ফরগেট মি নট পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
20

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
#অন্তিম_পর্ব(প্রথমাংশ)
“তুমি আমার সাথে মজা করছো দর্শন?”

দর্শনের মুখভঙ্গিতে এবার বদল আসে।সে মৃত্তিকার দিকে আরো গম্ভীর নজরে তাকায়।গম্ভীর আওয়াজে উত্তর দেয়,

“নাহ!”

মৃত্তিকা ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই দর্শন বলে উঠে,

“আমি ভেবেছিলাম তুমি এখানে আসবে আর আমাকে দেখা মাত্র হুট করে হাগ করবে।বাট না!তুমি এসেই এটা ওটা জিজ্ঞেস করা শুরু করেছো।”

মৃত্তিকা চোখ বুঁজে একটু দম ফেলে।দর্শন গাঢ় চোখে তাকিয়ে দেখে অর্ধাঙ্গিনীকে।মৃত্তিকা চোখ খুললেও সে সেভাবেই তাকিয়ে রয়।দর্শনকে এভাবে তাকাতে দেখে শুকনো ঢোক গিলে মৃত্তিকা।লোকটার এরুপ দৃষ্টি সর্বঘাতী!মৃত্তিকা অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“তুমি শুধুমাত্র আমার জন্য এই খুনের ভিডিও প্রচার করেছো সকলের সামনে?”

মৃত্তিকার গলার আওয়াজ খানিক কেঁপে কেঁপে উঠে।উত্তর জানতে সে বেশ আগ্রহী।দর্শন ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবে।তারপর বলে,

“আসলে আপনার বার্থডে গিফট কি দেওয়া যাই তা ভেবে পাচ্ছিলাম না।আফতার অল ইউ আর অনলি ওয়ান ওয়াইফ অফ মাইন!”

“তুমি জানো আমি তোমার বাবাকে ছারবো না।তারপরেও?নিজের বাবাকে জেলে যেতে দেখা কিন্তু সহজ ব্যাপার না।”

মৃত্তিকার কন্ঠে বিস্ময় মিশে।দর্শন কিছু বলবে তার আগেই ড্রয়িংরুম থেকে শোরগোল ভেসে আসে।মৃত্তিকার দিকে একপল তাকিয়ে দর্শন রুম থেকে বের হয়।মৃত্তিকাও পিছু পিছু আসে।সিঁড়ি অবধি আসতেই দেখে দীপন পুলিশের সাথে ঝগড়া করছে।দীপন উচ্চস্বরে কথা বলছে অফিসারের সাথে।মিসেস দানিশ এখনো রান্নাঘরে।হয়ত স্বামীর এরুপ কর্মের দরুন তিনি তার মুখ দেখতেও প্রস্তুত নন!
হঠাৎ দীপনের নজর এসে দর্শনের উপর পরে।দর্শন পকেটে একহাত পুরে দাড়িয়ে ছিল।দীপন তার দিকে তেড়ে এসে কলার চেপে ধরে।একপা পিছিয়ে আসে দর্শন।শান্ত চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে।দীপন তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলে উঠে,

“এইসব তোর জন্য হচ্ছে!বেইমান!একটা মেয়ের জন্য তুই ফ্যামিলির রিপুটেশন খারাও করতেও ভাবলি না।”

দর্শন দীপনের হাতে শক্ত করে ধরে।তারপর একটা ধাক্কা দিয়ে দীপনকে নিজের থেকে সরায়।শার্টের বোতাম ছেঁড়ার শব্দটা দীপনের পিছিয়ে পরার শব্দের চেয়ে বড্ড ক্ষীণ রয়।দর্শন বলে উঠে,

“মৃত্তিকা আমার ওয়াইফ।তোদের মতো আমার কাছে তার নিকনেম একটা মেয়ে নয়!”

