#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮
মাথামুন্ডু সবই আপাতত খারাপ হয়ে আছে পৌষ’র। রাগে, দুঃখে কান্না পায় ওর কিন্তু কাঁদে না। তৌসিফ’কে এত করে বলছে ও থাকবে আজ কিন্তু এই মহা লোক মানতে নারাজ, পৌষও আর মানাতে নারাজ। কতক্ষণ তুলুতুলু করবে আর? মানুষের বিবেক থাকা উচিত। এতদিন পর বাবার বাড়ী এসেছে থাকাটা মাস্ট কিন্তু হায় কপাল! এই কপালে জুটেছে তালুকদার বাড়ীর ছোট ছেলে। কপালটাকে মাঝেমধ্যে মন চায় সুপ্রসন্ন ভেবে নিজেই চুমু দিতে আবার মাঝেমধ্যে মন চায় ঝামা দিয়ে ঘঁষে পরিষ্কার করতে। কি এক কান্ড! শা*লার কপালটাই খারাপ। দেখেদুখে এক জামাই জুটেছে। তৌসিফ বউকে দেখছে অনেকক্ষণ যাবৎ। বউটা যেতে রাজি না কিন্তু যেতে তো হবেই। কাল সোহা’র পাঠ চুকাবে তৌসিফ। সংসারে তার শান্তি চাই ই চাই। বউ তার ভালো মন্দ বুঝে। ভলো একটা সুযোগ বুঝেই বাচ্চাকাচ্চা চাইবে তৌসিফ। যদি বউ রাজি হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা আর যদি এখন পড়তে চায়, বাচ্চা পরে চায় তাহলে নাহয় একটু ধৈর্য ধারণ করবে তৌসিফ। জীবনে সে কমতো ধৈর্য ধরলো না। বাবা হওয়ার স্বাদটা নাহয় আর কিছু বছর পরই পেলো। ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো তৌসিফ। দরদ মাখা কণ্ঠে বললো,
— এখন রুমে আছো যে? রাতেই চলে যাব হানি। ভাই-বোনদের সময় দাও এখন।
— আমি যাব না।
কাঠকাঠ একবাক্যে পৌষ’র। তৌসিফ খাটে হেলান দিয়ে বসা। ওভাবে থেকেই স্বাভাবিক ভাবে বললো,
— ইটস ইম্পরট্যান্ট হানি। ট্রাই টু…..
— না না না। আমি কিছুই বুঝব না। যাব না মানে না।
এই দফায় তৌসিফ উঠলো। বউ তার এত জেদী হয়েছে। এসে ধরার আগেই ছ্যাঁত করে উঠে পৌষ। তৌসিফ’কে ছুঁতেও দিলো না। ব্যপারটা একজন পুরুষের জন্য গায়ে লাগার মতো হলো তারমধ্যে সামনের জন স্বয়ং তৌসিফ তালুকদার। দাঁত চেপে অপমানটুকু গিলে নিলো তৌসিফ যা সে বিয়ের প্রথম দিন থেকে গিলছে। একটা টু শব্দ না করে গিলছে সে। শুধু মাত্র পৌষ’র জন্য। প্রথম হয়তো ভালোবাসা ছিলো না কিন্তু এখন? এখন তো তৌসিফ জান হারায় এই পৌষ’র মাঝে। তার রাগ, জেদ সবটা শিরোধার্য। তৌসিফ পৌষ’র হাতটা জোর করে ধরে নরম স্বরে বললো,
— তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে হানি। আমরা আবার আসব। বলছি না আমি? তোতাপাখি আমার না তুমি?
ঝটাক মে’রে হাত সরালো পৌষ। চোখ দুটো তুলে রাগী দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে বললো,
— আপনার বিবেকও বাঁধে না এমন আচরণ করতে? বিয়ের ঠিক কয়মাস পর আনলেন এখানে? আপনিই বলুন। আর সারপ্রাইজ? নিশ্চিত কোন নাইটি ধরিয়ে দিবেন আমার হাতে…….
রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কথাগুলো বলতে নিলেই স্ব জোড়ে এক ধমক খেলো পৌষ,
— অ্যাই চুপ!
আচমকা তৌসিফে’র গলার সুর বদলালো। পৌষ বড়বড় চোখে তাকিয়ে তখনও। তৌসিফ পুণরায় ধমক দিলো,
— চোখ নিচে নামাও!
ভয়ে মিহিয়ে গেলো পৌষ। এই মানুষটার রাগ সে ভয় পায় তাই যথেষ্ট সমীহ করে চলে। তৌসিফের তোপের মুখে বার কয়েক পরেছিলো পৌষ। ভয়ে তার বুকটা এখনও ধুকধুক করছে। মাথাটা নামিয়ে গুটিয়ে গেলো একদম। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো কান্না আটকাতে। কিন্তু সেই কপাল বুঝি আছে তার? চোখ দুটো বেইমানি করে বসলো। পানির ধারা গড়িয়ে পরলো। তৌফিক’কে মন, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ও। তৌসিফ ছাড়া যে ওর গতি নেই তা খুব ভালো করেই জানা পৌষ’র। নিজেকে খুব সাবধানে তৌসিফে’র হাতে সপেছে পৌষ। তৌসিফ অবশ্য মান রাখে। যত্নে আগলে রাখে। পুরুষ মানুষ রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। এখনকার বেয়াদবির ফলে ধমকটাও প্রাপ্ত তার। পৌষ জানে এটা কিন্তু ঐ যে ভয়। তৌসিফে’র ভয় তার আজও কাটে নি।
তৌসিফ তাকিয়ে পৌষ’র পানে। ওর থেকে বেশি না দুই হাত দূরে বসা। চোখে মুখে ভয় তার। কিছুটা আতঙ্ক। তৌসিফ ধমকটা শুধু শুধু দেয় নি। তার বিশ্বাস সম্পর্কে সম্মান জিনিসটা দরকার। একটু বেশিই দরকার। পৌষ’কেও সম্মান করে তৌসিফ। স্বামী হিসেবে হোক বা বয়সের হিসেবে তৌসিফ বড় সেই সুবাদে এহেন উচ্চবাক্য বেয়াদব বৈ কিছুই না। মাঝেমধ্যে অবশ্য তৌসিফের নিজের উপর ই রাগ হয়। বিয়ের পরপরই পৌষ’র সাথে একদিন জঘন্য এক কাজ করেছিলো সে। সেই থেকে হয়তো মেয়েটা ভয় পায় বেশি। রাগ উঠলে তার মাথা ঠিক থাকে না। তবে হ্যাঁ, এতটুকু ভয় কিন্তু সম্পর্কের সৌন্দর্য। এতটুকু ভয় প্রতিটা দাম্পত্য জীবনে দরকার। এটা সম্পর্কের মাধুর্য ধরে রাখে। একটা ব্যালেন্স হয়।
চাইলেই এখন বউকে বুঝিয়ে মানিয়ে নিতে সক্ষম তৌসিফ তবে নিজের পায়ে কুড়াল মা’রার পাবলিক তৌসিফ না। গটগট পায়ে রুম ত্যাগ করলো ও। পৌষ নাক টানলো। মানুষটা কি বেশিই রেগে গেলো? পৌষ কি করবে? ওর যে মুখটা বেশিই চলে একটু। এত বছরের তৈরী করা মুখ চাইলেই কি কম চালানো যায়? সে তো জানে তার তোতাপাখি মন থেকে বলে নি তবুও রাগ কমলো না? নিজেকে অপরাধী ভাবলো পৌষ। মনটা বেজার হলো নিমিষেই। চোখের পানি মুছতেই দেখলো পিহা ঢুকছে। হাসি মুখে আপা’কে দেখেই বললো,
— বাইরে এসো আপা। নাস্তার জন্য ডাকে।
— তোর দুলাভাই কি চলে গেল?
