ্টি সরিয়ে নূর স্বাভাবিক দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বলল,,

“তুমি যাও জায়মা। চাঁদ একটু পরে আসছে।”

হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো চাঁদ। নূরকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই সে জায়মার দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,,

“না জায়মা। তুই কোথাও যাবিনা প্লিজ। আমরা এখন পড়তে বসব। কাল বাদে পরশুই আমাদের পরীক্ষা।”

চাঁদের যাওয়ার পথে বেগড়া দিলো নূর। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো! রাগে গজগজ করে ঘাড়টা খানিক পেছনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো৷ কঠিন গলায় জায়মাকে বলল,,

“জায়মা তুমি যাও প্লিজ। চাঁদ একটু পরে আসছে।”

জায়মা এবার দারুন ভয় পেয়ে গেল। চাঁদের দিকে একবার অপারগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত পা ফেলে সে রুম থেকে প্রস্থান নিলো৷ জায়মার যাওয়ার পথে তাকিয়ে চাঁদ হাত-পা কচলালো চাঁদ। কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগল,,

“জায়মা যাসনা প্লিজ।”

ঝট করে নূর রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলো! ভ্রুযুগল উঁচিয়ে বাঁকা হেসে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। শার্টের কলারটা পেছনের দিকে ঝেড়ে সামনের চুলগুলো ঠিক করল। ব্যাপক ভাব নিয়ে রসাত্নক গলায় বলল,,

“এবার কী করবা হ্যাঁ? কেমনে পালাবা এই নূরের হাত থেকে?”

মুখে হাত চেপে চাঁদ নিরুপায় দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! অসভ্য, নির্লজ্জ, চূড়ান্ত বেহায়া লোক একটা! লম্পটের মতো আচরণ করছে। না জানি সুযোগ পেয়ে কী কী করে বসে আমার সাথে! ভাবসাব ঠিক মনে হচ্ছেনা লোকটার। এই লোকটাকে আমি একদম বুঝতে পারিনা। একটু আগেও তো কেমন প্রেমভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। ধারালো দৃষ্টির নেশায় আমাকে ঘায়েল করে তুলছিল। এখন আবার কোন ভূত চাপল এর মাথায়? এতে আমার কী বাপু? উল্টো পাল্টা কিছু করতে এলেই আমি খালামনিকে ডেকে দিব! তখন দেখব এই লম্পটের ভালোমানুষি কোথায় থাকে। নূর সম্মোহিত হয়ে একটু একটু করে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো৷ চাঁদের স্নিগ্ধ মুখের মায়ায় ক্রমাগত বেসামাল হয়ে উঠল। বুকের চিনচিনে ব্যথাটা গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগল। অস্থির শ্বাস ফেলতে লাগল নূর। চাঁদকে দেখতে পাওয়ার লোভ তাকে সাংঘাতিক মরিয়া করে তুলল। নূরের এই প্রবল রোমাঞ্চিত মুখমণ্ডল দেখে চাঁদ ঘাবড়ে উঠল। অস্ফুটে গলায় বলল,,

“আমাকে যেতে দিন প্লিজ নূর ভাইয়া। আমার পড়তে হবে।”

চাঁদের মুখোমুখি নূর তার অবস্থান গ্রহণ করে নিলো! চাঁদের ভয়ার্ত চোখে মগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঘায়েল করা ভাবসাব নিয়ে আনমনে বলল,,

“আমি তোমাকে পড়াব! ম্যাথ কিন্তু আমি বেশ ভালো বুঝি৷ পই পাই করে হিসাব করে বুঝাব।”

চাঁদ অসম্মতি প্রকাশ করল। ভীতু গলায় বলল,,

“নানাআ। আআমি আপনার কাছে পড়বনা।”

নূর কদাচিৎ হাসল। বাঁকা চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ধীরগতিতে চাঁদের মুখের দিকে খানিক এগিয়ে এলো! মন্থর গলায় বলল,,

“আচ্ছা যাও পড়তে হবেনা। শুধু একবার হাগ করতে দাও তাহলেই হবে!”

চাঁদ ভড়কে উঠল! তাজ্জব গলায় বলল,,

“কী?”

“বাপরে এতো রিয়েক্ট করার কী আছে? সামান্য হাগ’ই তো করতে চাইছি।”

“দেখি সরুন। পারবনা আমি। যা মুখ দিয়ে আসছে তাই বলছে। অসভ্য, নির্লজ্জ, বেহায়া পুরুষ মানুষ কোথাকার।”

রাগে চাঁদ মাথা নুইয়ে নিলো। নূরকে যা তা বকতে শুরু করল। চাঁদের মিষ্টি মধুর বকাঝকাগুলো নূর একটুও গাঁয়ে মাখলনা। উল্টো স্মিত হেসে চাঁদের থুতনিতে হাত রাখল। মুখটা জোর করে টেনে এনে তার মুখের কাছে ধরল। আবিষ্ট গলায় বলল,,

“কী হয় একবার হাগ করলে হ্যাঁ? আমি’ই তো।”

চাঁদ মোচড়ামোচড়ি করতে শুরু করল। নূরের দিকে তেজি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হুমকিমূলক গলায় বলল,,

“আমি কিন্তু এখন খালামনিকে ডাকব।”

“তো? ডেকে কী বলবা?”

