প্রেয়সী পর্ব-২২+২৩

0
288

#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ২২

৪৩.

—-” নাচের প্রোগ্রাম?”

আমার জোরেশোরে করা প্রশ্নটিতে স্যার সহ ক্লাসের বেশির ভাগ স্টুডেন্টেরই দৃষ্টি এসে ঠেকলো আমার ভোলা ভালা চেহারার উপর। আমি থতমত খেয়ে “উপস সরি” বলেই মুখ চেপে ধরলাম। স্যার পড়া থামিয়ে দিলেন। কতক্ষণ তিক্ত চোখে আমাকে দেখে আবারও নড়েচড়ে পড়াতে শুরু করলেন। রাই নিজের মাথা চেপে ধরলো বেঞ্চের উপর। এমন অস্বস্তিকর ঘটনার জন্য মূলত এই বেয়াদবই দায়ী। হঠাৎ নাচের প্রোগ্রাম হতে যাবে কেন ভার্সিটিতে? আমি বাম হাতটা তুলে চটাস করে বারি লাগিয়ে দিলাম রাইয়ের মাথায়। রাই মাথা উঠাতে গিয়েও উঠাতে পারলো না। কেননা না চাইতেও ওর মাথাটা খানিক ঝুঁকে গেলো সামনের দিকে। অবশেষে ভ্রু জুগল কুঁচকে নিয়েই রা/গী চোখে তাকালো আমার দিকে। আমার মুখের ভঙ্গিমা বিরক্ততায় সিক্ত। কেন? বুঝতে পারছিনা। এই অর্ধেক কথা বলা মানুষ গুলো আমার ভীষণ বিরক্তের। আর তারই মাঝে রাই একজন অন্যতম প্রানী।

—-” পুরো কথা বলবি নাকি আরেকটা গাট্টা খাবি?”

রাই ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালো। মাথায় হাত ডলে করুন গলায় বলল,

—-” স্যার বার বার তাকাচ্ছিলেন! দেখতে পাচ্ছিস না তুই?”

আমি আঁড়চোখে স্যারের দিকে তাকালাম। আসলেই এমন কিছু ছিলো নাকি?

—-” আর কিছু বলতে নিলেই সোজা ঘাড় ধরে ক্লাসের বাইরে ছুঁড়ে মা/র/তেন!”

—-” অহ এ-কাহিনী তবে! যাক-গে, এখন বল কিসের নাচের প্রোগ্রাম? ভার্সিটিতেও এসব হয় নাকি? জানা ছিলো না তো?”

—-” নাচের প্রোগ্রাম বলতে নবীন বরন অনুষ্ঠান!”

—-” কিইইই…”( উত্তেজনার বসে আবারও চেঁচিয়ে ওঠা আমার নিষ্পাপ গলা)

—-” হেই ইডিয়ট!! বোথ অফ ইউ… স্ট্যান্ডআপ?”

স্যারের বাজখাঁই গলায় আমার অন্তর-আত্মা অব্দি কেঁপে উঠলো। চমকে উঠে রাইয়ের হাত খামচে ধরতেই রাই, “ও-মা গো” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আমার কি দোষ? আমি তো স্রেফ নবীন বরন হওয়ার খুশিতেই চেঁচিয়ে উঠেছি। উনার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে উনার একমাত্র ছেলের হাতে মদের বোতল দেখে তো চেঁচাইনি! রাই কাঁপতে কাঁপতে আমাকে নিয়েই দাঁড়িয়ে গেলো। আমার দিকে একবার তাকিয়েই মেয়ের কেঁদে দেওয়ার উপক্রম হলো। আমি দাঁত কেলিয়ে একখানা হাসি দিয়ে স্যারের দিকে তাকালাম। চোখে মুখে এঁটে দিলাম সেরা অসহায়ের খেতাব।

—-” সরি স্যার!”

ছোট্ট বলা কথাটাতে স্যারের রাগে আরও ঘী-মসলা পরলো। গলার রগ ফুলিয়ে আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি,

—-” তোমরা দুজনে এক্ষনি বের হয়ে যাবে ক্লাসরুম থেকে। গেট আউট.. গেট আউউউট!”

আমি আবারও আঁতকে উঠলাম। সকাল বেলা এই লোক ঠিকই কচু ভর্তা দিয়ে গোল্লা গোল্লা ভাত খেয়ে এসেছে। অকারনেই ভীষণ চটছে। সামান্য কথাই তো বলেছি মশাই তাতে এতো চটে যাওয়ার কি হলো? হুহ্। আমি পাশ থেকে রাইকে খোঁচা মে/রে বের হয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলাম। স্কুল কলেজের টিচাররা হলে কতক্ষণ ঘ্যানোর ঘ্যানোর ঘ্যান করে আবারও ঠিক বসিয়ে দিতেন কিন্তু এরা কিছুতেই তা করবেননা। তাই কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বের হয়ে যাইয়াই উচিৎ কার্য।

ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছি। চারিপাশ একদম বেকায়দায় ফাঁকা। কেননা সব রুমেই ক্লাস চলছে। এই মুহুর্তে এ-পথ ধরে একা না যাওয়াটাই বেটার। যদিও আমার সাথে রাই আছে। মেয়েটা গুম
মে/রে আছে। কথা বলছেনা! স্যারের ধমক খেয়ে কোমায় চলে যায়নি তো আবার?

—-” কি-রে?? বাঁইচা আছিস না কোমায় ট্রান্সফার হয়েছিস?”

চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো রাই। নাহ্ সত্যি রে/গে আছে!

—-” স্যারের ধমক খেয়ে এখনও শকে আছিস?”

—-” তুই ওমন করে চেঁচালি কেন বলতো?”

—-” কেমন করে?”

