#প্রেমহিল্লোল||০২||
#তাসনীম_তামান্না
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। ড্রইংরুম জুড়ে নিরবতা তারমধ্যে কুয়াশার ফুঁপানো আওয়াজ সকলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দুপাশে বাবা আর চাচা বসা। ওরা বাবা দুই ভাই। কৌশল আর মনির। কৌশলের স্ত্রী কেয়া তাদের দুইটা সন্তান কুশান, কুয়াশা। কুশান বড় বিয়ে হয়েছে পাখির সাথে তার দুইটা ছোট জমজ ছেলে সন্তান আছে কুশ, শান। মনিরের স্ত্রী মুন্নি তাদেরও দুই সন্তান মেঘ আর মেঘা। মেঘের আট মাস বিয়ে হয়েছে তুতুলের সাথে।
কৌশল মেয়ের মাথায় আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল
–কাঁদছিস কোনো মা? বল কী হয়েছে? না বললে বুঝবো কীভাবে? তোর কী কোনো পছন্দ আছে? নির্দিধায় বল। বাবা আছে তো! বল…
কুয়াশা ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল
–না পছন্দ নেই। আমি এখন বিয়ে করবো না, বাবা।
কেয়া মেয়ের কথায় রেগে গেলো কয়েকপা তেড়ে এলো। কুয়াশা ভয়ে বাবার বুকে মুখ লুকালো।
–বিয়ে করবি না মানে কী? তুষার কত ভালো ছেলে এমন ছেলে কোথাও পাবি?
কৌশল স্ত্রীকে চোখ রাঙিয়ে ধমকে বলল
–ওর জীবন, ওর সিদ্ধান্ত। ও কী করবে না করবে। কার সাথে সংসার করবে সেটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ন অধিকার ওর আছে। সেখানে আমরা জোর করতে পারি না।
কেয়া ফোঁস ফোঁস করে বলল
–ও তো বলল ওর কোনো পছন্দ নেই তাহলে। তুষারকে বিয়ে করতে কী সমস্যা। মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছো
কুয়াশা বাবাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল
–আমি তোমাদেরকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। আমার খুব কষ্ট হবে। আমি কখনো বিয়ে করবো না, বাবা। তুমি আমাকে বিয়ে দিও না। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই।
ওর কথার পিঠে কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। কেয়া দমলো না কিছু বলতে নিলে কৌশল ইশারায় থামিয়ে দিয়ে ও মেয়েকে এতো কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল
–আচ্ছা তোর যেমনটা মন চাইবে তেমনটাই হবে। এখন রুমে গিয়ে রেস্ট কর। আর কান্নাকাটি করবি না এতো কাঁদলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। মেঘু মা কুশুমাকে নিয়ে যা রুমে।
মেঘা কুয়াশাকে নিয়ে গেলো। ওরা দৃষ্টির বাইরে যেতে কেয়া বলল
–বড় হয়েছে মেয়ের বয়স হয়েছে আর তুমি মেয়েকে লাই দিচ্ছো? মেয়ে হয়ে জন্মেছে আজ না হোক কাল শশুড়বাড়িতে যেতে হবে। ওর কান্নাকাটি দেখে গলে গেলে চলবে?
কুশান এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এখন বলল
–মা বাদ দাও। ও এখনো বাচ্চা। সহজসরল এখন ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে ও মানিয়ে নিতে না পারলে? সুখী না হলে তখন কী করবে?
–কুয়াশা আর মেঘা তো সমবয়সী। মেঘার বিয়ে ক’দিন পর। আর ওর এখনো বিয়ের বয়স হয় নি? ভেবেছিলাম দুজনকে একসাথে বিয়ে দিয়ে দিবো। তুই আর তোর বাপ মিলে মেয়েটাকে আহ্লাদে আহ্লাদে রেখে আস্ত বিয়াদপ বানিয়েছিস।
কৌশল স্ত্রীর কথায় বিরক্ত হয়ে বলল
–আমার মেয়েকে আমি আহ্লাদ দিবো যা খুশি করবো। তুমি মা হয়ে মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছ না? এক্সাম দিয়ে এসেছে কই মেয়েকে আস্তে ধীরে বুঝিয়ে সবটা বলবে তা-না হইচই শুরু করে দিয়েছো? কান্নাকাটি করছে। না বুঝিয়ে বকাঝকা করছো, মারার জন্য তেড়ে আসছো। জানো না আমার মেয়েটা নরম একটুতে কাবু হয়ে যায়। অসুস্থতা ঝেকে ধরে।
কেয়া দমে গেলো নরম গলায় বলল
–তাই বলে বিয়ে করবে না? তুষার এতো ভালো একটা ছেলে।
কৌশল স্ত্রীর দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে তুতুলের ভীতু মুখশ্রীতে তাকিয়ে বলল
–তুতুল মা, আমাকে খারাপ বুঝো না। তুষারের সাথে বিয়ে হলে তুষার নিশ্চয়ই কুয়াশাকে সাথে করে সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাবে?
