প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-৩৩

0
789

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩৩

রোকেয়া স্তব্ধ, বাকহারা। তিনি নিজ কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না প্রহরের উচ্চারিত বাক্যটুকু। অত্যন্ত বিস্মিত তাঁর কণ্ঠস্বর,
‘ কি বলছিস!’
প্রহর নির্লিপ্ত। ভাবভঙ্গি প্রচন্ড দায়সারা গোছের। গলায় অচিরেই প্রবল মুগ্ধতা এসে জড়ো হলো।
‘ আমার জীবনে সবথেকে প্রিয় আপনার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া কোমল মনের সুন্দরী মেয়েটা। তাকে আমি আমার বুকের সবচেয়ে দামী স্থানের মালকিন ঘোষিত করেছি সেই বছরখানেক আগে। আমানত হিসেবে রাখুন ক’টা দিন আমার প্রিয়তমাকে যত্ন করে। আমি নিয়ে যাব ওকে খুবই শীগগির। ‘
রোকেয়া তন্ময় হয়ে শুনলেন একেকটা শব্দ,শব্দগুচ্ছ। কর্ণধার আপাতত যেন তালাবদ্ধ হয়ে পড়েছে প্রহরের কথার ধাঁচে। কিছুটা ঝাঁঝ, মুগ্ধ মিশিয়ে বলা প্রতিটি কথা উনার নিরেট মনের গলনে উত্তাপ হয়ে ধরা দিল। ভাঙতে চাইল কঠিনতম প্রাচীর। ক্ষণিকের জন্য গললেও ফের শক্তরূপে ফিরে এলো মন।
‘ আমানত কেন বলছিস? নিশাত আমার মেয়ে। মেয়ে কি আমানত হয়?’
প্রহর মোবাইলটা ডান হাত হতে বা হাতে নিয়ে অন্য কানে ধরল। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
‘ আল্লাহর দেওয়া উপহার মামী। প্রতিটা মা তাঁর সন্তানকে যুক্তিহীন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। সন্তান যেন ভুল পথে না হাঁটে সেজন্য মাঝে মাঝে শা-সন,মা*রধর করে। ইট’স ওকে। কিন্তু সবসময় তার সাথে গম্ভীর, রুষ্ট আচরণ কেন করতে হবে? আপনি ছোট থেকেই নিশুর প্রতি খুব বেশি কড়া। কই কখনও সৌরভের প্রতি তো এমন না আপনি। সৌরভকে ভুল করেও একটা টোকা দিয়েছেন কি-না সন্দেহ আছে,কিন্তু নিশুকে ঠিক ক’বার মে**রেছেন একটু গুণে দেখবেন। সন্তানকে সঠিকভাবে বড় করতে হয়,সেটা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েও করা যায়। নিশু আপনাকে ভয় পায় মামী। তার কাছে মনে হয় এই বুঝি আপনি ওকে মা**রবেন। আপনি আমার বড়। ওর মা। আমার থেকে ভালো বুঝেন। তবুও কি করব বলেন, পাঁজরের হাড্ডি গুড়িয়ে যাচ্ছিল ওর চেহারাটা দেখে। ভালোবাসা অন্যায় নয়,আমাকে ভালোবেসে নিশু কখনোই অন্যায়ের পথে যাবে না। আমি ততটাই আগলে রাখব ওকে,যতটা রাখলে প্রতিটা মেয়ের বাবা-মার চেহারা খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। ‘

