#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৪৭
দাপুটে হাওয়ায় অলকচূর্ণ উন্মাতাল হয়ে উড়ে উড়ে পড়ছে নিশাতের শ্বেতবর্ণ ললাটে। উত্তরের দিক হতে দামাল বাতাস প্রবেশ করছে গাড়ির অভ্যন্তরে খোলা জানালা গলে। ভালোই শরীর শীতলে পরিণত করে দেওয়া বাতাস বইছে। ঠান্ডা লাগছে তার। মাথা ঘুরিয়ে কৃষ্ণ মেঘে ছেয়ে থাকা কালো অম্বরে তাকায় নিশাত। বৃষ্টি নামবে বোধহয়। জোরালো প্রভঞ্জন তারই আগমনের বার্তা বিলি করছে সর্বত্র প্রকৃতিতে। সে পুনশ্চ ঘাড় ঘুরিয়ে তার কাঁধে মুখ ডুবিয়ে রাখা প্রহরের পানে চাইল। মুখটা কাঁধে হওয়ায় ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না প্রহরের চেহারাটা। সাড়াশব্দ নেই, ঘুমিয়ে গেছে কি! যদি সত্যিই ঘুমিয়ে থাকে তাহলে হৃদয় খু**ন করা অতীব প্রিয় চেহারাটা দেখার এখনই মোক্ষম সময়। জাগনা থাকলে এই চেহারা গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে, ছুঁয়ে দেখার সাহস হয় না ওর। চোখ তুললেই কঠিন চাহনি অক্ষিপটে ভেসে ওঠতেই কেঁপে ওঠে ভিতর, তাই ওই চোখজোড়ায় সরাসরি চোখ ডুবিয়ে দেওয়ার সাহসটুকু হয় নি তার কভু।
ঘাড় কাত করেও প্রহরের চেহারাটা না দেখতে পেয়ে বিরক্ত হলো সে। প্রহর এতটাই মুখ ডুবিয়ে আছে তার ঘাড়ে চেহারাটা প্রায় আড়াল। আরেকবার ভালো করে চেষ্টা করতেই তার থুতনি গিয়ে ঠেকল প্রহরের গালে৷ সাথে সাথেই ডান হাতে ছোঁয়া পেল শক্ত হাতের। চকিতে থুতনি গাল থেকে সরিয়ে দৃষ্টি তাক করল নিজের ডান হাতের দিকে। প্রহর চেপে ধরে রেখেছে সেটা। তার মানে ঘুমোয় নি লোকটা! অস্বস্তিতে কাটাকাটা দিয়ে ওঠে শীর্ণ কায়া।
প্রহর হাতটা ধরে রেখে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করল ঘুম জড়ানো কণ্ঠে, ” কী করতে চাইছিলি? চুমু-টুমু খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে না-কি তোর? খেলে আমার চোখে চোখ রেখে খাবি,ঘুমে কেন খাবি? আমার ইজ্জত চু**রি করিস। চুরনি কোনখানের। ”
নিশাতের মুখের বর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল নিমিষেই। কালো রাত্রিরে সূর্যের অরুণ আলোকচ্ছটা যেন বিচরণ করছে তার সমস্ত বদনে। চুমু! প্রহর ভাইয়ের সব কথা সবসময় কেন এই চুমুতেই এসে আটকে যায়? আর সে কি ইজ্জত হরণ করবে? এই লোকের ইজ্জত তো তার নামেই জনমভরের জন্য লিখিত। মুখে বলতে পারল না কথাগুলো। বলল অন্যকিছু, ” আম্মু বলেছে আপনাকে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য। ”
প্রহর ঘাড় থেকে মুখ তুলে সোজা হয়ে বসল। চক্ষুযুগল লাল বর্ণে আরক্তিম। ঘুম এসে হানা দিয়েছে চোখ দুটিতে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। লোকটা কি ক্লান্ত? অমন সন্ধ্যায় চোখে ঘুম! চেহারাটাও কেমন শুকিয়ে গিয়েছে! গতকাল পরীক্ষা শেষে শিমুল বলেছিল নতুন এমপি হওয়ায় প্রহরের কাজের চাপ একটু বেশিই। সবদিক সামলে উঠতে খাটতে হয় দিনরাত। রাতে বাড়িও ফেরে প্রচন্ড দেরি করে। খাওয়া দাওয়ার ঠিক থাকে না।
” আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন তুই? আমার চেহারায় কি দেখছিলি? ”
প্রহর ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল। থতমত সুরে জবাব সাজায় নিশাত,” দেখছিলাম, আপনি ঘুমিয়ে গেছিলেন কিনা। ”
প্রহর সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,” তার মানে তোর মনে অন্য কোনো ইচ্ছে ছিল না?”
” অন্য কোনো ইচ্ছে, কি ইচ্ছে থাকবে?”
” অনেক ইচ্ছে থাকার কথা। এই যেমন ঘুমন্ত বরকে আদর করে একটা চুমু খাওয়া। ”
সিটে মাথা ঠেকিয়েই ঘাড় কাত করে নিশাতের দিকে চেয়ে কথাটা বলল প্রহর। অপ্রতিভ হয়ে পড়ল নিশাত। প্রহরের বেসামাল কথার তীর এসে বিঁধছে বুকে। র**ক্তপাত হবার বদলে দামামা বাজছে সেথায়। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,” যাবেন না ভিতরে?”
” যাব যদি একটা চুমু খাস। চুমু ছাড়া একটুও নড়ব না। ”
প্রহরের জেদি ও নির্লজ্জ কণ্ঠ শুনে বিপাকে পড়ে গেল নিশাত। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলল,” একটু আগে না দিলেন?”
” কি চুমু? ওটা আমি খেয়েছি,তুই স্বেচ্ছায় খাস নি। জামাইকে আদর করতে তোর এত চিন্তা? তোর কি আমার প্রতি ফিলিং জাগে না? বাচ্চা মেয়ে বুকে হামলে পড়ে চুমু খাবি তা না করে বউ হয়ে দূরে দূরে থাকছিস। বাচ্চাবউ কপালে জুটল ঠিকি কিন্তু চুমু আর জুটবে না বউয়ের ইচ্ছায়। বের হ গাড়ি থেকে, মামুজানের কাছে যাব। ”
শেষোক্ত কথাটা তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়েই বলল প্রহর। নিশাত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই প্রহর পরনের জ্যাকেট খুলে গাড়ির ভেতরে ছুঁড়ে মার**ল। শরীরে রইল সাদা টি শার্টটা। সুঠাম, সুপুষ্ট বাহু দুটি নজরে পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলল নিশাত। প্রহর ওর দিকে চেয়ে আদেশের বাণ ছুঁড়ে মারল। বলল,” চল। ”
” আব্বার সাথে কী বলবেন?”
ভয়াতুর শোনাল নিশাতের সুকণ্ঠখানা। রফিক আজম বিকেলে সালিশ থেকে আসার পর নিজের কক্ষ ছেড়ে বের হয় নি আর। কথা বলে নি কারো সঙ্গে। এহেন আচরণে স্পষ্টত তাঁর মেজাজের গতিবিধি। প্রহর কথা বলতে গেলে আরও চটে যাবেন তা নিশ্চিত। মিনমিন করে বাধা দেয় প্রহরকে,” আব্বার সাথে আজ কথা না বললে হয় না? আসলে উনার মেজাজ খুব ভালো নেই আজ। ”
” মেজাজ গরম যখন আমি করেছি,ঠান্ডা আমিই করব। তোর এত চিন্তা করতে হবে না। ”
” কী কথা বলবেন?” সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্নটা করে ফেলল সে। সামনের মানুষটার মুখের ওপর কথা বলতে অফুরন্ত সাহসের প্রয়োজন হয় তার। একে তো বয়সে অত্যধিক বড়ো, তার ওপর স্বভাবে অতিশয় রগচটা এবং ঘাড়ত্যাড়া।
গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও। প্রহর আলোক গতিতে কাছে এসে হাত রাখল ওর দুই পাশে। আটকে নিল তাকে বাহুবন্ধনে। আকস্মিক তার কাছে আসায় এলোমেলো দৃষ্টিতে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে চোখের পল্লব নেতিয়ে ফেলল নিশাত হৃদয়স্থের অসংযত স্পন্দনে। প্রহর ধীর কণ্ঠে কেমন ফিসফিস করে উচ্চারণ করল,
” এই যে তুই আমার বউ, বাচ্চাবয়সী বউ। তোর জ্ঞান, বুঝের অভাব। এতদিনে খেয়ালে এলো বিয়ের পর জামাইকে কীভাবে মিষ্টি মিষ্টি আদর করতে হয় তা তোর জানা নেই, অনুভূতি নিরামিষ তোর। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাছে রেখে তোকে কীভাবে বরকে আদর করতে হয় তা শেখাব। এজন্য মামুজানকে গিয়ে এখুনি বলব আমার বউ আমাকে দিয়ে দিতে। আমারটাকে আমি বুঝিয়ে পড়িয়ে আদরে একদম দক্ষ বানাব। লজ্জার ‘ল’ ও থাকতে দেব না তোর মধ্যে। এত লজ্জা দিয়ে আমার কী হবে যদি আমি চুমু থেকেই বঞ্চিত হই?”
