প্রেমালিঙ্গণ পর্ব-১২+১৩

0
434

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১২

মাঝেই দুটো দিন কে’টে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তন্দ্রা রেডি হচ্ছে। ভার্সিটিতে আজ ১ম বর্ষের স্টুডেন্টদের নবীন বরণ হচ্ছে। কালো রঙের লং গাউন পড়েছে তন্দ্রা। ইলোরা শাড়ি পড়তে বলেছিল। শাড়িতে খুব একটা কমফোর্টেবল ফিল আসে না তন্দ্রার। তাই সে ইলোরার কালো শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো গাউন পড়েছে। হালকা সাজের সাথে ধূসর রঙের হিজাব করেছে। ইলোরা একটু পর পর কল দিচ্ছে৷ রেডি হয়ে নিজের ঘর থেকে বের হয় তন্দ্রা। সকালের নাস্তা আগেই করে নিয়েছিল সে। তাহেরা মাহমুদ আর সাহেরা মাহমুদ এর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তন্দ্রা বাড়ি থেকে বের হয়। স্বাক্ষর অনেকক্ষণ আগেই নাস্তা করে হসপিটালে চলে গেছে হয়তো। তন্দ্রা স্বাক্ষরের সামনে খুব একটা যায় না। এমনকি প্রয়োজন পড়লেও কোনো কথা বলে না। ইলিয়াস মাহমুদ জানিয়ে দিয়েছেন আজ সন্ধ্যায় জোভানের বাবা মা এসে তন্দ্রাকে আংটি পড়িয়ে যাবেন। বিয়ের জন্য উনারা দেরি করতে চাইছেন না। এই নিয়ে তন্দ্রা কোনো কথাই বলেনি। সবাই তার নীরবতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ মনে করে নিয়েছে।

পায়ে হেঁটে কিছুটা সামনে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় তন্দ্রা। কোনো রিকশাই পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই খুব বিরক্ত হচ্ছে সে। ইদানীং ক্ষণে ক্ষণে একরাশ বিরক্তি জেঁকে বসে তাকে। হঠাৎ করেই সাক্ষর তার বাইক এনে দাঁড় করায় তন্দ্রার সামনে। সে তাকে দেখে সামনের দিকে হাঁটা ধরে। স্বাক্ষরও কম যায় না। সেও তন্দ্রার পিছু পিছু বাইক ধীর গতিতে চালিয়ে যেতে থাকে। এদিকে একটা রিকশারও দেখা মিলছে না।

–আজকের পর থেকে আমার উপর আর অভিমান করে থাকতে হবে না।

স্বাক্ষরের বলা কথা শুনে তন্দ্রা নিজের হাঁটা থামিয়ে দেয়। পা যেন সামনের দিকে যাবে না বলে বায়না ধরেছে। সত্যিই তো আজ যদি জোভানের বাবা মা এসে আংটি পড়িয়ে যান তাহলে সে আর কার উপর এভাবে রাগ করে থাকবে৷ তন্দ্রা ভেতরে যেন প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

–আজকের পর থেকে সব অন্যরকম হয়ে যাবে তন্দ্রাবতী।
–হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো। আজকের পর থেকে সব কিছু অন্যরকমই হয়ে যাবে।
–চলো আমিই তোমাকে আজ ভার্সিটি পৌঁছে দিয়ে আসছি।

তন্দ্রা একবার ভাবলো, আজই তো শেষ সুযোগ স্বাক্ষরের সাথে যাওয়ার। তাহলে সে কেন এই সুযোগটাকে হাত ছাড়া করছে। অবশ্যই সে যাবে তার সাথে। নিজের মনের প্রশান্তির জন্য হলেও যাবে।

–হেলমেট দাও।

স্বাক্ষরের যেন তন্দ্রার উত্তর জানা ছিল। সে তার হাতে রাখা হেলমেট এখনো তন্দ্রার দিকেই এগিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে তাকিয়ে স্বাক্ষরের সাথে কথা বলছিল, যার দরূন তার হাতে থাকা হেলমেট তন্দ্রা দেখেনি। স্বাক্ষরের হাত থেকে তাড়াতাড়ি করে তন্দ্রা হেলমেট নিয়ে পড়ে। এরপর বাইকে উঠে বসে। আজও সে স্বাক্ষরের থেকে কিছুটা দূরত্ব মেইনটেইন করছে।