“বলব, খালমনি দেখো তোমার ছেলে আমার সাথে হাগ করতে চাইছে!”

“একটু আগে যে কি’সি করেছি ওটা বলবেনা?”

চাঁদ বেকুব দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এ কোন ছেলেরে বাবা? এতো বড় হুমকি দেওয়ার পরেও ভয় পেলনা? উল্টো নিজেকে আরও ফাঁসাতে চাইল? চাঁদের হতভম্ব ভাবভঙ্গি দেখে নূর ফিক করে হেসে দিলো। চাঁদের থুতনিটা ছেড়ে দুষ্টু চাহনিতে চাঁদের ঘাড়ের কাছে থাকা কালো কুচকুচে তিলটার দিকে তাকালো! তিলটার দিকে একই নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে চাঁদের ডান হাতটা টেনে ধরল। হাতের উপরের পিঠে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে মোহিত গলায় বলল,,

“ঐ জায়গার কি’সিটা এই জায়গায় করে দিলাম! মা’কে পারলে এটাও বলে দিও!”

ব্যগ্র হেসে নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! স্পাইক করা চুলগুলো টেনে ধরল। যেতে যেতে রোমাঞ্চকর গলায় বলল,,

“চকলেটগুলো খেয়ে নিও সুইটহার্ট। মুখটা মিষ্টি থাকলেই তবে মুখ থেকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হবে তোমার!”

চাঁদের মাথা ঘুরে এলো! এখনই বুঝি সে অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে। এই কোন নূরকে দেখছে সে! কীসব ঠোঁটকাটা কথা বলছে নূর?

,
,

বহু যুদ্ধবিগ্রহের পর অবশেষে সোহানী ছাড়া পেল নীড়ের হাত থেকে! কাপড়-চোপড় ঠিক করে সে তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলো৷ এতেও আবার বেগড়া পড়ল! ফোন চাপতে চাপতে নীড় ব্যস্ত গলায় সোহানীকে বলল,,

“পরে ফ্রেশ হবে। আগে আমার জন্য এক কাপ কফি করে নিয়ে এসো।”

সোহানী বিরক্তবোধ করল। রাগী দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকালো। খরখরে গলায় বলল,,

“দশটা মিনিট সহ্য হয়না না? এতো অসহ্য লাগলে আমাকে এতক্ষণ আটকে রাখছিলেন কেন?”

“রোমান্স করতে! ইট’স সিম্পল!”

“ছিঃ! মুখে কিছুই আটকায় না আপনার? আপনি এতো নির্লজ্জ জানা ছিলনা আমার!”

“এখন তো জানছ। আরও একটু এদিকে আসো তো! উফফস, আবার রোমান্স পেয়ে বসল!”

বাঁকা হেসে নীড় সোহানীর দিকে তাকালো! মুখমণ্ডলে চরম দুষ্টুমির ছাপ ফুটিয়ে তুলল। রাগে গা পিত্তি জ্বলে উঠল সোহানীর। রাগে গটগট করে সে রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কর্কশ গলায় বলল,,

“অস’ভ্য, ইত’র কোথাকার! জ্বালিয়ে মা’রল আমাকে।”

ফিক করে হেসে দিলো নীড়! হাসতে হাসতেই বলল,,

“এই সোহানী শুনে যাও। এখনও তো অনেক রোমান্স বাকি আছে জানেমান! জামাইকে সেটিজফাইড করবানা?”

,
,

ঘুম ভেঙে ওঠেই আয়মন প্রথমে শাওয়ার সেরে নিলো। সকাল সকাল গোসল করার অভ্যেস তার। মাঝে মাঝে দিনে দু, তিনবারও গোসল করা হয়! গরমের আঁচ একদমই সহ্য হয়না তার। চরম অস্বস্তি কাজ করে। গাঁ জ্বালা-পোঁড়া করে ওঠে। তাই প্রতিদিনকার মতো আজও সকাল সকাল গোসল সেরে সে নিচে একটা হাফ শর্টস পড়ে ভেজা প্যান্ট এবং ভেজা শার্টটা বাড়ির আঙিনায় থাকা দড়িতে ছড়াতে গেল। বেশ ভালো মুড নিয়ে সে কাপড়গুলো ছড়াতে লাগল। গোসল করার পর শরীরটা খুব ফ্রেশ লাগছে তার। মন মর্জিও খুব শান্ত লাগছে। দেখতেও স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে। ভেজা চুল এবং শরীর থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। মৃদু হেসে স্বস্তি প্রকাশ করছে।