একটু থামে দর্শন।পুলিশ অফিসার দানিশ মির্জাকে এরেস্ট করতে বড্ড দ্বিধাগ্রস্ত তা বোঝাই যাচ্ছে।এত বড় বিজনেসম্যান!অবশ্যই বড় বড় লোকের সাথে লেনদেন আছে।যদি তাকে এরেস্ট করার জন্য পরে নিজের চাকরি খুইয়ে ফেলতে হয়!
দর্শন পুলিশ অফিসারের ভীত চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“আমি স্বজ্ঞানে মিস্টার দানিশ মির্জার কুকীর্তির প্রমাণ ফাঁস করেছি!কারো প্ররোচনায় নয়।মধ্যবিত্তদের তে প্রমাণ ছাড়াই এরেস্ট করা হয় তবে বিজনেসম্যান দানিশ মির্জার জন্য আপনার চোখে দ্বিধা কিসের অফিসার?নাকি আপনাদের এটা পড়ানো হয়েছে ধনীদের ক্ষেত্রে আইন আলাদা?”

দর্শনের কথায় রাগে ফেটে পরেন দানিশ মির্জা।নিজের ছেলের মুখে নিজের বিরুদ্ধে কখনো কথা শুনবে এটা ভাবেননি তিনি।দর্শনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মৃত্তিকার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তিনি।মনে মনে জপেন এই মেয়েকে তিনি কখনোই ছাড়বে না।আচমকা হাতে হাতকড়া পরতেই ধ্যানচূত হয় তার।শেষবারের মতো মৃত্তিকার দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষন করেন দানিশ মির্জা।মৃত্তিকা ওষ্ঠপটে বিচিত্র এক মিটমিটে হাসি নিয়ে তাকিয়ে যা দানিশ মির্জার রাগ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।তিনি মনে মনে মৃত্তিকার চুড়ান্ত পরিনাম ভাবতে ভাবতে হাতকড়া পরে পুলিশের সাথে সদর দরজা পার করেন।গেইটের বাইরে আসতেি সাংবাদিকের ভীড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পরেন তিনি।কিন্তু পুলিশ কোন জবাবদিহির সুযোগ না দিয়ে দ্রুত গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় উনাকে।
——–
দুদিন পরে আদালতে বিচার বসে।ইতিমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি চালু করলে দানিশ মির্জার পতিপক্ষের উকিল বলে উঠে,

“ইউর ওনার আমার মক্কেলের দাবি ভিডিওটি ফেক।এটা উনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বানানো হয়েছে।”

তখনই উঠে দাড়ায় দানিশ মির্জার বিরুদ্ধে থাকা উকিল।তিনি বলে উঠেন,

“আপনি অব্যশই বানানো কথা বলছেন।এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এটা কোন গোপন ক্যামেরায় বন্ধি হওয়া মুহুর্ত।আর সবচেয়ে বড় কথা।মিস্টার দানিশ মির্জার নিজের ছেলে মিস্টার দর্শন মির্জা স্বয়ং এই ভিডিও প্রচারের কাজ করেছেন।এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার জন্য আমি উনার ছেলেকে কাঠগড়ায় আসার অনুমতি চাইছি।”

“পারমিশন গ্রানটেড!”

আদালতে উপস্থিত ছিলো দর্শন ও মৃত্তিকা।দীপন আসেনি কারণ সে স্বয়ং সে স্থানে উপস্থিত ছিল।যদি এই ভিডিও সত্য প্রমানিত হয় তবে তার শাস্তিও অনিবার্য।
দর্শন কাঠগড়ায় আসলে মৃত্তিকা তার দিকে তাকিয়ে রয়।মানুষটা কেন নিজের বাবার বিরুদ্ধে গেল সেটা তার অজানা।দানিশ মির্জা ও দীপন মির্জা ভাষ্যমতে তার জন্য?

উকিল সাহেব সাদা শার্ট পরিহিত সুদর্শন দর্শনের দিকে একপল তাকায়।দর্শনের মুখশ্রী শান্ত ও গম্ভীর।উকিল সাহেব এবার প্রশ্ন করেন,

“আপনি কেন করলেন এমনটা?নিজের বাবা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেন গেলেন আপনি?”

