#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১০
আজ সকাল থেকেই তন্দ্রার মনটা বেজায় খারাপ। তিনদিন থেকে আজ শুভ’রা চলে গেছে। এই তিনদিনে ওরা সারাক্ষণ একসাথেই কাটিয়েছে। ওদের সাথে খুব ভালোই সময় কেটেছে তন্দ্রার। তার পায়ের ব্যথাও বেশ অনেকটাই কমে এসেছে। এই তিনদিন সে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে ছিল। তন্দ্রা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশাল আকাশটা কালো মেঘের আবরণে ঢেকে আছে৷ এই মুহুর্তে তার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মেঘের দেখা নেই। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না তন্দ্রার। বেলকনিতে রাখা চেয়ারটায় সন্তপর্ণে বসে যায়। কর্ণারে গ্রিলের উপর দুটো চড়ুই পাখি এসে দাঁড়িয়েছে। পাখি দুটো কিচিরমিচির করে শব্দ করছে। তন্দ্রা পাখি দুটোকে দেখে তার আর স্বাক্ষরের কথা আনমনে ভাবলো। নিজের এমন ভাবনা চিন্তায় ফিক করে হেসে ওঠে তন্দ্রা। ইদানীং স্বাক্ষরকে নিয়ে খুব বেশিই ভেবে ফেলছে সে। তিনদিন ধরে তো স্বাক্ষর তার সাথে ঠিক মতো কথাও বলছে না। এমনিতে বাসায় থাকলে তো তা-ও একটু আধটু কথা বলতো, এখন তাও বলে না। কিছু হয়েছে কি-না সেটাও বুঝার উপায় নেই৷ তন্দ্রার সাথে কথা না বললেও, তার যত্ন বা খোঁজ নেওয়া কোনোটায় অবহেলা করেনি স্বাক্ষর৷ স্বাক্ষরের কথা মনে পড়তেই তন্দ্রার মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল।
–কিরে মন খারাপের রানী। মুখটাকে এভাবে ভার করে রেখেছিস কেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে তন্দ্রা বেলকনির দরজার দিকে তাকায়। ইলোরা এসেছে। তন্দ্রা গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেই যে পরশুদিন এসেছিল তারপর আর আসার নাম গন্ধও নেই। বলে গিয়েছিল প্রতিদিন এসে তার সাথে দেখা করে যাবে।
–তন্দ্রারানীর কি অভিমান হয়েছে? শুনলাম তোর নাকি মন খারাপ। তাই তো এই মেঘলা দিনেও তোর কাছে ছুটে এসেছি।
–কথা নেই তোর সাথে।
–আমার সাথেও কথা বলবি না?
তন্দ্রা তাকিয়ে দেখলো মুহিত ইলোরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে একটা ভেংচি কে’টে বলল…
–গার্লফ্রেন্ডকে একলা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না বুঝি?
–যদি চুরি করে রেখে দিস তাইতো চোখে চোখে রাখি।
–নিয়ে যা তোর গার্লফ্রেন্ডকে। ওকে দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই।
তন্দ্রার কথায় ইলোরা হেসে দেয়। তন্দ্রার মন খারাপ দেখে স্বাক্ষরই তাকে কল করে আসতে বলল। এমনিতেও মুহিত আর ইলোরা দুজনে প্ল্যান করেছিল তন্দ্রাকে দেখতে আসবে।
–তুই যেহেতু আমার সাথে কথাই বলবি না তাহলে তোর জন্য আনা ফুচকা আমি বাড়িতে ফেরত নিয়ে যাবো। এই চলো তো। আমরা এক্ষুনি চলে যাবো।
–গিয়ে দেখ না। পা ভেঙে রেখে দেবো দুটোর।
এমন গাল ফুলিয়ে কথা বলায় ইলোরা আর মুহিত একসঙ্গে হেসে দেয়। তন্দ্রার হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। মুহিত বিছানার একপাশে আধশোয়া হয়ে বসে। ইলোরা একটা ফুচকায় টক পুরে তন্দ্রার মুখের সামনে ধরে ইশারা হা করতে বলে। ওমনি তন্দ্রা তা মুখে নিয়ে নেয়।
–তুইও খা। আরেকটু ঝাল দিয়ে আনতে পারলি না?