কাপড়গুলো ছড়ানো শেষে আয়মন আবারও তার ফ্ল্যাটের দিকে ফিরতেই হঠাৎ চোখ পড়ল বাড়ির মেইন গেইটের দিকে। অমনি তার চোখদুটো রাগে রঙিন হয়ে উঠল! গাঁয়ে লেপ্টে থাকা জলের শীতল কণাগুলো তার শরীরের গরম আঁচে ঝাঁঝালো হতে লাগল! প্রতিশোধপরায়নতা তার মাথায় চেপে বসল। সামনেই তার চিরশত্রু তাশফিয়া এবং তিথী হাসি হাসি মুখে তার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করছে! সহ্যশক্তির বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। অচিরেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার! দুজনকে হেস্তনেস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলো সে৷ আজই শত্রুটার চ্যাপ্টার শেষ করবে সে। এর ফাঁকেই হঠাৎ তার মাহিনের কথা মনে পড়ল! তিথীকে দেখলে মাহিনের মাথা ঠিক থাকবেনা! মাহিন সামনে থাকলে কিছুতেই সে তিথীকে শায়েস্তা করতে পারবেনা। তাই সে এক দৌঁড়ে নিজেদের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হলো। ফ্ল্যাটের দরজাটা বাইরে থেকে লাগানোর বুদ্ধিটা মাথায় চাপল। বুদ্ধি অনুসারে যেইনা কাজ করতে যাবে অমনি মাহিন ঘুমজড়ানো চোখে দরজা খুলে বের হয়ে এলো! যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয় প্রবাদবাক্যটা সত্যি হয়ে গেল! বিস্ফোরিত রূপে আয়মনকে দেখামাত্রই মাহিন হামি তুলল। কী হয়েছে কিছু জানতে না চেয়েই সে চোখ কচলালো। ঘোরে জড়ানো গলায় বলল,,

“ভাই এক কাপ তিথী দে তো! মাথাটা খুব ধরেছে।”

মাথাটা আরও খারাপ হয়ে গেল আয়মনের! রাগে গাঁ রি রি করে উঠল তার। গজগজ করে সে মাহিনকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকিয়ে নিলো। খিটখিটে গলায় বলল,,

“শা’লা তিথীখোর! এই রুমেই বন্দি থাক তুই!”

মাহিন কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই আয়মন বাইরে থেকে দরজার খিলটা লাগিয়ে দিলো! দরজা থেকে মোড় নিতেই সে তাশফিয়া এবং তিথীর মুখোমুখি হয়ে গেল! আয়মনকে শুধু হাফ শর্টস পড়া দেখে তাশফিয়া এবং তিথী গোল গোল চোখে আয়মনের দিকে তাকালো! মুখ হাত চেপে ধরে ভূত দেখার মতো জোরে চিৎকার করে উঠল! বিস্ফোরিত গলায় বলল,,

“আহ্হ্হ্! এসব কী!”

আয়মন তাজ্জব বনে গেল! কী থেকে কী ঘটে গেল তাই তাকে চরম ভাবাতে লাগল? ভয় না দেখাতেই বিরোধীদল ভয় পেতে শুরু করল? এসবের আসল মাজরাটা কী? এর সন্ধানেই লেগে পড়ল আয়মন। তাশফিয়া এবং তিথীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সে তার শরীরের দিকে তাকালো। অমনি তার চক্ষুজোড়া চড়কগাছ হয়ে গেল! থমথমে গলায় বলল,,

“ওহ্ শিট! মেরা তো সাব কুচ লুট গেয়া!”

দু’হাত দ্বারা ধবধবে উন্মুক্ত বুকটা ঢেকে নিলো আয়মন! হাফশর্টস পড়ে সে দু’দুটো মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে? এই লজ্জা সে কোথায় লুকাবে? আগপাছ না ভেবে আয়মন প্রতিশোধপরায়নতা বিসর্জন দিলো! শরীরের সাথে মুখটাও ঢেকে নিলো। দরজার খিল খুলে লজ্জাহত মুখে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়ল! ঘোরের রেশ কাটিয়ে মাহিন উদ্ভট দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী রে? বাইরে কে চ্যাচালো?”

আয়মন রাগে তার চুল টেনে ধরল! শরীর থেকে হাত সরিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“তোর নানী চ্যাচালো!”

#চলবে….?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৪১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“তোর নানী চ্যাচালো!”

মাহিন তাজ্জব বনে গেল। চোখে-মুখে অপার বিস্ময়তার ছাপ ফুটিয়ে তুলল। ভ্রুযুগল খড়তড়ভাবে কুঁচকে আয়মনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সন্দেহজনক গলায় শুধালো,,

“আমার নানী চ্যাচালো কই থাইকা হ্যাঁ? নানী তো সেই পাঁচবছর আগেই মারা গেছে। তোর সাথে কি নানীর জ্বীন-ভূত আছড় হইল না-কি? ভাবসাব আমার কিন্তু বেশ অলৌকিক ঠেকছে!”