আরও একবার বিভোর হতে বাধ্য হলেন রোকেয়া বেগম৷ এই ছেলেটা এত গুছিয়ে, সৌন্দর্য মিশিয়ে কথা বলছে কেন! এড়িয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে ভীষণ। ছোট থেকেই মেয়ের প্রতি আসলেই খুব বেশি কঠোর তিনি। বাড়ির মান সম্মান বজায় রাখতেই মূলত তাঁর এরকম আচরণে লিপ্ত হওয়া। প্রহর সুন্দর করে উনার করা ভুলটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। নিষ্প্রাণ স্বরে বললেন,
‘ তোর এ চাওয়া সব এলোমেলো করে দেবে প্রহর। আমার সাহস নেই তোর মামার সামনে বলার। মেয়েকে চার দেয়ালে বন্দী করে রাখবে তবুও তোর হাতে দিবে না। ‘
‘ উনি রাজি হলে আমাকে মেয়ের জামাই রূপে স্বীকার করবেন মামী?’
রোকেয়া চরম দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন। কি করে রফিক আজমকে রাজি করাবে প্রহর! গাম্ভীর্য স্বভাবের অহংকারে ভরপুর সেই আধবয়স্ক পুরুষ যদি ঘুণাক্ষরেও টের পান নিশাতের প্রেমের অনুভূতি তাহলে সেদিনই হয়ত কেঁপে উঠবে এ বাড়ির প্রতিটি ইট-পাথর,শিউরে উঠবে বসবাসরত প্রত্যেকটা মানুষজন। কণ্ঠটা নিস্তেজ হয়ে আসে দুশ্চিন্তায়।
‘ তোর মামা রাজি হবে না। কারণটা তুই জানিস ভালো করে। তোদের বাড়ির কাউকেই নিশুর আব্বা পছন্দ করেন না। এছাড়া তোর মেজো মামাও বেঁকে বসবে। ‘
‘ আমি কি নিশাতের অযোগ্য? ‘
রোকেয়া বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘ না বাবা। কিন্তু তোর প্রতি ও বেশি ঝুঁকে গেলে পরে যদি ভুল কিছু করে বসে!’
‘ ভয় পাচ্ছেন মামী? ভয় পাবেন না। ও আমারই হবে। পুরো দুনিয়া আমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও ওকেই আমি চাইব। আমাকে না পেয়ে মৃ*ত্যু বেছে নিবে এমন পরিস্থিতি আসার মাধ্যম আমি রাখব না। ‘

সব ভয়,সংশয়,চিন্তা, সব এক নিমিষেই ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল প্রহর। সন্তুষ্ট হলেন রোকেয়া,সাথে হলেন চিন্তার ভার হতে মুক্ত। প্রহরকে তিনি অপছন্দ করেন না। বরঞ্চ ভাগিনা, ভাগ্নী,ননদকে ঢের ভালোবাসেন। গভীর চিন্তা, খটকা আটকে ছিল নিশাতের আবেগি বয়সের পুরো উদ্যমে বাড়ন্ত অনুভূতি নিয়ে। ভাবনা ছিল প্রহরের মনে কিছু নেই তাকে নিয়ে। অথচ এখন জানলেন উনার মেয়ে নয়, বরং নিশাতের জন্য প্রেম ইস্পাতের ন্যায় মুখোভঙ্গির আড়ালে লুকিয়ে গোপনে গোপনে ভয়ংকর পা–গলপ্রেমিক হয়ে উঠেছে প্রহর। কিছুটা আশ্বস্ত হলেও আচমকা একটা কথা মনে পড়তেই উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন করেন,
‘ তোর না বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! আংটি পড়ানোও শেষ মেয়েকে। ‘
প্রহর পুরোদস্তুর তৈরি ছিল এ প্রশ্নটার জন্য। নিস্পৃহ ভঙ্গিমায় উত্তর দেয়,
‘ এটুকু নিশ্চিত জেনে রাখুন মামী- নিশাতই আমার প্রথম প্রেম,নিশাতই হবে আমার একমাত্র বউ। বাকিটা পরে সবাইকেই বলব। আর আমি আংটি পড়াই নি ওই মেয়েকে,পড়িয়েছি আপনার বেক্কল মেয়েটাকে। গিয়ে বেক্কলটাকে একটু আদর করবেন। রাখছি এখন। ‘