দর্শন চোখ ঘুরিয়ে বসে থাকা মৃত্তিকার দিকে চায়।কমলা রঙে আবৃত রমনী টান টান হয়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে।আলগোছে হাসে দর্শন গম্ভীর স্বরে বলে,

“আমি অন্যায়কে সমর্থন করতে চাইনি।তাই এটা প্রকাশ করেছি।কোনো ব্যাক্তিকৃত করা অপরাধ সহ্য করার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।সে যেই হোক না কেন!তাই!আর যদি প্রশ্ন উঠে এই ভিডিও ফেক তবে বলবো মিস্টার দানিশ মির্জা মিথ্যে বলছেন।বাকিটা যাচাই করার অধিকার আপনাদের ইউর ওনার।”

দর্শনের বয়ানের পর কিছুক্ষণ চুপ থাকে আদালত।দর্শন একটা পেনড্রাইভ বের করে জজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

” ইউর অনার এটা আসল ভিডিও।দয়া করে এটি যাচাই করার অনুরোধ রইলো।”

কিছুমুহুর্ত ব্যয় হওয়ার পর জজ সাহেব তার রায় ঘোষণা করেন।

“মিস্টার দর্শন পেশকৃত ভিডিওটি সত্য হওয়ায় ধারা ৩০২ মোতাবেক মিস্টার দানিশ মির্জাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও তার ছেলে দীপনকে সেই স্থানে উপস্থিত থেকে খুনে সহযোগিতা করার জন্য দ্রুত গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া হলো।দ্যা কেস ইস ক্লোজড!”

রায় শোনার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসে মৃত্তিকা।বাইরে বেরিয়ে মুক্তবাতাসে জোরে শ্বাস নেয় সে।পেছনে তাকিয়ে দেখে দর্শন আসছে।আদালত থেকে আগে আগে বেরিয়েছিল মৃত্তিকা।মৃত্তিকা সরু চোখে দর্শনের দিকে।খানিক অবাক মাখা কন্ঠে বলে উঠে,

“তুমি এত স্বাভাবিক কি করে?”

“অস্বাভাবিক থাকার কথা ছিল?”

দর্শনের পাল্টা প্রশ্নে একটু চুপ করে রয় মৃত্তিকা। তারপর বলে,

“হয়ত!”

দর্শন কিছু না বলে সামনে এগোয়।মৃত্তিকা পেছন পেছন পা চালায়।
তখন দানিশ মির্জাকে আদালত থেকে বের করে আনা হয়েছে।দানিশ মির্জার সামনে তাকাতেই মৃত্তিকা আর দর্শনকে চোখে পরে।ওমনি সমগ্র দেহে বহ্নিশিখা জ্বলে উঠে তার।জলদি তাকায় তার পাশে থাকা পুলিশের দিকে।তারা তখন নিজেদের গল্পে মশগুল।সন্তপর্ণে একজনের কোমড়ে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করে নেয় সে।যদি সে জেলে যায় তবে এই সর্বনাশীকে ধ্বংস করেই মরবে।
সহসা পেছন ফিরে মৃত্তিকার দিকে চায় দর্শন।একটু চোখ তুলতেই দ্রুত মৃত্তিকাকে ধাক্কা মেরে দূরে ছুঁড়ে সে।পরপরই গুলির শব্দ কানে আসে।
আচমকা দর্শনের দেওয়া ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে দূরে পরে যায় মৃত্তিকা।তারপরই বিকট গুলির আওয়াজে অন্তর আত্না কেঁপে উঠে তার।দ্রুত পরিস্থিতি বুঝতে দর্শনের পানে তাকাতেই চোখ বিকট আকার ধারণ করে তার।সেই সাথে হন্তভম্ব হয়ে পরেন দানিশ মির্জা।মৃত্তিকাকে গুলি করতে গিয়ে যে দর্শনকে গুলি করে ফেলবেন এটা ঘুনাক্ষরের ভাবেননি তিনি।
পরিস্থিতি সকলের বুঝে আসতেই দানিশ মির্জাকে টেনে গাড়িতে তুলা হয়।তিনি শুধু অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছুলেন যতক্ষণ অবধি দেখা যায়।
মৃত্তিকা দৌড়ে এসে দর্শনের সামনে দাড়ায়।চোখমুখ আতংকে বেহাল!দর্শন দপ করে হাটু মুরে বসে পরে।সাথে সাথো তাকে ধরে ফেলে মৃত্তিকা।
তার ওষ্ঠদ্বয় বড্ড কাঁপছে।চোখে জমেছে অশ্রুর পাথার।মৃত্তিকার চোখের জল গালে এসে পরতেই কাঁপা হাতে সেটা মুছে দেয় দর্শন।তার সাদা শার্টে তখন রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে।মৃত্তিকার একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বলিষ্ঠ মানুষটার ভর ধরে রাখার।মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে দর্শনের নাম উচ্চারণ করতেই দর্শন ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ধরে রেখে বলে উঠে,

“আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইউর টিয়ারস!”

চলবে….

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
#অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)
হাসপাতালের বেঞ্চে অস্থির চিত্তে বসে আছে মৃত্তিকা।পরনের কমলা শাড়িটায় লাল রক্ত লেগে অদ্ভুত ডিজাইন তৈরি করেছে।দেখতে কিছুটা বিদঘুটেও লাগছে।তবে খুটখুটে ধনী পরিবারের মেয়েটির মনোযোগ নেই তাতে।তার দৃষ্টি হাসপাতালের ফ্লোরে নিমজ্জিত।চোখের পলক ফেলছে বেশ কিছুক্ষণ পরপর।বক্ষস্থলে শঙ্কারা নিপীড়ন চালাচ্ছে অনবরত।হঠাৎ চোখের সামনে শাড়ি পরিহিতা একজোড়া পা দৃশ্যমান হতেই ধীরে ধীরে মুখশ্রী তুলে তাকায় সে।মিসেস দানিশকে দেখে ফের চোখ নামিয়ে নেয় সে।ভদ্রমহিলা কেঁদে কেটে চেহারা লাল টুকটুকে করে ফেলেছেন।তবে মৃত্তিকা শক্ত হয়ে বসে।চোখে অশ্রুরা টলমল করলেও নিমিষেই শুকিয়ে যাচ্ছে।অশ্রুদের সাথে আড়ি করেছে ইরফান কন্যা।হাসপাতালের এই জায়গায় এসে পুরোনো স্মৃতি হানা দিচ্ছে তার বুকে।হৃদপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন কাঁটার খোঁচার মতো সূচালো,বিষাক্ত ব্যথার মতো লাগছে তার কাছে।কান্না না আঁটকে রাখায় গলাটা বেশ জ্বলছে মৃত্তিকার।মৃত্তিকা ওষ্ঠদ্বয় একটু ফাঁকা করে তপ্ত শ্বাস ফেলে।বুকের ভেতরের জ্বালা বাড়ছে ক্রমশ যা সহ্য করার মৃত্তিকার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

মিসেস দানিশ দর্শনের খোঁজ করলে মৃত্তিকা টের পাই তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।কান্নাটা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে!গলার জ্বলন ক্রমশ বাড়ছে।একটু সময় নিয়ে মাথা না তুলেই মৃত্তিকা আস্তে করে বলে,

“আইসিউটে!”

মৃত্তিকার ভেজা কন্ঠ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।মিসেস দানিশ কাঁদতে কাঁদতে আইসিউতে উঁকি দেন।ভেতরে অপারেশন চলছে।রাফিন হন্তদন্ত হয়ে আসতেই নিথর হয়প বসে থাকা মৃত্তিকা নজরে আসে তার।মেয়েটা বাবার মৃত্যুর দিনও এভাবেই হাসপাতালে ছিল।দ্রুত চোখ সরায় রাফিন।হাসপাতালের বিল পরিশোধ থেকে সবটা সেই সামলাচ্ছে।রাফিনকে দেখে কান্নায় ভেঙে পরেন মিসেস দানিশ।ওনার স্বামী ও এক সন্তান পাপকার্যে কারাস্থ!আর ছোট ছেলে নিজের বাপের হাতের গুলি খেয়ে মৃত্যু শয্যায়।
মিসেস দানিশের কান্নার স্বর কানে আসতেই হঠাৎ বসা থেকে উঠে পরে মৃত্তিকা।তাকে এভাবে উঠতে দেখে খানিক অবাক হয় রাফিন।মৃত্তিকা কাউকে কিছু না বলে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটে।