হাত-পা ঝেড়েঝুড়ে আয়মনের অবস্থা প্রায় বিভীষিকাময়! ভেতরে মাহিনের ঘ্যানর ঘ্যানর, সন্দেহজনক দৃষ্টি, তিথীকে ঘিরে নানান প্রেমপলাপ। আর বাইরে তার চিরশত্রুরা তাকে ভয় পাওয়ার বদলে উল্টো তাকে দেখে মজা নিচ্ছে, মনে মনে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে, তাকে নিয়ে নানান কটুক্তিও করছে, তার বেঁচে যাওয়া ইজ্জতের দফারফা করছে। যা কল্পনায় আয়মনের চোখে অতি তিক্তভাবে ভেসে ওঠছে! মোট কথা সব মিলিয়ে আয়মনের গাঁ রি রি করছে৷ মাথাটা প্রবল ধরে আসছে। এখনি কোনো একটা চরম প্রতিশোধ নিতে না পারলে তার শান্তি হবেনা। গাঁয়ের জ্বালা গাঁয়েই রয়ে যাবে।

মাহিনকে উপেক্ষা করে আয়মন দ্রুত পা ফেলে তার বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো। মাহিন নির্বোধ দৃষ্টিতে আয়মনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। পেছন থেকে আয়মনকে ডেকে বলল,,

“এই কই যাস তুই? কী হইছে তোর বল তো? পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিস কেন?”

আয়মন এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালোনা। এমনকি পিছু ফিরেও তাকালোনা। তার লক্ষ্যে সে স্থির হয়ে রইল। শাণিত গলায় প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

“একটু সময় দে ভা’তার! তোর জন্য এক কাপ তিথী আনতে যাব! তিথীকে গুলে চায়ের সাথে মিক্স করে খাওয়াব! খুব শখ না তিথীকে খা’ওয়ার? সেই শখ মিটিয়ে দিব!”

মাহিন এবার চটে গেল! তিথীকে নিয়ে কটুক্তি তার গাঁয়ে বেশ জ্বালা ধরালো। সকাল সকাল তিথীকে নিয়ে এহেন অহেতুক বিদ্রুপ তার সহ্য হলো না! তাই সে গলায় কঠোরতা এনে তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে বলল,,

“তোর মাথা গেছে শা”লা। সকাল সকাল লাড়া চাড়া শুরু হইছে! এতো লাড়লে বিয়ে করছ না কেন? বিয়ের বয়স তো কম হইলনা। এখনই কীসব খাওয়াদাওয়া নিয়া পড়ছস! সকাল সকাল গোসল করার অভ্যেসটা ছাড় এবার! ঘুমের মধ্যে খাওয়াদাওয়া বন্ধ কর!”

মাহিনের কোনো কথাই আয়মন কানে তুললনা। এখন তার একটাই লক্ষ্য চিরশত্রু নিধন করা! শর্টস পাল্টে সে এখন প্যান্ট-শার্ট পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মনে মনে তাদের দুজনকে শাস্তি দেওয়ার পন্থা খুঁজতে লাগল! কেন তারা দুজন আজ জেচে এই বাড়িতে এলো তার কারণ জানার জন্য সে ছটফট করতে লাগল। তাড়াহুড়োর কাজ সবসময় দেরি হয় বলেও একটা কথা আছে। যা এখন আয়মনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে! এতে তার রাগ আরও দ্বিগুন বেড়ে উঠছে। আয়মনের যাওয়ার পথ থেকে মাহিন তার ধারালো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাথাটা ঝেড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এক্ষণি তাকে গরম এক কাপ চা অথবা কফি কিছু একটা খেতে হবে। নতুবা মাথায় চেপে বসা প্রচণ্ড ব্যথা তাকে অস্থির করে তুলবে। শরীরটাও ভালো হবেনা। আর মন-মর্জিও ঠিক হবেনা। ধীর পা ফেলে মাহিন ফ্ল্যাটের মেইন ডোর খুলতেই হঠাৎ দু’কদম পিছিয়ে গেল! দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড়িয়ে তাশফিয়া এবং তিথী ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে গেল! তারা দুজনই দরজায় আড়ি পাতছিল! যার কারণে দরজা খোলার সাথে সাথেই দুজন দরজা থেকে সরে এসে আপনাআপনি ফ্ল্যাটের ভেতরে চলে এলো। মাহিন দিনের আকাশে চাঁদ দেখার মতো অবাক হলো! হতভম্ব দৃষ্টিতে তাশফিয়া এবং তিথীর দিকে অস্থির দৃষ্টি বুলাতে লাগল। তাশফিয়া এবং তিথী লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। দুজনই আড়চোখে আড়ষ্ট দৃষ্টিতে দুজনকে দেখতে লাগল। হাত-পা কচলে জড়তা প্রকাশ করতে লাগল। মনে মনে নিজেদের হাজারটা বকা দিতে লাগল। কীভাবে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়িয়ে যাবে তার পথ খুঁজতে লাগল।