— কই যাবে? দুলাভাই তো চৈত্র ভাইয়ের সাথে বসা। আমরা সবাই আছি। মা পিঠা বানিয়েছে। আসো তুমি।
পৌষ’র বুকটা একটু হলেও শান্ত হলো। ও তো ভাবলো রাগে বুঝি জামাই তার ফুড়ুৎ হয়ে গেলো। সুন্দর মুখো এক জামাই। জ্বালা সব পৌষ’র৷ ভয়ই লাগে। কখন না উঁড়ে যায়। হায়! সে যে কি জ্বালা তা নারী মন বৈ কেউ বুঝবে না। জামাই আগলে রাখাও এক তপস্যার বিষয় যা রোজ করে বেড়াচ্ছে পৌষরাত হক তালুকদার।
_____________________
মাগরিবের আজান দিলো মাত্র। চোখে, মুখে পানি দিয়ে রুম ত্যাগ করলো পৌষ। চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সবসময় অল্পতে বাড়ী মাথায় তোলা পৌষ এখন কান্না লুকাতে জানে। কেউ বুঝলেই জিজ্ঞেস করবে চোখ ফুলার কারণ তখন পৌষ কিভাবে উত্তর দিবে? হাতে নিজের পার্সটা নিয়েই বের হলো। ড্রয়িং রুমে দুমসে আড্ডা চলছে। সবাই বেশ খোশমেজাজে আছে। পৌষ’র বুকটা ফেটে কান্না পায়। সে থাকতে চায় কিছুদিন কিন্তু তৌসিফ মানবে না। একেতো থাকা হবে না তার উপর তৌসিফ উল্টো রেগে গেলো। নাক টেনে উপস্থিত হলো পৌষ। জৈষ্ঠ্য বোনকে দেখেই বলে উঠলো,
— আপা এখানে বসো। দেখো তোমার না ডিম পিঠা পছন্দ।
পছন্দের ডিম পিঠাটাও আজ ওর খেতে মন টানলো না। মনটা তার কাছে আজকাল থাকেই না। তৌসিফ তালুকদার চুরি করেছে সেটা। ব্যাটা পাক্কা চোর একটা। ইনি, মিনি তৌসিফে’র পাশে বসা। তৌসিফ ছিত পিঠায় হাঁসের মাংস দিয়ে শালী দুটোর মুখে দিলো। মিনি আপাকে ডাকলো,
— আপা আপা আথো না।
ইনিও তাল মিলিয়ে ডাকলো। তৌসিফে’র পাশে বসার সাহস পৌষ’র নেই। সবার সামনে যদি তার রাগ প্রকাশ করে বসে তখন?
হেমন্ত হঠাৎ খেয়াল করলো পৌষ’র হাতে ব্যাগ। কপাল কুঁচকে তাকালো ও। জিজ্ঞেস করলো বোনকে,
— কোথাও বের হচ্ছিস?
মাথা নাড়ে পৌষ। হালকা শব্দে বলে,
— চলে যাচ্ছি হেমু ভাই।
এক সাথে অনেকগুলো চোখ তাকালো ওর পানে। তৌসিফ ও তাকালো। মুখে তার বক্র এক হাসির রেখা। ও জানতো এটাই হবে। পৌষ’কে এখান থেকে নেয়া যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন। তখন যদি বউকে ভয় ভাঙাতে বুকে আগলে নিতো তাহলেই এক লাফে তৌসিফে’র মাথায় চড়ে বসতো সে তাই তো তখন রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে এলো। এখন বউ উল্টো নিজে রাজি। হেমন্ত কিছুটা ধমকের গলায় বললো,
— ফাইজলামি করিস? যা ঘরে ব্যগ রেখে আয়। পিহু সোনা তোর আপা’র ব্যাগ রেখে আয় তো।
পিহা দৌড়ে এগিয়ে এলো। ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করলেও পৌষ দিলো না। পৌষ থমকানো গলায় বললো,
— আবার আসব। আজ যাই। কাজ আছে একটু।
শ্রেয়া তৌসিফে’র দিকে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করলো অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
— তুই না বললি থাকবি?
— কাজ আছে ভাবী নাহয় থাকতাম।
তৌসিফ পিঠা মুখে দিলো। ইনি, মিনি খাবে না আর। টেবিল ভর্তি হরেক রকমের পিঠা। বড় চাচা উঠে এলেন। পৌষ’র মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
— কিছু নিয়ে রেগে আছিস আম্মা? থেকে যা না আজ।
চোখ দুটো টলমল করে উঠলো হঠাৎ। বড় চাচার অনুরোধ ভালো লাগলো না ওর। চাচার হাত ধরে পৌষ নরম স্বরে বললো,
— আবার আসব তো।
— বেশি জরুরি?
