প্রেমসুধা পর্ব-৬২+৬৩+৬৪

0
769

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬২

— এই কাজটা আপনি কেন করলেন মেহেদী? আমাকে কোন দায়ে ফেলতে চাইছেন আপনি? আর কত মাফ চাইব আমি? আমি কি এত বড় ভুল করলাম যার মাফ নেই?

সোহা একনাগাড়ে বললো কথাগুলো। তার বুকটা ওঠা-নামা করছে। মেহেদী বাসা পাল্টাতে চাইছে। নতুন বছরে নাকি নতুন বাসায় উঠবে। সোহা তখন থেকেই নানান ভাবে ওকে নিষেধ করছে কিন্তু মেহেদী শুনতে নারাজ। ও কিছুতেই শুনছে না। অগত্যা সোহা তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে। মেহেদী বরাবরই শান্ত। আজও শান্ত ভাবে সোহা’র হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে নিলো। ঠান্ডায় জমে আছে তা। মেহেদী ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— আমি নিজের সাথে ওয়াদা করেছি সোহা যেই পর্যন্ত আমার সন্তানকে ভালো রাখতে না পরব ঐ পর্যন্ত তাকে ছুঁয়ে দেখব না। আমি ওকে ছুঁতে চাই সোহা। তুমি আমাকে সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছো আমার অসহায়ত্ব। সেদিন আমার এত বছরে প্রথম মনে হয়েছিলো আমি গরীব। আমরা কখনো না খেয়ে থাকি নি সোহা। সবই তো আছে শুধু উচ্চ বিলাসিতা নেই। আমি জানতামই না গরীবদের বাবা হতে নেই। একদমই জানতাম না৷ আমি তো ভাবতাম গরীবরাও বাবা হয় যেমন আমার বাবা। গরীব আমি যেভাবেই হোক টাকা কামাব সোহা। যতদিন আমার শরীরে বল আছে ততদিন আমি কাজ করব৷ আমার সন্তানকে আমি ভালো রাখতে চাই সোহা।

সোহা মেহেদী’র হাত ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে ওর পায়ের কাছে বসলো। দুই পা চেপে ধরে বললো,

— আমাকে কি মাফ করা যায় না?

— পা ছাড়ো সোহা। উঠো।

— বলুন, মাফ করা যায় না?

— তুমি ভুল করো নি।

— মেহেদী, আমার ভুলের শাস্তিটা এত বড় কেন হচ্ছে? আপনি কি বুঝতে…..

কাকুতি করা সোহা’র শরীর টলতে লাগলো৷ মেহেদী ওকে পা ছাড়তে বললেও সোহা ছাড়ছে না। ও ধীরে ধীরে ঢলে পরে। মেহেদী ঘাবড়ে গেলো। তারাতাড়ি বসে সোহা’কে কোলে তুললো। জোরে ওর মা’কে ডাক দিতেই তিনি দৌড়ে এলেন৷ সোহা’কে দেখে চমকালেন প্রচুর। তারাতাড়ি বিছানায় শুয়িয়ে দিলো সোহা’কে। মেহেদী অস্থির হয়ে বললো,

— মা, মা ওর কি হলো?

— ডাক্তার ডাক। তারাতাড়ি যা।

মেহেদী যায় না। ও সোহা’কে কোলে তুলতেই ওর মা ধমকে উঠে। মেহেদী ভরা চোখে তাকিয়ে বলে,

— হসপিটালে নিতে হবে আম্মু।

— রাখ ওকে। এখন এসব স্বাভাবিক। ফার্মেসী থেকে ডাক্তার ডাক শুধু।
.
অতিরিক্ত চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে সোহা। ডাক্তার শুধু বিশ্রাম করতে বলেই বিদায় নিয়েছে। মেহেদী’র মা ওর পাশে বসে গরম ভাত খাওয়ালেন। সোহা চুপচাপ খেয়েছে। পাশেই মেহেদী মাথা নিচু করে বসা৷ ওর মা বুঝলেন স্বামী- স্ত্রী’র মাঝে দন্ধ চলছে। কারণ তিনি জিজ্ঞেস করলেন না শুধু যাওয়ার সময় বললেন,

— মেহেদী, বাইরে আয়। দুধ গরম করে দেই সোহা’র জন্য।

চুপচাপ মায়ের পিছু গেলো মেহেদী। সোহা তখন পেটে হাত দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাস যাতে না আসে তাই বন্ধ করা। সোহা’র মন চাইলো জানালা খুলে দিতে। একটু ঠান্ডা বাতাস গায়ে মাখতে।
মেহেদী’র মা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,

— তুই কি ঝগড়া করেছিস সোহা’র সাথে? জ্ঞান কেন হারালো মেহেদী? দেখ, এই সময় মেয়েদের মন এমনিতেই ভালো থাকে না। ওর সাথে সময় কাটাবি কি উল্টো তুই রাতভর বাইরে থাকছিস। সময় থাকতে মূল্য দে মেহেদী নাহয় পস্তাবি।

মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনে মেহেদী চলে গেলো। সোহা’র পাশে দুধ রেখে দরজা আটকে এলো মেহেদী। দু’জন চুপচাপ। মেহেদীই বললো,

— দুধটা খেয়ে নিতে।

— ভালো লাগছে না।

— খেতে হবে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সোহা বললো,

— আপনি কি বের হবেন?

মেহেদী মাথা তুলে তাকালো। বললো,

— তুমি কি চাও?

— না।

— তাহলে যাচ্ছি না৷

— আমাকে বুকে নিবেন মেহেদী?

