প্রেমের রঙ পর্ব-১৬+১৭

0
550

#প্রেমের_রঙ
#পর্ব_১৬
#মোহনা_হক

‘বেশ কিছু সময় বাদে ইজহান পদ্ম কে ছেড়ে দিলো। ইজহান বরাবরের মতোই স্বাভাবিক আছে। কিন্তু পদ্ম সে তো পারছে না। নিজেকে শত শত গা’লি দিয়ে ফেললো আর কখনো কারও সাথে মজা করলেও ইজহানের সাথে ভুলেও মজা করবে না। লোকটা খুব বেশিই ভয়ংকর। প্রতিবার কিছু না কিছু করে তাকে লজ্জা দিবে। এই লজ্জার জন্যই বোধহয় সে একদিন শেষ হয়ে যাবে।’

‘ইজহান দুষ্টুমি করে বললো-‘
“আর মজা করবে আমার সাথে?”

‘পদ্ম থতমত খেয়ে গেলো। মাথা নাড়িয়ে বললো-‘
“কখনো করবো না আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।”

‘ইজহান পদ্মের গাল স্পর্শ করে করলো। বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে পদ্মের গালে ছুঁয়ে বললো-‘

“এখন তো মজা করেছো তাই শাস্তি দিয়েছি। কিছুদিন পর মজা না করলেও এমন শাস্তি ফ্রি পাবে।”

‘পদ্ম চোখগুলো ছোট ছোট করে বললো-‘
“উহুম আমার চাই না।”

‘ইজহান মুচকি হাসলো।’
“তুমি অনিচ্ছুক হলেও দিবো।”

‘পদ্ম সরে আসলো ইজহানের থেকে। অনেকটাই দূরে চলে এসেছে একদম দরজার কাছে।’

“মুচকি হাসেন কেনো? আপনার সেই সুন্দর দাঁতটা দেখিয়ে হাসবেন। সে হাসিটা আমার ভিষণ পছন্দের ডাক্তার সাহেব।”

‘কথাটি বলেই পদ্ম ভোঁ করে দৌড় দিয়ে চলে গিয়েছে। ইজহান হাসছে। এখন সেই সুন্দর দাঁতটা দেখা যাচ্ছে। তবে হাসিটা না দেখেই পদ্ম চলে গিয়েছে। কি প্রানবন্ত মেয়ে। আর কি চমৎকার কথাবার্তা। কাছে এসে কথাগুলো বলতে পারে না, দূরে গিয়ে বলে। ইশ এক কিশোরী মেয়ের প্রেমের বাক্য কি শুদ্ধ।’

‘সন্ধ্যায় ইজহান সোফায় বসে খবর দেখছে। একা একা ভালো লাগছিলো না দেখে ইজহান মুনিরা শেখের রুমে গিয়েছে।’

‘পদ্ম তার ওড়না নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার শ্বাশুড়িকে একটা কথা বলবে। কিন্তু কেনো জানি তার সংকোচ বোধ হচ্ছে।’

“মা আমার পি’রি’য়’ড হয়েছে।”

‘বেশ কিছুক্ষণ পর পদ্ম কথাটি বলতে সফল হলো। মুনিরা শেখ হেসে বললো-‘

“কথাটি বলতে এতক্ষণ লেগেছে তোমার?”

‘পদ্ম মিনমিন করে বললো-‘
“মা আমার লজ্জা লাগে এগুলো নিয়ে কথা বলতে। আমি সরাসরি কারও কাছে বলতে পারি না কথাগুলো।”

‘মুনিরা শেখ পদ্মকে সবকিছু দিলো।’
“আমাকে এগুলো বলতে কখনো লজ্জা পাবে না। আমি তো তোমার আরেক মা।”

‘পদ্ম হেসে দিলো। ভাগ্য করে মুনিরা শেখের মতো একজন শ্বাশুড়ি পেয়েছে। তিনি খুবই ভালো। পদ্ম হাজার কথা বললেও তিনি বিরক্ত হোননা। এজন্যই পদ্ম মুনিরা শেখকে বেশ পছন্দ করে।’
‘ইজহান আর রুমে ঢুকলো না এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পদ্ম আর তার মায়ের কথা শুনছিলো। এখন যদি রুমে ঢুকে সবচেয়ে লজ্জা পাবে পদ্ম। তাই সে চলে গেলো তার রুমে।’