— হু।
চৈত্র এসে আপার বাহু জড়িয়ে ধরলো। জৈষ্ঠ্য গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রইলো পাশে। পিহা নাক, মুখ লাল করে ফেললো। ইনি, মিনি বুঝলো কিছু হয়েছে। নেমে আপার কাছে এসেই হাঁটু জড়িয়ে ধরলো দুটো। তোতলানো শব্দে বললো,
— আপা? আপা, কি হয়েতে?
চাচিরা তৌসিফে’র মাথায় হাত রাখতে সঙ্কোচ করলেন। মুখেই বললেন,
— বাবা যদি আজ….
তৌসিফ সাধু রইলো বটে। বললো,
— পৌষরাত থাকলে আমার সমস্যা নেই।
পৌষ’র বুক ফেটে কান্না পেলো। পৌষ থাকলে নাকি ব্যাটার সমস্যা নেই। কেন নেই? থাকতে হবে সমস্যা। একশত বার থাকতে হবে।বউ থাকতে তুই ব্যাটা কেন বউ ছাড়া থাকবি?
হতাশ চাচিরা দ্রুত হাতে খাবার প্যাক করলো। তৌসিফ যা যা পিঠা পছন্দ করেছে সব দিলো সাথে। ফোন আসাতে তৌসিফ বিদায় জানিয়ে বের হলো। ও বের হতেই পৌষ ছাড়াতে চাইলো ভাই বোনদের কিন্তু হায় তা বুঝি হয়? কান্নার রোল পরে গেলো মুহুর্তেই। পৌষ শক্ত হাতে সামলালো কিন্তু সম্ভব হলো না। হঠাৎ ই তৌসিফ ফিরে এলো। পৌষ ভেবেছিলো লোকটা ফিরবে না ভেতরে। তৌসিফ এসেই ইনি, মিনিকে কোলে তুললো। আল্লাহ মালুম সে কি বুঝালো তারা থামলো। তৌসিফের দুই গালে দুটো চুমু দিয়ে আদর লাগিয়ে বললো,
— দুলাভাই থাতো না পিলিত।
#চলবে……
সেলিমের হঠাৎ ডাক পরলো। বাইরে আসতেই দেখলো মাহিম দাঁড়িয়ে। হাসি মুখে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে সেলিম। মাহিম বিরক্ত হয়ে ছাড়িয়ে নিলো ওকে। মুখে তিক্ততা নিয়ে বললো,
— গায়ে পরা স্বাভাবে পরিণত হচ্ছে তোর দিনকে দিন।
— বন্ধু রেগে যাচ্ছিস কেন?
— শালা দূরে যা। তোকে দিয়ে এটা আশা করি নি।
— আমার কি দোষ বল? জীবনে প্রথম বউ পেয়েছি। বিয়ে তো করো নি মামা। খাটে বউ দেখলে ভেতরে সুনামি উঠে। মনে হয় সুনামিতে গা ভাসিয়ে নিজেই মরে যাই।
— শালা অশ্লীল।সেলিমের হঠাৎ ডাক পরলো। বাইরে আসতেই দেখলো মাহিম দাঁড়িয়ে। হাসি মুখে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে সেলিম। মাহিম বিরক্ত হয়ে ছাড়িয়ে নিলো ওকে। মুখে তিক্ততা নিয়ে বললো,
— গায়ে পরা স্বাভাবে পরিণত হচ্ছে তোর দিনকে দিন।
— বন্ধু রেগে যাচ্ছিস কেন?
— শালা দূরে যা। তোকে দিয়ে এটা আশা করি নি।
— আমার কি দোষ বল? জীবনে প্রথম বউ পেয়েছি। বিয়ে তো করো নি মামা। খাটে বউ দেখলে ভেতরে সুনামি উঠে। মনে হয় সুনামিতে গা ভাসিয়ে নিজেই মরে যাই।
— শালা অ’শ্লীল।
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৯
গাড়ির এক কোণায় লেগে বসে আছে পৌষ। শেষ বেলায় তাদের থাকাটা হলো না। ইনি, মিনিকে কোন এক জাদু বলে বুঝ দিয়েছে তৌসিফ। পৌষ তো মুখে তালা দেয়া সেই কখন থেকে। মনটাও তার ভার ভার।লোকটা রেগে তার উপর। কথা বার্তাও ততটা বলছে না। শেষবার মনে হয় বুঝি সিট বেল্টটা লাগালো। এই তো। পৌষ তখনকার চোখ গরমই এখনও ভুলতে অক্ষম। ঢোক গিলে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো ও। সারি সারি কাশফুল দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে অবশ্য ততটা দেখা গেলো না। তৌসিফকে নিয়ে ঘুরতে মন চাইলেও পৌষ কথা বললো না। মূলত সাহসটাই হচ্ছে না।
একমনে ড্রাইভিং করছে তৌসিফ। তার নজর সড়কে। একটুও হেরফের হয় নি। মনোযোগ সম্পূর্ণ ড্রাইভিং এ হলেও তার ধ্যান আছে পৌষ’র উপর। চুপচাপ থাকার মেয়ে পৌষ না। তখনকার ধমকে এখনও থমকে আছে ও। তৌসিফ ভেবে নিলো বাসায় গিয়েই মানিয়ে নিবে। সেটা মুশকিল কিছু না অবশ্য।
গাড়িটা বাড়ীর সামনে থামতেই তৌসিফ নামলো। দারোয়ান এসে আগেভাগে পৌষ’র সাইডে ডোর খুলে দিতেই বেরিয়ে এলো পৌষ। সোজা হাটা দিলো উপরে। তৌসিফ সেদিকে নজর দিয়ে ফোন বের করে কাউকে কল লাগালো। কথা বলতে বলতে হাটা দিলো উপরে।
