ফরগেট মি নট পর্ব-১৩

0
21

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৩.
হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া ড্রয়িংরুমে মৃত্তিকার পদাঘাত ছন্দ তুলে।দর্শন হাত মুঠো করে দাড়িয়ে।তার দৃষ্টি মৃত্তিকার গম্ভীর মুখশ্রীতে।মৃত্তিকার হঠাৎ আগমনে চোরা চোখে তাকায় দীপন।দৃষ্টিতে অনুশোচনা নয় বরং অন্যকিছু।দীপনের উদ্দেশ্যে ছিল দর্শনকে রাগিয়ে তোলা।
তারপর?তারপর সেই সমস্ত বাক্য দর্শনের মুখ দিয়ে উগলে নেওয়া যা দীপনের অজানা।
মৃত্তিকা দীপনকে পাশ কাটিয়ে দর্শন সামনে এসে দাড়ায়।পূর্ণ চোখে তা লক্ষ্য করে দীপন।মৃত্তিকা দর্শনের ওয়াইফ এটা ভাবতেই তার সর্বাঙ্গ জ্বলছে।যে নারী তার কামনায় ছিল সেই নারীকে দর্শন এভাবে পেয়ে গেল এটা কিছুতেই মানতে পারছে না সে।

দর্শনের রাগান্বিত মুখশ্রীর দিকে একপল গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃত্তিকা দীপনের দিকে ফিরে তাকায়।ওমনি তার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে নিজ শক্তিতে।হাত দুটো বুকে ভাজ করে দাড়ায় মৃত্তিকা।প্রথম সাক্ষাৎের পর দীপনের সাথে দ্বিতীয়বার বাক্যালাপ হতে যাচ্ছে।
মৃত্তিকা অত্যন্ত শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

“ক্যারেক্টারলেস মানুষ অন্যকেও নিজের মতো ভাববে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে উল্টাপাল্টা বলার আপনি কে?হু আর ইউ?”

দীপনের মুখে রা নেই।এমনকি দৃষ্টি নতও নাহ তার।বরং এমন রেশ চেহারার যেন চরম কোন সত্য বলার জন্য তাকে জেরা করা হচ্ছে।মৃত্তিকা থেমে নেই।সে ফের আক্রোশের সাথে বলে উঠে,

“পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলাম আমি।তৃষার মার্ডার কেস ডিসমিস করে দেওয়ার আপনি কে?হু আর ইউ?”

পরপরই একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মৃত্তিকা বলতে শুরু করে,

“উত্তরটা খুব ভালো করেই আমার জানা।আপনি খুবই নোংরা মানসিকতার একজন লোক। যে মনে করেন ক্ষমতার জোরে সব করতে পারেন।তবে এটা মনে রাখবেন আপনার কোন অধিকার নেই কারো চরিত্র নিয়ে বাজে বকার।”

মৃত্তিকা কথা থামায়।দর্শনের দিকে চায় একনজর তারপর বলে,

“আপনার ভাই আমাকে আটকে রেখেছিলো ঠিক।কিন্তু তার থেকে আমি কোন বাজে ইঙ্গিত পাইনি।সে আমায় ছুঁয়েছিল ঠিক।পরপুরুষ হওয়ার পরও সেই ছোঁয়ায় আমার অস্বস্তি অনুভব হয়নি যতটা আপনি কেবল চোখ তুলে তাকালে হয়!”

কথাটুকু শেষ করে মৃত্তিকা আচমকা দর্শনের হাতের মুঠোয় নিজের হাত গুঁজে দেয়।তারপর শক্ত করে ধরে তাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়।দর্শন অবাক নয়নে আপন গতিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকা তেজস্বিনীর দিকে তাকায়।চারপাশের সব কুয়াশাচ্ছন্ন অনুভূত হয় তার।মৃত্তিকা তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানার কৌতুহল নেই তার।যুবকের চোখে তো রাজ্যের বিস্ময়!মৃত্তিকার নিজ থেকে তাকে স্পর্শ করবে এ তো কল্পনাতীত ছিল।দর্শন নরম,স্নিগ্ধ চোখে দু’জনের হাতের বাঁধনের দিকে তাকায়।
এখন যদি মৃত্তিকা তাকে জাহান্নামেও নিয়ে যায় তবুও সে মোহাচ্ছন্নের ন্যায় সেই পথ পাড়ি দিবে!