তুতুল ভয়ে ভয়ে বলল
–জি চাচ্চু, ভাইয়ার বিয়ের পার বাবা-মাকেও ওখানে নিয়ে যাবে।
–কিন্তু আমি দুঃখীত। আমার কথায় খারাপ ভাবে নিও না। তোমার বাবা-মায়ের সাথে আমি কথা বলে নিবো। আমি এ বিয়েতে মত দিতে পারছি না। আমার কখনো মনে পড়ে না জন্মের পর মেয়েকে একরাতের জন্যও দূরে রাখি নি। সেখানে এতদূর মেয়ে চলে যাবে ওখানে থাকবে অসুস্থতায় ছুঁতে পারবো না। তোমার বাবা-মা’কেও কথাগুলো বলে দিচ্ছি এখনই কেউ আর এই ব্যাপারে কুয়াশার সামনে কথা তুলবে না।
কেয়াও স্বামীর কথার দ্বিরুক্তি করার সাহস পেলো না। ওনি এতোটা গভীর ভাবে ভাবি নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মেয়েকে এতদূর পাঠিয়ে ওনিও শান্তিতে থাকতে পারবেন না। কেয়া তুতুলের শুকনো মুখ দেখে বলল
–মন খারাপ করো না। আমিও আমার মেয়েকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। মন খারাপ করো না আমরা সবাই মিলে তুষারের জন্য ভালো মেয়ে খুঁজে দিবো। কী বলিস ছোটো?
–ঠিক বলেছ ভাবি। এতো মন খারাপ করো না। তোমার মা-বাবাকে বুঝিয়ে বলো।
তুতুল সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো। কিন্তু মনে মনে ভয়ে আছে তার ভাই কী করবে এটা ভেবে আর কিছু মাথায় আসছে না।
———
তুষারকে প্রতিনিয়ত বাসা থেকে বিয়ে জন্য চাপ দেয়। ও কোনো ভাবে রাজি হয় না। প্রথমবার বলল ওর কুয়াশাকে পছন্দ। তুষারের মা-বাবার ও অমত নেই। কুয়াশা দেখতে সুন্দরী, শান্তশিষ্ট বাচ্চামো করা মেয়ে, ভালো পরিবার ওদের দিক থেকে অমত ছিলো না এবং ওদেরও বিশ্বাস ছিল। কুয়াশার পরিবারও অমত করবে না। কিন্তু কী থেকে কী ঘটে গেলো? তিশা ভীত মনে ছেলের কাছে ফোন দিলো তখন বাংলাদেশে রাত ১০টা ১০ বাজে সুইজারল্যান্ড ৪ঘন্টা পিছিয়ে ৬টা ১০ বাজে।
তুষার ফুরফুরে মেজাজে অফিস থেকে বাসায় ফিরে সাওয়ার নিয়ে গুনগুন করে গান গাইছিল। মায়ের ফোন পেয়ে হাসি বৃদ্ধি পেলো। খুশি হয়ে ফোন রিসিভ করে বলল
–মা, কেমন আছো?
তিশা থমথমে মুখে বলল
–ভালো আছি। কী করছিস? খেয়েছিস? ফিরে?
তুষারের কাছে মায়ের কথায় ধরণ ভালো লাগলো না বলল
–খাই নি খাবো। তোমার কিছু হয়েছে? বাবার সাথে কী আবার ঝগড়া করেছো?
তিশা রয়েসয়ে ধীরেসুস্থে বলল
–শোন, আগেই রাগারাগি করবি না।
তুষারের ভ্রু কুঁচকে গেলো বলল
–কী হয়েছে মা?
–আসলে ওরা প্রস্তাবটা না করে দিয়েছে!
তুষারের মুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
–কারণ কী?
–ওরা ওতদূরে মেয়েকে পাঠাবে না। কুয়াশাও না-কি কান্নাকাটি করছে বিয়ে করবে না বলে। শুন ওসব নিয়ে আর ভাবিস না। তোর জন্য মেয়ে খুঁজবো।
–কুয়াশাকে বিয়ে করবো বলেছি যখন ওকেই করবো অন্য কাউকে নয়। তুমি ওদের যেভাবেই হোক রাজি করা-ও নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।
তিশা আঁতকে উঠে বলল
–এসব কী বলছিস? ওরা আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে। বিয়ে তো জোরজবরদস্তি করে হয় না। এসব কথা বাদ দে। আরো সুন্দরী মেয়ে খুজে এনে দিবো। ঝামেলা বাধিয়ে লাভ কী? ওটা তোর বোনের শশুড়বাড়ি বাড়ি মাথায় রাখিস কথাটা।
তুষার হেসে বলল
–তুমি তোমার ছেলেকে এতো ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কিছুই করবো না। রাখছি একটু কাজ আছে।
তুষার ফোন কেটে চেয়ারে লাথি মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–বিয়াদপ মেয়ে। দেখবো কত কাঁদতে পারো। না কাঁদলে থাপড়িয়ে থাপড়িয়ে কাঁদাবো। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও কাঁদতে হবে।
চলবে ইনশাআল্লাহ