‘পদ্ম আজ রুমেই যাচ্ছে না। এই সময়টাতে তার একা থাকতে ভালো লাগে। পদ্মের মনেহয় কিছু কিছু সময় একা থাকা ভালো। জানে রুমে গেলে ইজহান কিছু না কিছু করবে। এমনিতে আছে এক জ্বালায় তারউপর মন একেবারে বিষিয়ে গিয়েছে।একা একা সন্ধ্যা বেলা ছাদে কাঁটাচ্ছে। চারদিকে মৃদু বাতাস বইছে। পদ্মের চুলগুলো উড়ছে। পাশের বাসাগুলো থেকে ছাদে আলো আসছে। এই নিয়ে মাএ ২বার ছাদে উঠেছে পদ্ম। প্রথম বার ইজনিয়ার সাথে উঠেছিলো। আর এখন একা উঠেছে। শরীরটা ঠিক থাকলে আরও ভালো করে এই স্নিগ্ধ সন্ধ্যাবেলা উপভোগ করতে পারতো। কিন্তু এখন তো তার মনে শান্তি নেই। প্রতিবার এই সময়টাতে পদ্মের মনটা অটোমেটিকলি খারাপ হয়ে থাকে। আজও একই অবস্থা। একটুও ভালো লাগছে না তার। একদম খিঁচে বসে রইলো পদ্ম।’

‘ইজহান বেডে শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছে। পদ্ম যে রুমে আসে নি আজ সেটা ইজহান খেয়াল করেছে। জোর করতে চাচ্ছে না পদ্মকে। নিজের ইচ্ছে হলে ঠিকই আসবে। হয়তো এখন লজ্জায় আসতে চাইছে না।’

‘রুবিনা খাতুন ইজহান কে কল করেছে। ইজহান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছু সময়ের পর রিসিভ করলো।’

‘ইজহান সুন্দর করে প্রথমেই সালাম দিলো।’
“আসসালামু আলাইকুম মা। ভালো আছেন?”

“জ্বী বাবা ভালো আছি। তুমি আর দু’জনেইপদ্ম কেমন আছে বাবা।”

‘ইজহান শান্ত কন্ঠে বললো-‘
“এইতো ভালোই আছি।”

“বাবা একটা জরুরী দরকারে কল দিয়েছিলাম।”

“জ্বী মা বলুন।”

“বাবা পদ্মের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে ৪ দিন পর। ও কি পরীক্ষা দিবে?”

‘ইজহান পদ্মের পড়াশোনার ব্যাপারে একদম ভুলেই গিয়েছে। এই গেট টুয়েদারের জন্য। নিজে নিজে আফসোস করতে লাগলো। কতো বড় ভুল হয়ে গেলো তার।’

“জ্বী মা অবশ্যই দিবে।”

‘রুবিনা খাতুন বললো-‘
“তাহলে বাবা ওকে কবে গ্রামে নিয়ে আসবে?”

‘ইজহান সাথে সাথে বললো-‘
“কালই নিয়ে আসবো।”

“আচ্ছা বাবা। তুমি কি কাল আসবে ওর সাথে?”

“জ্বী আসবো।”

‘তারপর আরও কিছু কথা বলে রুবিনা খাতুন কল টা রাখলো। ইজহান রুম থেকে বের হয়ে পদ্মকে খুঁজছে, কিন্তু কোথাও মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। এক সময়ে ইজহানের মাথাটা ভিষণ গরম হয়ে গেলো। এক জায়গায় স্থির হয়েও বসে থাকতে পারে না। ইজহানের এবার টেনশনে ধরলো। পদ্ম আসলে কোথায়? মুনিরা শেখের কাছে জিগ্যেস করলো পদ্ম কোথায় কিন্তু তিনিও জানেন না। রুমে আসার সময় ইজহান দেখলো ছাদের দরজা খোলা। মন বলছে পদ্ম ওখানে নেই তাও গেলো ছাদে। ঠিকই মহারানী ছাদে বসে আছেন। আগে ছাদে এসে খুঁজলে এতো বেশি হয়রানি হতো না। কি সুন্দর বসে বসে পা দুলাচ্ছে। আর এতক্ষণ সে অযথা কষ্ট করেছে।’

