প্রেমে পরা বারণ পর্ব-১৮+১৯

0
38

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat Monisha
পর্ব-১৮

–রুহান আমার উডবি হাসবেন্ড। উনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসেছেন।
ডা.প্রীতির কথায় পিন নিরবতা ছেয়ে গেলো জহুরা মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমে। সবাই এতটাই স্তব্ধ হয়ে গেল যে, কারও মুখে কোন বুলি ফুটছে না।

তখন পিছন থেকে অতি উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে আরশি বলে উঠে,
–রুহান খন্দকার! প্রীতি দিস ইজ চিটিং তুমি ফুল কান্ট্রির ক্রাশকে বিয়ে করতে পারো না। হ্যালো আমি আরশি সিদ্দিকী।
আরশির বাড়ানো হাতের সাথে হাত মিলিয়ে রুহান বলে,
–রুহান খন্দকার।

মাহের নিরাপত্তা জনিত কারণে সর্বক্ষণ জোহরা মঞ্জিলের সিসিটিভি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে। সে যখনই দেখেছে রুহান বাড়িতে প্রবেশ করেছে সেও সাথে সাথে সেখানে চলে আসে। এসে দেখে ডা.প্রীতি রুহানকে তার হবু স্বামী বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নির্জন আর রুহানের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপছে তাই যে নির্জনাকে সামলানোর জন্য তারদিকে এগিয়ে যাবে তখনই আরশির উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলা এই কথাগুলো শুনে আর রুহান এবং আরশির হাত মেলানো দোখে সে মুষ্ঠি শক্ত করে নেয়।
নিজের বোনের রুহানের সাথে এই বাড়াবাড়িটা অর্কও সহ্য করতে পারছে না। সে আরশি কিংবা ডা. প্রীতিকে কিছু বলবে তার আগেই মাহের সেখানে গিয়ে নির্জনার উদ্দেশ্য ফিসফিস করে বলে,
– ম্যাম প্লিজ আপনি শান্ত থাকুন। এখানে কিছু বলা মিনিস্টার স্যারের নিষেধ। আমি থাকতে কারও কোন ক্ষতি হবে না।

মাহেরের কথা শুনে অর্কও নিজের মত বদলায়। আর নির্জনাতো এতোটা আতঙ্কিত যে সে কোনকিছু বলার অবস্থায়ই নেই তবু মাহেরের কথা শুনে সে কিছুটা স্বস্তি পায়।

এদিকে অর্ণবও রুহানের দিকে হাত বাড়িয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,
–আমি ভাবতে পারি নি আপনি ডা.প্রীতির উডবি হবেন।

রুহান এক নজর নির্জনার দিকে দিয়ে বলে,
–আমিও ভাবতে পারিনি আমার ফিউচারকে এখানে পাবো। ইনফ্যানক্ট প্রীতির বাড়ির সবাই জানে সে ঢাকায় হসপিটালে জব করে কিন্তু কেউ জানে না সে কারও বাড়িতে এভাবে পার্সোনাল ডক্টর হিসেবে আছে। (প্রীতির দিকে তাকিয়ে) I owe an explanation.

প্রীতি খুব সহজভাবে বলে,
–গাড়িতে যেতে যেতে বলছি। আফটারঅল আমরা কুষ্টিয়া যাচ্ছি। অনেকটা রাস্তা।

খুব ভদ্রভাবে ডা.প্রীতির কথা মেনে নিয়ে রুহান বলে,
–আমরা হেলিকপ্টারে যাচ্ছি সো রাস্তাটা ২০মিনিটের।

–রিয়েলি! হেলিকাপ্টার? ইউ আর সো লাকি
কথাটি ডা.প্রীতির কানে ফিসফিস করে বলে চোখে টিপ দে আরশি।