রুমে এসে পোশাক বদলে বারান্দায় চলে এলো পৌষ। শরৎ কাল চলমান। শারদীয় বাতাসে বুনো এক গন্ধ। বাড়ীটার চারপাশই গাছ গাছালিতে ভরপুর। কৃষ্ণচূড়া গাছটা নজর কাড়ার মতো বটে। রাতের আকাশপানে তাকিয়ে পৌষ৷ মেঘগুলো ফুলা ফুলা। ঠান্ডা বাতাস বইছে হঠাৎ ই। বৃষ্টি বৃষ্টি একটা ভাবও বিরাজমান৷ তবে আদৌ বৃষ্টিপাত হবে কি না বুঝা দায়। ঠিক যেমন বুঝা দায় তৌসিফ তালুকদার’কে। এবছর কাশফুল দেখা হয় নি পৌষ’র। প্রতি বছরই এসময় হেমন্ত সব ভাই-বোন নিয়ে বিকেলে বেরিয়ে যায়। দুপুরের রোদ গড়িয়ে যখন বিকেল তখন থেকে সন্ধ্যা অবদি ওর কাঁশবনে ঘুরে। পৌষ’র অবশ্য দিয়া বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো যা কোনদিন পূরণ হয় নি। ইনি, মিনি এতদূর যেতে পারবে না। ওদের নিয়ে সর্বোচ্চ সারিঘাট অবদি যায় হেমন্ত। সেখানেই সারা বিকেল ঘুরে ওরা। খাল জাতীয় জায়গাটাতে নৌকা ভাড়া করে চড়ে বেড়ায়। এবছর বুঝি ঐ আনন্দটা মাটি চাপা যাবে। কথাগুলো ভেবেই ভেতর থেকে চাপা শ্বাস ছাড়লো পৌষ।
সম্মুখে রাখা কেদারায় গা এলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। পুকুর ভরা কচুরিপানা ছিলো যা আজ নেই। হয়তো তারা পরিষ্কার করালো। নৌকাটাও আজ একদম এই সাইডে কিণারায় বাঁধা। পৌষ ততটা ভাবলো না। দেখা যাবে তৌসিফ’কে কিছু বললে দিবে আবার এক ধমক। এমনিতেই লোকটা রেগে আছে। যদিও পৌষ নিজের দোষ স্বীকার করে তবুও অবুঝ মনটা বড়ই লোভী। সে আহ্লাদ পেলেই আহ্লাদী হয়ে উঠে। এই যেমন তৌসিফে’র প্রেমসুধা পানের পর থেকে তার মনে গভীর লোভ জাগ্রত হয়েছে। নিজের দোষ জানা সত্ত্বেও অভিমান জমেছে মনের কোণে। এই অভিমান তালুকদার বাড়ীর ছোট ছেলে ছাড়া কেউ ভাঙতে পারবে না। কিন্তু কথা হলো সেই তৌসিফ তালুকদার কি আদৌ রাগ ভাঙাবে? সে তো নিজেই টম্বুস হয়ে আছে ফুলে।
.
তৌসিফ রুমে ঢুকলো রাত দশটা নাগাদ। ক্ষুধা লেগেছে তার। কাল বাসায় গেস্ট আসবে তার জন্যই মূলত দেড়ী হলো একটু। বউটা সেই কখন থেকে তার অপেক্ষায় আছে। নিশ্চিত নিজেও খায় নি। এতটুকু তো তৌসিফ চেনে তার বউকে। আজ আবার তার উপর অভিমানও করেছে নিশ্চিত। মুখ দেখেই বুঝা যায়। তৌসিফ অবশ্য এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। বেয়াদবি করবা তো ধমক খাবা। মাঝেমধ্যে ধমক খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো আর তৌসিফ খুব করে চায় তার বউ সুস্থ থাকুক।
রুমে ঢুকবে ঠিক সেই সময় আবারও মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। ওর পিএ ইমু কল দিয়েছে। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকে তৌসিফ। সারা রুম জুড়ে নীরবতা। তৌসিফ কানে ফোনটা ধরেই ডাকলো,
— হানি? আর ইউ দেয়ার?
উত্তর এলো না। তৌসিফ লাইন অন করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। বিছানা খালি। ওয়াশরুম ও খালি। ইমুকে গম্ভীর কণ্ঠে তৌসিফ বললো,
— কাল সকাল সকাল পার্লার গার্ল বাসায় পাঠিয়ে দিবে। আর হ্যাঁ, তুমিও চলে এসো। কাজ আছে। আর এখন কল দিবে না।
উত্তরের আশা না করেই খট করে কলটা কেটে দিলো তৌসিফ। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে পরণে থাকা শার্টের বোতাম খুললো দুটো। বারান্দায় যেতেই দেখা মিললো পৌষ’র। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে এলো তৌসিফ। ঘুমন্ত ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কৃয়ংকাল। নিজির অজান্তেই হাত চলে গেল ওর মাথায়। পৌষ’র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্ষীণ শব্দ করে ডাকলো তৌসিফ,
— তোতাপাখি উঠবে না?
ডাকটা শুনলো না। শুনানোর জন্য অবশ্য পৌষ’কে ডাকে নি। নিজে ওর পাশে গা এলিয়ে বসে আলতো হাতে বউকে টেনে নিলো বুকে। অল্প ঘুমে থাকা পৌষ হয়তো কিছুটা সজাগ হলো। নাকে ঠেকলো তীব্র পুরুষনালী গন্ধ। সেই বুকটার উপরের দিকে দুটো বোতাম খোলা। খোলা বুকে তখন লোম উঁকি দিচ্ছে যা আস্কারা দেয় পৌষ’কে। সে মুখটা ঠেকায় উন্মুক্ত স্থানে। বুকে মুখ গুজে চুপ করে রয়। তৌসিফ বউকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। কিছুটা শক্ত করে। কিছুটা নরম হাতে।
মৃদু মৃদু বাতাস বয়ে চলছে তখন। নড়চড় নেই পৌষ’র। তৌসিফ অনুভব করলো বুকে থাকা নারীটিকে যার চাওয়া পাওয়া অতি নগন্য। ওর সিঁথিতে চুমু দিলো তৌসিফ। ডাকলো,
— পৌষরাত?
— হুউ।
— উঠো খাবে না?
— উহু।
— ক্ষুধা লেগেছে হানি।
পৌষ সরে যেতে চাইলো তবে তৌসিফ না ছাড়ায় পৌষ বলে উঠলো,
— ছাড়ুন। আমি রুমে যাই। আপনি খেয়ে আসুন।
— আমি খেয়ে আসব মানে? তুমি খাবে না?
— না।
— কারণ?
— ক্ষুধা নেই।
— মিথ্যা কাকে বলছো?
— সত্যি….
— চুপ!