–এই দূরত্বটা শুধুমাত্র একটা বাহানা। আসল দূরত্ব তো তোমার আমার মনের। একদিন সব দূরত্ব ঘুচে যাবে। সেদিন আমরা বড্ড কাছে চলে আসবো।

তন্দ্রা স্বাক্ষরের কথা আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। সে তার কিছুটা কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। স্বাক্ষর খুব সাবধান হয়ে বাইক চালানো তে মনোযোগ দেয়। এরই মাঝে আয়নার সন্তপর্ণে বার দুয়েক তন্দ্রাকে দেখে নেয় স্বাক্ষর। কালো রংটায় তন্দ্রাবতীকে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। স্বাক্ষর গুনগুন করে একটা গানের লাইন ধরে।

❝তোকে খুব ভালোবাসি, ছুটে তাই কাছে আসি
দুজনের রবো দুজন, এভাবেই বারোমাসই❞

লাইনটা বড্ড প্রিয় তন্দ্রার। সেদিন গাড়িতে বসে “ইমরান” এর গাওয়া এই গানটি শুনেছিল। গানের লাইন গুলো যেন তারই মনের কথা। দারুণ ভাবে উপভোগ করেছিল সেদিন এই গানটাকে। সমস্ত ভাবনাকে দূরে রেখে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে ভার্সিটির সামনে চলে আসে। তন্দ্রা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়।

–আসছি।

বলেই চলে আসতে নিলে স্বাক্ষর তাকে দাঁড়াতে বলে। তন্দ্রা তার কথায় থেমে যায়। বাইকের চাবিটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়ে তন্দ্রার সামনে এসে দাঁড়ায়।

–আজ আমি তোমার সাথেই সময় কা’টাবো তন্দ্রাবতী।
–কিন্তু!
–কোন কিন্তু না। চলো ভেতরে।

নবীন বরণের সকল কার্যক্রম অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হবে। সকল শিক্ষার্থী সেখানেই গিয়ে বসছে। ভেতরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। সিনিয়র রা মিলে নতুনদের বরণ করে নিচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে দুটি করে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে স্বাগতম জানাচ্ছে। স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে একটা কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যেই ভীড় হয়ে আসছে। দুজনে অডিটোরিয়ামের ভেতরে চলে যায়। স্বাক্ষর সামনের একটা চেয়ার টেনে তন্দ্রাকে বসায়। অল্প কিছু সময়ের মাঝেই সকল আয়োজন শুরু হয়ে যাবে।

অন্য দিকে বাড়িতে তাহেরা মাহমুদ অধীর আগ্রহে রান্না করছেন। বিভিন্ন পদের সুস্বাদু খাবার রান্না করায় ব্যস্ত উনি। সাহেরা মাহমুদ কিছুতেই কিছু করে আটকাতে পারছেন না এই সমস্ত আয়োজন। একমাত্র তিনি জানেন স্বাক্ষর কি পরিমান তন্দ্রাকে তার জীবনে চায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে তার একটাই বায়না “তন্দ্রাবতীকে সে বউ হিসেবে চায়” এতে সাহেরা মাহমুদ এর কোনো সময়ই আপত্তি ছিল না। কাল রাতে তিনি এই কথাটা ইলিয়াস মাহমুদকে জানিয়েছেন। তিনি বিষয়েটাকে খুব একটা আমলে নেননি। উনার একটাই কথা, উনি কিছুতেই নিজের কথা খেলাপ করবেন না। আর যেখানে তন্দ্রা কোনো আপত্তি করছে না। হয়তো বা তন্দ্রাও এই বিয়েতে মত আছে। তাহেরা মাহমুদ রান্নার দিকটা দেখছেন। সাহেরা মাহমুদ বাকি সকল কাজ করে নিজের ঘরে আসেন। বেশি কিছুক্ষণ থম মে’রে বিছানায় বসে থাকেন।

এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা। মায়ের কোলে মাথা রেখে স্বাক্ষর এই সেই কত ধরনের আবদার করছিলো। তার মধ্যে একটা আবদার ছিল তন্দ্রাকে নিয়ে। সাহেরা মাহমুদ খুশি মনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সকল আবদার খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তখনই ঘরের ভেতর তন্দ্রার আগমন ঘটে।

–বড় মা!
–ওই তো আমার মেয়েটা চলে এসেছে।

খুব খুশি হয়ে কথাটা বলেছিলেন সাহেরা মাহমুদ। স্বাক্ষর উনার কথায় ফোড়ন কে’টে বলে ওঠে।

–ওমনি! এখন তো আমাকে ভুলেই যাবা। জানি তো আমি সবই।

স্বাক্ষরের কথায় তন্দ্রা আর সাহেরা মাহমুদ একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

–তুমি কি আমাকে হিংসা করছো?
–তোর কি আমাকে দেখে হিংসুটে মনে হয়?
–মনে হওয়ার কি আছে, তোমার কথাতেই বুঝা যাচ্ছে। তবে যাই বলো বড় মা’র আদরের ভাগ কোনো ভাবেই ছাড়বে না এই তন্দ্রাবতী।
–তোরা থামবি? কি শুরু করলি দুজনে?

কথাগুলো মনে পড়তেই আনমনে হাসেন সাহেরা মাহমুদ। তাহলে কি সত্যি সত্যিই তন্দ্রার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে? তাহলে তিনি স্বাক্ষরকে কি করে সামলাবেন?

স্টেজে মুহিত আর ইলোরা নাচের পারফর্ম করছে। দুজনে বেশ ভালোই নাচ করছে। তন্দ্রা নিজের ফোনে ওদের ভিডিও করছে। সবাই বেশ উপভোগ করছে। স্বাক্ষর তন্দ্রার পাশের চেয়ারটায় বসে আছে। বরাবরই তার এই হৈ-হুল্লোড় নিয়ে খুব একটা কৌতুহলী নয়। ভালো লাগে না তার এই সব। তবে তার তন্দ্রাবতীর সব কিছুই ভালো লাগে। গান হোক নাচ হোক সব কিছুই ভালো লাগে। সবাই স্টেজে নাচ দেখায় ব্যস্ত আর এদিকে স্বাক্ষর ব্যস্ত তার তন্দ্রাবতীতে। খুব হৈ-হুল্লোড়ও হচ্ছে। সবাই খুব করে উপভোগ করছে আজকের এই আয়োজনটাকে।

নবীন বরণের সকল আয়োজন শেষ হতেই স্টুডেন্টরা এক এক করে সবাই চলে যেতে থাকে। এদিকে তন্দ্রার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। স্বাক্ষর কেন তাকে নিজের মনের কথাটা বলে না! এই নিয়ে এক আকাশ সময় অভিযোগ পুষে রেখেছে সে। বাসায় ফেরার সময়ও হয়ে আসছে। তার বুক ধুকপুক করছে ক্রমাগত। কি আছে কপালে, আল্লাহ ভালো জানেন। স্বাক্ষর তন্দ্রার পাশে দাঁড়িয়েই ইলোরা আর মুহিতকে ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করে। দুজনে স্বাক্ষরের ইশারা বুঝতে পেরে ভার্সিটি থেকে চলে যায়। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে বাইক পার্কিং সাইডে আসে। কম বেশি অনেকেও চলে গেছে। কিছুক্ষণ একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে। আজ স্বাক্ষরের কাছে তার তন্দ্রাবতীকে “বউ বউ লাগছে”। সে বাইকের হেলমেটটা তন্দ্রার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে…

–বিয়ে করবে আমাকে?

স্বাক্ষরের কথায় কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না তন্দ্রা। তার এই ছন্নছাড়া প্রশ্নের উত্তর কি-ই বা হতে পারে জানা নেই তার। বিয়ের কথা যখন বলেছে আরও আগে বলা উচিত ছিল, নয় কি? সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তন্দ্রার। অকপটে সেও উত্তর দিয়ে দেয়।

–না।

চলবে?…….