প্রীতি আরশির কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না করে রোহানকে বলে,
–তাহলে বাড়ি গিয়ে একবারে মা-বাবা আর আপনাকে এক্সপ্লেইন করছি।
এরপর সে আরশিকে জড়িয়ে তার কানে কানে বলে,
–একটু আগে কি বলেছি ভুলে যেও না। মাহের যতই তোমাকে রিজেক্ট করুক তুমি কিন্তু এতো সহজে আশা ছাড়বে না। আরশিও প্রীতির কানে কানে বলে,
–তুমি ভরসা দিলে বলেই তো হাল ছেড়ে দেইননি। তবে তুমি কিন্তু বলোনি তুমি কি আগে থেকে কি করে জানতে যে মাহের আমাকে রিজেক্ট করবে?
–আমার বিয়ের পর তোমাকে সব বলবো।
বলেই ডা.প্রীতি আরশিকে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু অর্ণব ডা.প্রীতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আপনি যদি চলে যান তাহলে আপনার রোগির কি হবে?
–আপনার বাবার সাথে নিয়ে আমার কথা হয়ে গেছে মি.অর্ণব।
বলে ডা.প্রীতি রুহানকে নিয়ে অর্ক আর নির্জনার দিকে এগিয়ে যায়৷
–মাই পেশেন্ট অর্ক এন্ড হিজ ওয়াইফ নির্জনা।
রুহান তাদের দিকে হাত না বাড়িয়ে বলে,
–নাইছ টু মিট ইউ(অর্কর দিকে তাকিয়ে) তোমারর পেশেন্টকে দেখে মনে হয় না সে অসুস্থ।
প্রীতি মৃদুস্বরে বলে,
–মানসিক অসুস্থতা বাইরে থেকে দেখা যায় না।
এরপর সে নির্জনার হাতে অর্কর হাত দিয়ে বলে,
–এরপর থেকে সে তোমার দায়িত্ব। মি.জাফর সিদ্দীকি যত বড় ডাক্তারই আনুক না কেন তুমি ছাড়া ওকে কেউ ভালো করতে পারবে না।
কিন্তু নির্জনা তো স্থির দৃষ্টিতে একরাশ ঘৃণা নিয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে আছে।
এদিকে ডা.প্রীতি এবং অর্ক ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে ,
–তুমি সকালে কেন বলো নি তুমি রুহানকে বিয়ে করছো?
–রুহান তোমাদের কাউকে বলতে বারণ করেছিলো।
–ডেফিনিটলি সে বারণ করবে। তুমি এ বিয়েটা ভেঙে দাও।
প্রীতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
–তোমার মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। আমি যাই পরে কথা হবে।
বলে সে রুহানকে নিয়ে বের হয়ে যাবে তখনই রুহান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–আপনাদের সবার দাওয়াত রইলো পরশু আমাদের এনগেজমেন্ট। আশা করি সবাই আসবেন। আমি মিনিস্টার সাহেবের কাছে অলরেডি কার্ড পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরশি আবারও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,
–আমরা নিশ্চয়ই যাবো।
রুহান নির্জনার দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমি অপেক্ষা করবো।
রুহান আর ডা.প্রীতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অর্ণব মনে মনে বলে,
–এই হলো আমাকে রিজেক্ট করার আসল কারণ
রুহান খন্দকার আমার চেয়ে বেশি সাকসেসফুল। সে যে রেভিশিং লাইফ তোমাকে দিবে তা আমি দিতে পারব না


গাড়িতে বসে রুহান খুব সুন্দর করে নির্জনাকে বলে,
– তুমি একজন সুস্থ মানুষের চিকিৎসা কেন করছিলে?

অবাক দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে প্রীতি বলে,
–তুমি কি করে জানলে অর্ক অসুস্থ না?

–বলবো তার আগে আমি যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও। তোমার সাথে আমার বিয়ে হতে চলেছে তাই আমি জানতে চাই যে, আমার হবু স্ত্রী কেন শুধু শুধু একটা সুস্থ মানুষের চিকিৎসা করছিলো? টাকার জন্য?

যা শুনে প্রীতি বলে,
–টাকার জন্য ডাক্তারি পেশাকে অপমান করবে এতটাও নিচু মন-মানসিকতা আমার নয়। একটু ধৈর্য ধরো, বাড়ি গিয়ে আমার মা-বাবা সহ সবাইকে একত্রে এক্সপ্লেইন করবো। কিন্তু আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না তুমি হঠাৎ এনগেজমেন্ট ডেট এগিয়ে কেন দিয়েছো? আর বিয়েতেই-বা কেন রাজি হয়েছো? আমার যতদূর মনে পরে, মাইমুনা আন্টি অনেকদিন থেকে আমাদের বিয়ের জন্য চেষ্টা করছিলো কিন্তু তুমিই কখনো রাজি হওনি। কারণ তুমি একজনকে ভালবাসতে।

রুহান বেশ জোরালো গলায় বলে,
–ভালবাসতাম না এখনো বাসি।

–তাই নাকি তাহলে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে যে ?