— হুঁ।

মেহেদী পা তুলে কম্বলের নিচে ঢুকে গেলো। বুকে টেনে নিলো সোহা’কে৷ সোহা অল্প স্বরে কেঁদে ফেললো৷ মেহেদী সোহা’র কাঁধে মুখ গুজে কেঁদে ফেললো৷ সে সুখে থাকতে চায়। ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘরই যথেষ্ট সুখে থাকতে।

________________

পৌষ আর কিছুতেই এখানে থাকবে না। তৌসিফ এত বুঝালো কিন্তু না ওর দফা এবং দাবি একটাই আর সেটা হলো অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ। যে করেই হোক সুন্দর এই দেশটায় ও থাকবে না৷ তৌসিফ দুই দিনের সময় চাইলো কিন্তু পৌষ তাতেও নানান ভাবে জ্বালাতন করছে। ওর নাকি এখানে গা চুলকাচ্ছে। তৌফিক হতাশ চোখে তাকালো। পৌষ তখন ইচ্ছে করে গলা চুলকাচ্ছে। তৌসিফ কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,

— চামড়া উঠে যাবে। কি শুরু করলে?

— সত্যি বলছি চুলকাচ্ছে। এখানে থাকা যাবে না৷

— হোটেল বদলাই তাহলে।

— দেশ বদলান।

— আগামী কাল লাস্ট একটা হেয়ারিং আছে। থাকাটা একটু জরুরী হানি নাহয় তোমার কথাই শুনতাম।

পৌষ বুঝে গেলো ডাল এখানে গলবে না। ইচ্ছে করে চুলকে গলাটা লাল বানালো ও। তৌসিফ মগটা সাইড টেবিলে রেখে বিছানায় উঠলো। নিজের ঠান্ডা হাতটা পৌষ’র গালে রাখতেই ও ত্যাড়া হলো। সরে গিয়ে বললো,

— ঠান্ডা।

তৌসিফ বাঁকা হাসে। তার চোখে দুষ্টামি। পৌষ’কে টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে ঠোঁটে চুমু দিয়ে খুব ধীরে সে থুতনিতে ঠোঁট রাখলো। চাপ দাঁড়ির স্পর্শে কাতর হয় পৌষ। তৌসিফ অতি যত্নে গলায় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। উষ্ণতায় চারপাশ ভরে উঠে। পৌষ তৌসিফে’র কাঁধ আঁকড়ে ধরে বলে,

— কি করেন?

তৌসিফ যথেষ্ট থেকেও চালাক পুরুষ। সে উত্তর করলো না বরং পৌষ’র পিঠটা নিজের বুকে লাগালো। পেছন থেকে গলায় আদর দিতেই পৌষ খেই হারিয়ে ফেললো। বরাবরের মতো এবারও তৌসিফ তাকে ঘায়েল করে ছেড়ে দিলো। ঠিক মাঝ সমুদ্রে। পৌষ খেই হারিয়ে ফেললো। ঘুরে বসে তৌসিফে’র দুই গালে নিজের হাত রেখে যথারীতি গালে, ঠোঁটে চুমু খেলো৷ তৌসিফ আদর নিতে তখন ব্যাস্ত। পৌষ হাপিশ নয়নে তাকাতেই তৌসিফ তার হৃদকম্পন জাগানো হাসিটা উপহার দিলো।
পৌষ লজ্জা পেলো। তৌসিফ উঠেপড়ে তখন লেগেছে বউয়ের লজ্জা ভাঙাতে। অতি যত্নে। খুব নীরবে।

ফেরী টেইলের মতো খুবই রোম্যান্টিক এক রাত কাটলো তাদের। আজ তৌসিফ ছিলো বেপরোয়া। তার আদর সামলাতে গিয়ে বড়ই ক্লান্ত আজ পৌষ। চোখ বুজে এখনও ঠাই শুয়ে আছে। ঠান্ডার এই শীতের রাতে প্রিয় পুরুষের বুকে ঘুমানো আসলে একটা ফ্যান্টাসি। প্রতিটা নারী এটা অনুভব করতে চায়। আস্ত একটা মানুষে’র উষ্ণতা নিছক কম নয়। একটি দেহের ভাজে আরেকটি দেহ যখন লুকিয়ে পরে তখন কিন্তু মুহুর্তটা কাটানো কঠিন। শীতের রাতে এই ইচ্ছে, আকাঙ্খা যেন বৃদ্ধি পায়। পৌষ আরামে গুঙিয়ে উঠে। তৌসিফ ওর মাথায় চুমু খায়। দৃষ্টি তার সম্মুখে। কাঁচের জানালা ভেদ করে বাইরে ঝলমলে দৃশ্য নজর কাড়ছে তার কিন্তু বুকে থাকা এই সুখের দলা যেন তার সকল ইচ্ছে ত্যাগ করাতে বাধ্য করে। মন চায় এখানেই সমাধি হোক। প্রিয় মানুষটার বুকে।
.
— আমিও চলি?

