প্রেমে পরা বারণ পর্ব-১৬+১৭

0
147

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat Monisha
পর্ব-১৬

–কে কার স্বপ্নের নায়ক?
নিজেকে অর্ণবের কাছ থেকে ছাড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ডা.প্রীতি।
–এভাবে আপনার হুমড়ি খেয়ে আমার বুকে আছড়ে পরা, ফুলের বৃষ্টি, স্পিকারের মিউজিক, এসব কিছুতো আপনি করেছেন আমার কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য তাই না?
অতিরিক্ত রাগে ডা. প্রীতির মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। সে দাঁত কটমট করে বলে,
–আমি আপনার বুকে আছড়ে পরিনি। কিছু একটাতে স্লিপ কেটেছি
বলে সে মেঝেতে সেই জিনিসটা খুঁজতে লাগলো কিন্তু ততক্ষণে অর্ক মার্বেলগুলো সরিয়ে ফেলেছে।
অর্ণব মুচকি হেসে বলে,
–কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন? আমি তো আগেই বলেছি আমার কোন আপত্তি নেই। তবে গতকালের ঘটনার পরে একটু রেগে ছিলাম কিন্তু এখন আপনি এতো সুন্দর করে প্রপোজ করলেন যে আর সেই রাগ নেই।

–আরে আমি আপনাকে কেন প্রপোজ করতে যাবো? এটাতো আ..
‘আরশি’ বলতে গিয়েও থেমে গেলো ডা.প্রীতি কারণ ইতিমধ্যে আরশি কানে ধরে তার দিকে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে ইশারায় বলছে,
–প্লিজ এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও। এরপর থেকে তোমার সব কথা শুনবো।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিজের মাথাটা ঠান্ডা করে ডা প্রীতি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
–দেখুন মি. অর্ণব আপাদত এখানে কি ঘটেছে তা আমি আপনাকে খুলে বলতে পারছি না। তবে একটা কথা আমি আপনাকে আবার ক্লিয়ার করে দিচ্ছি, আমি মরে গেলেও আপনার মতন ব্রয়লার মুরগিকে বিয়ে করবো না।
ডা.প্রীতির কথাটি শুনে উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়৷ অন্যদিকে ডা. প্রীতি রাগী চোখে একবার অর্কর দিকে, আরেকবার আরশির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে ফোঁসফোঁস করতে করতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
মাহের এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,
–বাড়ি তো নয় আস্ত একটা চিড়িয়াখানা।
অর্ণবকে যাতে অস্বস্তিতে পরতে না হয় তাই নির্জনাও নীরবে নিজের ঘরে চলে যায়।
অন্যদিকে আবারও নিজের আত্মঅহংকার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ায় অর্ণবের পরিণতি কিছুটা দেবদাসের মতো হয়ে যায়।


–সরি! প্লিজ আর রাগ করে থেকো না।
আরশির কথায় ডা.প্রীতি অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে,
–কি হলো তুমি সরি বলবে না?
অর্ক কিছুটা থতমত খেয়ে বলে,
–আমি কেন সরি বলবো আমি কি করেছি?
ধমকের স্বরে ডা.প্রীতি বলে,
–তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার পকেটের মার্বেলগুলো নোটিশ করিনি? আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এটা তোমার চাল।
নির্লিপ্ত গলায় অর্ক বলে,
–হ্যাঁ, তো? মার্বেলগুলো আমি রেখেছিলাম যাতে আমার বউ আমার বুকে আসে কিন্তু তুমি আমার প্লানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো। সরি তো তোমার বলা উচিত।
–তাই বুঝি আমার সরি বলা উচিত ঠিক আছে আমি মিস্টার অর্ণবকে গিয়ে বলি যে, আপনার ভাইয়ের নিজের বউকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হয়েছিল তাই সে মেঝেতে আজ মার্বেল ছড়িয়ে রেখেছিলো।
–তাই না না এমন করো না প্লিজ। আমি কথা দিচ্ছি আর এরকম হবে না, এরপর থেকে যা করবো সব বেড রুমের ভিতরে করবো।