রুহান জানে আর একমাত্র তুরুপের তাস এখন ডা.প্রীতি। তাকে কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবে না। বরং যে কোন উপায়ে তাকে হাতে রাখতে হবে। তাই সে অনেক দুঃখী গলায় বলে,
–তার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমি মুভ অন করার চেষ্টা করছি।


এদিকে নির্জনা একরাশ অস্থিরতা নিয়ে জাফর সিদ্দিকীর ঘরের বাইরে পায়চারি করছে যেভাবেই হোক বিয়েটা আটকাতে হবে। একটা মেয়ের জীবন সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে পারে না। জাফর সিদ্দিকী নিজের ঘরে প্রবেশ করার আগ মুহূর্তে নির্জনার মুখোমুখি হয়।
নির্জনা একই অস্থিরতা নিয়ে জাফর সিদ্দিকীকে বলে,
–রুহান ডা.প্রীতিকে বিয়ে করছে।
ভাবলেশহীনভাবে নির্লিপ্ত গলায় জাফর সিদ্দিকী বলে,
–তো?
–স্যার যে কোন মূল্যে বিয়েটা আটকাতে হবে। ডা.প্রীতির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
–হলে হবে এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে ভাবো। এখন ঘরে যাও অনেক রাত হয়েছে।

তাদের মধ্যেকার এসব কথা অর্ক আড়াল থেকে শুনতে পেয়ে মনে মনে বলে,
–বাবা কবে তুমি একটু অন্যদের কথা ভাববে? তোমার এই স্বার্থপরতার জন্যই আমি দশ বছর পাগল সেজে ছিলাম।

–চলবে

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat Monisha
পর্ব-১৯

–হলে হবে এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে ভাবো। এখন ঘরে যাও অনেক রাত হয়েছে।

জাফর সিদ্দিকীর এমন কথায় নির্জনা খুব বেশি অবাক হয় না। কারণ যার কাছে নিজের ছেলের চেয়ে ক্ষমতা জরুরি, সে বাহিরের একজনের জন্য সেটা হারাতে চাইবে?
কিন্তু এবার সে রুহানকে জিততে দিবে না বলে দৃঢ় সংকল্প করেছে। তাই সে জাফর সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে বলে,
–আজ ডা.প্রীতির জায়গায় যদি আপনার মেয়ে আরশি থাকতো।
খেই খেই করে উঠে জাফর সিদ্দিকী,
–তোমার সাহস কি করে হয় ঐ দু’টাকার ডাক্তারের সাথে আমার মেয়ের তুলনা করার। শোন মেয়ে তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি আরশি কোন দিনও ঐ ডাক্তার কিংবা তোমার জায়গায় থাকবে না কারণ সে আমার মেয়ে। মিনিস্টার জাফর সিদ্দিকীর মেয়ে। কোন ড্রাইভার কিংবা মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে না।
নির্জনাও কঠোর গলায় বলে,
–ড্রাইভার আর মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়েদের কি ভালো থাকতে নেই স্যার? আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করেছি প্লিজ স্যার এ বিয়েটা বন্ধ করুন।
–এটা সম্ভব না। কারণ তমিজউদদীন খন্দকারের সাথে আমার কথা হয়েছে এ বিয়েতে রুহান নিজে মত দিয়েছে। তাছাড়া এ বিয়েটা হলে তোমার জীবন থেকে রুহান নামের ঝামেলা দূর হবে।
–তারমানে এ বিয়েটা বন্ধ করতে আপনি কিছুই করবেন না? বেশ এবার যা করার আমিই করবো।
নির্জনার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে জাফর সিদ্দিকী হুঁশে এলো। সত্যি যদি নির্জনা বিয়েটা বন্ধ করে তবে হিতে বিপরীত হবে।
–তুমি মাথা গরম করো না আমার ধারণা একবার বিয়ে হয়ে রুহান ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া প্রীতি বুদ্ধিমতী মেয়ে সে ঠিক রুহানকে সামলে নিবে।
তাচ্ছিল্যের সাথে নির্জনা বলে,
–বুদ্ধিমতী হোক আর বোকা হোক রুহান খন্দকারে বিয়ে করে এ দুনিয়ায় কোন মেয়েই ভালো থাকতে পারবে না। আমি শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি আপনি বিয়ে ্টা বন্ধ করবেন কি-না?
শান্ত গলায় জাফর সিদ্দিকী বলেন,
–একবারই-তো বললাম না।
–বেশ তবে আমারও একটা কথা মনে রাখবেন আমিও এ বিয়েটা হতে দেবো না কিছুতেই।
কথাগুলো বলে সেখানে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলো নির্জনা।


