প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-০২

0
5

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

রোদ্দুরের মুখে ‘আমার বউ’ ডাক শুনে মুনার মাথা ঘুরে উঠল। চোখে সব অন্ধকার দেখতে পেল। কটমট করে চাইল রোদ্দুরের দিকে। এই লোক কী জীবনেও শুধরাবে না? মুনা উঠে দাঁড়াল। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবে না। এই অভদ্র লোকের মাথায় সমস্যা। সামনে থাকলে আবারো কোনো বেঁফাস কথা বলে ফেলবে। তাই এখানে বসে থাকা ঠিক হবে না ভেবে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল মুনা।

চারদিক থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। রাস্তাঘাট সুনশান নীরব। কাকপক্ষীরা ছুটাছুটি করে নিজেদের নীড়ে ফিরছে।
মুনা ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় লক্ষ্য করল ওকে কেউ ফলো করছে। ও তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই কয়েক কদম দূরে রোদ্দুরকে দেখতে পেল। মুনাকে দাঁড়াতে দেখে রোদ্দুর নিজেও ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর এদিকওদিক তাকিয়ে এমন একটা ভাব করতে লাগল যেন কারো অপেক্ষায় আছে। মুনা ক্ষুদ্ধ হলো ওকে দেখে। লোকটা এভাবে আঠার মতো পেছনে
পড়ে আছে! কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ভেবেছিল আহিলের সাথে বিয়েটা হয়ে গেলে এই লোক ওর প্রতি আগ্রহ হারাবে, জ্বালানো বন্ধ করবে। কিন্তু কীসের কী? মুনা নিজেকে ধাতস্থ করে রোদ্দুরের দিকে এগিয়ে গেল। যথাসম্ভব ধৈর্য নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— আপনি এখানে কী করছেন?
রোদ্দুর ওর প্রশ্ন শুনে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। এরপর হালকা গলায় জবাব দিল,
— কিছু না।
— আমাকে ফলো করছেন?
— না তো।
মুনার তির্যক দৃষ্টি। গলা খানিকটা জোরালো হলো,
— তাহলে এখানে কী? আপনার বাড়ি তো এখানে নয়।
রোদ্দুর শক্ত মুখে জবাব দিল,
— আমার ইচ্ছে করেছে তাই এখানে এসেছি। এতে তোমার সমস্যা কী?
— আমার কোনো সমস্যা নেই।
বলে মুনা আর কথা বাড়াল না। রোদ্দুরের সাথে কথা বাড়ানোই বৃথা। আস্ত এক পাগল লোক। লজিকলেস সব কথাবার্তার জবাব সবসময় রেডি থাকে। মুনা পারবে না ওর সাথে এত কথা বলে। তাই ও চুপচাপ বাড়ির পথ ধরল। পেছনে ফিরে দেখলও না একবার রোদ্দুরকে। এমনিতেই আহিল আর রাইমার কান্ডটা বাড়িতে কীভাবে জানাবে সেই চিন্তা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

পরপর কয়েকবার বেল বাজাতেই মুনার ভাবি নিপা দরজা খুলল। মুনাকে দেখেই চিৎকার করল,
— এখন বাড়ি ফেরার সময় হলো তোর? কতদিন বলেছি আজানের আগে আগে বাড়ি ফিরবি?
মুনা জুতা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
— কাজ ছিল, তাই দেরি হয়ে গেছে।
নিপার রাগী কন্ঠস্বর,
— হয়েছে। আমাকে উল্টাপাল্টা বুঝ দিবি না। নিশ্চয় হেঁটে হেঁটে ফিরেছিস।
মুনা ব্যাগটা রেখে সোফায় বসল। নিপা একগ্লাস পানি এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— রিকশা করে আসলে সমস্যা কী? কয়টাকা খরচ হয় বল তো?
— উফ বাদ দাও তো!
— দিলাম। হাসপাতালে গিয়েছিলি?
— হুম।
— খালাম্মার কী খবর এখন?
— ভালো। কাল নাকি ডিসচার্জ করে দেবে।
নিপা শুকরিয়া আদায় করে মুনাকে বলল,
— গোসলটা সেরে আয়, ভালো লাগবে।
মুনা উঠতে উঠতে একবার জিজ্ঞেস করল,
— ভাইয়া ফিরেছে?
— না। কেন বলতো?
— কথা ছিল!
— ফিরলে বলিস।

.

