প্রেয়সী পর্ব-৩৬+৩৭

0
241

#প্রেয়সী ♥️(৩৬)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৭০.

হুট করে মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে কাউকে কিছু না জানিয়ে ব্যাপারটা প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছেই যেমন অ*প*মা*নের তেমন ক*ষ্টে*র! রাইয়ের ক্ষেত্রেও বিপরীত কিছু ঘটেনি! একটা ছেলে বিয়ের জন্য জো*র করল বলে তাকেও যে ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করে ফেলতে হবে সেই শিক্ষা তো রাই কোনো কালেই পায়নি! তাহলে এমন কাজ সে কি করে করতে পারল? এখানে তো কোনো নাটক সিনেমা হচ্ছে না যে হিরো হিরোইন কে জো*র করলো আর হিরোইনও ভ*য়ে ভ*ড়কে গিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হলো!

বিয়ের পর কিছুদিন ঝ*গ*ড়া*ঝা*টি হবে, আর তারপর তারা হবে সেরা কাপল! এমনটা শুধু টিভির পর্দাতেই মানায়! বাস্তব জীবন এর থেকে ভ*য়া*ব*হ কঠিন! রাইয়ের বাবা-মায়ের এমন কিছু বক্তব্যেই রাই এবং আরফান ভাই অ*প*রা*ধ বোধে হাসফাস করতে লাগলেন। কিন্তু সেই অপরাধ বোধ আরফান ভাইয়ের মধ্যে ততক্ষণই দেখা গেলো যতক্ষণ অব্ধি রাহিয়ান মুখ খুলেননি।

—-” আন্টি-আঙ্কেল, আপনাদের কাছে আমি প্রথমেই আবির.. আই মিন আরফানের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ও হঠাৎ করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়েটা তৎক্ষনাৎ করে ফেলাতে আমরাও কম অবাক হইনি! কিন্তু, যা ঘটে গেছে তা-তো আমরা আর চেয়েও বদলাতে পারবনা বলুন? তবে আমি আপনাদের হলফ করে বলতে পারি আরফানের মতো ভালো ছেলে সত্যিই হয়না আর ওর থেকে ভালো ছেলে হয়তো আপনাদের মেয়ের জন্য আপনারা কখনোই পেতেননা!”

আন্টি চেতে উঠলেন রাহিয়ানের প্রতি। রা*গে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

—-” তুমি তো একথা এখন বলবেই! কারন ঐ ছেলে যে তোমার বন্ধু। কপাল তো আমাদের পু*ড়ে*ছে। ভোগান্তিটা তো আমাদেরই ভুগতে হবে তাই না? সমাজে বের হলে পাঁচ কথা শুনে মাথা নীচু করে চলে আসতে হবে আমাদের! লোকজন আমাদের দিকে হাত তুলে বলবে ঐ দেখো মেয়েকে এমন শিক্ষিত করলো যে মেয়ে তাদের না জানিয়ে একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করে ফেলল! আজকের এই দিনটা দেখার জন্য কি তোকে পেটে ধরেছিলাম মু*খপুরি!”

আন্টির কথায় আহত নয়নে তাকালো রাই। মুখ ফুটে দু’চারটে কথা বলারও যে পথ নেই তার। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাইয়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। রাই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতে আমি চোখের ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললাম! জানি এই সব কিছুতে ওর কোনো দো*ষ নেই কিন্তু যা ঘটে গেছে তার জন্য ওকে এমন অনেক মুখঝা*মটা সহ্য করতেই হবে। এটাই যে সমাজের নিয়ম! ঘরের লোক হোক বা বাইরের, মেয়েদের যে প্রতি পদে পদে খোঁটা দিবেনা সে যে অকল্পনীয়!

রাইয়ের বাবা নরম মানুষ। উনি এক দৃষ্টিতে মেয়ের গতিবিধি নিরীক্ষণ করে চলেছেন। বউয়ের কথায় তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে মেয়েকে কয়েক মিনিটের জন্য আলাদা করে পেলে মন ভরে দু’চারটে কথা বলে যেতেন। সবার মতো কথা শুনাতেন না! সমাজের এই ঝড় হাওয়া থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে হয়তো কিছুটা সাহস জোগাতে সাহায্য করতেন।

আরফান ভাই রাইয়ের মায়ের উদ্দেশ্যে কঠিনস্বরে বললেন,

—-” আপনি যা বলার আমাকে বলুন আন্টি! দয়াকরে রাইকে কিছু বলবেন না। ও আপনাদের একমাত্র মেয়ে হলেও আজ থেকে আমার বউ ও! তাই ওকে কিছু বলতে গেলে অবশ্যই আমাকে আগে বলতে হবে।”

রাইয়ের মা রা*গে*র অতিমাত্রায় পৌঁছে নিজেকে সামলাতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

—-” তোমার মেয়ে ভালোই প্রেমিক পুরুষ জুটিয়েছিলো! তাই বাবা-মাকে না বলে বিয়েটাও করে ফেলতে পেরেছে! আর এখন তাকে কিছু বলতে গেলে নাকি তার স্বামীর পারমিশন নিতে হবে! আমি তোমায় বলে রাখছি, এই মেয়েকে আমি আর কখনও ঘরে তুলবো না! আমি আজ থেকে জানবো আমাদের কোনো মেয়ে নেই! ম**রে গেছে আমাদের মেয়ে!”