মাহিন পুনরায় তার মাথা ঝাড়লো। চোখ কচলে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের দুজনের দিকে তাকালো। আবারও তার চোখকে অবিশ্বাস করল! এসব কী দেখছে সে? সত্যি সত্যিই কী তিথী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? তার প্রথম প্রেম তার সামনে এতটা অভাবনীয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে? আর সে কিনা এভাবে অপ্রস্তুতভাবে নিজেকে তার কাছে জাহির করছে? সামান্য টাউজার আর টি-শার্ট পড়ে? চোখে-মুখে অবসন্নতা নিয়ে? এতোটা উচ্ছৃঙ্খল সে কীভাবে হলো? ইমপ্রেশন তার সব গেল। তিথীকে পটানো আর সম্ভব হলো না বলে! আর এক মুহূর্ত ব্যয় করলনা মাহিন। মুখ লুকিয়ে উল্টা পথে হাঁটা ধরল। বিড়বিড়িয়ে বলল,,

“শিট। হাউ আনস্মার্ট আই এম! কাপড়-চোপড়ের নাই ঠিক। মুখ-চোখের নাই ঠিক। এই লুকে আমি তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম? যদি রিলেশান হওয়ার আগেই ব্রেকআপ হয়ে যায় তখন আমার কী হবে বাপ?”

হায়-হুতাশ করতে করতে মাহিন আয়মনের বেডরুমের দিকে অগ্রসর হলো৷ নিজেকে হ্যান্ডসাম লুকে তিথীর কাছে প্রেজেন্ট করার লক্ষ্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। অমনি তিথী এবং তাশফিয়া হঠকারী দৃষ্টিতে চোখ তুলে মাহিনের যাওয়ার পথে তাকালো। হুট করেই তিথী অপরাধী গলায় পেছন থেকে মাহিনকে ডেকে বলল,,

“ভাইয়া সরি প্লিজ। ঐদিনের বেয়াদবির জন্য সত্যিই আমি খুব লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। আপনি প্লিজ এভাবে আমাকে হতাশ করে চলে যাবেননা ভাইয়া। আমার প্রতি কোনো রাগ, অভিমান বা ঘৃণা পুষিয়ে রাখবেননা।”

মাহিন থমকালো। ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। পিছু না ফিরেই তিথীকে উদ্দেশ্য করে ইতস্তত গলায় বলল,,

“পরে এই বিষয় নিয়ে আমি কথা বলছি। আপনারা প্লিজ বসুন। দশমিনিট সময় দিন আমায়। আমি এক্ষুণি আসছি।”

দ্রুত পা ফেলে মাহিন প্রস্থান নিলো। নিজের ইমেজ রক্ষার্থে ছুটে চলল। তিথী এবং তাশফিয়া দুজন দুজনের দিকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকালো। দুজনই ঠোঁট উল্টিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মৌনতা ভেঙে তাশফিয়া হাফছাড়া গলায় তিথীকে বলল,,

“কী আর করার? চল আমরা বসি গিয়ে। মা ও আমাদের সাথে এলো না! হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল।”

তিথী অস্থির শ্বাস ছাড়ল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“শোন না? ঐ আয়মন ছেলেটাকে আমার মোটেও সুবিধার লাগছেনা! আমাদের দেখেই কেমন ভয়াল হয়ে উঠেছিল। রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ছেলেটা যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে বসে তখন?”

ইতোমধ্যেই আয়মন ফায়ার লুক নিয়ে হনহন করে ড্রয়িংরুমে ছুটে এলো! ডিপ ব্লু রঙের শার্টের হাতজোড়া ফোল্ড করতে করতে সে রুদ্রময় রূপ ধারণ করে তাশফিয়া এবং তিথীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তৎক্ষনাৎ ভয়ে দুজন আঁতকে উঠল! বুকে থুঃথুঃ ছিটিয়ে দুজন হাত ধরাধরি করে অসম্ভব কাঁপতে লাগল। তাদের ভয় দেখে আয়মন বেশ ভাব নিলো। দুজনের দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“এবার চিল্লাইয়া দেখাও! আমাকে নিয়া হাসি-ঠাট্টা কইরা দেখাও।”

তাশফিয়া শুকনো ঢোক গিলে আয়মনের দিকে তাকালো। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সে একটা ভয়ঙ্কর বুদ্ধি মাথায় আনল! থমথমে গলায় আয়মনকে বলল,,

“এবার তো আপনাকে পুরো আগুন লাগছে ভাইয়া! ফিল্মের হিরোদের মতো ডেশিং লাগছে! পুরা কিলার লুক। আমি চোখ বুজে বলতে পারি ভাইয়া, যেকোনো মেয়ে আপনাকে এই লুকে দেখলে আপনার প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেই হবে!”