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১৩

–এভাবে কান্না করলে সবাই ভাববে আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি। এই বিয়েতে তুমি কি খুশি না? কাজী সাহেবকে বলে সব ক্যান্সেল করে দিব?

স্বাক্ষরের এমন কথা শুনে তন্দ্রার কান্না যেন কোথাও উবে গেল। সে ফ্যালফ্যাল করে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো কি বলবে বুঝ উঠতে পারছে না৷ বিয়ে করে এখন আবার বলছে সব ক্যান্সেল করে দিবে। লাইক সিরিয়াসলি! ভাবলেই হাসি পায় তন্দ্রার। কিন্তু বাসায় গিয়েই বা কি বলবে! যদি কেউ এই বিয়েটা না মেনে নেয় তখন সে কি করবে?

দুই ঘন্টা আগের ঘটনা….

নবীন বরণের অনুষ্ঠান শেষ হতেই স্বাক্ষর বিয়ে করার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তন্দ্রার অকপটে নেতিবাচক জবাবটা স্বাক্ষরের পছন্দ হয় না। তন্দ্রার হাতটা শক্ত করে ধরে বাইকে বসায়। এরপর ভার্সিটি থেকে বের হয়ে আসে। তন্দ্রা বুঝতে পারে স্বাক্ষর এই মুহুর্তে খুব রেগে আছে। তাই সে চুপ করেই থাকে সারা রাস্তা। এরই মাঝে স্বাক্ষর বাইক এনে থামায় কাজী অফিসের সামনে। এখানে আসতে দেখে তন্দ্রা বেশ অবাক হয়। তার কৌতুহলী দৃষ্টি স্বাক্ষরের দিকেই। এদিকে স্বাক্ষর যেন বুঝেও অবুঝ হয়ে আছে।

–আমরা এখানে কেন এসেছি?
–কাজী অফিসে মানুষ কেন আসে?
–হেয়ালি ভালো লাগছে না।
–আমি কোথায় হেয়ালি করলাম। যা সত্যি তাই-ই তো বললাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের। বাসায়ও যেতে হবে।
–আমি এখানে আর এক মুহুর্তও নেই। বাড়ি যাবো আমি।

কথাটা বলেই তন্দ্রা চলে যেতে নিলে স্বাক্ষর নিজের পুরুষালি হাতের মাঝে তন্দ্রার কোমল হাতটা আকড়ে ধরে। তন্দ্রা অবাক হয়ে তাকে দেখে। স্বাক্ষর আ’হ’ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই চোখ যেন অনেক কিছুই বলতে চায়৷ মাঝে মাঝে চোখ মনের কথা বলে দেয়।

–আজকের দিনটা হয়তো আর ফিরে আসবে না। হয়তো তোমাকে আমার পাওয়া হবে না। এই দুটো দিন নিজের সাথে কম ল’ড়াই করতে হয়নি আমাকে। অনেক ভেবে চিন্তে আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় হয়েছি। এখন একান্ত তোমার মতামত আমার প্রয়োজন। প্লিজ আমাকে হারিয়ে দিও না।

তন্দ্রা কোনো কথাই বলছে না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বাক্ষরের চোখের দিকে। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে, কথা বলার সময় চোখ দুটি কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি স্বাক্ষর কেঁদে দিবে।

–কিছু বলছো না কেন? তুমি কি রাজি নও?
–বাবা মায়ের দোয়া ছাড়া কোনো কাজই সুষ্ঠু ভাবে সম্পূর্ণ হয় না।
–একবার বিয়েটা হয়ে যাক সবাই রাজি হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ রাজি হয়ে যাও।
–……..
–কিছু বলছো না যে? তোমার মতামত না থাকলে, আমি তোমাকে জোর করবো না। মুখে কিছু বলতে হবে না, তুমি রাজি না থাকলে আমার হাতের নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে পারো। এটাকেই তোমার মতামত হিসেবে ধরে নেব। আই প্রমিজ, এই মুখ নিয়ে আর কক্ষনও তোমার সামনে আসবো না।