–তোর জন্য বেশি ঝাল খাওয়া বারণ।
–কেন কেন? আবার কে বারণ করলো?
–এটা সিক্রেট।
–হুহ।
বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ওরা ঘর থেকে বের হয়। রান্না ঘরে তাহেরা মাহমুদ বিরিয়ানি রান্না করায় ব্যস্ত। ইলোরা আসার পর পরই বায়না ধরেছিল উনার হাতের বিরিয়ানি খাবে৷ তন্দ্রাকে নিয়ে ইলোরা আর মুহিত ড্রইং রুমে গিয়ে বসে৷ মুহিত এক কোণায় বসে টিভি দেখছে। ইলোরা তন্দ্রার কানাকানি বলে…
–কিরে তন্দ্রারানী। শুনলাম সে কথা বলে না দেখে নাকি তোর মন খারাপ।
–এই সমস্ত ফালতু কথা তোকে কে বলে?
–ফালতু না, ফালতু না। এটাই সত্যি তোর চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
তন্দ্রা তার ফোনে নিজের মুখটা দেখে নেয়। ভ্রু কুচকে ইলোরার দিকে তাকায়। এদিকে হাসতে হাসতে ইলোরার পেটের অবস্থা খারাপ। তন্দ্রা কপট রাগ দেখায় তাকে। ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়ছেন সাহেরা মাহমুদ এবং তাহেরা মাহমুদ এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। ইলোরা আর মুহিত বেশ তৃপ্তি নিয়ে খায় এবং বেশ প্রশংসাও করে। এরই মাঝে স্বাক্ষর হসপিটাল থেকে বাসায় আসে। তাকে দেখে বেশ ক্লান্ত লাগছে। তন্দ্রা একবার তার দিকে তাকায়। স্বাক্ষর সোজা তার ঘরে চলে যায়। তাহেরা মাহমুদ স্বাক্ষরের জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে যেতে নিলে তন্দ্রা উনাকে আটকায়। আর গ্লাসটা নিজেই নিয়ে নেয়। সাহেরা মাহমুদ কিছুটা হাসে। ইলোরা আর মুহিতও হেসে দেয় তন্দ্রার কান্ডে।
–তুমি আমাকে ইগনোর কেন করছো?
স্বাক্ষর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম গুলো ইতিমধ্যেই খুলে ফেলেছে। তন্দ্রা দ্রুত স্বাক্ষরের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আয়নার তন্দ্রাকে অন্যদিকে ঘুরে থাকতে দেখে স্বাক্ষর হাসে। এরপর টাওয়াল দিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
–তুই বোস। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
তন্দ্রা পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে দেয়। এরই মাঝে স্বাক্ষরের ফোনটা বার বার বাজছে। ধরবে কি ধরবে না তাই ভাবতে থাকে তন্দ্রা। এক পা দু পা করে ফোনের দিকে এগিয়ে যায়। আবারও কলটা কাট হয়ে যায়। তন্দ্রা স্বাক্ষরের ফোনটা হাতে নেয়। ফোন স্ক্রিনে নিজের ছবিটা জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে৷ এই ছবিটা তো তার ফোনে নেই। তারই অগোচরে তোলা হয়েছে এই ছবিটা। কিন্তু স্বাক্ষর এই ছবিটা কখন তুলল? এটা তো রুবির বিয়ের দিনের ছবি। তন্দ্রার বেশ পছন্দও হয় ছবিটা।
মিনিট পাঁচেক পর স্বাক্ষর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে৷ এরই মাঝে গোসল করে ফেলেছে ভাবতেই অবাক হয় তন্দ্রা। খুব তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না? স্বাক্ষরের পড়নে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর কালো রঙের টিশার্ট। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে তন্দ্রার কাছে আসে। ঠান্ডা পানিটা খেয়ে নেই এক নিশ্বাসে।
–কারো পারমিশন ছাড়া ছবি তুলতে নেই তুমি জানো না?