অর্কর কথায় আরশি তাল মিলিয়ে বলে,
–একদম আমিও মাহেরকে এবার প্রপোজ করার সময় খেয়াল রাখবে যাতে তুমি ফেঁসে না যাও।
আরশের কথাটা শুনে অর্ক চোখ ছোট ছোট করে বলে,
–তুমি মাহেরকে প্রপোজ করবে মানে?
আরশি খুব গর্বের সাথে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
– মানে হল আমি মিস্টার মাহের হুদাকে ভালোবাসি। সে তোমার হবু বোনজামাই।
আরশির কথা শুনে অর্ক হা হা করে হেসে বলে,
–বোন জামাই সিরিয়াসলি? তোমার মত আলুর বস্তাকে মাহের হুদার মতো হ্যান্ডসাম হাঙ্ক কেন বিয়ে করবে?
অন্য সময় অর্ক আরশিকে আলুর বস্তা বললে সে ঝগড়া করত কিন্তু আজ তার খানিকটা মন খারাপ হয়। কিন্তু সেটা সে অর্ককে বুঝতে না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে,
–আমি মোটা না আমি একটু বেশি কিউট।
অর্ক তখনও হেসে বলে,
–হ্যা যেমন অর্ণব ভাইয়া ব্রয়লার মুরগি না একটু বেশি ফর্সা। তুমি জানো ভাইয়া ছোটবেলায় অতিরিক্ত ফর্সা আর মোটা ছিল সেজন্য স্কুলের বাচ্চারা ব্রয়লার মুরগি বলে ক্ষেপাতো। সিরিয়াসলি প্রীতি তোমারও বেছে বেছে সেই নামটাই তাকে দিতে হলো?
আরশি ডাক্তার প্রীতি উদ্দেশ্য করে বলে,
–ও হ্যাঁ এত কিছুর মধ্যে তো আমি ভুলেই গেছিলাম তোমার আর ভাইয়ার ব্যাপারটা কি বলতো? মানে অর্কর কথা না-হয় বুঝলাম সুন্দরী বউ দেখে সে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু তোমার আর ভাইয়া সম্পর্ক তো আদায়-কাঁচকলা তাহলে আজ সে কেন তোমাকে ওসব বলেছে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডা.প্রীতি বলে,
–তোমার ভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
এরপর সে গতকালের সমস্ত ঘটনা বর্ননা করে।
যা শুনে দু’ভাইবোনের মাথায় জং ধরে যায়।
অর্ক প্রশ্ন করে,
–ভাইয়ার কেন মনে হলো তুমি তাকে পছন্দ করো। আই মিন তোমদের যতক্ষণ কথা হয় তোমারা শুধু ঝগড়া করো।

–এক্সাক্টলি আমার প্রশ্ন কিন্তু সে তার কোন জবাব দেয় নি।
ডা.প্রীতির এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আরশি বলে,
–জবাব দেয় নি কারণ তুমি তাকে ব্রয়লার মুরগি বলেছো এতে তার ইগো হার্ট হয়েছে। তবে প্রীতি একটা কথা তুমি আমাদের ভাবি হলে কিন্তু বেশ হবে। তুমি আমাদের বাড়িতে সারাজীবন থাকবে।
অর্ক আরশির কথায় তাল মিলিয়ে বলে,
–আমারও তাই ইচ্ছে ।
ডা.প্রীতি রেগে বলে,
–তোমাদের ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে আমি নিজের লাইফ নষ্ট করে দেবো না-কি?
দু’ভাইবোন একত্রে বলে,
–কিন্তু..
–কোন কিন্তু না এক্ষুনি বের হও।
তখনি ডা.প্রীতির ফোনে তার মায়ের কল আসে। সে ফোনটা রিসিভ করার আগে দু’ভাইবোনকে ইশারা দিয়ে বাইরে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয়।