প্রীতি নিজের মা-বাবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রীতির বাবা ফরিদ রহমান একজন শান্তিপ্রিয় মুসলিম এবং পেশায় স্কুল শিক্ষক। তার ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ আগের দিনের মানুষের মতো। বড়ো দুই মেয়েকে নিজের ইচ্ছে মতো আঠারো হওয়ার সাথে সাথে পাত্রস্থ করলেও ছোট মেয়ের বেলায় তা করতে পারেননি শুধুমাত্র স্ত্রী মোরশেদা আর বড়ো দুই মেয়ের জেদের জন্য। তাছাড়া একমাত্র ছেলের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় তিনি অনেকটা ভেঙে পরেছিলেন। এদিকে প্রীতি অন্যদের তুলনায় ছাত্রী হিসেবে ভালো তার উপর সরকারি মেডিক্যালে চান্স পাওয়ায় তিনিও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে বিশেষ আপত্তি জানায় নি। কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছে এখানেই তিনি ভুল করেছেন তখন স্ত্রী আর মেয়েদের কথার পাত্তা না দিয়ে যদি ছোটটাকেও সঠিক সময়ে বিয়ে দিয়ে দিতেন তবে আজ এই লজ্জার মুখোমুখি তাকে হতে হতো না।
–আজ আমার ইচ্ছে করছে তোকে নিজ হাতে খুন করি। বাড়িতে মিথ্যে কথা বলা? লেখাপড়া করে এই শিখেছো তুমি?
প্রীতি মাথা নিচু করে বলে,
–বাবা আমি..
–চুপ একদম চুপ তোমার মুখ থেকে আর একটা শব্দ বের হলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো।
–তুমি একটু শান্ত হও।
স্ত্রীর সাথে কোন দিন উচ্চস্বরে কথা না বললেও আজ মোরশেদাকে ধমকে উঠেন ফরিদ রহমান।
–সব নষ্টের গোড়া হলে তুমি। আমি বললাম বিয়ে দেই, না উনি মেয়েকে পড়াবেন নিজের পায়ে দাঁড় করাবেন এখন মিললো তো আমার সব কথা। পইপই করে বলেছিলাম মেয়েরে এতো লাই দিয়ো না।
রুহান এতোক্ষণ সবটা শুনছিলো। তার প্রীতির প্রতি কোন আগ্রহ নেই । সে বিয়েও করতে চায় না কিন্তু সে যখন জানতে পারে প্রীতি সবার অগোচরে অর্ণবের ব্যাক্তিগত ডাক্তার হিসেবে কাজ করছে তখনই তার মাথায় একটা প্ল্যান কাজ শুরু করে৷ তাই না চাইতেও মায়ের ছোটবেলার বান্ধবীর মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
–আঙ্কেল আমার মনে হয় প্রীতির কথাটা একবার শোনা উচিত।
ফরিদ রহমান এবার একটু শান্ত হলেন। যতই হোক হবু জামাতার সামনে কোনপ্রকার দৃষ্টিকটু আচার তিনি করতে পারেন না। তিনি গম্ভীর গলায় প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলেন,
–কিসের জন্য একটা মন্ত্রীর বাড়িতে পারসোনাল ডাক্তারের কাজ করতে হলো? তোমার হাসপাতালের বেতনে না পুষালে আমাকে বলতে, প্রয়োজনে আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিতাম।
ডা.প্রীতি নিজে চোখ মুছে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমি টাকার জন্য কাজটা করি নি বাবা।
–তবে?
–জাফর সিদ্দিকী কথা দিয়েছিলো, অর্ককে ভালো করে তুলতে পারলে হাসিবকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন কারণ হাসিব কোথায় আছে তা তিনি জানেন।
সাত বছর পর একমাত্র ছেলে বেঁচে আছে এমন কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠে মোরশেদা।
–আমার হাসিব কোথায়? বল না প্রীতি , আমার ছেলে।
–জাফর সিদ্দিকীর ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়ায় তিনি আমাকে কিছু বলেন নি।
–তুমি আমাকে নিয়ে চলো, আমি উনার সাথে কথা বলবো। দরকার হলে উনার পায়ে ধরবো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডা.প্রীতি বলে,
–মা উনি খুঁজে বের করবে না। হাসিবের নাম করে আমাকে যাস্ট ইউজ করেছে ।
–না তিনি যখন বলেছে তিনি বের করে দিবে, তুমি নিয়ে চলো। শুনছো সুমির বাবা তুমিই আমাকে নিয়ে চলো।
মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ পরায় এক পর্যায়ে মোরশেদা অজ্ঞান হয়ে যায়।
হাসিব নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই এমন হুটহাট জ্ঞান হারায় মোরশেদা। প্রীতি নিজের মা’কে ইনজেকশন দিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– আমাকে মাফ করে দাও। আমি শুধু হাসিবের জন্য।
গত সাত বছরে নিজের ছেলেকে কত খুঁজে বেরিয়েছে আর কতবার থানায় গেছেন তা শুধু ফরিদ রহমান নিজে জানে। আর ছোট ভাইকে প্রীতি কতটা ভালোবাসতো তাও তিনি জানেন। তাই তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
–হাসিবের আশা ছেড়ে দাও, ভাগ্যে থাকলে তোমার ভাই ফিরে আসবে । তোমার সামনে নতুন জীবন তা নিয়ে ভাবো।
ডা.প্রীতি কিছু বলবে তার আগেই রুহান বলে,
–আঙ্কেল আমি প্রীতির সাথে একটু একা কথা বলতে চাই ।
রুহানকে নিয়ে ডা.প্রীতি বাড়ির নিজের রুমে আসতেই রুহান প্রশ্ন করে,
–আপনি জাফর সিদ্দিকীকে কেন বলেন নি যে, তার ছেলে পাগল নয়, সে অভিনয় করছে।
প্রীতি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।