তন্দ্রার কথায় তোয়াক্কা না করে, বিছানায় বসে স্বাক্ষর স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে….
–পারমিশন ছাড়া কারো ফোনে হাত দিতে নেই, সেটা তুমি জানো না?
স্বাক্ষরের মুখে তুমি ডাকটায় হয়তো কিছু একটা ছিলো। মুহুর্তেই তন্দ্রার সারা শরীর যেন শিরশির করে উঠলো। হঠাৎ করেই তার ভীষণ লজ্জা করছে স্বাক্ষরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। কথা গুলো যেন গলায় দলা পাকিয়ে আছে। মুখে কিছুই বলতে পারছে না অথচ অনেক কিছু বলার ছিল তার।
–পরে কথা বলবো।
আমতা আমতা করে কথাটা বলেই দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় তন্দ্রা। এই মুহুর্তে স্বাক্ষরের ঐ সর্বনাশা চোখে কিছুতেই তাকানো সম্ভব না৷ ঐ চোখে কিছু একটা আছে যা তাকে বারংবার বিমোহিত করে। তন্দ্রা যেতেই স্বাক্ষর এসি অন করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই তন্দ্রার লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে ওঠে। কিছুটা হাসে সে।
তুলি কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। বেলকনিতে বসে তন্দ্রা ফোনে তার বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করছে। আজকে সারাদিনে একবারও অনলাইনে আসা হয়নি তার। নিউজফিড স্ক্রল করছে আর হাসছে। মুহিতের একটা পোস্ট দেখে মূলত সে হাসছে। ইনবক্সে ইলোরা তাকে মেসেজ দিয়ে বলে….
–আমার পোস্টে রিয়েক্ট দেওয়া তোর জন্মগত অধিকার।
ইলোরার মেসেজ সিন না করেই তন্দ্রা আবারও ফেসবুকে গিয়ে লাভ রিয়েক্ট আর একটা কমেন্ট করে।
–কমেন্ট বক্সে তোকে পচানো আমার জন্মগত অধিকার।
–হুহ।
এবার তন্দ্রা মনে মনে ভাবলো একবার স্বাক্ষরের প্রোফাইল দেখে আসা উচিত। ইংরেজিতে স্বাক্ষর মাহমুদ লিখে সার্চ দিতেই তার প্রোফাইল সামনে চলে আসে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, সে তো স্বাক্ষরকে এড পাঠায়নি তাহলে ফ্রেন্ড হয়ে আছে কি করে! যাক ভালোই হলো। স্বাক্ষরের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস এ দেওয়া ‘ইটস কমপ্লিকেটেড” তন্দ্রা কিছু ভ্রু কুচকায়। নিকনেম “গম্ভীর মহারাজ” দেওয়া। তন্দ্রা খুব হাসি পায় নামটা দেখে। এই নামটা সেই-ই দিয়েছে। তবে সেটা স্বাক্ষর জানলো কি করে? স্বাক্ষরের বেশ কয়েকটা ছবি তন্দ্রা নিজের ফোনের স্যাভ করে রাখে। এরপর ফোনের ডাটা অফ করে দেয়। গ্যালারিতে আসতেই সামনে স্বাক্ষরের তেরোটা ছবি দেখতে পায়। দ্রুত সে ছবি গুলোকে একটা ফোল্ডারে লুকিয়ে রাখে। জুম করে তন্দ্রা স্বাক্ষরের একটা ছবি দেখতে থাকে৷ ফর্সা মুখশ্রীতে খোচাখোচা চাপ দাঁড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা৷ গায়ে সাদা শার্ট জড়ানো। স্বাক্ষরকে শুভ্র রঙেই যেন বেশি মানায়। তন্দ্রা গালে হাত রেখে ভাবে…
–এত্তো কিউট কেন তুমি? এই কালো ফ্রেমের চশমাতে তোমাকে দারুণ মানায়। আচ্ছা তোমার আমার যদি প্রণয়ে পরিণয় হয় তাহলে আমি তোমাকে কোথায় লুকিয়ে রাখবো? যদি কারো নজর লেগে যায়। আমি তোমাকে নিয়ম করে নজর ফোটা লাগিয়ে দেবো কেমন?