—-” মা….”

রাইয়ের কন্ঠ ভে*ঙে এলো। মায়ের পরের শব্দ গুলো নিজের মতো করে আর জুড়তে পারলো না! আন্টি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন বাসা থেকে। আঙ্কেল সঙ্গে সঙ্গেই গেলেন না। কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থেকে আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ালেন। রাইয়ের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। বাবার দিকে একবুক আশা নিয়ে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো! কিন্তু আঙ্কেল আন্টির মতো মেয়েটাকে আশাহত করে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলেন না। যদিও চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আস্তেধীরে হাঁটা ধরলেন! রাই ছুটে গেলো তার দিকে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কেঁদে ফেলল মেয়েটা। নিজেকে সংযত করা যে আমার পক্ষেও সম্ভব হচ্ছিল না! রাই বাবার সামনে হাত জোর করে দাঁড়াতেই আঙ্কেল ডুকরে উঠে জড়িয়ে ধরল রাইকে। আমি চোখের জল ফেলে হেসে উঠলাম! প্রশান্তি এটাই যে আন্টি রাইকে ভুল বুঝলেও আঙ্কেল ওকে ভুল বুঝেনি।

—-” চিন্তা করিসনা মা সব ঠিক হয়ে যাবে!”

কথাটা আঙ্কেল রাইকে বললেও আমার মনে হচ্ছিলো যেন আমার বাবা এই কথাগুলো আমায় বলছে। মনটা আবারও অসহায়ের মতো কেঁদে উঠতে চাইলে সামলে নিলাম নিজেকে। চোখজোড়া বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে রাহিয়ানের কথাটা মনে করলাম। ‘বাবা অলওয়েজ আমার সাথেই আছে!’ সত্যিই যে বাবা আমার সাথে আছে। একেক সময় একেক রূপে বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজ যেমন রাইয়ের বাবার রূপ নিয়ে আমার সামনে এলো। আর বলে গেলো,

—-” চিন্তা করিস না মা সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আঙ্কেল রাইকে ভালোমন্দ কয়েক কথা বলে সেও চলে গেলেন। রাই বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওর কাছে যেতে নিলে রাহিয়ান হাত ধরে থামিয়ে দিলেন। আরফান ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

—-” ওকে নিয়ে রুমে যা । অনেক ধকল সইলো বেচারী।”

আরফান ভাই আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। ধীরপায়ে রাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরতেই চমকে উঠল রাই! আ*হ*ত নয়নে আরফান ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আরফান ভাই আলতো করে রাইকে বুকে আগলে নিলেন। আস্তে করে বললেন,

—-” চিন্তা করো না রাই। আমি আস্তে আস্তে সব ঠিক করে দিবো।”

ঘরের বাকি সদস্যরা নীরব দর্শকের মতো এতক্ষণ কাহিনী দেখলেও এবার সবাই একসাথে হৈচৈ করতে লাগল। বিয়ে বাড়ি এমন নীরব নিস্তেজ থাকলে কি মানায়? রাই আর আরফান ভাইকে আর কেউ জ্বা*লা*লো না! বউমনি আর নিতু আপু মিলে রাইকে রুমে দিয়ে এলো। কিছুক্ষন বাদে আরফান ভাইকেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো রেস্টের জন্য! আরফান ভাই যেতেই রাহিয়ানের বন্ধুমহল রাহিয়ানকে নিয়ে আড্ডায় বসলেন। তাদের উদ্দেশ্য আজ আড্ডায় আড্ডায় রাহিয়ানকে বাসর ঘরে আর পা রাখতে দিবে না! কিন্তু এদিকে বেচারা উনি তো কিছু বলতেও পারছেন না করতেও পারছেন না!

৭১.

ঘড়ির কাটায় ঠিক ১টা বেজে ৩০ মিনিট। বন্ধুদের ফাজলামো,শ*য়*তানি,ডেয়ার সব শেষ করে মাত্রই রুমে পা রাখলেন রাহিয়ান! আমাকে আরও ঘন্টা খানিক আগেই রুমে পাঠানো হয়েছে। এতক্ষণ আমি একা একাই তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম! অপেক্ষার সময়টা বেশ কঠিন হলেও এই মুহুর্তে সময়টা আমার কাছে বেশ অস্বস্তি লাগছে। খট করে শব্দ হতেই আমি ঘোমটার আড়ালে উনাকে এক পলক দেখে নিলাম। উনি রুমে পা রাখতেই যেন আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁ*ত করে পু*ড়*লো। আমি শুঁকনো গলায় ঢোক গিললাম। বুকের ভেতর কেউ যেন ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে বারবার। উনি রুমের দরজাটা লক করে পেছন ফিরে তাকাতে আমিও নেমে গেলাম বিছানা ছেড়ে।

বউমনিরা শিখিয়ে দিয়েছে, বাসর রাতে নাকি স্বামীর পায়ে হাত রেখে সালাম করতে হয়! এটাই নিয়ম। আজকাল এতো এতো নিয়মের মাঝে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছি আমি। আমাকে আচমকাই নিজের সামনে আবিস্কার করতে খানিক ভড়কে গেলেন মহাশয়। আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেই আমি ঝুঁকে গেলাম তার পায়ের কাছে। উনি চমকে উঠে প্রায় জোরেশোরেই বলে উঠলেন,

—-” আরে আরে কি করছো?”