কিন্তু হায়!দুজনার হাতের বাঁধন ছিন্ন কক্ষে প্রবেশের পর।মৃত্তিকা নিজের হাত ছড়িয়ে নেয় সন্তর্পণে।দর্শন নরম দৃষ্টিতে তাকায় সহধর্মিণীর পানে।মেয়েটা একটু আগে বউ বউ কাজ করলো না?দীপনের সামনে স্বামীর চরিত্রের কি সুন্দর ব্যাখা দিয়ে এলো!দর্শনের মনে হচ্ছে সে সুন্দর এক স্বপ্নে মজেছে।দর্শনের নরম স্বরে প্রশ্ন করে,

“বাড়িতে ফিরতে এত দেরি?”

“এখানে আসার কোন ইচ্ছায় আমার ছিল না।কিন্তু বাধ্য হয়ে এসেছি।আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে।

মৃত্তিকার শক্ত জবাব শুনে দর্শন বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওষ্ঠ ঘষে।ফের বলে,

” বহুত কথা বলেছো।নাও টেক রেস্ট!”

কথাগুলো খুব শান্ত স্বরে বলে দর্শন রুম ত্যাগ করে।যাওয়ার সময় দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে যায়।রুমের বাইরে পা রাখতেই মানব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়ির নিকটে আসে।
দর্শন চলে যেতেই বিছানায় ধপ করে বসে পরে মৃত্তিকা।একহাত দিয়ে মাথার সিল্কি চুলগুলো উল্টে দেয়।তারপর দু’হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে শুকনো ঢোক গিলে সে।অজানা এক অনুভূতি হানা দিচ্ছে বক্ষপিঞ্জরে।যার কোনো নাম নেই,কোনো যুক্তি নেই!

মিনিট কয়েকবাদে হাতে বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে দর্শন।একবার চোখ তুলে তাকায় বিছানায় আনমনে বসে থাকা রমনীর দিকে।তারপর রিমোট হাতে নিয়ে এসির মাত্রা বাড়ায় সে।মুহুর্তেই মৃত্তিকার কায়ায় সুক্ষ্ম কাঁপন অনুভূত হয়।শিউরে উঠে চোখ তুলে তাকাতেই দর্শনকে নজরে আসে তার।সুদর্শন যুবক উল্টোদিকে মুখ দিয়ে গায়ের বসন খুলছে।মৃত্তিকার দৃষ্টি আটকায় জিম করা বক্ষে।ওইযে ড্রেসিং টেবিলের আরশিতে স্পষ্ট ফুটে উঠছে দর্শনের সুদর্শন ফর্সা অনাবৃত বক্ষদেশ।হঠাৎ দর্শনের রসিকতা মিশ্রিত স্বর মৃত্তিকার কানে আসে,

“আপনি চাইলে আমার সামনে এসে মন ভরে দেখতে পারেন।আই ডোন্ট মাইন্ড!”

নির্লজ্জ টাইপ কথাবার্তা শুনে আহম্মক বনে তাকায় মৃত্তিকা।দর্শনের তো জানার কথা নয় সে তাকে দেখছে।পরপরই দর্শন ওষ্ঠকোণে হাসি বজায় রেখে মৃত্তিকার দিকে ঘুরে তাকালে লজ্জায় হাসফাস করে উঠে রমনী।দৃষ্টি হয় চোরা!দর্শন মৃত্তিকার এই লজ্জাবতী রুপ দেখতে দেখতে গায়ে টিশার্ট গড়িয়ে নেয়।ফের শপিং ব্যাগগুলো থেকে কয়েকটা শাড়ি বের করে কাবার্ডে রাখে।মৃত্তিকা সেটা লক্ষ্য করেনি।তার দৃষ্টি ছিল নিম্নে। এতক্ষণ ঠান্ডায় দেহে বয়ে যাওয়া শিহরণ বদলে গিয়ে পরিনত হয়েছে লাজে!
দর্শন বেরিয়ে যাওয়ার আগে মৃদুস্বরে বলে,

“কাবার্ডে নতুন শাড়ি আছে।ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি খাবার পাঠাচ্ছি।”