কথা গুলো ভাবে আর আনমনেই হাসে তন্দ্রা। ফর্সা গালে লজ্জায় লাল আভা দৃশ্যমান। স্বাক্ষরকে নিয়ে ভাবতে তার ভালোই লাগে। কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ফিলিংস হয়। দু’হাতে মুখ লুকায় সে। তন্দ্রার পাশের ঘরটাই স্বাক্ষরের। দুই ঘরের বেলকনি পাশাপাশিই। স্বাক্ষরের ঘরের বেলকনিটা তন্দ্রার সব থেকে বেশি পছন্দের। এতো পছন্দ হওয়ার একটাই কারণ, তা হলো সেখানে তার প্রিয় ফুলগাছ দুটো আছে। সাথে একটা দোলনাও আছে। দুজন বসে থাকার মতো স্পেস। তার সকল ভাবনার মাঝেই গিটারে সূর ভেসে আসছে তন্দ্রার কর্ণকুহরে। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলে বুঝতে পারে স্বাক্ষরের বেলকনি থেকেই আসছে। তবে কি সে এখন জেগে আছে? সে তো লেট নাইট জেগে থাকা পছন্দ করে না। গম্ভীর মহারাজ তার উপর ডক্টরও বটে। সব ভাবনাকে সাইডে ফেলে রেখে তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে মুহুর্তটা উপভোগ করে। স্বাক্ষর গানের সূর তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই শরীরে যেন এক শীতল স্রোত বয়ে যায়।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঘুম ছুয়ে যায় তোমায় ভালোবেসে
চলবে?…….
#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১১
সকাল সকাল খুব তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে তন্দ্রা। ইলোরার সাথে রাতে প্ল্যান করেছে আজ ভার্সিটি যাবে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠতেই যত দেরি। যার দরূন এখন তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। তুলির আজ স্কুল বন্ধ তাই সে ড্রইং রুমে তার প্রিয় কার্টুন দেখছে। তন্দ্রা নীল রঙের লং জামা পড়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। হিজাব করার মাঝেই, তন্দ্রার খাবার খেতে দেরি হয়ে যাবে তাই তাহেরা ঘরে আসেন।
–যেভাবে তাড়াহুড়ো করছিস মনে হচ্ছে খাবার খাওয়ার সময়টাও পাবি না।
–রাতে ইলোরা বলল আজ নাকি কিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।
–আচ্ছা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়।
–হুম।
তাহেরা মাহমুদ চলে যেতেই তন্দ্রা হিজাবটা ঠিক ভাবে পড়ে নেয়। বার কয়েক নিজের মুখশ্রী দেখে নেয় আয়নায়। সব ঠিকঠাক আছে৷ ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রার জন্য একটা প্লেটে খাবার বেড়ে দেন। সে গিয়ে অল্প কিছু মুখে দেয়। খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। খাওয়া হয়ে এলেই তন্দ্রা তার মা আর বড় মা’কে বলে ব্যাগ নিয়ে চলে যেতে নিলে ড্রইং রুমে স্বাক্ষরকে দেখতে পায়। হয়তো তন্দ্রার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
–তুমি হসপিটালে যাওনি ভাইয়া?
