প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-১২

0
1

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

রোদ্দুর বাবার কড়া নির্দেশের পর সোজা নিজের ঘরে চলে এল। মনে ভীষণ এক অশান্তি। নিজের রাগ আর অভিমান একসাথে যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মুনার কথাও মাথায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেন এতসব কথা সে গোপন করল? কেন একবারও বলল না ইনামুল সাহেব ওকে ওয়ার্ন করেছিল রোদ্দুরের কাছ থেকে যেন দূরে থাকে? আশকারা না দেয়? এতগুলো বছরে একবারও কেন বলেনি? সে এতদিন অকারণেই মুনাকে ভুল বুঝেছে?
মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করার প্রবল ইচ্ছে হলেও, অজানা এক অভিমানে সে নিজেকে আটকে রেখেছে।
মায়ের কথা মনে হলো তার। মুনা ওকে ভালোবাসে, এটা কি সত্যি? নাকি ভ্রম? এতই যদি ভালোবাসতো তাহলে ওকে এতগুলো কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে পারত না, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলত না। রোদ্দুরের কাছে সব অদ্ভুত লাগে! অভিমান তাকে আষ্টেপৃষ্টে শিকল বেঁধে রেখেছে। রোদ্দুর হাত ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখল। কিছুক্ষণ ঘরটায় পায়চারি করল। বাবার কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চিরকাল ইনামুল সাহেব নিজের এই অহংবোধ নিয়ে চলাফেরা করছে। নিজের চেয়ে ধন-সম্পদে নিচু কেউ যেন তার দু চোখের বি’ষ! লোকটা একবারও ভাবে না এসবের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াভহ। এতটাই যে দিনশেষে তাকেই জ্বালিয়ে দেবে, সব নিঃশেষ করে দেবে।
তখন পাশে কাউকে পাবে না। কথাগুলো মনে হতেই মুখ শক্ত করে উঠে দাঁড়াল। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। কয়েকটা কাপড় ব্যাগে ভরে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার উদ্দেশ্যে নিচে নেমে এল।

রিমু বেগম তখন রান্নাঘরে কিছু করছিলেন৷ তাই খেয়াল করেনি রোদ্দুর বেরিয়ে গেছে। ঘন্টাখানিক পর যখন রাতের খাবারের জন্য ডাকতে গেল, তখন কোথাও খুঁজে না পেয়ে এবং জামাকাপড় বিছানায় ছড়ানো দেখে বুঝলেন তার ছেলে সত্যিই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বিচলিত হয়ে সাথে সাথে ফোন লাগালেন। দুয়েক বার চেষ্টা করার পর রিসিভ হলো ফোন৷
— কী বলবে বলো!
ছেলের কথা শুনে রিমু বেগম বিস্মিত হয়ে শুধালেন,
— কী বলব মানে? এত রাতে কোথায় গিয়েছিস? খাবার নিয়ে বসে আছি…
রোদ্দুর উত্তরে শুধু বলল,
— তোমার স্বামী তার বাড়ি থেকে আমাকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। তাই বেরিয়ে এসেছি। আমার জন্য অপেক্ষা করো না।
ছেলের কথায় অভিমান আর ক্রোধ স্পষ্ট টের পেলেন রিমু বেগম। তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন। ইনামুল সাহেবের কথা যে রোদ্দুর এত সিরিয়াসলি নেবে তা তিনি ভাবেননি। ছেলেকে বুঝ দিতে লাগলেন,
— আরে ওসব তো রাগের মাথায় বলেছে। ধরিস না
ওই লোকের কথা। এ বাড়িতে আমরা সবাই থাকি, তাই তার একার সিদ্ধান্তে চলবে না সব…
রোদ্দুর রুষ্ট গলায় বলল,
— উফ মা! এটা তার বাড়ি, আমাকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তার অবশ্যই আছে। ভুল তো কিছু বলেনি।
রিমু বেগম কেঁদে ফেললেন। জোরালো গলায় ক্ষোভ ঝাড়তে লাগলেন,
— বেঁচে থাকতে এই দিন দেখতে হচ্ছে আমার? বাবা হয়ে কীভাবে পারল? ছি ছি। আমার ছেলেটা থাকবে কোথায়, খাবে কী? কিছু ভেবেছে এই লোক? স্বার্থপর কোথাকার!
— পৃথিবীতে তুমি-আমি সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজেদের নিতেই ভাবি। তাই কান্নাকাটি বন্ধ করো। তাছাড়া আমি বাচ্চা না যে হারিয়ে যাব।
— থাকবি কোথায় তুই, না না তুই এখনি বাড়িতে আয়। আমি কোথাও যেতে দেব না তোকে। তোর বাপের সাথে বোঝাপড়া আমি করে নেব…
— কিচ্ছু করতে হবে না তোমার। আমি বন্ধুদের ফ্ল্যাটে উঠব। তুমি বারবার এভাবে অনুরোধ করো না আমায়।পছন্দ হবে না।
রিমু বেগম বুঝলেন, ছেলের মাথা গরম। এ মুহূর্তে আটকানো সম্ভব নয়। তিনি শুধু এতটুকু বললেন,
— মুনার সাথে একবার কথা বলেছিস?
রোদ্দুর হালকা মাথা নাড়িয়ে বলল,
— না। তাছাড়া ওর সাথে আমার কথা বলার
কিছু নেই৷ সবকিছু সেদিনই চুকেবুকে গেছে।
রিমু বেগম অবাক হয়ে বললেন,
— কিন্তু তোরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসিস।
রোদ্দুর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— আমার কথা বাদ দাও। মুনতাহা যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসত, তাহলে এতদিন এত নাটক-সিনেমা তৈরি হতো না।
রিমু বেগম মৃদু দুঃখিত সুরে বললেন,
— সবকিছু কি তুই বুঝে ফেলেছিস? তাছাড়া তুই যে তোর বাবাকে বললি মুনাকে তুই বিয়ে করবি?
— রাগ হয়েছিল তখন তাই বলেছিলাম৷ কারণ বাবার কোনো অধিকার নেই কাউকে ছোট করে কথা বলার।
রিমু বেগম অবাক হয়ে শুনলেন ছেলের কথাগুলো।বুঝলেন মুনার উপর এখনো রেগে আছে তার ছেলে।
এই রাগ এত সহজে বোধহয় মিটবে না। রিমু বেগম আর কোনো কথা বললেন না, জানেন—রোদ্দুরকে বললে এখন ও কিছুই শুনবে না। তাই তিনি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ছেলেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। কিন্তু রোদ্দুর মাকে সরি বলে কল কেটে হাঁটতে শুরু করল। রাত গভীর হয়ে আসছে, রাস্তার দু’প্রান্তের বাতিগুলো একের পর এক জ্বলে উঠছে। কিন্তু রোদ্দুরের ভেতরের অন্ধকার যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। আচমকাই ওর মুনাকে ফোন করার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু অভিমান সে ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিলো না।
ও যদি আমাকে ভালোবাসত, তাহলে এভাবে আমাকে কষ্ট দিত না। মনে মনে বলে উঠল রোদ্দুর।