আয়মন ফুসলে গেল! ক্রোধ ভুলে খানিক চোখে পড়ার মতো লজ্জায় ভুগল! মেয়েদের মতো ব্লাস করতে লাগল। গলা ঝেড়ে শার্টের কলারটা টেনে ঠিক করতে লাগল। তিথী আড়চোখে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। তাশফিয়া বাঁকা হেসে ইশারায় তিথীকে বলল,,

“ব্যাটা পটে গেছে!”

তিথী মুখ চেপে হাসতে লাগল। মনে মনে তাশফিয়াকে বাহবা দিতে লাগল। হাসি বন্ধ করে তাশফিয়া ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। আয়মনকে আরও একটু গলানোর চেষ্টা করল। ঝেড়ে কেশে পুনরায় নাজুক স্বরে বলল,,

“সত্যিই বলছি ভাইয়া আপনাকে আজ একটু বেশিই সুদর্শণ লাগছে! সিরিয়াসলি কথাটা বলার সময় আমার গাঁয়ের লোমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠছিল! মানে ছেলেরা কি এতোটাও সুদর্শন হয়? ওহ্ মাই গুডনেস! আই কান্ট বিলিভ ইট।”

আয়মন বেশ ভাবুক হয়ে উঠল। ভূতের মুখে রাম নাম শুনে তার সন্দেহ যেনো দ্বিগুন বেড়ে গেল। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা তাশফিয়া তার সাথে ছলনা করছে! তাকে লক্ষচ্যুত করার জন্য খামোখা তারিফ করছে। মাথায় পুনরায় রাগ চেপে বসল আয়মনের। হিংস্র দৃষ্টিতে সে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। তটস্থ গলায় বলল,,

“নাটক করো হ্যাঁ? নাটক? কী ভাবছ তুমি? আমি কিছু বুঝি না? বাচ্চাদের মতো পিটার খাই আমি? নাক টিপলে দুধ বের হয় আমার? তুমি যে কথাগুলা বলছ না? এসব কথা আমি খাইও না! আয়মনকে শান্ত করা কী এতোই সহজ?”

তাশফিয়া এবং তিথী পুনরায় ভয় পেয়ে গেল! দুজনই মনে মনে আল্লাহ্’র নাম জপ করতে লাগল। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য দিশা খুঁজতে লাগল। তিথী চাইলেও এই মুহূর্তে রাগ দেখাতে পারছেনা! কারণ, অসুস্থ জেসমিন হক বারবার করে তাকে বারণ করে দিয়েছেন কারো সাথেই যেনো সে খারাপ আচরণ না করে, অহেতুক রেগে না যায়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলে আসে। সেই কথার রেশ ধরেই তিথী দাঁতে দাঁত চেপে সব অপমান সহ্য করে নিচ্ছে। কোনো দিশা খুঁজে না পেয়ে তাশফিয়া এবার ভয়ার্ত গলায় হঠাৎ আয়মনকে বলল,,

“দেখুন ভাইয়া আমি একটু চাঁদ এবং জায়মার সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ একবার সুযোগ করে দিন আমায় তাদের সাথে দেখা করার। কথা দিচ্ছি তাদের সাথে দেখা করেই আমরা আমাদের মধ্যে হওয়া ভুল বুঝাবুঝিটা প্যাচ আপ করে নিব।”

“একসেকেণ্ড একসেকেণ্ড। প্যাচ আপ করা মানে কী বুঝাইলা হ্যাঁ? শুধু কী সরি বলার জন্যই বাঘের গর্তে এসে ঢুকলা? প্যাচ আপ করা কী এতোই সহজ নাকি?”

তাশফিয়া মাথা নুইয়ে নিলো। ভাবনাচিন্তা ভুলে বিষণ্ন মনে নিচু স্বরে বলল,,

“প্রয়োজনে আমরা আপনাদের পা ধরে ক্ষমা চাইব ভাইয়া! মা বলেছেন ক্ষমা চাইতে কোনো লজ্জা নেই।”

আয়মন হু হা শব্দে হেসে দিলো! তাশফিয়ার নিচু হওয়াকে সে হেয়ালিপনা বলে ভেবে নিলো। বুকে হাত রেখে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,

“সিরিয়াসলি? তোমরা আমাদের পা ধরে ক্ষমা চাইবা? এখন এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে ভাই? টোটালি আনবিলিভঅ্যাবল! কেমনে পারো এতো নাটক করতে হ্যাঁ?”

তিথী এবার মুখ খুলল। দৃষ্টি উঁচিয়ে আয়মনের দিকে তাকালো। নম্রতা বজায় রেখে জোরপূর্বক হেসে বলল,,

“আপনি আমাদের ইমোশন নিয়ে হাসি-তামাশা করছেন ভাইয়া? আমরা কি এতোটাই খারাপ যে আমাদের কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা?”