অতি ঠান্ডা ধমক। পৌষ সরে যেতে চাইলো তবে ছাড়া হলো না তাকে। এক টানে নিজের উপর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তৌসিফ। রুমে নিয়ে ধপ করে ফেললো খাটে। নরম তুলতুলে গদিতে ব্যথার ব টাও লাগলো না পৌষ’র কিন্তু তৌসিফ যখন ওর উপর চড়াও হলো তখন একটু ব্যথা পেলো বটে।
তৌসিফ’কে নিজের উপর দেখে মুখ ঘুরায় পৌষ। অনীহা তাও কি না তৌসিফে’র প্রতি? সেটা আবার এক রাতে? মানা যায়? উহু। তৌসিফ মানে না। ঘুরানো মুখটা হাত দিয়ে নিজের বরাবর করে ও। দৃষ্টি পৌষ’র চোখের দিকে। পৌষ বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। অল্প স্বরে বললো,
— উঠুন। ব্যথা পাচ্ছি আমি।
— ব্যথা পাচ্ছো? কই কাল রাতে তো এরচাইতেও বেশি ওজন সহ্য করেছো?
লজ্জায় লাল রঙা হতে পারলো না পৌষ। অতটা ফর্সা সে না। তৌসিফ ওর এক গালে হাত দিয়ে বললো ভেজা নরম স্বরে,
— তখনকার ধমকটা তোমার পাওয়া ছিলো পৌষরাত। আশা করি এটা তুমিও জানো। আমি তোমার কত বড় তা তো জানো। সেই সুবাদেও তোমার আমাকে চোখ তুলে উচ্চবাচ্য তাও কি না ওমন ফালতু কথা বলার সাহস থাকা উচিত না। আর কি বলেছিলো নাইটি? সিরিয়াসলি হানি? এতটা বছর নারী ছাড়া ছিলাম আমি। কখনো চরিত্র খারাপ করি নি অথচ একরাত তোমার কাছে আসাতে কি বললে তুমি?
অনুমতি তো তুমি অনেক আগেই দিয়েছিলে আমি সময় দিয়েছি তাতেও তবুও তুমি এই কথা বললে আমাকে? স্বামী’কে এসব বলা কি বেয়াদবি না? আর বেয়াদবি করলে কি তোমাকে শাসন করার অধিকার আমার নেই? বাকিসব স্বামীদের মতো এখন তোমার কাছে নিচু হয়ে সরি বলতে পারছি না পৌষরাত। ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাব আমি।
টলমলে চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে রইলো পৌষ। ওর দোষ তো ও জানে তবুও মনটা বড্ড বেইমানি দেখালো আজ। তৌসিফ যে এতটা হার্ট হয়েছে তা ও বুঝতে পারে নি। বুঝলে অন্তত নিজে অভিমান করে থাকতো না। তৌসিফ ওর উপর থেকে সরে যেতে নিলেই পৌষ আটকালো। তৌসিফ অবশ্য ছাড়িয়ে নিলো। বিছানা ছাড়তে নিলেই আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পৌষ। পিঠে চুমু দিয়ে ক্ষীণ স্বরে জানায়,
— সরি।
তৌসিফ উত্তর দেয় না অথচ ওর ঠোঁটে চোরা হাসি। তৌসিফে’র উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো পৌষ। লোকটা কি বেশিই রেগে আছে? পৌষ ওকে ছেড়ে সামনে এলো। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বললো,
— ফ্রেশ হবেন না?
তৌসিফ নিরুত্তাপ। ওর উদাসীনতা আঘাত করে পৌষ’কে। ওর জামাই যে একটা ধরিবাজ তা ধরতে পারে না পৌষ। তাই তো জামাই এর মন মানাতে এত কাজ করছে। শার্ট খুলে দিতেই হাটু গেড়ে বসে পৌষ। তৌসিফে’র সু আর মুজা খুলে রেখে আসে। তৌসিফ ততক্ষণে ওয়াশরুমে। টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে পৌষ। কপাল একটা। জামাই কি মান ভাঙাবে উল্টো জামাই এর মান ভাঙাতে তৎপর পৌষ।
তৌসিফ বের হতেই টাওয়াল এগিয়ে দিলো পৌষ। নিজের চুলগুলো খোঁপা করে বললো,
— চলুন খাবেন।
তৌসিফ ভাবশালীন ভাবে তাকিয়ে গা ঝাড়া ভাবে বললো,
— তুমি যাও।
পৌষ হতাশ হলো। এ কেমন মেয়েদের মতো জেদ? তেল না দিয়ে পৌষ বেরিয়ে গেলো। তৌসিফ হতবাক হলো। বউ কি তাকে পাত্তা দিলো না? এটা কিছু হলো? পাত্তা পেতে তখন মরিয়া তৌসিফ তালুকদার ঠিক তখনই তার ছটফট করা হৃদয় শান্ত হলো। খাবার হাতে পৌষ এসেছে। টেবিলে বসে তৌসিফে’র হাত ধরে বসালো। মেখে মুখে তুলে দিলো তো গিললো তৌসিফ। পৌষ হতাশ! খুবই হতাশ! জামাই পেয়েছে একখানা। পুরাই চমলোক্ক।
খাওয়া শেষ হতেই নিজে খেয়ে রুমে এলো পৌষ। তৌসিফ আধ শোয়া হয়ে বসা বিছানায়। পৌষ চুপচাপ গিয়ে তার পাশে বসলো। লাইট অফ করে তৌসিফে’র পাশে শুতেই হঠাৎ টের পেলো ওর পা দুটো কারো শক্ত পা দ্বারা বদ্ধ। মৃদু শ্বাস ফেললো পৌষ। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলো,
— বুকে এসো।
পৌষ মাথাটা বুকে রাখতেই তৌসিফ আচমকা বো’ম ফাটালো,
— কাল সোহার বিয়ে। মেহেদীর সাথে। পারিবারিক ভাবেই আপাতত বিয়ে সেরে তুলে দিব কাল।
বাকরুদ্ধ, হতভম্ব, বিস্মিত পৌষ। আচমকা খুশি সে এতটাই হলো যে কথা বলার ভাষা পেলো না।
#চলবে…..