আমি থতমত খেয়ে উনার পায়ের কাছে নেমেই থেমে গেলাম। উনার এমন হাইপার রিয়াকশন আমি আশা করিনি। উনি গোলগোল চোখ পাকিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উত্তরের আশায়। আমি বোকা গলায় জবাব দিলাম,

—-” সালাম করছি!”

উনি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

—-” সালাম করছো? কিন্তু কিভাবে?”

—-” পায়ে হাত দিয়ে। বউমনি বলেছে এভাবে সালাম করা নাকি নিয়ম!”

—-” হোয়াট?”

—-” হু। দেখি এবার সালাম করতে দিন।”

আমি উনার পা ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতেই উনিও ঝুঁকে এলেন আমার সামনে। আমি চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির ন্যায় করে উনার দিকে তাকাতেই উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,

—-” দু’জনে একসাথে সালাম করি?”

আমি হা করে উনার দিকে তাকালাম। উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,

—-” হা মার্কা রিয়াকশন দেওয়ার কিছু হয়নি! আজ থেকে আমরা যা করব দু’জনে বরাবর করব। তুমি যা করবে আমিও তাই করব। যদি তুমি আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো তবে আমারও উচিৎ তোমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা।”

উনার কথায় ঠিক কতটা স্বাভাবিক এবং কতটা হাইপার রিয়াকশন দিতে হবে আমি প্রায় ভুলেই গেলাম।বোবা চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উনার মনের মধ্যে প্যাঁচ লাগানো কথা গুলোর জোট খোলার প্রচেষ্টা চালালাম। আখেরে ফলাফল শূন্য হতেই দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। আমার দাঁড়ানো দেখে উনিও দাঁড়িয়ে গেলেন। কি বলব বুঝতে না পেরে হাতের কাছে যা পেলাম ধরিয়ে দিলাম উনাকে। উনি কিছুক্ষন হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

—-” ছোট বেলায় বাংলা সিনেমাতে দেখতাম এসব! তুমিও দেখছি সিনেমার নায়িকাদের মতো শুরু করলে।”

উনি হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন। বিগলিত হেসে বললেন,

—-” বাকি সব কিছুও কি বাংলা সিনেমার মতোই করতে ইচ্ছুক?”

আমি লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে নিলাম দু’হাতের মাঝে। উনি মৃদু হেসে আমার মুখ থেকে হাত নামিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” আর লজ্জা পেতে হবেনা ম্যাডাম! ওখানে একটা শাড়ি রাখা আছে জলদি গিয়ে শাওয়ার নিয়ে এসো। তোমার এই ভারী শাড়িতে যেন আমারই দমব-ন্ধ হয়ে আসছে। তারউপর এতো ভারী ভারী গয়না! কি করে পারো বলোতো?”

আমি শাড়িটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বললাম,

—-” মেয়েরা সব পারে। যেখানে গোটা একটা সংসার সামলাতে পারে সেখানে এই ভারী গয়না পরে ঘুরে বেড়ানো আর কি ক*ষ্ট বলুন?”

উনি মৃদু হাসলেন। আমাকে যাওয়ার তাড়া দিয়ে বললেন,

—-” আই নো। এবার জলদি যাও!”

—-” আপনিও ফ্রেশ হয়ে নিন?”

—-” একসাথে হবো? আসবো তোমার সাথে?”

আমি হোঁচট খেয়ে তাকালাম। মেকি রা*গ দেখিয়ে বললাম,

—-” তাই বললাম নাকি?”

—-” তো কি বললে?”(শ*য়*তা*নি হাসি দিয়ে)

—-” ধ্যাৎ! কিছুনা।”

আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে চলে এলাম উনার সামনে থেকে। পেছন থেকে উনার হাসির শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। মানুষটা জ্বা*লি*য়ে মা*র*ল আমায়।

শাওয়ার নিয়ে শাড়ি পড়ে ভেজা চুল নিয়ে বের হলাম ওয়াসরুম থেকে। সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি এক গোসলেই যেন কেটে গেলো। এখন যে কতটা শান্তি লাগছে উনার কথায় ফ্রেশ না হলে বুঝতামই না। হাতে টাওয়াল নিয়ে উনার বিখ্যাত আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। যতই বলি শান্তি লাগছে, এতো রাতে চুল ভিজিয়ে শাওয়ার নেওয়াটা মোটেই ভালো কথা নয়। জ্ব/র-টর না এলেই হলো। টাওয়াল হাতে চুল মুছতে মুছতেই উপলব্ধি করলাম ঘরের মধ্যে মাতাল করা ফুলের সুগন্ধ। সারা ঘরময় ফুলোর এমন সুবাসে ‘ম’ ‘ম’ করছে। আমি জোরে টেনে নিঃশ্বাস নিলাম। অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ। ফুলের সুগন্ধ নিতে নিতে মনে হলো উনি ঘরে নেই!