রোকেয়া ফোন কান থেকে নামিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভালো হয়েছে সমীরণের পরিবারকে এখনও বিয়ের পাকা কথা দেন নি৷ নয়ত অপ**মানের কবলে পড়তে হত। সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে এতেই মঙ্গল। পেছন ফিরে চমকে উঠলেন তিনি। বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালেন। শঙ্কিত হয়ে পড়লেন৷ নিশাতের ছোট ফুপু আফিয়া অধর যুগলে স্মিত হাসি ফুটিয়ে তুলেন। উনার হাতটা ধরে হাতের আঁজলায় রেখে অভয় দিলেন,
‘ ভয় নেই ভাবী। কেউ কিছু জানবে না। ক্ষমা করে দিও তোমার কাছে এসেছিলাম একটা কাজে। এসেই এসব শুনে আর ফিরে যেতে পারলাম না। প্রহর নিশাতকে ভালোবাসে?’
তিনি অস্ফুটস্বরে জবাব দিলেন,’ হুম। ‘
আফিয়া নিষ্প্রভ, বিষন্ন স্বরে অতীতের বিষাদময় স্মৃতি তুলে ধরেন,
‘ তোমার মনে আছে ভাবী নিরুও রবিনকে অনেক ভালোবাসত? রবিন বাসত না এমন না। কিন্তু ওর ভালোবাসাটা ঠিক কেমন আজও বুঝে উঠতে পারি নি। আলতা বুবুর বিয়ের পর এ বাড়ি,ওই বাড়ির যাতায়াত বেড়ে যাওয়াতে ওদের চুপিসারে যখন প্রেম গভীরে রূপ নিল আমরা কেউই টের পেলাম না। টের পেলাম শুধু নিরুর গর্ভবতী হওয়ার কথাটা। সারা গ্রামেই হড়হড় করে ছড়িয়ে গেল এটা। বিয়ে ছাড়া একটা মেয়ের গর্ভবতী হওয়া এ সমাজে ভালোর চোখে দেখে না কেউই। নিরু তখন ষোলো বছরের মেয়ে। আমাদের রবিন বয়সে কত বড় ছিল ওর! সেই ষোলো বছরের মেয়েটাকে যখন ভরা সালিশে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিয়ের আগে এমন অ**পরাধ কেন করল! আমি দরজার আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখেছি কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা চোখে তুলে সোজা রবিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই চাহনিতে মেয়েটা কী বলতে চেয়েছিল জানো ভাবী?’

রোকেয়া গম্ভীর গলায় বললেন,’ হুম। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল ওর। ওকেই কেন প্রশ্নটা করা হলো? রবিনকে কেন করা হলো না? রবিন কি ওর হয়ে জবাবটা দিয়া দিবে? আশার আলো খুঁজতেছিল রবিনের কাছে। ‘