এই নিয়ে তৃতীয় বার প্রশ্নটা করলো পৌষ। তৌসিফ’কে তৈরী হতে দেখেই ও সাথে যেতে চাইছে। তৌসিফ বুঝলো বউ তাকে একা ছাড়তে চাইছে না৷ পৌষ’র মন পড়া শিখেছে তৌসিফ বহু আগে৷ ওর ভাবনা পিয়াসী। ওর সাথে তৌসিফে’র দেখা হোক সেটা কিছুতেই মানতে নারাজ পৌষ। না চাইতেও তৌসিফ বললো,

— কানটুপি পরে নাও পৌষরাত।

পৌষ’র মুখটা চকচক করে উঠলো। খাট থেকে এক লাফে নেমে তৌসিফ’কে জড়িয়ে ধরলো৷ তৌসিফ আগলে নেয়। কপালে চুমু দিয়ে বলে,

— লাফিও না হানি।

— ঠিক আছি আমি।

হাসিমুখে জানায় পৌষ। তৌসিফ তবুও ভরসা পায় না৷ ওর আয়োডিনের ঔষধ চললেও ওর দূর্বলতা তৌসিফ টের পায়। হয়তো চঞ্চলতার ভীরে কেউ টের পাবে না কিন্তু তৌসিফে’র চোখেও ফাঁকি দিতে পারবে না।

ওদের গাড়ি থামলো কোর্টের সামনে। পৌষ বেশ অবাক হলো। কোথায় ওদের কোর্টের সামনে তো এমন দৃশ্য থাকে না৷ কত সুন্দর নীরব একটা জায়গা। কোন কালো পোশাক পরা লোক নেই। ওরা ভেতরে যেতে অবশ্য পৌষ কালো পোশাকের লোক দেখলো। তৌসিফ একহাতে পৌষ’কে ধরে আরেক হাতে কিছু পেপার সাইন করলো৷ তারা বেশকিছুক্ষণ কথা বললো। আগামাথা ততটা পৌষ বুঝে না৷
হঠাৎ পিয়াসী উপস্থিত হলো সেখানে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে এক চোখ ঘুরানি দিলো পৌষ। পিয়াসী অবাক হলো৷ এই মেয়ে একটা বদর তা বুঝতে দেড়ী হলো না৷
পিয়াসী নরম স্বরে বললো,

— তৌসিফ ওর শাস্তিটা একটু কমাতে চেষ্টা…

— প্রশ্নই উঠে না। আমাকে তুমি খুব ভালো করে চিনো। ঠিক ততটা ভালো করে চিনো যতটা চিনলে এটা জানো যে শাস্তি কমাব না আমি। সো সময় অপচয় করো না এখানে।

উঠে যেতে নিলেই তৌসিফে’র হাত ধরে পিয়াসী। তড়িৎ বেগে খামচে ধরে পৌষ ওর হাত৷ ব্যাপারটা ঘটলো কারেন্টের গতিতে। পিয়াসী আর্তনাদ করে উঠে৷ তৌসিফ দেখলো পৌষ আরেক হাত বাড়াচ্ছে। চট করে বুঝে নিলো ও চুল টেনে ধরবে। পেছন থেকে ওর কোমড় চেপে সরালো তৌসিফ। পৌষ তবুও হাত ছাড়লো না। পিয়াসী নিজের আরেক হাত দিয়ে পৌষ’র বাহু শক্ত করে ধরে ছাড়াচ্ছে। উকিলটা অবাক হয়ে আছে। তৌসিফ এবার ধমক দিলো,

— ওর হাত ছাড়ো পৌষরাত।

— ছাড়ব না৷ ওর সাহস কত আমার জামাই’র হাত ধরে। তোর হাত ভেঙে আরেক হাতে ধরিয়ে দিব৷ চিনিস আমাকে? পৌষরাত হক আমি!

বহু কষ্টে হাত ছাড়ালো তৌসিফ। পিয়াসী দেখলো ওর হাতের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে এই মেয়ে। তৌসিফ পৌষ’কে নিজের সাথে ঝাপ্টে রেখে বললো,

— পিয়াসী, দূরে থাকার চেষ্টা করো। তোমার কৃতকর্ম তোমাকে আজ এখানে এনেছে। স্টে এওয়ে।

তৌসিফ পৌষ’কে নিয়ে চলে গেলো। পিয়াসী সেদিকে তাকিয়ে রইলো৷ এই তৌসিফ তার ছিলো। তার কথায় চলতো এই তৌসিফ। পিয়াসী হারিয়েছে। স্বেচ্ছায় সবটা হারিয়েছে।
.
গাড়িতে চুপচাপ দু’জন। পৌষ ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো একবার। এক হাত বাড়িয়ে তৌসিফে’র হাতে রাখতেই তা সরিয়ে দেয় ও। পৌষ’র মনে মনে রাগ হয়৷ রাগী কণ্ঠে বলে,

— কি প্রাক্তন’কে খামচি দেয়ায় রাগ হলো বুঝি?

তৌসিফ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাতেই দাঁত বের করে হাসে পৌষ। ডাকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে,

— অ্যাই মামাতো ভাই।

আচমকা গাড়ি ব্রেক কষলো। হুমড়ি খেয়ে পরতে নিয়েও বেঁচে গেলো পৌষ। তৌসিফ ওর সিট বেল্ট খুলে নিজের কোলে টেনে বসালো। পৌষ’র হাত কাছে নিয়ে বললো,

— এটার দরকার ছিলো?

— ব্যথা পাই নি।

— হ্যাঁ, আমি তো কানা৷

পিয়াসী শক্ত করে ধরে ছাড়াতে গিয়ে নিজেও নখ বিঁধিয়ে দিয়েছে পৌষ’র হাতে। তৌসিফে’র শক্ত হওয়া চোয়ালে পৌষ চুমু দিলো। বললো,

— অ্যাই জামাই, সতীন আমাকে খামচি দিয়েছে।

বলেই খিটমিট করে হাসতে লাগলো পৌষ। তৌসিফ ও হেসে ফেললো। এই মেয়ে এত পাঁজি কেন?
তৌসিফ ওর চুলের পেছনে হাত দিয়ে মুখোমুখি করলো। ফিসফিস করে বললো,

— সারাটা হানিমুন আদর খেলে তবুও মামাতো ভাই লাগে আমাকে?