ভাইয়া ডাকটা হয়তো স্বাক্ষরের ঠিক পছন্দ হলো না। মুখে কিছু না বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন…
–ছেলেটা তোর জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে।
–তন্দ্রাবতী তাড়াতাড়ি আয়।
কথাটা বলেই হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল স্বাক্ষর।
–ভাইয়ের থেকেও বেশি কিছু হই তোমার। বেয়াদব মেয়ে, আমাকে ভাইয়া বলার শাস্তি তোমাকে পরে দেবো। সুদে আসলে ফিরিয়ে দেবো কিন্তু সেটা অন্য উপায়ে।
মনে মনে আরও অনেক কিছুই ভাবে স্বাক্ষর। গাড়িতে এসে বসতেই তন্দ্রা এসে তার পাশে বসে। স্বাক্ষর গাড়ি স্টার্ট দেবে তখনই সে খেয়াল করলো তন্দ্রা সিট বেল্ট লাগায় নি। ধীর গতিতে তন্দ্রার খানিকটা কাছে যায়। তার তপ্ত নিশ্বাস তন্দ্রা ঘাড়ে মুখে এসে ঠেকছে। তন্দ্রার মনে এক অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। দুরুদুরু বুকে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
–দিনকে দিন খুব অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছো তন্দ্রাবতী। সিট বেল্ট কে লাগাবে শুনি?
সিট বেল্ট লাগিয়ে স্বাক্ষর তন্দ্রার কাছ থেকে সড়ে আসে। তন্দ্রা কিছুটা হাসার চেষ্টা করে। স্বাক্ষরের মুখে তুমি ডাকটা তার কর্ণকুহরে প্রণয়ের সূর তোলে। শুনতে বড়োই ভালো লাগে।
–অপ্স ভুলে গেছি ভাইয়া।
তন্দ্রার বেফাঁস উত্তরে স্বাক্ষর কিছুটা ক্ষেপে ওঠে। বার বার কেন এই মেয়ের ভাইয়া বলে ডাকতে হবে। সে তো আর টিনএজার নয়। একটা ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে বলে কয়ে কেন ভালোবাসার অনুভূতির জানান দিতে হবে। সে কি বুঝতে পারে না? অবশ্যই সে সব বুঝতে পারে। বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে যাচ্ছে। এক পলক তন্দ্রাকে দেখে নিলো সে। নীল রঙা জামাটা বেশ ভালোই মানিয়েছে তাকে। স্বাক্ষর গাড়ি স্টার্ট দেয় মুহুর্তেই। তন্দ্রা তাকে দেখে যাচ্ছে অনেকক্ষণ যাবৎ। স্বাক্ষর জানে তন্দ্রা এখন তাকেই দেখছে তাই সে আর সেদিকে তাকায়নি। সে চায় তন্দ্রার দৃষ্টি সবসময় তার দিকেই থাকুক। স্বাক্ষরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে তার বেশ ভালোই লাগছে। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে সে স্বাক্ষরের চোখের দিকে তাকিয়ে। এরই মাঝে বেশ কয়েক চোখের পলকও ফেলেছে। তন্দ্রা তা গুনেও নিয়েছে। তন্দ্রার ভাবনার মাঝেই স্বাক্ষর ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামায়। তন্দ্রা এখন গভীর ভাবনায় মগ্ন। স্বাক্ষর সিট বেল্টটা খুলে দেয়। তন্দ্রার ভাবনার সমাপ্তি ঘটে।
–ভাবনা শেষ হলে, যেতে পারেন। এই তো আসার আগেই কত তাড়াহুড়ো করছিলেন।
–যাচ্ছি।
–হুম।
তন্দ্রা নেমে যায় গাড়ি থেকে। ভার্সিটির ভেতরে ঢুকলে স্বাক্ষর সেখান থেকে চলে যায়। তন্দ্রাকে দেখা মাত্রই ইলোরা আর মুহিত এগিয়ে আসে। ইলোরা গদগদ করে তন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরে। তন্দ্রা ভার্সিটি আসার পর বুঝতে পারলো তার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা ঠিক কি। ইলোরা তাকে আসার জন্য এতো তাড়া কেন দিয়েছে। তন্দ্রা কপাল চাপড়ে, কপট রাগ দেখিয়ে ইলোরার দিকে তাকায়।
–রাগ করছিস কেন?