রাত দশটা। খাবার টেবিলে বসে মুনা যখন আহিল
আর রাইমার বিয়ের খবরটা ওর বড়ভাই মঈনকে দিলো, প্রচন্ড রেগে গেল মঈন। সেইসাথে বোনের জন্য নিজের পছন্দ করা ছেলের এই রুপ তাকে করল ভীষণ মর্মাহত! সে ধৈর্য রাখতে পারল না কিছুতেই। রাতেই ফোন করল আহিলের বাবার কাছে। দিয়ে সব খুলে বলল। ছেলের বিয়ে সম্বন্ধে আহিলের বাবা-মাও কিছুই জানেন না। মঈনের কাছ থেকে এ খবর শুনে তারাও প্রচন্ড চটে গেলেন। সব মিলিয়ে একটা বিশাল ঝামেলা তৈরি হয়ে গেল। ভাইয়ের কথাবার্তা শুনে মুনা বুঝল এ কাহিনীর একটা এসপার-ওসপার না করে তিনি কিছুতেই থামবেন না। ও মনে মনে প্রমাদ গুণল।

.

আকাশ ভরা তারকা রাজি। থালার মতো গোলাকার চাঁদটা জোৎস্না ছড়াচ্ছে মলিন ভাবে। রোদ্দুর ছাদে বসে সিগারেট টানছে। সচরাচর ও সিগারেট নেয় না। তবে মন বিক্ষিপ্ত থাকলে একদিনে আট-দশটার বেশিও নিয়ে ফেলে। ইতোমধ্যে আটটা সিগারেট সাবাড় হয়ে গেছে। কারণ আজ ওর মন ভালো নেই। এর কারণ মুনা। এতদিন, এতভাবে বুঝানোর পরেও মেয়েটা যদি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় তাহলে কী কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক প্রেমিকের পক্ষে সম্ভব এসব মেনে নেয়া? রোদ্দুরও মানতে পারছে না। তার উপর মেয়েটার উদাসীন ব্যবহার। সবসময় অহংকারী ভাব। ভীষণ বিদঘুটে ব্যাপার। রোদ্দুর সিগারেটটা পিষে
ফেলে নতুন নাম্বার থেকে মুনাকে কল করে। কারণ আগের সবগুলো নাম্বারই মুনার ব্লকলিস্টে। রোদ্দুর জানে এই নাম্বারটাও কিছুক্ষণের মধ্যে মুনার ব্লকলিস্টে পড়ে যাবে, তবুও সে ফোন করল। ফোনটা রিসিভ হলো অনেকক্ষণ পর। রিনরিনে, মিষ্টি কন্ঠ শোনা গেল মুনার,
— আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
— ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি মুনতাহা আঞ্জুমানের প্রেমিক বলছি!
তৎক্ষনাৎ ফোনের ওপাশ থেকে বিক্ষুব্ধ কন্ঠটি ভেসে এলো,
— রোদ্দুর সাহেব!!
চিৎকার শুনে রোদ্দুরের মনে হলো ওর কানে তালা লেগে গেছে।
— আস্তেধীরে। গলার এত জোর ভালো নয়।
— রাখছি…
— খবরদার ফোন কাটবে না। ভালো
হবে না।
মুনা চেঁচিয়ে উঠল,
— হুমকি দিচ্ছেন কোন সাহসে? আমি আপনার খাই না পড়ি? আচ্ছা, আপনার কোনো পার্সোনালিটি নেই?
এত নির্লজ্জ লোক আমি জীবনে দেখিনি।
— তোমাকে ভালোবাসি।