‘ ঠিক ভাবী। ওদের এত এত পাওয়ার। তবুও ওকেই গ্রামবাসী দোষা**রোপ করল। বিয়ে ছাড়া মা হবার দোষ**টা সে একাই যেন করেছিল। কারণ ও তো মেয়ে। এ সমাজে মেয়েদের ছাড় দেওয়া হয় না। উজ্জ্বল ভাই বোনের পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে রবিনকে যখন প্রশ্ন করলেন সবাই আমার বোনকে প্রশ্ন করতেছে,তুমি কি কিছু কইবা না? প্রেম করার বেলায় দুজন মিলেই তো করছিলা। রবিনকে আমি দেখেছি আঁড়চোখে বড় ভাইয়ার দিকে তাকাতে। কোথাও যেন আমার মন বলতেছিল বড় ভাইয়া রবিনকে তোতাপাখি বানিয়ে ফেলেছে। আমি আরও বেশি শিউর হলাম তক্ষুণি বড় ভাইয়ার উজ্জ্বল ভাইয়ের মুখের ওপর বলা কথায় যে তোর বোন কি দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা? মাইয়াদের লাজ থাকে,ওর ছিল না? মান সম্মানের জন্য তিনি নিজের ছোট ভাইকে সমাজের ঘেন্নার চোখ থেকে বাঁচিয়ে নিলেন,বন্ধুত্ব নষ্ট করলেন, আলতা বুবুকে দূরে ঠেলে দিলেন ওই বাড়ির বউ বলে, সেই সাথে কেড়ে নিলেন একটা মেয়ের প্রাণ। যে যা-ই বলুক আমি জানি বড় ভাইয়ার কোনো কাজই ঠিক ছিল না,অহংকারে সব নষ্ট করে দিয়েছেন উনি। ছিন্ন করেছেন সম্পর্ক।
আলতা বুবু নিজের হাতে সেই ছয় বছর থেকে নিরুকে সন্তানের মতো বড় করেছেন। ষোলো বছরের নিরুর ম**রা মুখটা দেখে এক ফোঁটাও কাঁদতে দেখি নি আপাকে। নিরুর মৃ**ত্যুর পেছনে দোষ ছিল রবিনের,বড় ভাইয়ের। অথচ বুবু এ বাড়ির কারোর প্রতিই রাগ রাখে নি। বড় ভাইয়া রাখলেন,নিজের সম্মান বজায় রাখতে অহংকারী হয়ে উঠলেন। যেখানে কথা ছিল সেই বাড়ির মানুষগুলোর ঘৃ**ণায় মুখ ফিরিয়ে নেবার কথা। তাঁর মতে, উজ্জ্বল ভাই নিরুকে দিয়ে লেলিয়ে দিয়েছিলেন উনার মান সম্মান নষ্ট করতে। উজ্জ্বল ভাইয়ের নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বটাকে তিনি শত্রু**র মর্যাদা দিলেন। আলতা বুবু পালিয়ে বিয়েটা না করলে সেটাও বোধহয় দিতেন না। ভাগ্যিস বাবা থাকতে সেটা মেনেছিলেন। প্রহর নিশাতকে ভালোবাসে শুনে আমি খুশি হলাম ভাবী। আমি মনেপ্রাণে চাই নিশু ভেঙ্গে চুরমার করে দিক তার বাবার অহংকার প্রহরের বউ হয়ে গিয়ে। আমি জানি প্রহর রবিন হবে না। আমার ভাগিনা রবিনের মতো কাপুরুষ না। সম্মান দিয়ে নিয়ে যাবে তোমার মেয়েকে। ‘

সুদীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিঃশব্দে বিলিয়ে দিলেন রোকেয়া। একরত্তিও মি**থ্যা, বানোয়াট কথা বলে নি আফিয়া।
_________________________

শিমুল কালো রঙের একটা থ্রি পিস পড়ে ফটাফট তৈরি হয়ে নেয়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল দেয় সৌরভকে। এছাড়া সৌরভের সাথে যোগাযোগ করার ভিন্ন কোনো পথ খোলা নেই ওর। সম্পর্ক ভালো থাকলে বছরের পর বছর সৌরভের জন্য নানার বাড়িতেই পড়ে থাকত ও। সৌরভকে ইমপ্রেস করার জন্য সকল পন্থা অবলম্বন করত। কলটা ধরা মাত্রই অস্থির হয়ে ক্রমাগত বলতে থাকে,

‘ ঊষা আপুর বিয়েতে যাচ্ছি। আমার আর এসব ভালো লাগছে না সৌরভ ভাই। সবার বিয়ে হয়ে গেছে আমি ক্যান একা একা ধুঁকে ম–রমু? কবে বিয়ে করবেন আমাকে? মামা এ জীবনে রাজি হইবে না,তাইলে কি আপনি এই জীবনেও আমারে বিয়ে করবেন না? ‘
দোকানে কাস্টমার আছে। সৌরভ চাপা,নিরুত্তাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ তোকে বিয়ে করলে তুই বকবক করা কমিয়ে দিবি?’
শিমুল খুশিতে,উত্তেজনায় গদগদ হয়ে উত্তর দিল,
‘ এক্কেবারে বোবা হয়ে যামু৷ তবুও বিয়ে করেন ভাই। ‘
‘ ভাই বললে বিয়ে করব কীভাবে? ‘
শান্ত গলায় কৌতুক মিশেল প্রশ্ন সৌরভের। শিমুল তৎক্ষনাৎ জিভে দাঁত বসিয়ে দেয় একটু জোরেই। ঈষৎ ব্যথায় আর্তনাদ করতে গিয়ে দমিয়ে ফেলে যন্ত্রণা। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে সৃষ্ট হলো,ভাই ডাকলে জামাই কেমনে হবে? মানুষ কী ভাববে? মিনমিন করে আওড়ায়,
‘ আর ডাকব না। ‘
পুনর্বার লাজলজ্জা ভুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ বিয়ে কবে করবেন? বিয়ের আগে একটু রূপচর্চা করতে হবে। আপনার প্রেমে পড়ে চিন্তায়,চিন্তায় আমি কালো হয়ে যাচ্ছি। যদি কালো বউ আপনার ভালো না লাগে!’
সৌরভ তাজ্জব বনে যায়। আজকাল শিমুলের সঙ্গে রাগটা দেখাতে পারে না সে আগের ন্যায়। শিমুলের কণ্ঠটা বক্ষস্থলটা শীতল করে দেয় সেকেন্ডেই৷ সৌরভ বুঝতে পারে নির্দ্বিধায় না চাইতেও শিমুল তার অন্দরমহলের রাণীর মর্যাদা লাভ করতে চলেছে। পরিপক্ব মনটা মারাত্ম–কভাবে চাইছে শিমুলকে। কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে দুর্বার গতিতে শিমুলের সান্নিধ্যে যেতে চাওয়া দেহটাকে দমানো। মন-দেহ সব কঠিনভাবে ঝুঁকে পড়ছে শিমুলের দিক।