ইতোমধ্যেই তাদের মাঝখানে মাহিনের উপস্থিতি ঘটল! কালো এবং সাদার কম্বিনেশনে আয়মনের একটা চেক শার্ট পড়ে সে নিজেকে মারাত্মক হ্যান্ডসাম লুকে তিথীর সামনে জাহির করল! তিথী আকস্মিক ড্যাব ড্যাব চোখে মাহিনের দিকে তাকালো! এই মার ডালা লুকে মাহিনকে দেখে সে তব্ধিত হয়ে গেল! শার্টের কলারটা সমতল করে মাহিন উপস্থিত তিনজনের দিকে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এলো। তৎপর গলায় বলল,,

“কে কার কথা বিশ্বাস করছেনা হ্যাঁ? কী হচ্ছে এখানে?”

আয়মনের দৃষ্টি সূচালো হয়ে উঠল। মাহিনের গাঁয়ে তার পছন্দের শার্টটা দেখে তার রাগ ওঠে গেল! মাহিনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সে খরখরে গলায় মাহিনের কানে মুখ ঠেকিয়ে বলল,,

“কী রে ভা’তার? নানীকে ইমপ্রেস করার জন্য আমার পছন্দের শার্টটাকেই টার্গেট করলি? দুনিয়ায় আর কোনো শার্ট পাইলি না?”

মাহিন দাঁতে দাঁত চাপল! শাণিত গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“চুপ কর শা’লার ব্যাটা! কখন থেকে কী নানী নানী করছিস? সি ইজ মাই লাভ! মাই প্রেজেন্ট, মাই ফিউচার, মাই ইস্ট, মাই ওয়েস্ট এন্ড অল অফ মাই ওর্য়াল্ড!”

“ভাই থাম থাম। হাসি পেয়ে যাচ্ছে আমার। নূরের মতো তোরও ছ্যাকা খাওয়ার পিনিক ওঠছে বুঝলি? তাই চোখে-মুখে এখন সরিষার ফুল দেখছিস! নেশা কেটে গেলে লাভ শাভও কেটে যাবে।”

,
,

ওয়াশরুম থেকে “ইয়ে” সেরে নূর মাত্র চোখে-মুখে চরম তিক্ততা এবং আড়ষ্টতা নিয়ে কুজো ভঙ্গিতে দরজার বাইরে বের হয়ে এলো! ধীর পা ফেলে সে নিজেদের রুমে না ঢুকে নীড়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। বড়ো সড়ো বিপদের মুখোমুখি পড়েছে সে। যে বিপদ থেকে আপাতত নীড় ছাড়া অন্য কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারবেনা! পথিমধ্যেই হঠাৎ চাঁদের মুখোমুখি পড়ে গেল নূর! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অন্তপ্রাণ চেষ্টা করল। তবে শেষ অবধি তা সম্ভব হলোনা। তাকে পুনরায় প্যান্টের চেইন ধরেই কুজো ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হলো! মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“সাইক্লোনটার এখনই আসার সময় হলো? মান-ইজ্জত আর রইলনা আমার! গেল গেল সব বিসর্জন গেল! প্রেম-ভালোবাসার আগেই সব ইমেজ গোল্লায় গেল!”

চাঁদ কোমরে হাত গুজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নূরকে দেখতে লাগল। মাঝে মাঝে ভ্রু যুগল উঁচিয়ে নূরের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিও নিক্ষেপ করতে লাগল। ফেলুদা’র মতো সন্দেহজনক দৃষ্টি তার। যেনো আটঘাট বেঁধেই সে গোয়ান্দাগিরিতে নেমে পড়েছে! ব্যাপারটায় নূর বেশ হাইপার হলো! চাঁদের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“কী দেখো হ্যাঁ? সামনে থেকে সরো।”

চাঁদ ঘাড়ত্যাড়ামো করল। একচুলও জায়গা থেকে নড়ল না! উল্টো বুকের পাঁজরে দু’হাত বেঁধে ট্যাড়াব্যাকা দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। উদ্বেগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ওখানে হাত দিয়ে কী ঢাকছেন হ্যাঁ? কী আছে ঐ জায়গায়? দেখি দেখি?”

নূর থতমত খেলো। যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো। চাঁদ তার ইজ্জত নিয়েই ছিনিমিনি খেলা ধরল! চাঁদের থেকে অস্থির দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নূর। এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেলে মিনমিনে গলায় বলল,,

“দেখ! কোথায় দৃষ্টি পড়েছে এই মেয়েই। আমিই দিন কী দিন মেয়েটাকে খারাপ করে তুলছি! আদর-সোহাগ করতে করতে লজ্জা কাটিয়ে তুলছি!”

রাগী ভাব নিলো নূর। ভালো কথায় চিঁড়ে ভিজবেনা বেশ বুঝতে পারল সে। তৎক্ষণাৎ চাঁদকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নূর তার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো! আবারও কুজো ভঙ্গিতে নীড়ের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। যেতে যেতে রুক্ষ গলায় বলল,,

“দাঁড়াও আগে বিপদটা সেরে আসি। এরপর আমি তোমার ক্লাস নিব! বেশি পাকা হয়ে গেছ না? ঐখানে কী হইছে এটা পরে দেখাব!”