নিশাতের মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি পাগল হয়ে যাবে,নয়ত হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মা**রা যাবে। কেন যে বিয়ে বসতে গেল! বিয়ের পর তাকে বাহুতে বন্দিনী বানিয়ে রাখা মানুষটা যেন বদ উম্মাদ হয়ে গেছে! প্রহর সরে গিয়ে বলল,” যা তোর চুমু দিতে হবে না,একটু জড়িয়ে ধর। ”
মাথা নুইয়ে একটু একটু করে প্রহরের বুকের কাছে এসে দাঁড়াল সে। জড়িয়ে ধরতে বাধা নেই তোর। অন্য বেলায় লজ্জাটা যেন জেঁকে ধরে তাকে। লজ্জা-শরম উচ্ছন্নে দিয়ে প্রহরের দুই বাহুর ফাঁক দিয়ে হাত নিয়ে রাখল পিঠে,জাপটে ধরল প্রহরকে। বিলম্ব না করে নিমেষে কোমলমতি শরীরটা নিজের বুকে মিশিয়ে কোমর আগলে ধরে সামান্য উঁচুতে উঠাল প্রহর। নিশাতের বন্ধ চোখে চেয়ে প্রগাঢ় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন গলায় বলল,
“কত আর তোর সাথে গাড়িতে, বাহিরে রোমান্স করব বল? বিয়ে করার পর এমন দূরত্ব আমার মানতে ইচ্ছে করে না। তোকে ছাড়া আমার শোবার ঘরটা, আমার হৃদয়টা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। তোর প্রেমোত্তাপে বছরখানেক ধরে পুড়ছি,এবার আমি পুড়তে চাই আদরের উত্তাপে। তুই কি আমার চাহনি,ইচ্ছে, কথা বুঝতে পারিস না? এতটা গাধী তো তুই না। ”
নিশাত চোখ বন্ধ রেখে মোটা ঠোঁট জোড়া নেড়ে ক্ষীণভাবে বলে উঠল,” বুঝতে পারি। ”
প্রহর পুনরায় বুকে মিশিয়ে হেসে বলল,” আলহামদুলিল্লাহ, আমার বউয়ের বুঝ হয়েছে। ”
________________________
তনুজা বসে বসে ই-মেইল চেক করছে। আমেরিকাতে পার্ট টাইম একটা জব করত সে। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে ফিরতে না পারায় হাতছাড়া হয়ে গেছে জবটা। গতমাসেই প্রহরের সাথে দেখা করে চলে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়াতে যাওয়া হয় নি। হুট করেই ব্রেইন স্ট্রো**ক করেছে বাবা। ডাক্তারের অবজারভেশনে রাখতে হচ্ছে সর্বক্ষণ। অর্থব হয়ে পড়ে আছে লোকটা। অকস্মাৎ বাবার এমন করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় চিন্তায় জর্জরিত হয়ে আর ফেরা হয় নি তার ওই দেশে। একটু সুস্থ হলেই ফিরে যাবে। প্রহর এমপি হয়ে যাওয়াতে সবথেকে খুশিটা বোধহয় সে হয়েছে। আজকাল লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব।লাস্ট বার দেখা হয়েছিল অন্তিম ও মৃন্ময়ীর বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে যাওয়ায়। তন্মধ্যে প্রহরের কাছ থেকে সমীরণের ব্যাপারে আরও একটা অকল্পনীয় সত্য জানতে পেরেছে ও। এটা জানার পর থেকে আরো বেশি ঘৃণা জন্মাল ওর সমীরণের প্রতি, আর চিন্তা বাড়ল প্রহরের জন্য। জানে, প্রহর বিচক্ষণ লোক,সব সামলে নিতে পারবে তবুও সমীরণের কার্যকলাপ ভয় পায় তনুজা। একটা মানুষ এত নিকৃষ্ট কীভাবে হয়!
প্রহরের সহায়তা নিয়ে মৃন্ময়ীকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে তনুজা। তার বাবার ট্রান্সফারও করিয়ে দিয়েছে সেই শহরে প্রহর রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে। কিন্তু সমীরণ হন্য হয়ে খোঁজ করছে তার। সেকারণে তনুজা, মৃন্ময়ীকে নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। সে আমেরিকা যাবার গুটি কয়েকদিন পরেই নিয়ে যাবে মৃন্ময়ী ও ভাইয়ের রেখে যাওয়া অংশকে। মানুষ দুটো এদেশে নিরাপদ না। অন্তিমকে কথা দিয়েছিল সে প্রাণ ত্যাগ করে মৃন্ময়ীকে বাঁচাতে হলে বাঁচাবে, তবুও কষ্ট পেতে দেবে না। আদৌ কি ভাইকে দেওয়া কথার পুরোপুরি পালন করতে পারছে সে? পড়ালেখা নষ্ট হয়ে গেল মৃন্ময়ীর। কত স্বনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত মেয়েটা! সমীরণের জন্য মাঝপথে ছেড়ে দিতে হলো সব। অন্তিম একদিন অসুস্থ শরীরে তাকে কলে বলেছিল,” মৃন্ময়ী শুধু আমার বউ না,আমার প্রাণ। তুই আমার প্রাণকে আগলে রাখবি, তনু? আমি যে আমার প্রাণটাকে আর দেখব না রে, কখনো আর জিজ্ঞেস করতে পারব না,’ কেমন আছো প্রাণ?’ তুই কি তাকে বলবি আমার হয়ে আমার প্রাণকে আমি ভীষণ ভালোবাসি? দেখিস, ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়। ”
ল্যাপটপ বন্ধ করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল তনুজা। ভাইয়ের কথা আজ মনে পড়ছে খুব। কেন এমন হলো? রাজনীতি! রাজনৈতিক ক্ষমতাই জীবনের সব? কি পেল সমীরণ অন্তিমকে মে**রে? পেল না তো রাজনৈতিক ক্ষমতা। তনুজা চাইলে এক মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারে জানো**য়াররূপী ওই ভাইটাকে। কিন্তু সে চায় সমীরণের জীবনে যন্ত্রণা আসুক। এমন যন্ত্রণা, যেই যন্ত্রণায় তিলে তিলে মৃ**ত্যুকে নিজ মুখে আহ্বান করবে সে। মোবাইল হাতে নিয়ে প্রহরের নাম্বারে ডায়াল করল। সংযোগ হলো না। ফের ডায়াল করতে গিয়ে থমকে গেল। অবাধ্য মন প্রহরকে চায় বলে কি সে তাকে সায় দেবে? কখনো না৷ নির্বোধ মনকে তখুনি সায় দেওয়া যায় যখন অপর জন তাহাকেই চায়। অপরজনের মনে যদি থাকে অন্য কেউ তবে কেন বেহায়া হবে সে? আমেরিকা থেকে সে প্রহরের সাথে সমীরণের বিরুদ্ধে প্ল্যান করে আসলেও সত্যিকারে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল প্রহরের। তার অস্থিরতা,আচরণ কিছুই লোকদেখানো ছিল না৷ ভেবেছিল খুলে বলবে প্রহরকে মনের কথা,’দেখুন নেতাসাহেব অভিনয় করতে এসে প্রেমে পড়ে গিয়েছি আপনার,আপনি কি বুঝতে পারছেন?’ কিন্তু বলা হলো না। যার মনে অন্যের বসবাস তাদের জীবনে তৃতীয় পক্ষ হবার মতো বোকা মেয়ে সে নয়।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে গম্ভীর স্বরে বলল,” দরজা খোলা আছে। ”
সমীরণ শব্দ করে দরজা মেলে পাগলাটে ষাঁড়ের ন্যায় ছুটে আসল তার দিকে। টলল না ও। সমীরণের তীক্ষ্ণ আগমনে নিজের জন্য ভয়ংকর কিছুর পূর্বাভাস বুঝে গেল। সত্য তাহলে জেনেই গেল সমীরণ! নির্ভয় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” মা**রতে আসছ ভাই? ”
সমীরণ থেমে গিয়ে বলল,” তুই বোন নামে কল**ঙ্ক। আমার বিরুদ্ধে আমার শ–ত্রুর সাথে আমাকে ধ্বংস করার প্ল্যান করতে বুক কাঁপল না তোর?”