এতক্ষণ চুপ থাকলেও বদ্ধ জায়গায় এসে মৃত্তিকা নিজের ভারসাম্য হারায়।শত চেষ্টা করেও কান্নারা বাঁধা মানে না।ছিটকে বেরিয়ে আসে নিজেদের প্রকটতা প্রকাশে।ওয়াশরুমের দর্পনে প্রতিফলিত হয় ডুকরে কাঁদতে থাকা এক রমনীর প্রতিচ্ছবি।

মিনিট দশেক বাদে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় মৃত্তিকা।বাইরে তখন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা গভীর রাত।আইসিউ এর সামনে আসতেই ডাক্তার এসে জানায় পেশেন্টের জ্ঞান এসেছে। সে কথা বলতে চাইছে।

প্রথমে আইসিউতে প্রবেশ করে মিসেস দানিশ।ছেলেকে হসপিটালের বেডে শষ্যাশয়ী দেখে কোমল মাতৃহৃদয় কেঁদে উঠে।দর্শনের হাতখানা চোখের উপর ঠেকিয়ে অজোরে কাঁদেন মিসেস দানিশ।দর্শন অস্ফুটস্বরে কিছু বলে উঠে,

“মৃত্তি..কা?”

সেই মুহুর্তে আস্তে আস্তে মাথা নত করে ভেতরে প্রবেশ করে মৃত্তিকা।লাল টকটকে হয়ে থাকা চোখ তুলে তাকিয়ে শষ্যাশয়ী দর্শনের পানে একবার তাকিয়ে ফের চোখ নামিয়ে ফেলে মৃত্তিকা।দাঁতে দাঁত চেপে ধরে শক্ত করে।ডাক্তার বলেছে পেশেন্ট এখনো আউট অফ ডেঞ্জার নয়।দর্শনের বুকের ঠিক বা পাশে গুলিটা লেগেছে।
মিসেস দানিশের কান্নার আওয়াজ আরো বাড়লে ডাক্তার বলেন,

“প্লিজ পেশেন্টের সামনে কাঁদবেন না।এতে উনার সমস্যা হবে।”

শেষে মিসেস দানিশ দর্শন হাতের পিঠে পরম মমতায় অধরের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে কেবিন থেকে বের হন।সাথে সাথে বের হয় রাফিনও।সকলে চলে গেলে দর্শন মৃত্তিকার দিকে তাকায়।রমনীর শাড়িতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ,দৃষ্টি নত।দর্শন সুস্থ হলে বোধহয় তাচ্ছিল্য করে বলতো,

“এখন কি তোমাকে কাছে এসে বসার জন্য নিমন্ত্রণ জানাতে হবে?”

কিন্তু না দর্শন এই কথাখান বলতে পারলো না।তবে মৃত্তিকা যেন অদৃশ্য এক শক্তিতে পড়ে নিন দর্শনের মনের কথা।ধীরে ধীরে পাশে এসে বসলো সে।একটু সময় নিয়ে দর্শনের দিকে না তাকিয়ে আধো আধো স্বরে বলে উঠলো,

“সরি!আ’ম সরি দর্শন!”

দর্শন তখন একদৃষ্টে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে।মৃত্তিকার চোখ থেকে অনবরত জল পরছে।দর্শন পরম আগ্রহ নিয়ে নিজের জন্য মৃত্তিকার অশ্রুপাত দেখছে।একসময় মুচকি হাসে দর্শন।মৃত্তিকা ভেজা চোখ নিয়ে তাকায়।কিন্তু আজ দর্শনের প্রেয়সীর গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুকণা মুছে দেওয়ার ক্ষমতা কিংবা চেষ্টা কোনটাই নেই।

“আমার সাথে কেন এমনটা হয় দর্শন?কেন সবসময় এমনটা হয়?যাদেরকে আমি ভালোবাসি,যারা আমার প্রিয়,যাদের আমি হৃদয়ে স্থান দেই তারা কেন সবসময় আমার থেকে দূরে চলে যেতে চায়?”