—-” কেমন করে কি! ওমন করে! স্যার কি ভাবলো আমাদের বলতো? আর ক্লাসের প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট আমাদের কীভাবে দেখছিলো! দেখেছিস তুই?”

—-” রিলাক্স ইয়ার। স্যারের ক্লাসে আমার নিজেকে স্রেফ মগা মগা বলে ফিল হচ্ছিলো! প্রচুর বোরড হচ্ছিলাম তাই তো তোকে কাজে লাগিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসলাম!”

—-” হোয়াট! তাই বলে এভাবে?”

—-” এভাবে আর কি? ভাল্লাগছিলো না ব্যস বেরিয়ে এসেছি এই তো! এসে গেছি… চল আজ জমিয়ে উপন্যাসের বই পড়বো। দেখবো কে ক’টা শেষ করতে পারে!”

—-” আমার এখন মুড নেই!”

—-” চড়িয়ে তোমার মুড করে দিবো বেদ্দপ! আয় বলছি।”

রাইয়ের অনিচ্ছা স্বত্বেও ওকে মোটকথা টেনেটুনে নিয়ে এলাম ভেতরে। ভেতরে আসতে আমি মোটামুটি ধরনের চমকালাম। বাইরে থেকে ভেতরকার অবস্থা ভূতুড়ে পরিবেশের মতো সুনসান লাগলেও ভেতরে তো পুরো উল্টো কাহিনী। লাইব্রেরীর এপাশ থেকে ওপাশ অব্দি ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে একদম গিজগিজ করছে। এই সময় এতো স্টুডেন্ট থাকে? জানা ছিলো না তো!

বড় বুক সেল্ফটার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা দাঁতভাঙা উপন্যাস পড়বো কি-না ভাবছি! মাঝেমধ্যে এমন দাঁতভাঙা উপন্যাস পড়তেও বেশ মজাই আছে।

রাই হাতের ভাজে শরৎচন্দ্রের একটা উপন্যাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—-” তুই কোনটা পড়ছিস?”

আমি বইয়ের মাঝে হাত চালাতে চালাতে বললাম,

—-” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইন্টারেস্টিং টাইপ কোনো বইয়ের নাম জানিস তুই?”

রাই উগ্র কন্ঠে বলল,

—-” এতো এতো কবি, লেখক রেখে উনার ওমন শক্ত লেখার প্রতি তোর এতো আগ্রহ জন্মালো কেন?”

আমি বিরস মুখে তাকালাম বটে। তবে জবাব দিলাম না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একখানা জব্বর ধাঁচের বই পেতেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বসলাম। বইয়ের পাতা চটপট উল্টানোর মাঝে রাইও এসে বসল। ব্যস, এখন দিন দুনিয়ার সব খেয়াল রেখে কেবল বইয়েই মগ্ন হয়ে পড়বো। রেডি 1,2,থি…… মনোযোগে বিগ্ন ঘটিয়েই পার্সের মধ্যে ফোনটা করুন সুরে চাপা আর্তনাদ করতে লাগলো। রাই আঁড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

—-” কি হলো?”

আমি তিক্ত সুরে জবাব দিলাম,

—-” ফোনটার ক্ষিধে পেয়েছে! তাই কাঁদছে!”

রাই মুখ টিপে হেসে বলল,

—-” দেখ তোর বরের কল হয়তো?”

—-” হ্যাঁ, আমার জন্মগত বর!”

রাই আবারও হাসলো। শব্দ বিহীন হাসি! ফোনটা বের করতে করতে কল কেটে যাওয়ার লাস্ট স্টেজ এসে গেছে। তাই তাড়াহুড়োর উপর নাম্বারে চোখ রাখা হলো না। এটা লাইব্রেরী! এখানে একজনের গলার আওয়াজ অন্যজনের কানে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই গলার স্বর চেপেই বলে উঠলাম,

—-” হ্যালো, কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসলো জবাব,

—-” এক আজনাবি, হাছিনা ছে~~
ইউ মুলাকাত হো-গায়ি।
ফির কেয়া হুয়া, ইয়ে না পুছো~~
কুছ এছি বাত, হো গায়ি।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম গানের লাইন শুনে। অপরিচিতর গলা!

—-” আপনি!”(ফিসফিসিয়ে)

—-” হ্যাঁ আমি।”

উনি আমার থেকেও আরো ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন। আমি দাঁত চিবিয়ে বললাম,

—-” আপনি কেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছেন?”

উনিও আমার সহিত বলে উঠলেন,

—-” তুমি কেন এভাবে কথা বলছো?”

—-” আমি বলছি কারন আমার ইচ্ছে!”

—-” ওহ, তবে ধরে নাও এটা আমারও ইচ্ছে!”

আমি গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,

—-” কেন কল করেছেন?”

—-” ঐ যে আমার ইচ্ছে।”

আমি শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,

—-” তাই বুঝি? তাহলে আমিও কলটা কেটে দিয়ে আপনাকে ব্লক করে দিচ্ছি!”

উনি কেশে উঠে বললেন,

—-” আরে আরে তা কেন?”

—-” ঐ-যে আমার ইচ্ছে!”

—-” নো নো নো এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয় নীলু! তুমি এমন অমানবিক কাজ কিছুতেই করতে পারো না।”

—-” ওয়েট আ মিনিট! হু ইজ নীলু?”

হেসে উঠলো লোকটা। চাপা হাসি দিয়ে বলল,

—-” আই মিন নীলাদ্রিতা!”

—-” হোয়াট!”(চেঁচিয়ে)

রাই আমার হাত চেপে ধরলো। করুন চাহনি দিয়ে বলল,

—-” কি করছিস? চেঁচাচ্ছিস কেন? এখন কি এখান থেকেও বের হয়ে যেতে চাস??”

