#প্রেমোবর্ষণ
৬.
সাঁঝনামা মুহূর্তটা এ ধরার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলোর একটি এমনটাই মনে হয় কলির। এ শহরে সন্ধ্যের আগ মুহূর্তে নিস্তব্ধ একাকীত্ব পাওয়া ভার তবুও হলের তিন সদস্যের ছোট্ট এ কামরাটায় কিছুটা হলেও নির্জনতা মেলে। রুমে এখন বান্ধবী নেই, সিনিয়র আপুটিও নেই তাই একদমই একা বসে কলি ভাবছে পরশ ভাইকে আর উপভোগ করছে দক্ষিণ কোণের মেঘশূন্য রক্তিম আকাশের রঙবদল। পাতার ফাঁক গলে এক টুকরো আকাশ বড্ড উপকার করছে কলির। আনমনেই সে খুঁজে পাচ্ছে জোর পরশ ভাইকে আর একটা দিন এড়িয়ে চলার৷ তারপরই তো মানুষটা দেশ ছাড়বে সেই সাথে ছাড়বে কলিকে। টানা দু বছর যে মানুষটার প্রেমে পড়ে উথাল-পাতাল হয়েছিল একসময় হঠাৎ মাস খানেকের মধ্যে সে প্রেম এমন গতিহীন হয়ে পড়লো কি করে! তবে কি সে শুধু দূর থেকে দেখা মানুষটাকেই ভালবাসে! কাছের পরশকে সে চায় না একটুও। এমনও হয় বুঝি! যাকে ভালোবাসে তাকে তো মানুষ সর্বাবস্থায়ই ভালোবাসে তবে কেন তার টান আসে না এই পাগলাটে পরশ ভাইয়ের প্রতি? বাড়ি থেকে একের পর এক কল আসছে তো আসছেই। আশফাক ভাইকে সবাই যা ভাবতো তিনি তা মোটেও নন। বড় চাচু প্রেমিকাসহ ধরেছিল উনাকে কিন্তু কে জানতো সেই মেয়ে প্রেমিকা নয়। লুকিয়ে আরও মাস তিনেক আগেই তারা বিয়ে করে ফেলেছে। বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড এ নিয়ে এরই মাঝে কলি বাড়িতে না গিয়ে কালই হলে এসে উঠেছে এ নিয়েও একটা ঝামেলা হবে। কিন্তু কলির এখন এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না আর তো মাত্র একটা দিন। তারপরই ওই পাগল লোক দেশ ছাড়বে কে জানে এরপর আর কলি তাকে দেখবে কিনা আর কখনো! তাই আজকে বসে শুধু তাকে নিয়েই ভেবে ভেবে রাতটা কাটাবে বলে ঠিক করল। এবার চোখ বুঁজে পুনরায় ভাবতে চাইলে আবারও বেজে উঠলো ফোনটা। কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকাতেই দেখলো পরশ কল করছে। ফোন ধরবে না ধরবে না করেও ধরলো, বলো।
-বেয়াদব! ফোন ধরে সালাম দিতে হয় জানিস না?
-আসসালামু আলাইকুম।
-ফাজিল কোথাকার!
-এবার কি করলাম?
-ফাইজলামি করেছিস।
-সালাম দেওয়া ফাইজলামি মনে হয় তোমার?
-না তোর ফাইজলামি অন্যটা।
-কোনটা?
কলি প্রশ্ন করলেও উত্তর পেলো না বরং আদেশ এলো পরশের তরফ থেকে, ‘জলদি একটু বাইরে আয় তো।’
– কেন?
-এত প্রশ্ন করিস কেন কথায় কথায়! যা বলছি তাই কর।
-পারব না।
-তুই পারবি সাথে তোর চৌদ্দ গুষ্টিও পারবে ফাজিল। জলদি আয় বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।
– কেন এমন করছো পরশ ভাই। যাও এখান থেকে আমি দেখা করব না।
-কথা বাড়াস না তো কলি৷ এমনিতেই বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি। জোরে নামলে ভিজে যাব তখন জ্বর চলে আসবে। জ্বর নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে উঠলে কে সেবা করবে? আমার জ্বর তো জানিস কাঁপা-কাঁপি, বমি করা, উল্টাপাল্টা কথা বলা, চোখ উল্টে আসা….