ভেতরটা ধ*ক করে উঠলো। ঘড়ির কাটা ২টার উপর স্থীর হয়ে আছে। ঘরের মৃদু আলোয় উনাকে কোথাও আবিস্কার করতে পারলাম না। ফ্রেশ হতে বলে কোথায় গেলেন উনি? আমি হাতের তোয়ালেটা ফেলে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি ছোট্ট মোড়াটায় বসে আছেন গিটার হাতে। আজ আকাশে মস্ত বড় একখানা চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোতেই আকর্ষণীয় হয়ে ফুটে উঠেছে উনার মুখ। ব্যালকনিতে আসার পথে বড় থাইটার কাছে আমার উপস্থিতি টের পেয়েই ঘাড় ফেরালেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে উনি ঠোঁটের কোনের হাসিটুকু দীর্ঘ করলেন। হাত থেকে গিটারটা নামিয়ে রেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তার চাহনিতে মাদকতা ভরপুর। গাঢ় চাহনিতে আমার ভেতরটা লন্ডভন্ড করে দিতে লাগলো।

আমি চোখ নামিয়ে নিলাম উনার থেকে। উনি উনার শেরওয়ানি পাল্টে সাদা শার্ট পরেছেন। শার্টের বেশির ভাগ বোতাম লাগানো থাকলেও বুক বরাবর তিনটা বোতামই খোলা! উনার সুঠাম দেহে শার্টটা টাইট হয়ে আঁটকে আছে। শার্টের লম্বা হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। চাঁদের আলোয় উনার ডার্ক রেড ঠোঁট দু’খানা আরও কঠিন রূপ নিয়েছে। মাথার সিল্ক চুলগুলো চিকচিক করছে। সেই সাথে ঝিরিঝিরি বাতাসের তালে মৃদুভাবে ভাসছে।

উনি উঠে দাঁড়ালেন। একপা একপা করে এগোতে লাগলেন আমার দিকে। উনার ফেলা প্রতিটি কদমে আমার ভেতরটায় তোলপাড় করা বাড়ছে বৈ কমছেনা! উনি আমার একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমি নিঃশ্বাস আঁটকে ধরে উনার চোখে চোখ রাখলাম। উনি উনার শীতল হাত জোড়া তুলে আমার দু’গালে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলাম আমি। বুকের ভেতরটার ধুমধাম ঢোল পেটানোর আওয়াজে বিচলিত হয়েই আকস্মিক জড়িয়ে ধরলাম তাকে! উনার বুকে মাথা রাখতেই অস্থিরতা কমার নাম করে আরও বেড়ে গেল উনার হৃৎস্পন্দনের শব্দে। আমার থেকেও যেন পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছুটছে উনার হার্টবিট। উনি কিছু না বলেই দু’হাতে আগলে ধরলেন আমায়। আমার ভেজা চুল গুলোর মাঝে হাত চালিয়ে বললেন,

—-” চুল গুলো ভালো করে মুছলেনা কেন? ঠান্ডা লেগে জ্ব*র বাঁধতে কিন্তু সময় নিবেনা।”

আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,

—-” আপনাকে হঠাৎ দেখতে না পেয়ে ভ*য় পেয়ে গিয়েছিলাম!”

উনি মুচকি হাসলেন বুঝি! আমাকে নিজের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে বললেন,

—-” তোমার অপেক্ষা করছিলাম!”

—-” এখানে কেন?”

—-” আমাদের মিলনের সাক্ষী চাঁদ থাকবে বলে!”

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম! জবাবে আর কিছুই বলতে পারলাম না উনাকে। উনি আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে আকস্মিক কোলে তুলে নিলেন। আমি অস্থির নয়নে উনার চোখে চোখ রেখে উনার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলাম। উনি মাদক হাসি হেসে রুমের ভেতর পা রাখতে রাখতে বলে উঠলেন,

—-” আমার বড় সাধ হয়,
একবার তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি,
তুমি ম*র,না আমি!
ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের ভাঁজে ভাঁজে,
আ*গু*ন জ্বা*লা*য়ে দেখি,
তুমি পো*ড়,না আমি!”

ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায় ভালোবাসার নতুন আবির্ভাব ঘটালাম দু’জনে। কিছু সুখ, কিছু বে*দ*নাকে সাক্ষী রেখেই আজ থেকে নতুন করে সূচনা হলো আমাদের অন্যরূপ ভালোবাসার। বুঝি এই সুখই শেষ নয়! সামনে হয়তো আরও অনেক অনেক ভালোবাসার নতুন রূপে বারবার সূচনা রটাতে থাকবে আমাদের এক মন এক প্রান। হাজার ভুল,হাজার ঠিককে একত্র করেই ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবে দুজন দুজনকে।

#চলবে____________________#প্রেয়সী 🧡(৩৭)

৭২.

—-” বাবা-মা তো আমাকে ছেড়ে গিয়েছে! আপনি কি করে বুঝবেন আমার ক*ষ্টটা? আপনি তো দয়াশীল মানুষ! বিয়ে করে আমাকে দয়া করেছেন! ক*ষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন! এখন বুঝতে পারছেন তো কতটা ভালো রাখতে পারবেন আমায়?”