আমি চুপসে গেলাম রাইয়ের কথায়। কারন এখান থেকে তো আমরা বের হতে চাই না! সব দোষ এই অভদ্র লোকের। আমি গলার স্বর আবারও চেপে বললাম,

—-” হাউ ডেয়ার ইউ? আপনি আমাকে নীলু বলেন কোন সাহসে?”

—-” কেন? নীলাদ্রিতা কে শর্ট করে নীলু বলা টা কি অন্যায়?”

—-” অন্যায় মানে? এতো রীতিমতো ঘোর অন্যায়। মহাপাপ!”

—-” বাট নীলাদ্রিতা, আমার যে তোমার এতবড় নাম নিতে নিঃশ্বাস ভরে আসে!”

আমি রাগে ফুঁসে উঠে বললাম,

—-” নিঃশ্বাস ভরে আসলে নিঃশ্বাস আঁটকে ম/রে যান! তবুও আমার নাম শর্ট করে ডাকবেন না! বুঝেছেন?”

—-” বাট নীলু…”

আমি আরও ক্ষে/পে গেলাম! দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফাস গলায় বললাম,

—-” আপনাকে কিন্তু আমি জাতাঁকলে পি/ষে মে/রে ফেলবো বলে দিলাম! ডোন্ট কল মি নীলু!”

উনি মাতাল সুরে হেসে উঠলেন। কোমল কন্ঠে বললেন,

—-” এই নীলু… সরি সরি! নীলাদ্রিতা, তুমি জানো এই মুহুর্তে আমার কিরকম ফিল হচ্ছে?”

—-” আমার জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই! বেশি ফিল হলে বুড়িগঙ্গার পানি খেয়ে ম/রে যান আপনি!”

—-” বাট নীলু আমার যে বলতে ইচ্ছে করছে!”

—-” আবার নীলু!”

—-” তুমি যতক্ষণ আমার কথা না শুনবে ততক্ষণ আমি নীলুই বলবো হু!”

—-” ভারি ডিজগাস্টিং লোক তো আপনি!”

—-” এভাবে বলছো!”

—-” আচ্ছা বলুন আপনার বুড়িগঙ্গার পঁচা পানি খাওয়ার ফিলিংস!”

—-” হোয়াট?”

—-” বলবেন কি বলবেন না?আমি তবে কল কেটে… ”

—-” এই না না বলছি!”

—-” হু,ফাস্ট…”

—-” এতো তাড়া দিচ্ছো কেন বলোতো?”

—-” ভাগ্যিস ফোনটা আমার খুব সাধের। তাই এখনো ছুড়ে মা/র/ছি/না! অন্যথা…”

—-” নীলু, আর ইউ এংরি উইথ মি?”

—-” বেটা তরে তো আমি…”

—-” নিধি তোমরা এখানে? ক্লাস শেষ?”

কয়েক কদম দূর থেকেই ভেসে আসলো আরফান ভাইয়ের কন্ঠ। আমি ফেনটা কান থেকে নামাতে ভাইয়া ধীরগতিতে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। আমি কলের দিকে আর না তাকিয়েই লাইনটা কেটে দিলাম।

রাই হাসি মুখে জবাব দিলো,

—-” জ্বী ভাইয়া। ক্লাসে একটু বোরিং লাগছিলো তাই…”

—-” তা বেশ ভালোই করেছো? উপন্যাস পড়ছো?”

আমি মাথা দুললাম। মুখে হাসির রেখা টেনে বললাম,

—-” হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!”

আরফান ভাই অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

—-” আরে ইয়ার! সব বই রেখে অবশেষে উনি?”

রাই হাসতে হাসতে বলল,

—-” ইউনিক লোক ইউনিকই চুজ করে ভাইয়া!”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম রাইয়ের দিকে। দাঁত চিবিয়ে বললাম,

—-” অপমান করছিস?”

আরফান ভাই ফিক করে হেসে দিলেন। সাথে রাইও যোগ দিলো। হাসতে হাসতেই বলতে লাগলেন আরফান ভাই,

—-” না না নিধি! রাই কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। তোমার মাঝে সত্যি সবটাই ইউনিক। আর তুমি সত্যিই মা/রা/ত্ম/ক লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট।”

অপমান করছে না সুনাম করছে ব্যাপারটা ক্যাচ করতে সত্যিই ঘাম ছুটছে আমার। আমি জোরপূর্বক দাঁত কেলালাম। মাথা চুলকে বললাম,

—-” হঠাৎ আপনার এমন কথা কেন মনে হলো ভাইয়া?”

আরফান ভাই আবারও অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

—-” আরে কি বলছো তুমি? যেখানে এজ আ সিনিয়র স্টুডেন্ট যারা নিজেরাই নিজেদের এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন করতে হিমশিম খেয়ে যায় সেখানে তুমি কতটা ইজিলি সবটা করে ফেললে। যদিও কয়েকদিন সময় লেগেছে তবে সময়টা কিন্তু তোমার অন্য কাজে ব্যয় হয়েছে নট ফর এসাইনমেন্ট। এম আই রাইট?”

আমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। কি থেকে যে কি হলো আমি নিজেই তো ঠিক করে বুঝতে পারিনি!

—-” হেহে হ্যাঁ হ্যাঁ!”

রাই আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—-” আসলেই?”

আরফান ভাই বললেন,

—-” আম ইমপ্রেসড নিধি!”

—-” থ্যাংক্যু ভাইয়া।”

—-” ফর এসাইনমেন্ট আমি তোমাকে ছোট্ট একটা ট্রিট দিতে চাই নিধি! তুমি কি আসবে আমার সাথে?”