নির্জনার মন খারাপের কারণটা অর্ক জানলেও এই মুহূর্তে তার করার কিছুই নেই। গতরাত হতে প্রীতিকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু শেষবার কলটি প্রীতি নয় রুহান রিসিভ করে বলে,
–এতোবার কল দিয়ে লাভ নেই আমার উডবি ওয়াইফ মিনিস্টার জাফর সিদ্দিকীর বাড়ির কারও কল রিসিভ করবে না। তাই তাকে কোন কথা বলতে হলে তোমাকে আমার এনগেজমেন্ট পার্টিতে আসতে হবে।
অর্ক রুহানের কথা শুনে বুঝতে পারে সে মরণ খেলায় মত্ত হয়েছে। তাই সেও মনস্থির করেছে এবার এসপার-ওসপার করেই ছাড়বে।
তাই শেষবারের মতো নিজের পাগলামিটা উপভোগ করতে নির্জনাকে নিয়ে বের হয়। যদিও নির্জনা প্রথমে রাজি ছিলো না কিন্তু আরশির অনুরোধে সে রাজি হতে বাধ্য হয়।
পরিশেষে নির্জনা, অর্ক, আরশি এবং মাহের তাদের বাসার পাশে একটা শপিংমলে যাওয়ার জন্য রওনা হয়।
শপিংমলটা কাছাকাছি হওয়ায় চারজন পায়ে হেঁটেই রওনা হয়।
শপিংমলের সামনে পৌঁছে আরশি রাস্তার অপরপ্রান্তে হাওয়াই মিঠাইয়ের একটা ফেরিওয়ালা দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বাসিত হয়ে আরশি বলে,
–হাওয়াই মিঠাই। আমি খাবো।
–রাস্তায় যা দেখে সবই খাওয়া চাই। তোমার এই খাই খাই স্বভাবের জন্যই কোন দিন ওজন কমবে না, আর বিয়েও হবে না।
অর্কর কথা শুনে প্রথমবার আরশির মন খারাপ হয় এবং কোন জবাব দেয় না। এদিক আরশিকে কেউ এমন কথা বলছে এই ভেবে মাহেরের রক্ত গরম হয়ে যায়।
সে নিজেকে শান্ত করে বলে,
–আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন আমি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আসছি।
–প্রয়োজন নেই।
বলে আরশি নিজের মতো রাস্তা পার হওয়া শুরু করে। অর্ক ব্যস্ত হয়ে মাহেরকে বলে,
–আরশি ঠিকমতো রাস্তা পার হতে জানে না, আপনি সাথে যান। যেতে তো মাহেরও চায় কিন্তু নির্জনা ও অর্ক একা থাকবে তাই সে ইতস্তত করে। এদিকে আরশি সত্যি ছোট থেকে একা রাস্তা পার হতে পারে না। সে এক পা এগিয়ে যায় তো দুইপা পিছিয়ে যায়।
নির্জনা তার অবস্থা দেখে মাহেরকে বলে,
–মি.হুদা আপনি যান আমরা এখানেই দাঁড়াই।
অগত্যা মাহের আরশির দিকে এগিয়ে যায়। মাহেরকে দেখে আরশি বলে,
–মাহের আমার কোন দয়ার প্রয়োজন নেই।
আরশি আরও কিছু বলবে তার আগেই মাহের তার হাত ধরে দু-মিনিটে রাস্তা পার হয়ে যায়। সে আরশির হাত ছাড়বে তার আগেই আরশি নিজের অপর হাতটা মাহেরের হাতে রেখে বলে,
–ভালবেসে সারাজীবন আমার হাতটা ধরে রাখা যায় না?
মেয়েদের কেন মমতাময়ী বলা হয় আজ মাহের তা বুঝতে পারছে। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার জানিয়ে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।
আরশিও এতো অবহেলা পেয়ে কোন প্রতিত্তোর না করে হাওয়াই মিঠাই কেনায় মনযোগ দেয়।