তন্দ্রা স্বাক্ষরের হাতটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। যেন ছেড়ে দিলেই আর কখনো তাকে দেখতে পারবে না সে। স্বাক্ষর যেন নিজের সব উত্তর পেয়ে গেল, তন্দ্রার নীরব চাহুনিতেই।

তন্দ্রাকে নিয়ে স্বাক্ষর কাজী অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে৷ তন্দ্রা মাথা নিচু করে রেখেছে। একদিকে পরিবার অন্যদিকে স্বাক্ষর। দুটোই তার অধিক প্রিয়। কারো চেনা কণ্ঠে সামনের দিকে অবাক হয়ে তাকায় তন্দ্রা। ইলোরা, মুহিত আর আকাশ দাঁড়িয়ে আছে৷ সাথে একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেনি সে। ইলোরার তন্দ্রার কাছে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করে।

–হাওয়া খেতে খেতে আসলি নাকি?

তন্দ্রা উত্তর দিল না। চুপটি করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে তার কথা বলার কোনো ইচ্ছে করছে না। সে বাদে ইলোরা, মুহিত, আকাশ সবাই জানতো এই বিয়ের ব্যাপারে। অথচ স্বাক্ষর তাকে শেষ সময়ে এসে জানালো। তন্দ্রাকে চুপ থাকতে দেখে আকাশ স্বাক্ষরকে সন্তপর্ণে জিজ্ঞেস করে।

–কি রে তোদের আসতে এতো সময় লাগলো কেন?
–প্রেম করতে গিয়েছিলাম।

স্বাক্ষরের এমন উত্তর পছন্দ হয়নি আকাশের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে স্বাক্ষরকে বলল…

–তোর সাথে ফালতু বকবক করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাড়াতাড়ি কর। সব ব্যবস্থা হয়ে আছে।
–আমরাও রেডি।

এরপর তন্দ্রার আর স্বাক্ষরের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে যায়। ধর্ম অনুযায়ী কাজী সাহেবকে দিয়ে বিয়েটাও সম্পূর্ণ হয়ে যায় ওদের। সাক্ষী হিসেবে ছিল ইলোরা, মুহিত, আকাশ আর ঐশী। আকাশের গার্লফ্রেন্ড ঐশি। ওদের এনগেজমেন্ট হয়ে আছে খুব শীগ্রই বিয়েও হয়ে যাবে। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই তার মিশুক স্বভাব।

বর্তমান….

ইলোরা, মুহিত, আকাশ আর ঐশী ওরা ওদের বাসায় চলে গিয়েছে। এখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। স্বাক্ষরের ফোনে তার মা বারবার কল করছেন। স্বাক্ষর ছোট্ট একটা টেক্সট করে দেয় তার মায়ের ফোনে। এরপর বাইকে গিয়ে বসে। তন্দ্রার দিকে হেলমেটটা এগিয়ে দেয়৷ তবে সে তা নাকচ করে দেয়। স্বাক্ষর এই নিয়ে কোনো জোর করে না। তন্দ্রা বাইকে উঠে বসে।

–শক্ত করে ধরে বসো।

মুখে কিছু না বললেও তন্দ্রা স্বাক্ষরকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এমন কান্ডে স্বাক্ষর মুচকি হাসে এবং মনে মনে খুশিও হয়। এটা ভেবে তার শান্তি লাগছে যে, এখন থেকে তন্দ্রাবতী একান্ত তার। আজ থেকে তন্দ্রাবতীকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে পিছু করবে না। দুজনের মাঝে রয়েছে এক পবিত্র বৈধ সম্পর্ক।

–এটা হচ্ছে বৈবাহিক আলিঙ্গন। আজ থেকে তুমি আমাকে পুরোপুরি অ’প’হ’রণ করেই নিলে তন্দ্রাবতী। প্রকৃত সৌভাগ্যবান তো সে-ই, যাকে ভালোবাসার জন্য একটা ব্যক্তিগত মানুষ থাকে। আমার সেই মানুষটা একান্তই তুমি।