আমি উনার কথায় হোঁচট খেলাম। এবার মনে হচ্ছে একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।

—-” আর তাছাড়া তোমার কিন্তু কথা ছিলো আমাকে রেঁধে খাওয়ানোর? মনে আছে তো?”

আরফান ভাই আবারও বলে উঠলেন। আমি রাইয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই রাই বলে উঠলো,

—-” আপনি তো ভারি সেলফিশ মানুষ ভাইয়া। আমার সামনে থেকে আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রিট দিচ্ছেন, অথচ আমায় একবারও বলছেন না?”

আরফান ভাই ছোট্ট করে হাসলেন। লজ্জিত কন্ঠে বললেন,

—-” ভেরি সরি রাই। চলো তোমার ফ্রেন্ডের সাথে আজ তোমাকেও ট্রিট দিবো।”

এই হলো বেস্ট ফ্রেন্ড। যেখানে উদ্ধার করতে গিয়ে বাঁশ-ই বেশি দিতে প্রস্তুত। কোথায় ভাবলাম মগারাম এই যাওয়া থেকে আমায় কোনো মতে আঁটকে দিবে তা-না উল্টো আরও ফাঁসিয়ে দিলো। এই কান্ড যদি রাহিয়ান ভাইয়া কোনো মতেও জানতে পারে তো জানিনা ঠিক কি কি হবে! সেদিন গার্ডেনে উনার সাথে কথা বলার সময় মনে নেই কিভাবে টানতে টানতে আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন? আর তারপর!! উফফ! আর ভাবা যাচ্ছে না! কি করে আঁটকাই এই বিপদ?

—-” বলছিলাম কি ভাইয়া…”

—-” তুই আর কোনো কথা বলিস না! চলতো চল?”

কথার মাঝখানে বা-হাত ঢুকিয়ে দিয়েই কথা থামিয়ে দিলো রাই। আরফান ভাইও আমোদিত গলায় বলে উঠলো,

—” ‘Popular Foods’ এ যাবে? বেশ নাম করা এবং খুব ভালো সার্ভিস দেয় ওরা!”

রাই আমোদে লাফিয়ে উঠে বলল,

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন!”

৪৪.

রেস্টুরেন্টের থাই ঠেলে ভেতরে পা রাখার আগেই শূন্যে ভেসে উঠলাম আমি। ভয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠতেই আবারও পায়ের নীচে যেন জমিন খুঁজে পেলাম! ভ/য়/টা আরও কিছুটা জাঁতা দিয়ে ধরলো। ভ/য়ে/র দরুন বন্ধ করা চোখ দুটো পিটপিট করে খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলাম। না, আমার সামনে তো কোনো ভূত নয়! তবে ভূতের চেয়েও কম নয়! স্বয়ং রাহিয়ান রাফিদ। ঠিকই মাঠে গোল দেওয়ার পূর্বে হাজির হয়ে গেলেন। কি টাইমিং ইয়ার! এই পা রাখতে যাচ্ছিলাম আর উনি এই এসে হাজিরও হয়ে গেলেন। পেছন থেকে আরফান ভাইয়ার কিছুটা ভ/য়মিশ্রিত আওয়াজ পাওয়া গেলো,

—-” দোস্ত? তুই না বাসায় ফিরে গেলি?”

রাহিয়ান ভাইয়ার কোনো জবাব নেই। উনি লাল চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আর আমার অসহায় হাতটা তার হাতের ভাজে বন্ধি! চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

রাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে রাহিয়ান ভাইয়ার উদ্দেশ্য আমতাআমতা করে বলল,

—-” রাফিদ ভাইয়া, আপনিও আমাদের সাথে জয়েন করুন না? আমাদের খুব ভালো লাগবে! আরফান ভাই বলুন না আপনি?”

আরফান ভাই গলা খাঁকারি দিলেন। বার কয়েক ঢোকও গিললেন। অতঃপর আমতাআমতা করে বললেন,

—-” হ্যাঁ রে রাফিদ। তুইও জয়েন কর আমাদের সাথে।”

—-” আমি বা নিধি কেউই তোদের সাথে জয়েন করছিনা আবির।”

গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে উঠলো৷ মস্তিষ্ক শীতল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই।

—-” বাড়িতে কেউ নেই। আমাদের সবাইকে রিম্মির শশুর-শাশুড়ী ইনভাইট করেছেন তাদের বাড়িতে। তাই সবাই আগে মেঝ-মনির বাড়িতে গিয়েছে। ওখান থেকেই রেডি হয়ে সেখানে সবাই একসাথে যাবো। আমাদেরও তাই মেঝ-মনির বাড়িতে যেতে বলেছে মা। কারন বাকিরা আমাদের জন্য ওখানেই ওয়েট করবে। বেশি লেট যেন না হয় তাও বলে দিয়েছে। তাই নিধি আর আমি সেখানেই যাচ্ছি। তোরা ইনজয় কর। পারলে রূপ আর বাকি সবাইকেও ডেকে নিস।”

একটুকু বলেই আমার হাত ধরে হাঁটা ধরলেন রাহিয়ান ভাইয়া। আমার মনের মধ্যে কাল বৈশাখী ঝড় উঠেছে। না জানি সামনে কি শনি নাচছে আমার ফুটা কপালে।

#চলবে_______________

#প্রেয়সী ♥️🥀 (২৩)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

—-” গাড়িতে উঠো!”

আমার মনের মধ্যে হয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝ/ড় থেমে এখন দমকা হাওয়া দিচ্ছে। মনেমনে একগাদা রা/গ পুষলেও উনি মুখের ভঙ্গিমা এতো শান্ত রাখছেন কি করে?

—-” কি হলো? গাড়িতে উঠতে বললাম তো?”