” তোমার বুক তো কাঁপে নি অন্তিম ভাইকে মার**তে। তাহলে আমার কেন কাঁপবে? ”
সমীরণ বাকা হাসল। বি**ষের ছোট বোতলখানা বের করে বলল,” বিশ্বাস কর বোন, তোকে মার–তেও এখন আমার বুক কাঁপবে না। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই, বোন হোক বা ভাই। স্বার্থপর হলেই দুনিয়ায় শান্তি। নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিলে শান্তি পাব নাকি?”
তনুজা মোটেও ভড়কাল না। সে জানত সত্য প্রকাশিত হলে তাকেও ছাড় দেবে না সমীরণ।
____________________
মেয়ের জামাই এসেছে বলে রোকেয়া ও পিংকির মা নানারকম নাস্তা তৈরি করলেন। সেগুলো সাজিয়ে রাখল প্রহরের সামনে। সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,” এসব খাব না,শুধু কফি হলেই চলবে মামি। ”
রফিক আজম ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুর পাড়ে যাবেন ভাবছিলেন৷ গম্ভীরমুখো হয়ে প্রহরকে এড়িয়ে চলেই যাচ্ছিলেন, নিশাত বসার ঘরে দাঁড়িয়ে দেখল প্রহর তার আব্বাকে ডাক দিল,” দাঁড়ান শ্বশুরজান। আপনার সাথেই কথা বলতে এলাম। ”
প্রহরের ভরাট গলায় আব্বাকে এমন অদ্ভুত সম্বোধন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল নিশাত। রফিক আজমের চেহারাটাও কেমন কুঁচকে গেল। বিরক্তি প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলেন,” এসব কেমন ডাক? আমাকে অসম্মান করে শান্তি হয় নি তোমার? ”
প্রহর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললল,” মামা-ভাগ্নের দীর্ঘকালের হিসেব- নিকেশ ছিল, আজ তা সমাধান হলো ব্যাস। এখন আপনি আমার চোখে কেবল আমার বউয়ের আব্বা, সুতরাং মামুজান থেকে এখন আপনি আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুরজান। এক পা-ও নাড়াবেন না,সিরিয়াস কথা আছে আপনার সাথে। ”
নিশাতের মুখ হা হয়ে গেল, প্রহর ভাই কি আব্বাকে আদেশ করছে না-কি অনুরোধ?
রফিক আজম রেগে গেলেন,” কী বলতে চাও তুমি?”
” বউ চাই,আমার বউ আমাকে দিয়ে দিন, শ্বশুরজান। ”
#চলবে~
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৪৮ ( অর্ধাংশ)
প্রহরের কথা শ্রবণ হতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় নিশাত। সামান্য ফুলোফুলো গাল দুটো ঈষৎ লালের আবরণে ঢেকে গেল তৎক্ষনাৎ। অপ্রস্তুত চাহনিতে আব্বার দিকে চাইল, সেখানে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখে নিল একবার প্রহরকে। অতিশয় নির্বিকার দেখাচ্ছে তাকে। যেন চমকানোর মতোন বা লজ্জা পাওয়ার মতো সে কিছুই বলে নি। জবাবের প্রতীক্ষায় নিষ্পলক চেয়ে আছে আব্বার দিকে।
রফিক আজমের কপালে বলিরেখার ভাঁজ পড়ল। এগিয়ে এসে প্রহরের সামনে উপস্থিত হলেন তিনি। গলার স্বর কঠিন রেখে প্রশ্ন করলেন, ” বউ দিয়ে দেব মানে? আমাদের আগে কথা হইছে না,কলেজ পাশ করলে নিয়ে যাইবা তোমাদের বাড়িতে?”
প্রহর বসা থেকে নির্লিপ্ত সুরে বলল,” বসুন শ্বশুরজান, বসে কথা বলি আমরা। ”
এবার ভয়ানক রাগ চড়ে গেল রফিক আজমের মাথায়। এমন বেয়াদব, অস–ভ্য ছেলে উনি জীবনেও দেখেন নি। ইচ্ছে করছে তিন চারটা চপেটাঘাত বসাতে,কিন্তু সময় তাঁর প্রতিকূলে বলে পারছেন না। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় রাগান্বিত স্বরে বললেন,” যা বলার জলদি বলো। তোমার সাথে বসে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই। এমপি হতে পারো শহরে, কিন্তু আমার চোখে তুমি আস্ত বড়ো বেয়া**দব। ”
প্রহরের ঠোঁটের কোণে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের ন্যায় ঝলমলে হাসি ফুটে উঠল। বসা থেকেই কথার পিঠে কথা বলল,” আপনাকে সম্মান করলেও ভাবেন বেয়াদবি করছি,অসম্মান করলেও ভাবেন বেয়াদবি করছি। না পেলাম ভাগ্নে হিসেবে দাম,না পেলাম মেয়ের জামাই হিসেবে সম্মান। কখনো আমাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখেন নি,ভালো লাগার চোখে দেখলে আমার ভুলগুলোও ফুল মনে হতো আপনার। আপনার মতো মামু ও শ্বশুর পেয়ে জীবনটাই লস হয়ে গেল। এখন আমার বউটা-ই দিচ্ছেন না। বিয়ে করে ফেলেছি,বউ থাকবে আমার কাছে। শর্ত কেন রাখবেন?”