–নবীন বরণ হবে ভালো কথা, তাই বলে তুই ফাংশনে আমার নাম কেন দিয়েছিস?
–কারণ তুই ভালো নাচতে পারিস৷
–তুই কি ভুলে গেছিস সপ্তাহ খানিক আগে আমার পায়ের গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার হয়েছিল! তোর কি মনে হয় সে আমাকে ফাংশনে নাচতে দেবে? যেখানে বাড়িতেই আমাকে ধীর পায়ে ছোট বাচ্চাদের মতো হাঁটতে হয়।
–আমি এতো কিছু ভেবে দেখিনি। চল তোর নাম কে’টে দিয়ে আসি।
–হুম।
অডিটোরিয়ামে কয়েকজন মিলে নাচের রিহার্সাল করছে। সবাই তাদের ক্লাসমেট। ওদের রিহার্সাল দেখে তন্দ্রারও নাচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পায়ে তার হালকা চিনচিনে ব্যথা এখনো আছে। এ কথা কাউকে সে বলেনি। বললে দেখা গেল, ভার্সিটিতেই আসতে দেবে না। একটা চেয়ারে বসে বন্ধুদের নাচ করা দেখছে। ইলোরা আর মুহিত একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতে নাচবে।
আরও তিন ঘন্টা নাচের রিহার্সাল করে ওরা বাসায় ফিরে আসে। তন্দ্রার খুব ক্লান্ত লাগছে তাই সে এসেই গোসল করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ভেজা চুল গুলো পর্যন্ত শুকায়নি। এমনকি দুপুরের খাবারটাও খায়নি। খোলা চুলে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ঘুমে চোখ টলমল করছে। মুহুর্তে ঘুমিয়েও পড়েছে সে। তাহেরা মাহমুদ তুলিকে একবার পাঠিয়েছিলেন তন্দ্রাকে ডাকার জন্য কিন্তু সে ওঠেনি। তুলি নিজেও তন্দ্রার পাশে শুয়ে পড়ে। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ আগে তন্দ্রার ঘুম ভাঙে। সময় দেখে খুব অবাক হয় সে। এতো সময় কি করে ঘুমালো। হয়তো ক্লান্ত লাগায় ঘুম বেশি হয়েছে। ভেজা চুলে ঘুমোনোর জন্য তার ঠান্ডা লেগে গেছে। বারবার হাঁচি আসছে। এতো সময়ে চুলও শুকিয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেনী গেঁথে নেয় তন্দ্রা। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়। নিজের জন্য আদা দিয়ে কড়া করে চা বানায়। ঠান্ডা লাগার কারণে মাথাটাও খুব ধরেছে। চা বানিয়ে তন্দ্রা ঘরে যাচ্ছিল এমন সময় স্বাক্ষর বাড়ি ফিরে আসে। তার হাতে একটা প্যাকেট। সাহেরা মাহমুদ আর তাহেরা মাহমুদ ড্রইং রুমেই বসে আছেন। স্বাক্ষর প্যাকেটটা তাহেরা মাহমুদ এর হাতে দেয়। এরপর নিজের ঘরে চলে যায়। তাহেরা মাহমুদ রান্না ঘরে আসেন। তন্দ্রা গিয়ে সাহেরা মাহমুদ এর পাশে গিয়ে বসে। বারবার নাক মুছতে মুছতে নাকটা লাল হয়ে গেছে তন্দ্রার।