গন্তব্যহীনভাবে হেঁটে চলল সে। মাকে যদিও বলে এসেছে বন্ধুদের ওখানে উঠবে কিন্তু আসলে তা নয়। রোদ্দুর তার বন্ধুদের বলেই নি সে বাড়ি ছাড়ছে। ঝিম ধরা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে রোদ্দুরের মনে হল,
এ শহরে এখন তার আর কোনো জায়গা নেই। হাঁটতে
হাঁটতে রোদ্দুর চলে এলো পার্কের সামনে। এত রাতেও সেখানে সোডিয়াম আলো জ্বলছে। হলদে আভায় রাতের নিঃস্তব্ধতা যেন গান গাইছে। পার্কের সরু ফুটপাত আর বসার জায়গাগুলো গৃহহীনদের দখলে। সকলেই কাঁথামুড়ি দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে৷ ওদের দেখে রোদ্দুর ঠিক করল আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবে সে। তবে মশা-মাছির বহর দেখে রোদ্দুর মনে মনে ঢোক গিলল। সব মানিয়ে নিতে পারলেও এই দুই ক্ষুদ্র পোকার দলগুলোর সাথে লড়াই করা
ওর পক্ষে অসম্ভব!

একটা ভালো, পরিষ্কার আর তুলনামূলক মশা-মাছি কম দেখে একটা জায়গা বাছাই করে ব্যাকপ্যাকটা রেখে বসল রোদ্দুর। এরপর দেখল ওর থেকে কয়েক গজ দূরে আরো একটি লোক বসা। পরণে শার্ট-প্যান্ট। মুখ শুকনো। আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই কখন থেকে। দেখে ভালো ঘরের ছেলে বলেই মনে হলো রোদ্দুরের। এমন একটা মানুষ এত রাতে এখানে বসে আছে দেখে বিস্মিতই হলো সে। কিছু জিজ্ঞেস করবে মনে করেও করল না। ধারণা করল, লোকটার হয়তো মন ভালো নেই। তাই অন্যের ব্যাপারে না ঢুকে চুপচাপ সেও আকাশ দেখায় মনোযোগ দিল। খানিকটা সময় কেটে যেতেই ওপাশে বসা লোকটা বলল,
— আমাদের জীবনটা ভুলেই উপরই দাঁড়ানো। ভুল করতে করতেই টিকে আছি। ভুল করতে করতেই সঠিকটা শিখি। নিজের ভুল স্বীকার করে কেউ যদি শুধরে নিতে চায় তাহলেও মানুষ আমাদের ক্ষমা করতে চায় না, এটা কী ন্যায়ের কাজ? নিষ্ঠুর পৃথিবী!
রোদ্দুর গম্ভীর গলায় বলল,
— আপনার ভুলগুলো হয়তো তাকে একদম ভেতরে গিয়ে আঘাত করেছে।
— তবুও ক্ষমা তো চাইলাম।
— এত সহজে ক্ষমা পেয়ে গেলে পৃথিবীতে তো কষ্ট বলে কোনো বিষয় থাকতো না। সবদিকে ব্যালেন্স করে চলার চেষ্টা করুন মিষ্টার! যার ক্ষমা পেতে চান তাকে ভালোবাসুন, বোঝান তার গুরুত্ব আপনার কাছে কতটা, তাকে বোঝান সে ছাড়া আপনি শূন্য। তাহলে ক্ষমা নামক মহৎ জিনিসটা পেলেও পেতে পারেন।
লোকটার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। আধো-অন্ধকারে সেটা দেখে রোদ্দুর কাষ্ঠ হাসল। অন্যকে জ্ঞান দেওয়া খুব সহজ, নিজে মানা খুব কঠিন। লোকটা এবার তার নিজের হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— আপনার কথা শুনে মোটিভেট হলাম ব্রাদার। থ্যাংকস। আমি আহিল, আহিল রহমান।
রোদ্দুর হাত মিলিয়ে বলল,
— আমি রোদ্দুর।
আহিল লজ্জিত মুখে বলল,
— আসলে সে আমার স্ত্রী। রাগ করে চলে গেছে। অবশ্য এর পেছনে আমারই দোষটা বেশি…