‘ইজহান দ্রুত পায়ে পদ্মের কাছে গেলো। পদ্ম চোখ বন্ধ করে বসে আছে৷ ইজহানের উপস্থিতি টের পেলো না। ইজহান পদ্মের হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড়া করালো।’
‘পদ্ম আচমকা এমন হওয়াতে ভয় পেয়েছে। আর ইজহানের এমন ব্যবহারে সে খুব অভিমান করেছে আর পেটেও ব্যাথা পেয়েছে।’

‘পদ্মের চোখে পানি চলে আসলো।’

“তোমাকে কতো খুঁজেছি আমি জানো? সন্ধ্যা বেলা এখানে বসে আছো কেনো? কাউকে কিছু না বলেও একা একা চলে এসেছো। আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি আর ম্যাডাম এখানে বসে বসে সন্ধ্যা বিলাস করছে।”

‘পদ্মের কেঁদে দিয়েছে। ইজহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।’

“পদ্ম কাঁদছো কেনো?”

‘পদ্ম কোনো উত্তর দিলো না। মুখে হাত দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। ইজহানের খুব খারাপ লাগলো। একটু বুঝে শুনে কথা বলা উচিৎ ছিলো। মুখটা ছোট করে পদ্মকে টেনে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।”

“পদ্মফুল কাঁদছে কেনো? সে কি জানে না কাঁদলে তার ডাক্তার সাহেবের খুব কষ্ট হয়।”

‘পদ্ম কান্নারত অবস্থায় বললো-‘
“আপনি আমাকে এভাবে টান দিয়েছেন কেনো আমি কি ব্যাথা পাই না? প্রত্যেক বার আপনি এমন করেন। কথা বলবো না আমি। ছাড়ুন আমাকে।”

‘পদ্ম ইজহানের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ইজহান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। তাড়াহুড়োতে ভুলেই গিয়েছে পদ্মের যে পি’রি’য়’ড হয়েছে।’

“সরি সরি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার পি’রি’য়’ড চলছে। আর কখনো এমনটা করবো না। আমার টেনশন হচ্ছিলো তো পদ্মফুল।”

‘পদ্ম অবাক হয়ে গিয়েছে ইজহান কিভাবে কথাটা জানে? সাথে একরাশি লজ্জা এসে হানা দিলো তার কাছে।’

“আপনি কিভাবে জানেন?”

‘ইজহান একদম স্বাভাবিক হয়ে বললো-‘
“তখন যে তুমি মায়ের কাছে বলেছো আমি শুনেছি। কিন্তু পদ্ম খবরদার লজ্জা পাবে না। এটার লজ্জার বিষয়ও না। আমরা ডক্টররা অনেক কিছুই জানি। তোমার কাছে হয়তো কথাটা লজ্জার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে এগুলো একদম স্বাভাবিক। যেহেতু তোমার ডাক্তার সাহেব একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সো তার এগুলো অনেক মেয়ে মানুষের থেকে শোনা লাগে। আমাদের ডক্টরদের জন্য এগুলো নরমাল। আর এটার মানে হচ্ছে তুমি একদম সুস্থ আছো। বোকা মেয়ে। আর ভাবতে হবে না এটা নিয়ে।”

‘পদ্ম একটু নরমাল হলো। ইজহান তো ঠিকই বলেছে। পদ্ম আর লজ্জা পেলো না। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মাথা তুলে ইজহানের দিকে তাকালো।’

“কেনো খুঁজেছিলেন আমায়?”

‘পদ্মের চোখের কোণায় পানি আটকে ছিলো। ইজহান তার দু’টো হাত দিয়ে পদ্মের চোখের পানি গুলো মুছে দিলো।’

“তোমার মা কল দিয়েছিলো। ৪ দিন পর এক্সাম শুরু। কাল তোমাকে গ্রামে যেতে হবে।”

‘পদ্মের বুকটা ধক করে উঠলো। কাল আবার ইজহান হসপিটালে যাবে আর কালই তাকে গ্রামে ফিরতে হবে। মনটা মানতে রাজি হচ্ছে না। আর বিয়ের পর এই প্রথম ইজহানকে ছাড়া থাকবে। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। এখন তো আরও কান্না পাচ্ছে।’

‘পদ্ম পর পর ঢোক গিললো কান্না যেনো না আসে সেজন্য।’
“কালই কেনো যাবো? পরশদিন ও তো যেতে পারি।”

‘ইজহান পদ্মের দিকে তাকালো।’
“পরশুদিন গেলে এক্সামের সময় আরও ঘনিয়ে আসবে। আর কাল গেলে মোটামুটি কিছু পড়তে পারবে। এখানে তো আর পড়াও হয় না আবার তোমার বইগুলোও নেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাল গ্রামে যাবে তুমি।”

“আসলে কাল তো আপনি হসপিটালে যাবেন। পরশুদিন গেলে হয় না?”