” দেখতেই পাইতেছ ওর এখন পড়াশোনা করার বয়স, এটুকু বয়সে সংসার কী করবে? আমি কি তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাইছি? জোর করে ফুসলিয়ে ফাঁসিয়ে বিয়া করছো তুমি।”
শ্বশুরের ত্যাড়া কথাগুলো কর্ণধারে হানা দিতেই প্রহরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রূপে থেকে বাকবিতণ্ডা ছেড়েছুঁড়ে বলল,” আমার আপনার সাথে তর্ক করার একদম ইচ্ছে নেই। আপনার মেয়ে হতে পারে বয়সে ছোট,কিন্তু আমি? আমি তো বড়ো। আমার সংসার করার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আপনার এই ছোটো মেয়েকেই আপনি কয়েক মাস আগে সমীরণের সাথে বিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন ছোট মনে হয় নি? আমার বেলায় এসব ছলচাতুরী বন্ধ করুন। ভালোবাসি আপনার মেয়েকে,তাই বলে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন? তাহলে আমিও যে আপনার মতো একই পথে হাঁটব,প্রাণপ্রিয় শ্বশুরজান। ”
সমাপ্তিতে বলা কথাটুকু প্রহর কাছে এগিয়ে এসে অত্যন্ত নিচু স্বরেই বলল। রফিক আজম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন কিঞ্চিৎ শব্দ সৃষ্টি করে। বুঝলেন,এই ছেলের সঙ্গে আর পারবেন না তিনি। চেয়েছিল নিজ অহংকারে অটল থেকে স্মরণিকা নিবাসের প্রতিটি মানুষকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে নিজের করা কর্ম তিনি নিজেই ফেরত পাচ্ছেন। বছর বছর ধরে যে রহস্য ছিল গোপন,প্রহর সেটা খোলাসা করে আজ সালিশে তাঁকে গ্রামের মানুষের সম্মুখে, সবার চোখে ছোট করে দিল। কিছু মানুষের কুমন্ত্রণায় ক্ষমতা অত্যধিক পাওয়ার লোভে লোভাতুর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চেয়ারম্যান নির্বাচনে,চেয়েছিলেন উজ্জ্বল সাহেবকে হারিয়ে গ্রামে রাজত্ব বাড়াতে। কিন্তু বিগড়ে গেল সব। অর্থের লোভ দেখিয়ে জিততে গিয়ে উল্টো ফেঁসে গেল জীবনভরের জন্য। প্রহর সেটার-ই ফায়দা লুটে তাঁর সকল অহংকার ধূলিসাৎ করে দিতে চাইছে। প্রহরের চোখে মেয়ের জন্য সবসময় অন্যরকম টান দেখতে পেতেন তিনি। নিশাত ও তার মাঝে দূরত্ব টেনে দিয়ে কষ্ট দিতে চেয়েছিলেন প্রহরকে। সেটাও আর হয়ে উঠবে না। তিনি স্বয়ং মানেন সর্বদা, আপনজনের চেয়ে তিনি নিজের সম্মান, অহংকারটাকে ভালোবাসেন বেশি। তাঁর অহংকারের নিকটে বাকি সবই নিরর্থক,তুচ্ছ। কিন্তু আজ বড্ড অসহায় লাগছে তাঁর নিজেকে। জেদটুকুও দেখাতে পারছেন না প্রহরের সামনে। যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো পরাজয় মেনে নিয়ে বললেন,
” সামনের মাসে তুলে নিয়ে যেয়ো তোমাদের বাড়িতে। এ নিয়ে পরে কথা বলব। তোমার আব্বা আম্মাকে আসতে বলিয়ো। ”
প্রহর আনন্দিত ভঙ্গিতে কফির কাপে সিপ দিতে লাগল। নিশাত, রোকেয়া, আফিয়া, সবার মুখচ্ছবিতে বিস্ময় স্পষ্ট। এত সহজে মেনে গেলেন রফিক আজম! প্রহর কফির কাপটা টেবিলে রেখে বলল,” আমি কেন বলব? নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা নিজে বলতে লজ্জা লাগে আমার। বরং আপনি আমার বাপকে কল করে বলবেন এ ব্যাপারে কথা বলতে চান। ”
রফিক আজম চোখা দৃষ্টিতে তাকালেন। নির্লজ্জের মতো বউ চাইছে, আবার বলে বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা বলতে লজ্জা লাগে! সব যে উনাকে নাস্তানাবুদ করার জন্য, ভালোই টের পেলেন তিনি।
” অসম্ভব। আমি ফোন দিমু না,আমার মেয়ে নেওয়ার আগ্রহ তোমাদের। আমার না। ”
কাটা কাটা গলায় বললেন। প্রহর একরোখা গলায় বলল,” ঠিক আছে,তবে আমি আমার পথ দেখতে হবে। ”
প্রহর যে তাকে আবার ব্ল্যাকমেইল করছে তা বিশদ হয়ে গেল রফিক আজমের কাছে। বহুদিন, বহুকাল পরে তবে দম্ভের প্রাচীর ভেঙে নত হতে হবে উজ্জ্বল সাহেবের সামনে। এই মুহূর্তে আদরের মেয়েকেই থা**প্পড় দিতে ইচ্ছে করছে উনার, মেয়েটা প্রহরকে বিয়ে না করলে এসব হতোই না।
” আমি কথা বলব। ”
বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন তিনি ঘর ছেড়ে । রোকেয়া এখনো হতবাকের সমুদ্রের অতল গহব্বরে ডুবে আছেন,সাথে বসার ঘরে উপস্থিত বাকি সবাইও। সৌরভ সবে সদর দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে ঘরে ঢুকেছিল। আব্বার ও প্রহরের কিছু বাক্যালাপ তারও কানে এলো। তবে কি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে? আজ প্রথমবার প্রহরকে খুব পছন্দ হলো তার। যতই বেয়াদব হোক না কেন, কোনো না কোনোভাবে এই বাড়ি আর ওই বাড়ির মানুষগুলোর একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত সহজ করে দিচ্ছে সে। এখন সকল পারিবারিক, কলহ মিটে গেলেই হয়।
_________________________
সমীরণ সোফায় বসে সামনের টি-টেবিলের ওপর পায়ে পা তুলে গালভর্তি হাসি নিয়ে বলল,” প্রহর ও তার আপনজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তোর কী লাভ হলো,তনু? রক্তের সম্পর্কের সাথে কেউ বেইমানি করে?”
তনুজা ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসল। সমীরণের মুখোমুখি বিছানায় বসে উরুতে কনুই ঠেকিয়ে এক হাত রাখল গালে। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,” আমি বেইমানি করেছি? কখন? একটুও মনে পড়ছে না,ভাইয়া। আমার যতদূর মনে আছে বেইমানি তুমি করেছ। এমপি পদ পাওয়ার জন্য, ক্ষমতার লোভে আপন ভাইকে ড্রাগস দিয়ে খুব সুন্দরভাবে হ—-ত্যা করেছ। দুনিয়ার সামনে বানিয়েছ মাদকা—-সক্ত ব্যক্তি। আমি তো কেবল এক পা***পীর আশাকে ভঙ্গ করেছি। তুমি একজন যোগ্য এমপি কীভাবে হবে? যোগ্য এমপি হবার আগে যে তোমার যোগ্য ভাই ও একজন ভালো মানুুষ হবার ঘাটতি যে রয়ে গেছে। তুমি হলে হিং—স্র প**শু।”
সমীরণ রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করল তনুজার দিক। মুখাবয়বে কঠিন ও হিংস্র–তার খেলা। তনুজা টলল না। উল্টো ভীতি হীন ও নিস্তরঙ্গ গলায় প্রশ্ন করল,
” গায়ে লাগছে,ভাইয়া? শুনতে খুবই বি–শ্রী তাই না? কিন্তু তুমি তো এটাই। কী পেলে এমন হয়ে? ধ্বংস ছাড়া কিছুই পাবে না। ক্ষমতা অত প্রিয় হলে কেন বললে না বাবাকে? অন্তিম ভাইকে মা—রার কী দরকার ছিল? কই,নেতাসাহেবকে মে***রে তো পারছো না ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে! আসলে উনাকে টেক্কা দেবার মতো ক্ষমতা তোমার মাঝে নেই, তোমার মাঝে আছে বেইমানি করে কাউকে মে**রে ফেলা। তুমি হচ্ছো হ—-ত্যাকারী, অসহায়, কাপুরুষ। ”
সমীরণ সামলে রাখতে পারল না আর জেদটুকু। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে গলা চেপে ধরল তনুজার। মুহূর্তেই গলদেশে তার হাতের চাপে তনুজার ফর্সা বদনকান্তি ছাই রংয়ে ছেয়ে যেতে লাগল। সমীরণ ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,
” কষ্ট হচ্ছে বোন?”
চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরছে তনুজার। মুখে মেকি হাসি। ব্যথিত কণ্ঠে কষ্টেসৃষ্টে উচ্চারণ করল,
” উঁহু! বরং আমায় মার***লে তুমি ফেঁসে যাবে। নেতাসাহেবের কাছে আমার একটা চিঠি দেওয়া আছে,বুঝলে? যেই চিঠিটায় আমার স্বাক্ষর সমেত লেখা আছে আমার মৃ**ত্যু হলে সেটার পেছনে তুমি দায়ী থাকবে। এবং অন্তিম ভাইয়ের মৃ–ত্যুর প্রমাণসহ সব দেওয়া। একদিকে তুমি আমায় শেষ করবে,অন্যদিকে তোমায় শয়–তানি রূপ এই জগতসংসার দেখবে। অতি দুর্বল মন কিংবা খালি হাতে তোমার সাথে লড়াই করতে নামি নি। ”
” কী চাস তুই? ”
” আশা ভঙ্গ হবার,প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল না পাওয়ায়,ক্ষমতা না পাওয়ার,ঘৃ**ণা পাওয়ার যন্ত্রণায় তুমি ধুঁকে ধুঁকে ম**রো। নয়তো কবেই পারতাম তোমায় জেলে পাঠাতে। কিন্তু জেলের কারাগারে বন্দি হবার চেয়ে নিজের মনে বন্দি হয়ে একটু একটু করে ম**রা বেশি যন্ত্রণাদায়ক। এর থেকে বড়ো শা**স্তি কী হতে পারে? তুমি এটাই পাবে ও পাচ্ছ, আমি জানি। ”
সমীরণ হিসহিসিয়ে বলল,” ভুল করছিস, তুই। ঠিকি তোকে আমি অন্তিমের মতো মা–রব। বাবাকে বহুবার বলেছিলাম আমায় রাজনীতিতে ক্ষমতা পাইয়ে দিতে। কিন্তু শুনেন নি তিনি। আর অন্তিমও এমপি পদ পাওয়ার জন্য লোভী ছিল। তার সাথে বান্দরবান ট্রিপে গিয়ে নানান কৌশলে মাদ–কের প্রতি এডিক্টেড করলাম। সেখানে থাকাকালীন কয়েকদিন জোর করেই আমি ড্রা**গস দিলাম, তারপর থেকে সে নিজেই আসক্ত হয়ে পড়ল। নেশাতুর জিনিস থেকে কি দূরে থাকা যায়,বল? তো সে নিজে মর**ল না? আমার দোষ কোথায়? আর বাবা-মায়ের কাছেও তো আমার দোষ বলে যায় নি। ”
” বলবে কীভাবে? বললে তো, তুমি হুমকি দিয়ে রেখেছিলে মৃন্ময়ীকে মে**রে ফেলতে। ভাইয়া তখন তোমাকে মোকাবিলা করার মতো পরিস্থিতিতে,সুস্থ শরীরে ছিল না। তুমি ভাইয়াকে এমন করে অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়ে বলছ তোমার দোষ কোথায়? পরিকল্পনা করে মে***রেছ তুমি তাকে। একটা মেয়ের জীবন শেষ করেছ। ”
” ওহ! ভালো কথা,মৃন্ময়ী কোথায়? কোথায় পাঠিয়েছিস তুই ওই শা—লীকে?”
” নোংরা কথা বলবে না ওকে নিয়ে। ওর জীবনটা শেষ করে দিয়েছ তুমি। ”
” শেষ হলো,কই! ঠিকি অন্তিমকে ভুলে প্রত্যয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাইতেছিল। কই লুকাইছিস ওরে? তুই কি ভাবছি আমার আড়ালে তুই এতকিছু করবি,কখনো জানমু না? শুধু একটাই আফসোস,বাবা তোরে ভালোবেসে আবারও একই ভুল করল। আবারও আমার থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল। দাঁড়াতে দিল না আমায় এমপি নির্বাচনে। ইচ্ছে করছিল তখনই মে—রে ফেলি,কিন্তু মাথা গরম করে আর কিছু করতে চাই নি। শত হোক, বাপ তো। করে ফেলেছে বোকামি। সমস্যা নেই, প্রহরকে সরালে সেই আসন একদিন আমার হবেই। রাজনীতিই আমার জীবনের সবথেকে বড়ো নে**শা, বুঝলি? ওই আসনে না বসা অব্দি তৃপ্তি পাব না। তোর বেইমানির শা**স্তিও সময় বুঝে দেব আমি। ”
তনুজা ক্রুর হতে ক্রুরতর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,” তুমি আমাকে,বাবাকে,মাকে কখনো কাউকেই ভালোবাসো নি। ক্ষমতাকে ভালোবাসো,রাইট? এমন কোনো মানুষ কি নেই এ ধরায়,যাকে তুমি ভালোবাসো? যার ভালোবাসা না পেয়ে মৃ—ত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করবে তুমি মৃন্ময়ীর মতো?”
সমীরণের নেশাটা ভালোই জেঁকে ধরেছে। তনুজার প্রশ্ন হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চাইল সে। কিন্তু হলো ব্যর্থ, ফেঁসে গেল ঐন্দ্রজালিক এক মুহূর্তে। চোখের সামনে যেন ভাসল ঊষার মায়াবী বদনখানি, স্ফীত হাসিখানা,তার দিকে গরম দৃষ্টিতে তাকানো। মাঝেই মাঝেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল্পনায়-বাস্তবে ঊষাকে হাতড়ে খুঁজে বেড়ায় সে। আগের মতো তাকে শারীরিক ভাবে পাওয়ার জেদ কাজ করে না,কেবল একটাই ক্রোধ হয় ঊষা কেন তার হলো না? কেন প্রত্যয়ের হলো। ঊষাকে বুকে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে তার প্রচন্ড। মুখ ফস্কে বলতে মন চায়,” শুধু তোমার দেহখানি নয়,তোমার মনটাও আমার দখলে চাই,ঊষা। ”
তবে কি তার মন জমিনে ঊষার জন্য রাখা অনুভূতির বীজ অঙ্কুরিত হয়ে পরিণত হলো ভালোবাসায়? তনুজাকে জবাব দিল এক শব্দে,” না। ”
______________________
প্রত্যয় আজ আর হলে ফিরে যেতে দেয় নি ঊষাকে৷ সোজা বাড়িতে নিয়ে এলো। আসার পর বাবার কাছে গিয়েছিল সে দেখা করতে। মোশতাক সাহেব রাতে একটু জলদিই ঘুমিয়ে যান ঔষধ খেয়ে, তবে আজ মেয়ের সাথে বেশ খানিক্ষণ আড্ডা দিয়ে ঘুমোলেন তিনি। বাবার ঘর থেকে রাত এগারোটায় বেরিয়ে আসে ও। নিজের ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যায়। ঘরটায় আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। অন্ধকারে হাতড়ে ঘরের আলো জ্বালানোর জন্য উদ্যত হলো সে। নিমিষেই পেছন থেকে একটা গম্ভীর স্বর তাকে বাধা প্রদান করে, ” জ্বালাস না আলো। ”
#চলবে~
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব______৪৮( বাকি অংশ)
” কেন জ্বালাব না?”
” তোর কেন-র উত্তরটা অন্যভাবে দেব আমি,মুখে নই। ”
অত্যন্ত গাঢ়, উন্মত্ত, মোহনীয় পুরুষালি কণ্ঠ ঊষার শ্রবণগ্রন্থিতে প্রবেশ করে সোজা হৃদপিণ্ডে এসে অনুভূতিদের মাঝে বাধিয়ে দিল গোলমাল। হাত-পা, বুক, সর্বাঙ্গে প্রারম্ভ হলো তুমুল আন্দোলনের। অবিরাম ঘাড়ে গভীরভাবে স্পর্শ করা প্রত্যয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর সইতে পারল না ঊষা। ত্রস্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলো সমুখে দাঁড়ানো পুরুষের। বাহিরের জ্বলন্ত বাতি থেকে কিছুটা আলোকচ্ছটা একেবারেই মৃদুভাবে ঘরের অভ্যন্তরে গমনের অধিকার খাটানোর শ্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই স্বল্প দীপ্ততার সাহায্যে আবছা আবছা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ সুদর্শন চেহারাখানা দৃষ্টিতে আবদ্ধ করার সুযোগ মিলছে তার। কেন যে এ বৃষ্টিমুখর, অমানিশায় ডুবন্ত মুহূর্তে প্রত্যয়কে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না ওর। অত্যাসক্ত পুরুষকে রেখে ধীরে ধীরে পিছিয়ে সফেদ প্রাচীরে গা ঘেষে দাঁড়াল সে। উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন করল,
” তোমার কী হয়েছে বলো তো? জোর করে বাসায় নিয়ে এলে। এতদিন পর নিজের রুমটায় পা রাখলাম, বলছো আলো জ্বালাবি না। আবার বলছো, মুখে বলবে না। এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছো কেন? নেশাটেশা তো করো নি,গন্ধ পাচ্ছি না। তবে হলো টা কী?”