আরফান ভাই আ*হ*ত নয়নে তাকালেন রাইয়ের দিকে। জড়ানো গলায় বললেন,

—-” এভাবে কেন ভাবছ তুমি? আমি তোমার উপর কোনো প্রকার দয়া করিনি রাই! রূপ,অরিন যা করেছে তার জন্য আমরা প্রত্যেকেই ভীষণ আপসেট! আর তাছাড়া তুমি ভাবো না তুমি যে এখনও রূপের কাছে ফিরতে চাও সেটা কি ঠিক? রূপ তো বিয়ে করে ফেলেছে। সামান্য ভরসা টুকুও দেখাতে পারেনি তোমার প্রতি! সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তুমি নিজেকে ক*ষ্ট দিয়ে যাচ্ছো প্রতিনিয়ত! আমি সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না রাই! আর তাই আমি তোমায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই! বিলিভ মি রাই, আমি সবটা ঠিক করে দিবো!”

রাই চোখের জল মুছে কঠিনস্বরে বলল,

—-” বললেই কি সবটা ঠিক হয়ে যায়? আপনিও যে আপনার ফ্রেন্ডদের মতো আমার সাথে ছলনাবাজি করবেননা তার কি নিশ্চয়তা আছে?”

—-” প্লিজ রাই! একটু ভরসা রাখো আমার প্রতি! আমি কথা দিচ্ছি…”

রাই হাত তুলে থামিয়ে দিলো আরফান ভাইকে।

—-” আপনি প্লিজ আমায় একটু একা ছেড়ে দিন! আমি সহ্য করতে পারছিনা আপনাকে!”

আরফান ভাই ঢোক গিললেন। রাইকে তার আরও কিছু বলার থাকলেও সাহস জুগিয়ে বলতে পারলেননা কিছুই। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে মনে হতেই আমি পর্দা ঠেলে ওদের রুমে প্রবেশ করলাম। আমাকে হঠাৎ দেখতে পাবেন বলে হয়তো আরফান ভাই প্রস্তুত ছিলেন না। নিজের অসহায়ত্ব মুখটা আমার থেকে আড়াল করতেই জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলেন,

—-” আরে নিধি তুমি!”

আরফান ভাইয়ের মুখে আমার নাম শুনতেই রাইয়ের টনক নড়ল যেন। আরফান ভাইয়ের থেকে মুখ ফিরিয়েই ছিলো ও। হঠাৎ তড়িঘড়ি করে সেও মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানল। থমথমে স্বরটা পরিস্কার করতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো রাই,

—-” নিধু। গ..গুড মর্নিং বেব।”

দু’জনেই চমৎকার ভাবে নিজেদের ভোল পাল্টে ফেলল। কিন্তু আমি পারলাম না! ওদের কথা গুলো না চাইতেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনা যদিও বা আমার অ*প*রা*ধ হয়েছে কিন্তু রাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার খাতিরে ওর জীবনের সমস্যা গুলো অনেকাংশে আমার সমস্যার মধ্যেই পড়ে। তাই সেগুলো ঠিক করে দেওয়াও আমার দায়িত্বের বাইরে নয়! আমি অ*প*রা*ধী চোখে দু’জনের দিকেই তাকালাম। থমথম কন্ঠেই বললাম,

—-” আমায় ক্ষমা করবেন আরফান ভাই! আমি ইচ্ছে করে আপনাদের কথা গুলো শুনতে চায়নি! কিন্তু চেয়েও যেন দরজার ওপাশ থেকে চলে যেতে পারেনি! দরজাটাও খোলা ছিল তাই সবটাই বাইরে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো! পরিস্থিতিটাও এমন যে পারমিশন না নিয়েই ঢুকে পড়লাম! তার জন্য প্রথমেই সরি বলে নিচ্ছি!”

আমার কথায় যেন দু’জনেই চমকে উঠলো! রাই শুঁকনো হাসি দিয়ে আঁড়চোখে একবার আরফান ভাইকে দেখে নিয়ে বলল,

—-” আরে ধুর! কি যে বলিসনা তুই? নিজের ঘরে আসবি তাতে আবার এতো ফর্মালিটি দেখাতে হবে কেন?”

আরফান ভাইও রাইয়ের কথার রেশ টেনে বলল,

—-” হ..হ্যাঁ তাই তো। আর দরজা যেহেতু খোলাই ছিলো সেহেতু পারমিশন আবার কেন নিতে হবে?”

বুঝলাম দু’জনেই অতি ফর্মালিটি মেইনটেইন করার চেষ্টা করছে। তারা যে নিজেদের প্রবলেম আমায় দেখাতে ইতস্ততবোধ করছে সেটুকু ঠিক বুঝে নিলাম। তাই আমিই কথা তুললাম তাদের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে! জানি ঠিক নয় কিন্তু, দু’জনকেই যে নর্মাল হতে হবে।