#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪০
রাত বিরাতে এহেন খবর দিয়ে পৌষ’কে আক্কার মা চক্কা বানিয়ে দিলো তৌসিফ। খবর দিলোও সে অদ্ভুত ভাবে। শিরোনাম বলে এখন বিস্তারিত বলছে না আর নাই জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলো পৌষ নিজে। অত বড়সড় খবর দেয়া মাত্রই পৌষ যখন ঝটকা খেলো তখনই তৌসিফ ওকে আটকে নিলো নিজের সাথে। গালে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে নরম স্বরে আবদার জুড়ে দিলো,
— তোমার আরজি কাল গ্রহণ হচ্ছে হানি এবার আমার আরজি শুনাই?
এ যেন কোন মহা আহবান নিয়ে এলো তৌসিফ। পৌষ মুহুর্তে বোকা বনে গেলো। চঞ্চলা মনটা যখনই একের পর এক প্রশ্ন করতে চাইলো তখনই বাঁধা পরলো তৌসিফে’র বাহুর ভাজে। চঞ্চল মনা কন্যার মন প্রাণ দেহ জুড়ে তখন বয়ে গেলো শুধু প্রেম আর প্রেম। পৌষ সাড়া দিলো গভীর ভাবে। সারাদিন ফটর ফটর করা পৌষ স্বামীর আদর পেলেই নেতিয়ে যায়। ঠিক যেন ঘাসের বুকে লুকিয়ে থাকা লজ্জাবতী গাছটা যাকে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতেই সে জুবে যায়। তৌসিফ এই বিষয়টা খুব উপভোগ করে অবশ্য। বউটা তার এমন মুহুর্তে তাকে সাপোর্ট করে। পারে না যদিও সে কঁচু তবুও যে সাড়া দেয় তাতেই বা কম কি?
তৌসিফ কৃতজ্ঞ স্বামী। সে জানে তার বউয়ের মন কখন কি চায়।
বাইরে আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে তবে আবছা। মেঘের মাঝে তারা আড়াল হয়েছে আজ। শরৎ কালটাও এবার খুবই ব্যাতিক্রম। এই শরীর ঝলসানো গরম আবার এই বৃষ্টি। বিকেল হতেই মন মাতানো বাতাস। রাত হতেই আবার তারা আদল বদলায়। চাঁদটা বেহায়ার ন্যায় হা করে তাকিয়ে থাকে। আবহাওয়ার উষ্ণতায় যখন হাজারো প্রেমিক স্বামী তার প্রিয়তমার প্রেমসুধা পানে ব্যস্ত তখনই চাঁদটা উঁকি দেয়। তার নজর থেকে আড়াল হতেই বদ্ধ ঘরে প্রেম বিনিময় ঘটে। বলা তো যায় না, ঝলসানো সেই রুটির মতো দেখতে ভরাট চাঁদটার যদি নজর লেগে যায়?
ফিসফিস করে কানে শব্দ এলো পৌষ’র। চোখ দুটো লেগে আসতে চাইলো বারবার কিন্তু ঘুমানো গেলো না। তৌসিফ দিলো না অবশ্য। পৌষ মুচড়ে সরতে চাইলেও লাভ হলো না। শক্ত বুকটার মাঝে সে খুব জটিল ভাবে আটকে আছে। তৌসিফ আচমকাই ওর ওর কপালে চুমু দিলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো পৌষ। তৌসিফ আদুরে ভাবে জড়িয়ে ধরলো ঠান্ডা উষ্ণ দেহটা। গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে আদর মিশ্রিত স্বরে জানতে চাইলো,
— খারাপ লাগছে?
— উহু।
— ঘুমিও না হানি।
— আচ্ছা।
বলেই বুকের মাঝে ঘুমাতে চাইলো। তৌসিফ চেয়ে রইলো ওর পানে। এতটা ভালো ওর কপাল তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না। ভাগ্য বড্ড সহায় হয়েছে ওর উপর। প্রথম বার জীবনে ধোঁকা খেয়ে তৌসিফ কিন্তু মোটেই ভেঙে পরে নি। পুরুষ মানুষ সে। শক্ত ভাবে গড়ন তার। সামান্য নারী ধোঁকা তাকে ভাঙতে সক্ষম নয়। অথচ কপাল গুনে এই পৌষ পেয়ে গেলো ও। ছলনা, কপটতা বা কলুষিত মন কোনটাই তার নেই। সে প্রেম বুঝে শুধু। একাকিত্ব বোঝে। সবসময় তোতাপাখির মতো কথা বলা পৌষটা কোথায় চুপ থাকতে হবে তাও বুঝে। পিয়াসী থেকে একদম ভিন্ন তার বুকে থাকা তোতাপাখিটা। এমন না তৌসিফ তুলনা করে। আসলে তুলনা করা সম্ভব না তবে ঐ যে মস্তিষ্ক এটা বারংবার তৌসিফ’কে জানায় সে কতটা অন্ধকারে ছিলো। টাকা পয়সা, সুখ কি না দিলো তবে ছলনাময়ী রইলো না। মূলত তার সুখ সয় নি। তৌসিফ তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলো,
— কুকুরের পেটে ঘি সয় না।
আধ ঘুমে থাকা পৌষ’র কানে ঢুকলো না। ঘুমটা যেন ফুঁস করে উঁড়ে গেলো। টেনে কোনমতে চোখটা খুলে বললো,
— আ..আমি ঘুমাই নি। জেগে আছি। কি করব?
আচমকা কথায় তৌসিফ ভ্রুঁ কুঁচকায়। মস্তিষ্ক ধরতে পারে না হঠাৎ কি হলো। যখনই বুঝলো পৌষ’র কথা তড়িঘড়ি করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,
— তোমাকে বলি নি আমি হানি। আই ওয়াজ জাস্ট রিকল সামথিং। নাথিং রিলেডেট টু ইউ।
— ওহ।
ছোট্ট একটা উত্তর দিলো পৌষ যা সন্তুষ্ট করতে পারলো না তৌসিফ’কে। ভেতরে আচমকাই খারাপ চিন্তা এলো। ভুল বুঝলো কি ওর পৌষ ওকে?
পৌষ উঠতে চাইলেই তৌসিফ পেছন থেকে ধরে। পৌষ আস্তে করে বললো,
— পানি খাব।
— আমি দিচ্ছি।
পাশ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— ক্ষুধা লেগেছে?