প্রত্যয় দুজনের মধ্যকার তফাতের অদৃশ্য দেয়াল নিষ্পেষিত করে দিয়ে এগিয়ে এসে বা হাতটা ধরল ঊষার ভীষণ আলতোভাবে। পরক্ষণেই সেই স্পর্শ কঠিন থেকে কঠিনতর হলো। অপর হাত বাড়িয়ে লক করে দিল দরজাটা। দপ করে পুরোপুরি অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায় কক্ষ। মোটামুটি বড়োসড়ো আকৃতির কক্ষে ছড়াতে লাগল প্রত্যয়ের ফিসফিস করে বলা কথাগুলো।
” অনেক কিছু হয়েছে। তুই খোঁজ রেখেছিস আমার? রাখিস নি। অভিমানে দূরে থেকে, আমাকে মে*রে ফেলার ফন্দি এঁটেছিলি তুই। এবার তুই দূরে যাওয়ার আগে আমি তোকে বন্দি করে ফেলব। শিকল পরিয়ে দেব তোর পায়ে। ”
ঊষা হতবিহ্বল হয়ে ভ্রু কুচকে আওড়ালো,” শিকল পরিয়ে দেবে!”
” হ্যাঁ, প্রেমের শিকল। এই শিকল তোকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দেবে না ভোরের পাখি। প্রেম শিকলে বেঁধে তোকে অনন্তকাল আমার বুকে পোষে রাখব আমি। তুই চাইলেও আর এই শিকল খুলে মুক্ত হতে পারবি না। ”
ঊষা বিভোর হয়ে শুনল প্রত্যয়ের কথা। জবাবে কলকল করে বলল,” তুমি বাঁধার আগেই তোমার প্রেম শিকলে বাঁধা পড়েছি আমি সেই কিশোরী বয়সে। শত চেষ্টায়ও যে পারি নি মুক্ত হতে। হতেও চাই না। আরো শক্ত করে বেঁধে দাও যেন শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোমারই বুকেতে রই আমি। ”
প্রত্যয় কেমন দুষ্ট কণ্ঠে বলল,” তুই নিশ্চিত? আমি কিন্তু ওই কীর্তিনাশা বর্ষণময় রাতকে স্বাক্ষী রেখে সূচনা করব তোর আর আমার প্রেমের মৌসুমের। পিছু হটতে পারবি না কিন্তু। তুই পিছু হটলে যে দুঃখ পাব ভোরের পাখি। ”
ঊষার গলা শুকিয়ে গেল। ইদানীং প্রত্যয় সন্নিকটে এলেই তার এমন হাল হয়। তার হাত ধরে রাখা মানুষটার কথাগুলো শুনে ছলকে উঠে র**ক্ত। ঝপাং করে অনুভূতিরা পুনশ্চ মিলিত হয়ে সমস্বরে যেন বলতে থাকে, কীর্তিনাশা বৈশাখেই আজ তোর সর্বনাশ। এই সর্বনাশে সম্মতি দিয়ে দে, ঊষা। নিজের অনুভূতিদের শাসিয়ে প্রত্যয়ের থেকে হাত ছাড়িয়ে বারান্দার দরজা মেলে দিল সে। বাতি জ্বালাল সেখানকার। দাঁড়াল বৃষ্টিতে ভেজা বারান্দায়। ত্যাছড়া বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল ওকে। সম্পর্ক নিয়ে সে একটুও দ্বিধান্বিত নয়। বরং পরিপূর্ণ রূপ সেও দিতে চায়। তবে আজ কেন এত লজ্জা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে? প্রত্যয় একটু বেহায়াভাবে, অকপটে প্রস্তাব রেখেছে বলে? বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটায় প্রায় আধভেজা হয়ে যেতে লাগল সে। প্রত্যয় পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” ভিজে যাচ্ছিস,ঘরে আয়। ”
” তুমি কি এজন্যই আলো নিভিয়ে রেখেছিলে,লজ্জা পাচ্ছিলে চোখে চোখ রেখে বলতে?”
” তোর কী মনে হয় আমি লজ্জা পাওয়ার ছেলে?”
” তোমাকে কখনো লজ্জা পেতে দেখি নি৷ শুধু নিজের ধারণা থেকে বললাম। ”
ঊষার এলোমেলো কেশগুচ্ছ ঘাড়ের একপাশে রেখে প্রত্যয় মুখে নিয়ে গেল ওর কানের কাছে। হৃদয়েশ্বরীর হৃদয়ে ঝড় তুলে দিয়ে বলল,
” লাইট অন করে দিয়ে যাচ্ছি। রুমে গিয়ে জেনে নিস,কেন অফ ছিল লাইট। ”
ঊষা ঘাড় ঘুরিয়ে মুখটা প্রত্যয়ের চেহারায় রাখল। দুজনের নাক ছুঁই,ছুঁই, কম্পনরত ওষ্ঠদ্বয় মিলিত হবার পথে। দুটি হৃদয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ হারা। প্রত্যয় সুপুষ্ট হাত নিয়ে রাখল ঊষার পেটের উপরিভাগে। মুখ কিছুটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ” এভাবে ঠোঁট দুটো কাছে এনে বুকের ভেতরের অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছিস কেন? কিছু বলবি?”
ঊষা বিব্রত হয়ে যায়। সে কেন যে ফিরল প্রত্যয়ের দিক? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। প্রশ্ন করল,” কোথায় যাচ্ছ?”
” বিছানায় থাকতে দিবি না,জড়িয়ে ধরতে দিবি না,প্রেমের মৌসুম আনতে দিবি না,তাই চলে যাচ্ছি নিচে। ”
ঊষা প্রত্যয়ের ঠোঁটে হাসি দেখে বুঝে গেল,এই লোক আবার ফিরে আসবে। তাই গা ছাড়া ভাবে বলল,” ঠিক আছে যাও,শুভরাত্রি। ”
কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলো প্রত্যয়ের। ঊষা কি তাকে এখনো ক্ষমা করতে পারে নি? নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে চায় সে। ঊষার মাঝে কি এখনো দ্বিধা ভাব রয়ে গেল! ভাবনঘরে তালা লাগিয়ে ঊষাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে দিয়ে বিষন্ন, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে চলে গেল কক্ষ ছেড়ে। যাওয়ার পূর্বে ঘরে শুভ্র আলো ছড়িয়ে দিয়ে গেল। সেই আলোয় ঊষা খুঁজে পেল রুমটাকে অন্ধকার করে রাখার রহস্যের উপযুক্ত সমাধান।
বড়ো একটা পেইন্টিং রাখা তার রুমের মাঝখানে। সেখানে তার ছবি এঁকেছে এক টুকিটাকি আঁকিবুঁকি করা চিত্রশিল্পী। এঁকেছে বড্ড মায়া মিশিয়ে। মনে হচ্ছে যেন রঙের পরিবর্তে রং তুলিতে মাখিয়ে নিয়েছিল কেবলই মায়া। এত সুন্দর কি সে! ঊষার নিজেকে এতটা অসাধারণ আগে কখনো লাগে নি। চোখের তারায় খুশিরা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে ছবিটা ছুঁয়ে দেখতে থাকল ও। মানুষটার পাগ**লামি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। মনে পড়ে গেল ওর বিয়ের কথা। বিয়ে ছিল না-কি প্রত্যয়ের ব্ল্যাকমেইল কে জানে! মোশতাক সাহেব ও উজ্জ্বল সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, অন্যের হাতে ঊষাকে তুলে দিলে ঘর ছাড়বে সে, ফিরবে না আর কখনো। প্রহর অবশ্যই হাসিমুখে বলেছিল চলে যা,ওর বিয়ে হলে তোর কি! প্রত্যয় নির্দ্বিধায় স্বীকারোক্তি দিয়েছিল,” আমি ওকে নিজের বউ করতে চাই৷ ” এ কথায় সবাই খুশি হলো। ভাবল,মৃন্ময়ীর ভূত ছাড়ল তবে। ওর পাগ**লামিতে মোশতাক সাহেব ক্ষমা চেয়ে পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দেন৷ তার আগে প্রত্যয় এক কাণ্ড করেছিল। হলুদের রাতে পাত্র এক বন্ধুর সাথে দেখা করে আসার সময় কিছু ছেলে সাথে নিয়ে মার**ধর করেছিল পাত্রকে। বেচারা বিয়ে করতে এসেছিল মাথায়,হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে। ছেলে প্রত্যয়কে চিনতে পেরে ভেজাল করে ভীষণ। কিন্তু প্রহর সামলে নেয়। ঊষা রাগে -ক্ষোভে প্রত্যয়কে বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসলেও আলতা ও বাবার অনুরোধ ফেলতে পারেন নি। মূলত আলতার মুখের দিকে চেয়ে বাধ্য হয়ে করে বিয়েটা। তারপর যেই জেদ জেগে ওঠে ভেতরে,সেটা দমাতে বাড়ি ছেড়ে ওঠে হোস্টেলে। ওর মন জেতার জন্য প্রত্যয় অনেক ধৈর্য্যশীল প্রেমিকের পরিচয় দিয়েছে, বেহায়াও হয়েছে। আর কত ফিরিয়ে দেবে মানুষটাকে! এবার নতুন কিছুর যাত্রা হোক। নিচে গিয়ে ডেকে আনবে কি?