মাহেরের জন্য কেকটার ডেকোরেশন শেষ করে ডা.প্রীতির উদ্দেশ্য আরশি বলে,
–আই এম ডান। আমি অত্যন্ত দুঃখিত আমার প্রথম রান্নাও তোমাকে খেতে দিতে পারি নি আবার আজকের কেকটাও তোমাকে টেস্ট করাতে পারলাম না।
ডা.প্রীতি বিড়বিড় করে বলে,
–ভাগ্যিস করাও নি। এ জিনিস খেয়ে আমি বেঁচে থাকতাম কি-না সন্দেহ।
এদিকে আরশি নিজের মতো করে বলতে থাকে ,
–আইডিয়া তুমি ভাইয়াকে বিয়ে করে আমার ভাবি হয়ে যাও এরপর আমি তোমাকে প্রতিদিন এরকম টেস্টি টেস্টি খাবার রান্না করে খাওয়াবো।
অর্ণবকে বিয়ে করার কথা শুনে ডা.প্রীতির মুখটা বিরক্তিতে অন্ধকার হয়ে যায়।
–লিসেন তোমার ভাইয়ের মতো সেফ অবসেসড পুরুষ আমার টাইপের না।
–আচ্ছা তাহলে তোমার টাইপ কি?
–এমন কেউ যে আমার কেয়ার করবে, আমাকে রেসপেক্ট করবে, আমাকে নিজের কাজ এবং অন্য সবার চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিবে, সবচেয়ে বড়কথা এমন কেউ যে আমাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসবো। আর তোমার ভাই হুহ! তার জীবন একটাই জিনিস ইমপোর্টেন্ট সে নিজে। সো আমাকে নিজের ভাবি বানানোর কথা ভুলে যাও।

অর্ণব পানির জন্য কিচেনের দিকেই আসছিলো তখনই ডা প্রীতি যখন তাকে সেলফ অবসেস্ট বলে সেটা তার কানে যায়। তাই সে দাঁড়িয়ে বাকি কথাবার্তা শুনে নিজের হাতের মুষ্টি শক্ত করে নেয়।


মাহের কেবল গোসল করে বের হয়েছে। সে অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তাই রুমের দরজা লাগানোর অভ্যেস তার নেই। তবে জহুরা মঞ্জিলে আসার পর তার রুমে কেউ নক না করে প্রবেশ করে নি। তাই এখানে আসা হতে গোসলের পর তোয়ালে পেঁচিয়েই বের হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি কিন্তু এখন বের হতেই সে একটা অস্বস্তিকর মুহূর্তের মধ্যে পড়ল। তার সামনে মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে আরশি। দেখছে বললে ভুল হবে চোখ দিয়ে একপ্রকার তাকে গিলে খাচ্ছে। আর একটু হলে যে তার মুখ থেকে লালা বের হয়ে যাবে সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।
এদিকে আরশি কেবলই কেকটা বেড সাইটে রেখেছে তখনই দরজার খোলার শব্দের পিছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে মাহেরকে দেখে। মাহিরের তামাটে বর্ণের রোদে পোড়া শ্যামসুন্দর শরীরের দিকে তাকিয়ে সে নিজের দৃষ্টিকে আর ফেরাতে পারে না।
মাহের অস্থির হয়ে নিজের কাপড় খুঁজতে থাকে। সে এতটাই অস্বস্তিতে পরে যে ভুলেই যায় বিছানার উপরেই তার কাপড় রাখা হচ্ছে। যাই হোক অবশেষে সেগুলো খুঁজে পেয়ে কোনরকমে সেগুলো নিয়ে একদৌড়ে ওয়াশরুম যায়।
এই প্রথম মাহেরের নিজের উপর সন্দেহ হচ্ছে । আয়নার দিকে খেয়াল করে দেখে তার গালে লালচে আভার সৃষ্টি হয়েছে। বিরক্ত হয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
–শালা মেয়ে মানুষের মতো লজ্জা পাচ্ছিস। এই তুই পুরুষ মানুষ? ছি!
এদিকে আরশি অস্থির হয়ে আছে।
–এখনো কেন বের হচ্ছে না? একবার রাজি হয়ে যাক বাবাকে বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিবো। তাহলে রোজ রোজ এমন দৃশ্য দেখে চোখ জুড়াতে পারবো।

মাহের বের হয়ে গলা ঝাড়া দিয়ে আরশির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
–ম্যাম আপনি এত রাতে? কোন প্রয়োজন ছিল কি?