#চলবে…

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬৩

তৌসিফ পৌষ থেকে দিন দুই সময় চাইলেও তা মিললো না। টিকেট কাটা শেষ। শেষমুহুর্ত পর্যন্ত তৌসিফ চেষ্টা করেছে যাতে এখানে টিকা যায়। আর কিছুদিন হানিমুন কাটাতে তার বড়ই ইচ্ছে। কপালে বউ জুটেছে জাঁহাবাজ। একে হাজার ফন্দি করেও আঁটকে রাখা যাচ্ছে না। উল্টো ফন্দি আঁটিয়ে সে তৌসিফ’কে আটকে নিবে। তৌসিফ নারাজ এতে। তার মন চায় বউ নিয়ে পাখি হয়ে উড়াল দিতে। প্রসস্ত আকাশের বুকে বিচরণ করতে তার তোতাপাখি নিয়ে। সারাটাক্ষন ঐ পাখিটাকে আদর, যত্ন করতে। আপাতত পৌষ’কে নিয়ে রাত্রি বিলাস করতে বাইরে এসেছে তৌসিফ। সুন্দর রাস্তায় সুন্দর একটা জুটি। পৌষ অবশ্য সোজা হাটছে না। ও হাটছে এদিক ওদিক হয়ে। তৌসিফ হাত ছাড়া করে না। তার ডান হাতের ভাজে পৌষ’র হাত ধরা। ছোট্ট একটা পাথর দেখে পৌষ এগিয়ে গিয়ে লাথি মা’রলো। বললো,

— এভাবে যদি সতিন টাকে শর্ট মা’রতে পারতাম। আহা, আমার কলিজাটা জুড়িয়ে যেতো।

তৌসিফ মুখ ভার করে। এই মেয়ে’র কি খারাপ লাগে না? সতিন ডাক শিখেছে নতুন নতুন। ঠিক যেন সদ্য বুলি শেখা এক তোতাপাখি যাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে এই ডাক। ডাক আয়ত্ত করে এখন সে বারংবার এটাই ডেকে চলে। তার আর কোন চাওয়া নেই। পাওয়া নেই। শুধু ডাক কেন্দ্র করেই সে তৌসিফে’র বুকে হুল ফুটাচ্ছে। ঠিক যেন এক ভোমরা। মনে মনে তৌসিফ উচ্চারণ করলো,

“কালো ভোমরা।”

পৌষ কপাল কুঁচকে তাকালো৷ তৌসিফ ভরকালো। মনে হচ্ছে পৌষ শুনে নিয়েছে সবটা৷ তৌসিফ অবাকই হয়। ও কি না বউ ভয় পায়? এটাই কি বাকি ছিলো জীবনে? পৌষ শিষ বাজালো। তৌসিফ তাকাতেই ভ্রু উঁচু করে বললো,

— কি ভাবেন?

— তোমাকে।

— আমি তো কাছে।

— আরো কাছে চাই আমি।

— কতটা?

— যতটা পারা যায়।

বলতে বলতে কিছুটা দূরত্ব কমায় তৌসিফ। পৌষ চট করে ওর নাকের ডগায় চুমু খেয়ে সরে গেলো। তৌসিফ হেসে ফেললো। চঞ্চলা পৌষ তখন এদিক ওদিক দেখছে। তৌসিফ কাছে টেনে হাটা ধরে। পৌষ শান্ত হয়। তৌসিফে’র বাহুতে মাথাটা রেখে হাটতে থাকে তাল মিলিয়ে। বুক ভরে শ্বাস টানে৷ তারা বিদায় নিবে। এই দেশে আসবে না আর পৌষ। কখনোই না৷ যেই দেশে অতীত থাকে সেই দেশ ত্যাগেই সুখ। এসব দেশে অভিশাপ বয়ে আনে। ঐসব পিয়াসী শুধু ধ্বংস করতে জানে। তারা গড়া জিনিস নষ্টে বিশ্বাসী। নষ্ট করতে তারা পছন্দ করে।
পৌষ এসব চায় না৷ সে চায় সুখে থাকতে। সে প্রেমে পড়েছে। এই তৌসিফ তালুকদারের প্রেমে পড়েছে। গভীর সেই প্রেম। সেই প্রেমের অতলের তলা নেই। পৌষ ভাবে, যেই পুরুষের সাথে তার মানানসই বলতে শুধু বিপরীত লিঙ্গ বৈ কিছুই না সেই পুরুষ’কে কিভাবে সে এতটা চাইতে লাগলো? কিভাবে প্রেম সাগরে ডুবতে লাগলো। এখনও পৌষ ভেবে কুল পায় না, এই অসমবয়সী, দাম্ভিক, গম্ভীর কণ্ঠের অধিকারী পুরুষটাকে কিভাবে এতটা ভালোবাসলো পৌষ।
কিভাবে সে অধিকার পেলো ঐ চাপ দাঁড়িতে হাত রাখতে? কিভাবে সে অধিকার পেলো তার চিকন ওষ্ঠাধর ঐ হালকা কালচে গোলাপি ওষ্ঠাধরে রাখতে? কে দিলো ঐ বিশাল বুকে মাথা রাখতে?
পৌষ’র চোখ ভিজে উঠলো। হঠাৎ বুকে ভয় চাপলো।আচমকা পানিও গড়িয়ে পড়েছে। তৌসিফ দেখার আগেই পৌষ মুছতে নিলো তবে অপারগ ও। তৌসিফ দেখে নিয়েছে। ডান হাতে চোখ মুছতে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে তৌসিফ প্রশ্ন করলো,

— কিসের পানি?