আমায় খাম্বার ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ধমকে উঠলেন উনি। একেই তো ভ/য়ে অবস্থা যায় যায় আমার। তার-উপর ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলার উপক্রম। আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,

—-” আমি বাড়িতে যাবো না!”

কপাল কুঁচকে তাকালেন উনি। ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় বললেন,

—-” আমরা বাড়িতে যাচ্ছি না। রিম্মিদের বাড়িতে যাচ্ছি আর সেখান থেকে আসিফ ভাইয়ের বাসায়।”

—-” আমি আপ… আপনার সাথে কোথাও যাবোনা! আমাকে ছেড়ে দিন। আ..আমি রিক্সা নিয়ে নিচ্ছি। রিক্সায় করেই চলে…”

আমার কথার মাঝপথেই উনি ধাম করে এক বারি বসালেন গাড়ির উপর। উনার চোখ জোড়া থেকে
আ/গু/নের ফুলকি ঝড়ছে এবার। আমি আঁতকে উঠেই লেপ্টে গেলাম গাড়ির সাথে। ভ/য়ে কাঁপতে কাঁপতে কতক্ষণ চোখ আড়াল করছি তো কতক্ষণ মুখ। উনি একই ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি উপায়ন্তর না দেখে কোনো মতে টেনেটুনে গাড়ির দরজার খুলে বসে পড়লাম ভেতরে। বেঁচে থাকলে আবার কখনো রিক্সায় চড়া যাবে নিধি! মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিতে দিতেই গাড়ির দরজাটা খুব সাবধানতার সহিত লাগাতে নিলাম। কিন্তু শেষ অব্দি আর তা হলো। হলো কি? কি আর হবে___যা হওয়ার তাই হলো। উনি হাত দিয়ে গাড়ির দরজাটা কিছুক্ষণ আঁটকে ধরে আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বের করে আনলেন। অতঃপর, আমি আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক সেই জায়গাতেই দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি ভ/য়া/র্ত দৃষ্টিতে উনার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আছি। চড়-থাপ্পড় লাগাবেন নাকি? যেভাবে রে/গে আছেন লাগাতেই বা কতক্ষণ?

—-” আমার সাথে গাড়িতে যেতে প্রবলেম তো? যেতে হবেনা আমার সাথে। এক্ষনি আমার সামনে থেকে চলে যাও। আমার সাথে যেতে হবেনা তোমায়। তুমি বরং আরফানের সাথে যাও। হ্যাঁ যাও যাও? গো?(চিল্লিয়ে)”

আমি আঁতকে উঠে মাথা নীচু করেই রইলাম। তার চোখের দিকে তাকানোর দুঃসাহস আপাতত আমার নেই।

—-” আমি বারন করা স্বত্বেও তোমার আরফানের সাথে এতো কিসের কথা? ওর সাথে নাচতে নাচতে খেতে চলে যাচ্ছো? বাহ্ ওয়ান্ডারফুল। ওর সাথে তোমার খেতে যেতে খুব ভালো লাগে তাই না? খুব শখ ওর সাথে খেতে যাওয়ার? আবার ওকে রেঁধেও খাওয়াতে ইচ্ছে হয় তোমার? বাহ্ গ্রেট! আচ্ছা আর কি কি ইচ্ছে করে ওর সাথে? বলো… বলো? আচ্ছা কেন বলোতো? কেন ওকে তোমার রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করে ? কেন ওর থেকে ট্রিট নিতে ইচ্ছে করে? কেন ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলতে ইচ্ছে করে? কেন? বলো কেন?”

মাত্রাতিরিক্ত রা/গে/র দরুন উনার শরীরে মৃদু কম্পন দিচ্ছে। আমি তো এটাই ভেবে পাচ্ছি না আরফান ভাইয়া তো উনারই বেস্ট ফ্রেন্ড। তবে উনার সাথে কথা বললেই বা কি? তাতে করে উনি এভাবে কেন রে/গে যাচ্ছেন? আর উনি যা ভাবছেন এমন তো কিছুই না!

—-” কি হলো চুপ করে আছো কেন? স্পিক আউট?”(চেঁচিয়ে)

আমি আবারও আঁতকে উঠলাম। নিজের ওড়নার আঁচল দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে মনের মধ্যে সাহস জোগালাম। উনার অকারণে আমাকে এভাবে বকাঝকা করা আমি মোটেই সহ্য করবোনা। বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে উনার চোখে চোখ রাখলাম। গলায় বেশ জোর দিয়ে বলে উঠলাম,

—-” আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না। কারন আপনি যা ভাবছেন….”

কেবল উনিই ভাবলেন! আমাকে ভেবে আর কিছুই বলার সুযোগ দিলেননা। আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে আমাকে নিজের মুখোমুখি করে নিলেন চোখের পলকে। আমি ভীত মনে দোয়া দরূদ পড়তে পড়তেই চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম। উনার তপ্ত শ্বাসে আমার বুক ভারী হয়ে আসছে। মুখের উপর উনার র/ক্তি/ম চোখের চাহনি কিছুক্ষণ বিরাজমান হতেই আবারও ছেড়ে দিলেন আমায়। হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ায় নিজের ভার সামলাতে পারলাম না। পেছন দিক থেকেই গাড়িতে বারি খেয়ে হেলতে দুলতে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু সে দাড়ানোও সুখকর হলো না। উনি এবার আমাকে গাড়ির সাথে চেপে ধরলেন। চোখের মাঝে আ/গু/নে/র লাভা ফুটিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন,

—-” নেক্সট টাইম যেকোনো ছেলের থেকে মিনিমাম একশ-হাত দূরত্ব বজায় রাখবে। (আমি অবাক চোখে তাকাতেই) মিনিমাম একশ-হাত। অন্যথা এর ফল খুব একটা ভালো হবে না।”