মৃত্তিকা নির্বাক চেয়ে রয় চলে যাওয়া মানুষটার দিকে।কিছুসময় বাদে একজন সার্ভেন্টকে সাথে নিয়ে রুমে আসেন মিসেস দানিশ।ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরিহিতা মহিলার বসনে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট।সার্ভেন্টকে খাবার রাখে বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।ছেলে ও তার সহধর্মিণীর মধ্যকার জটিলতা আন্দাজ করে নিজ দায়িত্বে খাবার রুমে নিয়ে এসেছেন তিনি।রুমে চোখ বুলিয়ে মৃত্তিকাকে না পেয়ে অন্ধকার হয়ে থাকা বারান্দায় এসে দাড়ান তিনি।লাইট জ্বালিয়ে মৃত্তিকার দর্শন না পেয়ে ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হয় মিসেস দানিশের।তখনি ওয়াশরুম থেকে নিঃশব্দে বের হয় মৃত্তিকা।পরনে দর্শনের নিয়ে আসা স্কাই ব্লু কালারের একটা জর্জেট শাড়ি।বারান্দায় মিসেস দানিশকে দেখে হাতের তোয়ালে বিছানায় রেখে মৃত্তিকা মৃদুস্বরে সালাম দিয়ে উঠে।দর্শনের মা খানিক চমকে পাশ ফিরে তাকায়।ঠোঁটের কোণে জোর করে একটা হাসি টেনে নিয়ে এসে বলেন,

“খাবারটা ট্রি টেবিলে রাখা আছে খেয়ে নাও জলদি।”

এতটুকু বলে থামেন ভদ্রমহিলা।একটা সুক্ষ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

“আমি আন্দাজ করতে পারছি তোমার আর দর্শনের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়।কিন্তু যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে তখন সবটা মেনে নেওয়ার অনুরোধ রইল তোমার কাছে।”

এতটুকু বলে মৃত্তিকার সফেদ মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত করেন মিসেস দানিশ।রমনী নির্বাক তাকিয়ে।মৃত্তিকা তিনি প্রথম দেখেন সেইদিন পার্টিতে।আর্কষণীয় শাড়িতে আবৃত রমনীকে দেখে দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল মিসেস দানিশের।কিন্তু তারপরই ঘটে গেল অনেক ঘটনা।মেয়েটার শেষ অভিভাবক বাবাকে হারালো।মেয়েটার মুখে দূঃখের ছাপ স্পষ্ট থাকার কথা না?কিন্তু কি এক গাম্ভীর্যে পূর্ণ ওই মনোরম মুখশ্রী!

মৃত্তিকা মিসেস দানিশকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টি নত করে।তারপর গোপন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“যে সম্পর্কের শুরুটা ঘৃণা দিয়ে হয় তা স্বাভাবিক করা মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পরে আন্টি।কিংবা মস্তিষ্ক এই সাজেশন দেয় যে এ সম্পর্ক সুন্দর করে তুলতে চাওয়াও পাপ!”

মিসেস দানিশ মৃত্তিকার কথা শুনে কি বলবেন ভেবে পান না।মৃত্তিকার কাঁধে নরম স্পর্শ দিয়ে রুম থেকে প্রস্থান করেন তিনি।
.
ঘড়ির কাঁটা এগারো ছুঁতেই রুমে প্রবেশ করে দর্শন।দরজা আটকে প্রথমেই চোখ বুলায় সমগ্র রুমে।তারপর রুমের কোথাও মৃত্তিকাকে না পেয়ে সোজা বারান্দায় আসে সে।মিসেস দানিশ জায়গাটা আলোকিত করে দিয়ে গেলেও সেটা আবার অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে মৃত্তিকা।যার জীবনের সমস্ত দ্যুতি লীন হয়ে গেছে তার কি আলো সহ্য হয়?দর্শনকে আসতে দেখেই সে স্থান ত্যাগ করে মৃত্তিকা।রুমে পা রাখতেই আকাশি রঙে আবৃত তার অপরুপ কায়া দৃশ্যমান হয় দর্শনের নিকট।

আচমকা দর্শন এক কান্ড করে বসে।মৃত্তিকার বাহু চেপে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। আকস্মাৎ অপ্রিয় কাজে আঁটকে মৃত্তিকা।আকুল চোখে তাকায় দর্শনের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে।দর্শনের পেশিবহুল বাহু চেপে রেখেছে মৃত্তিকাকে।মৃত্তিকার এলোচুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে দর্শন মুগ্ধস্বরে বলে উঠে,

“অজান্তেই আমার প্রিয় রঙ পরিধান করে আমাকে অভিভূত করেছো মিসেস দর্শন।দ্যাটস মিনস?এভাবেই তোমার বলা প্রতিটি ঘৃণ্য বাক্য তুমি মিথ্যা প্রমাণ করবে শুধুমাত্র আমাকে কখনো ছাড়বে না এটা ছাড়া।”

চলবে….?