— ভয়।

— আমাকে?

— ভাগ্য’কে।

তৌসিফ পৌষ’কে বুকে জড়ালো। অসমবয়সী অথচ সবচাইতে সুন্দর এক দম্পতি যাদের এক আঁচল পরিমাণ আছে শুধু সুখ। যারা পাশাপাশি হাঁটছে। হয়তো এটা একটা সুন্দরতম রাত। হয়তো পৌষের মন তাকে আগাম বানী শুনালো তার ভবিষ্যতের। হয়তো তার ভালোবাসার অথৈ সাগরে খুব শিঘ্রই আগমন ঘটবে জলচ্ছাসের। হয়তো তারা বেখবর।

তৌসিফ পৌষ’কে নিয়ে বসলো। সামনে কিছু ক্যাফে খোলা। তৌসিফ কফি আনতে যেতেই পৌষ দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। তার কান্না পাচ্ছে। তার মন বলছে সামনে আজকের রাত আসবে না৷ ঝরঝরে কেঁদে ফেললো পৌষ। শব্দহীন। দাবালো নিজেকে ও। তৌসিফ জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দিবে? অকারণেই কাঁদছে। পৌষ জানে না তার মন খারাপের কারণ।
ও চোখ মুছলো। গলা ঠিক করলো। তৌসিফ ততক্ষণে ফিরে এসেছে। তার মুখে হালকা আভায় হাসি। পৌষ তাকিয়ে রইলো। তার যেন তর সয় না৷ মন চায় নিজের মাঝে একে লুকিয়ে নিতে। একান্ত নিজের করে রাখতে।
তৌসিফ এসেই আন্দাজ করে ফেললো। তার বউ কেঁদেছে কিন্তু কারণ জানা নেই। তৌসিফ আচমকা পৌষ’কে এক হাত আদর দিলো। সারা মুখ ভর্তি আদরে আহ্লাদী হয় পৌষ। তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,

— কেন কাঁদে আমার তোতাপাখি?

— জানি না তো। শুধু মনে হয় আপনাকে ভালোবাসি।

— আমিও তো ভালোবাসি।

— আজকে ভালোবাসবেন?

— শুধু আজকে না, রোজ প্রতিটা নিঃশ্বাসে তোমাকে ভালোবাসি আমি পৌষরাত। কিভাবে বুঝাই?

পৌষ শান্তি পায়। তার মন শান্ত হয়। দূরে অচেনা পাখি গান করছে। রাস্তায় ভায়োলিনের সুরে সবটা ভুলে পৌষ। সবটা। আজ তাদের মাঝে শুধু আনন্দ আর এক বুক ভালোবাসা। তৌসিফ ওর কপালে চুমু দিলো। পৌষ মুখ তুলে তাকালো। বললো,

— একটা নামতা বানিয়েছি। শুনবেন?

তৌসিফ বুঝি না করে? সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। পৌষ বললো,

“চুম্মা একে চুম্মা
চুম্মা দ্বিগুণ এ উম্মা
তিন চুম্মায় পাপ্পি
চার চুম্মায় ঝাপ্পি”

হঠাৎ এহেন নামতা শুনে তৌসিফ হতবাক। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো অতঃপর সেকেন্ডের ব্যবধানে গা কাঁপিয়ে হেসে ফেললো। তার হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে। পৌষ মুগ্ধ নয়নে তাকায়৷ তৌসিফে’র যেন হাসি থামে না৷ পেটে হাত চেপে বলে,

— না জানি আমার বাচ্চাদের কোন নামতা তুমি শিখাও হানি৷ আই কান্ট….

বেচারা হাসির দাপটে বলতে পারলো না। তার হাসি দেখে পৌষও হাসলো। মুচকি হাসি।

#চলবে….

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬৪

আজ দুই দিন পার হলো দেশের মাটিতে ফিরে এসেছে তৌসিফ। এসেছে থেকে বেড়েছে তার কাজের চাপ। গোছানো হাতে গড়া তার কোটি টাকার ব্যাবসা। চাইলেই খামখেয়ালি দেখানো যাচ্ছে না। হাজার লোক থাকলেও নিজের তদারকি যদি সঠিক না থাকে তাহলে সেই কাজে আয় উন্নতি থাকে না। এটাই নিয়ম। এটাই সত্যি। সমস্যা বেঁধেছে ভিন্ন জায়গায়। দেশে আসা মাত্র অসুস্থ হয়েছে পৌষ। ঠান্ডার দেশে খাপ খায়িয়ে ফেললেও দেশের অল্প ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপানো জ্বর চলে এলো। তৌসিফ চাইলেও ততটা সময় দিতে পারছে না৷ কাল রাত ভর বুকে নিয়ে শুয়েছিলো। পৌষ মাঝরাতে উঠে বমি করলো। তৌসিফ সকালেই ডাক্তার দেখিয়েছে। তেমন কিছু না যদিও তবুও তৌসিফ চিন্তিত। কেন একটা মানুষ এত অসুস্থ থাকবে? তারমধ্য একটু মনমালিন্য চলছে তাদের মাঝে। এই অসুস্থ শরীরে পৌষ চাচার বাসায় যেতে চাইছে। টুকটাক টুকটাক করে শপিং করেছে সে ভাই-বোনদের জন্য। কথাটা অবশ্য মিথ্যা। শপিং গুলো তৌসিফ করিয়েছে। পৌষ তার ভাই-বোনদের জন্য জমিয়েছে একগাধা হাবিজাবি। তৌসিফে’র ভাষায় সেগুলো হাবিজাবি হলেও পৌষ’র কাছে তা অমূল্য রত্ন। সে প্লেন সহ হোটেল থেকে নানান জিনিসপাতি হাতিয়ে নিয়েছে। হোটেলের রুমের সাদা তয়লা কখন যে চুরি করলো তৌসিফ জানে না৷ দেশে এসে দেখলো। নরম এক কুসন ছিলো তাদের খাটে সেটা আবদি কাপড়ের ভাজে লুকিয়ে এনেছে। ফিরার পথে প্লেনে তার মরিমরি অবস্থা অথচ যতটা পেরেছে লুটপাট করেছে সে। এখন এগুলো বিলাবে তার ভাই-বোনদের মাঝে। রাতে জ্বরে ম’রে অথচ তৌসিফ’কে বলে,