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে দেখে প্রত্যয় ফিরে এসেছে। চুল উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। নিশ্চয়ই চুলের ওপর রাগ ঝেড়েছে নিচে গিয়ে। ওকে অবাক করে দিয়ে মেঝেতে বসে বলল,
” তোর বিছানায় জায়গা দিস না, মেঝেতে দে। আমার না একদম বউ ছাড়া থাকতে ইচ্ছে করছে না। জড়িয়ে ধরতে না পারি, বউয়ের রুমের মেঝেতে ঘুমানোর ভাগ্য হোক আমার। ”
ঊষা এবার শব্দ করেই হেসে দিল। প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে বলল,” ধন্যবাদ, চিত্রশিল্পী। আমি অতটা সুন্দর তা জানতাম না। ”
প্রত্যয় হাত টেনে ধরে ওর পাশে বসিয়ে বলল,” তুই আমার চোখে নন্দনকাননের পারিজাত। যার মায়ায় লেপ্টে গিয়ে আমি প্রেমে পড়ি বারে বার৷ ভালোবাসি,ঊষা। ”
ঊষা চোখ বুঁজে শুধাল,” তুমি কি লাইট টা বন্ধ করে আসবে?”
” কেন?”
প্রশ্নাত্মক বাক্যে জানতে চাইল প্রত্যয়। ঊষা ধানাইপানাই না করে এক নিঃশ্বাসে উত্তর দেয়,” আমিও তোমার প্রেমের মৌসুমে শামিল হতে চাই। ”
এক মুহূর্তও নষ্ট না করে প্রত্যয় বাতি নিভিয়ে দিল। মৃদু আলোর একটা লাইট জ্বালিয়ে দিল। যেই রশ্মিতে ঊষার মুখটা দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট। পাজাকোলা করে বিছানায় বসালো তাকে। এগিয়ে এলো ঊষার অধরজোড়ার কাছাকাছি রুক্ষ ওষ্ঠদ্বয়। চোখ বুঁজল সে পুনরায়। আঁকড়ে ধরল প্রত্যয়ের গলা। তন্মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ সৃষ্ট করে, নীরবতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেজে উঠল ঊষার ফোনটা। রুমে আসার সময় হাতে করে নিয়ে এসেছিল সে। প্রত্যয়ের কথার মাঝে ছুঁয়ে দেখা হয় নি, ফেলে রেখেছিল অন্ধকারে বিছানার এক কোণে। কলটা কেটে যায়। হাতে নিয়ে দেখে একই নাম্বার থেকে আরো বার তিনেক কল এসেছিল। বারান্দায় থাকাকালীন এসেছিল হয়তো। নতুবা শুনতে পাওয়ার কথা। উম্মাদ বৈশাখের তুফানে, প্রলয়ংকরী বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দের ভিড়ে মুঠোফোনের কিঞ্চিৎ বিরক্তি মিশ্রিত শব্দটুকু হারিয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
প্রত্যয় চোখ মুখ কুঁচকে গা**লি দিল ফোনের ওপাশের অজানা ব্যক্তিকে। টেনে নিয়ে মোবাইল সে রিসিভ করল, ইশারায় ঊষাকে জিজ্ঞেস করে নেয় একবার,” তুই চিনিস?”
ঊষা ঘাড় ডানে বায়ে করে বুঝিয়ে দেয় সে চিনে না নাম্বারটা। প্রায় গভীর হওয়া রজনীতে অপরিচিত কারো কল নিয়ে ও বেশ হতবাক। কিয়ৎপরিমাণ নিস্তব্ধতার পর একটা মাতা**ল কণ্ঠ কাতর স্বরে ডেকে উঠল,” ঊষা,ঊষা,,এই ঊষা!”
কণ্ঠ চিনতে ভুল করল না প্রত্যয়। চোখ দুটো লাল হয়ে রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। তবুও আগের মতোই দাঁতে দাঁত চেপে নিশ্চুপতা বজায় রাখল। লাউডস্পিকারে দিল কলটা। সমীরণ আরেকবার ঊষার নামটা নিতেই ক্রোধমিশ্রিত স্বরে বলল,
” অন্যের বউকে মাঝ রাতে কল কেন বিখ্যাত মডেল সমীরণ সাহেব? ”
সমীরণ গর্জে উঠল,” তুই ঊষার কাছে কী করছিস?”
” কী করছি মানে? মাত্রই বউকে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম,তুই আমাদের মধুময় রাতকে সর্বনাশময় রাত করে দিলি। ”
নেশায় ডুবে থাকা সমীরণের বক্ষস্থলে যাতনা ছড়িয়ে গেল। কণ্ঠটাও তীব্র তেজে জ্বলে উঠল,” তুই ওকে ছুঁয়েছিস?”