উনার ছোটখাটো হু/ম/কির বিরুদ্ধে আমার ধড়ফড় করতে থাকা অসহায় মনটা একদমই চুপসে রইলো। কোথায় যেন পড়েছিলাম রা/গের বিপরীতে কখনো রা/গ দেখাতে নেই। তাহলে তার ফল তেমন সুখকর হয় না। তাই আমিও চুপসে রইলাম। অন্যথা আমিও দেখাতাম নিধি কি জিনিস? আমাকে হুকুম করা হচ্ছে? বলে কি না যেকোনো ছেলের থেকে একশ-হাত দূরত্ব বজায় রাখতে? অসম্ভব! দরকার হলে আমার আগে-পিছে একশ টা ছেলে নিয়ে ঘুরবো। আর তারপর? তারপর, আমিও দেখবো উনি কি করে?

৪৫.

মেঝ-খালামনির বাসাটা বড়-খালামনির বাসার মতো আহামরি কতখানি বড় নয়। বলা যায় প্রয়োজন মাফিক বাড়ির আয়তন। বাইরে থেকে বাড়ির রঙটা আকাশি। দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে। বাড়ির চারপাশটাও বেশ উপভোগ্য। একপাশে গার্ডেন অন্যপাশে সুইমিং পুল। অনেকটা বড়-খালামনির বাড়ির সামনের ক্যাটাগরি টাইপ। আমাদের গাড়ি বাড়ির গেট অব্দি আসলো। আর ভেতরে ঢুকতে পারলো না। রাহিয়ান ভাইয়া দুই-বার হর্ন বাজাতে তাদের বাড়ির ন্যায় দারোয়ান চাচা দৌড়ে এলেননা। তাই কিছুক্ষন গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে থেকে অবশেষে আমাকে নামতে বলে নিজেও নেমে এলেন। আমরা গেট দিয়ে ঢুকতেই আধপাকা চুলের অধিকারী এক লোক এসে সামনে দাঁড়ালো। উনাকে দেখতে বেশ বোঝা যাচ্ছে চরম অলস প্রকৃতির মানুষ। মুখে একগাদা পান ঠেসে ডান-হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের মাথায় চুন নিয়ে মুখের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে এগিয়ে এলেন। উনার এই দায়সারা ভাবে রাহিয়ান ভাইয়ার নিশ্চয়ই ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কিন্তু আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এই মানুষটার মতো আজব কায়দার লোক এই প্রথম দেখলাম আমি। রাহিয়ান ভাইয়া দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,

—-” গেট ছাড়া তোমাকে সব জায়গাতেই দেখা যায়। মেঝ আঙ্কেলকে এবার তোমার নামে নালিশ ঠুকতেই হবে রিপন ভাই।”

লোকটা লালচে হাসি দিলো। রাহিয়ান ভাইয়ার কথায় তার ভ্রুক্ষেপ হলো না কভু। উনার দৃষ্টি রাহিয়ান ভাইয়াকে ছাড়িয়ে এবার আমার দিকে। পান চিবোতে চিবোতে ঠোঁট দু’খানা উঁচু করে ফেললেন পানের পিক গড়িয়ে পড়ার ভয়ে। ঠোঁট উঁচিয়েই প্রশ্ন ছুড়লেন,

—-” এই শ্যামাবতি আফা কিডা ভাইজান?”

আমি সরু চোখে তাকালাম। কিছু বলবো তার আগেই তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলেন রাহিয়ান ভাইয়া,

—-” নিধি। ছোটমনির মেয়ে।”

লোকটা কি বুঝলো তা আর পর্যবেক্ষণ করা হলো না। তার আগেই আমার হাত ধরে হাঁটা ধরলেন রাহিয়ান ভাইয়া। আমি হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিলাম নিজেকে। বুঝিনা বাপু, উনি আমার সাথে এমন বিহেভ কেন করছেন? আমাকে দেখে কি উনার দুই বছরের বাচ্চা মনে হয়?

—-” শ্যামবতী আফা, আফনে কিন্তু একছেরই সুন্দার!”

পেছন থেকে দারোয়ানের বোকাসোকা স্বরে ভেসে আসলো কথাটা। আমি পেছনে তাকানোর আর সুযোগ পেলাম না। রাহিয়ান ভাইয়ার টানাটানিতে অবশেষে এসে হাজির হলাম বাসার ভেতরে। ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমের দিকে নজরে পড়লো ফাহিম ভাইয়াকে। মনে মনে প্রশান্তির বাতাস বইলো। যাক, এবার অন্তত মুক্তি মিলবে এই হুতুমপেঁচার থেকে। মনে মনে তো কেবল একটা কথাই লাফালাফি করে ম/রে যাচ্ছে, ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’।

রাহিয়ান ভাইয়ার হাতের বাঁধন হালকা হতেই এক দৌড়ে এসে হাজির হলাম ফাহিম ভাইয়ার কাছে। ফাহিম ভাইয়া আমাকে দেখতেই খুশিতে ছোট্ট করে দু’খানা লুঙ্গি ডান্স মা/র/লো। সাথে আমিও একটি কোমর দুলালাম। ভাইয়া হাসতে হাসতে আগলে ধরলো আমায়। ফাহিম ভাইটা না বেশ মিশুক। আমার একটা নিজের ভাই থাকলে হয়তো ওর মতোই হতো। মনে মনে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ার পেটে খোঁচা দিয়ে বললাম,

—-” ভাইয়া, আস্তে চেঁচাও। তোমাদের হুতুমপেঁচা ঐ মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে।”

ভাইয়া আমার সতর্ক দৃষ্টি অনুসরণ করে মেইন গেটের দিকে তাকাতেই আঁকতে উঠে আমায় নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। অতঃপর ফিক করে হেসে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—-” আমাদের হুতুমপেঁচা এভাবে রে/গে আছে কেন?”