এদিকে অর্ক বিভিন্ন কথা বলে নির্জনার মন ভালো করার চেষ্টা করছিলো ঠিক তখনই একটা ছিনতাইকারী বিহানের দেওয়া চেইনটা নির্জনার গলা থেকে টান দিয়ে দৌড় দেয়।
নির্জনার মনে হয় আবারও কেউ তার কাছ থেকে বিহানকে ছিনিয়ে নিচ্ছে । তাই সে চিৎকার করে,
–বিহান!
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে অর্ক বলে,
–কি হয়েছে?
নির্জনা সেই ছিনতাইকারীর দিকে দৌড়ে যেতে যেতে বলে,
–আমার বিহানের শেষ চিহ্ন।
অর্ক ঘটনা বুঝতে পরে দৌড় লাগায় এবং নির্জনাকে অনেকটা পিছনে ফেলে ছিনতাইকারীর দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়।

এদিকে রাস্তার অপর পাশ থেকে মাহের বুঝতে পারে কোন ঝামেলা হয়েছে তাই আরশিকে তাড়া দেয়। এতে আরশি একটু রেগে বলে,
–আপনি চলে যান, আমি যেতে পারবো।
মাহেরও পাল্টা রাগ দেখিয়ে বলে,
–আপনি সবসময় এতো বেশি কেন বুঝেন? তাছাড়া আমি আপনার ভাবির বডিগার্ড আপনার না।
এতে আরশি মেজাজ খারাপ হয়ে যায় সে হাওয়াই মিঠাইটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পথশিশুর হাতে ধরিয়ে একা হাঁটা দেয়। মাহের তাকে আটকাবে কিন্তু তখনই এটা দ্রুত গতির বাইক এসে আরশিকে ধাক্কা দেয়।
মাহের ভয়ে চিৎকার করে,
–আরশি!!


অন্যদিকে নির্জনা দৌড়ে কিছুদূর গিয়ে দেখে একটা ভিড় একত্রিত হয়েছে। সে তা ঠেলে ভিতরে যেতেই দেখে অর্ক ছুরি বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পরে আছে।
আজ আর জ্ঞান হারায় না নির্জনা। সে দৌড়ে অর্কের কাছে ছুটে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাক দেয়,
–অর্ক!!

–চলবে