— শুনুন, কাল ওদের দিতেই হবে। বাসি হয়ে যাবে নাহয়।

তৌসিফ রাগে কথা বলে নি। একবার তো চাইলো রাগের বহিঃপ্রকাশ সে পৌষ’কে বুক থেকে সরিয়ে করবে কিন্তু জ্বরে পুড়া বউ সে সরাতে পারে নি। শীতের রাতে উষ্ণ তার বউ, যাকে জড়িয়ে ধরে তৌসিফ চোখ বুজেছিলো।

ফোন হাতে তুলে কল করতেই তা রিসিভ হলো। ধরেছে মিনু। ধরেই সালাম দিয়ে জানায় সে মিনু। তৌসিফ কপাল কুঁচকায়। কোনভাবে যদি পৌষ জানে তার ফোন মিনু’র হাতে গিয়েছে তাহলে মিনু’কে কি করবে তা তো পরে দেখার বিষয় তার আগেই সে তৌসিফ’কে ঝাড়বে। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

— পৌষরাত কোথায়? ওর ফোন তুমি ধরলে যে?

— মামা, ছোট ভাবী বাইরে গেলো মাত্র। ফোন খাটে ছিলো। কাপড় রাখতে এসে দেখলাম তাই তুলেছি।

পৌষ বাইরে গিয়েছে শোনামাত্র তৌসিফে’র মেজাজ বিগড়ালো। এই অসুস্থ শরীরে কোথায় গেলো ও? তৌসিফ কত করে বুঝালো ওকে। কথা শোনে না ও। আজ তৌসিফ তাকে রাগ দেখাবে। এত আদরে রাখার পরও কেন এই অবাধ্যতা?
রাগ চেপে মিনু’কে জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় গিয়েছে বলেছে? গাড়ি নিয়েছে সাথে?

— গাড়ি লাগবে কেন মামা? ছোট ভাবী তো বাড়ীতেই আছে।

— মানে?

— নিচে হাঁটতে গেলো মনে হয়। ঘাটের দিকে দেখেছি ছাদ থেকে।

তৌসিফ ফোঁস করে দম ছাড়লো। ফোন কেটে দিলো। ডান হাতটা ঘাড়ে ডললো কিছুক্ষণ। কাঁধ ব্যথা করছে তার। ইমু’কে ডেকে কাজ বুঝিয়ে তৌসিফ বেরিয়ে গেলো৷ তার মন বলছে পৌষ’র এখন তাকে দরকার। নিশ্চিত একা একা খারাপ লাগছিলো তাই হয়তো বাইরে বেরিয়েছে।
.
“পৌষ।”

নারী কণ্ঠের ডাকে পিছু ফিরে পৌষ। আভিজাত্যের ছাপে জর্জরিত একজন নারী দাঁড়িয়ে সামনে। তৌসিফে’র ভাবী হন সম্পর্কে। পৌষ’র কপাল কুঁচকে গেলো৷ মেজাজ খারাপ হলো। এত সুন্দর বিকেলে কেন এই উজবুক মহিলার চেহারা দেখতে হবে? পৌষ’র চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। মহিলাটি তা বুঝলো। তৌহিদে’র বউ হাসলো। পৌষ’র বড়ই আশ্চর্য লাগে। পা থেকে নাক পর্যন্ত স্বর্ণে মুড়ে আছেন উনি। বাড়ীর মধ্যে কে পরে এগুলো? পৌষ’র এখন হাসি পেলো। কেমন আশ্চর্য লাগছে তাকে দেখছে। মিরা এগিয়ে এলো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

— হানিমুন কেমন কাটলো?

পৌষ অবাক হলো। সবাই জানে তারা হানিমুনে গিয়েছে? কই তৌসিফ মিয়া তো বললো না তাকে। উত্তর না পেয়ে পৌষ’র বাহুতে হাত রাখে মিরা। পৌষ চমকালো। বললো,

— ভালো।

— ঘাটে বসবে? নাহলে চলো হাটি?

পৌষ সরাসরি নাকচ করে,

— যেতে হবে আমাকে।

— তোমার স্বামী আসতে দেড়ী হবে না? এতদিন পরে বেরিয়েছে। নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে? আচ্ছা, চলো তাহলে উপরে যাই। অনেকদিন যাওয়া হয় না৷

পৌষ’র অবস্থা এখন সামনে কুয়ো পিছনে খাল। ও কিছুতেই মিরা’কে নিজেদের ফ্লাটে নিতে চাইছে না। কেন জানি ভালো লাগে না৷ তাই ভেবেচিন্তে বললো,

— আচ্ছা, তাহলে এখানেই হাটি।

— ঘাটে?