রোদ্দুরের সরল স্বীকারোক্তিতে ফোনের ওপাশে মুনা কিছুক্ষণের জন্য থমকালো, ভড়কালো। তিনবছর যাবৎ পেছনে পড়ে থাকলেও রোদ্দুর কখনো এভাবে ওকে ভালোবাসি বলেনি। তাই ও আশ্চর্যই হয়েছে বলা যায়। রোদ্দুরের পুরুষালি কন্ঠস্বর আবারও ভেসে এলো,
— ভালোবাসি তোমাকে, শুনছ তুমি?
— অবান্তর সব কথা শুনতে চাইছি না।
নিজেকে প্রস্তুত করে মুনা সোজাসাপটা কথাটা বলে দিল। রোদ্দুর অবশ্য ওর কথা আমলে নিলো না। সূক্ষ্ম গলায় বলল,
— তুমি আমাকে ভালোবাসো মুনতাহা, সেটা নিজেও
জানো না।
— দুঃস্বপ্নেও না।
রোদ্দুরের কন্ঠ সঙ্কুচিত হয়ে এলো,
— তোমার কোনো দয়ামায়া নেই? এত নিষ্ঠুর কেন আমার প্রতি?
— কারণটা আপনি নিজেই।
রোদ্দুর গম্ভীর গলায় বলল,
— কী করেছি আমি তোমাকে?
পিনপতন নীরবতায় কাটলো কিছু মুহূর্ত। এরপর একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনা বলল,
— আমি আপনার বোনের হোম টিউটর। আমাকে কী সেই হিসেবে ট্রিট করা উচিৎ না আপনার? কিন্তু আপনি তা না করে আমার পিছনে আঠার মতো লেগে রইলেন, কেন? পটিয়ে নিজের প্রেমে ফেলবেন বলে। আমি ওখানে আমার দায়িত্ব পালন আর রুটি-রুজির জন্য গিয়েছি। প্রেম করতে নই।
আকাশে চাঁদ-তারা, জোৎস্না মিশে গিয়ে গিয়ে মেঘ জমিয়েছে। বাতাস বরফের ন্যায় ঠান্ডা। বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। নামুক, রোদ্দুরের মনের ভেতর যে আগুন জ্বলছে তা নেভাতে এখন শীতল বর্ষণই দরকার। ও শান্ত স্বরে বলল,
— আমি তো বাড়িতে তোমাকে কখনো কিছু বলিনি, তবে হ্যাঁ, আজ ভিন্ন। তোমার বিয়ের খবর শুনে মাথা ঠিক ছিল না। বাড়াবাড়িই করে ফেলেছি। সেজন্য সরি। কিন্তু রাহাকে পড়ানোর আগে থেকেই আমি তোমার প্রতি উইক হয়েছিলাম, সেটা তুমিও খুব ভালো করে জানো।
— দ্রুত এই উইকনেস কাটিয়ে উঠুন রোদ্দুর সাহেব।
— কাটবে না।
— টিউশনিটা তাহলে ছাড়তে হবে, আন্টির অনুরোধ রাখাটাও এবার সম্ভব হবে না।
— রোজ রোজ জ্বলার থেকে একেবারেই জ্বালিয়ে
ফেল, শান্তি পাব।
রোদ্দুর তীব্র গলায় কথাগুলো বলে নিজেই মুনাকে
ব্লক করে দিলো ফোন থেকে। অনেক হয়েছে, আর নয়। নিজের ব্যক্তিত্ব, অহংকার সব বিসর্জন দিয়েছে সে এই মেয়ের জন্য। এবার থামতে হবে। নিজের সীমা-পরিসীমা জানতে হবে।

.

এদিকে রোদ্দুরকে ব্লক দিতে গিয়ে নিজেকেই ব্লক
দেখে এই প্রথম মুনা ভীষণ আশ্চর্য হলো!

________
চলবে…