আরশি কোন প্রকার ভনিতা ছাড়া বলে,
– আপনাকে আকারে ইঙ্গিতে লাস্ট কয়েকদিন ধরে অনেকভাবে বোঝাতে চেয়েছি কিন্তু আপনি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোনদিন কিচেনে যাই নি অথচ আপনার জন্য রান্না করতে গিয়েছি। তাও আপনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না। ইভেন আপনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকান ও-না। অনেক হয়েছে আমি আর নিতে পারছি না তাই সরাসরি বলছি আই লাভ ইউ। আপনাকে এখনই কোন অ্যানসার দিতে হবে না আগামীকাল বিকাল চারটায় আমাদের বাসার সামনের কফিশপটাতে আমি অপেক্ষা করবো। তখনই আপনি নিজের ডিসিশন জানাবেন।
আরশির বলার কথাগুলোতে মাহের এতটাই হতভম্ব হয়ে গেল যে সে নির্বাক হয়ে গেলো।
–আপনার জন্য কেকটা বানিয়েছি।
বলে আরশি কেকটা কাটতে শুরু করে কিন্তু সেটা এতটাই শক্ত হয়েছিল যে কাটা যাচ্ছিল না।
আরশি এতে বেশ লজ্জায় পরে। পরিস্থিতি সামলাতে সে মাহের দিকে তাকিয়ে বলে,
–প্রথমবার বানিয়েছি তো তাই একটু শক্ত হয়েছে নেক্সটাইম ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আপনার সাথে বিয়ের পর সব রান্না এমনি শিখে যাবো।

এরপর বহুকষ্টে কেকের একটা টুকরা কেটে মাহেরের মুখে গুজে দিয়ে সে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
মাহের তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তে মুখের কেকে একটা কামড় দিয়ে সাথে সাথে তা বের করে দেয়।
–আল্লাহ এটা কেক না ইট! এই কেক খেলে তো আমার দাঁত একটাও আস্ত থাকবে না। বিয়ের পর এই মেয়েকে কিচেনের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। ওর জন্য রান্না না খাওয়াটাই পারফেক্ট।
বলে চার্জে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে আনলক করে গ্যালারিতে প্রবেশ করে। যেখানে আরশির কিছু ছবি বিদ্যমান আর প্রত্যেকটাতেই সে কিছু না কিছু খাচ্ছে। কখনো বার্গার কখনো-বা চকলেট কেক।
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাহের বলে,
–ইউ আর লুকিং সো এডোরেবল হোয়াইল ইটিং, মাই কুইন।


ডা.প্রীতি আরশির দেওয়া লাল লিপস্টিকটা ঠোঁটে লাগিয়ে দেখছিলো তখনই দরজা নক হয়।
অর্ক বা আরশি এসেছে ভেবে দরজা খুলে দিতেই অর্ণব ঝড়ের বেগে তার রুমে প্রবেশ করে। সে কোন প্রতিক্রিয়া জানাবে তার পূর্বেই অর্ণব তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসে। সে চিৎকার করবে কিন্তু অর্ণব তার ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে বলে,
–হুসসসস..
আচমকা এই স্পর্শে প্রীতির পুরো শরীর কেঁপে উঠে।
এরপর অর্ণব ডা. প্রীতির কানের কাছের চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–আমি মানছি আমি সেলফ অবসেস্ট। তবু্ও আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? কথা দিচ্ছি, তোমাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসবো।
–অর্ণব!
অস্ফুটস্বরে ডাক্তার প্রীতি শব্দটি উচ্চারণ করল।
অর্ণবের মনে হলো এর চেয়ে সুমধুর কন্ঠে আর কেউ তার নাম উচ্চারণ করতে পারবে না।
অর্ণব আরও কিছু একটা বলতে চাইছিলো কিন্তু তখনই বাইরে থেকে একটা আওয়াজ শুনা যায়।
তাই সে ডা.প্রীতির উদ্দেশ্য বলে,
–কেউ আমাকে তোমার রুমে এভাবে দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। কাল সকালে তোমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করবো। আর একটা কথা (ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে প্রীতির ঠোঁটের উপর থেকে লিপস্টিক মুছে) এই রঙের লিপস্টিক শুধু বিয়ের পর পরবে। আজ অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করেছি কিন্তু এরপর কি করবো তার কোন গ্যারান্টি নেই।


মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতেই নিজেকে এক শক্তিশালী পুরুষালি বন্ধনে আবদ্ধ অবস্থায় পায় নির্জনা। ভয় পেয়ে সেই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু সেই হাত বাঁধন আলগা হওয়ার বদলে আরো শক্ত হয়ে যায়।
নির্জনার মনে পড়ে যায় তাকে জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় তার নিজের স্বামী। গতরাতে বাজে স্বপ্ন দেখেছে বলে আজ নির্জনাকে তার পাশে ঘুমাতে বলেছে। কিন্তু ঘুমের ঘোরে সে নির্জনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
নির্জনা পুনরায় অর্কর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য নড়চড় শুরু করে কিন্তু পরক্ষণেই অর্ক তাকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে।
অর্ক নিশ্চিত মনে নিজের প্রেয়সীকে বুকে নিয়ে তার চুলের সুবাস এবং শরীরের স্পর্শ অনুভব করছে। আর মনে মনে বলছে,
–এতো ছটফট করলে ছেড়ে দেবো ভেবেছো? মোটেই না, এই যে তোমার দস্যি ছেলে ভালোবেসে তোমাকে বুকের খাঁচায় বন্দী করেছে এতো সহজে তো তোমার ছাড় নেই, ওয়াইফি।

এদিকে অর্কর স্পর্শে নির্জনার অস্বস্তি হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না বরং তার শরীর -মনে এক অদ্ভুত শিহরণ লাগছে। সাথে সাথে হৃৎস্পন্দনও দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
এটা নিয়ে নিজের উপর চরম বিরক্ত হয় নির্জনা।
মনে মনে বলে,
–আমার নির্ঘাত হার্টে সমস্যা হয়েছে। তা-নাহলে আগে কখনোই-তো আমার বুক এমন ধুকপুক করে নি।

এসব আজগুবি চিন্তা-ভাবনা করতে করতে নির্জনা অর্কর বুকে কখন যে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায় তা সে নিজেও জানে না।

নির্জনা ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতেই অর্ক তার কপালে ভালবাসার পরশ দিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,
–আজ থেকে তুমি প্রতিদিন এখানে এভাবেই ঘুমাবে। মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না


জহুরা মঞ্জিলে কতগুলো নিষ্পাপ হৃদয় আশার আলো নিয়ে তাদের জীবনের নতুন দিনের অপেক্ষায় থাকে কিন্তু তারা এ বিষয়ে অজ্ঞাত থাকে যে তাদের জীবনে ভালবাসার সূর্যোদয় এতো শীঘ্রই হবে না।

––চলবে?