কী করবে সৌরভ মোটেও বুঝে উঠতে পারছে না। পিংকিকে মানে নি বাবা,আর শিমুল! কখনোই মানবে না। ত্যাজ্য করবে ওকে প্রয়োজনে। যাকে ভালোবেসেছে তাকে পাওয়া হলো না। যে ভালোবাসে তাকে কেন হারাবে! যে ভালোবাসে ভালো থাকার জন্য তাকে সযত্নে নিজেকে করে নেওয়াই উচিত। সৌরভ নিচুগলায় বলল,
‘ তুই কি জানিস শিমুল তোর লাজলজ্জা কম? বিয়ের পর আমি তোর সাথে কী করব তা জানিস? জানলে লজ্জায় বিয়ের নাম নিতি না। ‘
শিমুল উন্মুক্ত কয়েকটা চুল আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে লজ্জালু হয়ে জানায়,
‘ জানি। ‘
‘ কী জানিস? ভেবেছিস শুধু চুমু খেলেই চলবে, কাম খতম? বাংলা ছবি দেখে এতটুকুই শিখলি! এটা জানলি না শুধু চুমুতে হয় না! ‘

ঝটকা খেল শিমুল। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ফোন কেটে দিল তাৎক্ষণিক। এমন করে সৌরভ কখনো বলে নি,কখনো না। আজ কী হলো সৌরভের? জ্বর ওঠেছে কি! আবোলতাবোল গিলার মানুষ সে নয়। নেশা**ক্ত জিনিসের প্রতি কোনো টান নেই তার। বলাবাহুল্য সে আবার ভদ্রসমাজের ভদ্রলোক। তাহলে অমন বেসামাল কথা কেন বলল! ছোট থেকেই বেশি বেশি বাংলা ছবি দেখে ও। বাংলা মুভির প্রতি তার আসক্তিটা গভীর। তাই বলে এভাবে বলবে! উঁহু! কিছু একটা হয়েছে সৌরভ ভাইয়ের। প্রেম হয়ে যায় নি তো! ভাবনাটা মনে আসা মাত্র বুকটায় ধপধপের সূচনা হলো। পুরো কায়া ঝিমঝিম করে উঠল। কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ করল,
‘ আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন সৌরভ ভাই। ‘
টুপ করে জবাব আসে বার্তাটার,
‘ তোর যদি মনে হয় তোকে আমি ভালোবাসি, তাহলে বাসি। তোর প্রেমের উষ্ণ তাপে গা পুড়ছে আমার ভীষণভাবে। এটা থেকে মুক্তির সমাধান থাকলে আমায় হাওলাত দিস,নয়ত পুড়েই কয়লা হবে অন্তর। ‘
শিমুল মোহিত হয়ে বার,বার পড়ল কেবল। এত এত বকবক করা সে এখন নির্বাক।
______________________________

দুপুরে গোসল সেড়ে হলুদ একটা শাড়ি জড়িয়েছে দেহে ঊষা। তৎপরে রান্নাঘরে ছুটে এসে কফি বানায়। বুয়া ওকে দেখে মুখ হা করে বলল,