রোদ্দুর মৃদু হেসে বলল,
— দোষ স্বীকার করে ভুল শুধরে নেওয়ার চেয়ে ভালোকিছু আছে বলে মনে করি না। বেস্ট অব লাক।
আহিল মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। এ সময় কারো সাপোর্ট খুব করে আশা করেছিল সে। রাইমাকে মানাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, তবে সে রাজি। কারণ বাবা বলেছে, সে যদি নিজের ভুল শুধরে ভালো মানুষ হয়ে ফিরে আসে তাহলেই বাবা তাকে মেনে নেবে। নয়তো এবার চিরকালের জন্য ত্যাজ্য হবে সে। কতবড় সাহস, পালিয়ে বিয়ে করে এখন আবার বউয়ের গায়ে হাত তুলে! কুলা’ঙ্গা’রের শেষ নেই!

.

ভোর তখনো নামেনি। হবে হবে ভাব! গাঢ় অন্ধকার লেপ্টে আছে চারিদিকে। রোদ্দুরের পকেটে ফোন বাজছে। সে ব্যাকপ্যাকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। মশা-মাছির ভ্যানভানানিতে এমনিতেই সে মহাবিরক্ত, তার উপর ফোনটা নির্লজ্জের মতো বেজেই যাচ্ছে। এতক্ষণ ফোনটা অফ ছিল, সময় দেখার জন্য খোলার পর থেকে এ অবস্থা!
রোদ্দুর ভাবল বন্ধুরা কেউ। কারণ রাতবিরেতে ফোন করাটা এদেরই কাজ। তাই স্ক্রিনে নাম না দেখেই কল রিসিভ করল! ধমকের সুরে বলল,
— প্রেমিকার সাথে লাইন মার না গিয়ে? আমায় জ্বালাচ্ছিস কেন? শরীরে বেশি কারেন্ট না শালারা? সামনে পেলে…
তখনি ওপাশ থেকে বলে উঠল,
— আমি মুনা।
রোদ্দুর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল,
— মাঝরাতে পরপুরুষের কাছে কী চাই? পরপুরুষ কিন্তু ভালো চরিত্রের নয়।
— খারাপ পুরুষ আপনি সেটা ভালোই জানি! আগে বলুন আপনি কোথায়? আন্টিকে নাকি বলেছেন বন্ধুদের বাসায় উঠবেন? কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছে ওখানে যাননি। ফোনও এতক্ষণ বন্ধ পাচ্ছিল, তাই চিন্তায় আছে…
রোদ্দুর দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— তাই দায়িত্বটাকে আপনাকে দিয়েছে?
— দিলো যে..
— কেন দিল? আপনি কে?
ঝাঁঝালো শোনাল রোদ্দুরের গলা। মুনা ব্যাকুল স্বরে বলল,
— আপনি কোথায় বলুন না…
— কেন? আসবেন নাকি? পরপুরুষের কাছে…
— আসব!
— কেন আসবেন?
— ভালোবাসি বলে।
রোদ্দুরের মনে হলো সে কিছু একটা ভুল শুনেছে। বিস্মিত হয়ে তাই আবারো প্রশ্ন করল,
— কী বললেন?
— আজকে কি বার?
রোদ্দুর চটে গেল,
— ফাজলামো হচ্ছে মাঝরাতে ফোন দিয়ে?
— বিয়ে করে নিলে তো এমন সুযোগ পাব না আর!
— করুন না বিয়ে, না করেছে কে?
মুনা ভার স্বরে বলল,
— রোদ্দুর সাহেব!
— চরিত্র’হীন লোকটা বললে বিয়ে ক্যান্সেল?
— একটু একটু!
রোদ্দুর যেন বিষম খেল,
— হঠাৎ এত পরিবর্তন? মুনতাহা আমি তোমাকে চিনতে পারছি না।
— আমিও না।
আচমকা হেসে ফেলল রোদ্দুর!
— সামথিং ইজ ভেরি সাস্পিশাস…
মুনা রেগে গেল,
— ওটা আপনার মন।

_______

চলবে…