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat _Monisha
পর্ব-১৭
(রোমান্টিকতা এল্যার্ট!! )
অপেক্ষার প্রহর গুনে ক্লান্ত হয়ে যায় আরশি তবুও যেন কাঙ্খিত সময় আসে না। প্রথম সকাল থেকে বিকেল হওয়ার অপেক্ষা আর এখন কফিশপে বসে চারটা বাজার অপেক্ষা। প্রায় এক ঘন্টা আগে সে কফিশপে এসে বসে আছে।
চারটা থেকে পাঁচটা বেজে যায়, পাঁচটা থেকে ছয়টা তবু মাহেরের দেখা মেলে না। এবার আরশির বেশ রাগ হয়।
–ভাবেটা কি নিজেকে? আজ অব্দি আমি খাবারের জন্যও এতো অপেক্ষা করি নি। মি.মাহের হুদা একবার বাড়িতে ফিরি তারপর আপনার খবর নিচ্ছি।


লজ্জাবতী গাছের মতো সারাদিন নুয়ে আছে নির্জনা। যতবার অর্কর মুখোমুখি হচ্ছে ততবারই চোখ লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
বারংবার তার মাথায় সকালের ঘটনা আনাগোনা করছে।

ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য নির্জনা ঘুম থেকে উঠবে তখন সে আবিষ্কার করে শুধু অর্কই না সেও অর্ককে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। যখনই একটু নড়েচড়ে সরে গিয়ে অপর পাশ হয় তখনই পেছন থেকে অর্কর খসখসে একটা হাত তার ফর্সা উন্মুক্ত কোমর থেকে মেদহীন পেটে অবাধে বিচরণ শুরু করে।
শুধু তাই নয় সে বুঝতে পারে পিছনে তার ব্লাউজের খোলা অংশে অর্কের রুক্ষ ওষ্ঠব্দয় ক্রমাগত স্পর্শ করছে।
নির্জনার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ শিহরিত হয়। এক মুহূর্তের জন্যও তখন তার মস্তিষ্কে বিহানের কথা কিংবা অর্কর অসুস্থতার কথা আসে না। বরং সে নিজের নারীসত্তাকে অনুভব করা শুরু করে।
সে বুঝতেও পারে না সেই অনুভূতি কখন এতটা তীব্র হয়ে গেছে যে সে অর্কর হাতের কব্জিতে নিজের নখ বসিয়ে দেয়।
–উহ!
অর্কর করা শব্দে ঘোর কাটে নির্জনার। এতক্ষণ কি হচ্ছিলো সে খানিক সময়ের জন্য বুঝতে পারে না।
পিছনে ফিরে দেখে অর্ক ঘুম ঘুম চোখ নিজের হাতে ফু দিচ্ছে।
–ক্্ক্্কি হয়েছে?
ঘুম জড়ানো কন্ঠে অর্ক হাতটা নির্জনার দিকে বাড়িয়ে বলে,
–দেখো না মেনি(আরশির বেড়াল) খামচি দিয়েছে।

নির্জনা তাকি দেখে অর্কর নীল শিরায় ফুলানো পেশিবহুল হাতে তার নখের আঁচড়ে লাল রক্ত বের হচ্ছে। যা দেখে নির্জনার বুঝতে পারে নিজের অজান্তে সে কি করেছে। যার বিপরীতে নির্জনা নিশ্চুপ থাকলেও অর্ক তার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে সে কতটা লজ্জা পাচ্ছে।
চট জলদি নির্জনা অর্কর হাতে এন্টিসেপ্টিক ক্রিম লাগিয়ে কোনরকমে ওয়াশরুমে চলে যায় বলতে গেলে লজ্জায় পালিয়ে যায় ।
তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের জখম হওয়া হাতে ফুঁ দিতে দিতে বলে,
–জংলি বিল্লি কোথাকার! কিছু করিই-নি তাতেই এই অবস্থা।
যখন তোমাকে মন ভরে সোহাগ করবো তখন তো ৩৬৫ দিনই আমাকে সোয়েটার পরে বাইরে বের হতে হবে। কি ভেবেছো ব্যাথা পেয়ে ছেড়েছি? উঁহু, একবারে সব আদর দিয়ে দিলে প্রেমটা জমবে না। তোমাকে তো আমি ধীরে ধীরে আমার প্রেমে পাগল করবো ।