“না ম্যাডাম কালই যেতে হবে।”

“প্লিইইইজ।”

‘ইজহান পদ্মকে থামিয়ে দিলো।’
“কোনো রকম এক্সকিউজ শুনতে চাচ্ছি না আমি। কাল মানে কাল।”

‘পদ্ম ইজহানকে খুব শক্ত করে ধরে কেঁদে দিলো। ইজহান বুঝলো না কেনো কাঁদছে?”

‘ইজহান নরম কন্ঠে বললো-‘
“কি হয়েছে তোমার? বেশি ব্যাথা পেয়েছিলে যখন টান দিয়েছিলাম?”

‘পদ্ম মাথা নাড়ালো। তার মানে সে কাঁদছে অন্য কারণে।’

‘ইজহান আবারও বললো-‘
“তাহলে কেনো কাঁদছো? তুমি কি এক্সাম কে ভয় পাও।”

‘পদ্ম কোনো উত্তর দিলো না। যতোবারই মনে পড়ে ইজহানকে ছেড়ে তাকে গ্রামে যেতে হবে ততবারই চোখ ভরে পানি উপচে পড়ে। ভালো লাগে না তো তাকে ছাড়া। এ কথা কিভাবে বোঝাবে তার ডাক্তার সাহেব কে। আচ্ছা পদ্ম তো হাসলে তিনি বুঝে যান তাহলে এই কথা বুঝছে না কেনো। নাকি বুঝেও না বোঝার মতো রয়েছে।’

‘ইজহান এখন বিরক্ত হলো। অকারণে কান্না করার কোনো মানেই হয় না।’

“হয়েছে অনেক কেঁদে ফেলেছো। যতোবারই কাঁদো আমার জামা-কাপড় একদম ভিজিয়ে ফেলো। কোনো কারণ ছাড়া আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাকে বুকে এসে কান্না করা যাবে না।”

“আপনিই তো প্রথমে আপনার কাছে টেনে নিয়েছেন। এখন এমনটা বলছেন কেনো। আর একটু কাঁদি?”

‘ইজহান খেয়াল করেছে পদ্ম নাক টানছে আর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। মেয়েটা যে কেঁদে একেবারে লাল হয়ে গেলো। সেটা কি মনে আছে তার? টমেটোর মতো লাগছে একদম।’

“না আর একটুও কাঁদা যাবে না। কাঁদলে অন্য কোথাও কাঁদো। আমার কাছে এসব চলবে না।”

‘পদ্মের আরও ঠেলে কান্না আসলো। মানুষটা ভিষণ স্বার্থপর। তার মনের কষ্টগুলো এখন অনুভব করতে পারছে না কেনো। খুব তো তখন পটু পটু কথা বলতে পারে। আবার তার বুকে কান্নাও করা যাবে না।’

‘পদ্ম ইজহানকে আবারও জড়িয়ে ধরলো।’

“আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না ডাক্তার সাহেব। আমার মন বসবে না ওখানে। বিয়ের পর একদিনও থাকিনি। কাল থেকে থাকবো কিভাবে? আপনি নাকি আমার হাসি অন্ধকারেও অনুভব করতে পারেন। আজ যে আমার কষ্ট হচ্ছে সেটা কেনো পারছেন না অনুভব করতে? ভালো লাগবে না তো আপনাকে ছাড়া থাকতে। আপনি ছাড়া আপনার পদ্মফুল শূন্য একেবারে।আর আমি একশোবার আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনার বুকে কাঁদবো। কারণ আপনি একান্তই আমার ব্যাক্তিগত মানুষ।”

‘ইজহান বিস্মিত হয়ে আছে। এসব কথা কি পদ্ম বলছে? মেয়েটা যে অজান্তেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছে এটা কি সে জানে। ইশ আগে এমনটা হবে জানলে এই ট্রিকস আরও আগে কাজে লাগাতো। ইজহান ঠোঁট কামড়ে হাসছে পদ্মের কাহিনী দেখে।’