“আমায় ভালোবাসো তুমি?”

দর্শন চট করে মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক খুলে প্রশ্ন করে মৃত্তিকাকে।তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়!যেন এই একটি কথা শোনার জন্য বহুকাল অপেক্ষা করে আছে সে।মৃত্তিকা দর্শনের চোখে চোখ রাখে।বলে,

” তোমাকে ভুল বোঝার জন্য দূঃখিত দর্শন।”

“তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি কিন্তু।”

মাথা নিচু করে শব্দ করে কেঁদে উঠে মৃত্তিকা।মাথা উপর নিচ করে উত্তর জানায় আমার প্রশ্নের।একফোঁটা অশ্রু বোধহয় দর্শনের আঁখি থেকেও গড়ায়।হঠাৎ মৃত্তিকা কোমল হাতের দিকে হাত বাড়ায় দর্শন।সেই হাতদুটোকে শক্ত করে নিজের হাতের সাথে চেপে ধরে বলে উঠে,

“মিসেস মৃত্তিকা দর্শন মির্জা সারাজীবন তোমার ঢাল হবে বলে তোমার সাথে নিজের নাম জুড়েছিলাম।বুকে ব্যথা লুকিয়ে শক্ত কন্ঠে ঝগড়া করা মেয়েটার একমাত্র দূর্বলতার কারণ হবো ভেবে তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী করেছিলাম।সেই অনাথ মেয়েটাকে আমি বোধহয় আরেকবার নিঃস্ব করে দিয়ে যাচ্ছি!তাকে আরেকবার একা করে দিয়ে যাওয়ার জন্য ফরগিভ মি প্লিজ।আর আমাকে যে ভালোবাসে সেই মৃত্তিকা মেহেরজানকে আদেশ ফরগেট মি নট।

মৃত্তিকা প্রাণহীন চোখে দর্শনের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায়।হঠাৎ খেয়াল করে মানুষটার চোখে পলক পরছে না।দর্শনের মুঠোয় থাকা হাতটা ছাড়িয়ে চিৎকার করে ডাক্তারকে ডেকে উঠে সে।হৃদপিণ্ডের অবস্থা ততক্ষণে বেহাল।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।ডাক্তাররা এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দর্শনের হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরে মৃত্তিকা।
——————-
গ্রীষ্মের এক উত্তপ্ত দুপুর।সমুদ্রের পাড়ে পানিতে দাদির সাথে খেলছে তিন বছরের।অদুরেই শাড়ি পরিহিতা এক নারী বালুর উপর বসে তাদের দেখে চলছে।লাল টকটকে শাড়ি পরিহিতা নারীটির অধরে সুক্ষ হাসি ফুটলেও তা নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ ছেলেটা খেলা ফেলে এগিয়ে আসে নারীটির দিকে।অমনি চোখমুখ গম্ভীর করে ফেলে নারীটি।ছেলেটা এসে আধো আধো স্বরে বলে উঠে,

” মামাহ!তলো না আমি তোমাল সাথে খেলবো।”

সাথে সাথে শক্ত কন্ঠে রমনীটি বলে উঠে।

“তোমার দাদিজান খেলছে তো তোমার সাথে।”

“নাহ আমি তোমাল সাথে খেলবো।”

“আমি খেলবো না তোমার সাথে।”

না বোধক কথা শুনে ঠোঁট উল্টে তাকায় ছেলেটি।তখনই মিসেস দানিশ তাদের নিকটে আসতে আসতে বলে,

“মৃত্তিকা ছেলেটা খেলতে চাইছে তোমার সাথে।একটু খেললে কি হয়?”