চাঁদ বেকুব দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মুখটা ফুলিয়ে আশ্চর্যজনক গলায় বলল,,

“যাহ্ বাবা। এর আবার কী হলো? কী লুকালো আমার থেকে? কী এমন বেফাঁস কথা বলে ফেললাম আমি? আমি কী এখন তাকে ফলো করব?”

যে ভাবা সেই কাজ। পা টিপেটিপে হেঁটে চাঁদ পাতি চোরদের মতো নূরকে ফলো করতে লাগল! আজ নূরের কারসাজি সে ধরবেই ধরবে। প্যান্টের চেইন সামলে নূর এক দৌঁড়ে দরজায় কোনো নক-টক ছাড়াই নীড়ের রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল! অমনি নিজের বিবেচকহীনতার জন্য তাকে লজ্জার সম্মুখীন হতে হলো! যা নূর ক্ষণিকের জন্যও ভাবেনি! নীড় এবং সোহানী দুজন দুজনকে ছেড়ে দুই থেকে তিন ফুট দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো! কফি খাওয়ার বাহানা করে নীড় সুযোগ বুঝে সোহানীকে রাগানোর পায়তারা খুঁজছিল। সোহানীকে বারবার শাড়ি ঠিক করতে বেগড়া দিচ্ছিল! এই রোমাঞ্চকর মুহূর্তেই হঠাৎ তাদের নূরের আগমন ঘটল। যা তাদের তিনজনকেই লজ্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো।

উশখুশ করে নূর গলা ঝাড়লো। তৎক্ষনাৎ পিছনের দিকে মুখটা ফিরিয়ে নিলো। লজ্জায় চোখ টিপে বন্ধ করে নিলো। ইতস্তত গলায় সোহানীকে বলল,,

“ভাবী তুমি একটু বাইরে যাবা? ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কাজ আছে!”

সোহানী অপ্রস্তুত হয়ে নূরের দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে সে সম্মতি জানালো। নীড়ের মাথা-মুথা হুট করে গরম হয়ে গেল! এই প্রাইভেট টাইমিংয়ে নূরের আগমন তাকে বেশ ঘাটালো! কী আর করার। পরিস্থিতি তো মানতেই হবে। ছোটো ভাইকে তো আর ধাক্কা দিয়েও রুম থেকে বের করে দেওয়া যাবেনা। সোহানী একবার আড়চোখে নীড়ের গম্ভীরতায় ভরা মুখমুণ্ডলের দিকে তাকালো। অতঃপর সে শাড়ির কুচিটা সামলে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীড় মাথা চুলকে সোহানীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে বলল,,

“এই কাছেই থাইকো। কাজে টাজে লেগে পইড়ো না আবার।”

সোহানী লজ্জা রাঙা মুখে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীড়ের আহ্লাদিপনা দেখে তার খুব হাসি পেল। চোখে চোখে বউকে হারাচ্ছে একদম। যা সোহানী প্রথম থেকেই চাইছিল! নূর মনে মনে বেশ বিব্রতবোধ করল। ধমকের স্বরে নিজেকে বলল,,

“ওহ্ শিট! ভাইয়া-ভাবির প্রাইভেট টাইমেই আমাকে আসতে হলো? মহা আহা’ম্মক তো আমি।”

সোহানী দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে বের হতেই নীড় পিছু ঘুরে রুক্ষ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে রূঢ় গলায় শুধালো,,

“এই কী সমস্যা তোর হ্যাঁ? বিয়ার পরেও আমাকে শান্তি দিবিনা নাকি?”

নূর মুখটা কাচুমাচু করে নীড়ের দিকে এগিয়ে এলো। প্যান্টের চেইনে হাত রেখে বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে নিলো। অসহায় গলায় বলল,,

“চেইনটা লেগে গেছে ভাইয়া! আই থিংক আমার ওয়েট কিছুটা বেড়েছে। তাই কাল থেকেই এই প্যান্টটা আমার কোমরে কেমন চিপা চিপা লাগছে! চেইন খুলতে লাগাতেও অসুবিধা হচ্ছে।”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চাঁদ অট্ট হেসে উঠল! মুখ টিপে ধরে দম ফাঁটা হাসিতে মরে যাচ্ছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাত-পা ঝেড়ে হাসতে লাগল সে। পাশ থেকে সোহানী চাঁদের মাথায় জোরে এক গাড্ডা মারল! দাঁতে দাঁত চেপে মন্থর গলায় বলল,,

“বেশরমের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আঁড়ি পাতছিল কেন হ্যাঁ? দিন দিন তো বড্ড বে” য়াদব হয়ে উঠছিস তুই। কিছু বলছি না দেখে খুব সাহস পেয়ে গেছ না?”

#চলবে…?

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]