‘ আপনে আজকাই শাড়ি পড়ছেন কা আফা? হবু দুলাভাইয়ের লগে ঘুরতেন যাইবেন? বিয়ের আগে বেডা মানুষের লগে ঘুরতে যাইয়েন না। কওন যায় না,যদি আপনেরে সুন্দর দেইখা ওই বেডা আকাম কুকাম কইরা ফেলে?’
বুয়ার মুখ লাগামহীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও ঊষার কাছে সকাল,মধ্যাহ্নবেলা সুন্দর, বুয়ার কথাগুলোও রুমঝুম করে বাজছে শ্রবণগ্রন্থিতে। আস্তে করে প্রশ্ন করে বুয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে,
‘ সত্যিই ভালো লাগছে?’
বুয়া মাথা নাড়াতে নাড়াতে জবাব দিলেন,
‘ হ আফা। একশতে একশ লাগতেছে আপনারে। ‘
মুচকি হেসে হাতে দুই মগ কফি নিয়ে ড্রইং রুমে প্রহরের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো ও। বাড়িয়ে দিল কফির মগ। রান্নাঘরে যাবার আগে নজরে পড়েছিল প্রহরকে। প্রহর চোখ বুঁজে বসে আছে সোফায়। একঝাঁক ক্লান্তি ঘিরে ধরে আছে তাকে। ঊষার ডাকে মেলে ধরল নেত্রপল্লব। প্রশংসা করল অকস্মাৎ,
‘ শাড়ি পড়েছিস! চমৎকার লাগছে। ‘
ঊষার বদনে লজ্জা এসে জুড়ে বসল। মিহি স্বরে বলল,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া। ‘
প্রহর হুট করে জিজ্ঞেস করল,
‘ বসবি আমার পাশে? দু’টো কথা জিজ্ঞেস করার আছে। ‘
দ্বিতীয় কফির মগটার দিকে তাকায় ঊষা। গরম গরম ধোঁয়া উঠছে। প্রহরও সেদিকে তাকিয়ে বলে,
‘ প্রত্যয়ের জন্য? ‘
‘ হুম। ‘
প্রহর ক্ষীণ হাসে। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
‘ দু’টো প্রশ্নই করব। শর্টকাটে উত্তর দিবি। নবাব সাহেবের কফি ঠান্ডা হবে না। তাছাড়া দুপুরে ঠান্ডা কফিই ভালো। ‘
ঊষার মন ইতোমধ্যে খচখচ করা শুরু করে দিয়েছে। বড় ভাইয়ার সঙ্গে মিথ্যা বলা অসম্ভব। বললেও সেটা সহজেই, নিখুঁতভাবে ধরে ফেলে প্রহর। খুঁতখুঁত স্বরে সম্মতি জানায় সঠিক উত্তর দিবে। অতঃপর প্রথমটা প্রশ্নটা শুনেই দ্বিধায় পড়ে যায় কী উত্তর দিবে ভেবে। প্রশ্নটা হলো,
‘ জেদের বশে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছিস?’
ও জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে প্রতুত্তর করল,
‘ কারো ভালোর জন্য রাজি হয়েছি। ‘
প্রহর উত্তর শুনে সেটা নিয়ে বিশ্লেষণে গেল না। দ্বিতীয় প্রশ্নটা করল বিলম্ব না করেই,
‘ তুই প্রত্যয়কে ভালোবাসিস ঊষা?’
ঊষা আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকায়। চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে যায়। রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। কী জবাব দিবে ও! ও জানে প্রহর নিশ্চিত হয়েই প্রশ্নটা করেছে। উত্তর নিয়ে হেলাফেলা করা যাবে না। আর সঠিক উত্তরটা দিলে অনেককিছুই পাল্টে যাবে। পরিবর্তন হবে অনেকের মন,জীবনের গতিও। কিছু কিছু চাপাক্লেশ সবাই নিরবে সহ্য করলেও প্রহরের এই সহ্যক্ষমতা নেই।

#চলবে,,,!