— না। হাটি শুধু।

এই ঘাট নিয়ে পৌষ চরম অপমানিত হয়েছিলো তৌসিফ থেকে যদিও পরে সে নৌকা দিয়ে পৌষ’কে ঘুরিয়েছে কিন্তু প্রথম ভয়টা এখনও চাপা কাজ করে তার মাঝে। তৌসিফ’কে ভয় সে আজীবন পাবে। মুখ চালালেও তার ভেতর টিপটিপ করে এই লোকের ভয়ে। পৌষ বুঝতে দিতে চায় না কিন্তু চালাক তৌসিফ বুঝে ফেলে। মামাতো ভাই কি না৷

মিরা’র কথায় পৌষ’র ধ্যান ভাঙলো।

— কোথায় কোথায় ঘুরলে পৌষ?

— অনেক জায়গাই ঘুরেছি। নাম মনে নেই।

— ভাইয়া, গিফট দিলো না?

— দিয়েছে।

— কি দিলো?

— অনেককিছু।

— ও বুঝেছি বলতে চাইছো না। তাই তো? আচ্ছা থাকুক। এই দেখো এই আংটিটা তোমার ভাসুর দিলো। ডায়মন্ডের। সাথে ম্যাচিং ইয়ার রিং আছে। তবে কাজ ভারী পরতে মন চাইলো তাই কানে স্বর্ণ দিলাম। পাঁচ ভরীর তাই টানা ছাড়া পরতে পারি না৷ তোমার কানেরটা কিসের?

পৌষ’র মাথা ওরনা দিয়ে পুরো ঢাকা। দেখার জোঁ নেই। ও বললো,

— আছে ভাবী।

— ভাবী? যাক এতক্ষণে মনে পরলো আমি তোমার জা। শোনো পৌষ, লজ্জা পেয়ো না৷ এই দেখো না আমার আর তোমার ভাসুরেরও কত অমিল কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি। প্রথম বাচ্চার পরই মোটা হয়ে গিয়েছিলান। তৌহিদ তখন মোটি বলে ক্ষেপাতো আমাকে। ওকে ভালোবাসি বলে কত কষ্টেই না শুকালাম। আমি ছিলাম উড়ন্ত এক মেয়ে। তোমার ভাসুরকে ভালোবেসে এখন কতই না সংকুচিত হয়েছি। গতবছর হজ করেছি। এখন মাথা ঢেকে রাখি। বুঝোই তো কালার করা চুল। কত যত্ন নিতে হয়……

নিজের বিষয়ে নানান কথা মিরা বললো। পৌষ বুঝলো তার থেকে বড় বাঁচাল মিরা। মাথায় দুই একটা স্কু ঢিলাও আছে। বিষয়টা তুসু ভাই’কে জানাতে হবে। পৌষ মনে মনে ফন্দি আটলো। তবে আশ্চর্যের বিষয় পৌষ’র সাথে তার ভালোই কথা হলো। পৌষ নিজের পরিবার সম্পর্কে তাকে জানালো যদিও মিরার যথেষ্ট খোঁচানিতে ও বলেছে। মাগরিবের আজান হতেই মিরা বললো,

— নামাজ না পরলে তোমার ভাসুর রেগে যাবে। তুমি আমার সাথে চলো। চা খেতে খেতে আড্ডা দেই।

পৌষ মুখ মুছে না করলো কিন্তু মিরা মানলো না। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ে টেনে ওকে ভেতরে নিলো। পৌষ এত করে না করলো কিন্তু মিরা হার মানলো না। চায়ের সাথে নানান নাস্তার আয়োজন করলো। এদিকে ভয়ে ভয়ে বসে আছে পৌষ। তৌসিফ জানলে মাইর ই না দেয় তাকে। একবার সে না করছিলো যাতে তার ভাই বউদের সাথে না মিশে পৌষ বা তারা কিছু বললেও পৌষ চুপ থাকে। ভয়ে এক ফাঁকা ঢোক গিললো ও।
.
পৌষ ভয়ে ভয়ে নিজেদের ফ্লাটে ঢুকলো। রাত প্রায় আটটার কাছাকাছি। তৌসিফ কি চলে এলো? ও বুঝতে পারছে না। স্বাভাবিক পরিস্থিতি। মিনু টিভিতে নাটক দেখছে। যত কুটনা নাটক আছে তার ওর দেখতে হবেই হবে। এমনি সময় হলো ওর সাথে একটু লাগালাগি করতো পৌষ কিন্তু এখন ভয়ে কলিজায় তার পানি শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। মামাতো ভাই তার কোথায়? ভীতু পা জোরা তার পদচারণ করে এগিয়ে এলো রুমের কাছাকাছি। জাঁকজমকপূর্ণ ড্রয়িং রুম পেরিয়ে যেই না রুমে ঢুকবে ওমনিই দরজায় বেল বেজে উঠলো। হঠাৎ শব্দে ছিটলে যায় পৌষ। ঠান্ডার মধ্যেও যেন কপালে ঘাম ছুটছে। গতরাতে এমনিতেও তৌসিফ রেগে ছিলো। পৌষ বুঝে। এতটুকু তো সে তার তৌসিফ’কে চিনতে পেরেছে। মিরা এলো কি না কে জানে। আসলে পৌষ খতম। একেবারে শেষ। ওর বুক উঠানামা করছে। পৌষ হাঁপিয়ে উঠলো যেন। ততক্ষণে নাটক ত্যাগ করে মিনু উঠেছে দরজা খুলতে। বুয়া একজন রান্নাঘরে হয়তো রাতের খাবার রান্না হচ্ছে। এসেছে থেকে পৌষ রান্নায় হাত দিতে পারে নি। সম্ভব হয় নি।
ড্রয়িং রুমের পিলার ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো পৌষ। ওর মাথায় নানান কথা চলমান। তার মধ্যে কিছু কিছু মিরা’র বলা কথা। কথার ফাঁকে ফাঁকে সে খুবই সূক্ষ্ম ভাবে তৌসিফ’কে নিয়ে কথা বলেছে। তাদের তিন ভাইকে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেছে যদিও কোনটাই খারাপ কথা না। কিন্তু পৌষ এতটুকু বুঝেছে তৌসিফ গোছানো মানুষ পছন্দ করে। সেই হিসেবে তো পৌষ অগোছানো। এছাড়াও নানান তথ্য যার সাথে পৌষ নিজেকে মিলিয়ে পায় না৷