—-” কেন আবার? দেখো না হুতুমপেঁচা গুলো অলওয়েজ কিভাবে গাল ফুলিয়ে, নাক ফুলিয়ে রে/গে থাকে? অকারনেই,হুদ্দাই। ও তুমি ছাড়ো তো। এই বউমনি আর রিম্মি আপু কোথায়?”

ফাহিম ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল,

—-” উপরে রেডি হচ্ছে। দেখ আমি কিন্তু রেডি। এখন শুধু তোরাই বাদ পরে গেলি। জলদি যা আর চট করে রেডি হয়ে নীচে চলে আয়। অলরেডি অনেক লেট।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। উপরের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে বললাম,

—-” তোমায় কিন্তু ভীষণ কিউট লিউট লাগছে ভাইয়া।”

ফাহিম ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মাথার চুল গুলোর মাঝে হাত চালিয়ে বলল,

—-” থ্যাংক্যু বনু।”

সিঁড়ি ভে/ঙে উপরে উঠে এলাম। দুই দিকে দু’টো দু’টো করে মোট চারটি রুম। এপাশ যাবো না ওপাশ যাবো ভাবতে ভাবতেই ডান পাশের রুম থেকে রিম্মি আপুর গলা ভেসে আসলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই রিম্মি আপুর দেখা মিলল। আমায় হাত ইশারা করে ডাকতে আমিও মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। রুমের ভেতর ঢুকতেই দেখি এলাহী কান্ড। বিছানা,ওয়ারড্রব, ড্রেসিং টেবিল সবই শাড়িতে মুড়িয়ে আছে। আমি অবাক কন্ঠে বউমনির উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়লাম,

—-” একি কান্ড? রিম্মি আপু কি আজ শাড়ি পড়ে হবু শশুড়বাড়ি যাবে?”

বউমনি হেসে উঠে বলল,

—-” শুধু কি তাই? সে আজ তোমাকেও শাড়ি পড়িয়ে নিবে।”

আমার মাথায় আসমান ভে/ঙে পড়লো। শাড়ি আর আমি? অসম্ভব! আমি আতংকিত চোখে রিম্মি আপুর দিকে তাকাতেই দাঁত কেলানো হাসি দিলো রিম্মি আপু। আমি না সূচক মাথা নেড়ে বউমনির দিকে অসহায় চোখে তাকালাম। বউমনি হয়তো বুঝলো আমার ক/ষ্ট কিন্তু কিছু করতে পারল না। নিজের দিকে ইশারা করে বলল,

—-” কিছু করার নেই সোনা আমাকেও ওর পছন্দ মতোই শাড়ি পড়তে হয়েছে।”

রিম্মি আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো। কুঁচি ধরে হেলতে দুলতে আমার সামনে এসে বলল,

—-” দেখ নিধু, শাড়ি কিন্তু আমিও পড়তে পারিনা। কিন্তু শশুড়বাড়ি বলে কথা! সম্মানের খাতিরেই আজ স্ব-ইচ্ছায় অসম্মানিত হতে যাচ্ছি। আমার নিজেরই ভীষণ নার্ভাস লাগছে নিধু। তাই তো নিজের মনের শান্তনা বাড়ানোর জন্য তোকে আর বউমনিকেও সেম ড্রেস, আইমিন শাড়ি পড়াচ্ছি। না করিসনা নিধু! প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

আমি গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। রিম্মি আপুকে ওভারটেক করে বউমনির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।পূনরায় গাল ফুলিয়ে বললাম,

—-” দিস ইজ নট ডান বউমনি। দেখো, আপু যেভাবে শাড়ি সামলে দাঁড়িয়ে আছে আমি তো তার এই-টুকুও পারবো না! শুধু খুলবে আর খুলবে। তখন দেখবে তোমাদের মান-সম্মান বাড়ার বদলে উল্টে ডাউন হয়ে যাবে। প্লিজ আপু? আচ্ছা আমি না হয় কূর্তি পড়ে নিচ্ছি?(রিম্মি আপু তাকাতেই) হবেনা? তবে কি চূরিদার?”

—-” নো! নাথিং এলস নিধি। অনলি শাড়ি বেবি।”

আমি ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকালাম। বউমনি উঠে আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

—-” নো টেনশন কিউটি। বউমনি আছে না? বউমনি থাকতে আবার এতো ভাবতে হয় নাকি?”

—-” যদি সবার সামনে বসে খুলে যায়?”

আমার বোকা টাইপ কথায় হেসে ফেললো বউমনি। রিম্মি আপুও হাসতে লাগলো কয়েক সেকেন্ডের ব্যাতিরেকে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। রিম্মি আপুর সম্মান বলে কথা। তাই নিজের ইজ্জত হাতে নিয়েই আপুর ইজ্জত ধরে রাখছি।

ঘন্টাখানিক লাগিয়ে শাড়ির বারোটা বাজিয়ে অবশেষে কমপ্লিট করে পড়তে পারলাম। দুঃখিত! আমার সাথে পাল্লা দিয়ে বউমনি পড়াতে পারলো। শাড়ীর রঙখানা বেশ চোখা। যে কারোরই চোখে খুব ইজিলি ধরা পড়বে। একবার মনে হচ্ছে রঙটা গাঢ় লাল। আবার মনে হচ্ছে লাল নয়। লালের মতো। ধুর এতো কে বাছাই করতে যাবে লাল কি লাল নয়?