—-” দেখ রাই, আরফান ভাই যে তোর প্রতি দয়াশীল হয়ে তোকে বিয়ে করেছে তেমনটা কিন্তু নয়! সে তার বন্ধুর কর্মকান্ডে খুবই লজ্জিত আর তাদের সবার মাঝেই কিছু অপরাধবোধ ছিলো বিধায় সে তোকে তোর ক*ষ্টগুলো থেকে বের করে আনতে সাহায্য করতে চেয়েছে। তুই রূপ ভাইয়াকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছিস তা হয়তো আমার থেকে তুই-ই বেটার জানিস! আর সেই ভালোবাসার দ*হনে পু-ড়তে পু*ড়তে তুই নিজেও ক*ষ্ট পাচ্ছিস আর এই মানুষ গুলোকেও ক*ষ্ট দিচ্ছিস! রূপ ভাইয়া যে কাজ করেছে তাতে তোর কোনো দো*ষ নেই আর বাকিদেরও কোনো দো*ষ নেই! সে মানুষটাই এমন ছিলো যে বাইরের লোকের কথায় ভালোবাসার মানুষটাকে দো*ষী করে চলে গিয়েছে! অথচ যেখানে তোর কোনো ভুলই ছিলো না! ভুল রূপ ভাইয়া করেছে কিন্তু শা*স্তি তুই পাচ্ছিস! কেন বলতো? ভালোবেসেছিস বলে সব অ*ন্যা*য় মেনে নিয়ে চুপসে থাকতে হবে? এটা কি সত্যিই তোর ব্যাক্তিত্বের সাথে যায় বল? ক্ষমা তো রূপ ভাইয়ার তোর কাছে চাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু উল্টে তুই বারবার উনাকে কল করে অনবরত ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিস! নিজেকে এতোটা ব্যাক্তিত্বহীন কবে থেকে ভাবা শুরু করলি বলতো? আর যে মানুষটা তোকে এই খাদ থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে তুই তাকেই পাল্টা আ*ঘা*ত করছিস? এমন বোকা কবে থেকে হলি রাই? ঠিক ভুলের বিচার করাটাও কি ভুলে গেলি?”

রাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরফান ভাইয়ের দিকে তাকালো। আরফান ভাই মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো উনার রাইকে বোঝানোর মতো আর কিছু নেই!

আমি আবারও বলে উঠলাম,

—-” ভুল মানুষটাকে ভুলে গিয়ে, ঠিক মানুষটাকে আগলে রাখ রাই! আর যদি বলিস আন্টি আর আঙ্কেলের তোর প্রতি ঘৃ*না বা আ*ক্রো*শে*র কারন আরফান ভাই তাহলেও তুই ভুল!”

—-” মা আমাদের এই বিয়ে কখনই মেনে নিবেনা নিধু! তুই মাকে খুব ভালো করেই জানিস! আমাদের এই বিয়েটা না হলে মা আজ কখনই আমার সাথে সম্পর্ক না রাখার কথা বলতে পারতনা!”

—-” তুই ভুল ভাবছিস রাই! আন্টি এই বিয়ের জন্য তোকে ভুল বুঝেনি বা আরফান ভাইয়ের জন্যও তোর সাথে সম্পর্ক ভা*ঙা*র কথা বলেনি! বলেছে এই সমাজের জন্য! সমাজটা এমনই এক জিনিস যেখানে ভালোর দাম তুই কখনই পাবিনা! ভালো কাজে তোকে কখনও কেউ সাবাসি দিবেনা বা উৎসাহ দিয়ে বলবেনা ‘বাহ্ তুমি কাজটা বেশ করেছ’! সমাজ তখনই তোর দিকে ফিরে তাকাবে যখন তুই সমাজের বি*রু*দ্ধে কিছু করবি! রাই, সমাজকে ভেবে কখনও কিছু করা উচিৎ নয়! কেননা, তুই সমাজের জন্য ম*র*লেও সমাজ কখনও তোর জন্য ভালো কিছু রাখবেনা! সর্বদা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তোর মনটা আরও বি*ষি*য়ে দিবে। ভেবে দেখ তো রাই, আন্টি তোকে দু’চার কথা শোনালেও আঙ্কেল কি তোকে এমন কিছু বলেছে? বলেনি! বলেনি কারন আঙ্কেল সমাজের ধার ধারেনা! সে এই নি*কৃ*ষ্ট সমাজ থেকে অনেকটা ব্যবধানে বাস করে আর তোকেও কিন্তু সেভাবেই মানুষ করেছে রাই। একদিন দেখবি আন্টিও নিজের থেকে এসে তোকে আবারও বুকে আগলে নিবে! যেদিন দেখবে এই সমাজ তাকে কিছু দিচ্ছে না কেবল কেড়েই নিচ্ছে! যেদিন এই সমাজের আসল রূপটা আন্টির কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে সেদিন থেকে আন্টিও আর সমাজের ধার ধারবেনা! সেও মেয়েকে আপন করে নেওয়ার জন্য ছুটে আসবে। মানুষের জীবনে সবসময় ভালো সময় থাকেনা! ভালো-মন্দ মিশিয়েই তো জীবন বল! তাই জন্য ভালো সময়টাকে প্রশংসা করব আর খারাপ সময়টাকে নিন্দা করব সেটা তো হতে পারেনা তাই না? বেঁচে থাকতে হলে ভালো-মন্দ দুটোকেই সমান ভাবে আপন করে নিতে হবে আর ইনজয় করতে হবে। এই যে মানুষটা তোকে বিয়ে করেছে না? আমি কিন্তু বড় মুখ করে তোকে কথা দিতে পারি সে কখনও তোর এই প্রতিকূল পরিবেশে তোকে একলা ছাড়বেনা রে। সবসময় শক্ত করে তোর এই হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে আঁটকে রাখবে! কেন বলতো? দয়া করে? উঁহু… নতুন করে ভালোবাসার মানে শিখিয়ে ভালোবেসে আগলে রাখতে চায় তোকে! তুই এভাবে ভুল বুঝে মানুষটালে হেলাফেলা করিসনা যেন! তুইও তাকে ভালোবেসে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলতো দেখি। দেখবি জীবনটা এভাবেই কত সুন্দর।”