সাথে সাথে তাল মিলায় ছোট সমুদ্র।আধো কন্ঠে দাদিকে অভিযোগ করে,

“দেকো না মিত্তিজান মাম্মাম আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”

কথার পিঠে মৃত্তিকার জবাব আসে,

“ইয়াহ আই হেইট ইউ।”

সাথে সাথে ভেভে করে কেঁদে দেয় সমুদ্র।মিসেস দানিশ এসে সাথে সাথে কোলে নেয় নাতিকে।উন্মুক্ত ধবধবে ফর্সা পিঠে হালকা চাপড় মারতে মারতে বোঝাতে থাকে প্রিয় নাতিকে।মৃত্তিকা দু হাঁটুতে হাত রেখে অপলক চেয়ে থাকে ছেলের কান্নার দিকে।হুবুহু বাবার মতো বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকে আঁখি ভরে।

বছর তিনেক আগে দর্শনের পরলোক গমনের পর মৃত্তিকার শারীরিক অবস্থার বেহাল হাল দেখে ডাক্তারের কাছে গেলে জানা যায় মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট।প্রায় মরে যাওয়া মেয়েটা বাঁচার একটা অজুহাত পেয়ে গিয়েছিল সেদিন।দর্শনের পর কেউ তো থাকলো তার জীবনে।সেদিন ঠিৎকার করে মৃত্তিকা শুধু এটাই বলেছিল,

“তুমি আমায় নিঃস্ব করে যাওনি দর্শন।আমায় নিঃস্ব করে যাওনি।”

মিসেস দানিশ সমুদ্রর কান্না থামাতে থামাতে মৃত্তিকার দিকে চায়।সমুদ্রের জন্মের পরপর ছেলেকে খুব ভালোবাসলেও আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে মৃত্তিকা।কি এক চিন্তায় মগ্ন থাকে সে।ছেলেকে মিসেস দানিশের কাছে রেখে যায়।ধীরে ধীরে নাতির সমস্ত কাজই করতে মিসেস দানিশকে।মৃত্তিকা বিজনেসে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ দেয়।ছেলের সাথে কি এক দ্বন্দ্ব যেন তার।

সমুদ্র কান্না থামালে মিসেস দানিশ তাকে নিয়ে আবার সমুদ্রের কাছে নিয়ে যান।সমুদ্রের জল ছিটাতে ছিটাতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সমুদ্র।সেই হাসির স্বর এসে কানে বাজে মৃত্তিকার।

বিকেলের দিকে ছেলের বায়না মেটাতে আবার সমুদ্রের পাড়ে বেড়াতে এসেছে মৃত্তিকা।কালকেই ঢাকা ব্যাক করবে তারা।সমুদ্রের পাড়ে আসতেই সমুদ্র বায়না জুড়ে দেয় সে খালি পায়ে মার মতো এখানে হাঁটবে।
ছেলেকে গোসল করিয়ে সুন্দর করে ফিটফাট করে এনেছে মৃত্তিকা।এখন সে মৃত্তিকার কোলে।মৃত্তিকা খালি পায়ে হাঁটছে বালুচরে।ছেলের বায়না দেখে মৃত্তিকা শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

“এখন একদম হাঁটাহাটি নয় সমুদ্র।দেখো কত সুন্দর করে জুতো পরিয়ে দিয়েছে তোমার মিষ্টিজান।মাম্মাহ হাঁটছে তো!আর তুমি তো দুপুরে কত দৌড়েছো বালুতে।এখন লক্ষী বাচ্চার মতো কোলে থাকো।”

মায়ের বকা শুনে গাল ফুলিয়ে সমুদ্র বলে উঠে,

“আমাকে একটুও লাভ কলো না তুমি মাম্মাম।”

কথার উত্তরে কিছু বলে না মৃত্তিকা।সমুদ্র চট করে প্রশ্ন করে,

“আচ্ছা তুমি তাহলে কাকে ভালোবাসো বলোতো?”