#চলবে…

#প্রেমের_রঙ
#পর্ব_১৭
#মোহনা_হক

‘সকাল ১০টা।’
‘ইজহান পদ্মকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পদ্মের খুব কান্না পেয়েছিলো তাও নিজের মনটা কে শক্ত রেখে বাসা থেকে বের হয়েছিলো। গাড়িতে উঠেই মনটা হুহু করে উঠলো। ১৪দিন যেনো এক বছরের মতো লাগবে তার কাছে। বিয়ের প্রথম প্রথম গ্রামে যেতে খুব ইচ্ছে করেছিলো এখন ঢাকা শহরে থাকতে মন চাচ্ছে। ইজহান নিজেই ড্রাইভ করছে৷ পাশের সিটে পদ্ম মন খারাপ করে বাহিরে তাকিয়ে আছে। যতোবার মনে পড়ছে ইজহান কে ছাড়া তার থাকতে হবে ততবার যেনো মনটা ভেঙ্গে যাচ্ছে তার। অসহ্য ব্যাথা একদম। মাঝে মাঝে পদ্ম ইজহানের দিকেও তাকাচ্ছে। লোকটা একদম শান্ত ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে।’

‘পদ্ম নিরবতা ভেঙ্গে ইজহানকে বললো-‘
“আমি যে চলে যাচ্ছি আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”

‘ইজহানের দৃষ্টি সামনের দিকে। পদ্মের দিকে একবারও তাকালো না।’

“না কেনো কষ্ট হবে? তুমি তো এক্সাম দিতে যাচ্ছো। শেষ হলেই আবার চলে আসবে।”

‘পদ্মের মনটা আবারও ভেঙ্গে গেলো।’
“জানি তো কষ্ট হচ্ছে না। আপনার মনে তো আর আমি নেই যে আমার জন্য কেনো কষ্ট হবে? কষ্ট তো হবে অন্য মেয়ের জন্য।”

‘ইজহান গাড়িটা থামালো। অবাক চোখে পদ্মের দিকে তাকিয়ে। ইদানীং তার ব্যবহারগুলোর সাথে অপরিচিত সে। গ্রামে যাচ্ছে এই শোকে বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছে। ইজহান পদ্মের দিকে অনেকটা ঝুঁকে এলো। যা দেখে পদ্ম ঘাবড়ে গিয়েছে।’

“কি বললে তুমি?”

‘পদ্ম থতমত খেয়ে গেলো।’
“না না কিছু বলি নি। আপনি গাড়ি চালানো বন্ধ করলেন কেনো?”

‘ইজহান হেসে দিলো। তাও আবার সেই সুন্দর হাসিটা। উফ পদ্ম তুই আজ শেষ হবি এই হাসি দেখে। ইজহান আবার ঠিকঠাক মতো বসলো। পদ্ম বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হুটহাট এমন হওয়াতে ঘাবড়ে গেলো অনেকটা।’

‘ইজহান হেসে বললো-‘
“যাকে রেখে আসতে যাচ্ছি তার জন্যই তো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি কষ্ট পাচ্ছি এটা দেখলে তো আর ম্যাডাম যেতে চাইবে না। পড়াশোনার বিষয়ে এতো ভালোবাসা দেখাই না।”

‘পদ্ম মুখটা বাঁকালো। ভেবেছিলো ইজহান দেখেনি। কিন্তু ইজহান ঠিকই দেখে নিয়েছে। আর জানেও পদ্ম কেনো এমন করেছে।’

“মুখ বাঁকিয়ে লাভ নেই। যদি এমন করো ইজহান কিন্তু তোমাকে আর গ্রাম থেকে আনবে না।”

‘পদ্ম ত্যাড়া ভাবে উত্তর দিলো।’
“আমি নিজেই চলে আসবো। যদি একা না আসতে পারি তাহলে মা আর পুষ্প কে নিয়ে সোজা আপনার বাসায় চলে যাবো।”

‘ইজহান পদ্মকে রাগানোর জন্য বললো-‘
“তুমি গ্রাম থেকে এসে দেখবে তোমার সতীন অলরেডি তোমার বরের সাথে সংসার করছে। তুমি কি আসলেই বুঝছো না আমি কেনো তোমাকে ওখানে এতো তাড়াতাড়ি রেখে আসছি? আমি তো আরেকটা বিয়ে করছি। তোমার দাওয়াত রইলো অবশ্যই তোমার বরের বিয়েতে আসবে। আমি আর তোমার সতীন খুবই খুশি হবো।”