পৌষ উত্তর দেয়ার আগেই তৌসিফ লাইট জ্বালালো ওমনিই হলদেটে আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠলো চারপাশ। চারপাশের সাদা এবং সোনালী রঙের দেয়ালটায় আভিজাত্য ফুটে উঠলো। পৌষ এক পলক তাকিয়ে বললো,
— উঠব।
তৌসিফ সময় গড়াতে দিলো না। ঝট করে বউটাকে কোলে তুলে নিলো। কপালের মাঝখানে গভীর মিষ্টি একটা চুমু দিয়ে বললো,
— একটা খারাপ মানুষের কথা মনে পরেছিলো তাই কথাটা মুখ দিয়ে বের হলো। এখন বলো তোমার মনটা খারাপ দেখাচ্ছে কেন? আদর কম পরলো নাকি?
পৌষ মুখটা প্যাঁচার মতো করলো। তৌসিফ গলাটা জড়িয়ে ধরলো আচমকা। তৌসিফ বউকে শক্ত করে ধরে আছে। আচমকাই তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো ও। পৌষ গলা থেকে মুখটা সরিয়ে নিয়ে পুণরায় চুমু দিলো জখম করা স্থানে। এক পাটি দাঁত বের করে হেসে আদর মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— খারাপ লাগছে জামাই?
চালাক তৌসিফ মুহুর্তেই ধরে ফেললো কাহিনি। পৌষ’র গলায় নজর দিতেই দেখলো লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ। বউটাকে আদর সে মন প্রাণ খুলেই করে তাই বলে বউটা কি সুন্দর প্রতিশোধ নিলো। তৌসিফ বিনিময়ে পৌষ’কে বুকে চেপে ওয়াশরুম ঢুকতে ঢুকতে বললো,
— না তো খারাপ লাগছে না।
— তাহলে আরেকটা দেই?
অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো পৌষ। তৌসিফ ওর নাকটায় একটা চুমু দিয়ে বললো,
— একটা কেন একশটা দাও। আমিতো পুরোটাই তোমার। একদম আপ টু টো।
পৌষ লজ্জা পেলো বটে। বেহায়া লোক। লজ্জা দিলো পৌষ’কে। পৌষ ওর গালাটা জড়িয়ে রাখলো। পানির শব্দ শোনা গেলো বাইরে গেলে তার সাথে শোনা যাচ্ছে তৌসিফে’র পুরুষ শব্দে করা গুনগুন যা ইহকালের একমাত্র শ্রোতা পৌষরাত হক তালুকদার।
________________
দুটো হাঁচি দিয়ে থামলো পৌষ। রাত এখন প্রায় বারোটার উপর। চুলের তয়লাটা খুলে মাথা মুছে নিলো পৌষ। তৌসিফ এখনও আসছে দেখে পৌষই বাইরে গেলো। কিচেনে শুধু মাত্র একটা টাউজার পরা তৌসিফ। নাভীর নিচে থাকা টাউজারটার ডুরি দুটো ঝুলে আছে। পেছন থেকে বড়ই সুন্দর দেখালো তাকে। হাতের মাসল গুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে। চওড়া কাঁধের সুন্দর পুরুষ। পৌষ’র মনটা আন্দোলিত হলো। বলেকয়ে একখানা জামাই তার। মনটা মাঝেমধ্যে চায় বয়সে বড় এই জামাইটার কাঁধে ঝুলে থাকতে এতে মানুষ তাকে বান্দর বললেও সমস্যা নেই। আবার মাঝেমধ্যে মনটা চায় তৌসিফ’কেই নিজের কোলে বসিয়ে রাখতে আর বলতে, “আপনি সারাদিন এভাবেই থাকুন, আমি দেখব আপনাকে মন ভরে”।
পুরুষের প্রেম ভয়ংকর তবে নারীর প্রেম ভুবন ভুলানো। এই যে মনের গহীনে এত এত প্রেম কিন্তু পৌষ তা প্রকাশ করতে অপারগ। বড়ই আফসোসের বিষয় এটা।
এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেলো পৌষ। পেছন থেকে গালটা রাখলো তৌসিফে’র উন্মুক্ত পিঠে। তৌসিফের চলন্ত হাতটা তখন থেমে। বুয়া আজ পৌষ’র জন্য রান্না করে নি। মূলত রান্নার ঐ বুয়া আজ আসে নি। তার স্বামী অসুস্থ। দুই দিনের ছুটি চেয়েছে। কাল হয়তো চলে আসবে তাই রান্নাটা এখন তৌসিফ ই করছে। নুডলসে মশলা দিয়ে তৌসিফ অনুভব করলো পিঠের গালটাতে। পৌষ আস্তে ধীরে রয়েসয়ে নিজের শরীরের ভরটাও তৌসিফে’র উপর দিয়ে দিলো। তৌসিফ চুলার গ্যাসটা একদম কমিয়ে দিলো। পেছন দিকে হাত দিয়ে ধরলো পৌষ’কে অতঃপর নিজের কাছে এনে বুকে টেনে নিলো। ভেজা চুলে হাত গলিয়ে দিলো অতি যত্নে। ডাকলো নরম স্বরে,
— পৌষরাত?
— হু।
— বেশি খারাপ লাগছে?
— উহু।
— দূর্বল দেখাচ্ছে হানি।
— মাথাটা গোল গোল ঘুরছে। উঠে দাঁড়াতেই সব ঘোলা লাগলো।
তপ্ত শ্বাস ফেলে তৌসিফ। আজ দুপুরে মেডিসিনটা মিস গেলো। তৌসিফে’র একদমই খেয়াল ছিলো না আর পৌষ নিজে কোনদিন সেঁধে নিজের খেয়াল রাখবে না।
পৌষ দুই হাতে জড়িয়ে রাখলো তৌসিফ’কে। পুরোটা তৌসিফ ওর ছোট বাহুতে আটে না তাই যতটুকু পারলো হাত মেলে দিলো। তৌসিফ একটা বড় প্লেটে নুডলস সার্ভ করলো। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
— হাঁটতে পারবে? কোলে তুলি?