-এ্যাই থামো তো আসছি আমি।
গায়ের ওড়না ঠিক করে সময় দেখলো কলি। এই ছেলেকে এখন না থামালে আরও কত কি যে উঠে আসবে তার বক্তব্যে একমাত্র আল্লাহই জানেন। সাতটা পঁয়ত্রিশ বাজে তার মানে এখনো সময় আছে কিছুটা। নয়টার পর বের হওয়া যাবে না, আসাও যাবে না কিন্তু এখন সমস্যা হবে না বলেই কলি বের হলো রুম থেকে। হলের গেইট পেরিয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই পরশকে দেখতে পেল। এক হাতে ফোন কানে ধরা অন্যহাত মুষ্টিবদ্ধ। রাস্তার পাশের হলদে বাতির আলোয় কলি খেয়াল করল পরশ ভাইকে। লম্বা চওড়া মানুষটা একটু বোধহয় শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কাল তো দেখতে এমন লাগেনি! নাকি কাল সে ভাল করে তাকিয়েই দেখেনি৷ দেখবেইবা কেমন করে ভরা রাস্তায় অতগুলো বাইক আর অমন ধারার প্রপোজে ভড়কে গিয়েছিল সে। কিন্তু আজ এ ক্ষণে পরশ ভাইকে দেখতেই বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙেচুরে আসছে যেন! এত রোগাটে আর পাতলা লাগছে মানুষটাকে, চোখের কোল ডুবে আছে রাত জাগার সাক্ষী নিয়ে৷ পরশ সল্প সময়েই সামনে এসে দাঁড়ালো কলির।
-দেখলি কেমন বৃষ্টি হচ্ছে? অযথাই দেরি করালি আমি তো প্রায় ভিজেই গেছি।
-কেন ডাকলে?
-যে কারণেই হোক আমি ডাকলেই তুই চলে আসবি?
কলির মেজাজ খারাপ হলো এবার। তারই ভুল এই মাথা খারাপ লোক ডাকতেই কেন এলো সে। আগেই বোঝা উচিত ছিল ফালতু লোক ফালতু কথা বলতেই ডাকবে। নিজের ভুল হয়েছে ভেবেই কলি ফিরে যেতে পা বাড়ালো। পরশ তা টের পেতেই হাত ধরলো কলির, ‘আরেহ দাঁড়া এক সেকেন্ড’ বলেই পরশ তার মুঠোয় থাকা একটুখানি কাচা হলুদ বাটা মেখে দিল কলির মুখে। হঠাৎ কি হলো কলি তা বুঝে ওঠার আগেই পরশ তাকে আরো বেশি চমকে দিয়ে নিজের গাল ঘষে নিলো কলির গালে। আর ক্ষীণ স্বরে তার কানের কাছে বলল, ‘গায়ে হলুদ মোবারক ম্যাডাম।’
এরপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে রাস্তা পেরিয়ে রিকশা করে চলে গেল কোথাও। অনেক কষ্টে এই হলুদটুকু পিষিয়ে এনেছে সে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে। হলুদ ছাড়া বিয়ে হবে এ কেমন কথা! এমন করেই এক বন্ধু বলার পরই পরশ ভাবলো এইটুকু তো করাই যায়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ৷ সেও বাজারে গিয়ে এক টুকরো হলুদ কিনেছে দশ টাকায়। তারপর সেটা বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে শিল নোড়ায় পিষে প্লাস্টিক এক কাগজে পেঁচিয়ে নিয়ে এসেছে। আর এখন তা কলির গালে মাখিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল কেমন! কলি তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কিনারায়। বৃষ্টির তোড় বেড়ে চলছে। পথচারী অনেকেই যেতে যেতে কলিকে দেখছে কেউ আবার বৃষ্টি বলে জোর পায়ে চলে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। মিনিট কয়েক পর যখন বৃষ্টির তেজ অনেক বেড়ে গেল অনেক বেশি ঠিক তখনই কলির হুঁশ ফিরল যেন। সে ধীর পায়ে ফিরে গেল রুমে।
-রূবাইবা মেহউইশ