‘পদ্ম যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ইজহানের কথাটা খুবই বাজে ছিলো। এক বউ থাকতেও আবার বিয়ে করার কথা বলছে। পদ্ম কেঁদে ফেললো।’

“আপনি খুব খারাপ। আমি আপনার সাথে থাকবো না। এতোদিন তাহলে আপনি আমার সাথে অভিনয় করেছেন? আমি তো জানি আপনার আমাকে ভালো লাগে না। কারণ আমি গ্রামের মেয়ে আপনার চোখে তো শহুরে মেয়েদেরকেই ভালো লাগে। আমাকে কেনো লাগবে। দরকার নেই আমাকে গ্রামে দিয়ে আসার এখানেই নামিয়ে দিন। আমি একাই চলে যেতে পারবো।”

‘ইজহান ভেবেছে পদ্ম রাগ করে কথা শোনাবে কিন্তু তিনি তো একেবারে কেঁদেই দিলো। ইজহান পদ্মকে টেনে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।’

“পদ্মফুল আমার চোখে তুমিই সব সময় সুন্দর। আমি তোমার সাথে কোনো অভিনয় করিনি। তবে এটা ঠিক বিয়েতে আমার মত ছিলো না আমার মা জোর করেছিলো। এইযে তোমাকে আদর দেই, ভালোবাসি এগুলো আমি মন থেকেই দিই। বিয়ের পরেরদিন থেকে আমি তোমাকে মেনে নিয়েছি। প্রথমে মানতে পারছিলাম না এখন তুমি গ্রামে যাচ্ছো আমি সহ্য করতে পারছি না। ইজহান শেখের জীবনে প্রথম নারী তুমি। যার প্রতি সে এতোটা দূর্বল, যাকে না দেখে ইজহান তার সকালটা শুরু করতে পারেনা, যার কষ্ট হলে সে নিজেও কষ্ট পায়, যার প্রতি ইজহানের বুকভরা ভালোবাসা রয়েছে সে মেয়েটি তুমি পদ্মফুল। তুমি নিতান্তই ভাগ্যবতী মেয়ে।”

‘ইজহানের কথা শুনে পদ্ম কষ্টের মাঝেও হাসলো।’
“আপনিও অনেক ভাগ্য করে আমার মতো বউ পেয়েছেন এই কথাও কিন্তু ভুলে যাবেন না।”

‘ইজহান হেসে দিলো।’
“উহুম একটুও ভুলবো না।”

‘পদ্ম ইজহানের বুকে একটা সুন্দর করে চুমু এঁকে দিলো। তারপর গভীর ভাবে ইজহান কে জড়িয়ে ধরলো। ইজহানও এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। আর এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করছে।’

‘দেখতে দেখতে পদ্ম আর ইজহান গ্রামে ঢুকলো। পদ্ম ঘুমিয়ে আছে। সে যে গ্রামে চলে এসেছে তার কোনো খেয়ালই নেই। ইজহান পদ্মের বাসার জন্য একগাদা জিনিসপএ কিনেছে। সাথে অনেক বাজার ও করেছে। আসার সময় মুনিরা শেখ বলে দিয়েছিলো ও যেনো বাজার করে নিয়ে যায়, কারণ নতুন বর বিয়ের পর প্রথমবার মেয়ের বাড়িতে গেলে বাজার করতে হয়। আর ইজহান ও তাই করলো। তার মা যা যা বলে দিয়েছে সে সবকিছুই নিয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে পদ্ম এগুলো কিছুই দেখতে পারলো না। সে তখন ঘুমে ছিলো।’
‘ইজহান পথটা ভুলে গিয়েছে তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও পদ্মকে জাগালো।’

‘ইজহান পদ্মকে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু পদ্ম ঘুম থেকে উঠছে না। এবার ইজহান পদ্মের মুখে পানি ছিটালো। সাথে সাথে পদ্ম হড়বড় করে চোখ খুললো।’

“উঠেছো তুমি? আমি কতক্ষণ ধরে ডাকছিলাম তোমায়।”

‘পদ্ম চোখ পিটপিট করে ইজহানের দিকে তাকালো।’
“কি হয়েছে?”