তন্দ্রা তার মাথার ভরটা স্বাক্ষরের পিঠে ঠেকিয়ে দেয়। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। স্বাক্ষর তাকে কতটা ভালোবাসে। তাকে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে। তন্দ্রা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। না জানি বাড়িতে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এই ভেবে তন্দ্রার কিছুটা দু’শ্চি’ন্তাও হয় বটে। কিন্তু স্বাক্ষরের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সে নিজের মতো বাইক চালাতে ব্যস্ত৷ আসল চিন্তা তো ছিল তন্দ্রাকে নিয়ে। সে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়-ই নাকি! এই সমস্ত প্রশ্নই আজ সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে।

প্রায় আধ ঘন্টার মাঝে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে বাড়িতে আসে। কলিং বেল চাপতেই সাহেরা মাহমুদ হুড়মুড় করে এসে দরজা খুলে দেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেন না তিনি। তন্দ্রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বাক্ষরের পাশে। ড্রইং রুমে সবাই তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সবাই দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। সবার মুখেই গম্ভীরতা বিরাজ করছে। ইউসুফ মাহমুদ কাটকাট গলায় বলেন…

–তন্দ্রাকে তুমি পছন্দ করো এই কথা আমাদের আগে বললেই পারতে।
–ছোট আব্বু আমি তো..
–থাক হয়েছে। নিজের হয়ে আর সাফাই গাইতে হবে না। তোমরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তাই বলে বিয়ের করার সিদ্ধান্তটা একাই নিয়ে নিবে। তন্দ্রাকে তো আগে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তো কিছু বলল না।

ইউসুফ মাহমুদ এর কথায় ফোড়ন কে’টে সাহেরা মাহমুদ বলেন…

–আহা ভাই। ছেলে মেয়ে দুটো মাত্রই বাড়িতে ফিরলো। ভেতরে তো আসতে দাও। তাহু গিয়ে মিষ্টি আর পানি নিয়ে আয়। আমার ছেলে আর ছেলের বউকে বরণ করে নিতে হবে তো। নাকি?

ইউসুফ মাহমুদ চুপ করে সড়ে গেলেন। তাহেরা মাহমুদ ছুটলেন রান্না ঘরের দিকে। ইলিয়াস মাহমুদ কোনো কথাই বলছেন না। উনার রাগ সম্পর্কে অবগত স্বাক্ষর। একটু পরেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। স্বাক্ষর তন্দ্রার হাতটা এখনো ধরে আছে। তার কোমল হাতটা মৃদু কাঁপছে। হয়তো ভয়টা পুরোপুরি যায়নি। তন্দ্রার অহেতুক ভয়ে স্বাক্ষর বেশ উপভোগ করছে। পরিস্থিতি বরাবরই স্বাভাবিক। তুলি অ্যালভিনকে কোলে করে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। এতোক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিল। স্বাক্ষর তন্দ্রার বিয়ের ব্যাপারে সেই কিছুই জানে না। সবাইকে সিরিয়াস মুডে দেখে, সে ড্রইং রুমে গিয়ে তার বাবার পাশে বসে। ইউসুফ মাহমুদ এর কানাকানি বলে….

–বড় আব্বুর কি হয়েছে আব্বু?
–কিছু হয়নি মা।

সাহেরা মাহমুদ তন্দ্রা আর স্বাক্ষরকে বরণ করে ঘরে তুলে নেন। উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে এখানে উপস্থিত সবার চাইতে খুশি তিনিই হয়েছেন। এতোদিনে উনার মনের আশাটা পূরণ হয়েছে। বরণ শেষে তন্দ্রা আর স্বাক্ষরকে তিনি ওদের ঘরে পাঠিয়ে দেন। সবাই ওদের বিয়ে নিঃশব্দে মেনে নিলেও ইলিয়াস মাহমুদ কিচ্ছুটি বলছেন না। তবে মনে মনে ঠিকই সব মেয়ে নিয়েছেন। উপরে উপরে নিজের গম্ভীরতা বজায় রেখেছেন।

চলবে?…….