আমি ভারী শাড়ি সামলাতে হিমশিম খেতে পারি ভেবেই বউমনি সিল্কের মধ্যে এই সফ্ট শাড়িটাই উঠিয়ে আনলো। হাতে ধরতে বেশ আরাম দায়ক কিন্তু বিপত্তি হলো শরীরে পেঁচিয়ে। বারবার মনে হচ্ছে শাড়ির কুঁচি খুলে পড়েছে আবার বারবার মনে হচ্ছে শাড়ির আঁচল খুলে এসেছে। সত্যি বলছি, এমন যদি কিছু হয় তাহলে আমি সবার সামনেই কেঁদে ভাসিয়ে ফেলবো। আমার এমন ধারা কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল আমার দুই এনিমি। মানে বউমনি আর আপু। শাড়ি পড়া কমপ্লিট হতেই সুন্দর করে পোজ দিচ্ছিলাম আয়নার সামনে। হঠাৎ পেছন থেকে হাই হিল নিয়ে দাঁড়ালো রিম্মি আপু। চোখ টিপে বলল,

—-” আমার খাতিরে লাস্ট কোরবান নিধু।”

এবার আমার কেঁদে ফেলার উপক্রম। একেতো শাড়ি তারউপর হাই-হিল। এরা কি আমার প্রেস্টিজটা একেবারে ধুয়েমুছে দিতে চাচ্ছে? এবারও কেঁদেকেটে আখেরে লাভ কিছু হলো না! সেই আপুর ইজ্জতের দোহাই দিয়েই ঠিকই পড়ালো। এর পরিনতি শেষ অব্দি ঠিক কতটা সুখকর হবে আমারও জানা নেই।

বউমনিকে বাহন করে আস্তেধীরে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলাম। আমাদের নীচে নামতে দেখেই হাহুতাশ করতে করতে এগিয়ে এলো ফাহিম ভাইয়া। মেয়েদের সাজতে অলওয়েজ কেন এতো লেট হতে হবে তাই তার লাখ টাকার প্রশ্ন। ভাইয়াকে কেউই বিশেষ পাত্তা দিলো না। রিম্মি আপু মুখে ভেংচি কেটে হাঁটা ধরলো। বউমনি আর আমি দাঁড়িয়ে থেকে হাসতে লাগলাম। ফাহিম ভাই আপুকে ছেড়ে আমার সামনে আসতেই আমার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো কারোর মোহনীয় চোখের প্রতি। হুতুমপেঁচা মানে রাহিয়ান ভাইয়া, বোধকরি ফাহিম ভাইয়ার পাশেই বসেছিলেন। আমার চোখে উনার চোখ আটকাতেই দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। আমার পা থেকে মাথা অব্ধি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। পলকহীন চাহনি। উনার ডার্ক রেড ঠোঁট দু’খানায় স্নিগ্ধ কোমল মন ভুলানো হাসি। উনি হাসছেন না তবে কোনো এক তৃপ্তিতে উনার ঠোঁট দু’খানা হাসির ছলে ক্রমশই প্রসারিত হচ্ছে। উনার মাথার উপর গ্যাঁটগ্যাঁট শব্দ করে ফ্যানের পাখা ঘুরছে। আর সেই পাখার বাতাসেই উনার বাধ্যবাধকতার নাম করে বুঝিয়ে রাখা চুল গুলো অবাধ্যের মতো উড়ছে। কোনো দাগ বিহীন সাদা শার্টটা আঁকড়ে পড়ে আছে উনার শরীরে। মনোমুগ্ধকর!

—-” এই পিচ্চি! কোন ধ্যানে আছিস বলতো?”

ফাহিম ভাইয়ার মৃদুস্বরে চেঁচানো কথাটিতে চমকে উঠলাম আমি। চোখ দুটো গোলাকার বৃত্ত করে ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো।

—-” হ..হ্যাঁ বলো?”

ফাহিম ভাইয়া আবারও সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,

—-” ভাবছিস কিছু?”

আমি তুমুল গতিতে মাথা নাড়লাম। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,

—-” ক..কি যেনো বলছিলে??”

—-” বললাম যে তুইও রিম্মির পাল্লায় পরে শাড়ি পড়লি?”

আমি করুন চোখে তাকালাম। একমাত্র দুঃখ বুঝলে আমার ভাইটাই বুঝতো। ভাইয়াকে আগে ডেকে নিলেই হতো। এতো ক/ষ্ট করে আর শাড়ি পড়ে টেনশন নিয়ে ঘুরতে হতো না।

—-” তুমি উপরে থাকলে আপু হয়তো তোমাকেও শাড়ি পড়িয়ে দিতো ভাইয়া। আর বলিও না দুঃখের কথা!”

ফাহিম ভাইয়া শাড়ি পড়ার কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো যেন। আমতাআমতা করে মাথা চুলকে কিছু বলতে নিলেই বউমনি হেসে উঠে বললো,

—-” আর কারোর শাড়ি পড়তে হবেনা। চলো এবার, আর বেশিক্ষণ থাকলে যে লেট হয়ে যাবে!”

ফাহিম ভাইয়া বউমনির সুর টেনে হেসে উঠলো। আমার মাথায় ছোট্ট করে একটা গাট্টা মে/রে বলল,

—-” ফাজিল। চল এবার। ভাইয়া? এসো?”

—-” হ্যাঁ চলো চলো। রাহিয়ান এসো ভাই?”

আমার হাত ধরেই হেঁটে চলল বউমনি। সবার ডাক পেয়ে রাহিয়ান ভাইয়াও নড়েচড়ে উঠলেন। আবারও কিছুক্ষণ আমাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেও হেঁটে আসলেন আমাদের পেছনে পেছনে।

#চলবে_______________