‘ইজহান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে পদ্মের দিকে।’
“তোমার গ্রামে ঢুকেছি কিন্তু পথটা ভুলে গিয়েছি। চিনতে পারছি না ঠিক।”

‘পদ্মের মনে হলো সে ঘুমেই ভালো ছিলো। এখন আবার মনটা খারাপ করে দিলো লোকটা। পদ্ম ঢোক গিললো।’

“আচ্ছা আপনি গাড়ি চালান আমি বলছি।”

‘পদ্ম বলছে আর ইজহান সেই মোতাবেক গাড়ি চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে বলতে গিয়ে তার কান্না চলে আসছে। তবুও সে মনটা একদম ঠিক রেখে ইজহানকে বললো। পদ্মের বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থেমেছে। গ্রামের রাস্তাগুলো একেবারে সরু। রাস্তার চারপাশে গাছ আর ধান ক্ষেত। ইজহান গাড়ি চালানো পাশাপাশি চারপাশ ও একটু দেখে নিয়েছিলো। যখন প্রথমে এসেছিলো তখন এসব কিছুই খেয়াল করে নি।’

‘পদ্ম গাড়ি থেকে নামলো, আর পুষ্প সেটা দেখে দৌড়ে তার আপু কে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।’

“মা আপু এসেছে।”

‘রুবিনা খাতুন ও আসলো। তার মেয়েকে একেবারে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখলো। পদ্মের মাথায় কয়েকটা চুমু দিলো রুবিনা খাতুন। পদ্ম ও একদম তার মা কে জড়িয়ে ধরে আছে পাখির ছানার মতো।’
‘ইজহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো রুবিনা খাতুন। কিন্তু পুষ্প কোনো রকম কথা বললো না। ইজহান একবার ভুলবশত তাকিয়ে ছিলো কিন্তু মেয়ে তাকে দেখে মুখটা ভেঙ্গিয়ে দিলো। ইজহান একেবারে হকচকিয়ে গেলো।বুঝেছে এর রাগ এখনো কমেনি।’

‘ইজহান শান্ত কন্ঠে রুবিনা খাতুন কে বললো-‘
“তাহলে মা আমি এখন আসি!”

‘রুবিনা খাতুন অবাক হয়ে গেলো। আসি মানে কি এখনই চলে যাবে নাকি? নতুন জামাই প্রথম বাড়িতে এসেছে মাএ এখনই যাওয়ার কথা বলছে?’

“কি বলছো বাবা। এখন চলে যাবে মানে?”

‘ইজহান সৌজন্যবোধক হাসলো।’
“আসলে মা আজ কিন্তু আমার ডিউটি ছিলো। তাও ছুটি নিয়েছি শুধুমাত্র পদ্মের জন্য। এখন আবার চলে যেতে হবে কারণ কাল থেকে আমাকে ডিউটি তে ফিরতেই হবে। পদ্ম জানে সব।”

‘শেষের কথা বলার সময় ইজহান পদ্মের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ যে পানিতে টলমল করছে তা বোঝাই যাচ্ছে। ইজহানের কথা কোনোমতেই রুবিনা খাতুন রাজি নন। অন্তত আজ রাতটা থাকতেই হবে। ইজহান বলছে সম্ভব না তাও তিনি জোর করছেন।’

‘ইজহান অনুরোধের সুরে বললো-‘
“আজ না মা। আমি তো আসবোই আবার। পরে একদিন নাহয় থাকা যাবে। এখন আমাকে আসতে হবে। ”

‘রুবিনা খাতুন বললো-‘
“দুপুরের খাবারটা ও কি খেয়ে যেতে পারবে না?”

‘ইজহান ভাবলো কিছুক্ষণ তারপর ভেবে বললো-‘
“জ্বী খেয়ে যাবো।”

‘রুবিনা খাতুন খুশি হলো সাথে পদ্মও। পদ্মের তো খুশির শেষ নেই। কিন্তু পুষ্প তৎক্ষনাত বলে উঠলো-‘

“ইহ এই লোক কে আমাদের বাসায় খেতে দিবো না। ওনাদের বাসায় যখন গিয়েছিলাম তখন ওনি আমাকে একটুও ঘুরাতে নেননি। আবার একদিন প্রায় দুপুরের সময় সকালের নাস্তা খেতে দিয়েছিলেন।”

‘পুষ্পের কথায় ইজহান লজ্জা পেলো। এই বিচ্চু মেয়ে যে একদম সরাসরি অপমান করে দেয় কে জানতো। রুবিনা খাতুন পুষ্পকে চোখ রাঙ্গাচ্ছে। এই মেয়ে কখনো ভালো হবে না।’