আরফান ভাই পেছন থেকে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো আমার সামনে। তার চোখ জোড়া কৃতজ্ঞতায় চিকচিক করছে। হাত গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। আমি মৃদু হেসে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

—-” তোর এই হিরোর জন্য কিন্তু ভার্সিটির অর্ধেক মেয়ে শুধু হা-হুতাশ করে! অর্ধেক উনার জন্য আর অর্ধেক আমার উনার জন্য।”

চোখে জল নিয়েই ফিক করে হেসে ফেললো রাই। আমি মুগ্ধ নয়নে মেয়েটার হাসিতে ঝলমল করা মুখখানা দেখতে লাগলাম। পাশ থেকে আরফান মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,

—-” থ্যাংক্যু নিধি! আমাদের ব্যাক্তিগত সমস্যা তোমার ব্যাক্তিগত সমস্যা ভাবার জন্য! বিশ্বাস করো তুমি যেভাবে রাইকে বোঝালে না সেভাবে হয়তো আমি নিজেও কখনও বেঝাতে পারতাম না! কখনও রাগ আর কখনও অভিমান বুকে চেপেই সরে আসতাম ওর সামনে থেকে! ওকে বেঝাতে গিয়েও ওর ক*ষ্ট হবে ভেবে চুপ করে যেতাম। কিন্তু তুমি পারলে! তুমি সত্যিই প্রমান করে দিলে ইউ আর দ্য বেস্ট নিধি।”

আমি মুচকি হাসলাম। রাইকে আগলে ধরে বললাম,

—-” এই পা*গ*লি*টা তো আমার কলিজা আরফান ভাই। আর আমার কলিজাটা এভাবে ক*ষ্ট পাবে আর আমি চুপ করে সইবো তা কি করে হয়? ওকে তো আমার এসব কথা বলতেই হতো।”

রাই চোখের জল মুছতে মুছতে আরফান ভাইয়ের দিকে তাকালো। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

—-” আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দিবেন! আমি না বুঝে আপনাকে অনেক বেশি হার্ট করে ফেলেছি। আসলে…”

রাইকে থামিয়ে দিয়ে মাঝপথেই বলে উঠলেন আরফান ভাই,

—-” এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমার মনের ক্ষ*ত*টা আর বাড়িয়ে দিও না প্লিজ। আমি এমনিতেই তোমায় খুব বেশি ক*ষ্ট দিয়ে ফেলেছি! তোমার অমতে আমি তোমায় বিয়ে করে তোমার বাবা-মাকে তোমার থেকে দূরে করে দিয়েছি! এই অ*প*রা*ধ*বোধেই যে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো।”

রাই আমাকে পাশ কাটিয়েই আরফান ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাত ধরে অসহায় ঘেরা কন্ঠে বলে উঠলো,

—-” মাথায় উল্টা পাল্টা ঘুরছিলো বলেই তো আপনাকে ওসব কথা বলে ফেলেছি! এখন আপনিও যদি ওটাকেই আমার মনের কথা ধরে নেন তখন যে আমার নিজকেই সব থেকে বেশি অ*প*রা*ধী লাগবে।”

আরফান ভাই কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো রাইয়ের দিকে। এখন মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলবে। সেখানে আমি কি করে থাকতে পারি? আমি তাদের আড়ালেই রুম থেকে প্রস্থান করলাম। সবশেষে শান্তির এটাই যে, ওদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটা তো মিটল। এখন শুধু রাইয়ের মাকে মানানো বাকি। চিন্তা নেই, সময়ের ফেরে পরে সে নিজেও বুঝবে মেয়ের শূন্যতা। আর দিনশেষে সেও মেয়েকে আপন করে নিতে সমাজের কটু কথাকে গ্রাহ্য করবে না আর।

৭৩.

বৈঠক হচ্ছে রাহিয়ান আর আমার মাঝে! তাও আবার শাড়ি নিয়ে। বড় খালামনি আর বউমনি মিলে আমাদের বিয়েতে আসা সব গিফ্টবক্স গুলো লিয়ার হাতে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দিলো। সেই সাথে বড় খালামনি আমার শাশুড়ী মা হওয়ার সুবাদে গুনে গুনে ঠিক আটখানা তাঁতের শাড়ি পাঠালো আমার জন্য। মূলত বাসায় পড়ব বলে। এখন সমস্যা টা হলো এখানে যে গিফ্ট বক্সের বেশিরভাগ গিফ্টই শাড়ি আর শাড়ি। হয় কাজ করা ভারী শাড়ি,নয় সিল্ক,নয় কাতান আর নয় তাঁতের শাড়ি। তাই আমি ভাবলাম শাড়ির সংখ্যাই যখন এতো বেশি তখন অন্যান্য ড্রেস না পড়ে কিছুদিন শাড়িই পড়ি। তাতে নিজের মধ্যে একটা বউ বউ ভাব থাকবে আর আমার শাড়ি পড়ার হাতও পাঁকা হবে। আমার ভাবনাকে অহেতুক ভেবেই রে*গে গেলেন রাহিয়ান। সব ড্রেস রেখে কেন শুধু শাড়িই পড়তে হবে? শাড়ি পড়লে নাকি আমাকে পে*ত্নীর মতো লাগে! আর পে*ত্নীদের নাকি শাড়ি পড়তে মানা! ব্যস, আমার ক্ষে*পে যাওয়ার জন্য উনার এইটুকু মন্তব্যই বহুদূর কাজ করল। আমিও জে*দ দেখিয়ে বললাম,