মাহেরের কলার টেনে ধরে তার চোখে চোখ রেখে আরশি প্রশ্ন করে,
–কেন এলেন না?
নিজেকে আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে মাহের বলে,
–আমি তো মনে করেছিলাম রূপ না থাকলেও অন্তত এটা বোঝার মতো বুদ্ধি আছে যে, কেন আমি আপনার সাথে দেখা করতে যাই নি।
এক আজানা ভয়ে আরশির হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যায়।
কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে,
–ম..ম..মানে?
তাচ্ছিল্যের সাথে মাহের বলে,
–মানে সিম্পল আপনি নিজেই বলুন না আপনার সাথে কি আমার কোন দিক দিয়ে যায়? এক বাবার টাকা ছাড়া আপনার আর আছে কি? টাকা পয়সার জন্য আপনার মতো মেয়েকে বিয়ে করবো তেমন রুচি আমার নেই ।
–আমার মতো মেয়ে মানে?
–আপনার মতো মেয়ে মানে, যার জীবনে খাওয়া আর মোটা হওয়া ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই। ট্রাস্ট মি আপনার মতো মোটা মেয়েকে বিয়ে করার চেয়ে আমি সারাজীবন অবিবাহিত থাকা প্রেফার করবো।

মা না-থাকায় ছোটবেলা হতে ভাই আর বাবার অতিরিক্ত আদর ভালবাসায় বড় হয়েছে আরশি। তাছাড়া বাবার টাকা আর ক্ষমতা থাকায় কেউ তাকে নিয়ে কখনো কোন বাজে মন্তব্যও করে নি। তাই সে সবসময় ভেবেছে সবাই তাকে ভালবাসে। এবং ভবিষ্যৎ তার জীবন সাথীও তাকে একইভাবে ভালবাসবে। সেইজন্য কখনোই সে নিজেকে পরিবর্তনের কথা ভাবে নি।
তবে আজ মাহেরের জন্য সে এই কাজ করতেও প্রস্তুত হয়ে যায়, ,
–আপনি চাইলে আমি ডায়েট করে স্বাস্থ্য কমিয়ে ফেলবো।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মাহের বলে,
–ডায়েট করলে স্বাস্থ্য কমবে কিন্তু চেহারার কি করবেন? প্লাস্টিক সার্জারি? অবশ্য আপনারা ধনী মানুষ এসব করতেই পারেন।

মাহেরে প্রতিটি কথায় আরশির হৃদয়ে এতো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তবু তাকে ঘৃণা কিংবা অপমান করতে পারছে না। বরং বাজে ভাবে অপমানিত হয়েও আরশি মাহেরকে কোন ঝাঁঝালো জবাব না দিয়ে আহত মৃদুস্বরে বলে,
–আমি ভেবেছিলাম আমি মোটা বলে আপনার সমস্যা এখন তো দেখছি আমার চেহারাটাই আপনার পছন্দ না। বিশ্বাস করুন এতে যদি আমার কোন হাত থাকতো তবে নিজের চেহারাটা আপনার মনের মত করে গড়ে নিতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব না। (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) আল্লাহর কাছে দোয়া করব যাতে আপনি আপনার মনের মতো মুখশ্রী খুঁজে পান। যাই হোক আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
এরপর সে নীরব অশ্রু বিসর্জন দিয়ে মাহেরের ঘর হতে বের হয়ে যায়।
সে চলে যেতেই মাহের একটু দূরে রাখা নিজের ফোনের ভিডিও রেকর্ডারটা অফ করে তার আর নির্জনার মধ্যকার কথোপকথন একটা নম্বরে পাঠিয়ে দেয়।
আর সেই নম্বরে এসএমএস করে,
‘কাজ হয়ে গেছে।’
এরপর দরজা লাগিয়ে সেখানেই মেঝেতে বসে বিড়বিড় করে বলে,
–তোমার দোয়া কবুল হবে না, কারণ আমার মনের মতো মুখশ্রী পৃথিবীতে একটাই আছে যার মালিক তুমি। তোমার জন্য আমি জীবন দিতে পারবো কিন্তু ভালোবেসে তোমার হাত ধরতে পারবো না। কারণ তোমার চেয়ে আমার জীবনে আরও ইম্পরট্যান্ট কেউ আছে তাই বাধ্য হয়ে তোমার মনটা ভাঙতে হলো। তাছাড়া আমার মতো ছা-পোষা বডিগার্ডের প্রেমে পরা তোমার জন্য বারণ, মাই কুইন।।