“বাবা তুমি কিছু মনে করো না ওর কথায়। ও এমনই আমি কতো বকি কিন্তু সে বকা খাওয়ার পর সব আবার ভুলে যায়।”

‘ইজহান পুষ্পের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।’
“সমস্যা নেই মা।”

‘রুবিনা খাতুন পদ্মের উদ্দেশ্যে বললো-‘
“পদ্ম ইজহান বাবা কে ভিতরে নিয়ে যা।”

‘ইজহান পদ্মের সাথে ভিতরে ঢুকলো। পদ্ম ইজহান কে তার রুমে নিয়ে গেলো। পদ্ম রুমে গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। ইজহান পকেটে হাত গুঁজে পদ্মের সোজাসুজি দাঁড়ালো।’

“এসেছো তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। যেখানে আমার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকার কথা সেখানে তুমি কাজটা করছো।”

‘পদ্ম অন্যদিকে ফিরে গেলো। ইজহান এটা দেখে পদ্মের পাশাপাশি শুয়ে পড়েছে।’

“চলেই তো যাবো একটু পর তাও রাগ দেখাচ্ছো?”

‘পদ্ম ইজহানের দিকে ফিরলো এবার।’
“রাগ করছি না তো। আমার আসলে ভালো লাগছে না।”

“কেনো লাগছে না?”

“জানি না।”

“কেনো জানো না?”

“উহু।”

“আমি চলে গেলে ভালো লাগবে তোমার?”

‘পদ্ম ইজহানকে জড়িয়ে ধরেছে। ইজহান হাসছে। মেয়েটা একটু পাগলাটে ধরনের।’

“আপনি চলে গেলে আমার একটুও ভালো লাগবে না ডাক্তার সাহেব।”

‘ইজহান পদ্মকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ডাক পড়েছে। পুষ্প দরজার ওপাশ থেকে বললো তারা যেনো তাড়াতাড়ি খেতে আসে।’
‘পদ্মের খাওয়া আগেই শেষ কিন্তু ইজহানের জন্য বসে রইলো। তাদের খাওয়া শেষ করে পদ্ম আর ইজহান রুমে আসলো। ভাবতেই মন কেমন করে উঠলো কারণ এইতো এখনই ইজহান চলে যাবে।’

‘পদ্ম আর ইজহান পাশাপাশি বসেছে। দু’জনেই চুপ করে আছে। ইজহান পদ্মের মাথায় হাত দিয়ে বললো-‘

“শুনো এক্সাম গুলো ঠিকঠাক মতো দিবে। আমি হয়তো আসতেও পারি আবার নাও আসতে পারি। চেষ্টা করবো আসার জন্য। তুমি কিন্তু ভালো করে এক্সাম দিবে।”

“হু।”

‘ইজহান ভেবেছে পদ্ম আর কিছু বলবে না তাই সে বললো-‘

“তাহলে আসি হ্যাঁ। ঠিকঠাক মতো চলবে আমি কল দিবো তোমায়।”

‘পদ্ম ইজহানের হাত ধরে বললো-‘
“এতো তাড়া কিসের? আরেকটু বসুন না।”

‘ইজহান পদ্মকে মোবাইল টা দেখালো। যেখান বড় করে উল্লেখ করা 5:45 বাজে।’

“দেখো অলরেডি আমি লেইট করে ফেলেছি অনেক। আমাকেও তো বাসায় ফিরতে হবে তাই না?”

‘পদ্ম এখন আবার কেঁদে উঠলো।’
“আজ থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো।”

‘ইজহান হেসে পদ্মের গালে হাত বুলাচ্ছে।’
“এ দু’দিন তুমি যতোবার কেঁদেছো জীবনেও মনেহয় এতোবার কাঁদোনি।”

‘পদ্ম ইজহানকে অবাক করে দিয়ে একটা কাজ করলো। পদ্ম ইজহানের ওষ্ঠে তার ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। মুহুর্তেই পদ্ম নিজেই চোখটা বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু ইজহান ব্যা’টা তো ছাড়ছে না। পদ্ম অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। ওদিক মুখ রেখে বললো-‘

“আপনি কোনো মেয়ের দিকে তাকাবেন না ডাক্তার সাহেব। পদ্মফুল কিন্তু রাগ করবে। এবার আপনি আসতে পারেন।”

#চলবে…