” ছবির মতো ভিলেন সেজে ডায়ালগ ছাড়া বন্ধ কর,মানুষ হো এবার। আমাকে ও ভাইকে ধ্বংস করতে নিশাতের দিক থেকে নজর সরিয়ে এখন ঊষাকে বেছে নিলি। এসবে কোনো লাভ হবে না। ”
” তুই ঊষাকে বিয়ে করার আগে থেকেই ওকে আমি পছন্দ করি। তুই এসেছিস আমাদের মাঝে। আমি ওকে পছন্দ করি এটা জানে ও। ”
” তোর নজর কেমন,তুই কেমন চরিত্রের এটা সবাই জানে। ”
” তুইও তো ভালো না। দিন রাত এক করে ঘুরলি মৃন্ময়ীর পেছনে, বউ করে নিলি আমার ঊষাকে। বুঝতে সময় লেগে গেল,নয়তো ও তো আমার বুকেই থাকত এখন। ফোনটা দে ওকে। ”
ঊষা প্রত্যয়ের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে রোষপূর্ণ স্বরে বলে,” আপনি আর কল দেবেন না আমায়। চরি**ত্রহীন। কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন? ”
সমীরণ কাতরচিত্তে বলল,” আমি আর তোমায় আগের মতো চাই না। এখন আমি তোমায় ভালোবাসি, ঊষা। আগে থেকেই হয়তো বাসতাম, কিন্তু বুঝতে পারি নি। শুনেছি তোমার ও প্রত্যয়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় নি। তোমাকে পাওয়ার একটা সুযোগ কি আমায় দেবে? ”
” অন্যের ঘর ভেঙে কোনো বিবাহিত নারীকে চাওয়া চরিত্র**হীনতার পরিচয় দেয়। যদি আপনার ভালোবাসা সত্য হয়ে থাকে তাহলে শুনে আমি খুশি। নিজে ভালোবাসলেই অন্য কারো ভালোবাসা উপলব্ধি করা যায়,এতে কারো ক্ষতি করতেও আপনি দু’বার ভাববেন। ”
বলেই কলটা কেটে মোবাইলটা অফ করে দিল। সমীরণ কি সত্যিই তাকে ভালোবাসে! না-কি নতুন কোনো ঢং! সে চায় লোকটা পরিবর্তন হয়ে যাক,তার বর ও ভাইয়ের কোনো ক্ষতি না করুক। সামনে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল। রক্তাভ নেত্রযুগল নিবদ্ধ তার দিকে। প্রশ্ন আসল,” সমীরণ তোকে বিরক্ত করত,সেটা তুই একবারও আমায় বলিস নি কেন? ”
” বললে তোমরা ওকে মা**রতে যেতা,আরো ভেজাল হয়ে যেত। আমি আসলে আর কোনো ঝঞ্ঝাট চাইছিলাম না। ওর স্বভাব-ই এমন। ”
প্রত্যয় ঊষার কোমরে দুই হাত পেঁচিয়ে বুকের মধ্যে টেনে আনল। গালে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিয়ে মোহনিয়া কথার জালে জড়িয়ে নিল তাকে,ঘায়েল করল অন্তর, করে দিল কমজোর।
” পায়ে শিকল পড়ানো ক্যান্সেল, আমি বরং বুকের ভেতর পিঞ্জিরা বানাব। সেই পিঞ্জিরায় লুকিয়ে রাখব তোকে। তার জন্য যে আরো অনেক অনেক ধাপ এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। ”
দুর্বল ঊষা বশীভূত হয়ে উচ্চারণ করে,” ভালোবাসার সকল ধাপ পার হতে আমি রাজি। ”
আচম্বিতে তার নরম অধরোষ্ঠ চলে গেল প্রত্যয়ের ওষ্ঠের দখলে। নেত্র পল্লব নেতিয়ে গেল লজ্জাবতীর ন্যায়। পণ করল মনে মনে, এই নিশীথে আর চোখ মেলে দেখবে না কোনো সৌন্দর্য এবং প্রত্যয়কে। অতর্কিতে সমাপ্তি হোক অমানিশার।
__________________________
নিশাতের হলো জ্বালা। এই বাড়ি,ওই বাড়ি করতে করতে পা জোড়া ক্লান্ত। সকাল সকাল শ্বশুর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। আলতা রান্নায় লেগে আছে। শিমুল ঘরে ঘুমে বিভোর। প্রহর চলে যাবে সেজন্য ছেলের নাস্তা তৈরি করে ফেলছে আলতা। শাড়ি পরিহিতা নিশাতকে দেখে মুচকি হেসে বলল,” পুত্রবধূ, আপনাকে দেখে আমারই হৃদয় কেঁপে উঠল, মাশাআল্লাহ। ”
ফুপির কথায় নিশাত লজ্জাবনত হয়ে জবাব দেয়,” আমি বাড়ির জামা পরেই চলে আসছিলাম, আসার সময় মা একটা জোর করে পরিয়ে দিল। এটা আমার ওপর অত্যাচার হলো না?”
মুখ টিপে হাসল আলতা। বলল,” অনেক বড়ো অত্যাচার। তোর বর এখনো ঘুমায়। দেশের মন্ত্রী এভাবে ঘুমালে,সাধারণ জনগণের কী হাল হবে বল? উঠিয়ে দে গিয়ে। নয়তো না খেয়েই বের হয়ে যাবে। ”
পা টিপে টিপে বিনা আওয়াজে ঘরে ঢুকল নিশাত। দরজা ভেজানো ছিল। ঘরে ঢুকে দেখে প্রহর সোজা হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার চোখেও রাজ্যের ঘুম। রোকেয়া টেনে উঠিয়ে রেডি করিয়ে পাঠাল এখানে। বকেছেও খুব। বলল,” স্বামী চলে যাবে, আর উনি নাক ডেকে ঘুমায়। শাশুড়ি আর স্বামী ভালো বলে, নয়তো আমাদের শাশুড়ি ৫টা বাজার আগেই ঢাকঢোল পেটানো শুরু করত উঠার জন্য। ”
ধীর গতিতে কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। প্রহর রেগে যায় যদি ডাকলে! তার শিথানের কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকল,” প্রহর ভাই,প্রহর ভাই!”
চোখ বুঁজেই বিছানার অপরপাশে সরে গেল প্রহর। খালি জায়গাটায় হাত রেখে আদেশমূলক সুরে বলল, ” শুয়ে পড় এখানে। ”
নিশাত হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। সে এখানে কেন শোবে! মুখে কিছু বলল না। তার নিশ্চুপতা প্রহরকে ফের বলতে বাধ্য করল,” শুইতে বলেছি না তোকে?”
এবার ধমক দিয়েই বলল। রোষের তোপে পড়ে শুতে দেরি করল না নিশাত। সে শুয়ে পড়তেই প্রহরের বলিষ্ঠ হাত শাড়ি ভেদ করে কোমর জড়িয়ে নিয়ে গেল তার অতিশয় কাছে। পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল নিশাতের পা দুটি। এ মুহূর্তে নিশাতের মনে হলো সে কোনো জায়গায় বন্দি। প্রহর ঘুমজড়িত চোখ খুলে তাকাল ওর ভয়ার্ত, অপ্রস্তুত, লজ্জারুণ চেহারায়। ঠোঁট কামড়ে হেসে আরো কাছে টেনে নিল সে।
” সকাল বেলা শাড়ি পরে আদর নিতে এসেছিস? তুই মুখে না বললেও আমি বুঝি। তোর ভাগ্য ভালো, তোর বরের আদর করার আগ্রহটা একটু বেশিই। ”
” আমি ইচ্ছে করে পরি নি,আম্মা পরিয়ে দিছে। ”
অকম্পিত গলায় জবাব দিল নিশাত। প্রহরের মনোযোগ নেই তার জবাবে। তার নজর কেবল ওর চেহারায়। কপালে চুমু খেয়ে বলল,” ভালোবাসি, তিলবতী। ”
নিশাত এ ক্ষেত্রেও চুপ থাকল, নত ওর বদন। মেজাজ তপ্ততায় পরিণত হয় প্রহরের,” জবাব দিচ্ছিস না কেন? ভালোবাসি বলতে তোর এত লজ্জা পেতে হবে কেন? ঘুষ লাগবে? আমাকে ‘ ভালোবাসি ‘ বলতে কত টাকা ঘুষ নিবি? ”
নিশাতের অস্ফুট কণ্ঠস্বর,” ঘুষ? টাকা দিয়ে কী করব?”
” ভাবলাম তুই আমার শ্বশুরজানের মতো লোভী কিনা! টাকা লাগবে না বুঝলাম, তাহলে নিশ্চয়ই তুই অন্য কিছু চাস। এক মাস পরে অন্য কিছু হবে,অপেক্ষা কর। ”
” আব্বা টাকার লোভী?”
” অবশ্যই। তোর মনে হয় না? আমার একশত পার্সেন্ট মনে হয়। লোভী,কিপ্টুস, অহংকারী সব তোর বাপ। ”
নিশাত রেগে গিয়ে ওঠে যেতে চেষ্টা করল। প্রহর বুকের ওপর উঠিয়ে চেপে ধরল জোর করে। তারপর যা করল তাতে হিমশীতল হয়ে গেল নিশাতের সমস্ত দেহ। মুখ ফোটে উচ্চারিত হলো,” রাক্ষস। ”
প্রহর তার শরীরের নিচে ওর শীর্ণ কায়া ফেলে গলার এক সাইডে কামড় দেওয়া স্থানে ঠোঁট ছুঁয়ে নিবিড় আলিঙ্গনে রেখে বলল,” তুই রা*গ দেখালেই এমন শা-স্তি পাবি,তিলবতী। ”
# চলবে~