সন্ধ্যায় অর্ক পিয়াজু খাওয়ার আবদার করে।সেটা রক্ষা করতে নির্জনা কোমর বেঁধে লেগে যায়।
জহুরা মঞ্জিলে ডাইনিং থেকে রান্না ঘরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর কোমরে শাড়ি গুঁজে রান্নার দৃশ্য দেখে নয়ন জুড়াচ্ছে অর্ক ।
আগুনের তাপে বিন্দু বিন্দু জলকণা জমছে নির্জনা নাকে উপরে।
মুচকি হেসে নিচু কণ্ঠে অর্ক বলে,
–এই হলো সুন্দরী বউ থাকার জ্বালা। এদের দেখলেই যখন তখন টুক করে আদর করতে মন চায়। আহারে আমার বউটা কত কষ্ট করছে। কিন্তু আমিই বা কি করবো সকাল থেকে যেভাবে চড়ুই পাখির মতো ফুরুৎ ফুরুৎ করছে দুমিনিট শান্তিতে তাকে দেখতেও পারি নি। তাইতো এই বায়না।
তখনই তার চোখ যায় নির্জনার কোমরের দিকে যেখানে একই রকম জলকণার অবস্থান। আর এতে তাকে এতোটাই আবেদনময়ী লাগছে যে অর্ক একটা শুকনো ঢুক গিলে বিড়বিড় করে বলে,
– নাহ এই মেয়ে সালোয়ার কামিজেই ভালো ছিলো। আমি মাতব্বরি করে নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছিস।

পিঁয়াজুগুলো নিয়ে নির্জনা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিংয়ের দিকে এগিয়ে যায় তখন অদূরে কিছু একটা দেখে তার হাত থেকে পিঁয়াজু ভর্তি কাঁচের প্লেটটা পরে ভেঙে যায়।
অর্ক নির্জনার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখশ্রীটা আতঙ্কে বিকৃত হয়ে গেছে। সে নির্জনার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই রুহানকে নিজেদের ড্রইং রুমে দাঁড়ানোর অবস্থায় দেখতে পায়।
প্রচন্ড আক্রোশের অর্ক দিকবিদিক শুন্য হয়ে রুহানের দিকে ছুটে যাবে তখনই অর্ণব সেখানে এসে উপস্থিত হয়। আর রুহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আরে মি.খন্দকার। আপনি হঠাৎ আমাদের বাড়িতে? আপনি এখানে আসবেন বাবা সে ব্যাপারে বাবা তো কিছু বলেনি। কোন জরুরি দরকার ?
রোহান রহস্যময় হাসি দিয়ে বাঁকা চোখে নির্জনার দিকে তাকিয়ে বলে,
–ভীষন জরুরী দরকার মি. সিদ্দিকী। আমার একটা খুব প্রিয় জিনিস আপনাদের বাড়িতে আছে।
ভয়ে নির্জনা কাঁপতে শুরু করে। অর্ক রাগে তার মুষ্টি শক্ত করে নেয়।
অর্ণব রুহানের কথা বুঝতে না পেরে বলে,
–আই এ্যাম সো সরি মি. খন্দকার। আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আপনি কি বাবার কাছে এসেছেন? যদি তাই হয়ে থাকে বাবা তো এখনো ফেরে নি।
তখনই একটু দূর হতে একটা নারী কন্ঠ ভেসে আসে,
–উনি আমার জন্য এসেছেন।
অর্ণব পিছন ফিরে দেখে ডা. প্রীতি ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক লাগিয়ে হাতে একটা লাগেজ নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে ।
প্রীতি রুহানের পাশে দাঁড়িয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
–রুহান আমার উডবি হাসবেন্ড। উনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসেছেন।

–চলব?