মৃত্তিকা হাঁটতে হাঁটতে ছেলের পানে চায় একনজর।তারপর বলে,

“আমি যাদের ভালোবাসি তারা ঐ আসমানের তারা হয়ে গেছে।”

মাম্মাহ তাকে ভালো না বেসে অন্যদের ভালোবাসে ভেবে গাল ফুলিয়ে কাঁধে মাথা ঠেকায় সমুদ্র।মৃত্তিকা পরম যত্নে হাত বোলায় ছেলের পিঠে।তার বাচ্চাটা এখনো বুঝতেই সক্ষম নয় শুধু মুখের বুলিতে ভালেবাসা থাকে না।এইযে তার মাম্মাহ তার পিঠে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয়,ঘুমানোর পর কপালে চুমু খায় এটাই তো ভালোবাসা।

মৃত্তিকা চলতে চলতে অনেকদূর আসে।দূরে তংন সূর্য অস্ত যাওয়ার পালা।হলুদ সূর্যটা কমলা রঙ ধারণ করে প্রতিদিনের ন্যায় অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।সমুদ্রের বাতাসের তোড়ে মৃত্তিকার পরনের হলুদ শাড়িটার আঁচলটা উড়ছে।ছেলেকে ভালোভাবে কোলে নেয় মৃত্তিকা।ফের চলতে চলতে বলে,

“আমার কোন ইচ্ছে ছিল না তোমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার।কিন্তু কি করবো বলো?আমাকে যে তুমি পুরোপুরি নিঃস্ব করে যাওনি।একটা নিষ্পাপ প্রাণ উপহার দিয়ে গেছো।জানো আজও আমি তোমার অপছন্দের রঙের শাড়িটা পরি।এইযে এখনো আমি হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে আছি।শুধু তুমি নেই যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলবে,এটা কখনোই আমার পছন্দের রঙ হতো না যদি না তুমি পরতে।আরেকটা কথা তোমাকে আমি একদম মনে রাখতে চাইনি।কিন্তু কি করবো?তোমার মা সারাদিনে কমপক্ষে তিন চারবার বলে ফেলে সমুদ্র একদম নাকি তোমার মতো হয়েছে।ছোট বেলায় নাকি তুমি এমনই ছিলে!এমনই নাক,এমনই চোখ,ঠোঁট।তোমার ছেলেটা না বড্ড ছিঁচকাদুনে।মা ভালো বাসে না বললেই কেঁদে ফেলে।ও তো জানে না ওর মায়ের ভালোবাসা বিষের ন্যায়,যা পান করলে মৃত্যু নিশ্চিত!”

কথা বলতে বলতে মৃত্তিকার গলা ভিজে আসে।ভেজা একটা ঢোক গিলে মৃত্তিকা আবার বলে উঠে,

“আমার না তোমার ছেলেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।ওর নরম নরম গালে আদর দিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ওকে আমি খুব ভালোবাসি।কিন্তু পারিনা।আমি যে সর্বগ্রাসী!আমার ভালোবাসা বিষ।যাদের ভালোবেসেছি তারা ক্ষনিকেরই হারিয়ে গেছে।ওই আকাশের মালিককে বলো আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি না।একটুও না!ওকে যেন আমার থেকে ছিনিয়ে না নেয়।

কথা বলতে বলতে মৃত্তিকার কন্ঠ রোধ হয়ে আসে।আর কিছু না বলে ছেলের গালে টুপ করে চুমু খায় সে।ততক্ষণে সমুদ্র ঘুমিয়ে কাতর।মায়ের মুক্তোর মতো অশ্রু ওর কপোল ছুঁয়ে শুকিয়ে যায়।বাতাসে একটা বিষন্নতা ছুঁয়ে যায় তাদের।চারপাশ পুরোপুরি অন্ধকার হতেই মৃত্তিকা হোটেলের দিকে বাড়ায়।যেতে যেতে অস্ফুটেস্বরে বলে উঠে,

“ওই মহান সৃষ্টিকর্তাকে বলে দিও আমি সমুদ্রকে ভালোবাসি না!”

সমাপ্ত।