— পারব তো।
তৌসিফ মানলো না অবশ্য। পৌষ’কে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বললো,
— প্লেট হাতে নাও।
হাত বাড়িয়ে নিলো পৌষ। তৌসিফ হাটা দিলো রুমে। পৌষ’কে খাটে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। চামুচে নুডলস পেঁচিয়ে মুখে দিলো পৌষ। ঝাল ওর পছন্দের। লোকটা জানে সেটা তাই তো ঝাল দিয়ে বানিয়েছে। তৌসিফে’র রান্নার হাত ভালো।
পরবর্তী চামুচটা তৌসিফে’র সামনে দিতেই তৌসিফ মুখ খুলে খেয়ে নিলো। খেতে খেতেই বললো,
— তোমার সাথে থাকতে থাকতে অভ্যাস আমারও না হয়ে যায় হানি।
— হলে হবে।
— আমার বডি নষ্ট হয়ে যাবে তো।
— হোক তাতে কি? কাকে শো অফ করবেন আপনি হ্যাঁ? কাকে দেখাবেন এই পেটানো শরীরটা? কি কথা বলুন। বলেন না কেন? নিশ্চিত আপনার মধ্যেই সমস্যা আছে নাহলে মেয়ে মানুষ আপনাকে দেখলেই কেন ইটিশপিটিশ করতে চাইবে?
তৌসিফ অবাক হলো। ও কি বললো আর পৌষ কি বুঝলো? রাগে গপাগপ গিলছে লুডুলস। তৌসিফ ভাবলো ওকে আর দিবে না কিন্তু নাহ। বউ এর তার মন বড় তাই তো রাগ করেও তার মুখের সামনে দিলো। তৌসিফ খেতে খেতে বললো,
— বডিটা তো তোমার জন্যই ঠিক রাখি।
চকিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো পৌষ। সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— মানে?
বলেই সুড়ুৎ করে লুডুলস টেনে নিলো।
— ইশ!
তৌসিফ এহেন শব্দ করতেই পৌষ না বুঝে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হলো?
— লুডুলসটা খেয়ে নিলে?
— তো?
— আমি নিতাম।
ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে পৌষ। তৌসিফ চামুচে নুডলস তুলে পৌষ’র মুখে দিলো অতঃপর ওখান থেকে নিজে একটা নিলো। পৌষ এই কাহিনি সিনেমায় দেখেছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা যে এতটা সুন্দর হবে তা ওর জানার বাইরে। টুপ করে ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে তৌসিফ বললো,
— মেডিসিন খাবে কাল দুপুরে। আমি ব্যাস্ত থাকলেও খেয়ে নিও। আর হ্যাঁ তোমার ড্রেস কাল সকালে চলে আসবে।
— আপনি না বললেন বাসায়ই হবে।
— হবে তো।
— তাহলে আবার এসবের কি দরকার?
— একশ বার দরকার। আমার বউ সবচাইতে বেশি সুন্দর লাগবে। তার সৌন্দর্য আমি আজীবন দেখব৷ চোখ জুড়াব।
পৌষ হাসলো একটু তবে মুখে নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করলো না।
.
সব গুছিয়ে বিছানায় এলো তৌসিফ। পৌষ’কে বুকে নিতেই একবার ভাবলো বাচ্চার কথা তুলবে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো এভাবে শুকনো মুখে বাবু চাইলে কেমন দেখায়? এত বড় একটা উপহার তো এমনি এমনি চাওয়া যায় না। তৌসিফ একটু বন্দবস্ত করেই চাইবে।
পৌষ ওর বুকে আঁকিবুঁকি করছে আঙুল দিয়ে। পৌষ’র তাড়নায় তৌসিফ বলে উঠলো,
— উস্কানিমূলক ছোঁয়া দিচ্ছ কিন্তু হানি। পরে আমার দোষ দিও না কিন্তু।
— খারাপ লোক!
— আমি কি করলাম?
পৌষ মুখ ঝামটা মে’রে সরতে চাইলো। বলতে লাগলো,
— একটু আগে কি করেছেন হ্যাঁ? এখন আবার বলছেন? সরুন। ছাড়ুন আমাকে। আআআআআ ছাড়ুন বলছি। ধরবেন না।
— আরে আরে কি কোথায় যাচ্ছো? তোতাপাখি, এই দেখো আমি ভদ্রলোক হয়ে যাচ্ছি। আহা পৌষরাত। আচ্ছা বাবা আর জ্বালাব না৷
কিসের কি পৌষ থাকবে না। এদিকে তৌসিফ ও ছাড়বে না। শেষমেষ ওর বুকের মাঝেই আটকা পরলো তোতাপাখিটা। তৌসিফ সযত্নে তাকে বক্ষপিঞ্জরের মাঝে আটকে নিলো।
_________________
সকাল থেকে বিয়ের তোরজোর চলছে। সোহা রুম থেকে বের হয় নি এখনও৷ সেদিকে অবশ্য তৌসিফ মাথা মা’রছে না। সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে শুধু। তাওহীদ বা তৌফিক আদৌ আসবে কি না আসবে তা তাদের ব্যাপার। তৌসিফ বলার দরকার বলেছে। মিনু’কে ডাক দিতেই ও এগিয়ে এলো। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— সোহা’কে বল ওর জন্য শাড়ী পাঠিয়েছে মেহেদী তাই কাল যেই লেহেঙ্গা এনেছে ওটা আজ না পড়তে।
মিনু মাথা নেড়ে চলে গেলো বলতে। রুমে বসে অবশ্য সোহা শুনেছে। বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে রইলো ও শাড়ীটার দিকে। লাল রঙের একটা জামদানী শাড়ী। কতই বা মূল্য হবে এটার? পাঁচ অথবা দশ হাজার অথচ সোহা বাসাতেই এরচেয়ে দামি পোশাক পরেছে। তার শাড়ীগুলো ব্যান্ডের কিন্তু এই শাড়ী দেখেই বুঝা যাচ্ছে নিউমার্কেট থেকে আনা। কোথায় বিয়ে দিচ্ছে তৌসিফ তাকে? কে সে যার বিয়ের জন্য বউকে এত কম দামি শাড়ী দেয়? সোহা গায়ে তুলবে তো দূর ছুঁয়ে ও দেখবে না।
রাগে ফুঁসতে থাকা সোহা জানলোও না কারো সারাদিনের খাটনির টাকা দিয়ে কেনা এই শাড়ী। হুট করে বিয়েতে এর থেকে দামি কিছু কেনার সামর্থ্য তার নেই। তার খুব শখের কিছু বিক্রি করে শাড়ীটা সে কিনেছে নাহয় মাসের শেষ দিকে একজন চাকুরীজিবী কোথায় পাবে টাকা?
#চলবে……