কাঁধে শক্ত হাতের ছোঁয়া পেতেই ওর দেহ ঝাঁকি দিয়ে উঠে। সামনে তৌসিফ দাঁড়িয়ে। পৌষ’র দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পৌষ বুঝলো মাত্রই তাহলে তৌসিফ ফিরেছে। কলিজায় সৃষ্ট মরুভূমিতে তখন এক পশলা বৃষ্টির আগমন৷ শুকরিয়া আদায় করলো পৌষ। এই যাত্রায় বেঁচেছে ও।
তৌসিফ পৌষ’র কপালে হাত রাখলো। এখনও গরম। এই মেয়ের জ্বর কমে নি অথচ ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরেও নাকি ঘুরে এসেছে। একা-একা বাইরে ঘুরঘুর করলো। তৌসিফ ফিরতো আরো আগেই। হঠাৎ শেষে একটা কল আসায় আবার তাকে শোরুমে যেতে হয়েছে। ঘাড়ের ব্যথা বেড়েছে। পৌষ’র হাত ধরে রুমে যেতেই পৌষ বললো,

— গ্রিজার অন করব? গোসল করবেন এখন?

— হ্যাঁ কিন্তু তোমাকে করতে হবে না।

— ও তাহলে কে করবে?

— খেয়েছো কিছু?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তৌসিফ জিজ্ঞেস করে। পৌষ মাথা নিচু করে বললো,

— খেয়েছি। আপনি এখন খাবেন? নিয়ে আসব?

— গোসল করে খাব।

তৌসিফ রাগ প্রকাশ করছে এভাবে পৌষ তা চট করে বুঝে নিলো। এত বড় এক লোক যদি বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে অভিমান করে তখন কেমন লাগে? পৌষ’র হাসি পেলো। হাসি চেপে বললো,

— বাসায় একজন এসেছিলো। আমি দেখি নি৷ মিনু দেখেছে। আপনাদের নিচে কিসের জানি কাজ হচ্ছে তার জন্য বললো।

— হ্যাঁ। বাসার নিচে অফিস রুম করছি একটা। কাজের জন্য কত মানুষের আনাগোনা। আমি চাই না নিজের বাসায় তুমি লুকিয়ে থাকো।

তৌসিফ বাথরুমে ঢুকলো। পৌষ পা ঝুলিয়ে বসলো বিছানায়৷ ওর মনে পরলো কিছু মাস আগে বাসায় এক গাদা লোকের আগমন হয়েছিলো। পৌষ তখন রুমে ঘাপটি মে’রে বসে ছিলো। প্রায় দুই ঘন্টা মিটিং থাকায় পৌষ এক রুম থেকে আরেক রুমেও যেতে পারে নি।
ঐ দিনের পর অবশ্য বাসায় ওমন ভাবে কাউকে আনে নি তৌসিফ। পৌষ অবাক না হয়ে পারলো না। এই লোকটা এতটা ভালো কেন? কারণটা কি?

তৌসিফ এসে বিছানায় বসতেই পৌষ নিজ থেকে ওর ঘাড়ে মলম মালিশ করতে লাগলো। তৌসিফ চোখ বুজে নিলো। পৌষ হা করে তাকিয়ে রইলো তৌসিফে’র পিঠে। ফর্সা চামড়ার লোক। পৌষ হাত বাড়িয়ে পিঠ পর্যন্ত মালিশ দিলো। তৌসিফ আরামে গুঙিয়ে উঠে। পৌষ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওকে। পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ফিসফিস করে ডাকে,

— তুসু ভাই, আপনি এত কেন সুন্দর? লজ্জা হওয়া দরকার আপনার। আপনার বউ থেকেও আপনি সুন্দর।

— আমার বউ নিয়ে খারাপ মন্তব্য করো না হানি৷ খারাপ হবে। ঘাটে কি করছিলে তুমি আজ?

যাহ! দিলো তো রোমাঞ্চকর মূহুর্তের বারোটা বাজিয়ে। সরে বসে পৌষ বললো,

— বাতাস খেতে গিয়েছিলাম।

— আর?

— আর কি?

— মিরা ভাবীর কাছে?

পৌষ’র চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। তৌসিফ কিভাবে জানলো? ও দেখলো তৌসিফ র’ক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। পৌষ মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সাহসের অভাবে পারলো না। এদিকে ক্রমশ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ তৌসিফ। সে সত্যিই ব্যার্থ।

প্রায়শই ভালোর মাঝে মন্দ থাকে। সেই মন্দ দেখা যায় না৷ তারা হয় নীরব ঘাতক যারা ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া করে অতঃপর সবটা শুষে খতম করে।

#চলবে….