—-” যদি কোনো ড্রেস আমাকে পড়তেই হয় তা হবে অলনি শাড়ি। আদারস কোনো ড্রেস নয়!”

উনি আরও রে*গে গেলেন। বিছানা থেকে সমস্ত শাড়ি তুলে নিয়ে আলমারির এক কোনে ফেলে রেখে লক করে দিলেন আলমারি। আমি কোমরে হাত চেপে উনার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া দিতে রেডি হয়ে গেলাম। উনি চাবিটা আঙ্গুলের মাথায় পেঁচাতে পেঁচাতে বললেন,

—-” আমার পারমিশন ছাড়া তুমি কখনও শাড়ি পড়বেনা নিধি!”

আমি রা*গে ফুঁসে উঠে বললাম,

—-” আমি শুধু শাড়িই পড়ব। কারন শাড়ি আমার খুব পছন্দের। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আলমারিতে শাড়ি ছাড়া আমার যে বাকি ড্রেসগুলো আছে আমি সব গুলো লিয়াকে আর রানিকে দিয়ে দিব!”

উনি তেড়ে এলেন আমার দিকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

—-” আমি যখন বলেছি তুমি শাড়ি পড়বেনা সো পড়বেনা। নো মিনস নো!”

আমি থতমত খেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলাম। কাচুমাচু করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বললাম,

—-” এমন কেন করছেন? খালামনি নিজেই তো বলল শাড়ি পড়ার কথা! আর গিফ্টগুলোও তো দেখলেন বেশিরভাগই শাড়ি। তাই ভাবলাম সব শাড়ি গুলো এভাবে ফেলে রাখলে অযত্ন হবে আর পড়লে তারও যত্ন হবে আর আমারও শাড়ি পড়ার হাত পাঁকা হবে।”

—-” মা বললেও পড়তে হবেনা তোমাকে! বাড়িতে বাইরের লোকের অভাব নেই। আর আমি চাইনা কোনো বাইরের লোক আমার বউকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখুক! শুধু এই রুমের ভেতরে থেকে শাড়ি পড়বে। এই রুমের বাইরে শাড়ি পড়ে পা রাখলে আমি তোমার পা কে**টে ফেলবো বলে রাখলাম।”

আমি আঁতকে উঠে উনার দিকে তাকালাম! অসহায় মুখ করে বললাম,

—-” আ..আপনি এমন কেন করছেন সত্যি করে বলুন তো? কিছু হয়েছে?”

উনি সরে গেলেন আমার সামনে থেকে। ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললেন,

—-” শাড়ি পড়তে আগে শিখো তারপর বাইরে আসবে।”

—-” আমি শাড়ি পড়তে জানি!”

—-” জানলে পেটের একটা পাশ পুরোটাই কেন বের হয়ে থাকবে?”

আমি আবারও আঁতকে উঠে নিজের দিকে তাকালাম! এখনও পেটের একটা পাশ অনেকাংশে বেরিয়ে আছে! ছিহ্! কি লজ্জা কি লজ্জা!

উনি আবারও কপট রা*গ দেখিয়ে বললেন,

—-” আর যখন তোমার শাড়ি এখান থেকে একটু, ওখান থেকে একটু সরে যায় তখন তোমার নিজের দিকে কোনো খেয়ালই থাকেনা! ইডিয়ট মেয়ে!”

আমি ভড়কে গিয়ে তাকালাম! উনি আমায় ইডিয়ট বললেন! এতবড় অপবাদ! শাড়ি পড়লে তো একটু অসাবধানতা বশত সরে যেতেই পারে! তার জন্য এমন রিয়াক্ট করার কি আছে?

—-” আমি কি ইচ্ছে করে সরাই নাকি?”

আমার প্রশ্নে উনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কপালের রগ ফুলিয়ে বললেন,

—-” তুমি আমার সামনে ইচ্ছে করে সরালেও সমস্যা নেই কিন্তু বাইরের লোকের সামনে অসাবধানতা বশত সরে গেলেও আমার প্রচুর সমস্যা হয়। রা*গ হয় খুব। ইচ্ছে করে সবার সামনেই তোমায় ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দেই!”

আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম। উনি যেভাবে রে*গে যাচ্ছেন যেন তৃতীয় বিশ্ব*যু*দ্ধ হওয়ার পেছনে এই অসহায় আমিই দায়ী! ধূর বাবা ভাল্লাগে না।

#চলবে____________________