ড্রইং রুমে সবাই একসাথে বসে আছে। ইলিয়াস মাহমুদ এবং ইউসুফ মাহমুদ অফিসে থেকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। স্বাক্ষর আসার সময় সিঙ্গারা আর জিলাপি নিয়ে এসেছিল। সাহেরা মাহমুদ-ই কল করে এগুলো আনতে বলছিলেন৷ স্বাক্ষর বাইরের খাবার একদমই পছন্দ করে না। বাড়ির খাবারই তার জন্য পারফেক্ট। স্বাক্ষর একপাশে সিঙ্গেল সোফায় বসেছে। কোলে অ্যালভিন বসে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে মিয়াও মিয়াও করছে। তন্দ্রা আর তুলি একসঙ্গে। সন্ধ্যা থেকে তন্দ্রার দু কাপ চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। নিজের জন্য তখন আদা দিয়ে কড়া করে চা বানিয়েছিল, এরপর তাহেরা মাহমুদ দুধ চা বানিয়েছেন আর স্বাক্ষরের জন্য আলাদা ভাবে কফি বানিয়েছিলেন। এখন সবাই চা, সিঙ্গারা আর জিলাপি খেতে খেতে খুশগল্পে ব্যস্ত। ইলিয়াস মাহমুদ তন্দ্রা আর তুলিকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। স্বাক্ষর ভ্রু কুচকে তাকায় তার বাবার দিকে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো তন্দ্রা তুলিকে নিয়ে ঘরে এসে দরজা আটকে দেয়। কৌতূহল মেটাতে দরজা কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করে, সেখানে কি কথা হচ্ছে।
–আমার বন্ধু জাহিদ তার ছেলের জন্য তন্দ্রাকে পছন্দ করেছে।
ইলিয়াস মাহমুদ এর কথায় স্বাক্ষরের মনে এক অজানা ভয় জেঁকে বসে। তার তন্দ্রাবতীকে সে হারিয়ে ফেলবে না তো। বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করে। স্বাক্ষর একবার তার মায়ের দিকে তাকায়। ছেলের চাহুনিতেই যেন সাহেরা মাহমুদ মনের কথা সব বুঝে যান।
–কিন্তু তন্দ্রা তো এখনো পড়াশোনা করছে। অনার্সটা না-হয় শেষ করুক।
–বিয়ের পরেও ওরা পড়াশোনা করাবে। ছেলে তার বাবার ব্যবসা সামলায়। ব্যবহারও খুব ভালো। আমি আর ইউসুফ গিয়েছিলাম তো ওখানে।
–ভাবী আমার কাছে ভালোই লেগেছে জোভানকে। তন্দ্রার জন্য আমরা যেমন ছেলে চাই তেমনই। কিন্তু আমাদের আগে জানতে হবে মেয়ের কাউকে পছন্দ আছে কি-না!
–আমার মনে হয় না তন্দ্রার পছন্দের কেউ আছে বলে।
তাহেরার ফোড়ন কা’টা জবাবে সাহেরা মাহমুদ এর ভ্রু কুচকে আসে। যেন তাহেরার কথাটা উনার পছন্দই হয়নি। তিনি প্রতিবাদী স্বরে বললেন…
–তারপরও ওকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার।
আবছা হলেও তন্দ্রা বেশ ভালো ভাবেই কথা গুলো বুঝতে পেরেছে। অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে ভাবতেই তন্দ্রা বুকটা কেমন ধক করে উঠল। আজ হয়তো বুঝতে পারছে সে স্বাক্ষরকে পছন্দ করে। হয়তোবা ভালোও বাসে।
স্বাক্ষর অ্যালভিনকে কোলে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়। তার কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার শুধু মনে হচ্ছে তন্দ্রাকে সে হারিয়ে ফেলবে। বাসায় কি করে বলবে, সে তন্দ্রাকে ভালোবাসে! কেউ কি আদৌও মেনে নেবে।
চলবে?…….